গোপনে পর্ব-০৩

0
759

#গল্পঃ_গোপনে |০৩|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক



আমি এক রকম দৌড়ে ভেতরে যাই। মায়ের কাছে। গিয়ে দেখি মা ছটফট করছেন।চোখ বুজেই দু ‘হাত দিয়ে অদৃশ্য কাকে যেন তাড়াতে তাড়াতে বলছেন,’ তুই আমার জীবন নিতে আসছস? কেন নিবি আমার জীবন? আমি তোর কি ক্ষতি করছি? যাহ।দূর হয়ে যাহ।যা বলছি। দোহাই লাগে যা! ‘
এসব বলতে বলতে মা কেঁদে উঠছেন হঠাৎ। আবার হঠাৎ কান্না থামিয়ে রাগে ধমকে উঠছেন।আর এই কথাগুলোই বার বার বলছেন।
নার্স এখানেই ছিলেন। তিনি বললেন,’ স্যার তো একটু আগেই বেরিয়ে গেলেন। তার ডিউটি শেষ। এখন যার ডিউটি তিনি এখনও আসেননি।উনি সব সময়ই লেইট করেন। এখন আমি কি করি বলুন তো? আপনার মায়ের অবস্থা তো ভালো না। এরকম সমস্যা আমি কখনোই দেখিনি। তাছাড়া আমি এই পেশায় নতুন।তাই কিছুই বুঝতে পারছি না!’
নার্স না বুঝতে পারলেও আমি একটা অনুমান করছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে মা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন।টানা ঘুমের ওষুধের প্রভাবে এমন হয়েছে। তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় নাই বলেই এমন করছেন।
আমি নার্সকে বললাম,’ আপু এখন যার ডিউটি উনার নম্বর আছে আপনার কাছে? ‘
নার্স বললেন,’ আমি কল দিয়েছি। ফোন রিসিভ করেননি।আর উনাকে ফোন দিয়েও কোন লাভ নাই। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে উনি যুক্ত।মন যা চায় তিনি তাই করেন। তাকে জবাবদিহি করার সাহস কারোর নেই!’
আমি নিরূপায় হয়ে বললাম,’ তাহলে আগে যিনি ডিউটিতে ছিলেন তার নম্বরটা দিন না প্লিজ! ‘
আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। এমন অসহায় আর কখনো লাগেনি নিজেকে।
নার্স বললেন,’ স্যার সারা রাত ছিলেন।উনি বিধ্বস্ত। ক্লান্ত। এখন নিশ্চয় ঘুমাচ্ছেন তিনি। উনাকে বিরক্ত করে কি লাভ হবে? উনি কিভাবে আসবেন বলুন! ‘
আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,’ বোন, আমার মা মারা যাচ্ছে! আপনি দেখছেন না তার পরিস্থিতি। আপনার মা হলে কি আপনি যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করতেন না বোন!’
নার্স বললেন,’ আমি নম্বর দিচ্ছি। আপনি কল দিন।পরিচয় দিয়ে সব বলুন ।স্যার কোমল মনের মানুষ।যতো কষ্টই হোক উনি আসবেন।’
নার্স আপুর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আমি কল দিলাম । প্রথমবারেই কল রিসিভ করলেন ডাক্তার।আমি অনুনয় করে বললাম,’ স্যার, আমার মা মারা যাচ্ছে। তার অবস্থা গুরুতর! ‘
কথা শেষ করার আগেই তিনি বললেন,’ একটু অপেক্ষা করুন।আমি আসছি।’
ডাক্তার মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে এলেন। ততোক্ষণে মা ঘুমের মধ্যে ঢলে পড়েছেন। নাক ডাকছেন। শব্দ হচ্ছে।
ডাক্তার সব দেখে বললেন,’ এরকম সমস্যা হবেই।বমিও হবে হয়তো। অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়ার ইফেক্ট তো পড়বেই। তাছাড়া উনার বয়স হয়েছে। বুড়ো শরীর। এই অবস্থায় মানুষ টিকে না। আল্লাহ উনাকে রহম করুন। ‘
আমি চুপ করে রইলাম। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মায়ের মিষ্টি মুখটা কেমন কালচে হয়ে গেছে। ভীষণ রোগা লাগছে মাকে।
ডাক্তার হঠাৎ করেই একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন,’ আপনার মা তো আর অবোঝ না। আমার একটা জিনিসে বিরাট খটকা লাগছে?’
আমি বললাম,’ কি বিষয়ে স্যার?’
ডাক্তার বললেন,’ উনি কাউকে না জানিয়ে এভাবে লুকিয়ে চোরিয়ে ঘুমের ওষুধ খাবেন কেন? উনার তো কোন রকম অশান্তি ছিল না।নাকি ছিল?’
আমি বললাম,’ জ্বি না। অশান্তি থাকবে কেন? ‘
ডাক্তার বললেন,’ পারিবারিক ঝামেলা? কলহ?’
আমি বললাম,’ এসব কিছুই ঘটেনি স্যার। আমাদের খুব সুন্দর ফ্যামিলি।’
এবার তিনি বললেন,’ আপনি এক কাজ করুন। বাসায় খোঁজাখুঁজি করে দেখুন তো কোন ধরনের টেবলেট উনি খেতেন এর কোন আলামত পাওয়া যায় কি না! ঘরে যদি খুঁজে না পান তবে আশে পাশের ফার্মেসিতে খবর নিন।যে ফার্মেসি আপনাদের পরিচিত সেখানে যাবেন না।যেটা অপরিচিত সেখানেই যাবেন। পরিচিত ফার্মেসি থেকে এই ওষুধ নেয়ার কথা না।যদি পরিচিত ফার্মেসি থেকে এভাবে টানা ওষুধ নিতো তারা অবশ্যই আপনাকে নোটিশ করতো! ‘
আমি বললাম,’ আচ্ছা স্যার।’
এরমধ্যেই শানু এলো হাসপাতালে। ডাক্তার ততোক্ষণে চলে গিয়েছেন।যাবার আগে বলে গিয়েছেন, ‘আমি একটা ইনজেকশন দিয়ে গিয়েছি। এরপর আশা করি সমস্যা হবে না। উনাকে কেউ বিরক্ত করবেন না প্লিজ!’

