নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
817

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৭
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

“অ্যানি,

আমাকে দেখে কী আপনার খুব দুঃখি মানুষ বলে মনে হয়? তেমনটা ভাববেন না। নিজের জীবন নিয়ে আমি যথেষ্ট খুশি। তবে একাকীত্বপ্রেমী নই। এই অপ্রিয় বিষয়টাকেই সঙ্গে নিয়ে বহু বছর যাবৎ দিন কাটাচ্ছি। জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমি একা এভাবে থাকি কী করে? বিশ্বাস করুন, আর ইচ্ছে করেনা একা থাকতে। মন চায় সঙ্গে কেউ থাকুক। চাইলেই মায়ের কাছে যেতে পারি, আদরে রাখবে, পছন্দের খাবার রেঁধে খাওয়াবে। তবে জায়গাটা পর পর লাগবে, দম আটকে আসতে চাইবে। নিজের বাড়িতে গেলে গোটা একটা পরিবার পাবো, তবুও দিনশেষে মনে হবে আমি সেই একা-ই রয়ে গেলাম। আপনার ধারণা, সাধারণ, সহজ একটা মন নিয়ে আমায় বুঝতে পারবেন না। আমি তো চাইনি! কখনো এই স্বপ্ন দেখি নি যে কেউ আমাকে বুঝবে। আমি তো বেশ আছি, কাছের মানুষের কাছে ঠিক একটা খোলা বইয়ের মতোই থাকবো।
আমার ব্যক্তিজীবনটা ভীষন গাম্ভীর্যতাপূর্ণ অ্যানি। কিন্তু আমি মানুষটা তেমন নই। আপনার সঙ্গে বসে তো চা খেতেও ভালো লাগে, জোর করে তো অভ্যাস গড়তে হয়না!
মনে আছে, যেদিন প্রথম ছুটে এসেছিলেন টাকা ফেরত দিতে? কোনো কারণ ছাড়াই বেশ মনমরা ছিলাম সেদিন। আপনি এলেন, সহজ ভাষায় নিষ্পাপ মনে কিছু বললেন, আমার মন হুট করেই ভালো হয়ে গেল! সেদিন যখন কল করলেন, শরীরের তাপমাত্রা ১০০ তে নয়, ১০২ ডিগ্রির আসেপাশে ছিলো। আপনার দ্বিধান্বিত কণ্ঠ ম্যাজিক এর মতো আমায় উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। বিশ্বাস হয়না, না? আপনি নিজেকে খুব সাধারণ দাবি করেন অ্যানি। আমি মেনে নিলাম আজ আপনার কথা। সঙ্গে এটাও বলি, সাধারণ আপনার চঞ্চলতাই আমার পছন্দের। সামান্য নয়, অনেকটা পছন্দের। আমার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কথা আপনার ভাবাই উচিৎ নয়। কেননা কাজটা আমার, আমি চেয়েছি আপনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে, দূরে না সরে গেলে আমি ভবিষ্যতেও সেই চেষ্টাই করতাম। আপনার এই সহজ জীবনের সঙ্গী বানিয়ে আমার জীবনটাতে একটু সরলতা দান করলে কি আপনার খুব বেশি ক্ষতি হবে অ্যানি?”

পৃষ্ঠায় আর জায়গা ছিলোনা বলে ইতি লেখা হয়নি তার। অ্যানি ক্যাম্পাসের মাঝে বসে পড়লো লেখাটুকু, বেশ কয়েকবার। লোকটা সহজ ভাষায় একপ্রকার অনুরোধ জানালো। কীসের জন্য? সে কী বোকা? বোকা বলেই হয়তো রোজ নয়টা অবধি চেম্বারে বসে থাকতো তার অপেক্ষায়, বাস অবধি হাঁটতো একসঙ্গে, বাইক থেকে যেত গ্যারেজে। আবার ফিরে এসে বাইক নিয়ে যেত নিজের বাসায়। কী এমন কথা বলে সে? শাফায়াত তা এমন মনোযোগ দিয়ে শোনে যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা সে গম্ভীর গলায় বলে চলেছে। অথচ তেমন কিছুই নয়। তার কথার মাঝে থাকে নিজের পরিবার, প্রজ্ঞা-এনজাম, আর নিজের বন্ধুবান্ধব। এইতো তার গণ্ডি। সেখানে শাফায়াতের চিন্তাধারা বহুদূর অবধি বিস্তির্ণ।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাগজটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে অ্যানি। কী করে বোঝায়, প্রেম শব্দটার প্রতি তার বিশ্বাসই নেই আর! এনজাম-প্রজ্ঞার মতো জুটির সম্পর্কের মাঝেই যদি চিড় ধরতে পারে, সেখানে সে তো কিছুই নয়। অথচ লোকটার জন্য তার মন পুড়ছে। এটাকে ভালোবাসা না বললেও মায়া অবশ্যই বলা যায়। মানুষটা যেন মায়ায় ঘেরা। ভাবনারা ফুরোয় না অ্যানির। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড়ই অপটু সে। ওদিকে একজন তার উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে। এমন দ্বিধাজড়িত মুহূর্ত জীবনে আসে কেন?

— — —
পেটজুড়ে ঠান্ডা জেল এর উপস্থিতি টের পেতেই চোখদুটো বুজে ঘনঘন নিঃশ্বাস টানলো প্রজ্ঞা। হৃদস্পন্দনের গতি বোধ হয় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। তার এমন অবস্থা দেখে ডাক্তারের সহচারী পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
– “আপনি স্বাভাবিক থাকুন ম্যাডাম। ভয় পাচ্ছেন কেন?”

প্রজ্ঞা চোখ খুললো ধীরেধীরে। মহিলা নিশ্চিত ভাবছেন এটা তার প্রথম প্রেগন্যান্সি। দ্বিতীয়বারে এসে এত উত্তেজনা তো থাকার কথা নয়। অথচ সে সবকিছু যেন এবারে আরো বিশেষভাবে অনুভব করছে। প্রণয়ের বেলায় কী থেকে যে কী হলো, তার মাথায় আসেনা।
পেটের উপর ট্রান্সডুসার ঘোরাতেই প্রজ্ঞা দোয়াদরুদ পড়া শুরু করলো। সব যেন ঠিকঠাক থাকে। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে সে আড়চোখে চাইলো মনিটরের দিকে। মিনিটের মাঝেই সেখানে স্পষ্ট কিছু দেখা গেলো। ডাক্তার বারেবারে ঘুরিয়ে দেখলেন। হেসে উঠে একটা যায়গায় নির্দেশ করে বললেন,
– “এইযে তোমার বাচ্চা,দেখতে পাও? কী সুন্দর হার্টবিট চলে এসেছে, মাশ আল্লাহ।”

ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো প্রজ্ঞার। সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করলো শুরুতেই। ডাক্তার বললেন,
– “ক’মাস চলছে জানো?”

– “ঠিক জানিনা ম্যাম।”

– “আট সপ্তাহের বেশি দেখাচ্ছে। দুমাস প্লাস। বাচ্চা… হ্যা, সব তো ঠিকঠাকই আছে। প্রথম বাচ্চা?”

– “উঁহু। এক ছেলে আছে।”

– “বয়স কতো?”

– “ছয় হয়নি।”

– “বাহ, বেশ ভালো তো। আগের বাবুর সময় সমস্যা ছিলো কোনো?”

– “জি ম্যাম। প্লাসেন্টা নিচের দিকে ছিলো… পাঁচমাসের পর থেকে একপ্রকার বেডরেস্ট এ থাকতে হয়েছে।”

– “হুম… যেহেতু আগের বার প্রবলেম ছিলো, তো এবারে আরো বেশি সাবধানে থাকতে হবে। ওকে?”

– “জি ম্যাম।”

আল্ট্রাসনোগ্রাফী শেষে কেবিনে এসে ডাক্তার জানতে চাইলেন,
– “সাথে কেউ আসেনি? বর কোথায়?”

প্রজ্ঞা মুচকি হেসে বলে,
– “সে আপাতত অফিসে। তবে আপনি ভুল ভাববেন না… তাকে এখনো জানানো হয়নি আসলে।”

ডাক্তার হেসে বললেন,
– “জানাও তাকে। সময়মতো চেকাপে এসো। আমি এখন চিনলাম, তোমার আগের বাচ্চার সময় সিজার আমিই করেছিলাম না?”

– “জি ম্যাম, তাই তো আপনার কাছেই এসেছি।”

– “পরের বার বরকে সঙ্গে নিয়ে এসো। বউয়ের প্রতি যত্নশীল হতে হবে কিন্তু।”

প্রজ্ঞা প্রশস্ত হেসে শুধায়,
– “একবার জানতে পারলে মাথায় তুলে রাখবে। দোয়া করবেন ম্যাম। আজ আসি?”

– “হ্যা,অবশ্যই। সাবধানে থেকো, ভারী কাজ ভুলেও না। ইটস ইয়োর সেকেন্ড প্রেগন্যান্সি, নতুন করে তো বলার কিছু নেই।”

মাথা নেড়ে হসপিটাল থেকে বের হলো প্রজ্ঞা। রিক্সায় উঠে পুনরায় অফিসের পথ ধরলো। ছয়টার আগে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এনজাম নিতে আসবে তাকে। এ দুদিন তার সঙ্গেই বাড়ি যাওয়া হচ্ছে। কাল মোহাম্মদপুর ফিরে যাওয়ার কথা বলেছে এনজাম। নিজের বাসায় যাবে, আগের মতো ঝগড়াঝাঁটি করবে, প্রণয়কে স্কুলে দিয়ে আসবে…
কিন্তু না, এনজাম এই খবর শুনলে তাকে এত দৌড়ঝাঁপ জীবনেও করতে দিবেনা। সব কাজ সে-ই করে দেবে।

ডাক্তারের কথা ভাবতেই প্রজ্ঞার মাথায় এলো, দুমাস চলছে তার গর্ভাবস্থার। দুমাস মানে ষাট দিন তো হবেই। শাফায়াতের বলা নব্বই দিনের মাঝে আনুমানিক চুয়াত্তর কী পঁচাত্তর দিন চলছে এখন। প্রজ্ঞার হাসি পেলো খুব। অর্থাৎ এই নব্বই দিনের সাক্ষী হয়েও রইলো কেউ, তারা চাইলেও কখনো সময়টা ভুলতে পারবেনা। এই ব্যক্তি ভুলতে দেবেই না।

অফিসের সামনে এসে পাঁচমিনিট দাঁড়াতেই এনজাম গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। প্রজ্ঞা নিজে থেকেই দরজা খুলে ভিতরে বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। সচরাচর এই কাজ এনজামের করতে হয়। কিন্তু সে এখন ভালো মা হয়ে যাচ্ছে, বাচ্চার খেয়াল রাখতে হবে তাকে।

এনজাম গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আড়চোখে তাকালো তার পানে। চোখেমুখে এমন আনন্দের ঝিলিক দেখে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো,
– “এত খুশিখুশি ভাব কেন? প্রমোশন হয়েছে নাকি?”

