নব্বই পাতার ডায়েরী পর্ব-৪৪

0
731

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪৪ [প্রথমাংশ]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

পূর্ণতার বয়স তখন চারমাস। ইনকিউবেটরের জীবন থেকে মুক্ত বাতাসে মায়ের কোলে ফিরতে তার পুরো দু-মাস লেগেছিলো। যখন ডাক্তাররা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলো, সে নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারে, মুখে খাবার খেতে পারে, তখনই ছাড়া হলো তাকে। দু-মাসের হসপিটালের জীবন পার করে বাড়ি ফিরলো সে বাবার কোলে চড়ে। পাশে মা,ভাই। ধীরেধীরে বোঝা গেলো, সে দেখতে হয়েছে অনেকটা ভাইয়ের মতো। এরা যে একই রক্তের, তা দেখেই বোঝা যায়। তবে প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে সে হয়েছে নিজের বাবার মতো। ঘুমোলে তার মতোই ভ্রু কুঁচকে রাখে, মাথার নিচে হাত রেখে ঘুমায়, একেবারে বাবার অভ্যাস।
সন্ধ্যাবেলা প্রজ্ঞা মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে অ্যানির কাছে গেলো কয়েকটা ছবি তোলার উদ্দেশ্যে। পূর্ণতার গলায় চিকন একটা স্বর্ণের চেইন। এটা সে পেয়েছে দাদা-দাদির থেকে। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিন দাদাভাই তাকে এটা পরিয়ে দিয়েছিলো। এনজাম সেদিন আরো একধাপ কান্নাকাটি করে ক্ষমা চায় বাবা-মায়ের কাছে। কথা দেয় এ জীবনে আর কখনো তাদের মুখের উপর কথা বলবেনা।

এনজাম অফিস থেকে ফিরে এসে বসলো বিছানায়। প্রচণ্ড ক্লান্ত সে। বহু জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়েছে আজ। তার উপর মেয়ে রাতে ঘুমোতে দেয়না। রাত বারোটার পর তার খেলার সময় শুরু হয়, চারটার আগে চোখে ঘুম নামার কোনো নামই থাকেনা। প্রজ্ঞা,প্রণয়,পূর্ণতাকে না পেয়ে সে ধপ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। এতেও শান্তি নেই। বিছানায় বিছিয়ে রাখা ছোট খেলনা গাড়ির উপর শুতেই মাথায় লাগলো খুব। চোখমুখ বিকৃত করে সেটা সরিয়ে চোখ বুজলো এনজাম। হাতদুটো ছড়িয়ে রাখলো দুদিকে। একহাতের পিঠে ভেজা অনুভূত হতেই চোখ বন্ধ অবস্থাতে হাতরে পেলো একটা ভেজা টিস্যু। পূর্ণতার মুখ মোছানোর কাজে ব্যবহৃত হয় ভেবে এনজাম সেটা দিয়ে নিজের মুখটাও মুছে নিলো। ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হওয়ায় ভালোই লাগলো তার। বাচ্চাদের এসব জিনিস খুবই কাজের। টিস্যুটা মুখের উপর ছড়িয়ে রেখেই শুয়ে রইলো সে।

খানিক বাদে ঘরে ঢুকলো প্রজ্ঞা। এনজামকে এমন মুখে টিস্যু ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
– “এমন পাগলের মতো মুখে টিস্যু রেখে শুয়ে আছো কেন? সমস্যা কী?”

এনজাম চোখ না খুলে আরো একবার মুখ মুছে বলে,
– “আহ, কী শান্তি! এর একটা প্যাকেট আমাকেও দিও তো।”

প্রজ্ঞা চোখ ছোট করে শুধায়,
– “এটা কীসের টিস্যু জানো?”

– “হ্যা…ঐযে মুখ মোছাও ওর।”

– “আজ্ঞে না। এটা পূর্ণতার পটি ক্লিন করার ওয়েট ওয়াইপ্স।”

– “ওহ আচ্ছা…কিহ!”

হুরমুরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো এনজাম। বড়বড় চোখে টিস্যুটার দিকে তাকিয়ে সেটা দূরে ফেলে দিলো। প্রজ্ঞা তার কাছে এসে টিস্যুটা তুলে বলে,
– “সমস্যা কী? এটা ক্লিন টিস্যু, একদম ফ্রেশ। নাক শিটকানোর কী আছে? আজব!”

এনজাম চোখমুখ কুঁচকে বলে,
– “কিন্তু এটা ঐ টিস্যু হয় কী করে? কী সুন্দর স্মেল! পটি ক্লিন করার টিস্যু তে এত সুন্দর স্মেল কেন হবে?”

– “টিস্যু কোম্পানি কে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। তার আগে বিছানা থেকে ওঠো। দু মিনিটের জন্য ঘুমিয়েছে পূর্ণতা, এর মধ্যে পুরো ঘর গোছাতে হবে। যাও সরো।”

এনজামকে একপ্রকার টেনে সরিয়ে দিলো। হতভম্ব হয়ে সে তাকিয়ে থেকে বললো,
– “আমি যে অত্যাধিক ক্লান্ত এটা চোখেই পড়ছে না? কোথায় লেবুপানি এনে যত্ন করবে তা না…”।

প্রজ্ঞা খেলনাগুলো সরিয়ে ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে তাকায় তার পানে। অন্যহাতটা কোমড়ে রেখে বলে,
– “লেবু ফ্রিজে কাটা আছে, নিজে বানিয়ে খাও। তার আগে বলো, তুমি কি ডায়েপার এনেছো?”

শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়ে এনজাম, অর্থাৎ সে আনেনি। প্রজ্ঞা তেঁতে উঠলো মুহূর্তেই। ক্ষিপ্ত স্বরে আঙুল উঁচিয়ে বললো,
– “রাতে যদি ঐ একটা ডায়েপার নষ্ট হয় তো বাকি রাত তুমি কোলে নিয়ে বসে থাকবে মেয়েকে। অসহ্য! একটা জিনিসও ঠিক সময়ে আনতে পারেনা।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টাওয়ালটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো এনজাম। গত দু-মাস যাবৎ প্রজ্ঞার মাথা সর্বদা গরম হয়েই থাকে, কর্কষ কণ্ঠ ব্যতীত কোনো কথাই বেরোয় না মুখ থেকে। এনজাম তার কাছে বেশিরভাগ সময় ভেজা বেড়াল হয়েই থাকে। যেন এক অসহায় পথিক!

গোসল সেরে বেরোনোর পর বিছানায় চোখ যেতেই একটা হাফপ্লেটে কয়েকটা মিষ্টি সাজানো দেখে মনটা নেচে উঠলো এনজামের। যাক, বউয়ের এখন অবধি মনে আছে যে তার একটা বর রয়েছে। সোফায় বসে পূর্ণতার কাঁথা ভাজ করছিলো প্রজ্ঞা। চোখের ইশারায় মিষ্টি দেখিয়ে বললো এনজামকে,
– “কত কষ্ট করে বানিয়েছি জানো? গিলো এখন বসেবসে। মিষ্টি মিষ্টি বলে দুই বাপ ব্যাটা একদম মাথা খারাপ করে দিচ্ছে দুদিন ধরে।”

এনজাম মুচকি হেসে বিছানায় বসে। প্লেটটা হাতে নিয়ে বলে,
– “যাক, বউ নামক মিষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে আসল মিষ্টি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি।”

প্রজ্ঞা খুব উৎসাহ নিয়ে চেয়ে রইলো তার পানে, প্রশংসা শোনার উদ্দেশ্যে। এনজাম পরপর দুটো মিষ্টি খেয়ে একটু মস্করা করেই বললো,
– “চিনির বদলে কী লবণ দিয়ে রেখেছো নাকি? কেমন নোনতা নোনতা লাগছে।”

– “নোনতা?”
ভ্রু কুঁচকায় প্রজ্ঞা। এমন সময় অ্যানি পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকেই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
– “এই ভাবি, মিষ্টি বানানোর সময় পূর্ণতা তোমার কোলে ছিলোনা? ঐযে কোলে বসেই হিসু করে দিয়েছিলো, তুমি আবার মিষ্টি বানানো রেখে জামা বদলাতে গেলে? তখন কী ঠিকঠাকভাবে হাত ধুয়েছিলে?”