শানু এসে মার পাশে বসলো।মার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তার চোখ মুছলো কয়েকবার।আমি দেখে অবাক হলাম।শানু কাঁদছে।চোখ মুছে ভেজা গলায় সে বললো,’ শিহাব, বারান্দায় আসো। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
আমি তার পেছন পেছন বারান্দায় গেলাম।
শানু আমার দিকে তাকালো। তার চোখ জলে ভেজা।লাল হয়ে আছে চোখের মণি। সে কান্নাভেজা গলায় বললো,’ মানুষ কি সব বলছে শিহাব? আমার কাছে তোমার বন্ধুরা কল করে জানতে চাইছে ঘটনা সত্যি কি না!’
আমি অবাক হলাম। বললাম,’ কোন ঘটনা?’
শানু বললো,’ কেন সব লুকিয়ে রাখতে চাইছো এখনও?সারা দেশ জেনে গিয়েছে তুমি জেবাকে বিয়ে করছো।সব ঠিকঠাক।কাবিনে কতো দিবে তাও ঠিক। আমার কাছে কেন সব লুকাতে চাও তুমি?’
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারি না।সবাই কি করে এসব জানবে? তাহলে কি জেবা এই কাজ করছে? সবাইকে জানিয়ে বেড়াচ্ছে এসব? নাকি বস? কিন্তু বস এসবের পেছনে থাকবেন কেন? তিনি তো উপর মহলের মানুষ। আমাদের মতো নিচু শ্রেণীর লোকদের নিয়ে তো তার মতো লোকেদের মাথা ঘামাবার কথা না!
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে শানুই আবার বললো,’ কিন্তু তুমি ভয় পেয়ো না শিহাব।আমি এসবে কখনোই কাঁটা হয়ে দাঁড়াবো না।আমি নিজের হাতে তোমায় বর সাজিয়ে পাঠাবো। নিজের হাতে তোমার বাসর রচনা করে দিবো। সন্তান দানে অক্ষম মেয়েদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় শিহাব। আমিও ত্যাগ স্বীকার করবো!’
কথাগুলো বলে হাসপাতালের বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো শানু।
আমি তাড়াহুড়ো করে ওর একটা হাত ধরলাম। কাছে টেনে আনলাম ওকে। তারপর বললাম,’ কান্না থামাও প্লিজ! লোকে শুনলে মান সম্মান থাকবে না! প্লিজ শানু! একটু চুপ করো তুমি! ‘
শানু কান্না থামালো। থামিয়ে ধারালো গলায় বললো ,’ তোমার মান সম্মান নষ্ট করবো না আমি শিহাব। কোনদিন না। তুমি যদি চাও আমি ডিভোর্স নিতেও রাজি আছি।যদি বলো, দেশ ছাড়ি, তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাই, তাতেও আমি রাজি। তোমার খুশিমতো আমি সব করবো শিহাব।’
আমি ওর হাতে শক্ত করে একটা নাড়া দিয়ে বললাম,’ তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে শানু! এসব বাজে কথা তোমার কাছে কে বলে? কোথায় শুনেছো তুমি এসব? কেন এরকম পাগলামি তুমি করছো বলো? ‘
শানু বললো,’ সত্য কখনোই চাপা থাকে না শিহাব। তোমার অফিসের সবাই জানে এসব।আমি বোকা বলেই এতো দিন শুধু মুখে মুখে এসব বলে তোমায় খ্যাপাতাম। মন থেকে এসব বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু তুমি গোপনে এতো কিছু করে ফেললে শিহাব! যা নিয়ে ভয় পেতাম ঠিক তাই তুমি করলে শেষে! ‘
আমি কি করবো বা কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না! শুধু অসহায়ের মতো শানুর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আমি কথা বললেও কোন লাভ হবে না।শানু তা শুনবে না।মানবে না।
