#নব্বই_পাতার_ডায়েরী
#পর্ব_৪৫ [অন্তিম পর্ব]
#মৌরিন_জিনাত_জাহিন
পরিবারে ভাইবোনের সংখ্যা চার। প্রণয় তাদের মধ্যে সবার বড়। আজকাল তার আফসোস হয় খুব, তার ছোট কোনো ভাই নেই কেন? তিনজনই মেয়ে কেন? এইযে তিনজন আদাজল খেয়ে তার পিছনে লেগে থাকে, একটা চুল ধরে টানে তো বাকি দুটো চশমা ধরে। নিজেই একটা বাচ্চা সে, এদের কী করে সামলাবে? কোথাও ঘুড়তে এসেও দু দণ্ড শান্তি পায়না ছেলেটা। এইযে নিজের ম্যাঙ্গো ফ্লেভার ললিপপটা খুলতে নিলো মাত্র, অমনি পাশ থেকে টুশি চেঁচিয়ে উঠলো,
– “তুমি সবুজ কালার নিয়েছো কেন? আমারটা পিঙ্ক কালার কেন? আমি ওটা নেবো, দাও!”
প্রণয় ভদ্র ছেলে, ঝগড়া টগড়ার ধারেকাছেও নেই। চুপচাপ নিজের ললিপপটা দিয়ে তার থেকে স্ট্রবেরি ফ্লেভার টা নিয়ে নিলো। সেটা খুলতে নিলেই আবার পূর্ণতা নিজের টার সাথে মিলিয়ে বললো,
– “তোমালটা এমন কিনো? আমালটা চাদা কিনো? ওতা আমাকে দাও!”
প্রণয় বিরক্ত হয়ে দিয়ে দিলো, হাতে নিলো লিচি ফ্লেভার ললিপপ। এবারে কেউ প্রতিবাদ জানালো না ঠিকই, তবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। তার ললিপপের থেকে চোখ সরিয়ে নিজের টার দিকে তাকালো। ভাইবোনেদের মাঝে এখন অবধি সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য সে। বয়স আর কতো, দেড় বছর হবে। প্রণয় তার মুখভঙ্গি দেখে ফিঁক করে হেসে ফেললো। ভাগ্যক্রমে তাদের ললিপপের ফ্লেভার মিলে গেছে, নইলে এই বাচ্চাও কান্না জুড়ে দিতো নিশ্চিত। প্রণয় তাকে কোলে তুলে বসালো। দু-পাশে পূর্ণতা,টুশি। আর কোলে স্মৃতি, স্বজন-প্রীতির একমাত্র মেয়ে। তার অবশ্য আরেকটা নাম আছে। দেখতে ভীষন আদুরে বলে প্রজ্ঞা তাকে আদুরী বলেও ডাকে।
প্রণয় তার হাত থেকে ললিপপটা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– “খাবে? খুলে দেবো?”
চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়ে স্মৃতি। তিনি যথেষ্ট ভদ্র, একেবারে প্রণয়ের মতো। যে কেউ কোলে নিয়ে রাখতে পারবে,কিচ্ছুটি বলবে না। তার শুধু একটা কোল হলেই চলে। প্রণয় ললিপপটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দেয়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সবে তা মুখে দিয়েছিলো স্মৃতি, তারই মাঝে প্রীতি ফিডার হাতে ছুটে এসে চেপে ধরলো হাতখানা। দুদিকে মাথা নেড়ে বললো,
– “নো বেবি, এখন এটা খাবেনা। এমনিতেই পেটেব্যাথা হয় তোমার। কোন এক কচুর ডাক্তার, মেয়ের কান্না থামাতে পারেনা…”
স্বজন পাশে এসে বুকে হাত গুঁজে বলে,
– “হুটহাট বললেই বাচ্চাদের ঔষধ দেওয়া যায়না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এতে। যেগুলো খেলে সমস্যা হয় সেগুলো থেকে দূরে রাখতে হবে। দেখি মা, ওটা দাও। আমি তোমাকে ফ্রেশ ফ্রুটস কিনে দেবো।”
ললিপপটা নিয়ে মেয়েকে কোলে তুললো স্বজন। গিয়ে বসলো সবুজ ঘাসের মাঝে। প্রজ্ঞা,এনজামের ভার্সিটি ক্যাম্পাস এটা। সকাল থেকে সবাই মিলে পার্ক, রেসট্রন্ট বহু জায়গা ঘুড়ে শেষ অবধি এখানে এসে থেমেছে। তা অবশ্য প্রজ্ঞার কথায়, টেনে নিয়ে এসেছে এনজামকে। সবার থেকে খানিকটা দূরে সরে বসেছে এক গাছের ছায়ায়।
এনজামের হাতে ক্যানভাস,রংতুলি আর পাশে জলরঙ। বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে একবার তাকাচ্ছে প্রজ্ঞার পানে, আরেকবার ক্যানভাসের দিকে। প্রজ্ঞা মুখে বিস্তর হাসির রেখা টেনে বারবার উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতেই এনজাম ধমকে উঠলো,
– “সোজা হয়ে না বসলে ছবিও বাঁকাই আঁকবো। তখন মনে হবে কোমরটা ভেঙে দিয়েছে কেউ।”
প্রজ্ঞা চোখ কপালে তুকে বুকে হাত গুঁজে বললো,
– “আমার কোমর একদম ঠিক আছে।”
এনজাম মুখ বেঁকিয়ে শুধায়,
– “তো আসো, একটা লা’থি দিয়ে বাঁকা বানিয়ে দেই। রাতের বেলা তোমার লা’থি খেতে খেতে তো মেরুদন্ড বাঁকা হওয়ার পর্যায়ে চলেই এসেছে, তুমি আর সুস্থ থাকবে কী করতে? অসহ্য…”
তার কথায় গাল ফোলালো প্রজ্ঞা। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কাটকাট গলায় বলে দিলো,
– “আজকে থেকে ঘুমোতে হবেনা আমার কাছে, অন্য ঘরে থাকবে। মাঝরাতে এসে সোনা ময়না কোকিল টিয়া বলেও কোনো কাজ হবেনা।”
ফোঁস করে দম ফেললো এনজাম। বিড়বিড়িয়ে বললো,
– “মেয়ে মানুষের এই এক হাতিয়ার। কিছু হলেই ‘থাকতে হবেনা’… মামা বাড়ির আবদার তো!”
– “কী বললে?”
একটু স্থির হয়ে বসলো এনজাম। শান্ত কণ্ঠে শুধালো,
– “মুখটাকে প্যাঁচার মতো না রেখে স্বাভাবিকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বোসো। পরে ছবি খারাপ হলে আমার দোষ নেই। এসবের হাত আছে নাকি এখন আর!”
– “প্রেম করার সময়, কথা দেওয়ার সময় মনে ছিলোনা?”
সরু চোখে তাকিয়ে বলে প্রজ্ঞা। এনজাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্যানভাসে তুলি ঘুরিয়ে গেয়ে ওঠে,
– “ওরে পিরিতি কাঁঠালের আঠা,
সে আঠা লাগলে পরে ছাড়েনা…
গোলেমালে গোলেমারে পিরিত কইরো না।”
।