এনজাম তিন নম্বর মিষ্টিটা সবে মুখের সামনে ধরেছিলো। অ্যানির কথা শুনে সেটা পড়ে গেলো প্লেট এ। হতবাক দৃষ্টিতে চাইলো প্রজ্ঞার দিকে। অ্যানি তার হাবভাব দেখে মিটিমিটি হেসে শুধায়,
– “আরে আরে, তাতে কী? তোমারই তো মেয়ে ভাইয়া। একটু স্পেশাল ফ্লেভার অ্যাড হলে কিচ্ছু হবেনা। খাও খাও, সেই স্বাদ!”

হাসি আটকে সে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। প্রজ্ঞা দাঁতে দাত চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণে রেখে এনজামের দিকে তাকিয়ে বলে,
– “ওভাবে তাকানোর কিছু নেই। ছোট বাচ্চাকাচ্চা থাকলে খাবারে অমন নোনতা স্বাদ একটু আকটু আসতেই পারে। ডায়াবেটিস আসবেনা, খেয়ে নাও।”

এনজাম শুকনো ঢোক গিলে অসহায় কণ্ঠে জানতে চায়,
– “তুমি কি আসলেই হাত ধোঁও নি?”

– “আজ সারাদিনে চার কাপ চা তুমি অলরেডি শেষ করেছো। এটা পাঁচ নম্বর… বাচ্চার দিকে কোনো খেয়াল আছে আদেও?”

প্রীতির হাত থেকে ধোয়া ওঠা চায়ের কাপটা কেড়ে নিয়ে বললো স্বজন। সে হতবাক দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায় সঙ্গেসঙ্গে। কেমন অদ্ভুত লোক! একটা গর্ভবতী মেয়ের হাত থেকে খাবার কেড়ে নেয়!
উঠে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপটা আবারো ছিনিয়ে নেয় প্রীতি। গরম চায়েই দু-বার চুমুক দিয়ে বলে,
– “আরো দশ কাপ খাবো। আপনাকে বানিয়ে দিতে বললে আপনি সেটাও করতে বাধ্য। একদম মুখেমুখে তর্ক করবেন না বলে দিচ্ছি!”

স্বজন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে দেখে প্রীতিকে। এটা কি সেই মেয়ে, যার মুখ থেকে যুক্তিহীন দুটো কথা বেরোনোও দুষ্কর ছিলো?
গত চারমাস ধরে ধীরেধীরে তার ব্যবহারের যা অবনতি হচ্ছে, তাতে নয় মাস পার হওয়া অবধি স্বজন বিস্ময়তার চূড়ায় পৌঁছে যাবে নিশ্চিত।

পূর্ণতার জন্মের মাসখানেক এর মাঝেই একটা সুখবর আসে তাদের মাঝে। স্বজনের একটা বাচ্চার ভীষণ শখ ছিলো, এই একটা বিষয় আবদার করতো খুব। তার এই আবদারটা নাকোচ করতে চায়নি প্রীতি, তাই আর দেরি করেনি। তার বাবাও বিদেশ দেখে একেবারের জন্য ফিরে আসেন মাসখানেক এর মাথায়। পূর্ণতা সুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার সপ্তাহখানেক এর মাঝেই বেশ বড়সড় আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাকে তুলে দেওয়া হয়। সেই থেকে শশুর বাড়িতে সবার আদরের মাঝেই দিন কাটছে তার।

স্বজন একটু নরম স্বরে শুধায়,
– “ফ্রুটস খাও, ভাত খাও… এই এক চা দিয়ে হবেটা কী? ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ তো নেই?”

প্রীতি হুট করেই তেঁতে উঠে বললো,
– “চা ছাড়া যে অন্য কিছু গলা দিয়ে নামছেনা এটা কি আপনার চোখে পড়েনা? কতবার করে বলছি রুচি ঠিক করার জন্য কিছু একটা করুন! সেই তো হাত গুটিয়ে বসেই আছে। বউয়ের এইটুকু উপকার না করতে পারলে কোন চুলের ডাক্তারি করবেন আপনি?”

– “প্রীতি! আমি তোমার বর, বন্ধু নই। মুখের ভাষা সংযত রাখো। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তোমার?”
কড়া গলায় বললো স্বজন। প্রীতি যেন এতে বিশাল আঘাত পেল। ছলছল চোখে চেয়ে বললো,
– “আপনি বকলেন আমাকে? এই অবস্থায়! আর মাথা খারাপ মানে…আপনি কী আমাকে পাগল বললেন? আমি পাগল? শালা তুই পাগল, তোর চৌদ্দ গুষ্টি পাগল। খাবোনা তোর চা, লাগবেনা কিছু। আব্বু আমাকে খুব আদরে রাখবে, আমি তার কাছেই চলে যাবো।”

চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে এক চুমুকে পুরোটা চা শেষ করলো প্রীতি। সেটা টেবিলের উপর রেখে হাতের পিঠে মুখ মুছে চলে গেল আলমারির দিকে, নিজের জামাকাপড় বের করতে। তার এহেন কাজে বোকা বোনে যাওয়া স্বজন হা করে তাকিয়ে রয়। এনজামের মতো তারও এখন বলতে ইচ্ছে করছে, “এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম, মাবুদ!”

এনজামের কথার ভঙ্গিমায় না হেসে পারলোনা প্রজ্ঞা। পেট চেপে ধরে ঘর কাপিয়ে হাসা আরম্ভ করলো। এনজাম শুরুতে রাগী চোখে তাকালেও ক্ষনিকের মাঝে সেই চোখে দুষ্টুমির ছাপ পড়লো। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে চট করে গিয়ে লক করে দিলো দরজাটা। প্রজ্ঞা হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই এনজাম বুক ফুলিয়ে নায়কের বেশ ধরে হেঁটে এলো তার সামনে। একহাতটা সোফার সঙ্গে ঠেকিয়ে ঝুঁকে এলো তার মুখের কাছে। প্রজ্ঞা পিছনে সরতে সরতে একেবারে মিশেই যায় ফোমের সঙ্গে। এনজামের ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা ভেবে শুকনো ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
– “প পূর্ণতার খিদে পেয়েছে বোধ হয়। আমি যাই…”

– “ও তো ঘুমোচ্ছে,তাইনা?”
মিটিমিটি হেসে বললো এনজাম। তর্জনী ছুঁইয়ে দিলো তার সমগ্র মুখে, থামলো ঠোঁটের কাছে এসে। মাতাল স্বরে শুধালো,
– “বউয়ের চুমুর অভাবে মিষ্টিও এখন মিষ্টি লাগেনা রে! জীবনটাই নোনতা হয়ে যাচ্ছে…”

– “আমি একটু আগে করলার রস খেয়ে এসেছি।”
ঝড়ের বেগে বললো প্রজ্ঞা। এনজাম নাক কুঁচকে বলে,
– “হোয়াট? মজা করো?”

প্রজ্ঞা উত্তর দিতে পারলোনা। কারণ আসলেই সে মিথ্যে বলেছে। তা বুঝতে পেরে এনজাম আরো কাছে এগিয়ে বাচ্চামোর স্বরে বলে,
– “বাচ্চা পেয়ে বরকে ভুলে যাচ্ছো হে বউ!
মনে রেখো, আমি ছাড়া তোমার এ উপকার
করতো না গো কেউ…”

প্রজ্ঞা তার বাহুতে এক কিল বসিয়ে বলে,
– “কেমন অসভ্যের মতো কথাবার্তা! ছিহঃ… দুই বাচ্চার বাপ হয়েছো, তা কী ভুলে যাচ্ছো?”