শানু আমার আরো কাছে এলো। কাছে এসে বললো,’ আমি কি খুব অসুন্দর শিহাব? আমায় কি দেখতে ভালো লাগে না? জেবার থেকে আমি কোনদিকে কম বলো? তবুও আমায় ঠকালে কেন তুমি? বাচ্চা হয় না আমার এই জন্য? তুমি আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারলে না।বড় স্বার্থপর তুমি শিহাব! ‘
আমি ওকে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু সে কিছুই বুঝবে না।আমার কোন কথাই সে কানে তুললো না। সে গিয়ে আবার মার কাছে বসে রইল। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
আমি শানুর কাছে গিয়ে বললাম,’ তুমি একটু থাকো শানু। আমার একটু বাইরে যেতে হবে।’
ভাবলাম শানুকে কিছু বলবো না। না বলে গোপনেই গিয়ে বাসার আশে পাশের সবকটা ফার্মেসিতে খোঁজ নিবো মা কি তাদের ফার্মেসি থেকে ঘুমের ওষুধ নিতেন কি না তা জেনে আসবো। নাকি এখানে গোপন কিছু আছে তাও জানবো।
শানু বললো,’ বাইরে কোথায় যাবে? জেবার কাছে বুঝি? আচ্ছা ওর সঙ্গে কি তুমি কখনো থেকেছো? বেড শেয়ার —
আমি ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম শানুকে। বললাম,’ তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে শানু! তুমি পাগল হয়ে গেছো।মন যা চায় তাই বানিয়ে বানিয়ে বলছো!’
শানু দমে গেল না। সে হিংস্র বাঘিনীর মতো আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তুমি একটা খারাপ লোক শিহাব! তুমি একটা ল*ম্পট! আমি তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করবো না! ‘
বলে আবার কাঁদতে লাগলো শানু।
আমি রাগে আর কথা বললাম না ওর সঙ্গে। বারান্দায় এসে আয়ার হাতে দুশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ আমি একটা জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি। আমি যতোক্ষণ না আসি আপনি কষ্ট করে মায়ের একটু খেয়াল রাখবেন।’
আয়া বললো, সে খেয়াল রাখবে।
শানুর উপর কেন জানি পুরো ভরসা আমি আর পাই না। দুদিন আগেও এই মেয়েটির উপর আমার সব ভরসা ছিল। বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন কেন যে তাকেই আমি অনেক সন্দেহ করছি তা জানি না!

ফার্মেসিতে যাবার আগে বাসায় এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। কিচ্ছু পেলাম না। ঘুমের ওষুধ টসুধ বা সন্দেহ করার মতো কিছুই নেই। এরপর ফার্মেসির উদ্দেশ্যে যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা লক করার সময় ময়লার ঝুড়ির দিকে হঠাৎ চোখটা গেল।ঝুড়ির ভেতর একটা রঙিন প্যাকেট। ওখানে লিখা ‘ কানন ঔষধালয় ‘ ।এটা দেখেই আমার কেমন সন্দেহ হলো। আমাদের বাসার আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে এই নামে কোন ফার্মেসি নাই।তার মানে ঘুমের ওষুধটা এই ফার্মেসি থেকেই আনা হতো। কিন্তু মা এতো দূরের ফার্মেসিতে যাবে কি করে?

(চলবে)…
#গোপনে