ভালোবাসা মন্দবাসা পর্ব-১১+১২+১৩

0
728

#ভালোবাসা_মন্দবাসা (পর্বঃ১১,১২,১৩)

১১.

প্রথম পাতাটা খুললেন তিনি। শুধু একটা লাইন লিখা।
“তাকে আমি এত পছন্দ কেন করি?”
তিনি তাড়াতাড়ি পাতা ওল্টালেন। কিছু নেই। বেশ কিছু পতা উল্টিয়ে পেলেন,
“আমার মনের কথা কি কখনও আমি তাকে বলতে পারবো?”

তিনি ডায়েরী রেখে দিলেন। কার কথা লিখেছে? তিনি বা এটা নিয়ে এত ভাবছেন কেন? তার তো এত কিছু ভাবার দরকার নেই। রিহানের ঘরের দিকে এগুলেন। আজকাল রিহানের সাথে তার তেমন কথা হয় না। অবশ্য কোনো কিছুতেই আজকাল তার মন লাগে না। চাকরিটা কি ছেড়ে দিবেন? তাহলে আবার অলস বসে থাকতে হবে। রিহানের ঘরের দরজায় দাড়িয়ে টোকা দিয়ে রিহানকে ডাকলেন।
রিহান মুভি দেখছিল শুয়ে শুয়ে। বাবার ডাকে উঠে বসলো।
-কিছু বলবে বাবা?
-তেমন কিছু না। তোর সাথে তো কথাই হয় না তাই ভাবলাম একটু গল্প করি।
-বস তুমি। বলো কি বলবে?
-আমি ঠিক করলাম কদিনের জন্য গ্রামে যাব। তুই কি যাবি?
-কি যে বল বাবা কদিন পর আমার ফাইনাল এক্সাম। আমি এখন কোথাও যাব না।
-সমস্যা নেই। তুই তাহলে থাক। আমি বাজার করে দিয়ে যাব। আর কিছু লাগলে সবুজ মিয়াকে বলে আনিয়ে নিস।
-কেন তুমি কতদিনের জন্য যাবে?
-ছুটি তো তেমন নেই না। অনেক ছুটি জমে গেছে। ভাবছি মাস খানেক থেকে আসবো। বাড়িটাও ঠিক করাবো। ঢাকায় থাকতে আর ভাল লাগে না।
-কি বল এই সব? সারাজীবন ঢাকায় থাকলে আর এখন এই সব বলছো।
-তোর একটা চাকরী হলে তোকে বিয়ে দিয়ে গ্রামে চলে যাব।
-এই সব চিন্তা বাদ দাও বাবা।
-আচ্ছা তুই তোর কাজ কর। শরীরটা ভাল লাগছে না। আমি বরং বিশ্রাম করি।
রিহান কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলো। আসলেই বাবা একা হয়ে গেছে। কথা বলার লোকও নেই। কিন্তু তাই বলে রাহা? এটাও কি সম্ভব? তার কি কিছু করার আছে? কি করতে পারে সে?

রিহানের ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদ বারান্দার ইজি চেয়ারে এসে বসলেন তিনি। অনেকদিন আসা হয়নি। গাছ গুলোর যত্ন নেয়া হয় না ঠিকমত সব কেমন মৃতপ্রায়। সবুজ মিয়াকে ডেকে গাছের গোড়ায় নিড়ানী দিয়ে পানি দিতে বললেন।

নিজের ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললেন। ছুটি মন্জুর না হলে যদিও যেতে পারবেন না তবুও কাজ গুছিয়ে রাখা তার পুরোনো দিনের অভ্যেস। চলে যাব বললেই তো আর চলে যাওয়া যায় না। কত শত দায়িত্ব পিছুটান্। একমাত্র মৃত্যুই বুঝি সব পিছুটান অগ্রাহ্য করে। কবিতাও মনে পড়ে গেল একটা… রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা। তিনি বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগলেন।
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে
নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়
সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…”

১২.

সায়লা রাহার জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছেন। রিহানের বাবা সব কিছু পাঠিয়ে দিয়েছেন দুই দিন হয়ে গেল। সময়ের অভাবে গোছাতে পারছিলেন না। রাহা এখন অবশ্য কিছুটা সুস্হ। চিনতে পারে সবাইকে। কথা অবশ‍্য তেমন বলে না দরকার ছাড়া। বেড রেস্টেই আছে । ডাক্তার বেশী নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছে।
রাহা শুয়ে শুয়ে দেখছিল মায়ের কাজ। চোখ বেয়ে পানি পড়েছিল তার। ওই বাড়িতে আর বোধহয় কখনও যাওয়া হবে না। উনি কেন সব পাঠিয়ে দিলেন? সুস্থ হয়ে সে কি নিজে আনতে পারতো না সব? তবে কি তিনি রাহা কবে বিদায় হবে এই আশায় বসে ছিলেন? অবশ্য তাকে যে এতদিন আশ্রয় দিয়েছিল এই তো বেশী।

সে তো দিন গুনতে থাকে কবে সে উঠে চলাফেরা করতে পারবে। বাসায় আসার পর লোকটা একদিনও দেখতে আসেনি। আসবেই বা কি করে। বাবা প্রথমদিন যে অপমান করেছিলো। এত লোক থাকতেই কিনা ওই আধবুড়ো লোকটাকেই সে ভালবাসলো?

