গোপনে পর্ব-০৫

0
671

#গল্পঃ_গোপনে |০৫|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক

অলকা ভাবীর মুখ থেকে এই কথা শুনে আমি যেন চোখে ঝাঁপসা দেখছি! আমার মাথা ঠিক ভাবে কাজ করছিলো না!
আমার ঘরে বাইরের পুরুষ আসা যাওয়া করে এটা কিভাবে মেনে নিবো আমি? আমার খুব বিশ্বস্ত স্ত্রী শানু, যাকে আমার মা তার অসহায় অবস্থা থেকে তুলে এনে আমার ঘরের রাজরানী করেছিলেন।
শানু এমন করেই প্রতিদান দিচ্ছে এসবের?
আমি তো শানুকে কম ভালোবাসিনি। কিন্তু শানু আমার সঙ্গে এমন করলো কি করে?

মা আবার জেগে উঠেছেন । চোখ খুলেছেন।চোখ খুলে তিনি তার পাশে বসে থাকা অলকা ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
অলকা ভাবী মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাসি আপনার কেমন লাগছে এখন? ‘
মা আবার রেগে গেলেন। বললেন,’ আমায় বি*ষ দিছো কি ভালো হবার জন্য বউ? আমি শেষ। আমারে শেষ করে দিয়েছো তুমি!’
অলকা ভাবী কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি হয়তো ভাবছেন মা তাকেই এসব বলছেন। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি, মা অলকা ভাবীকে চিনতে পারেননি। তিনি ভেবেছেন তার পাশে বসা মেয়েটি শানু। তাকে শানু ভেবেই এসব বলছেন তিনি।
আমি অলকা ভাবীকে বললাম,’ ভাবী , মায়ের শরীর ঠিক নেই। কাউকে চিনতে পারেন না। উল্টাপাল্টা বকছেন এই জন্য। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ!’
আমি গিয়ে এবার মার পাশে বসলাম।অলকা ভাবী সরে এলেন।আমি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,’ মা, আমি তোমার শিহাব। তুমি আমায় চিনতে পেরেছো?’
মা অনেকক্ষণ ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন ফ্যাল ফ্যাল করে। তারপর দেখলাম তার চোখের কোল গড়িয়ে জল নামছে। তিনি কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলছেন, ‘ আমি আর কোনদিন দাঁড়াতে পারবো না বাজান! আমারে শেষ করে দিলো শানু! আমি বুঝতে পারি নাই তখন! আমার সঙ্গে কেন এই শত্রুতা করলো সে? কেন করলো!’
এই কথার জবাব আমার কাছে নাই।আমি জানি না এসবের কিছুই। কিন্তু এর পেছনে অবশ্যই বিরাট কোন কারণ জড়িয়ে আছে। সেই কারণ আমাকে জানতেই হবে।

মা মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন আরো এক সপ্তাহ পর। এই এক সপ্তাহে শানুর কোন খোঁজ আমি পাইনি।শানু উধাও হয়ে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে কার সাথে গিয়েছে এর কিচ্ছু আমি জানি না।
এরমধ্যে আমি আমার অফিসের বসের খোঁজও নিয়েছি। তিনি প্রতিদিন অফিসে আসছেন।
আচ্ছা শানুর যদি আমার বসের সঙ্গে কোন সম্পর্ক থেকে থাকে তবে তো শানুর সঙ্গে সঙ্গে বসেরও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু বস তো নিরুদ্দেশ হয়নি।ঠিক মতোই অফিসে আসা যাওয়া করছে। তাহলে কি আমি ভুল লোককে সন্দেহ করে গিয়েছি এতো দিন? নাকি বস চালাকি করে শানুকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে নিয়মিত অফিসে আসছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে অফিস ছাড়া অন্য কোন কিছুর সঙ্গে সে জড়িত না!

মার সঙ্গে কথা হয়েছে বিস্তারিত। মাকে জিজ্ঞেস করলাম , এতো এতো ঘুমের ওষুধ তিনি কিভাবে খেলেন?
মা বললেন, শানু তাকে প্রতিদিন দুপুরে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিতো।মা জানতেন না এটা ঘুমের ওষুধ।শানু নাকি মাকে বলেছিল, তার বড় চাচা এই ওষুধ খেয়ে হার্টের সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছে। মাকে মিথ্যে বলে প্রতিদিন এই ওষুধ খাইয়েছে সে।মা ওষুধ খেয়েই দুপুর বেলা ঘুমিয়ে যেতেন, আর আমি থাকতাম তখন অফিসে।মা ঘুমে, আমি অফিসে। তার মানে তখন শানু একা।শানু তখন যা ইচ্ছে তাই করলেও কেউ দেখবে না। কোথাও কারো সঙ্গে গেলেও কেউ তা জানবে না। এই জন্যই কি শানু মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিতো রোজ রোজ?
কি জানি!