এনজাম একটু রেগে বললো এবার,
– “বিরহ জ্বালায় আমি বউকেই তো ভুলে যাচ্ছি!”

– “কিহ!”

– “কিহ না জিহ… আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সময় ই তো নেই আপনার!”

প্রজ্ঞার একটু মায়া হলো। আসলেই, বরটাকে কদিন ধরে সে একদম পাত্তাই দিচ্ছেনা। বেচারা! স্মিত হেসে প্রজ্ঞা দু-হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে বামগালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এনজাম এতটুকুতে ক্ষ্যান্ত হয়না। একহাতে কোমড় চেপে ধরে আয়ত্তে নেয় তার ঔষ্ঠ্যদ্বয়। অভিমানের বসে দু একবার দাঁত বসিয়ে দেয়, পরক্ষনেই অতি আদরে চুমু খায় সেখানে। মিনিট পাঁচেক বাদে তাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড়বড় দম ফেলে এনজাম। প্রজ্ঞা চোখ খুলে বলে,
– “শান্তি? এবার যেতে দাও।”

– “নো বেবস… ইট’স টু মাচ লেইট টু লেট ইউ গো।”

প্রজ্ঞাকে অবাক হওয়ার সময়টুকু না দিয়ে সে কোলে নেয় তাকে। প্রজ্ঞা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
– “আরে ছাড়ো, মেয়ে উঠে যাবে!”

এনজাম মুখ বিকৃত করে বলে,
– “হ্যা, মেয়ে সকালেও উঠে যায়, মেয়ে দুপুরেও উঠে যায়, মেয়ে রাতেও উঠে যায়… আমি আপনার এক হাত দূরত্বে এলেই শুধু মেয়ে উঠে যাবে। শুনছিনা এসব।”

বিছানার কাছাকাছি এসে সে আবেগাপ্লুত হয়ে গেয়ে ওঠে,
– “আজ কি রাত…হোনা হে কেয়া,
পানা হে কেয়া,
খোনা হে কেয়া!”

– “এটা রাত না, সন্ধ্যা।”

– “হোয়াটএভার… আজ কি শাম, হোনা হে…”

গান থেমে যায় তার। বাহিরে থেকে ভেসে আসে পূর্ণতার কান্নার আওয়াজ। অ্যানি চেঁচিয়ে ডাকে,
– “ভাবী, পূর্ণতার বোধ হয় খিদে পেয়েছে।”

মুহূর্তের মাঝে মুখখানা চুপসে যায় এনজামের। হাতদুটো আলগা হয়ে আসায় প্রজ্ঞা পড়েই যায় বিছানার উপর। অতি শোকে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে সে,
– “আম্মোওও! আমি খেলবোনা!”

প্রজ্ঞা সোজা হয়ে বসে চোখ বড়বড় করে বলে,
– “কী খেলবেনা?”

এনজাম মেকি হেসে বসে পড়ে বিছানায়। মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে,
– “কী আবার? লুডো…”

প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– “তা তো এমনিতেও খেলা যাবেনা। গুটির শব্দে আমার বাচ্চার ঘুম ভেঙে যাবে।”

– “ফোনে, অনলাইনে খেলবো হ্যা?”

– “হ্যা, তা খেলা যায়। রাতে ইনভাইট দিও।”
বলে সে এনজামের মুখখানা তুলে ধরে বলে,
– “খিদে পেয়েছে মেয়ের, যাই আমি?”

এনজাম অসহায় চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “যান। খাওয়ান মেয়েকে। আমার আর কী… উপোষ থেকেই জীবন কেটে যাক।”

প্রজ্ঞা স্বান্ত্বনা জানিয়ে বলে,
– “মন খারাপ করেনা, তুমহারা টাইম জারুর আয়েগা!”

তার মাথায় হাত বুলিয়ে দরজা অবধি যেতেই এনজাম কাঁদোকাঁদো গলায় বলে ওঠে,
– “কাল থেকে রোজা রাখবো আমি! রাতে সেহেরি খেতে ডেকে দিও।”

প্রজ্ঞা ফিঁক করে হেসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। এনজাম দুঃখি মনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসতেই শাফায়াতের কল আসে তার ফোনে। তাদের মাঝে ভালোই কথাবার্তা হয় আজকাল। এনজাম ফোন তুলতেই সাধারণ কথাবার্তা শেষে শাফায়াত জানতে চায়,
– “আচ্ছা স্যার, আপনার বাড়িতে তো অনেক মেয়ে মানুষ আছে। বউ, বোন… তো ধরুন সারাদিন ব্যস্ত থাকার কারণে আপনি আপনার বউকে কল করতে পারলেন না। এরপর কল করছেন, সে কল তুলছেনা… আপনি তখন কী করবেন?”

এনজাম হতাশ কণ্ঠে জানায়,
– “আমারটা তো চোখের সামনে থেকেই কল রিসিভ করছেনা। রিংটোন ই শুনতে পারছেনা।”

– “অ্যাহ?”

এনজাম বিড়বিড় করে বলে,
– “মানে বউ এখন ড্রাগন ফ্রুটের মতো। দেখতে অপূর্ব, কিন্তু ছুঁতে গেলে মনে হয় বিদেশি কিছু, ধরতে হলে পারমিশন লাগবে! আগে ছিল পেয়ারা, ঘরের যেকোনো জায়গায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত, এখন একদম স্পেশাল প্রটেক্টেড!”

– “আপনি কী ঠিক আছেন স্যার? ম্যাডামের সাথে সব ঠিকঠাক?”

এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “হ্যা, একদম। আপনি কী বলছিলেন?”

– “ঐযে ফোন না তুললে কী করা যায়?”

– “যদি রাগ কমানোর সহজ উপায় চান, তাহলে মেসেজ করেন, ‘বুঝেছি, এটা আমার শাস্তি, কারণ আমি এতটা ভাগ্যবান যে তোমাকে পেয়েছি! আমি তো এমন ভালো থাকার যোগ্যই না!’ দেখবেন, সাথে সাথে কল করবে, শুধু আপনার অভিনয় টিকিয়ে রাখার ট্যালেন্ট থাকতে হবে!”

– “ওহ… আচ্ছা।”

কল কেটেই শাফায়াত আবারো কল করলো অ্যানিকে। এসব মেসেজ তো আর পাঠানো যায়না! ভাগ্যক্রমে এবার ফোনটা তুললো অ্যানি। শাফায়াত কিছু বলার পূর্বেই একনাগাড়ে বলে গেল,
– “মানুষের মাখোমাখো প্রেম যে কয়েক মাসের বেশি টিকেনা এটা আমি খুব ভালো করে জানতাম। তখন কেউ খুব মহান মহান কথা বলে উস্কে দিয়েছিলো। এখন তো বেশ ফল পাচ্ছি। দেখা করতে বললে কাজ আছে, কলের পর কল করে গেলেও তাকে পাওয়া যায়না। বরং মেসেজ করে বলে, বাচ্চামো করোনা,ফ্রি হয়ে কল করছি। কে বলেছিলো এমন মেয়ের সাথে প্রেম করতে? যান গিয়ে নিজের টাইপের কাউকে খুঁজুন। আর একবার বিরক্ত করলে সব জায়গা থেকে ব্লক করে বসে থাকবো।”

.
এনজাম চোখ বুজে শোয়ামাত্রই ফোনে কল এলো স্বজনের। সোজা হয়ে বসে কল তুলতেই সে চিন্তিত স্বরে বললো,
– “ভাই, তোর বউ কী কখনো রেগেমেগে হুট করে বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছে? না মানে দুটো তো টুইন, একটু মিল থাকার কথা। আমার জন শুধুশুধু পাগলের মতো আচরণ করছে! চা খেতে দেবোনা বলেছি বলে সে কিনা চলে যাবে বাপের বাড়ি, এটা কোনো কথা?”

