নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
136

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৪
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

স্বজনদের বাড়ি থেকে প্রীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখতে আসার দিন ঠিক হলো দুদিন বাদে। বড়রা মোট আটজন আসবেন। স্বজনের মা-বাবা, দুই চাচি, এক চাচা, স্বজন এবং তার খালা, মামা। সঙ্গে দু চারজন বাচ্চাকাচ্চাও থাকবে।
ঢাকা শহরে প্রজ্ঞাদের আত্মীয় বলতে আছেন ই গুটিকয়েক মানুষ। তার খালা-খালু, খালাতো ভাইবোন এরাই এসেছে তাই। প্রজ্ঞার কত দায়িত্ব! বোনের বিয়ে বলে কথা!

এইযে সকাল থেকে ছোটাছুটি করছে, কী লাগবে না লাগবে দেখে নিচ্ছে। যদিও কাজ করতে হচ্ছেনা। উৎফুল্ল মনে তার হুট করেই বিষাদেরা ভর করলো। কত আনন্দ, কত উৎসব! তার বিয়ে সাধারণভাবে হলে নিশ্চই এমনই আনন্দ থাকতো সবার মাঝে? সাজিয়ে, শাড়ি পড়িয়ে পাত্রপক্ষের সামনে বসানো হতো। এনজাম আড়চোখে তাকাতো একবার, সে নিশ্চিত লাজে রাঙা হয়ে চোখ নামিয়ে রাখতো।
প্রজ্ঞা ভাবে, আর পাঁচটা মেয়ের মতো সে-ও তো কবুল বলার মুহূর্তে মা-বাবার দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকাতে পারতো। এক নতুন ভবিষ্যতের কথা ভেবে জড়তায় তার কণ্ঠ আটকে আসতো হয়তো। অথচ তেমনটা হয়নি। সে কবুল বলেছিলো একেবারে স্পষ্টভাবে, এনজামের ব্যাকুল চোখের দিকে তাকিয়ে। সেখানে কোনো জড়তা ছিলোনা। এক পুরুষের পাগলামো নির্দিধায় মেনে নেওয়ায় কোনোপ্রকার ভয় ছিলোই না মাঝে!
আচ্ছা, তারও তো একটা শশুর বাড়ি আছে। শশুর-শাশুড়ি, ননদ,ননাশ সবই আছে। অথচ এ বাড়িতে অ্যানি,টুশি ব্যতীত আর কারো আগমন ঘটেনি। এমন উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরিই হয়নি। প্রণয়ের জন্মের পর ধীরেধীরে সবটা স্বাভাবিক হলেও দুই পরিবার কখনোই এক হয়নি। হয়তো হবেও না…

চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলার পূর্বেই জামায় টান পড়লো প্রজ্ঞার। চোখ নামিয়ে দেখলো প্রণয় তার জামা ধরে ঘুমে ঢুলছে। চোখে চশমা নেই, বড় হয়ে যাওয়া চুলগুলো একেবারেই এলোমেলো, ভ্রুজোড়া ঠিক বাবার মতো কুঁচকে রাখে। প্রজ্ঞা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো, মনে মনে মাশ-আল্লাহ বলে ঝুঁকে বসলো তার সামনে। দু গালে দুটো চুমু বসিয়ে কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলো,
– “ঘুম হয়েছে আমার বাবাটার? দেখি দেখি চোখটা দেখি। এমা… ঘুমোতে ঘুমোতে চোখ ফুলে গেছে একদম। চলো, ব্রাশ করবে।”

প্রণয় ঘুমঘুম চোখে প্রজ্ঞার হাতে তার ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লোকায়। ঘুম পুরো হয়নি তার এখনো। প্রজ্ঞা ফোনের লক খুলতে খুলতে বলে,
– “ফোন কেন? কেউ কল করেছিলো?”

– “হুম হুম।”

হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় প্রণয়। প্রজ্ঞা হোয়াটস অ্যাপ এ ঢুকতেই দুটো বাচ্চার ছবি দেখতে পেলো। পুতুলের মতো দেখতে দুটো মেয়ে, খিলখিলিয়ে হাসছে একজন, অন্যজন কোনো এক বিষয়ে খুশি হয়ে হাত তালি দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে এনজামই তুলেছে ছবিটা। প্রজ্ঞা অবাক হলো। এই ছেলে বাচ্চার ছবি পাঠাচ্ছে কেন? সে কী কিছু বুঝতে পেরেছে? নাকি সব জানাই ছিলো? ডিভোর্স যেন না দিতে পারে তাই… কিন্তু না। এনজামের ব্যবহারে তা একবারের জন্যও মনে হয়নি। তার মাথায় এত সুন্দর বুদ্ধি অবশ্যই নেই। তাহলে কী প্রীতি জানিয়ে দিলো? তারও কথা নয়। সে বেশ ভালোভাবে বলে দিয়েছে এখনই কাউকে কিছু না বলতে। প্রথমত সে একবার ডাক্তারের থেকে চেকাপ করিয়ে সিওর হয়ে নেবে, দ্বিতীয়ত এনজামকে ফোনে জানাবেনা।
প্রণয়ের আগমনের খবর তাদের দুজনের জন্যই মিশ্র অনুভূতি বয়ে এনেছিলো। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে চিন্তা। চিন্তাটা এনজামের ই বেশি ছিলো। তবুও প্রতিমুহূর্তে আশ্বাস দিয়ে গেছে। এবারে সময় বদলেছে। চিন্তাগুলো তাদের জীবন থেকে ছুটি নিয়ে দূরে কোথাও অবস্থান করছে হয়তো। একজন সাধারণ বাবা সন্তানের আসার খবর শুনে যতটা খুশি হয়, এনজামের ক্ষেত্রেও এবার তেমনটাই হবে নিশ্চই।

প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণয়কে কোলে তুলতে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রীতি এসে বড়বড় চোখে চেয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
– “পাগল তুই? কোলে তুলছিস কেন ওকে? নিজের অবস্থার কথা কী বেরিয়ে গেছে মাথা থেকে?”

প্রজ্ঞা বিস্ময় কণ্ঠে শুধায়,
– “তো কী হয়েছে? এইটুকু বাচ্চা আমার, কোলে নিতে পারবোনা? সর তো তুই… কিচ্ছু হবেনা।”

– “প্রজ্ঞা! বারণ করেছি আমি।”

কড়া গলায় বললো প্রীতি। প্রণয় গোলগোল চোখে দুজনের দিকে চেয়ে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরতেই প্রজ্ঞা নিচু স্বরে বলে,
– “দেখ, কিছুই হবেনা আমার। খামোখা এত চিন্তা করে আমাকে ভয় পাইয়ে দিসনা।”

প্রজ্ঞা যদিও শুনলো প্রীতির কথা। কোলে না তুলে প্রণয়কে হাত ধরেই উপরে নিয়ে গেলো। ঘরে আসতেই প্রণয় আবারো ঢুকে পড়লো কম্বলের ভিতর। প্রজ্ঞা পাশে বসে কল করলো এনজামকে। এনজাম ফোন তুলেই বলে,
– “থাকো কোথায়? এত সময় লাগে কল ব্যাক করতে? মনে হচ্ছে বাড়ির সব কাজ তুমি একাই করে উল্টে ফেলছো একদম।”

প্রজ্ঞা প্রণয়ের দিকে একবার চেয়ে বলে,
– “মেয়ের একমাত্র বোন আমি, দায়িত্ব আছে না?”

এনজাম তার কথায় পাত্তা না দিয়ে বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে শুধায়,
– “ছবিটা দেখেছো? কি কিউট না মেয়েদুটো? এমনভাবে তাকিয়ে হাসছিলো! কাজবাজ ছেড়ে ওদের ই দেখলাম কতক্ষন। পিচ্চি দুটো, অথচ সাজিয়েছে কী সুন্দর করে! এইজন্যই আমি মেয়ে চাইতাম।”

– “ছেলেকে অবজ্ঞা করছো নাকি?”

– “কক্ষনো না! কিন্তু মেয়ে জিনিসটাই আলাদা।”

প্রজ্ঞা মিটিমিটি হেসে ক্ষীণ স্বরে শুধায়,
– “দোয়া করো দোয়া।”

এনজাম ফিঁক করে হেসে বলে,
– “শুধু দোয়া দিয়ে কী কাজ হবে ম্যাডাম? আগে তো আমাকে দরকার… দেশে থাকলে ভাবা যেতো।”

ঠোঁট কামড়ে হাসলো প্রজ্ঞা। সে এখনো কিছু জানেনা এটা নিশ্চিত। এমনকি ধারণাও করেনি।
পরমুহূর্তেই রাগ হলো তার। কেন ধারণা করেনি? তার দিকে খেয়াল ই রাখেনা ছেলেটা। এইযে সেদিন বললো বমি পাচ্ছে, কোনো পাত্তাই দিলোনা!