স্বজন মেয়েকে কোলে বসিয়ে ফিডারটা মুখের সামনে ধরে রেখেছে, চোখের ভঙ্গিমায় খেলছে তার সঙ্গে। একটু পর পর গিয়ে নাকে নাক ঘষে দিচ্ছে। প্রীতি হাতের উপর থুঁতনি রেখে স্মিত হেসে তাকিয়ে দেখে এই দৃশ্য। সে নিজেকে খুব সুখী ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। একটা মেয়ের ভালো থাকার জন্য কী-ই বা চাই? একটা সুন্দর পরিবার, গর্বের পেশা, চমৎকার জীবনসঙ্গী, সঙ্গে মাতৃত্ব,যা তার সুখের সংসারকে পরিপূর্ণ করে তোলে।
স্বজনের মাধ্যমে দারুণ এক পরিবার পেয়েছে প্রীতি, অনেক মানুষের সন্নিবেশের যৌথ পরিবার। সবাই সেখানে মিলেমিশে থাকে, একে অন্যের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। ছোট থেকে কেবল তিনজনের মাঝে বড় হওয়া প্রীতির জন্য এটা খুব বড় একটা পাওয়া ছিলো।
এরপর আসে স্বজনের কথা। তাকে সে অসাধারণ প্রেমিক এর বদলে একজন যোগ্য স্বামী বলতেই পছন্দ করে। কেননা ভালো স্বামীর মাঝে প্রেমিকের গুণ একটু আকটু থাকেই, স্বজন নিজেই বলেছিলো। সে সংসারী মানুষ, পরিবারকে ভালোবাসে, সবার দিকে খেয়াল রাখে। অতি ভাবুক নয় বলেই বোধ হয় প্রীতির ভাবনাগুলো সময় নিয়ে শুনতে পছন্দ করে, নিজের তুলনায় তার মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেয়। একজন বুদ্ধিমতি নারীকে সে যথাযথ সম্মান দিতে পারে।
নাহ, তাদের মাঝে ঝগড়া যে একদম হয়না, তেমনটা নয়। তবে সেটাকে ঝগড়া,তর্ক না বলে খুনসুটি বলাই ভালো। বউ হিসেবে প্রীতি মাঝেসাঝেই গাল ফোলায়, অভিমান করে। খুব বেশি নয়, স্বজন মানিয়ে নিতে পারে। আবার সে-ও দুয়েকটা কাজ নিয়ে বকে, প্রীতি ঠান্ডা মাথায় কখনো শোনে,কখনো শোনেনা। এভাবেই চলছে জীবন।
বউকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বজন মৃদু হেসে শুধায়,
– “কী ব্যাপার উকিল সাহেবা? চোখের পলক পড়ছেই না একদম! আমার বয়স কমছে নাকি দিনদিন?”
– “খুব দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। ঐযে দাড়ি পেঁকে যাচ্ছে… মেয়ে এখনো স্কুলে ভর্তি হতে তিন চার বছর বাকি। আপনার কী হাল হবে বলুন তো? বাবা না বলে দাদা বলবে মানুষ।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে প্রীতি। স্বজনও একইভাবে শুধায়,
– “আপনি আগে কেন এলেন না বলুন তো? এতদিনে কোলে আরো দুয়েকটা থাকতো তাহলে।”
দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে একসঙ্গে হেসে ফেললো তারা। তাদের দেখে ফিডার মুখ থেকে সরিয়ে হাসলো স্মৃতিও। কী সুন্দর পরিবার তাদের! আল্লাহ নিরাশ করেননি প্রীতিকে। ধৈর্য,ভরসার ফল সে ভালোভাবেই পেয়েছে। তার এই সুখের সংসারে কখনো কারো নজর না লাগুক…
প্রজ্ঞা বসে থাকতে থাকতে লম্বা হাই তুললো। কিছু বললোনা এনজামকে, বিহুদিন পর এই তুলি ধরেছে হাতে, সময় নিয়েই আঁকুক তাকে। নিজের আটাশতম জন্মদিনের ছোট অথচ অতি মূল্যবান উপহার হিসেবে সাজিয়ে রাখবে সে এই চিত্র। যেমন দশবছর আগের ক্যানভাসটা যত্নে রেখেছে, তেমনই এটাও সামলে রাখবে। প্রজ্ঞা তাকিয়ে দেখে এনজামকে, বড্ড অবাক হয়, বাস্তবতা যেন বিশ্বাসই হতে চায়না। বাইশ বছরের সেই তরুণ নাকি এখন বত্রিশ এর যুবক, তার দুই সন্তানের বাবা! নানান ঝড়ঝাপটা পেড়িয়ে সে নিজের কথা রাখছে অবশেষে।
এনজাম তাকায়নি, তবুও কীভাবে যেন প্রজ্ঞার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বসলো। চোখ না তুলেই বললো,
– “আরো দশমিনিট লাগবে। ততক্ষনে বলো, ট্রেনিং কতদূর এগোলো?”