এনজাম হেসে বললো,
– “আমারটা আপনার চেয়ে দশ ডিগ্রি উপরে। রাত তিনটার সময় বলছিলো একদিন, ‘এই মুহূর্তে তেঁতুলের আচাড় না এনে দিলে ছাঁদ থেকে ঝাপ দেবে।”

স্বজন তার কথায় পরোয়া না করে বলে,
– “বউয়ের কাছে বর্তমানে কাঁঠালের বীজ হয়ে আছি। চোখেই পড়ে না! মনে হয়, চোখে পড়লেই আছাড় মারবে।”

এনজাম তাচ্ছিল্যের কণ্ঠে শুধায়,
– “আপনার তো ভাগ্য ভালো, কাঁঠালের বীজ ভেজে খাওয়া যায়। আমি তো বউয়ের কাছে শুকনো লিচুর বিচি—একদম ফেলে দেওয়া আইটেম!”

স্বজনের সমস্যা শোনার বদলে সে শুরু করলো নিজের দুঃখের কথা,
– “কথায় আছে না, মা মরলে বাপ হয় তালোই? আমি এখন বলছি, বাচ্চা এলে বউ হয় ডাব।”

– “ডাব?”

– “হ্যা, আগে বউ ছিল পাঁকা পেয়ারা। দেখতেও সুন্দর, স্বাদও মিষ্টি, কাছে পাওয়া একদম সহজ! আর এখন হয়ে গেছে ডাব। টেস্ট ভালো, কিন্তু একটু স্বাদ পেতে গেলেও দা-বটি নিয়ে বসতে হয়!
এইজন্য পরামর্শ দেই, বউ ঝগড়া করুক আর যাই করুক,করতে দিন। এখন অবধি সে আপনার আছে। কদিন পরে দেখবেন, লিচুর বিচি হয়ে গড়াগড়ি খেতে হবে। আর…”

ফোঁস করে দম ফেলে কলটাই কেটে দিলো স্বজন। এ কাকে কল করেছে সমাধান চাইতে? হতাশ হয়ে বসামাত্রই প্রীতি জামাকাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়ালো তার সামনে। ছলছল চোখে চেয়ে কাপড়গুলো মুখের উপর ছুড়ে বললো,
– “আপনি একবার মানাতেও এলেন না?”

রাত এগারোটার আগেই মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ে প্রজ্ঞা। সে ঘুমোয় না, তবে আগেআগে শুয়ে পড়া ভালো, ধীরেধীরে ঘুমোনোর অভ্যাস হয়ে যাবে। পূর্ণতা শুয়েশুয়ে একহাত মায়ের গালে রেখে চোখ বুজে দুধ খাচ্ছিলো। প্রজ্ঞা তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, মৃদু আওয়াজে ঘুম পাড়ানির গান গায়।
এনজাম আসে মিনিট পাঁচেক বাদে। লাইট নেভায় না, যদি মেয়ে ভয় পায়? ওভাবেই এসে শুয়ে পড়ে বিছানায়। প্রজ্ঞা মাঝে শোয়, তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে মেয়ের দিকেই ঘুরে থাকে সবসময়। এনজাম খানিক বাদে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
– “বাচ্চা এলে বউ হয়ে যায় নারকেলের মতো। ভেতরে এখনো মিষ্টি, কিন্তু কাছে পাওয়া মানে কড়া খোলস ফাটানোর যুদ্ধ! আগে ছিলো আঙুরের মতো, ধরলেই চলে আসতো। এখন নারকেল, দেখতে পাই, ছুঁতে গেলে ঠাঁই নাই!”

প্রজ্ঞা ঠোঁট চেপে হাসে, কোনো প্রত্যুত্তর জানায় না। মিনিট পাঁচেক বাদে এনজাম আবারো বলে,
– “একসময় আমার বউ ছিলো আমের মতো, একটু তাকালেই ঝরে পড়তো। আর এখন হয়ে গেছে জাম্বুরা। বাইরে টসটসে, কিন্তু খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে জীবন শেষ!”

প্রজ্ঞা এবার ঘাড় ফিরিয়ে ক্ষুব্ধ স্বরে বলে,
– “মানুষ বউকে ফুলের সঙ্গে তুলনা করে, আর তুমি কী করছো?”

– “জনসনস বেবি পাউডার।”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো এনজাম। প্রজ্ঞা অবাক হয়ে বলে,
– “অ্যাহ?”

– “ওটা আর হ্যাপি ন্যাপি ওয়েট ওয়াইপ্স ব্যতীত শরীরে কোনো সুবাস ই তো পাইনা। পরের বার দেখেশুনে ফুলের সুবাসযুক্ত ওয়েট ওয়াইপ্স কিনে আনবে। তারপর তুলনা করবো ফুলের সাথে।”

প্রজ্ঞা কিছু বলার পূর্বে সে তার দিকে তাকিয়ে ভাবুক স্বরে বলে,
– “এবার বুঝেছি, তুমি আগে রোজ রাতের বেলা গোসলে কেন ঢুকতে। বলতে তো, ছোট বেলাকার অভ্যাস। এখন তো বুঝতে পারছি, গোলাপের সুবাসযুক্ত বডি ওয়াশ মেখে গোসল করে এসে সিডিউস করতে না আমাকে?”

প্রজ্ঞা চোখ কপালে তুলে বলে,
– “মাথা খারাপ নাকি?”

– “উহুহু… ধরা তো পড়েই গেলে। কই, এখন তো পাইনা ফুলের সুবাস! তুলনা করবো কী করে? তুমি চাইলে আমাকে সিডিউস করার চেষ্টা আবার করতেই পারো। তখন ভেবে দেখবো, প্রশংসা করা যায় কিনা।”

চোখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বললো এনজাম। প্রজ্ঞা আচমকা নিজ স্থান ছেড়ে উঠে এলো তার বুকের উপর। এনজাম অবাক চোখে তাকানোমাত্র সে চোখের ইশারায় পূর্ণতার দিকে নির্দেশ করে। এনজাম তাকাতেই আকাশ থেকে পড়লো। তার মেয়ে… রাত এগারোটার আগে চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে! এও সম্ভব? কী করে? এ তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!

প্রজ্ঞা তার হা করে থাকা মুখটা ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। সরু চোখে চেয়ে বললো,
– “বললে কী? তোমাকে সিডিউস করি আমি? ঠ্যাকা পড়েছে নাকি আমার?”

এনজামের ফোনটা আবারো বেজে উঠলো। শাফায়াতের কল। সে না তাকিয়েই রিসিভ করে বললো,
– “দ্যা পারসন ইউ আর কল ইজ কারেন্টলি ট্রাইং টু রি-গেইন হিজ বউ’স অ্যাটেনশন হু ইজ থিংকিং হিম অ্যাজ হার পার্সোনাল চৌকিদার। আপনার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি এই মুহূর্তে বিজিং টু ইমপ্রেস হিজ বাচ্চার মাদার। প্লিজ কল আফটার শি ফাইনালি রিমেম্বার দ্যাট হি এক্সিস্ট, নট শুধু হোমওয়ার্ক, ডায়েপার চেঞ্জিং অ্যান্ড দুধের বোতল ক্যারিং।”

কল কেটে ফোনটা সে রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলের উপর। প্রজ্ঞা একটু নিচু হয়ে গলায় মুখ ঘষলো তার। মুহূর্তেই মুখ বিকৃত করে বললো,
– “আমার শরীর থেকে তো তাও জনসনস পাউডার এর স্মেল পাওয়া যায়। তোমার শরীরে দুর্গন্ধ ব্যতীত আর কিছুই তো পাচ্ছিনা। এখন পাঠাই গোলাপের সুবাসযুক্ত বডি ওয়াশ দিয়ে গোসল করতে?”