খানিক বাদে এনজাম হুট করেই নরম কণ্ঠে বললো,
– “হয়েছে কী? মন খারাপ?”

হকচকিয়ে উঠলো প্রজ্ঞা। এই খুঁটিনাটি বিষয়ে মন খারাপের কথা সে জীবনে কখনো বলবেনা এনজামকে। ভেজা ঢোক গিলে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
– “অবশ্যই। তুমি আর ভালো থাকতে দিলে কই? তোমার মতো একটা বর থাকলে জীবনে আর মন ভালো থাকার কোনো কারণ কী অবশিষ্ট থাকে?”

এনজাম বিপরীতে আরো শান্ত গলায় ডাকে,
– “প্রজ্ঞা?”

লম্বা দম ফেলে বললো সে,
– “হুম?”

– “মন খারাপ?”

– “উঁহু…”

প্রজ্ঞা বুঝলো, এই মুহূর্তে এনজাম আর যেকোনো প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিতে পারবেনা। দ্বিধাবোধ করবে, সে কষ্ট পাবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠবে। তাই তড়িঘড়ি করে কাজের বাহানায় প্রণয়কে তুলে ফোনটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– “বাবার সাথে কথা বলো হ্যা, মাম্মা আসছি একটু পর।”

আর বসলোনা সে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তখনি। প্রণয় চোখদুটো ডলে শুরুতেই জিজ্ঞেস করলো,
– “বাবা, কখন আসবে?”

এনজাম মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
– “আসবো তো। এই তোমার জন্য আর কয়েকটা খেলনা কিনে তারপরই চলে আসবো।
আচ্ছা বাবা, একটা কাজ করো।”

– “কী কাজ?”

– “মাম্মার কাছে গিয়ে টপাটপ গালে দুটো পাপ্পি দিয়ে কানেকানে বলবে, ‘বাবা লাভস ইউ’। পারবে?”

প্রণয় উৎসাহের সহিত নেচে উঠলো,
– “হ্যা পারবো।”

– “কী বলবে?”

– “বলবো, বাবা লাভস প্রণয়।”

এনজাম কপালে আঙুল ঘষে হেসে বললো,
– “ইয়েস, বাবা লাভস ইউ সো মাচ। কিন্তু এখন গিয়ে বলবে, ‘বাবা লাভস ইউ মাম্মা’। ঠিক আছে?”

বলতে দেরি, প্রণয়ের ছুটতে দেরি নেই। সিড়ির পাশে গিয়েই প্রজ্ঞার ওড়না টেনে হাতের ইশারায় ঝুঁকতে বললো তাকে। প্রজ্ঞা জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে তার সমানে আসতেই বামগালে পরপর দুটো চুমু বসিয়ে কানেকানে বললো,
– “মাম্মা, বাবা লাভস ইউ।”

একনজর ছেলের দিকে তাকিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো প্রজ্ঞা। ফিঁক করে হেসে প্রণয়ের সারা মুখে অজস্র চুমু খেয়ে বললো,
– “অ্যান্ড মাম্মা লাভস প্রণয়, বাবার চেয়েও বেশি। ওকে?”

প্রণয় ‘ইয়েস’ বলেই লাফিয়ে উঠলো খুশিতে। ফোন কানে ধরে ভেঙচি কেটে তর্ক শুরু করলো রীতিমতো। গালে হাত ঠেকিয়ে বসতেই প্রজ্ঞা অনুভব করলো, তার মন খারাপের কারণগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। লোকে বলে নারী নাকি ভালোবাসায় আটকে যায়। এটাকে সত্য বলেই মেনে নেয় প্রজ্ঞা। চোখের সম্মুখে এবং ফোনের অপর প্রান্তে থাকা মানুষদুটোর ভালোবাসা তার কঠিন থেকে কঠিনতর দুঃখ ভুলিয়ে দিতে সক্ষম। সেখানে এই সামান্য বিষয়গুলোতো ফেলনা। এমন হাজারটা আক্ষেপ থাকলেও ভালোবাসার কাছে মিলিয়ে যাবে, প্রতিবারের ন্যায় অদৃশ্য হয়েই যাবে।

.
স্বজনদের বাড়ির লোকেরা এগারোটা নাগাদ এসে পৌঁছালো। সোফায় তাদের বসতে দিয়ে পাশে চেয়ার টেনে বসলেন পাপিয়া এবং তার বোন। প্রজ্ঞা হাসিমুখে তাদের সঙ্গে কথা বলার মাঝেই চা নাস্তা এনে দিলো। তবে প্রণয় নতুন মানুষ দেখে চুপসে গেলো একদম। মায়ের আঁচল ধরে তাকে লুকিয়ে থাকতে দেখেই স্বজনের চাচি জিজ্ঞেস করলেন,
– “বাচ্চাটা কে গো? এইযে বাবু, এদিকে এসো।”

পাপিয়া বেগম উত্তর দিলেন,
– “আমার নাতি। ওর ছেলে, প্রণয়।”

মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। হা করে চেয়ে বললেন,
– “তোমার ছেলে? মাশ আল্লাহ! দেখে বোঝাই যায়না। বয়স কত ওর?”

– “ছয় হবে সামনে।”
মৃদু হেসে বললো প্রজ্ঞা। মিনিট পাঁচেক বাদে প্রীতিকে নিয়ে আসার সময় প্রজ্ঞার কানে এলো কিছু কথা। সম্ভবত স্বজনের খালা এবং মামি ফিসফিসিয়ে বলছেন, “দুই বোন তো জমজ। একজনের এত বড় বাচ্চাও আছে, আর অন্য বোনের বিয়েই হয়নি?”

আর শোনা হলোনা প্রজ্ঞার। খুব একটা পাত্তাও দিলোনা। এই কথা সে আজ প্রথম শোনেনি। প্রতিবেশিদের মুখেও মাঝেসাঝেই এসব কথা শোনা যায়। একজনের বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে বাচ্চা বড় ও হয়ে গেল, অন্য মেয়ের বিয়ে হয়নি কেন?
কানাঘুষায় দোষটা গিয়ে পড়ে প্রীতির উপর। প্রথমবার এসব শুনে প্রজ্ঞার নিজেকে ছোট লাগছিলো খুব। তার জন্য বোনের উপর অপবাদ আসবে কেন? মানুষ এত বেশি ভাবতে যায় কেন?

যেহেতু প্রীতি,স্বজন আগে একে অপরের সঙ্গে কথা বলেছে, তাই আর নতুনকরে তাদের কথা বলাটা হয়ে উঠলোনা। দুই পরিবার আলোচনার পর স্বজনের মা একটা আঙটি পরিয়ে দিলেন প্রীতির আঙুলে। জানালেন তিনি যত দ্রুত সম্ভব শুভ কাজ সেরে ফেলতে চান। তবে পাপিয়া সাবলীল কণ্ঠে জানান, প্রীতির বাবা একেবারে দেশে না ফেরা অবধি মেয়েকে তিনি তুলে দেবেন না। আকদ চাইলে সম্পন্ন করে রাখা যায়। সেক্ষেত্রেও তার মেয়ের জামাই এর উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ন। এনজাম পরের সপ্তাহ নাগাদ ফিরে আসবে। আজ মঙ্গলবার। সেই হিসেবে পরের শুক্রবারে ঘরোয়াভাবে আকদ সম্পন্ন করার প্রস্তাব রাখেন তিনি। স্বজনের পরিবারের লোক কিছুক্ষন আলোচনার পর তার সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করেন। পরের শুক্রবারেই দিন ঠিক হলো।
প্রীতি আর স্বজন একনজর তাকালো একে অপরের দিকে। এর পূর্বেও স্বজন তাকিয়েছে বেশ কয়েকবার, প্রীতি তা খেয়াল করেনি। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বিষয়টাতে তার কখনোই অনাগ্রহ ছিলোনা। বরং দুই পরিবার, সঙ্গে পাত্রপাত্রীর সম্মতির বিয়েই তার নিকট অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে এসেছে। আশা রাখে সে, ভবিষ্যতেও পাবে।

– – –
– “অ্যানি দাঁড়ান!”
সিঁড়িগোড়ায় এসে থেমে যায় অ্যানি। ভ্যানিটি ব্যাগটা চেপে ধরে রাখার মাঝেই শাফায়াত এসে দাঁড়ায় তার সামনে। শিথিল মুখভঙ্গি তার, কেবল ঠোঁটে হাসি নেই। অ্যানির দিকে চেয়ে তবুও খানিকটা হেসে শুধায়,
– “আপনার দেখাই তো পাচ্ছিনা কদিন যাবৎ। কিছু কি হয়েছে?”

অ্যানি আমতাআমতা করে বলে,
– “আসলে… নিজের পড়ার চাপ ছিলো একটু। তাই কদিন পড়াতে আসা হয়নি।”

– “তাহলে আমি যে তিনদিনই দেখলাম আপনাকে?”