প্রজ্ঞা হাসির পরিধি বাড়িয়ে বললো,
– “অফিসে নয়, তবে কোনো এক ক্ষেত্রে। বললে তুমিও লাফিয়ে উঠবে।”

– “আচ্ছা? কী এমন প্রমোশন?”

প্রজ্ঞা মিটিমিটি হেসে শুধায়,
– “আমি কেন বলবো? গেস করো… একটা দায়িত্ব আছে তোমার।”

– “এই তুমি কদিন ধরে কী নিয়ে ঘোল খাওয়াচ্ছো বলতো আমাকে? যা বলবে স্পষ্টভাবে বলবে, এমন প্যাঁচানোর কী আছে?”

এনজামের গা-ছাড়া ভঙ্গী দেখে রাগ হয় প্রজ্ঞার। তার দিকে ঠিকঠাক নজর রাখলেই তো বুঝে যেত। ছেলেটা তাকিয়েই দেখেনা একদম। কিছু না বলেই মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো প্রজ্ঞা। এনজাম একবার দেখলো তা, ঠোঁট চেপে হেসে পুনরায় রাস্তার দিকে মনোযোগ দিলো। দশমিনিট অবধি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেও এরপর হাই টানতে টানতে সেই গিয়ে এনজামের কাঁধেই মাথা রাখলো প্রজ্ঞা। পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়তে আরো দশ মিনিট লাগলো তার। এনজাম ভালো একটা সুযোগ পেলো। একজায়গায় গিয়ে গাড়ি থামিয়ে বসে রইলো চুপচাপ। তার বর্তমান কাজ, সময় পার করা। আরো বেশ কিছু ঘণ্টা পার করতে হবে এদিক ওদিক ঘুরে। প্রজ্ঞার ঘুমিয়ে পড়াটা তার জন্য ভালোই লাভজনক।
এভাবে বেশিক্ষন থাকলে পরে ঘাড় ব্যাথা করতো প্রজ্ঞার। তাই ধীরহস্তে মাথাটা নিয়ে সিটের সঙ্গে মিলিয়ে দিলো। নিজেও বাঁকা হয়ে বসে সময় নিয়ে দেখলো তাকে।

একটা সময় ছিলো, সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো প্রজ্ঞাকে। নির্লজ্জ ছেলেদের ন্যায় তাকিয়ে থাকতো। ক্লাস মিস দিয়ে তাকে দেখার আশায় বসে থাকতো, ক্লাসের মাঝে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকতো যদি কলেজের মেয়েরা একটু এদিকে আসে! এক মেয়ের ভাবনায় পড়াশোনা ভেসেই যাচ্ছিলো একদম। কত কিছু কল্পনা করতো তখন, এখন তা ভাবলেও হাসি পায়।
ভাগ্যের লিখনে এখন সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকলেও কেউ তাকে নির্লজ্জ বলবেনা, কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবেনা, মেয়েটা একটুও বিব্রত হবেনা। সে মনেমনে খুশি হবে, লজ্জা পাবে।
অনেকদিন বাদে একাকী এতটা সময় সে দেখলো নিজের বউকে। চুল স্ট্রেইট করা তার, একদম কলেজ লাইফ থেকেই। মুখের গঠনে পরিবর্তন বলতে খানিকটা মোটা হয়েছে। যদিও এটাকে মোটা বলেনা, একেবারে টিকটিকি থেকে এখন ঠিক পর্যায়ে এসেছে। এনজাম তা নিয়েও ক্ষ্যাপায় সবসময়।

তার ঘুমকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য এনজাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো একটু পরপর। প্রজ্ঞার ঘুম ভাঙলো গিয়ে দশটা নাগাদ। এসির ঠান্ডা বাতাসে আরাম পেয়ে প্রায় তিনঘণ্টার বেশি সময় ঘুমিয়েছে। সে যখন চোখ মেললো, এনজাম গাড়ি নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। সোজা হয়ে বসে চোখ ডলে বলে সে,
– “এখনো পৌঁছোই নি? ওমা… আমার তো মনে হলো কতক্ষন যেন ঘুমোলাম।”

– “বেশি না। এই তিন ঘণ্টা হবে।”

– “ওহ আচ্ছা… কীহ!”

চোখ বড়বড় করে বললো প্রজ্ঞা। তড়িঘড়ি করে নিজের ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো দশটা বাজে। হা করে এনজামের দিকে চাইলো সে,
– “তুমি কী রাস্তা ভুলে গেছো নাকি? কয়টা বাজে দেখেছো? এই তুমি কিছু খেয়ে টেয়ে এসেছো? কথা বলোনা কেন? এনজাইমের বাচ্চা… তুই কী আমাকে কিডন্যাপ করতে চাইছিস?”

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো এনজাম,
– “কিডন্যাপ করে আর কী নেবো তোমার থেকে? সব তো আমার ই দেওয়া।”

– “পাগল টাগল হয়ে গেছো? যাচ্ছোটা কোথায় তুমি? প্রণয় বাড়িতে আছে… কান্নাকাটি করবে!”

– “কিচ্ছু করছেনা।”

– “তুমি খবর নিয়েছো?”

– “হুম। অতো বোকা না আমি।”

– “কিন্তু যাচ্ছিটা কোথায় আমরা? তোমার মতলবটা কী?”

এনজাম মৃদু হেসে শুধায়,
– “চলো, একদিন নাহয় রাত্রীবিলাস ই করি। চাঁদ, তুমি আর আমি।”

প্রজ্ঞা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে ফিঁক করে হেসে ফেললো। ভেংচি কেটে বললো,
– “আমি থাকতে আবার চাঁদ কীসের? সতীনের ঘর করতে পারবোনা।”

– “আপাতত এগিয়ে বোসো। এত দূরে থাকলে মাঝে তো কেউ ঢুকে পড়বেই।”

প্রজ্ঞা এগিয়ে এলো। এনজামের বাহু জড়িয়ে ধরে বললো,
– “তা তো এমনিতেও আসবে।”

– “কী করে?”

– “কোথায় যাচ্ছি সেটা বলো।”

এনজাম বললোনা। নানান কথার মাঝে কাঁটালো আরো দেড়ঘন্টা। রাত তখন সাড়ে এগারোটার বেশি বাজে। প্রজ্ঞা হাই টেনে বললো,
– “সারারাত কী ঘুরবে এভাবেই? লং ড্রাইভে এসেছি আমরা? সে হলে হোক, তার আগে কিছু তো খাওয়াও। মানুষ এভাবে বউকে খালি পেটে রাখে?”

এনজাম তার দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি ঘোরালো। এতক্ষন সে একই পথে ঘুরেছে বারবার। এখন এগোলো আসল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এগারোটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ একটা ফাইভ স্টার হোটেলের সামনে এসে থামলো তার গাড়ি। প্রজ্ঞাকে নিয়ে নেমে দাঁড়াতেই সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– “এখানে? রাত বাজে ক’টা? খাবারদাবার আদেও পাবে কিছু?”

এনজাম তার হাতটা ধরে বললো,
– “দেখি পাওয়া যায় কিনা।”

একসঙ্গে ভিতরে গেলো তারা। রিসেপশন এ এসে নিজের নাম এবং কিছু তথ্যাদি বলতেই একটি লোক হাসিমুখে চাবি এগিয়ে দিলেন। এনজাম মৃদু হেসে প্রজ্ঞার কাছে এসে তার হাতটা ধরে সিঁড়ির দিকে যেতেই সে চোখ কপালে তুলে বললো,
– “ভাই আমাকে আগে কিছু খাওয়া তুই! তারপর যেখানে খুশি যাবি, আমি কিচ্ছু বলবোনা। এখন যদি খিদের জ্বালায় আমি সেন্সলেস হয়ে যাই তার দায়ভার কী তুমি নেবে? আরে! কথা বলোনা কেন?”

এনজাম তার হাতটা ধরেই দোতলার শেষপ্রান্তে এসে একটা রুমের সামনে দাঁড়ায়। চাবির সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে দরজা খুলে প্রজ্ঞাকে নিয়েই ভিতরে প্রবেশ করলো, সঙ্গেসঙ্গে দরজাটাও লক করে দিলো। পুরো ঘর একেবারেই অন্ধকার। প্রজ্ঞা ভয় পায়নি। তবে এনজামের হাতটা ধরে বলে,
– “লাইট জ্বালাও আগে। এত বড় হোটেলে কী ইলেক্ট্রিসিটির সমস্যা নাকি?”

– “আমি থাকতে আবার ইলেক্ট্রিসিটি চাই কেন? আমি কী সতানের সঙ্গে ঘর করবো নাকি?”

– “সতান?”

– “ঐতো… সতীন সতান, একই হলো।”

প্রজ্ঞা এবার খানিকটা রেগে গিয়েই বলে,
– “নাটক লাগিয়েছো তুমি? বলছি আমার খিদে পেয়েছে… কিছু না খাইয়ে রেখে সে ঢং করছে!”

অন্ধকারে পা ফেলে সামনে এগোতেই কিছু একটাতে পা বেজে পিছনদিকে পড়ে যেতে নেয় প্রজ্ঞা। একমুহূর্তের জন্য আত্মা বুঝি বেরিয়েই এলো তার! চেঁচিয়ে ওঠামাত্রই এনজাম পিছন থেকে আগলে নিলো তাকে। প্রজ্ঞার বুকটা কাঁপছিলো তবুও। শার্ট চেপে ধরে জাপটে ধরলো এনজামকে। এনজাম তার বাহু ধরে মাথায় হাত রেখে বলে,
– “আছি তো আমি, কিচ্ছু হয়নি। এত ভয় পাচ্ছো কেন?”

প্রজ্ঞা চোখ বুজে ঘনঘন দম ফেলে বললো,
– “ভয় পাওয়ার কারণ আছে। আমি…”

হুট করে ঘরের আলো জ্বলে ওঠায় চোখ বুজে ফেললো প্রজ্ঞা। মাথার উপর ফুলের ন্যায় কিছু একটা পড়তেই চোখ মেলে চাইলো। পরক্ষণেই চাইলো নিজের আসেপাশে। ঘরের কিনারে টেবিলের উপর ছোট্ট একটা কেক রাখা। তবে ঘরে তেমন কোনো সাজসজ্জা নেই। পুরাতন বিছানার চাদর, ফাইভ স্টার হোটেলের সঙ্গে এমনটা যায়না। প্রজ্ঞা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
– “এসব কী?”

এনজাম ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষনেই শব্দ করে হেসে তাকে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– “আজ কত তারিখ ম্যাডাম?”

– “আজ… হবে পঁচিশে মার্চ।”

তারিখটা আরো একবার মস্তিষ্কে বাজতেই হতবাক দৃষ্টিতে চাইলো প্রজ্ঞা। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ফাঁকা স্থান সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই। চোখদুটো চিকচিক করে উঠতেই হতবিহ্বল কণ্ঠে শুধায়,
– “সেভেন ইয়ারস?”