-কি রে কাঁদছিস কেন? ব্যাথা হচ্ছে কোথাও?
-না মা এমনি মাথাটা একটু ব্যাথা করছিলো।
-তাহলে তোর বাবাকে ফোন করি। ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুক। হঠাৎ মাথা ব্যাথা হবে কেন?
-কিছু হয়নি মা। অযথা চিন্তা কোরো না।
-চিন্তা কোরো না বললেই হয়। তোর চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি। রিহানের বাবা তোকে রেখেছে বলেই রক্ষা। উনি কেমন মানুষ বলতো?
-ওনার মত মানুষ হয় না মা। কত যত্নশীল, ধীরস্থির। তুমি যদি কাছে থেকে দেখতে।
রাহার চোখ চকচক করে ওঠে। সায়লা তা লক্ষ্য করেন। মেয়ে কি তবে কোন ভুল পথে পা বাড়িয়েছে?
-মা তুমি কি একটু রিয়াদ সাহেবকে ফোন করবে? আমি একটু কথা বলতাম। আমার ফোনটা তো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
-কি কথা বলবি তার সাথে।?
-তেমন কিছু না মা। কেমন আছেন, হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর তো আমাকে দেখতে আসলেন না।
-আচ্ছা ফোন পরে করিস। এখন বিশ্রাম কর। আমি রান্না ঘরে যাই। কিছু লাগলে ডাক দিস। তিনি ব‍্যাপারটাকে এড়িয়ে গেলেন।

১৩.

রিয়াদ সাহেবের অবশ্য খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। প্রায় চার বছর বাড়ি আসেননি। বাড়িটা পোকামাকড়ের ঘরবসতি হয়েছে। মিস্ত্রী ডেকে সব ঠিকঠাক করতেই দশ দিন প্রায় উড়ে চলে গেল। তবে এই ধরনের কর্মব্যস্ততা তার বেশ ভাল লাগছে।
রিহান অবশ্য প্রতিদিন ফোন করে ডাকছে। তারও যে মন কেমন করছে না তা নয়। তবে তিনি নিজের সাথে বোঝপড়া করতেই কিছুদিন একা থাকতে চেয়েছিলেন। এই বয়সে এসে একটা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়ে যাওয়া কোন কাজের কিছু না। তিনি পুরো সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলেন। এই কদিনে নিজেকে কিছুটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন বলেই তিনি মনে করেন।
আজকের সকালটা বেশ সুন্দর। ঘুম থেকে উঠেই তিনি পুকুর ঘাটে এসে বসলেন সুন্দর সবুজ ছায়াময় পরিবেশ। ছোট কিছু পাখি কিচিরমিচির করছে। এমন সময় ফোনটা বাজলো। অপরিচিত নাম্বার…
-হ্যালো
-আসসালামুয়ালাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছো?
-আমি রাহা।
-ওহ তুমি। কি খবর তোমার? কেমন আছো এখন?
-আগের চেয়ে অনেকটা ভাল। আপনি তো আর আমাকে দেখতে এলেন না?
-আসলে আমি গ্রামে এসেছি কয়েকদিনের জন্য। তুমি সুস্থ্য হয়ে ওঠো। অবশ‍্যই যাবো একদিন। এখন তো বাবা মা আছেন তোমার পাশে। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাবে। এখন রাখি। ভালো থেকো।
অপর প্রান্তের কথা না শুনেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। তার এমন লাগছে কেন?সব ফেলে এক্ষুনি ঢাকা ফিরতে ইচ্ছে করছে। নিজের কাছে তো নিজেই হেরে যাচ্ছেন। তার কি করা উচিত? ঘরে এসে শুয়ে থাকলেন কিছুক্ষণের করে।
বেলা বাড়তেই তিনি হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে গেলেন। চাকরিটা এখনও বেশ কয়েক বছর আছে তা না হলে সব ছেড়ে এখানে চলে আসতেন। বাজার করে ফিরতে ফিরতে বেলা হয়ে গেল। চাচাতো ভাইয়ের বউয়ের হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে তিনি উঠানে পেয়ারা গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসলেন। চাচাতো ভাইকে ডেকে বললেন,
-শোন জরুরী কাজ পড়ে গেছে। আমি কাল চলে যাব।
-কি বলেন ভাইজান? আপনি তো বললেন বেশ কিছুদিন থাকবেন।
-আবার পরে আসবো। তুই এক কাজ কর আমার বাড়িতে একটা লোক রাখার ব্যবস্থা কর। টাকা আমি প্রতি মাসে পাঠিয়ে দেব।
-দেখি ভাইজান। লোক তো খুঁজতে হবে। বিশ্বস্ত লোক পাওয়াই কঠিন।
-আচ্ছা দেখ। পেলে আমাকে ফোন করে জানাস।
তিনি উঠলেন। জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেললেন দ্রুত হাতে। টিকেট কাটতে লোক পাঠালেন। ট্রেনের টিকেট না পেলে বাসেই চলে যাবেন। রিহানকে ফোন করে বললেন কাল চলে আসবেন।

রিহান বাবার কথা শুনে বেশ অবাক হল। গেলেন এক মাসের জন্য। হঠাৎ মত বদলালো কেন বাবা?

চলবে

এমি