ধরা পড়ে যাওয়ায় আর চোখ তুলে তাকাতে পারলোনা অ্যানি। শাফায়াত খানিক বাদে শুধায়,
– “দেখা দিচ্ছেন না, কথাও বলছেন না… হুট করেই! আমার কোনো কথায় খারাপ লেগে থাকলে বলতে পারেন।”

অ্যানি দুদিকে মাথা নেড়ে বলে,
– “না না… খারাপ লাগার মতো কিছু আপনি বলেন ই নি।”

– “ভিতরে গিয়ে কথা বলি?”

অ্যানি মাথা নুইয়ে তার পিছুপিছু এলো চেম্বারে। তবে চেয়ারব বসলোনা। শাফায়াত কিছুটা গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো,
– “কী হয়েছে আপনার?”

অ্যানি আরো একবার ঠোঁট ভিজিয়ে থেমেথেমে বলে,
– “কিছু না। তবে যা হচ্ছে, তা ঠিক হচ্ছেনা।”

– “কী ঠিক হচ্ছেনা?”

– “তা আপনি জানেন।”

শাফায়াত একপেশে হেসে বললো,
– “কেন?”

অ্যানি উত্তর দেয়না। তার নিরবতা পছন্দ হলোনা শাফায়াতের। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
– “ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এর জন্য, তাইতো?”

চকিত দৃষ্টিতে তার পানে চাইলো অ্যানি। বিরোধ জানিয়ে বললো,
– “একদমই না।”

– “তাহলে?”

আবার থেমে রয় অ্যানি। শাফায়াত কিছুটা আহত স্বরেই বললো এবার,
– “কিছু তো বলুন!”

অ্যানি লম্বা দম টেনে চোখ তুললো। খানিকটা সময় নিয়ে বললো,
– “আপনার আর আমার মধ্যে কোনো মিল নেই উকিল সাহেব। না ব্যবহার, না জীবন… কোনো দিক থেকেই না। হ্যা, জীবনে কষ্ট আমারো এসেছে টুকটাক। তবে তেমন কোনো ট্রাজেডি নেই, আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভীষন সাধারণ। আর আমার ভাবনাও ততটাই সাধারণ। আপনি যতটা বুঝদার আমি ঠিক ততটাই অবুঝ। মানুষের জীবনের এতএত কঠিন দিকগুলো আমি কেন জানি মেনে নিতে পারিনা। ভাবতে পারিনা এসব নিয়ে। আমার জীবনটা স্বচ্ছ জলের মতো, বাধাহীন, যেখানে আমি ভেসে যাই কেবল। আপনার ভাবধারা আমি কখনোই সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারবোনা। এটা আমার নিজের জন্য কষ্টের হবে, যা আমি চাইছিনা। তাইজন্যই… বুঝতে পেরেছেন আশা করি।”

তার কথার প্রেক্ষিতে মৃদু হেসে বলে শাফায়াত,
– “ধরুন আপনি হলেন কুসুম গরম পানি, সবচেয়ে উপকারী। আর আমি হলাম জমে যাওয়া এক টুকরো বরফ। চাইলে কিন্তু আপনি খুব সহজেই বরফের টুকরোটাকে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে ফিরিয়ে আনতে পারতেন অ্যানি!”

– “কিছু বলেনি ও?”

ফোঁস করে দম ছাড়ে শাফায়াত,
– “উঁহু, চলেই গেলো।”

– “আপনি আটকাননি?”
নিষ্প্রভ কণ্ঠে জানতে চায় প্রীতি। শাফায়াত স্মিত হেসে জানায়,
– “কী বলে আটকাই? এটা ঠিক, সবার চিন্তাধারা এক হয়না। সে ভাবছে নিজের মতো, যা আমার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই অযৌক্তিক। কিন্তু তার দিক থেকে ওটাই যৌক্তিক। মজার বিষয় কী জানো? তার এই অযৌক্তিক ভাবনাগুলো আমার বেশ ভালো লাগছে।”

প্রীতি ফোন কাটার তাড়া দেখিয়ে বলে,
– “আম্মু ডাকছে বুঝলেন। আমি… পরে কথা বলছি। দেখি কী করা যায় আপনার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য।”

হাসিমুখে ফোন কেটে আবারো বিছানায় বসলো প্রীতি। চোখ বন্ধ করে বসেই রইলো কিছুক্ষন। মনেমনে বেশ কয়েকবার বকলো নিজেকে। নতুন করে খারাপ লাগার কোনো মানেই হয়না। সে সবটা মেনেই নিয়েছে।
অথচ বেশ বুঝলো সে, তার কষ্ট হচ্ছে। একটু হলেও… আয়নায় তাকিয়ে আবিষ্কার করলো,
“তাকে আমি পাবোনা— কথাটা মেনে নেওয়া যতটা সহজ, তাকে অন্য কেউ পাবে— কথাটা মেনে নেওয়া ঠিক ততটাই কঠিন।”

বিছানায় গা এলিয়ে সিলিং এর দিকে চেয়ে অ্যানির কথা ভাবলো প্রীতি। ও তো ভুল বলেনি। ওর সঙ্গে শাফায়াতের মিল নেই কোনো। অথচ তার সঙ্গে সবদিক থেকে মিল রয়েছে। মানসিকতা, ব্যবহার, ভাবধারা সবকিছুতে। এক্ষেত্রে শাফায়াতের কী তাকেই মনে ধরার কথা ছিলোনা? ছেলেরা তো এমন কাউকেই চায়, যার সঙ্গে মানসিকতা মিলবে, যে তার মনটাকে বুঝবে। সব গুনগুলো ছিলো তো প্রীতির মাঝে। সূত্রানুযায়ী কাউকে ভালো লাগলে তো সবার শুরুতে প্রীতিকেই লাগার কথা। তেমনটা হয়নি কেন?
এই অদ্ভুত মিলগুলোর কারণে? নিজের একটা প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায় বলেই কি তার মাঝে বিশেষ কিছু দেখলোনা শাফায়াত?

প্রচণ্ডরকম রাগ হলো প্রীতির নিজের উপর। কীসব ভাবছে! এমন বাচ্চামো তো সে করেনা। নিজের অজান্তেই কী হিংসে করে বসছে ঐ মেয়েটাকে?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা চেপে ধরলো প্রীতি। মনে পড়লো স্বজনের কথা। সে কি একটা ভুল করছে? কাউকে ঠকাচ্ছে?
ঘনঘন শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখে প্রীতি। ফোনটা হাতে নিয়ে স্বজনের নম্বর খুঁজে কল করলো। প্রথমবারে না তুললেও দ্বিতীয়বারে সে তুললো কলটা। সালাম দিতেই প্রীতি তার উত্তর দিয়ে জানতে চাই,
– “আপনি কী ব্যস্ত খুব?”

স্বজন ভ্রু কুঁচকে উত্তর দেয়,
– “কেন?”

– “একবার দেখা করতে পারবেন?”

স্বজন মুচকি হেসে জানায়,
– “কেন নয়? চলুন সন্ধ্যার দিকে…”

– “সন্ধ্যায় নয়, এক্ষুনি। পারবেন?”

– “ঠিক আছো তুমি?”

– “হ্যা, একদম। আপনি বলুন, এক্ষুনি একবার পারবেন দেখা করতে?”

স্বজন কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে,
– “এখন তো হসপিটাল এ আছি… বাট, তুমি চাইলে এখানে আসতে পারো। কিছুটা টাইম ম্যানেজ করে নেবো।”

– “ওকে, অ্যাড্রেস সেন্ড করুন। আসছি আমি, থাকবেন কিন্তু!”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৫
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

হসপিটালের পাশে ছোটখাটো একটা পার্কের ন্যায় জায়গা। বাচ্চারাই খেলাধুলা করে মূলত। মাঝেসাঝে বড়দের ও লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে পাশের বেঞ্চগুলো থাকে তরুণ-তরুণীদের দখলে। তাদের খাতায় নাম লিখিয়ে প্রীতি,স্বজনও জায়গা খুঁজে নিলো। গায়ে অ্যাপ্রোন জড়ানো স্বজনের, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলছে, চোখে চিকন ফ্রেম এর চশমাটা নাকের সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে আছে। প্রীতি এসব দিকে লক্ষ্য করলোনা। রূপ দেখে পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হবার বয়স সে বহু আগেই পেরিয়ে এসেছে।

স্বজন বেশ কিছুক্ষন নির্বাক রূপে বসে থেকে শুধায়,
– “তো, কী ভাবলে শেষ অবধি?”

প্রীতি আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
– “কিছু ভাবতে পারছিনা বলেই এভাবে হুট করে দেখা করতে চেয়েছি।”

– “মানে, আমার থেকে সাজেশন চাও?”