এনজাম নিচু হয়ে এলো। নাকে নাক ঘষে বললো,
– “জি… সাত বছর! আপনার জ্বালাতন সহ্য করতে করতে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। এখন তো দেখছি নিজেই বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন। স্পেশাল দিনও মাথায় থাকছেনা।”

প্রজ্ঞা আরো একবার আসেপাশে চোখ বুলিয়ে বলে,
– “কিন্তু… এখানে?”

এনজাম বুকে হাত গুঁজে বললো,
– “সাত বছর আগে এইদিনে আপনাকে নিয়ে এখানেই এসেছিলাম। তখন জায়গাটা অন্যরকম ছিলো। ফাইভ স্টার হোটেল নয়, সাধারণ একটা আবাসিক হোটেল, মনে পড়ে? ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এসে খুব কষ্টে একটা রুম ম্যানেজ করা, আবার সেদিনের রাতটাও কেটেছিলো এখানেই। রুলস অনুযায়ী সেটা বাসর রাত হলেও… পরদিনের চিন্তা নিয়ে আর বাসর করা হয়ে ওঠেনি। রাতটা আপনার হাত ধরে সেই মেঝেতে বসেই কাটিয়েছি। হাহ… মানুষ এভাবেই ভুলে যায়।”

হতাশ শ্বাস ফেললো এনজাম। প্রজ্ঞা অবাক চোখে চেয়ে শুধায়,
– “আমার কিছু বিশ্বাস হচ্ছেনা!”

এনজাম ঠোঁট চেপে কাছে এসে হাতটা ধরলো তার। মাথা ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
– “বছরখানেক বাদে কোরো বিশ্বাস। এসো এখন… খিদের কথা বলে তো মাথা খেয়ে ফেলছিলে একদম! আগে কেক কাটো, তারপর আনছি তোমার খাবার।”

প্রজ্ঞা এগোতে না দিয়ে হাতটা চেপে ধরলো তার। ছলছল নয়নে তাকিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। কয়েকবার নাক টেনে কাপাকাপা গলায় বললো,
– “তোমার মনেও আছে এসব?”

এনজাম হাসে নিরবে। কানেকানে বলে,
– “কদিনে মাথার উপর বিশাল চাপ প্রয়োগ করে এসব স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে এনেছি। এবার এসো, কেক কাটো।”

প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরেই টেবিলটার সামনে এলো সে। ছুড়িটা প্রজ্ঞার হাতে ধরিয়ে নিজেও তার উপর হাত রেখে কাটলো এক পাউন্ডের ব্লাক ফরেস্ট কেকটা। একপিস তুলে ধরলো প্রজ্ঞার মুখের কাছে। সে যেন ভাষাহীন হয়ে পড়েছে। সারপ্রাইজ দেওয়ার নিয়ম কিংবা এতে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সঠিক পদ্ধতি তাদের কারোই জানা নেই। অতি প্রেমের মনভোলানো বাণী এনজামের মুখ থেকে সহজে বেরোয় না। সে ওভাবে প্রকাশ করতে পারেনা। মাঝেসাঝে বলে ফেললে ঘাবড়ে যায় প্রজ্ঞা। হাসফাস লাগে খুব, ঠিক বর্তমান সময়ের মতো।
একটুখানি কেক মুখে নিয়ে বাকিটা এনজামকে খাওয়ালো সে। দুষ্টুমি করে কিছুটা ক্রিম তার গালে লাগিয়ে দিলো এনজাম। আবার তা সরিয়েও দিলো নিজেই, তার ওষ্ঠদ্বয়ের মাধ্যমে। তবে এমন সুন্দর মুহূর্ত প্রজ্ঞার শরীর সইতে পারলোনা বোধ হয়। পেট মুচড়ে উঠতেই মুখে হাত চেপে দৌড়ে বাথরুমে চলে যায় সে। এনজাম হতভম্ব হয়ে ছুটে যায় তার পিছনে। পাশে এসে ধরে তাকে। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
– “কী হলো? শরীর খারাপ লাগছে?”

খানিকক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে মুখ ধুয়ে কুলি করলো প্রজ্ঞা। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ঢলে পড়লো এনজামের বুকে। এনজাম তার গালে হাত রেখে কিছু ভেবেই করুণ স্বরে বলে,
– “এই রে… আমার একদম মনেই ছিলোনা তোমার যে খালি পেটে মিষ্টি কিছু খেলে বমি পায়। সরি সোনা!”

তার কথা শুনে হাসি পেলো প্রজ্ঞার। এনজাম ধরে নিয়ে বিছানায় বসালো তাকে। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়েই বললো,
– “বসো একটু, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

প্রজ্ঞা চেয়েচেয়ে দেখল তার কাজকারবার। দরজা খুলে বেরিয়ে যেতেই মুখ খুলে হেসে উঠলো সে। প্রীতি তাকে বোকা বললে এই ছেলেকে কী বলবে? এমন একটা ভাব করছে যেন কিছুই বুঝতে পারেনা!

এনজাম ইচ্ছে করেই ভাত,ডাল,ভর্তা,ডিম নিয়ে এলো। আগে থেকেই বলা ছিলো বলে কোনো সমস্যা হয়নি। আজকের দিনে একটু বেশিই যত্নশীল হলো সে। পাশে বসে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো বউকে। যেভাবে সাত বছর আগে খাইয়ে দিয়েছিলো নতুন বউকে, এই সাদামাটা খাবার। তাদের বাসর ঘর ফুল দিয়ে সাজানো ছিলোনা। বরং পুরোনো, ভাঙাচোরা একটা ঘর ছিলো। পরদিন সকালের দিকে পাপিয়া খোঁজ পেয়ে যান প্রজ্ঞার। আর একসাথে থাকা হয়নি তাদের। সকাল সকাল বাসা খুঁজতে যাওয়া হয়নি।

খাওয়ানো শেষে হাত ধুয়ে এলো এনজাম। কিছু একটা মনে পড়তেই অফিস ব্যাগ থেকে সাইনপেন বের করে নিয়ে বসলো প্রজ্ঞার পাশে। এই কাজটা তাদের পরিচিত। তবে প্রজ্ঞার দু হাতেই বিয়ের মেহেদী। মাঝে অবশ্য ‘E’ বড় করেই লেখা আছে। তবুও সে জায়গা খুজে নতুন করে নিজের নাম লিখে দিলো, লাভ একে তার মাঝে আটকে রাখলো নিজের নামটা। এরপর সাইনপেনটা এগিয়ে দিলো প্রজ্ঞার দিকে। সে হাতে নিয়েই মনে করিয়ে দিলো,
– “গতবছর লিখে দাওনি।”

এনজামের হাতটা টেনে নিতেই সে নিচু স্বরে বললো,
– “তুমিও দাওনি। নিজে নিজে লিখেছিলাম।”

প্রজ্ঞা নিজের নামটা তার হাতে লিখে দিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,
– “আমিও লিখেছিলাম। ব্রোকেন হার্ট এর ভিতর।”

এনজাম নিজের হাতের দিকে চেয়ে বলে,
– “হার্ট জুড়লো?”

– “আবার তো ভেঙে দেবে পরের বছর!”

এনজাম ঘাড়ে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে আনলো তাকে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
– “তার পরের বছর আবার জুড়ে দেবো।”

প্রজ্ঞা ঠোঁট কামড়ে শুধায়,
– “এভাবে কথা বলবেনা। ভালোলাগেনা… কান্না পায় শুধু। যেমন আছো তেমনই সই, এত ভালোবাসা সহ্য হচ্ছেনা।”

– “কেন?”

প্রজ্ঞা চোখে চোখ রাখে তার। গালে হাত ছুঁইয়ে আবেগী কণ্ঠে বলে,
– “এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করে। এমন এক জায়গা, যেখানে ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু থাকবেনা। না রাগ, না অভিমান, না ঝগড়া… কিচ্ছু না।”

একটু এগিয়ে তার গালে ঠোঁট চাপলো প্রজ্ঞা। মুচকি হেসে বললো,
– “ইউ ডিজার্ভ আ রিটার্ন সারপ্রাইজ। আজ বারোটায় আমায় চমকে দিলে না? কাল ঠিক বারোটার আগে, বিশেষ দিনের শেষক্ষণে তোমাকেও একটা সারপ্রাইজ দেবো। একদম চমকে যাবে।”

ভ্রু কুঁচকালো এনজাম। প্রজ্ঞা একদৃষ্টে চেয়ে রইলো অনেকটা সময়। অনুরোধ এর স্বরে বললো,
– “আমার এই সময়টা শেষ না হোক… প্লিজ!

এনজাম মৃদু হেসে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো তাকে। চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে শুধায়,
– “আগামী চব্বিশ ঘণ্টা আমি তোমার নামে লিখে দিলাম প্রজ্ঞারাণী। বিনিময়ে বাকি জীবনটা এই এনজাইমকেই দিও নাহয়।”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৮
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

২৫ শে মার্চ, সকাল নয়টা… ২০১৭ সালের এইদিনে এই সময়ে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা শেষবারের মতো একবার নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবছিলো। যা করছে, তা ঠিক হচ্ছে কিনা। তাদের ভাবনা দু মিনিট ও স্থায়ী হয়নি, এনজাম আর ভাবাভাবির মধ্যে যেতেই চায়নি। মেয়েটিকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলো কাজি অফিস। সঙ্গে ছিলো স্বজন এবং আরো দুটি মেয়ে।

আজ আপাতত তারা একাই আছে। একেবারে একা নয়… পার্লারের মেয়েরা বেশ মনোযোগী হয়ে সাজাচ্ছে প্রজ্ঞাকে। এনজাম পাশে সোফায় বসে হাই তুলছে, সঙ্গে দেখছে বউকে। প্রজ্ঞার চোখ দেখেও মনে হচ্ছে সে যেকোনো মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়বে। অস্বাভাবিক নয়, গতকাল রাতে কান্নাকাটির পর্ব মিটলেও তাদের কারো চোখে ঘুমপাখি ধরা দেয়নি। প্রজ্ঞা সন্ধ্যা থেকে ঘুমিয়েছিলো বলে তার কোনো সমস্যা না হলেও এনজাম ঘুমে ঢুলছিলো শেষরাতে। প্রজ্ঞা জোর করেই তাকে জাগিয়ে রেখেছে। তুলে ধরেছে নিজের নানান অভিযোগ। এনজাম ঠিকই বলেছিলো, এই চব্বিশটা ঘণ্টা সে লিখেছে প্রজ্ঞার নামে। তাইতো মুখ থেকে একটা পাল্টা অভিযোগ ও বেরোয়নি তার।
সকালে হোটেল থেকে খেয়েই তারা চলে এসেছে পার্লারে। এতক্ষনে প্রজ্ঞা বেশ ধরতে পেরেছে এনজাম কী করতে চায়। তাইতো বাধ্য মেয়ের ন্যায় তার কথা মেনে চলছে। সোফায় এনজামের পাশেই রাখা ছিলো একটা লাল টকটকে বেনারসি। তার উপর বউ ওড়না, গহনা। প্রজ্ঞা কতক্ষন একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। এগুলো তার, গায়ে জড়িয়ে সম্পূর্ণরূপে বউ সাজবে সে। হোক একাকী, পরিবারবিহীন, এনজাম বর সেজে দাঁড়াবে তার পাশে, একেবারে বধূবেশে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবে।

সাজগোজ শেষে শাড়ি পড়ানোর বেলায় এনজাম সোজা হয়ে বসে বাঁধা দিলো তাদের। এই কাজটা সে-ই করুক, বরাবরের ন্যায়। দুটো মেয়ে সরে গেলেই সে এসে খুব যত্নের সহিত শাড়ি পরালো বউকে। সব ঠিকঠাক হলে চেয়ারে বসিয়ে একেএকে সব গহনাগুলোও পরিয়ে দিলো। সুযোগ বুঝে খুলে রাখলো গলার চেইন আর হাতের আঙটিখানা। সবশেষে বউ ওড়নাটা মাথায় তুলে দিতেই প্রজ্ঞা মুচকি হেসে বললো,
– “কেমন লাগছে?”