এনজাম তার গালে দুটো চুমু খেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে,
– “কাল থেকে গোলাপ,পদ্মা,শিউলি,ডালিয়া সব দিয়ে গোসল করে আসবো জান। আজকে এই শাস্তি দিওনা প্লিজ! এই রাত… তোমার আমার…”

প্রজ্ঞাও সুর মিলিয়ে গায়,
– “এই চাঁদ, তোমার আমার। শুধু দুজনের…”

দু জোড়া ঔষ্ঠ্য অবিলম্বে মিলিত হয় একে অপরের সঙ্গে। চুম্বনের গতি এমন, যেন এখনই তাদের ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে যাওয়া এক প্রেমিক যুগল একে অপরের তৃষ্ণায় বড্ড তৃষ্ণার্ত। সময় পেরোলো কয়েক মিনিট।

কিন্তু একি! হুট করে গালে কেউ চ’ড় মারলো এনজামের। তড়িৎবেগে চোখ মেললো সে। প্রজ্ঞার চোখের দিকে তাকিয়ে এবার একসঙ্গে পাশে তাকায় দুজন। হা করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
পূর্ণতা ঘুম থেকে উঠে উপুড় হয়ে শুয়ে চুক চুক করে আঙুল চুষছে। পা দাপিয়ে খেলছে। অন্যহাত ছোড়াছুঁড়ি করতে গিয়েই বাবার গালে এসে লেগেছে। প্রজ্ঞা,এনজাম দুজনেই এবার অসহায় চোখে তাকালো একে অপরের দিকে। প্রজ্ঞার চোখ বলছে, “আমার কী দোষ?”

নিজের উপর থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো এনজাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে পা বাড়াতেই প্রজ্ঞা জিজ্ঞেস করলো,
– “কই যাও?”

এনজাম ঘাড় ঘুরালো। একবার মেয়ের দিকে, আরেকবার তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– “উনো আনতে, খেলবো। ও ছাড়া আর কিছু নেই আমার কপালে।”

#চলবে?

#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪৪ [শেষাংশ]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন

শাফায়াতের বাবা শরিফুল আহসান, বয়সটা তার ষাট ছুঁয়েছে। স্বাভাবিক অর্থেই শরীরটাও নানান ধরণের রোগের বাসস্থান হয়ে উঠছে ধীরেধীরে। ব্যক্তিজীবনে সুস্থতার একটি বড় অংশ হলো মানসিক স্বাস্থ্য। আনন্দের মাঝে থাকা ব্যক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামান্য রোগে নুইয়ে পড়েন না। শরিফুল সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। যৌথ পরিবারের অংশ হলেও সন্ধ্যার চায়ের আড্ডায় তার বসা হয়না বহুদিন। ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা সম্মান করে তাকে, তিনিও ভালোবাসেন সবাইকে, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মত প্রকাশ করেন। এইটুকুই… এছাড়া কারও সঙ্গে তার সময় কাটানো হয়ে ওঠেনা।

বেশ কয়েকমাস যাবৎ মাঝেসাঝে বুকে ব্যাথা হতো তার। শাফায়াতকে জানিয়েছেন সপ্তাহখানেক আগে। তবুও অনেক প্রশ্নের পর তার মুখ থেকে কথা বের করা সম্ভব হয়েছে। ছেলে হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালনে কখনো গাফিলতি করতে চায়নি শাফায়াত। তাইতো দুদিনের মাঝেই চলে এসেছে বাড়িতে, নিজেই বাবাকে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে। সব ধরণের পরীক্ষার পর ডাক্তার বলেছেন কিছুটা ব্লক রয়েছে, দুমাসের ঔষধ দিয়েছেন। এগুলো শেষ হলে আবার যেতে বলেছেন তার কাছে। ঠিক হয়ে গেলে ভালো, নাহলে তারা অন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

একটা কেস নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছলো শাফায়াতের। সময়ের সাথে একটু একটু করে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে সে, সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাইলেও খুব বেশিদিন থাকা সম্ভব ছিলোনা। সে তা চায়ও না।
বিকেলের বাস তার। ভোরবেলা ফজরের সময় কলপাড়ে ওযু করতে এসে বাবার সঙ্গে দেখা হয় তার। মুখে পানি দিতে দিতে জানতে চায়,
– “ঘুম হয়েছে রাতে? সমস্যা বুঝো কোনো?”

শরিফুল সাহেব জবাব দেন,
– “নাহ, আর সমস্যা কীসের। আজকেই চলে যাবি?”

– “হ্যা। কাজ আছে। সময় পেলে আসবো আবার। ওষুধপাতি ঠিকভাবে খেও। শান্তাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবো, তাও নিজে দেখে নিও।”

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানান তিনি। জানুয়ারি মাস, ভোরের কুয়াশার মাঝে বাবা-ছেলে গায়ে চাদর জড়িয়ে চলে গেলেন মসজিদে। নামাজ শেষে শরিফুল সাহেব ছেলেকে নিয়ে গেলেন সবজির বাগানে। নিজের জমিজমা, সম্পত্তি ছেলেকে দেখানোর আর সময় কোথায় পান তিনি? ঘুরেঘুরে সবকিছু দেখালেন তিনি ছেলেকে। কোন জায়গা তার, কতটুকু তার ভাইদের, কতটুকু বোনেদের। শাফায়াত মুখে হাসি টেনে বলে,
– “মনে থাকবে এসব? শুধুশুধু বোঝাচ্ছো। তোমার জিনিস, বুঝে রাখো নিজেই। আমাকে দেখানোর প্রয়োজন নেই।”

শরিফুল সাহেব হেসে উঠে তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
– “কবরে এক পা রেখে বসে আছি, এখন আর আমার কী? ম’রার পর যেন কিছু নিয়ে ঝামেলা না হয়, এটুকু বলে যাই।”

শাফায়াত ভ্রু কুঁচকালো,
– “মৃত্যুর ভয় মনে থাকলে দুনিয়ার কাজবাজ ছেড়ে এখন আল্লাহ খোদার নাম জপো। বাসায় থাকো কতক্ষন? ব্যাবসা বাণিজ্যের পাঠ চুকিয়ে বিশ্রাম করো এখন। এতটা অপারগ হয়ে যাইনি যে বুড়ো বয়সে বাপকে নিজে কাজ করে খেতে হবে।”

শরিফুল আহসান এক তৃপ্তির হাসি আঁটলেন মুখে। ছোট থেকে লোকে বলেছে, ছেলে দেখতে হয়েছে মায়ের মতো, কেবল গায়ের রংটা বাবার দিক থেকে পেয়েছে। তার মায়ের বর্ণ ছিলো একেবারে দুধে আলতা। যৌবনকালে অতি আদরের বউকে তিনি সাজিয়ে রাখতে চাইতেন। কী সুন্দর এক সংসার ছিলো তাদের! মানুষের নজর লাগলো তাতে, বিয়ের পাঁচ ছয়বছর পর থেকে তার মনে হলো তিনি বউয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আগের ন্যায় তাকে দেখার তৃষ্ণা নেই মনে। ব্যাবসায়ে তিনদিনের কাজ দুদিনে সেরে বাড়ি ফিরে আসার তাড়া কাজ করেনা নিজের মাঝে। উঁহু, তিনি কোনোপ্রকার পরকীয়ায় জড়াননি। বউ বাচ্চার প্রতি সকল দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছেন, তাদের সুখে রেখেছেন। শাফায়াতের মায়ের দিক থেকেও কিছুটা গাফিলতি ছিলো বোধ হয়। তিনি সংসারী হয়ে ওঠেন, সন্তানের যত্ন নেন। এসবের মাঝেই নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়াটা তাদের কখন যে নড়বড়ে হয়ে যায়, তারা বুঝতেই পারেনি। সম্পর্কে কখনো একঘেয়েমি চলে এলে, তাতে ভাঙন ধরার বিস্তর সম্ভাবনা থাকে। তাদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। ধীরেধীরে সামান্য বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু হলো নিজেদের মাঝে। সহজেই সবটা মিটমাট করে নেওয়ার ইচ্ছে জাগ্রত হয়নি তাদের মাঝে। একসময় লক্ষ্য করলেন, তাদের মধ্যকার অস্বাস্থ্যকর এই সম্পর্কের প্রভাব পড়ছে ছোট্ট শাফায়াতের উপর। সে বাবা মা-কে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে, এই বুঝি তারা রেগে যায়!