প্রীতি হেসে সামনে তাকায়। বলে,
– “ঠিক সেটাও নয়। মেইনলি, আমার কনফিউজড লাগছে। অর্থাৎ, নিজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি। ঠিক করছি নাকি ভুল, এটাই বুঝতে পারছিনা। একবার মনে হচ্ছে আমি ঠিক পথেই আছি, তার খানিক বাদেই মনে হচ্ছে যা করছি তা ঠিক করছি না। একবার মনে হচ্ছে আমার সময় নেওয়া উচিৎ, তো আরেকবার মনে হচ্ছে সময়টা আমার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবেনা।
মানে রাগটা আমার নিজের উপর হচ্ছে। একেবারে ব্লাঙ্ক হয়ে যাচ্ছি, যেটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছেনা।”

– “সবসময় কী এমন শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলো?”

– “হু?”

অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে চাইলো প্রীতি। স্বজন হাত মুঠো করে মুখের সামনে এনে দুবার কেশে বললো,
– “জানতাম বরিশালের মানুষ তোমরা। এত শুদ্ধ ভাষা দেখে কিছুটা অবাক হলাম।”

প্রীতি একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলে,
– “ইন্ডিরেক্টলি অপমান করছেন না-তো? দেখুন নিজের জেলা তো নিজের জেলা-ই। থাকি কিংবা না-ই থাকি, একটা টান এসেই যায়। তাই আমার জেলা কে অপমান করলে কিন্তু মেনে নেবোনা।”

স্বজন হেসে উঠে শুধায়,
– “অপমান করিনি উকিল সাহেবা। প্রজ্ঞার কথায় আঞ্চলিক টান চলে আসে, তোমার টা-তে খুবই রেয়ার, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমার বাড়িতে এসে আবার তোমাকে শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলতে হবে কিনা! কারণ আমার বাপজান ভাষা নিয়ে ভীষন সতর্ক। মাথায় হাত রেখে বুঝিয়ে হলেও ভাষা ঠিক করিয়ে নেন।”

প্রীতি তার কথায় ফিঁক করে হেসে ফেললো।
– “আপনি যতটা ভাবছেন আমি কিন্তু ওটোটাও ভদ্রসভ্য না। প্রজ্ঞার চেয়েও আমার ভাষা অতি জঘন্য। জাস্ট অপরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত মানুষের সামনে একটু ভদ্র সেজে থাকি আরকি।
আর আপনার বাবার সঙ্গে আমার মায়ের দেখছি মিল আছে খুব। আম্মুও ভাষা নিয়ে সতর্ক। ছোটবেলায় এক আধটা আঞ্চলিক শব্দ মুখ থেকে বেরোলেই এমন চোখ রাঙাতো! তার সামনে এইজন্য একটু সাবধানে থাকতে হয়।”

হাসিমুখে কথা বলার মাঝেই প্রীতি বিস্ময় চোখে চাইলো একবার। ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “আপনার বাড়িতে গিয়ে মানে? আপনি বোধ হয় বুঝতে পারছেন না, আমার মাথায় বিয়ে ভাঙার চিন্তা ঘুরছে।”

স্বজন বাচ্চাদের দিকে চেয়ে গা-ছাড়া ভঙ্গিতে শুধায়,
– “আচ্ছা, ভেঙে দিয়ে কী করবে?”

– “কিছুই করবো না। সময় নিতে পারি খানিকটা, এইটুকুই।”

– “সময় নেওয়া আর বিয়ে ভাঙা কী এক হলো?”

– “এক নয়?”

– “উঁহু। তবে তুমি তো সময়টাই চাচ্ছো, সেটা নিতেই পারো। বিয়ে ভাঙার কোনো কারণতো বললে না?”

প্রীতি জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো তার পানে। স্বজন মৃদু হেসে জানায়,
– “বত্রিশ টা বছর তো একাই কাটিয়ে দিলাম। আর এক দু-মাস কাটালে কী ই বা এসে যাবে?”

– “সময়টা তো এরও বেশি হতে পারে।”

– “কত? এক বছর? তাও আহামরি কিছু তো না। তুমি চাইলে সময় নিতে পারো, এক সপ্তাহ, এক মাস, দু-মাস… যতদিন খুশি। কিন্তু বিয়েটা আমাকেই করছো।”

– “আপনাকেই কেন করতে হবে?”

– “উঁহু, কথাটা উল্টো হবে। তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। আসল কথা হলো, আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।”

অধিক বিস্ময়তায় চোখমুখ ছেয়ে যায় প্রীতির। স্বজনকে দুবার পরখ করে বলে,
– “সেটা কেন? অন্য শিক্ষিত মেয়ে পেয়ে যাবেন।”

স্বজন তার দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “বোকার মতো কেন কেন করছো কেন? সহজ কথা, বউ হিসেবে আমার তোমাকেই পছন্দ হয়েছে।”

– “আমাকেই পছন্দ হবার কারণ?”
একটু হাসে প্রীতি। স্বজন তাকিয়ে থেকেই বলে,
– “পছন্দ না হবার কারণ?”

প্রীতি উত্তর না দেওয়ায় সে মৃদুস্বরে বলে,
– “রূপান্বিতা, গুনান্বিতা… পছন্দ হবার জন্য আর কী চাই? তার চেয়ে বড় কথা আমি যেমন মেয়ে চেয়ে এসেছি, তুমি ঠিক তেমন।”

প্রীতি একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রয়। রূপ,গুন সবদিক থেকে যদি সে পরিপূর্ণ হয়, তাহলে শাফায়াত কেন তাকালো না তার দিকে?

– “চাওয়ার উপর কী মানুষের পছন্দ নির্ভর করে?”

– “হুম। আমরা যেমন মানুষ কল্পনা করি, চোখের সামনে তেমন কাউকে পেয়ে গেলে পছন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকলে না-চাওয়া ব্যক্তিকেও পছন্দ হয়ে যেতে পারে, এটা ভিন্ন ব্যাপার।”

প্রীতির হাসি পেলো সেই মুহূর্তে। এইতো আসল কথা। শাফায়াত একদিন কথায় কথায় বলেছিলো, সে খুব সাধারণ একজন মেয়ে চায়। কোনো বিশেষ গুণ নাই থাকুক তার মাঝে। সে হোক আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই কেউ। কিন্তু প্রীতি নিজেই বিশ্বাস করে, তার মাঝে কিছুটা হলেও বিশেষত্ব রয়েছে। বিশেষ কাউকে তো শাফায়াত চায়ই নি, তাহলে তাকে চোখে পড়বে কী করে?

তার ভাবুক দৃষ্টি দেখে স্বজন চোখের সামনে তুড়ি বাজালো একবার। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– “কোথায় হারালে? বিয়েতে না করার প্ল্যান করছো? করতেই পারো। সেক্ষেত্রে তোমায় পটিয়ে ফেলতে আমার খুব বেশিদিন সময় লাগবেনা।”

প্রীতি বড়বড় চোখে চেয়ে বলে,
– “আপনাকে বেশ ভদ্রসভ্য ভেবেছিলাম!”

হেসে উঠলো স্বজন,
– “অভদ্রের মতো কী করলাম ম্যাডাম? আর চশমার আড়ালে দুনিয়ার সবাই ই ভদ্র। তবে তোমার একটু ভেবে দেখা উচিৎ ছিলো, এত ভদ্রসভ্য হলে কাউকে পালিয়ে বিয়ে করার বুদ্ধি দিতাম না। সারাটা জীবন মানুষের প্রেমে সুপার গ্লু এর মতো কাজ করেছি। বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে বন্ধুদের কম সাহায্য করিনি। নিজের বেলায় এইটুকু আমি করতেই পারি।”

প্রীতি আকাশপানে চাইলো একবার। মনেপ্রাণে আবারো বিশ্বাস করতে চাইলো, সৃষ্টিকর্তা না পাওয়ার বিনিময়ে নিশ্চই অধিক ভালো কিছু পাইয়ে দেন। কেবল ভরসা রাখা জরুরী। এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে জীবনকে একটা সুযোগ দেওয়াই যায়।

– – –

সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে সি এন জির আশায় ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিলো প্রজ্ঞা। একটা সি এন জি পাওয়া এখন খুবই জরুরী। একেকটা গাড়ির ধোয়া নাকে আসতেই গা গুলিয়ে উঠছে একদম, মাথাও ঘুরছে। সি এন জি না পেয়ে ফোনে উবার রাইড খুঁজতে শুরু করলো প্রজ্ঞা। কেবল কল করতে নেবে, তখনি কোথা থেকেই সামনে উদয় হলো একটা গাড়ি। অন্য গাড়ি হলে কথা ছিলো না, তবে গাড়িটা এনজামের। ঠিক তার পাশে দাঁড়িয়ে একহাতে দরজাটা খুলে দিলো এনজাম। পাশ ফিরে সানগ্লাস টা নাকের ডগায় নামিয়ে বললো,
– “উঠে বোসো।”

প্রজ্ঞা হা করে তাকিয়ে দেখলো তাকে। এই বান্দা কোত্থেকে উদয় হলো? এ না সিঙ্গাপুর ছিলো? চোখদুটো ডলে আরো একবার তাকায় প্রজ্ঞা। নাহ, এটা তারই জামাই। ঐযে প্যাঁচানো প্যানকেকের মতো মুখ, বাঁশির মতো নাক…
এনজাম একটু এগিয়ে তার হাত ধরে টেনে বসালো গাড়িতে। পা’টা ঠিক করে রেখে দরজা আটকে আবারো সানগ্লাস টা চোখে এঁটে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিতেই প্রজ্ঞা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
– “তুমি কখন এলে?”