এনজাম আয়নায় চেয়ে দেখলো তাকে। খুব বেশি সাজগোজ এনজামের পছন্দ নয় ঠিকই, তবে একটি মেয়ের বধূবেশের সাজ সবচেয়ে ভিন্ন। মুখে মেকআপের প্রলেপ থাকলেও এই সাজে তাদের অমায়িক লাগে। এনজাম প্রজ্ঞাকে দেখে বিশ্বাস করে নিলো এই কথা। মাথায় থুঁতনি ঠেকিয়ে তার দুই বাহু চেপে ধরে বললো,
– “আশ্চর্য! আমার বউয়ের মতো লাগছে!”

ঘাড় ঘুরিয়ে হাসলো প্রজ্ঞা। খানিকটা গাল ফুলিয়েই বললো,
– “কিন্তু আপনাকে আমার বরের মতো লাগছেনা। মনে হচ্ছে কোথাও কামলা খেটে এসেছেন।”

এনজাম একরাশ হতাশামিশ্রিত দম ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পাশে দাঁড়ানো মেয়েদুটির দিকে তাকিয়ে বলে,
– “ছেলেদের জন্য কোনো মেকআপ টেকআপ নেই আপারা? সব কী শুধু মেয়েদের জন্যই?”

একজন মেয়ে হেসে বলে,
– “কেন থাকবেনা স্যার? আপনি বসুন, ফেইস একদম চকচকা ফকফকা বানিয়ে দিচ্ছি।”

প্রজ্ঞা চোখ বড়বড় করে বলে,
– “আসতাগফিরুল্লাহ…থাক ভাই! আমার জামাইকে হাফ লেডিস বানাতে হবেনা। সে এমনিতেই সুন্দর।”

এনজাম মুচকি হেসে নিজের পাঞ্জাবী,পায়জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। চেঞ্জ করে এসে প্রজ্ঞার পিছনে দাঁড়িয়ে চুলটা আছড়ে নিয়ে বললো,
– “এবার ঠিকঠাক? লাগে বরের মতো?”

প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ থেকে একটুখানি কাজল আঙুলে নিয়ে এনজামের কানের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে বললো,
– “খুবই বিশ্রি! দেখেই বমি পাচ্ছে আমার… ছিহঃ!”

চোখ কুঁচকে হেসে ফেললো এনজাম। প্রজ্ঞার হাতটা ধরে মেয়ে দুটোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো পার্লার থেকে। গাড়ির সামনে আসতেই বললো প্রজ্ঞা,
– “প্রণয়কে না নিয়ে যাবো বাসায়? ছেলেটাকে নিয়ে চলো না প্লিজ!”

গাড়িতে উঠে সে আবারো বলে,
– “ছবি টবি তুলবোনা একটু? কোনো ভালো জায়গায় চলো। একটা স্মৃতি তো রাখতে হবে, নইলে এত সেজেগুজে লাভ কী?”

এনজাম গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে পাশে তাকিয়ে বলে,
– “চলো… দেখি কোথায় যাওয়া যায়। কেমন ভালো জায়গায়।”

প্রজ্ঞা নিজের ফোনটা বের করে ক্যামেরায় দেখেই গেল নিজেকে। বর তার প্রশংসাও করতে পারেনা ঠিকঠাক। কী সুন্দর লাগছে তাকে! প্রশংসা করতে করতেই তো মুখে ফ্যানা তুলে ফেলার কথা। সেখানে সে দুটো কথা বলেই খালাস। যদিও আজ রাগ হলোনা প্রজ্ঞার। বারেবারে মোহিত দৃষ্টিত তাকালো বরের পানে। ছেলেটা তাকে নিয়ে কত ভাবে! তার শখ,আহ্লাদ,ইচ্ছে সবটা মাথায় রাখে। এগুলো সে মনে রাখবে, কখনো ভুলে যাবেনা।
ধ্যানমগ্ন প্রজ্ঞার হুশ ফিরলো গাড়ি ব্রেক কষার পর। এনজাম কাউকে কল করে বললো,
– “আছেন আপনারা? আসতে পারি? আচ্ছা আচ্ছা।”

কলটা কেটেই বললো প্রজ্ঞাকে,
– “নেমে এসো।”

প্রজ্ঞা আসেপাশে তাকিয়ে জায়গা বোঝার চেষ্টা করলো। তারই মাঝে এনজাম পাশে এসে হাত বাড়িয়ে তাকে বের হবার নির্দেশ করলো। মুচকি হেসে তার হাত ধরেই বের হলো প্রজ্ঞা। কয়েক সেকেন্ড সামনে তাকিয়ে থাকতেই পা দুটো থমকে যায় তার। এই জায়গা চিনতে তার মোটেই অসুবিধা হচ্ছেনা। তৎক্ষণাৎ চোখ তুলে উপরে চাইলো সে। দোতলায় বোর্ডের উপর গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ‘কাজি অফিস’।মরিচা পড়েছে এখন, বেশ পুরাতন দালান। বিস্মিত নয়নে এনজামের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, সে ওকে এখানে কেন নিয়ে এলো। এনজাম তার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো। কাছে এসে কানেকানে বললো,
– “রিল্যাক্স… উপরে তো চলো আগে।”

এনজাম তার হাত ধরে এগোলো। চিকন সিড়ি বেয়ে ধীরেধীরে উঠলো উপরে। স্তব্ধ চিত্তে তার সঙ্গে চললো প্রজ্ঞা। চারিপাশে কী চলছে তা না বুঝেই দোতলায় পৌঁছোলো তারা। ঠিক তখনি কেউ মাম্মা বলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। অকস্মাৎ ঘটনায় কেঁপে উঠলো প্রজ্ঞা। পরক্ষণেই প্রণয়কে দেখে আকাশ থেকে পড়লো যেন! চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো আরো কিছু পরিচিত মুখ। প্রীতি,স্বজন এবং তাদের একটু পাশে শাফায়াত। সকলের মুখে বিস্তর হাসি লেগে আছে। প্রজ্ঞা ছেলের দিকে তাকালো এবার। ঠিক এনজামের মতো একটা পাঞ্জাবী পরা, মাথায় সোনালি রঙের টুপি। কী অপূর্ব লাগছে তার ছেলেকে! বিস্ময়তা কেটে মুখে হাসি ফুটলো তার। প্রণয়ের মাথায় হাত রাখার পূর্বেই এনজাম কোলে তুলে নিলো তাকে। প্রজ্ঞার দিকে নির্দেশ করে জানতে চাইলো,
– “দেখোতো বাবাই, মাম্মাকে সুন্দর লাগে?”

প্রণয় তাকিয়ে বললো,
– “হ্যা! অনেক সুন্দর লাগে।”

চোখদুটো ভিজে উঠলো প্রজ্ঞা। প্রণয়ের গালে হাত রেখে বললো,
– “আমার বাচ্চাটাকে সবার চেয়ে সুন্দর লাগে, মাশ আল্লাহ! কে সাজিয়ে দিয়েছে এত সুন্দর করে?”

প্রণয় স্বজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,
– “ঐযে, খালু সাজিয়ে দিয়েছে।”

প্রজ্ঞা সকলের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
– “আপনারা?”

স্বজন স্মিত হেসে একহাতে প্রীতিকে আগলে রেখে বলে,
– “সাক্ষী ছাড়া বিয়ে হয় নাকি শালিকা?”

– “বিয়ে!”

চকিত দৃষ্টিতে এনজামের দিকে তাকাতেই সে কাছে এগিয়ে বললো,
– “বউ-জামাই সাজলাম। বিয়ে করবোনা?”

প্রজ্ঞা হতবাক স্বরে শুধায়,
– “তুমি কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো?”

এনজাম সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– “আজ একটা পাগলকেই দেখবে ডিয়ার।”

তাদের কথার মাঝে প্রীতি তাগাদা দিয়ে বললো,
– “কথা পরে বলিস। তোদের জন্য কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি। আগে মেইন কাজ শেষ কর, তারপর বাকি সব।”

প্রজ্ঞার কাছে এসে তার দু-গালে হাত রেখে কপালে একটা চুমু খেলো প্রীতি। আবেগী কণ্ঠে বললো,
– “কী সুন্দর লাগছে রে তোকে! নজর না লাগুক কারো। আয়…”

হাত ধরে নিয়ে প্রজ্ঞাকে একটা চেয়ারে বসালো প্রীতি। পাশেই বসলো এনজাম, তার কোলে প্রণয়। প্রজ্ঞার মনে হলো সে এক ঘোরের মধ্যে আছে। স্থানটা তেমনভাবে বদলায়নি, সাত বছর আগেও অনেকটা এমনই ছিলো। শুধু তখন তাদের মুখে এমন হাসি ছিলোনা, পরনে বিয়ের পোষাক ছিলো, এত সাজসজ্জা ছিলোনা।
কাজি সাহেব জিজ্ঞেস করার পূর্বেই এনজাম প্রণয়ের গাল টেনে জানালো,
– “সাক্ষী হিসেবে তিনজনকে রাখবেন। পিছনের দুই পুরুষ। আর…”

একটু থামে সে। প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আবারো প্রণয়ের গালে চুমু খেয়ে বলে,
– “সর্বোচ্চ সাক্ষী হিসেবে একে রাখবেন। এনাম খান প্রণয়… তার চেয়ে বড় সাক্ষী ইহজগতে দুটি নেই।”

এনজাম লক্ষ্য করলো, প্রজ্ঞার মুখে বুলি নেই। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে শুধু। সেই চোখে তাকানোর শক্তি হলোনা এনজামের। একটা শক্ত ঢোক গিলে জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। কাজি সাহেব যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন, প্রজ্ঞার হাসফাস লাগতে শুরু করলো। আশ্চর্য! এমনটা তার আসল বিয়ের সময়ও লাগেনি। বুক কাঁপেনি, চোখে জল আসেনি, গলাও আটকে আসেনি। অথচ এবারে তার অশ্রু বাধ মানলো না। চোখ নামিয়ে নিতেই গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। কাজি যখন কবুল বলতে বললেন, সেই বারিধারার মাত্রা বৃদ্ধি পেলো আরো। কান্নার তোপে কেঁপে উঠলো শরীরটা। এনজাম ফিরে চাইলো তার দিকে। কেন কাঁদছে মেয়েটা? সে কি সন্দিহান আজ? নাকি এই অশ্রু তাদের ফেলে আসা কঠিন সময়ের চিহ্নমাত্র? আজকের এই অশ্রুর দ্বারা কি সে অতিতের সব দুঃখকষ্ট কে বিদায় জানিয়ে এক নতুন ভবিষ্যতে পদার্পন করতে চাইছে?

