#হৃদয়ে_প্রণয়ের_বাস
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ রোদসী রঙ্গন
গুণে গুণে পাঁচদিন পার হলো রাহি আসার। ঠিক পাঁচদিন পরই হুট করেই তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে চমৎকার একটা বাস্তবতার সম্মুখীন করানো হলো। রাহি তখনো ঘোরে আছে। ঘুম থেকে উঠাতে চোখজোড়া ফুলে আছে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে কয়েক পলক দেখে নিয়ে চোখ আবছা হয়ে উঠল। গলা রুদ্ধ হয়ে এল। ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, “আব্বু!” অথচ রাহি পারল না। একটাবারও পারল না আব্বু বলে ডাক দিতে। মাহমুদ সাহেব এই প্রথম বারের মতো রাহির মাথায় হাত বুলালেন। আদুরে গলায় বললেন,
“ শুভ জম্মদিন আমার আম্মা! শুভ জম্মদিন। আব্বাকে কি এতবছরের সব পাপের জন্য মাফ করতে পারবেন আম্মজান?আচ্ছা মাফ করার প্রয়োজন নেই, আমার আম্মা হয়ে থাকবেন তো এবার থেকে? কি? থাকবেন আম্মা? ”
রাহির চোখ টলমল করল। যাকে কোনদিন বাবা বলে সামনে যেতে পারে নি সে মানুষটার মুখেই এতবার আম্মা সম্বোধন শুনে চোখ টলমল করল। বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল ঠিক বিছানার উপরেই। পাশ থেকে মৃধা বলল,
“ ননদিনী! এতদিন শুধু তোমার জম্মদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। এবার ভালোয় ভালোয় বাপ-মেয়ের দ্বন্ধ মিটিয়ে নাও তো। আমরা হ্যাপি ফ্যামিলির মতো একসাথে থাকব এবার থেকে! ”
রাহি আবেগে কেঁদে ফেলল। কোনরকমে বলল,
“ ভাবি! ”
“হু! ”
রাহি আর পারল না এবারে। মৃধাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলল। মৃধা হাসল। বলল,
“সারপ্রাইজ পেয়ে কাঁদলে কি করে হবে রাহি? খুশি হওনি তুমি? আব্বুর মেয়ে হয়ে খুশি লাগছে না তোমার? ”
মাহমুদ সাহেব মেয়েকে কাঁদতে দেখে নিরস চাহনিতে চাইলেন। মৃধার দিকে চেয়ে বললেন,
“ ও বোধহয় খুশি হয়নি মৃধা। আসলে দোষটা তো আমারই। এতবছর যাবৎ ওকে এতোটা অবহেলায় রেখেছিলাম যে ও এখন আমাকে বাবা হিসেবে মানতেই পারবে না। স্বাভাবিকই তো এটা। ”
মৃধা রাগ দেখিয়ে বলল,
“ হু,তোমারে বলেছে নাকি ও? বেশি বুঝো কেন আঙ্কেল? রাহি? তুমি খুশি হওনি? সত্যিই খুশি হওনি? ”
রাহি এবারে মাথা তুলে তাকাল। বোকাবোকা স্বরে বলল,
“আমি কখনো আব্বুকে আব্বু বলে ডাকিনি ভাবি। ”
“ এখন ডাকো। ”
রাহি চুপ করে থাকল। মাহমুদ সাহেব অপেক্ষায় থাকল কবে আব্বু ডাক শুনবে না৷ অথচ অনেকটা সময় চেয়ে থেকেও যখন রাহি বলল না তখন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“ ডাকবি না?
রাহি এবারে শব্দ করে কেঁদে উঠল। ভাঙ্গা গলায় বলল,
“আব্বুউ!”