– “হয়েছে দু ঘণ্টা।”

– “আমাকে বলোনি কেন?”

এনজাম মুচকি হেসে শুধায়,
– “সারপ্রাইজ!”

তপ্তশ্বাস ছেড়ে সিটের সঙ্গে মাথা এলিয়ে রাখে প্রজ্ঞা। ভাগ্যেস এলো সে! রাস্তাঘাটে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে কী যে হতো!
দু সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে আড়চোখে পাশে তাকালো প্রজ্ঞা। জানতে চাইলো,
– “মিরপুর নাকি মোহাম্মদপুর?”

– “আপাতত মিরপুর। তোমার মাতাজি যেভাবে অর্ডার করেছে!”

প্রজ্ঞা তার চোখে থাকা সানগ্লাসটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়,
– “এই রাতের বেলা সানগ্লাস কেন?”

এনজাম বাঁকা হেসে চোখ টিপলো,
– “স্টাইল, বেইবি।”

প্রজ্ঞা চোখ কপালে তুলে বললো,
– “স্টাইল না, এটা স্রেফ আত্মঘাতী মিশন।”

– “তাহলে তো আমায় ‘মিশন ইম্পসিবল’ বলতে পারো।”

প্রজ্ঞা বুকে হাত গুঁজে বললো,
– “হ্যাঁ, আর আমি বলব, ‘মিশন ইনভিজিবল’। কারণ তুমি তো রাস্তাই দেখতে পাচ্ছো না!”

এনজাম পাত্তা না দিয়ে স্টেয়ারিং এ হাত ঘোরায়। প্রজ্ঞা আবারো সতর্কতার সুরে কড়া গলায় বলে,
– “এই সানগ্লাস খোলো তো! তুমি রাস্তা দেখতে পাচ্ছ?”

– “অবশ্যই! আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে সব বুঝে নিই।”
বিশ্বাসী ভঙ্গিতে শুধায় এনজাম। প্রজ্ঞা মুখ বিকৃত করে বলে,
– “ওহ! তা এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তো রাস্তায় বাঁধা গরুটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শেষ হয়ে যাবে!”

এনজাম সানগ্লাসটা নাকের ডগায় নামিয়ে চোখ উঁচিয়ে বলে,
– “ধাক্কা লাগলে তো গরুটাই আমার ফ্যাশন দেখে মুগ্ধ হবে!”

– “তারপর হাসপাতালে গিয়ে নার্সকে দেখারও সুযোগ পাবে। আসল কথা তো এটাই!”

– “ইশ! এমন সত্য কথা পথেঘাটে বলতে আছে?”

– “এনজাম!”

বাহুতে দুটো কিল পড়তেই হাসতে লাগলো এনজাম। পরক্ষনেই প্রজ্ঞার মাথাটা এসে ঠেকলো তার কাঁধে। হাতের মাঝে হাত ঢুকিয়ে একেবারে নিকটে এসে বসলো সে। এনজাম সানগ্লাসটা খুলে পকেটে রেখে শুধায়,
– “এটুকুতেই দম শেষ? শরীর খারাপ নাকি?”

নিরবে মিটিমিটি হাসে প্রজ্ঞা। আরো একটু শক্তকরে জড়িয়ে ধরে তার হাতখানা। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “আই মিসড ইউ!”

মুচকি হেসে একটুখানি পাশ ফিরে পুনরায় সামনের দিকে মনোযোগ দিলো এনজাম। প্রজ্ঞা গলায় নাক ঘষে বিরক্ত করলে চাপাস্বরে বললো,
– “অ্যাক্সিডেন্ট কিন্তু এখন তোমার কারণেই হবে!”

প্রজ্ঞা তার গলায় আলতোভাবে এক কামড় দিয়ে বললো,
– “একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”

– “কী সারপ্রাইজ?”

– “উঁহু, এখন না, পরে।”

এনজাম ভ্রু কুঁচকে তাকানোর পূর্বেই কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজলো প্রজ্ঞা। মুখখানা দেখে ক্লান্ত লাগছে বিধায় আর কিছু বললোনা একজাম। বরং একহাতে তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো মিরপুর এর পথে।

.

বাড়ি ফিরে বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই প্রজ্ঞা দেখলো এনজাম বিছানায় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে মিষ্টি খেয়ে চলেছে। অথচ এই মিষ্টি দেখেই গা গুলোচ্ছে তার। নিশ্চিত খালা এসে জামাইকে এসব দিয়ে গেছে। প্রজ্ঞা মুখ মুছতে মুছতে নাক শিটকে বললো,
– “তুমি এত মিষ্টি খাচ্ছো কীভাবে? আমি না বলেছি ওজন কমাতে?”

এনজাম চামচে মিষ্টি তুলে মুখে ঢুকিয়ে বলে,
– “তুমিই তো বলেছিলে একদিন, আমাকে মিষ্টি ছেলের মতো দেখতে ভালো লাগে। সেটাই ধরে রাখছি।”

প্রজ্ঞা চোখ কপালে তুলে বলে,
– “আরে! মিষ্টি ছেলে বলেছি, সুগার ড্যাডি তো বলিনি!”

এনজাম মেকি হাসে তার কথায়,
– “আচ্ছা, তাহলে এবার থেকে লবণ খাওয়া শুরু করবো। তখন বলবে, ‘তোমাকে দেখে বোরহানির মতো লাগছে।”

প্রজ্ঞা কটমট চোখে চেয়ে কাছে এসে শুধায়,
– “তুমি কি জানো, তোমার শরীরের শিরাগুলো এখন চিনি দিয়ে ভরা?”

এনজাম উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– “হ্যাঁ, আমি আসলে তোমার জন্য সুগার ফ্যাক্টরি হয়ে উঠছি।”

– “আর এই ফ্যাক্টরির মালিক আমি হয়ে যাবো। তারপর তোমার চিনি বিক্রি বন্ধ করে দেব।”

এনজামও বিপরীতে বললো,
– “চিনি বিক্রি বন্ধ করলে ডিমও খেতে দেব না। তখন তোমার ব্রেকফাস্টই হবে না!”

আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলতে নিলেই একহাতে তার আঙুলটা চেপে ধরলো এনজাম। ছেড়ে দিয়ে মিষ্টির প্লেট থেকে অল্প কিছুটা মিষ্টি কেটে হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো। আচমকা অন্যহাতে তার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বললো,
– “ইউ নো হোয়াট? সুইট ইজ আ সিম্বল অফ লাফ।”

সরু চোখে চেয়ে তার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে পিছনে সরে যায় প্রজ্ঞা। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে এনজামও। ঠিক দরজার সঙ্গে গিয়ে পিঠ ঠেকতেই এনজাম তার গালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
– “ইউ লাভ সুইটস না? অ্যান্ড ইউ অলসো লাভ মি… ওয়ানা টেস্ট বোথ টুগেদার?”

প্রজ্ঞা বড়বড় চোখে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো,
– “ন নাহ… এনজাম, ভুলেও না! দূরে সরো।”

তার কথায় কপাল কুঁচকালো এনজাম,
– “একেবারেই নিরামিষ হয়ে যাচ্ছো দিনদিন!”

মিষ্টিটুকু তার মুখের সামনে ধরে বললো,
– “হা করো।”

– “প্লিজ, নাহ! মিষ্টি খাবোনা আম…”

দু আঙুলে তার গাল চেপে ধরে অর্ধেকটা মিষ্টি মুখে পুরে দিলো এনজাম। সেকেন্ডের মাঝে বাকিটুকু নিলো নিজের আয়ত্তে। এটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হলোনা সে। মিষ্টির সঙ্গে আঁকড়ে ধরলো তার ওষ্ঠদ্বয়।
মিষ্টির স্বাদ পেতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো প্রজ্ঞা। এনজাম চেপে রাখা হাতটা শিথিল করে যত্নের সহিত গালে হাত বুলিয়ে দিলো তার। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো খালা,
– “ও জামাই! এদিকে আসো, বাজার ঘাট এর লিস্ট বানাতে হবে তো। তোমার তো থাকতে হবে। তারাতারি আসো তো।”

এনজাম মুখ বিকৃত করে ছেড়ে দিলো প্রজ্ঞাকে। দম আটকে মিষ্টিটুকু গিলেই কটমট চোখে তাকালো প্রজ্ঞা। এনজামের চোখেমুখে কেবলই বিরক্তি। প্রজ্ঞা রাগী স্বরে বললো,
– “বারণ করেছিলাম আমি!”