প্রণয়কে একহাতে ধরে রেখে অন্য হাতটা প্রজ্ঞার কাঁধে রাখলো এনজাম। সে চোখ তুলে তাকাতেই বৃদ্ধাঙ্গুলের দ্বারা চোখ মুছিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
– “উঁহু… কাঁদেনা।”

প্রজ্ঞার ঠোঁট ভেঙে এলো। তা দেখে ফুঁপিয়ে উঠলো প্রণয়। বাবাকে অনুকরণ করে মায়ের চোখ মুছিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
– “মাম্মা কাঁদেনা।”

প্রজ্ঞা কান্নার মাঝেও হেসে ফেললো। তার ছোট্ট হাতখানা ধরে ঠোঁটের সামনে এনে চুমু খেলো দুবার। এনজাম অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। নাকের পাটা কাঁপলো তারও। চোয়াল শক্ত রেখে ফু দিয়ে দম ছাড়লো। চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু আড়াল করতে শক্ত করে চেপে ধরলো চোখদুটি। সে চাইলেও কখনো বোঝাতে পারবেনা এই মেয়েটাকে, সে যে তার কত শখের! এ কথা ভাষায় ব্যক্ত করার সাধ্যি নেই তার, কখনো হয়ে উঠবে না বোধ হয়।

নিজের গালে প্রণয়ের নরম হাতের স্পর্ষ পেতেই হাত সরিয়ে চোখ মেললো এনজাম। প্রণয় তার সমগ্র মুখে হাত বুলিয়ে একইভাবে বললো,
– “কাঁদেনা বাবা।”

এনজাম অবাক চোখে দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই শক্ত হাতে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো তাকে। প্রজ্ঞার দিকে চেয়ে অন্যহাতে তাকেও কাছে টেনে নিলো। ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বললো,
– “কেউ কাঁদছেনা বাবা, সবাই হাসছে।”

প্রজ্ঞা তার জীবনের দুটি বিশেষ মানুষের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি টানলো ঠোঁটে। আসলেই সবাই হাসছে। তার পেটে যে আছে, সেও নিশ্চই বাবা মায়ের এই ভালোবাসা দেখে আনন্দে হাসছে।
কান্নাকাটির পাঠ চুকিয়ে একে অপরকে দ্বিতীয়বারের মতো কবুল করলো তারা। জুড়ে থাকা নামটা আবারো জুড়ে দিলো নতুনভাবে। দুজন বিশেষ সাক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে। তাদের একজন অবশ্য ভূমিষ্ঠ হয়নি, তবে মায়ের পেটে তার অস্তিত্ব বিদ্যমান।

শাফায়াত তাদের এই আবেগঘন মুহূর্ত দেখে আপনমনে শুধায়,
– “এদের নিয়ে একটা ডায়েরী লেখা উচিৎ। যার নাম দেওয়া হবে, পাগলের প্রেমকাহন।”

প্রীতি হেসে উঠে বললো,
– “আপনিই লিখে ফেলুন। ভবিষ্যতে ওদের বাচ্চারা পড়বে আর হাসবে। ফ্রিতে বিনোদন পেয়ে যাবে।”

স্বজন বিরোধ জানিয়ে বললো,
– “উঁহু। শুধু বিনোদন নয়। এদের নিয়ে ভাবতে পারলে অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়। ভালোমন্দ মিলিয়েই যে মানবজাতি,তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক সুন্দর ভালোবাসার দর্শন পাওয়া যায়, তার তীক্ত সময়ের সাক্ষীও হওয়া যায়।”

প্রীতি তাকালো তার পানে। লোকটা সুন্দর করে কথা বলে। কিছুদিন কাছে থাকলে সে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য।

কবুল বলার পরমুহূর্তে এনজাম প্রজ্ঞার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
– “সাত বছর আগে নিজের প্রেমকে সঙ্গীরূপে গ্রহণ করেছিলাম। সে প্রেমের গভীরতা জানিনা আমি। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই প্রেমকে কেবল প্রেম বলতে পারছিনা, অভ্যাস বলতে হচ্ছে। আজ নিজের এক অভ্যাসকে গ্রহণ করলাম। আরো একবার বললাম, ‘তুমি আমার আজন্মের অভ্যাস হয়ে যাও। এমন অভ্যাস, যাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে আমার।’
আমার অতি সাধনার অর্ধাঙ্গিনী, রংধনু হয়ে এই প্রেমিকের মনের আকাশ সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব দিলাম আপনাকে। বিনিময়ে স্বামী হিসেবে আপনাকে চিরজীবন ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।”

— — —
কাজি অফিস থেকে বেরিয়ে তারা ঘুরলো নানান জায়গায়। পার্ক থেকে শুরু করে রেস্তোরা, সবখানে বর বউয়ের সাজে বাচ্চা সমেত ঘুরে বেরালো এক নবদম্পতি। আশ্চর্যজনকভাবে প্রজ্ঞাও আজ বেশ সুস্থ রইলো, এত ঘোরাফেরার পরও তার অস্থির লাগলোনা, শরীর খারাপ করলোনা। বাচ্চাও বুঝি আজকের এই সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করলো!

ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় দেড়মাস বাদে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো প্রজ্ঞা। এমন বউয়ের সাজে আনজুম দেখে ফেললে লজ্জায় পড়তে হতো প্রজ্ঞাকে। ভাগ্যেস সে আজ বাড়িতে নেই! প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ায় অ্যানি এসে নিয়ে গেল তাকে। প্রজ্ঞা দেখলো তার ঘরের দরজাটা ভিড়িয়ে রাখা। পা বাড়াতে নিলেই এনজাম অকস্মাৎ পাজাকোলে তুলে নিলো তাকে। প্রজ্ঞা তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– “প্লিজ! আর সারপ্রাইজ নেওয়া সম্ভব না আজ।”

এনজাম মিছে বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
– “আমি কী রোজরোজ অভিনয় করবো নাকি?”

প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “আজকের এসব অভিনয় ছিলো?”

– “তা নয়তো কী? কতদিন বসে প্রাকটিস করলাম!”

বলতে বলতে পা দিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো এনজাম। নাকে মিষ্টি ফুলের গন্ধ পেতেই কথা থেমে যায় প্রজ্ঞার। সমগ্র ঘরে চোখ বোলাতেই আরো এক পাল্লায় অবাক হয়। এসব কে করলো? বিছানায় ফুলের ছড়াছড়ি, বেডসাইড টেবিলের ফুলদানী তেও তাজা রজনীগন্ধা ফুল। প্রজ্ঞাকে নিয়ে এসে বিছানায় বসায় এনজাম। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে দরজা লাগিয়ে বাতি নিভিয়ে দেয় হুট করে। প্রজ্ঞা চমকে উঠে তাকানোর পূর্বেই লাইটার জ্বালিয়ে টেবিলে, ওয়ারড্রবের উপর, বারান্দার কাচের সামনে সাজিয়ে রাখা ক্যান্ডেলগুলো জ্বালিয়ে দেয়। এগুলো খেয়াল ই করেনি প্রজ্ঞা। আর কী কী চমক দেবে আজ এই ছেলে?
লাইটারটা রেখে দিয়ে পুনরায় দরজার সামনে যায় এনজাম। কী বুঝেই ফিরে আসে, চট করে প্রজ্ঞার মাথায় থাকা বউ ওড়নাটা টেনে নামিয়ে দেয় গলা অবধি। দরজার সামনে গিয়ে বলে,
– “লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন… ধরো তোমার নতুন বর দরজায় নক করে ভিতরে আসছে।”

ঠিকই দরজায় খটখট শব্দ করে গলা খাঁকড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো এনজাম। প্রজ্ঞার সামনে এসে মুচকি হেসে ওড়নাটা সরিয়ে থুঁতনি তুলে ধরে বললো,
– “মাশ আল্লাহ! অমাবস্যার চাঁদ আজ ঘরে নামলো কী করে? জীবনটাই অন্ধকার ঠেকছে!”

আহাম্মকের ন্যায় চেয়ে থেকে তার বাহুতে দুটো চ’ড় মারলো প্রজ্ঞা। নাক ফুলিয়ে বললো,
– “কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না, এটা ভুলেই গিয়েছিলাম!”

এনজাম নিজেও ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “তো সালাম দাওনি কেন? বাসর ঘরে আগে বরকে সালাম করতে হয় জানোনা? বাড়ির লোক শিখিয়ে দেয়নি নাকি?”

প্রজ্ঞা বিড়বিড় করে বলে,
– “বাচ্চা পেটে নিয়ে কে বাসরে বসে থাকে?”

– “কী বললে?”

– “তোমার মাথা।”

ওড়নাটা ফেলে উঠে দাঁড়াতেই এনজাম পিছন থেকে পেঁচিয়ে ধরলো তাকে। গালে আঙুল ছুঁইয়ে বললো,
– “বরের থেকে এই দিনে পালাতে আছে ম্যাডাম? কী মারাত্মক গুনাহ এর কাজ করছেন জানেন?”

প্রজ্ঞা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তার পানে। অমনি হেসে ওঠে এনজাম। আরো আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে বলে,
– “তোমাকে নতুন বউ ই লাগছে, সত্যি বলছি। নতুন বউয়ের রাগ করতে নেই। তাকে লাজে রাঙা হয়ে থাকতে হয়, গাল ফুলিয়ে নয়।”

প্রজ্ঞা ঠোঁট চেপে হাসলো,
– “এক বাচ্চার বাপের কাছে আর কী লজ্জা পাবো শিখিয়ে দাও। তারপর ট্রাই করছি।”

– “বাচ্চার বাপের আগে তোমার জামাই, সেটা ভাবো।”

চোখ বুজে মুচকি হাসে প্রজ্ঞা। এনজাম মিটিমিটি হেসে তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে বলে,
– “কতদিনের বউ আনবক্সিং এর শখ আমার!”