তারা ধৈর্য ধরতে ব্যার্থ হয়েছিলেন, কিংবা তাদের বোঝানোর জন্য তখন শাফায়াতের ন্যায় বুঝদার কেউ ছিলোনা। পরিবারের কথা তারা কানে নেয়নি। একসময় এই সম্পর্কের পরিণতি হিসেবে বিচ্ছেদকেই শ্রেয় মনে করে আলাদা হয়ে যায় দুজন, ভিন্ন হয়ে যায় তাদের দুই পথ। মাঝের অপরিচিত বিষাদপূর্ণ রাস্তাটা অবশিষ্ট রয়ে যায় শাফায়াতের জন্য। সেই পথ পেরিয়েই আজ সে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।

বালু ফেলানো পথ ধরে হাঁটার সময় শাফায়াত পাশের উঁচু গাছগুলোর পানে চোখ রেখে হুট করেই জানতে চাইলো,
– “একা থাকতে খারাপ লাগেনা? বয়স হচ্ছে তোমার, ঔষধ এগিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও তো কাউকে প্রয়োজন। বিয়ে করছোনা কেন?”

শরিফুল সাহেব অবাক হয়ে চাইলেব ছেলের দিকে। বিয়ের বিষয়ে সে এযাবতকালে কোনো কথা তোলেনি,এই প্রথম। তার বিস্ময়তা লক্ষ্য করে শাফায়াত শান্ত গলায় শুধায়,
– “কারণটা আমি হলে সেটা অহেতুক। কিছুই মনে করবোনা। যথেষ্ট বড় হয়েছি আমি, তোমরা ভালো থাকলেই ভালো লাগবে আমার।”

– “এত ভালো রাখার ইচ্ছে থাকলে নিজে বিয়ে করো। নাতিপুতি এনে দাও, তাদের নিয়ে সময় কাটাই।”
বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। শাফায়াত স্মিত হেসে মাথা নোয়ায়। বাবার সাথে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলে শাফায়াত সাহস করে আজ জিজ্ঞেস করতো, ‘এমন ভুল করলে কেন, যেখানে অনুতপ্ততাও ভিত্তিহীন হয়ে যায়?’ তেমন সম্পর্ক নয় তাদের, জিজ্ঞেস করাও হলোনা তাই। তবে সে প্রস্তাব জানায়,
– “আমার কাছে গিয়ে থাকো তাহলে। কিছু ভালো রান্না শেখা যাবে।”

শরিফুল সাহেব শব্দ করে হাসলেন এবার। তিনি ভালো রান্না জানেন, শাফায়াতের মায়ের সঙ্গে থেকে অনেককিছুই শিখেছিলেন। তারই কথা বলছে শাফায়াত। ছেলের কাঁধে হাত রেখে খুশিমনে বললেন তিনি,
– “ছেলে বলেছে যখন, যাবো কখনো। হুট করে… সারপ্রাইজ।”

– – –

– “পূর্ণ তোকে আমি দাঁড়াতে বলেছি! পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবি, এভাবে হাঁটতে হয়না।”

কে শোনে কার কথা, পূর্ণতা আপনমনে জুতোয় শব্দ তুলে হেঁটেই চলেছে। নেহাতই গলিটা চিকন বলে গাড়ি চলে আসার সম্ভাবনা নেই। প্রণয় হাপিয়ে যায় ছুটতে ছুটতে। এইটুকু পুঁচকে মেয়ে,বয়স এখনো দু বছর হয়নি, সে এত দৌড়ায় কী করে? আর মা,বাবার ও কোনো চিন্তা নেই তাকে নিয়ে। কী সুন্দর আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে তাদের পিছনে! এনজাম বলেছে, মেয়েটা হাঁটছে হাঁটুক, এই রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট এর সম্ভাবনা নেই।
তবুও…যত চিন্তা সব প্রণয়ের। একটামাত্র বোন তার! দৌড়োতে গিয়ে এক সময় হাতে থাকা চকবার আইসক্রিমটা পড়ে যায় পূর্ণতার। পা থেমে যায় তার, চোখ ভরে আসে জলে। অর্ধেকটাও খাওয়া হয়নি যে! এখন কাঁদতেও কেমন লাগছে, ভাইয়া তো বারণ করেছিলো। বলেছিলো আস্তে হাঁটতে, সে শোনেনি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। প্রণয় এবার ধীরেসুস্থে এসে দাঁড়ায় তার পাশে। একটু নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– “পড়ে গেল?”

মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানায় পূর্ণতা। নাক টানে দু-বার, চোখের পলকে ঘন পাপড়িগুলো ভিজে ওঠে। প্রণয় তার হাতটা টেনে নিজের আইসক্রিমটা ধরিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলে,
– “আমার কথা না শুনলে এমন ই হবে। আর করবিনা এমন, ঠিক আছে?”

পূর্ণতার মুখে একরাশ হাসি ফুটে উঠলো সঙ্গেসঙ্গে। আইসক্রিমটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে বললো,
– “ইতা আমাল?”

– “হ্যাঁ।”

‘ইয়ে’ বলে আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগী হলো সে। এবার আর ছোটাছুটি করলোনা, ভাইয়ের কথা শুনলো। এনজাম-প্রজ্ঞা ভাইবোনের কার্যকলাপ দেখছিলো পিছন থেকে। মুচকি হেসে এগিয়ে আসে তারা। এনজাম প্রণয়ের পাশে এসে তাকে কোলে তুলে নেয়। জিজ্ঞেস করে,
– “বোনকে দিয়ে দিলে আইসক্রিম? এখন তুমি কী খাবে?”

প্রণয় বাবার আইসক্রিম এ একটা কামড় দিয়ে বলে,
– “তুমি দেবে।”

এনজাম হেসে উঠে নিজের আইসক্রিমটা ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয়। তাকিয়ে দেখে দুই মা মেয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে নিজেদের মতো আইসক্রিম খেয়েই চলেছে। ভ্রু কুঁচকে বলে এনজাম,
– “ছেলের থেকে শেখো কিছু। তুমি কখনো দিতে কাউকে নিজের আইসক্রিম?”

প্রজ্ঞা মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে,
– “এগুলো ছেলেদের ই কাজ। আমার ছেলে বলে কথা। এখন বোনকে দিচ্ছে,ভবিষ্যতে বউকে দেবে। তোমার মতো নাকি? আইসক্রিমের শেষ চামচ নিয়েও ঝগড়া করে…কিপটা কোথাকার।”

– “এই দেখো, সবকিছু মেনে নেবো কিন্তু আইসক্রিমের শেষ চামচ নিয়ে কোনো তর্ক চলবেনা। ওটা আমিই খাবো।”

প্রজ্ঞা নাক শিটকে বলে,
– “নির্লজ্জ একটা, কেমন প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মতো কথা বলছে দেখো! পেট তো সেভাবেই ফুলছে। পরশু রাতে দেখলাম বমিও করছো, কাল বললে মাথা ঘুরছে। আসতাগফিরুল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কু ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ… হে মাবুদ, এ কী সর্বনাশ হলো আমার!”