এনজাম চাইলো তার পানে। মুচকি হেসে ঠোঁটের কোণে আরো একটা চুমু খেয়ে বললো,
– “বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি সোনা।”

খালার ডাক এলো পুনরায়। এনজাম “আসছি খালা” বলে ঘর থেকে বের হতেই প্রজ্ঞা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
– “শ’য়’তা’ন তোর সোনা রূপার গুষ্টি কিলাই! আর কিছু ছিলোনা দুনিয়ায়? মিষ্টিই কেন? এত আদর করে তেঁতুল খাওয়াতে পারতিস, অ্যাটলিস্ট একটা চকলেট খাওয়াতে পারতিস! বেয়াদব কোথাকার…”

পানির বোতল খুঁজে দ্রুত কয়েক ঢোক পানি খেলো প্রজ্ঞা, তবুও মুখ ঠিক হচ্ছেনা। শেষে কাঁদোকাঁদো মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রণয়কে খুঁজতে খুঁজতে বললো,
– “প্রণয়? একটা চকলেট দে না বাবা!”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৬
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

দিনটা শুক্রবার, ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২২ মার্চ। প্রীতির বিয়ের দিন। মানুষজন তখনো আসেনি সেভাবে। রান্নাবান্নার কাজ চলছে, আত্মীয় স্বজন এসেছেন এই বারো চৌদ্দ জন। প্রীতি বন্দি নিজের ঘরে, পার্লার এর মেয়েরা তাকে সাজানো শুরু করেছে আরো আধঘণ্টা আগে। মাঝখান থেকে প্রজ্ঞা গিয়ে হালকা সেজে এসেছিলো। বলেছে, শাড়ি সে নিজেই পরতে পারবে। ঘরে এসে সেই কাজেই লেগে পড়েছে।

সবুজ শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলে কুচির দিকটাতে হাত দেওয়া মাত্রই তার নজর যায় নিজের পেটের দিকে। আয়নায় নিজেকে দেখে নেয় একবার। কুচিটা ছেড়ে পেটে হাত রাখে সে। কদিন ধরে বিয়ের হৈ হুল্লোর এর মাঝে এই ছোট্টসোনা কে সময়ই দেওয়া হয়নি। আনমনেই মৃদু হাসে প্রজ্ঞা। পেটে হাত বুলিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
– “বেবি, আর ইউ হিয়ার? সত্যিই!”

উত্তরের প্রতিক্ষায় থেকে নিজেই হেসে উঠলো প্রজ্ঞা। এত জলদি কখনোই বাচ্চার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবেনা সে। তবুও একটু আদর করলো তাকে। মনে মনে পণ করে নিলো, এবারে সে ভীষন মনোযোগী হবে নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে। প্রণয়ের সময়ে অতিরিক্ত চিন্তায় থাকায় এর প্রভাব প্রণয়সহ তার নিজের উপরেও পড়েছিল। এবারে তেমন কিছু হতে দেবেনা।

– “দরজা খোলা রেখে কোন বলদে শাড়ি পরে?”

এনজামের কণ্ঠ শুনেই পেট থেকে হাত সরায় প্রজ্ঞা। পিছু ঘোরার মাঝেই এনজাম দরজা লক করে এসে দাঁড়ায় তার সম্মুখে। বিছানা থেকে এসির রিমোটটা নিয়ে অন করে দেয়। কাজবাজ করে বড্ড ক্লান্ত সে, যদিও তেমন কিছুই করতে হয়নি।
প্রজ্ঞা নিজের শাড়ি পরায় মনোযোগী হয়ে শুধায়,
– “দরজা চাপানোই ছিলো। আর তুমি ব্যতীত কোনো পুরুষ মানুষ আমার ঘরে আসবেও না।”

এনজাম তাকে আপাদমস্তক পরখ করে নিলো একবার। থুঁতনিতে আঙুল ঘষে বললো,
– “এত সিম্পেল সাজ? ভাবলাম ঘরের আটা ময়দাই শেষ হয়ে যাবে, এখন তো অবাক হচ্ছি!”

প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “তুমিই তো বলো আমার সাজ বেশি হয়, এখন বলছো কম! ঠিক কী চাও?”

– “আমি চাই একটা ব্যালেন্স… মানে এমন কিছু যাতে তুমি রান্নাঘর আর ফ্যাশন শো, দুটোতেই খাপ খাওয়াতে পারো!”

– “ওহ! তাহলে তুমি নিজেই রান্না করো, আর আমি ফ্যাশন শো-তে যাই!”

– “বাহ! তাহলে আমি কি ‘মাস্টারশেফ এনজাম’ হয়ে যাবো?”

– “তুমি ‘সেল্ফ সার্ভিস এনজাম’ হও আগে, সেটাই ভালো!”

এনজাম তার কথায় পাত্তা না দিয়ে একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালো। ফ্লোরে পড়ে থাকা শাড়ির কুচির অংশটুকু নিয়ে সাবধানে কুচি করতে লাগলো। এই কাজটা তার বড্ড প্রিয়। প্রজ্ঞা তার সামনে কখনো একাএকা শাড়ি পরতে পারেনি আজ অবধি। ঝগড়াঝাঁটির মাঝেও এই ছেলে ছুটে আসবেই। মেয়েরা শাড়ি পরতে পছন্দ করে, আর তিনি বউকে শাড়ি পরায় সাহায্য করতে। প্রজ্ঞা মুচকি হেসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ইচ্ছে করলো এখনি সুখবরটা জানিয়ে দিতে। পরক্ষনেই মনে হলো, নাহ থাক। কদিনে যখন জানায়নি তখন একেবারে চেকাপ করিয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই জানাবে। টেস্ট কিট এর উপর তার সম্পূর্ন ভরসা নেই। প্রীতির বিয়েটা শেষ হোক, কাল পরশুই চলে যাবে ডাক্তারের কাছে।

সাজগোজ শেষে প্রীতিকে নিচের একটা ঘরে এনে বসানো হলো। গতকাল অবধি বেশ উৎসাহ থাকলেও এখন রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গেছে সে। এইযে মানুষ তাকিয়ে দেখছে, ছবি তুলছে, এগুলো একদমই সহ্য হচ্ছেনা তার। প্রণয়কে পাশে বসিয়ে ঠোঁটে এক মিছে হাসি টেনে বসেই আছে কতক্ষন যাবৎ। প্রজ্ঞা, অ্যানি পাশ থেকে বারবার এসে দেখছে তার মেকআপ ঠিক আছে কিনা। শাড়ি ঠিক করে মাথার বউ ওড়নাটা টেনে দিচ্ছে।
বরপক্ষ আসার ঠিক দশ মিনিট আগে বাড়িতে আগমন ঘটে শাফায়াতের। খয়েরী পাঞ্জাবী গায়ে ভিতরে এসে অপরিচিত মানুষের ভীরে লোকসমাগমপূর্ন ঘরটার সামনে চলেই এলো সে। প্রজ্ঞা,এনজাম,অ্যানি সকলেই ছিলো ঘরে। সে দরজায় টোকা দিয়ে হালকা কেশে বলে,
– “আসতে পারি?”

প্রীতিসহ বাকিরাই চাইলো দরজার পানে। মুখের মিছে হাসিটুকুও হুট করেই মিলিয়ে যায় প্রীতির। আমন্ত্রণ জানালেও সে আজ না আসলেই ভালো হতো, অন্তত প্রীতির জন্য।
এনজাম, প্রজ্ঞা তাকে দেখে অবাক হলো খুব। এনজাম উঠে এসে মৃদু হেসে বলে,
– “স্যার, আপনি? এখানে… কী করে?”

– “অতিথিকে এভাবে বলছেন? অসন্তুষ্ট হলে চলেই যাই!”

প্রজ্ঞা তড়িঘড়ি করে মাথা নেড়ে বলে,
– “না নাহ ভাইয়া… চলে কেন যাবেন? কিন্তু আপনি এখানে… কোনোভাবে কী বরপক্ষের লোক?”

শাফায়াত হেসে বলে,
– “নাহ ম্যাডাম। আমি কনেপক্ষের লোক। কনের পরিচিত… জিজ্ঞেস করুন।”

প্রজ্ঞা,এনজাম তড়িৎবেগে চাইলো প্রীতির দিকে। প্রীতি শাফায়াতের থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নুইয়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। এনজাম,প্রজ্ঞা একে অপরের দিকে চেয়ে পুনরায় তাকালো তাদের পানে। ভ্রু কুঁচকে বললো এনজাম,
– “আপনারা কী পূর্বপরিচিত?”