– “ওমা… কোনো গিফট বক্স নাকি আমি?”

এনজাম কানেকানে বললো,
– “তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু।”

মাথার টিকলিটা আগে খুললো এনজাম। সিঁথির মাঝে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে খুলে দিলো কানের দুল। এরপর গলার হার। বারকয়েক ঠোঁট স্পর্ষ করলো ঘাড়ের সেই উন্মুক্ত অংশে। প্রজ্ঞা লম্বা দম টেনে এক ভেজা ঢোক গিয়ে আচমকা উঠে দাঁড়ায়। এনজামের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার বুকে মাথা রেখে বলে,
– “আজ এতগুলো সারপ্রাইজ দিলে। বলেছিলাম তোমাকেও একটা সারপ্রাইজ দেবো, বারোটার আগে।”

এনজাম পাত্তা না দিয়ে খুলে দিলো তার হাতের রুলিদুটো। প্রজ্ঞা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “একটা কথা বলার আছে।”

এনজাম তার একগালে হাত রেখে অপর গালে আঙুল ছুঁইয়ে বাঁধা দেয়,
– “তোমার কথা বলার দিন আজ নয়। আজকে আমি বলবো, তুমি চুপ করে শুনবে। কোনো কথা নয়।”

– “তুমি ভাবতে…”

– “হুশশ… বললাম তো,আজ না। তোমার কথা শোনার জন্য জীবন পরে আছে। আজ আমি বলি।”

প্রজ্ঞা সুযোগ পেলোনা তাকে কথাটা জানানোর। এনজাম গাল থেকে হাত সরিয়ে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে তার আঙটি,চেইন বের করে আনলো। প্রজ্ঞার এতক্ষনে খেয়াল হলো তার গলা, আঙুল একেবারেই খালি।
এনজাম মৃদু হেসে শুধায়,
– “ধারাবাহিকভাবে কিছু জিনিস দেই তোমাকে। হুম?”

প্রথমেই তার হাতটা ধরে মেঝেতে হাটু গেড়ে বসলো এনজাম। পুরনো আঙটিটাই তার অনামিকা আঙুলে পরিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
– “এটা… আমার ডাকে সাড়া দেবার জন্য।”

মুচকি হাসে প্রজ্ঞা। এনজাম উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ছোট্ট দুটো কানের দুল বের করলো। এগুলোও অনেক আগের কেনা, অনেক মাস ধরে টাকা জমিয়ে প্রজ্ঞার জন্মদিনে সে উপহার দিয়েছিলো। দুলজোড়া দু কানে পরিয়ে দিয়ে বললো,
– “এটা দিলাম, কোনোদিক না ভেবে আমার হাতটা ধরার জন্য।”

ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ব্রেসলেট বের করলো সে। এটা নতুন কেনা, সিঙ্গাপুর থেকে এনেছে এবার। প্রজ্ঞার চিকন হাতে সন্তর্পণে ব্রেসলেটটা পরিয়ে দিয়ে বললো,
– “এটা দিলাম, এক অধমকে মূল্য দিয়ে তার অপেক্ষায় দিন গোনার জন্য।”

– “আমার প্রেমিক অধম নয়।”
মৃদুস্বরে বলে প্রজ্ঞা। এনজাম ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা চেইনটা হাতে তুলে নেয়। ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞার গলায় পরিয়ে দিয়ে কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা রেখে শুধায়,
– “এটা… শত কষ্ট সহ্য করে এই এনজামকে বাবা ডাক শোনানোর জন্য। নামমাত্র উপহার, কারণ এটার বিনিময়ে আকাশের চাঁদ এনে দিলেও কম পড়বে।”

চোখ বুজে তার আদুরে স্বর শুনলো প্রজ্ঞা। তবে তার পরবর্তি কাজে বিস্ময়তার চূড়ায় পৌঁছে গেল সে। সামনে এসে তার হাতে একখানা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বললো এনজাম,
– “সবশেষে, সাধারণ এই ছেলেটার উপর সর্বোচ্চ বিশ্বাস রাখার জন্য।”

প্রজ্ঞা চাবিটার দিকে তাকিয়ে অবাক কণ্ঠে বলে,
– “এটা কীসের চাবি?”

এনজাম তার দু-গালে হাত রেখে মুখটা তুলে ধরলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
– “একদিন বলেছিলে, তোমার জীবনে নিজের একটা বাড়ির খুব শখ। কোনো আলিশান বাড়ি নয়। ছোটখাটো একটা দোতলা বাড়ি। অল্প কয়েকটা ঘর, একটা সুন্দর রান্নাঘর। একটা ছাদহীন সরু বারান্দা,পাশে একটা দুটো ফুলের গাছ। শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বেঁধে যেই বাড়িতে মালকিন হয়ে ঘুড়ে বেড়াবে তুমি, পুরোপুরি গিন্নি সেজে সংসার সামলাবে। ছোট্ট একটা সংসার।”

প্রজ্ঞার ঠোঁটের হাসিটুকু মিলিয়ে যায়। প্রতিক্রিয়াহীন রূপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। এনজাম তার গালে হাত রেখে বলে,
– “তোমার অগাধ বিশ্বাসের বিপরীতে দেওয়া একটা ছোট্ট ধন্যবাদ এটা। সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ। তোমার শখ, আমার স্বপ্ন।”

প্রজ্ঞা চোখ তুলে তাকায় না তবুও। এনজাম কাঁধে হাত রেখে শুধায়,
– “বলো কিছু। আমার ইচ্ছে ছিলো আজই নিয়ে যাবো তোমাকে। কিন্তু পরে ভাবলাম এখানেই আসি। সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে তারপর যাবো নতুন জায়গায়।”

প্রজ্ঞা তার থেকে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। মাথা নিচু করে ঘুরে দাঁড়ালো। এনজাম অবাক হয়ে কাঁধে হাত রাখতেই সরে এসে বিছানায় বসলো সে। এনজাম তার এরূপ প্রতিক্রিয়ার অর্থ ধরতে না পেরে এগিয়ে এলো। প্রজ্ঞার সামনে বসে তার হাতদুটো ধরে বললো,
– “কী হলো? চমকে গিয়ে কী কথাই বন্ধ করে দেবে নাকি? ভেবোনা দুদিনের প্ল্যান আমার। অনেক দিন ধরেই ভেবেছি এটা নিয়ে। আজকের দিনটা ভালো ছিলো তাই…”

প্রজ্ঞা চোখ তুললো এবার। গম্ভীর গলায় বললো,
– “তাই কী?”

– “এভাবে বলছো কেন?”

প্রজ্ঞা দৃঢ়কণ্ঠে বলে,
– “তো কীভাবে বলবো আর?”

চাবিটা চোখের সামনে ধরে বললো সে,
– “উপহার, বাড়ি এসব দিয়ে কিনতে এসেছো আমাকে?”

– “প্রজ্ঞা!”
হতবাক কণ্ঠে বললো এনজাম। প্রজ্ঞা দুদিকে মাথা নেড়ে শুধায়,
– “গাড়ি, বাড়ি, সোনাদানা…এগুলোর একটাও কখনো চেয়েছি আমি তোমার কাছে?”

এনজাম উঠে এসে তার হাতজোড়া ধরতেই ছিটকে সরে যায় প্রজ্ঞা। চোখ মুছে বলে,
– “চাইনি তো, তাহলে কেন দেবে? কেন এসেছি আমি তোমার কাছে? এসবের জন্য তো নয়।”

চোখ নামিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। এনজাম জোরপূর্বক তার হাতটা চেপে ধরে বলে,
– “তুমি চাওনি। এগুলো আমার দেওয়া উপহার প্রজ্ঞা! আবার বেশি ভাবছো তুমি। এভাবে ভাবতে হয়না।”

প্রজ্ঞা তাকালো তার পানে। অশ্রুসিক্ত চোখে বললো,
– “এসব কিছু চাইনা আমার। যেমন আছি, খুব ভালো আছি। আমি শুধু ভালোবাসা চাই। সেটুকু পেলে এরচেয়ে শতগুণ বেশি খুশি হয়ে যেতাম। এগুলো দিয়ে বারবার ছোট করে দাও আমাকে। আমার যে নিজেকে ছোট মনে হয় খুব… এটা কেন বুঝতে পারোনা?”

এনজাম এক ঝটকায় তাকে বুকে টেনে নেয়। মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলে,
– “শেষ কথা তো শোনোই নি।”

একটু থেমে বলে সে,
– “সারাজীবন আমায় সঙ্গ দেবার বিনিময়ে এই জায়গাটা তোমাকে দিলাম। সবচেয়ে দামি, যার মূল্য নির্ধারণ করা যায়না।”

বুকের কাছের পাঞ্জাবীটুকু একহাতে চেপে ধরে আবারো কেঁদে উঠলো প্রজ্ঞা। এনজাম তাকে বোকা ভাবলেও আজ সে যতখুশি কাঁদবে। তাকে বকাঝকাও করবে। সে কিচ্ছু বলতে পারবেনা।
সময়ের সাথে সাথে কান্না কিছুটা থেমে এলো প্রজ্ঞার। পিঠ এসে ঠেকলো ফুল সজ্জিত নরম বিছানায়। এনজাম সযত্নে চোখে জমে থাকা জলটুকু মুছিয়ে দিলো তার। চুলের খোপায় আটকে রাখা ব্যান্ডটা খুলে মৃদুস্বরে শুধালো,
– “তোমার নামের চব্বিশ ঘণ্টা শেষের পথে। বলেই দিয়েছি, বাকি জীবনটা আমার।”

প্রজ্ঞার দু চোখের ভেজা পাতায় চুমু এঁকে বললো সে,
– “পুরো দেড়টা মাস দূরে থেকেছো প্রজ্ঞারাণী। পরের কটাদিন এতই কাছে রাখবো যা তোমার জন্য একটু কষ্টের হয়ে যাবে।”

প্রজ্ঞা মুখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে। তার উন্মুক্ত গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে অকস্মাৎ বলে বসলো এনজাম,
– “নতুন বাড়ি, তোমার নতুন সংসারে সদস্য সংখ্যাটা একটু কম পরে যাবেনা?”

তড়িৎবেগে ঘাড় ঘোরালো প্রজ্ঞা। এনজাম তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– “সদস্য সংখ্যা একটু বাড়লে কী ভালো হতোনা? এই ধরো, তিনজনের জায়গায় যদি চারজন হতো… তোমার সংসারটা ভরে উঠতো না?”