মাহমুদ সাহেব হাসলেন। চোখ টলমল করছে। বললেন,
“আম্মাজান আমার।আমার তিনজন আম্মাজানই সেরা!সত্যি বলব? তুই যখন ছোট ছিলি! কতোটা আদুরে ছিলি আমার। যখন জানলাম তোর মায়ের গর্ভে মেয়ে সন্তান আমার চেয়ে খুশি বোধহয়সেদিন আর কেউউ হয়নি। অথচ যখন ঐ মহিলার সত্যিটা জানতে পারলাম তখন থেকেই আমি আর সহ্য করতে পারতাম না ওকে। সাথে সাথে তোকেও। মনে হতে তুই আমার নয় ওর ঐ… ”
বাকিটুকু বলতে পারলেন না মাহমুদ সাহেব৷ বাবা মেয়ে যখন অনুভূতিপ্রবণ হয়ে তাকিয়ে আছে তখন মৃধা তাদের দিকে চেয়ে আছেে।হেসে বলল,
“ বাবা মেয়ে খুশি হুহ?”
মাহমুদ সাহেব হাসলেন। বললেন,
“ভাগ্যিম তুই ছিলি৷ নয়তো আজীবন এই ভুলটা করে যেতাম। ”
.
লিয়ন এসেছিল রাহিকে ঠিক রাত বারোটাতেই উইশ করবে বলে। অথচ বাবা মেয়ের এমন দৃশ্য দেখে দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকল। নিঃশব্দে দেখে গেল সবটা। সাথে দাঁড়ানো আছে নিশীথও। আজ বহুদিন পর তার চোখজোড়া আবার টলমল করছে। তার ছোট্ট বোনটা! পরিবার পেল অবশেষে? নিশীথ নিঃশব্দে হাসে। লিয়নের হাতে তরতাজা গোলাপটা দেখে কাঁধে চাপড় দিয়ে উল্টোদিকে মুখ করে বলল,
“ এত সারপ্রাইজ হজম করতে পারবে না আমার বোন। সাথে সাথে দুটো সারপ্রাইজে আমার বোন এ্যাটাক ফ্যাটাক করে মরে গেলে? তুই বরং এখন কেটে পড় বন্ধু!”
লিয়ন মানল না। মুহুর্তেই রাগ দেখিয়ে বলল,
“তোর কথা মতো নাকি? এতদিন পর তার মান ভাঙ্গাব, ভালোবাসার কথা বলব, ভালোবাসব। তা না, তুই কে বাঁধা দেওয়ার শালা?”
“তোর কপালটা খারাপ বুঝলি লিও। তুইযে ভালোবাসার কথা বলেই বিয়ে টিয়ে করার প্ল্যান করে পেলেছিলি তা তো আপাতত ক্যন্সেল। রাহি তো আপাতত আমাদের বাসাতেই থাকবে এখন। তুই ভাগ।”
লিয়ন মানল না। বলল,
“ এবার আর তোদের কথা মানব না শা’লা। যখন থেকে রাহির জন্য পাগল পাগল হয়ে গেলাম, ওকে জানাতে চাইলাম সব তখন তোরা বললি ও দেশে ফিরুক আগে। তারপর যখন দেশে ফিরল তখন বললি, আর কয়দিন পরই ওর জম্মদিন। একেবারে জম্মদিনেই সব জানিয়ে সারপ্রাইজ দিব। আর এখন? এমন করে করে আমার বিয়ে পিঁছিয়ে যাচ্ছে। বউ পাচ্ছি না, বউয়ের ভালোবাসা পাচ্ছি না। বউয়ের ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছি আমি।”
লিয়ন হেসে উঠল এবারে।হাসির শব্দে মৃধা এদিক পানে তাকালে ইশারায় বুঝাল যাতে লিয়ন আর রাহিকে সময় করে দেয়। মৃধা হাসল পরপরই।রাহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ রাহি? এই বাসায় থেকে আমরা ও বাসায় যাব বুঝলে। এবার থেকে একসাথে থাকবে আমাদের সাথে, এক পরিবারে। তুমি রাজি তো তাই না রাহি? ”
রাহি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। মৃধা এবারেও মিষ্টি হেসে মাহমুদ সাহেবকে বলল,
“আঙ্কেল? শোনো? তুমি বরং এখন বাসায় যাও হুহ?আমরা রাহিকে নিয়ে একসাথেই ফিরছি। তুমি ওখানে গিয়ে আন্টি আর নীলুকে আয়োজন করতে সাহায্য করো,হুহ? আমরা আসছি। ”
মাহমুদ সাহেব রাজি হলেন। রাহিকে আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে পরমুহুর্তেই বিদায় নিলেন। রাহি বোকাবোকা চাহনিতে চেয়ে শুধাল,
“কিসের আয়োজন ভাবি?”