এনজাম থতমত খেয়ে যায় তার কথায়। বাচ্চাদের সামনে এসব কী? প্রজ্ঞা মেয়েকে নিয়েই হাঁটা ধরলো। এনজাম তার পিছু ধরে চেঁচিয়ে বললো,
– “পেট ফুলছে তোমার বানানো অতিরিক্ত তেলের খাবার খেয়ে। বমিও করছিলাম বদ হজম এর কারণে, আর মাথা ঘুরছিলো তোমার ফালতু প্যানপ্যানানি শুনে।”

— —

রাত নয়টা বাজতেই বাসার মধ্যে শুরু হয় এক নতুন যুদ্ধ। স্পষ্টভাষায় একে খাওয়ানোর যুদ্ধ বলা হয়। বলা ভালো, প্রজ্ঞা-এনজাম এখনো মোহাম্মদপুর এর ফ্ল্যাটেই থাকছে। একটা মায়া পড়ে গেছে তাদের, চেয়েও যেতে পারছেনা নতুন বাড়িতে। ভেবেছে মেয়েটা আরেকটু বড় হোক, তারপর যাবে নাহয়। ততদিন থাকুক একসঙ্গে।

পূর্ণতার চুল এইটুকু বয়সেই কাঁধ ছাড়িয়েছে। ভাইয়ের খুব পছন্দের তার চুল। ছোটবেলায় একবার কাটানোর পর আর কাটাতে দেয়নি। একবার প্রজ্ঞা বলেছিলো গরমের কারণে চুল কেটে ফেলবে, প্রণয়ের সে কী কান্না! যেন তার চুলই কেটে ফেলার কথা বলা হয়েছে। তার কান্না দেখে টুশিও কাঁদে। দুজন মিলে মা, মামির হাতেপায়ে ধরে পূর্ণতার চুল কাটা আটকেছে সেবার।

হাতে ভাতের থালাটা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো প্রজ্ঞা। নাহ, আর সম্ভব নয়। যেখানে প্রণয়ের খাবার নিয়ে কখনো বিশমিনিটের বেশি বসে থাকতে হয়নি,সেখানে এই মেয়ের খাবার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ধরে বসে থাকতে হয়, তবুও খাওয়ানো যায়না। এত দুষ্টু তার আদুরে মেয়েটা!
প্রণয় নিজের রংপেনসিল অবধি এনে দিলো তাকে। বললো,
– “নতুন ছবি এঁকে দেবো, এবার তো হা কর!”

এনজামও তাল মিলিয়ে বললো,
– “আম্মু, আমার সোনা মা! বাবা তোমাকে অ্যারোপ্লেইন বানিয়ে দেবো, হা করো বাচ্চা…”

পূর্ণতা মুখে হাত চেপে বসে রয়। হা করবে না তো করবেই না। প্রজ্ঞা রেগে যায় এতে। ঠা’স করে তার হাতের উপর একটা আলতো চ’ড় বসিয়ে বলে,
– “ফাজিল মেয়ে! হাত শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে যাচ্ছে তাও মুখ খোলার নাম নেই। লাঠি নিয়ে আসবো এখন, তখন ভালো লাগবে?”

পূর্ণতা কষ্ট পাওয়ার সঙ্গে রেগেও গেলো। ছুটে গিয়ে বাবার কোলের মাঝে ঢুকে আহ্লাদী স্বরে বললো,
– “মাম্মা মেলেচে।”

এনজাম ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় প্রজ্ঞার পানে। রাগ দেখিয়ে বলে,
– “কত বড় সাহস! এই তুমি মেরেছো কেন আমার মেয়েকে? আর কখনো মারবেনা। এইযে মা, বকে দিয়েছি। এবার খাও।”

– “মাম্মাকে মালো।”

এনজাম অসহায় চোখে তাকিয়ে দুয়েকটা চ’ড় বসালো প্রজ্ঞার গায়ে। প্রজ্ঞা শক্ত মুখে মেয়ের দিকে চেয়ে রয় শুধু। পূর্ণতা এবার গোলগোল চোখে তাকিয়ে বাবার কোল থেকে নেমে বলে,
– “মাম্মা জগলা কলো।”

হা করে তাকায় প্রজ্ঞা। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “মানে?”

– “মাম্মা বাবা জগলা কলো।”

খুবই উৎসুক কণ্ঠ তার। প্রজ্ঞা তেড়ে এসে বলে,
– “দেখেছো কাণ্ড! সে এখন মা বাবার ঝগড়া দেখতে চাইছে, মামা বাড়ির আবদার তো! এবার কিন্তু সত্যিই মা’র খাবে পূর্ণ, হা করো, খাওয়া শেষ করো।”

পূর্ণতা মায়ের কথা শুনেই আহ্লাদী ভঙ্গিতে কান্না জুড়ে দিলো। সে কী কান্না! নিচ থেকেও মানুষ শুনতে পারবে এমন, যেন তাকে কত মে’রেছে সবাই মিলে।
প্রজ্ঞা তার এহেন কাণ্ডে থতমত খেয়ে যায়। এনজাম উঠে আসতেই তার দিকে চেয়ে কড়া গলায় বলে,
– “দেখছোনা মেয়ে কাঁদছে? ঝগড়া করতে বলছে, করছোনা কেন ঝগড়া?”

এনজাম কোমড়ে হাত রেখেই একইভাবে বলে ওঠে,
– “তো তুমি কাঁদালে কেন আমার মেয়েকে? ঝগড়া করতে পারছোনা? করো ঝগড়া!”

– “আমি কেন করবো? সব দায় আমার? এই সুযোগে বোঝাতে চাইছো তো যে আমিই সবসময় ঝগড়া শুরু করি? আমি ফাঁসছিনা তোমার জালে।”

– “তোমার ফাঁসা না ফাঁসায় আর কী এসে যায়? যেটা সত্যি সেটা তো সত্যিই।”

– “তুমি কিন্তু আমাকে…”

পূর্ণতার হাততালির আওয়াজে পাশ ফিরলো তারা। কী সুন্দর খিলখিলিয়ে হাসছে সে। কত্ত খুশি বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে! তাকে খেয়াল করার খুব বেশি সময় অবশ্য হলোনা তাদের। পুনরায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে একেক যুক্তিতে তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়লো। পূর্ণতা এই ফাঁকে ছুটে চলে যায় ফুফির বাসায়। রাতে কোনো এক মেহমান আসবে বলে আনজুম প্লেট, বাটি, চামচ গুছিয়ে রাখছিলো। পূর্ণতা পাশে এসেই হাতের নাগালে গেলো দুটো চামচ। সেগুলো হাতে তুলে ফুফির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
– “ইতা কী কলবে পুপ্পি?”

আনজুম কাজের মাঝে একনজর তাকিয়ে বলে,
– “তোর বাপ মায়ের মাথায় দুইটা বাড়ি মে’রে আয়।”

– “বালি মালবো? কিনো?”

– “মা’র গিয়ে। দুটোতে আবার শুরু করেছে…”

পূর্ণতা হাতে থাকা চামচদুটোর দিকে তাকিয়ে বলে,
– “আচ্চা।”

আনজুম ফিরে তাকানোর পূর্বেই সে ছুটে যায় নিজেদের ঘরে। প্রণয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিছানায় উঠে দাঁড়িয়েই দুটো চামচ দ্বারা আঘাত করে দুজনের মাথায়। ছোট ছোট হাত তার, খুব জোরে লাগেনি। তবে অকস্মাৎ আক্রমণে তাল হারিয়ে একে অপরের সঙ্গে মাথায় বাড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যায় দুজন। মাথায় হাত ঘষে এনজাম মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,
– “এটা কী করলে মা?”