প্রজ্ঞার পেট ফেটে হাসি পেলো। অবশেষে! তার আলোচনার শখ ও কিনা পূরণ করছে এনজাম! প্রজ্ঞার নিকট হতে প্রতিক্রিয়া না পেয়ে এনজাম তার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
– “সাহস করো? তোমার উপর নির্ভর করছে। মনে ভয় থাকলে নো প্রবলেম। সচেতন নাগরিক হিসেবে পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম রাখতেও আমার সমস্যা নেই।”

ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো প্রজ্ঞা। তার এই হাসি সম্মতির প্রকাশ ঘটালো বলে মনে হলো এনজামের। শাড়ি ভেদ করে তার পেটে হাত রাখলো সে। প্রজ্ঞা চোখ বুজে ফেললো সঙ্গেসঙ্গে। তার বরের গাঢ় স্পর্শে দিশেহারা বোধ করলো। পেটের কাটা জায়গাতে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তার। এই পাগলকে বলাই তো হলোনা! যেই স্থানে তার আদুরে স্পর্ষের আনাগোনা, সেখানেই বেড়ে উঠছে তার অংশ। তাদের নব্বই দিনের গল্পের সবচেয়ে বড় সাক্ষী…


প্রজ্ঞা এ জীবনে যতবার কোনো এক ভালো কাজ করতে চেয়েছে, প্রতিবারই এনজামের কারণে তার কাজ ভেস্তে গেছে। এইযে সে সাদা মনে ভাবলো, নরম স্বরে ভদ্র বউয়ের ন্যায় জানাবে বরকে, ‘তুমি বাবা হতে চলেছো গো’ কতবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতিও নিলো… সব চিন্তায় এক বালতি জল ঢেলে ঢং শুরু করলো সে। ‘আজ আমি বলবো, তুমি কিছু বলবেনা’ এই বলে বিশেষ খবরটা সে আর শুনলোই না! রাতে আরো এক দুবার বলতে গেলেও ঠোঁটে আঙুল চেপে বিরক্তির স্বরে বলেছে,
– “চুপ থাকো”

সীমাহীন আদরের কারণে তখন প্রজ্ঞার আর রাগ হয়নি। কিন্তু সকাল থেকেই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে রইলো। অকারণেই কিছুক্ষন চ্যাঁচাতে পারলে একটু শান্তি পেতো সে। এনজাম বসেবসে আড়েআড়ে চেয়ে তার গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। এই বিছানা গোছাচ্ছে, আবার গিয়ে কাপড় গোছাচ্ছে। মোটকথা সে কী থেকে কী করছে নিজেই জানেনা। সোফায় এনজামের পাশে থাকা একটা কাপড় তুলে দু কদম এগোতেই হুট করে মাথাটা ঘুরে উঠলো তার। চোখের সামনে অন্ধকার দেখে পড়ে যেতে নিলেই এনজাম ছুটে এসে ধরলো তাকে। ব্যস্ত হয়ে বললো,
– “কী হলো? মাথা ঘুরছে?”

তাকে নিয়ে বিছানায় বসালো এনজাম। চোখ টেনে দেখে বললো,
– “না রক্ত তো একেবারে কম বলে মনে হচ্ছেনা। ওহহো! তুমি ডিম খাচ্ছোনা কদিন ধরে… এবার বুঝতে পেরেছি। এইজন্যই শরীর এতো দূর্বল। চুপ করে বোসো। একটা ডিম সেদ্ধ করে নিয়ে আসি, খেয়ে নাও।”

রান্নাঘরে গিয়েও সে পুনরায় ফিরে এসে বললো,
– “এই, হাসের ডিম আনবো?”

প্রজ্ঞার রাগটুকু মাথায় চড়ে বসলো একদম। তেঁতে উঠে বললো,
– “ঘোড়ার ডিম এনে ভেজে খাও, গরু কোথাকার!”

এনজাম হতবাক কণ্ঠে বলে,
– “ঘোড়ার ডিম এ প্রেশার ঠিক হবে? আরে ঘোড়ার তো ডিম ই হয়না…কীসব বলছো? মাথা ঠিক আছে?”

– “নাহ, ঠিক থাকতে আর দিচ্ছো কই?”

– “আমি কী করলাম?”

প্রজ্ঞা পাশ থেকে একটা বালিশ ছুড়ে মেরে বলে,
– “কী করলাম? কী করোনি সেটা বলো। কদিন ধরে দেখছো আমার শরীর দূর্বল, মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে। একশোবার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করলাম কাল কিছু বলার আছে বলে। তারপরও তুমি কিচ্ছু বোঝোনা না? ফিডার খাস তুই?”

এনজাম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে অস্ফুটস্বরে বললো,
– “তুমি…”

একটু চ্যাঁচাতে পেরে রাগ খানিকটা কমলো প্রজ্ঞার। মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসলো। ওদিকে এনজাম আহাম্মকের ন্যায় চেয়ে রইলো তার পানে। খানিক বাদে মাথা চুলকে হিসেব মেলাতে না পেরে বললো,
– “কিন্তু এক রাতের মধ্যে কী করে?”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৩৯
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

প্রজ্ঞার মাথাটা রিতীমতো ভনভন করে ঘুরে উঠলো। কী বলে এই ছেলে! নাহ… এর সাথে কোনো সুস্থ মানুষের থাকা সম্ভব না। ক্ষেপে উঠে বললো সে,
– “একদিনের মধ্যে কী করে হবে? পাগল নাকি!”

এনজাম দ্রুতবেগে কাছে এগিয়ে শুধায়,
– “আমরা না কাল প্ল্যানিং করলাম? তো একদিনেই তো…”
থেমে গিয়ে মাথা নাড়ে এনজাম,
– “না না একদিনে না। কিন্তু… কবে, কখন?”

কপাল চাপড়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো প্রজ্ঞা,
– “তুই দূর হ আমার চোখের সামনে দিয়ে। এমনিতেই অন্ধকার দেখছি। তোর কারণে আরো বেশি ঘুরছে মাথা।”

এনজাম কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রজ্ঞার দিকে। শুকনো ঢোক গিলে চট করে তার মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
– “আর ইউ সিরিয়াস?”

প্রজ্ঞা শান্ত চোখে দেখলো তাকে। চোখেমুখে তার উপচে পড়া উত্তেজনা। প্রজ্ঞা উত্তর না দেওয়ায় আবারো জানতে চায়,
– “সামওয়ান ইজ কামিং… সত্যি বলছো?”

– “মিথ্যে বলে কত টাকা কামাবো?”

এক মুহূর্তের জন্য বুঝি ভাবশক্তিই হারিয়ে বসলো এনজাম। হাতদুটো থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো। এমন একটা খবরের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না মোটেই। তার কম্পনরত হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে হাসি পেলো প্রজ্ঞার। দুনিয়ার কে বিশ্বাস করবে, সমাজের মাঝে পুরাদস্তুর বুদ্ধিমান সেজে থাকা এক পুরুষ যে তার সম্মুখে বাচ্চা হয়ে যায় মাঝেসাঝে?
অনেকক্ষন বাদে চোখের পলক ফেলে বললো এনজাম,
– “ত তুমি বলোনি কেন আমাকে?”

প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
– “বলতে দিয়েছো? দুদিন ধরে বলার চেষ্টা করছি, কতবার বললাম কাল… তুমি তো শুনবেই না।”

এনজাম হাত নাড়িয়ে বলে,
– “আরে তখন কি আমি এ দুনিয়ায় ছিলাম নাকি?”

– “ছিলেনা কেন? এটাও আমার দোষ?”

– “অন্যসময় বলতে পারতে! এত বড় একটা খবর তুমি লুকোতে পারলে?”

প্রজ্ঞা কথা বললোনা। মাথা নিচু করে আঙুলে ওড়না প্যাঁচালো। পরক্ষণেই আড়চোখে তাকালো এনজামের পানে। সে সোজা হয়ে দুহাতে মুখ চেপে ধরে ঝুঁকে বসে রইলো। কেমন যে লাগছে তার! এই অনুভূতি আগের চেয়ে ভিন্ন, অনেকটা ভিন্ন। সে একজন বাবা, এই নামের মূল্য বোঝে। বাবা হবার আনন্দ দ্বিগুণ গভীরভাবে অনুভব করতে পারে। নিজের সব অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণের আশায় উতলা হয়ে ওঠে সে। সেই সুযোগ মেলার খবরে তার ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ? না পাওয়ার কথা মনে করে আবেগাপ্লুত হওয়া উচিৎ, নাকি এক সুন্দর সময়ের আগমনী বার্তায় আনন্দে আত্মহারা হওয়া উচিৎ?

তাকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে প্রজ্ঞা ধীরহস্তে কাঁধ স্পর্ষ করলো তার। এনজাম মুখ তুলে চাইলো, সেকেন্ডের মাঝে কাছে এসে এক শক্ত, গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো তাকে। কাঁধে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজে রইলো। প্রজ্ঞা স্থির চিত্তে অনুভব করলো তার ভারী নিঃশ্বাসটুকু। সময় দিলো তাকে, আলতোস্পর্ষে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। খানিক বাদে মৃদুস্বরে শুধালো,
– “খুশি?”

একটু একটু করে মুখ তুললো এনজাম। চোখে আঙুল ডলে বললো,
– “এমন চমকের আশা করিনি। থমকে দিলে একদম!”

– “জানতে চেয়েছি খুশি কিনা।”

এনজাম ঠোঁট কামড়ে বলে,
– “কলিজাটা বের করে দেখানো গেলে বোঝাতে পারতাম।”

নিচের ঠোঁটে দাঁতের দাগ বসে যায় তার। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে লম্বা দম টানে বারকয়েক। প্রজ্ঞার তার অবস্থা দেখে হেসে শুধায়,
– “তোমাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না দ্বিতীয়বার বাবা হচ্ছো।”

এনজাম চোখ ঘুরিয়ে বলে,
– “নিজেই তো বুঝতে পারছিনা, অন্যরা কী করে বুঝবে?”

চোখে এবার জল চলে এলো তার। জমে রইলো এককোণে। প্রজ্ঞা অবাক কণ্ঠে বলে,
– “এত শখ আরেকটা বাচ্চার? আগে কখনো বলোনি!”

এনজাম মুচকি হেসে বললো,
– “বলার স্কোপ ছিলো? আর শখ… এই শখটা না খুব বেড়ে গিয়েছিলো। যখন বুঝলাম ছেলের বেড়ে ওঠার সময়টুকু আমি উপভোগ করতে পারিনি, তাকে নিয়ে রাত জাগার সৌভাগ্য হয়নি, খাবার নিয়ে যুদ্ধ করার সুযোগ হয়নি, ইচ্ছে করলেই ওকে বুকের উপর নিয়ে ঘুমোতে পারিনি, হাত ধরে হাঁটতে শেখাইনি… কত কিছু থাকে একটা বাচ্চার মধ্যে!”