মৃধা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“ কিছু নয় কিছু নয়। তুমি এই বাসার ছাদটা দেখতে যাবে একটু রাহি? প্লিজ! যাবে? আমার বড্ড আকাশ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ”
রাহি হতবিহ্বল চাহনিতে চেয়ে বলল,
“এখন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ এখনই। চলো না প্লিজ।”
বোকা রাহি উত্তরই করতে পারল না তার আগেই মৃধা হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগল। রাহি বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। এতক্ষনে কে আকাশ দেখে?কে?
.
মৃধা রাহিকে ছাদের কোণে লিয়নের সাথে রেখে এসেই চলে এল। রুমে এসে নিশীথকে দেখেই একলাফে গলা জড়িয়ে ধরল। নিশীথের নাকে কয়েক সেকেন্ড নিয়ে একটা চুমু খেয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল,
“ বলেছিলাম না রাহি পরিবার পাবে? তোকে খুশি করব? খুশি হলি না নিশীথ? ”
নিশীথ হাসে। মৃধার কোমড়ে হাতজোড়া রেখে সবটুকু দূরত্ব গুঁছাল। বলল,
” উহুম, পাঁচদিন পাঁচরাত বউ ছাড়া আছি আমি। বউ ঘুমাচ্ছে বোনের সাথে আর এদিকে ছোটবোনের সামনে থেকে বড়ভাই হয়ে বউকে কোলে তুলে নিয়েও আনতে পারিনি। বউ ও আমার দুঃখ বুঝেনি। এখন আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে খুশি কিনা? ”
মৃধা মুখ নিরস করে বলল,
“সবসময় মজা করিস নিশীথ। সত্যি বল। খুশি হয়েছিস না? কি হলো বল?”
নিশীথ এবারে ঠোঁট এলিয়ে হাসল। মৃধার নাকের সাথে নাক লাগিয়ে বলল,
“ আপনি আমায় খুশি করার চেষ্টা করেছেন আর আমি খুশি হবো না ম্যাম? ”
” আমি তোকে ভালোবাসি নিশীথ, অনেকটুকু ভালোবাসি। কখনো আমায় ছাড়িস না প্লিজ! তোকে ছাড়া বাঁচতেই পারব না আমি। ”
নিশীথ চুমু খেল মৃধার ফুলো গাল দুটোতে। আলতো করে চুমু খেল কপালেও। হাসি হাসি চাহনিতে চেয়ে বলল,
“ বেঁচে থাকতে তো ছাড়ছি না আপনাকে। ছাড়ার প্রশ্নও আসে না। আপনি আমার সুখ তো। কে না চায় সুখী হতে বলুন? ”
মৃধার আবারও কাঁধ জড়িয়ে ধরল। নিশীথ লেপ্টে নিল মৃধাকে নিজের সাথে। মুখ ডুবাল মৃধার কাঁধে। ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
”তুই আমার জন্য সেই সুখ যা আমি পুরো পৃথিবী খুঁজলেও পাব না। তুই আমার সেই শান্তি যাকে আমি সব মুহুর্তেই চাই। ”
#চলবে….