পূর্ণতা উত্তর দেয়,
– “পুপ্পি বুলেচে।”

আনজুম এসে বিরোধ জানিয়ে শুধায়,
– “আমিতো কথার কথা বলেছিলাম। তোদের মেয়ে যে সত্যি ভেবে নেবে তা কী করে জানবো?”

পূর্ণতা বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো আবারো। প্রজ্ঞা তার দিকে একবার তাকিয়ে রাগী চোখে তাকায় এনজামের পানে। মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে আনজুমের উদ্দেশ্যে হতাশ স্বরে বলে,
– “আপা, আমি বলছি, এই মেয়ের শরীরের নব্বই শতাংশ রক্তই ওর বাপের। আমার কাছ থেকে কোনোমতে দশ শতাংশ পেয়েছে হয়তো। নইলে এমন আকাইম্মা বুদ্ধি থাকবে কেন মাথায় বাপের মতো?”

এনজাম তেঁতে উঠে বললো,
– “আজব তো! শুধু আমাকে অপমান করে মন ভরেনা, এখন মেয়েকেও? শুধু নব্বই শতাংশ না, আমার মেয়ের শরীরের একশো শতাংশ রক্তই আমার। বড় হয়ে তোমার মতো ঝগড়ুটে হবেনা অ্যাটলিস্ট।”

– “এহহ আইছে… মেয়ের শতভাগ রক্ত তোমার হলে ছেলের শরীরে আমার রক্ত আছে। দেখোনা, আমার মতো ভদ্রসভ্য কিউট? আয় বাবা, আমার কলিজা, মায়ের কাছে আয়।”

প্রণয় আসে তার কাছে। একহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করে প্রজ্ঞা। এনজামও মেয়েকে কোলে তুলে বলে,
– “ছেলেকে নিয়েই থাকো তুমি। মেয়েকে আমিই সামলাতে পারবো। তাই না মা? বাবার কাছে খাবেনা তুমি?”

পূর্ণতা কিছুই বলেনা, ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। প্রজ্ঞা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণয়ের হাতটা চেপে ধরে বলে,
– “ওহহো, ভালো তো। থাকো মেয়েকে নিয়ে। আজ থেকে আমি আর আমার ছেলে অন্য ঘরে থাকবো। প্রণয়, লেটস গো…”

প্রণয়,পূর্ণতা আহাম্মকের ন্যায় চেয়ে দেখে দুজনকে। প্রজ্ঞা প্রণয়কে নিয়ে চলে যায় অন্যঘরে। আনজুম দুদিকে মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে যায় নিজের কাজে। এনজাম এবার খাবারের প্লেট নিয়ে বসে পূর্ণতার সামনে। ভালো বুদ্ধি বের করে নিজের ফোনটা ধরিয়ে দেয় তার হাতে। একদিন ফোন দেখে খেলে কিছুই হবেনা। এমনিতেও কাল প্রজ্ঞা ঠিকই মেয়ের কাছে চলে আসবে।
এনজামের বুদ্ধি ফলেও যায়। সুন্দরভাবে খেয়ে ওঠে পূর্ণতা। রান্নাঘরে প্লেট রাখতে গিয়ে প্রজ্ঞাকে দেখে ভেংচি কেটে চলে আসে সে। দরজা আটকে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে মেয়েকে নিয়ে। পূর্ণতা মা-কে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে,
– “মাম্মা আতবেনা?”

এনজাম তাকে বুকে জড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
– “মাম্মা ঘুমেশে পড়েছেন। তুমিও ঘুমাও মা, নাহলে পুলিশ আঙ্কেল চলে আসবে কিন্তু! জলদি জলদি চোখ বুজো তো। বাবা ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।”

পূর্ণতা বাবার সঙ্গে ঘুমোতে পারে, তাই কোনো কান্নাকাটি করলোনা। মিনিট দশেকের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো। এনজামও ঘুমোলো মেয়েকে বুকে নিয়ে। তবে বিপত্তি বাধলো ঘণ্টা দুয়েকের মাথায়।

ঘুমের মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার অভ্যাস পূর্ণতার। স্বভাবতই পাশে থাকা ব্যক্তিকে সে মা ভেবে বসলো। হাতের সাহায্যে এনজামের গেঞ্জি তুলে মা ভেবেই নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলো। বুকের পশমে নাক মুখে খোঁচা লাগতেই বিরক্ত হলো খুব। রেগে গিয়ে কামড় বসালো তার বুকে।

এতক্ষণে ঘুম ছুটলো এনজামের। রীতিমতো চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো সে। বুকে হাত দিয়ে বললো,
– “লা হাওলা ওয়ালা কু ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ…”

পূর্ণতা চোখ ডলে উঠে বসলো তখন,চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। এনজাম নিজের বুকে তার মুখের লালা দেখে চোখ বড়বড় করে বললো,
– “আম্মা, কী করছিলে তুমি?”

পূর্ণতা চোখ একটু খুলে বলে,
– “তুত্তু!”

এনজাম জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে শুধায়,
– “সেটা বাবার কাছে কী করে থাকবে মা? এখন ঘুমাও, সকালে খেও তুত্তু…মানে দুধ সকালে খেও হ্যা?”

– “না না না… একুন, তুত্তু!”

এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– “আচ্ছা, বাবা ফিডার বানিয়ে দেই?”

পূর্ণতা মাথা নেড়ে হাত পা ছড়িয়ে বললো,
– “না। পিদাল না, তুত্তু।”

– “আরে বাপ ফিডারের মধ্যেও তো তুত্তুই থাকে রে!”

– “পিদাল তুত্তু না, মাম্মা তুত্তু!”

বাবার কোলে এসে পুনরায় তার বুকে মুখ ঘষলো সে। এনজাম আর বসে রইলো না এবার। গোল্লায় যাক তার চ্যালেঞ্জ। পূর্ণতাকে কোলে নিয়েই ছুটলো অন্য ঘরে। মা,ছেলে হাত পা ছড়িয়ে কী শান্তির ঘুমটাই না ঘুমোচ্ছে। এনজাম এসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাকলো প্রজ্ঞাকে,
– “প্রজ্ঞা, সোনা আমার, ময়না পাখিটা… একটু ওঠো জান, তোমার মেয়েকে নাও, আমার ছেলেটাকে দাও।”

প্রজ্ঞা বিরক্তির সঙ্গে একচোখ খুলে বললো,
– “পারতাম না, সর। ঘুমোতে দে।”

এনজাম হাতেপায়ে ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো এবার,
– “আরে আমার কলিজা,ফুসফুস,কিডনি! দয়া কর মা, আমার ইজ্জত বাঁচা সোনা! খোদার কসম, মেয়ে তোর। ছেলে আমার।”

প্রজ্ঞা গম্ভীর গলায় বলে,
– “স্বিকার কর, তুই একটা আকাইম্মা?”

– “আকাইম্মার মাস্টার আমি। এবার মেয়েকে নাও, পাখি!”

প্রজ্ঞা ফোঁস করে দম ফেলে এনজাম কোল থেকে টেনে নিলো পূর্ণতাকে। পাশে শুইয়ে কামিজের নিচে তার মুখ লুকিয়ে চোখ বুজলো আবারো। পূর্ণতাও মায়ের গালে হাত রেখে ঘুমের মাঝে চুক চুক করে কয়েক সেকেন্ড দুধ খেয়েই পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লো। কোনো ঝামেলাই নেই! এনজাম হতভম্ব হয়ে চেয়ে রয় তাদের পানে। হা করে তাকিয়ে মাথা চুলকায়। ঠোঁট উল্টে বাহবা জানানোর ভঙ্গিতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– “গাজাব কি চিজ হে ইয়ার!”

#চলবে?