হেসে উঠে বৃদ্ধাঙ্গুলে চোখ মুছে প্রজ্ঞার হাতদুটো ধরে বললো সে,
– “কিন্তু এবার তো কোনো বাঁধা নেই। তুমি দেখে নিও, এবারে আমি সবকিছু করবো। একেবারে ছোট… এতটুকু যখন থাকবে, তখন থেকে ওকে বড় করে তুলবো চোখের সামনে। যা যা করতে পারিনি, সবকিছু করবো। আমার চোখের সামনে থেকে বড় হতে দেখবো। আমার অধিকার থাকবে ওর উপর, আর কারো না।”

কেমন উদভ্রান্তের ন্যায় কথাগুলো বলছিলো এনজাম একপর্যায়ে চোখ নামিয়ে উৎসুক স্বরে বললো,
– “আমার বাচ্চাকে এবার সবার আগে আমি দেখবো। ছুঁয়ে দেখবো, কোলে নেবো একদম সবার আগে। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোতে একটুও দ্বিধাবোধ থাকবেনা। প্রণয়কে তো মুখ ফুটে চাইতেই পারিনি… কিন্তু এবারে তেমনটা হবেনা। আমি সবকিছু করবো প্রজ্ঞা! যা যা পারিনি সবকিছু!”

এনজাম খানিকটা হারিয়েই গিয়েছিলো কথার মাঝে। কার সামনে কী বলছে তা খেয়াল হতেই বিভ্রান্ত হয়ে তাকালো প্রজ্ঞার দিকে। তার মুখে হাসি নেই একটুও। এনজাম ঢোক গিলে কিছু বলার পূর্বেই সে বিস্ময় কণ্ঠে জানতে চায়,
– “প্রণয়কে সবার আগে ধরোনি তুমি? তোমার কোলে দেওয়া হয়নি ওকে?”

এনজাম হেসে উঠে কথা ঘোরাতে চাইলো,
– “তাতে কী… এবারে একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। ডাক্তার অ্যালাও করলে অপারেশন থিয়েটার এও…”
প্রজ্ঞার অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া থামিয়ে দেয় তাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার গালে হাত রেখে শুধায়,
– “ছেড়ে দাও, পুরনো কথা নিয়ে বেশি ভাবতে হয়না। উই হ্যাভ টু থিংক অ্যাবাউট দ্যা ফিউচার।”

প্রজ্ঞা মাথা নাড়িয়ে বলে,
– “কেমন মানুষ তুমি? নিজের অধিকার বুঝে নিতে জানোনা? অন্যের কথা মেনে চলতে কে বলেছে? আমি বলেছি? বলিনি তো। নিজের হকগুলো বুঝে নিতে জানোনা কেন?”

– “জেনে নেবো।”

– “একবার এসব কথা বললে আমি এতটা সময় ও নিতাম না। তোমার আনন্দ দেখে বিরাট অহংকার হচ্ছে।”

এনজাম নাক টেনে তার বামগালে ঠোঁট চেপে দুটো চুমু খেলো পরপর। ফিঁক করে হেসে বললো,
– “আনন্দটা আরেকজনকেও দেওয়া উচিৎ। কিন্তু সে এখনো গভীর ঘুমে মগ্ন।”

প্রজ্ঞা চোখ বড়বড় করে বলে,
– “আনন্দ? ছেলে আমার খবর পেলে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। সে আগে থেকে সতর্কবার্তা জারি করেছে, নতুন বোন চাইনা, আদর কমে যাবে তার।”

এনজাম হেসে উঠে মাথা ঝুঁকিয়ে আনলো প্রজ্ঞার পেটের কাছে। আলতোভাবে হাত রেখে বললো,
– “কতদিন ধরে লুকিয়ে আছেন?”

– “বেশি না, দু-মাস তিন চারদিন হবে।”

এনজাম কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
– “সুস্থ থাকলে তুলে একটা আছাড় মারতাম। মুখে তো খই ফোঁটে সবসময়, আর এই খবরটা এতদিনে জানাতে পারলে না?”

প্রজ্ঞা মুখ ফুলিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
– “কেন বলবো আমি? খেয়াল রাখো একটুও? বউ বেঁচে আছে কিনা, সুস্থ আছে কিনা সেদিকে তাকানোর ও তো প্রয়োজনবোধ করোনি। আবার বলে বড়বড় কথা। এইযে জানিয়েছি, এটা তোমার সাত কপালের ভাগ্য। উচিৎ তো ছিলো আরো মাসখানেক পরে জানানো।”

এনজাম আঙুল তুলে কিছু বলতে গিয়েও বলেনা। ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাজ রেখে চেয়ে থাকতেই প্রজ্ঞা মুচকি হেসে বলে,
– “ভুলেও বকবেনা… প্রমিস করেছো কিন্তু।”

এনজাম একটু হেসে মাথা নোয়াতেই সে কাছে এগিয়ে হাতটা ধরে বলে,
– “চলো, নাটকের মতো কিছু চুক্তি করবো। কাগজে কলমে লিখে রাখবো একদম।”

এনজাম সম্মতি জানিয়ে শুধায়,
– “বলুন, আপনার হুকুম মাথা পেতে গ্রহণ করবো।”

প্রজ্ঞা সোজা হয়ে বসলো। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো,
– “ঝগড়া আমি করবো ঠিকই, তবে একটু কমিয়ে। কথায় কথায় রেগে যাওয়ার অভ্যাস বদলানোর চেষ্টা করবো।”

এনজামও মাথা নুইয়ে জোর গলায় বলে,
– “রাগ আমি করবো ঠিকই, তবে সামান্য কারণে নয়। রেগে গিয়ে ভুলভাল কথা বলার অভ্যাস বদলে ফেলবো।”

আড়চোখে তাকিয়ে বললো প্রজ্ঞা,
– “যেটুকু পারি ঠিক আছে, তবে আরেকটু ভালো রান্না শেখার চেষ্টা করবো।”

– “লবণ কম হলে অভিযোগ না জানিয়ে ভাতের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবো।”

– “নজর রাখবো, তবে ওভারপসেসিভ হবোনা। যেকোনো কিছুতে আগে কথা বলে নেবো। না জেনে কাজ করবো না।”

– “পসেসিভনেস কে ভালোবাসা হিসেবে নিয়ে আনন্দে থাকবো, ভুল ধরার পায়তারা করবো না।”

প্রজ্ঞা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মৃদু গলায় বললো,
– “নিজেকেই বড় করে দেখবো না। যতই হোক, অন্যের দিকটাও বোঝার চেষ্টা করবো। তার উপর বিশ্বাস রাখবো।”

এনজাম শীতল চোখে চেয়ে শুধায়,
– “এমন কিছু করবো না যার ফলে এই বিশ্বাসে চিড় ধরে। বউয়ের বিশ্বাস ধরে রাখায় মনোযোগী হবো।”

প্রজ্ঞা দু-বার নাক টেনে বললো,
– “বাচ্চামো করবো, বোকামিও করবো। কিন্তু অতিরিক্ত এমন কিছু করবো না যার ফলে বর বিরক্ত হয়।”

এনজাম তার হাতটা ছুঁয়ে বলে,
– “এই মনে তার প্রতি বিরক্তি আসার সুযোগটাই দেবোনা। শত ঝামেলার মাঝেও তার মনে আঘাত করার মতো কোনো কথা বলবোনা।”

হাতের পিঠে চোখ মুছলো প্রজ্ঞা। বললো,
– “যত খুশি ঝগড়া করবো, কিন্তু বাচ্চার সামনে না। নিজেদের কারণে তাদের মনে কোনোপ্রকার খারাপ প্রভাব পড়তে দেবোনা। একসঙ্গে মিলে তাদের সুস্থ এক পরিবেশে বড় করে তুলবো।”

এনজাম এগোলো খানিকটা। আঙুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে বললো,
– “রাগ,অভিমান,ঝগড়া যত যাই হোক না কেন, তার স্থায়িত্ব হবে সর্বোচ্চ একদিন। সারাদিনের ঝামেলা রাতের আগেই মিটিয়ে ফেলতে হবে। কোনো দূরত্ব তৈরি হতে দেওয়া যাবেনা।”

– “প্রয়োজনে নিজে থেকে আত্মসমর্পন করতে হবে। অন্যের আশায় থাকলে চলবেনা। ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয়ে যায়না, বরং ভালোবাসা বাড়ে। এটা মনে রাখবো সবসময়।”

প্রজ্ঞার চোখ মুছিয়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে সুখের হাসি রেখে বলে এনজাম,
– “ভালোবাসায় একটুও কৃপণতা করবোনা। সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবেসে যাবো, সারাজীবন।”

প্রজ্ঞা ফুঁপিয়ে উঠে গালে হাত রাখলো তার। ঠোঁট কামড়ে আকুতির স্বরে আবদার জানালো,
– “মেইক দিস টাইম স্পেশাল ফর মি, প্লিজ! এবারের সময়টা যেন স্মৃতির পাতায় সবচেয়ে সুখের সময় হিসেবে খোদাই করা থাকে। যা মনে করে আর চোখ ভেজাতে হবেনা আমায়। না পাওয়া নিয়ে আর কোনো আক্ষেপ করতে হবেনা। আই রিকুয়েস্ট, এ কটা মাস আমায় দিও। কোনো খারাপ স্মৃতি না থাকুক এর মাঝে। জীবনটাকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয় যেন।”

দু-গালে হাত রেখে তার কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে বললো এনজাম,
– “কখনো বিন্দুমাত্র অভিমান মনে জমলে এভাবে ডাকবে, এই অনুরোধগুলোর সামনে একেবারেই দিশেহারা আমি। মনে রেখো, এ জীবনে আমি তোমারই ছিলাম, আছি এবং থাকবো। হাজারো ঝগড়া বিবাদের শেষে এভাবেই ফিরে আসবো। প্রয়োজনে মাথা নোয়াবো। তোমাকে, তোমাদের ভালো রাখার জন্য জীবন দিয়ে দেবো।”

দুজনের বন্ধ চোখজোড়া জলে টইটম্বুর। তারা নিরব… অনেকটা সময় নিশ্চুপ থেকে শক্ত হাতের বাধনে জড়িয়ে নিলো একে অপরকে। এই অপরূপ মিলনচিত্র বারান্দার গ্রিলে বসে থাকা পাখিটি ব্যতীত কেউ দেখেনি। দেখাতে নেই… নজর লেগে যাবে যে!
আরো দুটো পাখি এসে জানালায় বসলো, এই মনোহর দৃশ্য দেখার জন্য বুঝি? তাদের এই সুন্দর মুহূর্তকে সাক্ষী রেখে দূরে কোথাও বাজলো একটা গান। হয়তো কানে এলো তাদের, হয়তো এলো না। তাতে কী? দুজনের নিরবতাই তো উচ্চস্বরে পাল্লা দিয়ে গাইলো তখন,
– “দুনিয়ার সবকিছু লাগে যদি ম্লান
তোর জন্য বানাতে পারি একটা গান
যে সুরে ভেসে যাবে তোর সবই ভুল
মনে হবে শুধু life is beautiful

এই আমি আসবো ফিরে শতবার
ডাকিস যদি একবার ডাকনাম ধরে…
আমার নাওয়া-খাওয়া-ঘুম হারাম করে
তুই আমার জীবনে থাক আরাম করে!”

#চলবে?