শাফায়াত উত্তরে বলে,
– “আজ্ঞে হ্যা। একসঙ্গে বেশ কিছু কেস এ কাজও করেছি।”

প্রীতির চাল ধরতে খুব বেশি সময় লাগলোনা প্রজ্ঞার। তবুও সে খুশিই হলো। তাদের জন্য শাফায়াতের মতো একজন বুঝদার উকিল এর দরকার ছিলো খুব। এনজাম শাফায়াত কে সঙ্গে নিয়ে বসার ঘরে যাওয়ার পূর্বে সে একনজর তাকালো অ্যানির দিকে। সে শাড়ি পরেনি, পরেছে সবুজ রঙের সেলোয়ার কামিজ, প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিয়ে। শাফায়াতের দিকে চোখ তুলে চাইলো না একবারো। তার আশাহত দৃষ্টিকে পরোয়া না করে মাথা নুইয়ে রাখলো পুরোটা সময়।

বরপক্ষ এলো যথাসময়ে। খুব বেশি মানুষ নয়,বিশজনের মতো, সঙ্গে অধিকাংশের কোলে ছোট বাচ্চা। প্রণয়ের আজ আর মায়ের পিছনে লুকোতে হলোনা। সে আজ খেলার সঙ্গী পেয়েছে বলে কথা! টুশি ও ভয় পাচ্ছে এত মানুষ দেখে, সে নিজেও ভয় পাচ্ছে। তবে সে বড়, নিজে বাচ্চা হলেও টুশির চেয়ে তো বড়। তাই নিজের ভয় প্রকাশ করলে চলবেনা। বারেবারে ছোট বোনকে বুঝ দিচ্ছে, ‘এরা খাম্মির বরের বাড়ির লোক, ভয় পেতে হবেনা।’ টুশি বুঝছে। তার দু সেকেন্ড বাদেই প্রণয়ের হাত জড়িয়ে লুকিয়ে থাকছে একদম। প্রণয় আবারো আদর করে বোঝায় তাকে, এভাবেই চলছে।

খুব বেশি দেরি করা হলোনা আর। স্বজনকে নিয়ে আসা হলো ঘরে, বসানো হলো প্রীতির পাশে। দুজনেই একনজর চাইলো একে অপরের দিকে। কাজি এলেন, সামনের চেয়ারে বসতেই প্রীতি ভেজা ঢোক গিললো একটা। শাফায়াতকে চোখের সামনে দেখে ফেলার ভয়ে চোখই তুললোনা আর। গতকাল রাতে প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেছিলো একবার,
– “কবুল বলার সময় কী বুক কাঁপে? ভয় হয়?”

প্রজ্ঞা মুচকি হেসে বলেছিলো,
– “জানিনা… আমার হয়নি।”

– “কেন?”

– “হয়তো, বিপরীত মানুষটার প্রতি অগাধ ভরসা ছিলো বলে।”

অথচ প্রীতির এখন বুকটা কাঁপছে খুব। তবে কী সে এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি স্বজনকে? লোকটা যে গত কয়েকদিনে দু-বেলা নিয়ম করে তাকে কল করলো, খবর নিলো… এরপরও বিশ্বাস টা কী আসেনি পুরোপুরি?
চোখ বুজে নিজেকে আশ্বাস দিলো প্রীতি। ভরসা যদি না-ও এসে থাকে, তা ধীরেধীরে চলে আসবে। পারিবারিক বিয়ের এই তো নিয়ম!

নিজ ভাবনায় অটল থেকে বেশ সাবলীল কণ্ঠেই কবুল বললো প্রীতি। কান্না-টান্না তেমন পায়নি তার। অথচ একপাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো প্রজ্ঞা। এইতো বোনটা তার পর হয়ে গেল!
এনজাম পাশে এসে কাঁধে হাত রাখে তার। কানেকানে বলে,
– “নিজের বিয়েতে কাঁদোনি, এখন ফ্যাচফ্যাচ করার কী আছে?”

প্রজ্ঞা আড়চোখে চেয়ে বলে,
– “নিজের বিয়ে ঠিকভাবে হলে তো কাঁদতাম। কোন ঝড়ের বেগে যে বলি দিলাম নিজেকে তাই তো বুঝলাম না!”

বলে আবারো ফুঁপিয়ে উঠলো সে। এনজাম তার মাথাটা আলতোভাবে বুকে টেনে স্বান্ত্বনা দিলো নিরবে। মেয়ে মানুষ এত আবেগী হয় কী করে?

যোহর বাদ বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই যখন ধাপেধাপে খেতে বসলো, শাফায়াত বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলো অ্যানির সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু তাকে আর পাওয়া গেলোনা। ফোনে কল সে করবেনা। বাধ্য হয়ে এবার একখানা কাগজে কিছু কথা লিখে প্রণয়কে খুঁজে বের করলো। কাগজ টা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে অ্যানির দিকে নির্দেশ করে বললো কাগজটা তাকে দিয়ে আসতে। প্রণয় ভদ্র ছেলের মতো শুনলো তার কথা। কাগজটা নিয়ে অ্যানির হাতে ধরিয়ে দিলো, পরক্ষণেই টুশির সঙ্গে খেলতে চলে গেলো। শাফায়াত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরে আসে। এবারে যদি মেয়েটা কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় তবুও!

বরপক্ষের লোকেদের মাঝে স্বজনের সঙ্গে রইলো তার চাচাতো বোন এবং ভাই। বাকিরা চলে যায় বিকেলের দিকেই।
স্বজনের সঙ্গে প্রীতির সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠলো রাত দশটার পর। ছবি টবি তোলার শেষে সবাই যখন নয়া দম্পতীকে একা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, প্রীতি লক্ষ্মী বউটির মতো বসে রইলো বিছানায়। প্রজ্ঞা খুব বুঝিয়ে বলেছে, বরকে সালাম করবি, সুন্দরভাবে কথা বলবি, সপ্তাহখানেক একটু ভদ্র সেজে থেকে তারপর যা খুশি তাই কর, কোনো সমস্যা নেই।

স্বজন ধীর পায়ে এসে বসলো তার পাশে। ঘোমটা টানা নেই বলে আর মুখ দেখার কষ্ট করতে হলোনা। তবে সে চেয়ে দেখলো বউকে। মানুষজন এর ভীরে দুপুর থেকে এ অবধি তাকে ঠিকঠাকভাবে দেখার সুযোগটাই হয়ে ওঠেনি।
মন ভরে বউকে দেখা শেষে স্বজন খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসলো। প্রথমেই প্রশ্ন করলো,
– “সময় নিলে না যে?”

প্রীতি আড়চোখে চেয়ে উত্তর দেয়,
– “কী করবো সময় নিয়ে? বিয়ে যখন করতেই হবে, তো দেরি করে কী লাভ?”

স্বজন স্মিত হেসে বলে,
– “একা থাকতে পারতে আরো কদিন। বিয়ে যে করলে, এখানে তো একটা ঝামেলা আছে ম্যাডাম।”

প্রীতি জিজ্ঞাসু কণ্ঠে শুধায়,
– “কীসের ঝামেলা?”

স্বজন গলা খাকড়ি দিয়ে নিচু স্বরে জানায়,
– “বছর ঘুরতে আম্মাজানকে দাদি ডাক না শোনাতে পারলে তিনি মনের দুঃখে হারপিক ও খেয়ে বসতে পারেন। তাই তোমাকে যে খুব বেশি সময় দিতে পারবোনা, এটা ঝামেলা নয়? বিয়ে দেরিতে করলে কথা আলাদা ছিলো।”

প্রীতি বিস্ময় চোখে চাইলো তার পানে। অদ্ভুতভাবেই তার লজ্জা লাগছে! এটা কী বিয়ের সুফল? স্বজনের মিটিমিটি হাসি দেখে অবাক কণ্ঠে বললো,
– “মিস্টার স্বজন, আপনি কী জানেন আপনাকে দেখতে একেবারেই ভোলাভালা লাগে! কিন্তু আপনি সেটা নন।”

স্বজন উচ্চস্বরে হেসে সোজা হয়ে বসলো। প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো,
– “এটা তো তোমার দেখার সমস্যা মিসেস, আমার নয়।
তবে… আজ তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে। নিজের ব্যাপারে বলো কিছু। শুনি।”

– “আমার ব্যাপারে আর কী বলবো?”

– “বলার নেই? লাইফ স্টোরি বলো। ছোটবেলার কোনো মেমোরেবল ঘটনা, কিংবা কোনো খারাপ ঘটনা… যেকোনো কিছু।”

প্রীতি নিজের বউ ওড়নাটা ধরে শরীরে থাকা গহনাগুলোর দিকে নির্দেশ করে বললো,
– “এই অবস্থাতে গল্প বলবো?”

স্বজন খেয়াল করে বললো,
– “ওহহো! না না, চেঞ্জ করে নাও। তারপর বোলো।”

প্রীতি বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো। বউ ওড়নার ক্লিপগুলো খুলতে সমস্যা হতেই স্বজন পাশে এসে বললো,
– “সাহায্য করবো?”