– “কীসের ট্রেনিং?”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো প্রজ্ঞা। এনজাম একনজর তাকিয়ে বললো,
– “ঐযে, ভালো বউ হওয়ার ট্রেনিং।”
প্রজ্ঞা কোমড়ে হাত রেখে বলে,
– “আমাকে জিজ্ঞেস করার আগে কি নিজেকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ নয়?”
– “ওমা… আমি কবে কথা দিয়েছিলাম ভালো স্বামী হবো?”
– “দাওনি?”
– “অবশ্যই না, কারণ আমি শুরু থেকেই ভালো ছিলাম।”
প্রজ্ঞা চোখ বড়বড় করে বললো,
– “ওরে আমার ভালোর তালতো ভাই! এত ভালো থাকলে কান্নাকাটি করে কতগুলো চুক্তি কে গ্রহণ করেছিলো?”
এনজাম বাঁকা হেসে বলে,
– “অস্বিকার করেছি নাকি? যা বলেছি তা আমি করেছি।”
– “আচ্ছা, ঠিক কী কী করেছেন বলুন।”
গালে হাত ঠেকিয়ে শুধায় প্রজ্ঞা। এনজাম বলে,
– “লেডিস ফার্স্ট, শুরু করো।”
প্রজ্ঞা ভেবেচিন্তে বলে,
– “অনেক কথাই রেখেছি। যেমন… ভালো রান্না করতে শিখেছি, অযথা ঝগড়া করা কমিয়েছি, বাচ্চাদের সামনে তো আরো কমিয়ে দিয়েছি, ফোন চেক করাও বাদ দিয়েছি। কেউ নিজে থেকে না বললেও তার দিকটা বোঝার চেষ্টা করেছি, হুহ…”
ভাবসাব নিয়ে নাক ঘষলো প্রজ্ঞা। এনজাম তুলি থামিয়ে তার দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ হেসে শুধালো,
– “সবকিছুর উপরে গিয়ে, আমি কাউকে কষ্ট দেওয়া পুরোপুরি বাদ দিয়েছি। সে মনে করে দেখতেই পারে, প্রায় গত তিনবছরের মাঝে আমার কোনো কাজে বা কথায় হার্ট হয়েছে কিনা?”
প্রজ্ঞা মাথা নুইয়ে মুচকি হাসে। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– “সে তো হারিয়ে ফেলার ভয়ে।”
– “হারানোর ভয় থাকাও একপ্রকার ভালোবাসা। এই ভয়ের কারণে যদি প্রেম সতেজ থাকে, তবে এই ভয় আজীবন থেকে যাক আমার মনে।”
প্রজ্ঞার চোখে চোখ রেখে বললো সে। সঙ্গেসঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয় প্রজ্ঞা। ছেলেটা বড্ড ভয় পেয়েছিলো সেবার। কতবার যে তাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে অশ্রু ঝড়িয়েছে তার হিসেব নেই। এটাও হয়তো উপরওয়ালার ইচ্ছে। এক বড়সড় ধাক্কায় তাদের একে অপরের গুরুত্ব, মা-বাবার কদর বোঝানো। অনেককিছু শিখেছে তারা ঐ দু-মাসে। এই শিক্ষার কারণে খারাপ সময়ের স্মৃতিগুলোও তারা মনে করে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্মৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করে।
এই সময়টাতে তাদের নবদম্পতী মনে হলো যেন! কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা। প্রেমিকা লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে আছে, আর প্রেমিক অপলক চোখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা এঁটে চেয়ে আছে তার পানে।
তাদের দেখে দূরে বসে থাকা শাফায়াতের মুখেও হাসি ফুটেছিলো। একহাতে ছিলো একটা ডায়েরী, অন্যহাতে কলম… শেষপাতা খোলা। চোখ নামিয়ে একটা দাড়ি বসিয়ে শেষপাতার ইতি টানলো সে। অ্যানি চট করে কেড়ে নিলো সেটা। শাফায়াত তাকায়, সে পাত্তা না নিয়ে উল্টেপাল্টে একেবারে শেষ পাতাটা পড়ে একটু। এরপর তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “সেই আদিকালের ঘটনা লিখেছেন কেন? এরপর কতকিছু হয়ে গেলো! আপনি সেই নব্বই দিনেই পড়ে আছেন?”