প্রীতি চোখ উঁচিয়ে তাকায় একবার। নিজের হাতটা সরিয়ে মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানালো। স্বজন পিছনে দাঁড়িয়ে মাথার ক্লিপগুলো খুলে দেয়। ধীরেধীরে গলার,কানের ভারী গহনাগুলোও খুলতে সাহায্য করে। প্রীতি আয়নায় চেয়ে বারকয়েক দেখলো তাকে। যত যাই হোক, তার জীবনের বিশেষ একটা দিন আজ। অনেকেই পায়না, যেমন প্রজ্ঞা পায়নি। সে পেয়েছে, নিশ্চিত সে ভাগ্যবতী।
শাড়ি পাল্টে হালকা রঙের সুতির সেলোয়ার কামিজ পরে এলো প্রীতি। স্বজনও পাঞ্জাবী বদলে টিশার্ট,ট্রাউজার পরে এসে বসলো তার পাশে। বিছানায় হেলান দিয়ে ধীরেধীরে গল্পে ডুবলো তারা। কত কথা প্রীতির! কতশত ঘটনা, ছোট বড় সব। স্বজন মনোযোগ দিয়ে শুনলো। এত গল্পের মাঝে কখন যে পুরুষটির অতি নিকটে, ঠিক তার বুকে চলে এলো প্রীতি… সে টেরই পেলো না। টের পেলেও সরে যাওয়ার আগ্রহ দেখালো না। লোকটি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো, মাঝে একবার মাথার মাঝে সিঁথি বরাবর ঠোঁটও ছোঁয়ালো। নিচু গলায় বললো,
– “এখন ঘুমাও। বাকিটা কাল শুনবো।”

প্রীতি হেসে চোখ বুজে বললো,
– “কাল নয়, আমার কথা শোনা আপনার এ জীবনে শেষ হবে ডাক্তার সাহেব।”

– – –

সারাদিনের ধকল শেষে রাতে শরীরটা ছেড়ে দিলো প্রজ্ঞার, একেবারেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে রইলো বিছানায়। এনজাম বাকিদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘরে এলো আরো খানিকটা সময় বাদে। প্রজ্ঞাকে মাথার উপর হাত রেখে শুয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে দ্রুতপায়ে এসে বসলো তার পাশে। মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– “কী হয়েছে? এভাবে শুয়ে আছো, চেঞ্জ ও করোনি। প্রজ্ঞা?”

প্রজ্ঞা চোখ কুঁচকে মাথা নাড়লো শুধু, অর্থাৎ কিছু হয়নি তার। এনজাম কপালে, গালে হাত ছুঁইয়ে বলে,
– “কই, জ্বর তো নেই। দূর্বল লাগছে?”

সম্মতি জানায় প্রজ্ঞা। এনজাম সঙ্গেসঙ্গে বলে ওঠে,
– “নিশ্চিত বিপি লো! দেখি তাকাও তো, রক্ত আছে শরীরে আদেও? যা খেতে বলি তা খাবেনা, দুনিয়ার যত অস্বাস্থ্যকর খাবার আছে সেগুলো দিনভর গিলতে পারবে। এরপর অসুস্থ হলে আমি সেবা করতে পারবোনা তোমার।”

ঝগড়া করার আর শক্তি পেলোনা প্রজ্ঞা। এনজাম চোখ টেনে ধরে দেখলো তার… নাহ,একেবারে সাদা নয়। প্রজ্ঞার নিকট হতে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়না। সে কেবল চোখ খুলে জানতে চায়,
– “প্রণয় খেয়েছে?”

– “হুম, খেয়েছে। এখন ওঠো তুমি। চেঞ্জ করে এসে ঘুমাও।”

প্রজ্ঞা বিরক্তির সহিত মাথা নেড়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এনজাম একটু কড়া গলায় বললো,
– “এই শাড়ি পরে ঘুমোতে পারবে? আর জ্বালিও না তো! ওঠো, শাড়ি বদলে এসে শোও, কিচ্ছু বলবোনা।”

– “পারবোনা।”

এনজাম বুকে হাত গুঁজে শুধায়,
– “তো কী আমি বদলে দেবো?”

প্রজ্ঞা আড়চোখে চাইলো একবার। চোখ-নাক কুঁচকে বললো,
– “ছিহঃ! কী অশ্লীল!”

এনজাম চোখ কপালে তুলে বলে,
– “তোমার বর আমি!”

– “তাতে কী? ছেলে মানুষ ই তো! অসুস্থ একটা মেয়ের সামনে এসে এসব কথা বলতে লজ্জা করেনা?”

– “তুলে স্রেফ একটা আছাড় মা’রবো। বিয়ে বাড়িতে কেউ ডেট ওভার পানি টানি এনেছিলো নাকি?”

– “ডেট ওভার পানি?”
চোখ পিটপিট করে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম মাথা ঝাঁকিয়ে একপ্রকার টেনে তুললো তাকে। গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি, মাথার টিকলি সব একেএকে খুলে দিয়ে উঠে দাঁড় করালো। হাতে একসেট জামা ধরিয়ে দিয়ে জোর করেই পাঠালো ওয়াশরুমে। প্রজ্ঞা মুখ ফুলিয়ে কাপড় বদলে এসেই শুয়ে পড়লো বিছানায়। এনজাম লাইটটা নিভিয়ে এসে তার পাশে আধশোয়া হয়ে বসলো। কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললো,
– “আসলেই শরীর খারাপ? নাকি মন খারাপ?”

প্রজ্ঞা চোখ না খুলেই বলে,
– “মন খারাপ কেন হবে? বোন তো কাছেই আছে।”

– “সেজন্য না।”

– “তাহলে?”

এনজাম উত্তর না দিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সেখানেই মাথা ঠেকিয়ে বললো,
– “আমার উপর রাগ?”

ভ্রু কুঁচকে চোখ মেললো প্রজ্ঞা। এনজামের কথার মানে বোঝামাত্রই চুল ধরে টেনে সরিয়ে দিলো তাকে। রাগত স্বরে বললো,
– “উল্টো জিনিসটাই সবসময় বুঝতে হবে কেন? এত বেশি ভাবতে বলিনি আমি।”

এনজাম মৃদু হাসে শুধু। প্রজ্ঞার ভালো লাগলোনা তা। এমনিতেই শরীর ভালো লাগছেনা, এই ছেলে মনটাকেও খারাপ করে দিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার দিকে এগিয়ে এলো প্রজ্ঞা। ক্লান্তস্বরে বললো,
– “মন আমার একদমই ঠিক আছে, শরীরটা ঠিক নেই। বেশি না বুঝে একটু সেবাযত্ন ও তো করতে পারো!”

এনজাম তার নাকে নাক ঘষে জানতে চায়,
– “কেমন সেবা করি বলুন? আপনার আদেশ তো মানতে বাধ্য!”

– “শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই চলবে। আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট।”

এনজাম ঠোঁট উল্টে বলে,
– “আরেকটু বেশি চাইলে কী হতো?”

প্রজ্ঞা পরোয়া না করে বুকে মাথা রেখে জাপটে ধরলো তাকে। এনজামও কথা অনুযায়ী শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো তার। বিলি কেটে দিলো মাঝেসাঝে। খানিক বাদে প্রজ্ঞা মৃদুস্বরে জানতে চাইলো,
– “কদিন ধরে ভালো ব্যবহার করছো কেন?”

– “তুমি কেন করছো?”

– “কারণ আমি ভালো হয়ে যাচ্ছি। একদম ভালো বউ প্লাস ভালো মা।”

এনজাম মৃদু হেসে ফিসফিসিয়ে শুধায়,
– “ভালো মা-ই ছিলে।”

– “জানি তো। কিন্তু আরো ভালো হতে হবে। এবারে কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবেনা।”

– “কীহ?”

প্রজ্ঞা তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে তার ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে বলে,
– “কিছুনা। ঘুমোবো… গান শোনাও একটা।”

এনজাম মুচকি হেসে মাথাটা আরেকটু কাছে টেনে নিলো। তার গানের গলা এমন ভালো নয় যে ঘুম চলে আসবে। তবুও বউ আবদার করেছে বলে কথা। ভাঙা গলাতেও সে মৃদুস্বরে গাইলো কিছু চরণ,
– “যদি বলি, “আমার প্রতিটা রাত তোমার কোলে চাই”
বলো, ঠোঁটের ছোঁয়ায় আদর মাখাবে গালে!
যদি বলি, “হ্যাঁ, হাসছি আমি শুধুই তুমি আমার তাই”
বলো, ছেড়ে তো দেবে না কখনও মনের ভুলে?

বাঁচি এই বিশ্বাসে
শেষ নিঃশ্বাসে তোমাকেই পাশে চাই
তুমি না থাকলে আমি শূন্য এ মহাদেশে
যদি ঘুমিয়েও পড়ি
শেষ ঘুমে আমি তবুও তোমাকে চাই
তুমি স্বপ্নেই এসো রূপকথার ওই দেশে”

#চলবে?