শাফায়াত হেসে বললো,
– “এই ডায়েরীর পাতা কয়টা বলুন তো?”
– “গুনতে পারবোনা, আপনিই বলুন।”
– “নব্বইটা পাতা।”
– “নব্বই?”
অবাক হয়ে হাসলো অ্যানি। শাফায়াতের হাতের লেখা সুন্দর খুব। ডায়েরীর একদম প্রথম পাতায় লেখা, “নব্বই পাতার ডায়েরী”
গত নব্বই দিন ধরে এখানে একটু একটু করে লিখেছে সে প্রায় তিনবছর আগেকার নব্বই দিনের গল্প (গল্পে যা লিখেছি সবকিছু নয়, সংক্ষিপ্ত আকারে। কেবল তার জানা ঘটনা)। অ্যানি জানতে চায়,
– “সাজিয়ে রাখবেন এটা?”
– “উঁহু,উপহার দেবো। একজোড়া দম্পতীর দশম বিবাহবার্ষিকীতে।”
– “চমকে যাবে একদম!”
উৎসুক স্বরে বললো অ্যানি। শাফায়ার সোজা হয়ে বসে জানায়,
– “চমকানো টা বড় কথা নয়। একটা স্মৃতি রাখবে। মাঝেসাঝে মনে করবে। নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়াগুলো ভুলে গেলে তো চলবে না। সেগুলো মাথায় রাখতে হবে।”
– “আপনি মাথায় রাখেন আদেও?”
একটু অভিমানী স্বরে বললো অ্যানি। শাফায়াত আড়চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। ইন্টার্নি শেষের পথে তার। ভাগ্যক্রমে এনজামের সামনে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলো মাসখানেক আগে। যদিও সে গোপনে আগে থেকেই জানতো তাদের সম্পর্কের কথা, সেবারে প্রকাশ্যেই জেনে গিয়েছিলো। গম্ভীর গলায় বলেছে,
– “সারাজীবন কী প্রেমই করবেন স্যার? মেয়েপক্ষের কিন্তু একটা দাম আছে। তাই প্রস্তাব আপনাকেই পাঠাতে হবে। পরিবার নিয়ে আসুন একদিন বাড়িতে।”
শাফায়াত পারলে পরদিনই চলে যেত। কিন্তু শরিফুল সাহেবের শরীরটা ভালো নেই। রিং পড়ানো হয়েছে কদিন আগে, তার অসুস্থতার কারণেই দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে আশা রাখে সে, খুব দ্রুতই প্রস্তাব নিয়ে যাবে অ্যানির বাড়িতে। তারপর নিজের নামে লিখে তাকে নিয়ে যাবে নিজের কাছে। খানিকটা সময় চুপ থেকে বললো শাফায়াত,
– “আপনার আমার সংসারটা সুন্দর হবে, মিলিয়ে নেবেন।”
অ্যানি ডায়েরীর মাঝে চোখ রেখে শুধায়,
– “আমার সংসার, তবে শশুরের খেদমত করতে চাই। তাকে আমাদের কাছে এনে রাখবো। বাকিটা জীবন যেন মনমরা হয়ে না কাটে তার।”
– “বাবা রান্না জানেন ভালো। আপনি শিখবেন তার থেকে। বাবার রান্নায় একদম মায়ের হাতের স্বাদ পাওয়া যায়, আপনার হাতের রান্নার মাঝেও তা পেতে আগ্রহী আমি।”
মুচকি হেসে বলে অ্যানি,
– “চেষ্টা করবো।”
কথা ঘুরিয়ে বললো সে,
– “কিন্তু ডায়েরীর পাতা বারানো উচিৎ। ওরা কথা রেখেছে কিনা তা লিখবেন না?”
শাফায়াত তাদের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
– “এটা তারাই ভালো জানে, নিজেদের মনেই রাখুক। নব্বই দিনের কথা মনে করে অন্তত এই পরিবর্তনগুলো স্থায়ী হোক।”
প্রণয়,পূর্ণতা,টুশি ললিপপ খাচ্ছে তখনো। পূর্ণতা দু দণ্ড শান্ত থাকতে পারেনা। খাচ্ছে তো খাচ্ছে, সঙ্গে ভাইকে বিরক্ত করছে। একেবারে হাটুর উপর শুয়ে পড়ছে। প্রণয় বকেনা বোনকে। সবসময় শান্ত থেকে বোঝায়। ‘এটা করো, ওটা করবে না’।
স্মৃতির খাওয়া শেষ। তাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ায় স্বজন-প্রীতি, এগিয়ে আসে শাফায়াত-অ্যানিও। বাচ্চাদের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে পা বাড়ায় দুই পাগলের নিকট। এনজামের আঁকা শেষ হলো তখনই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্যানভাসটা এগিয়ে দিলো প্রজ্ঞার দিকে। প্রজ্ঞার বুক ধড়ফড় করছিলো রীতিমতো। চোখে জল এসে জমেছিলো। তারা হারিয়ে যায়নি, ঠিকই কথা রেখেছে। ফিরে এসেছে ক্যাম্পাসে। এনজাম তাকে সামনে বসিয়ে এঁকেছে এই ছবি। আনন্দগুলো যে ধরে রাখা দায়!
কাপাকাপা হাতে ক্যানভাসটা নিলো প্রজ্ঞা। তবে শক্ত ঢোক গিলে সম্পূর্ণ ছবিটা দেখতেই মুখভঙ্গি বদলে যায় তার। বাকিরা পাশেই এসে দাঁডিয়েছিলো। প্রজ্ঞা তড়িৎবেগে এনজামের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
– “এইহ! এটা কী?”
এনজামের সঙ্গে বাকিরাও তাকায় তার পানে। সকলের মাঝে টানটান উত্তেজনা বিরাজমান। মন বলছে, এক্ষুনি শুরু হবে এক নতুন সিনেমা। যা লেখা হয়নি শাফায়াতের ডায়েরীতে; যা চলে এসেছে… চলছে, চলবে। ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হলো তাদের। এনজাম ভ্রু নাচাতেই রাগে ফোঁস ফোঁস করে শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো প্রজ্ঞা,
– “আমার নাক এতো বোঁচা না। স্যার আপনিই দেখুন!”
আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে অসহায় চোখে অ্যানির দিকে তাকায় শাফায়াত। দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝায়,
“নব্বই পাতার সমাপ্তি হলেও দুই পাগলের ডায়েরীর কোনো সমাপ্তি নেই”
#সমাপ্ত
[এই প্রথম ইতি টানতে গিয়ে নার্ভাস লাগছিলো খুব। অনেক কিছু বলার থাকলেও বলতে পারছিনা। কেবল এইটুকু বলি, ডায়েরীর এই সময়টুকু আমার নিকট বিশেষ। অনেক সুন্দর স্মৃতি জমা হয়েছে। কেবল রম্য গল্প লিখতে এসে মাঝে অনেক বিষয় না চাইতেই নিয়ে এসেছি। শব্দভাণ্ডার উন্নত নয় আমার। যা ভেবেছি, যা মাথায় এসেছে তাই লিখেছি, পড়েছেন ও তাই।
সমাপ্তিতে এসে আজ আপনাদের মন্তব্যের আশা আমি করতেই পারি বোধ হয়। তা কেবল অন্তিম পর্ব নিয়ে নয়, সম্পূর্ণ গল্প নিয়ে। কিছু ভালো লেগে থাকলে বলবেন, ভুলগুলোও বলে যাবেন। বাচ্চা মানুষ আমি, কিছু শেখালে উৎসাহ নিয়ে শিখবো।
এইটুকুই। ভালো থাকবেন, ইন-শা-আল্লাহ নতুন গল্প নিয়ে ফিরবো। আসসালামু আলাইকুম।🤎]