অনেক দিন পর অফিসে গেলাম। ভাবলাম জেবার সঙ্গে বিষয়টা মিটমাট করা দরকার।
বসের সঙ্গেও বসবো।জানবো সব বৃত্তান্ত। তিনি জেবাকে কিছু বলেছেন কি না। নাকি জেবাই নিজ থেকে এসব বলে বেড়াচ্ছে। আজকাল আর কাউকে বিশ্বাস হয় না।উপরে ভালো মানুষের মুখোশ পরে ভেতরে কে শয়তান কে জানে! কিন্তু অফিসে গিয়ে দেখি জেবা অফিসে আসেনি। সে নাকি আর কখনো অফিসে আসবেও না। এখানে চাকরি করবে না।শেষে একাই বসের কাছে গেলাম।সাহস নিয়েই তাকে জিজ্ঞেস করলাম সবকিছু। বললাম,’ আপনি জেবার কাছে কি বলেছেন এসব? ‘
বস বললেন,’ কি বলেছি?’
আমি বললাম,’ আপনি কি বলেছেন তা আপনি জানেন না?’
বস হাসলেন। খুব রহস্যময় হাসি। এরকম ভাবে তাকে হাসতে আর কখনোই দেখিনি।
হাসি শেষ করে বস বললেন,’ আমার যা ইচ্ছে তাই বলেছি। এখন আপনি কি করবেন আমায়? আমার বিচার করবেন ? আচ্ছা কিভাবে বিচার করবেন শুনি?’
শুনে রাগে আমার মাথা আগুন হয়ে গেল।আমি রাগী গলায় বলেই ফেললাম,’ আপনি একটা নোংরা লোক! অসভ্য লোক!’
বস তার দু ঠোঁটের মাঝ বরাবর হাতের একটা আঙুল ধরে সাপের মতো ফিসফিস করে বললেন,’ চুপ।একদম চুপ। গলা বাড়িয়ে একটা কথাও এখানে বলবেন না।আপনি এখন থেকে এই অফিসের বহিরাগত। বেরিয়ে যান বলছি এখান থেকে। নয়তো পুলিশ ডেকে বের করাবো কিন্তু!’
আমি বললাম,’ বহিরাগত মানে?’
বস বললো,’ আপনার চাকরিটা আপনি হারিয়ে ফেলেছেন।টাকা চুরির দায়ে। আপনি অফিস থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা চুরি করেছেন। এই যে কাগজ পত্র দেখুন। এখানে সব লিখা আছে। এছাড়া সাক্ষীও আছে। আপনি আপনার একজন কলিগের বাসায় টাকাটা ছয় মাস জমা রেখেছিলেন। কদিন আগে সেই টাকা তার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছেন।’
বস কিছু কাগজপত্র বের করে দেখালো। তারপর বললো,’ ভালোই ভালোই বেরিয়ে চুপচাপ চলে যান এখান থেকে। নয়তো জেলে পঁচে মরতে হবে আপনার।চুরির দায়ে জেল।বুঝলেন? এখন আপনার ইচ্ছে। আপনি বাড়াবাড়ি করলে আমিও বাড়াবাড়ি করবো।আর আপনি ঠান্ডা হয়ে গেলে আমিও ঠান্ডা। এখন যান। চুপচাপ চলে যান।’
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। কিছুই করতে পারলাম না।আমি জানি আশফাক সুমনরা সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোক। এদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অতো সহজ না।আর এক্ষুনি যদি আমি বাড়াবাড়ি করি তবে সত্যি সত্যি আশফাক এখানে পুলিশ ডেকে আনবে। তারপর আমার জেল হবে।জেল হলে আমার মায়ের কি হবে? মাকে কে দেখাশোনা করবে?
আমাকে বরং এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।সময় নিতে হবে।
আমি চুপচাপ অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। চোরের মতোই।


বাসায় ফিরে শানুকে আবার কল দিলাম। শানুর ফোন এখনও বন্ধ করে রাখা। হয়তো সিম বদলে নিয়েছে। আচ্ছা ও এখন কোথায় আছে? ওর বাবার বাড়িতে? কিন্তু ওখানে তো ওর সৎ মা।বড় অত্যাচারী মহিলা ‌।শানু ওখানে যাবে কেন?
ওখানে যাবে না জানা সত্ত্বেও শানুর সৎ ভাইকে আমি কল দিলাম।কল দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে ফোন রিসিভ করলো।আমায় কুশল জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি।এসব কথা শেষ হলে সে হুট করেই একটা কথা বললো আমায়। বললো, ‘দুলাভাই, আপনারা আমাদের শহরে জায়গা কিনে বাসা বাড়ি করছেন আর আমাদের একবারও শুনালেন না!শুনালে কি আমরা গিয়ে বাসা বাড়ি দখল করে ফেলতাম নাকি? ‘
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বললাম,’ কি সব বলছো তুমি হাসান?’
শানুর ভাই হাসান হাসলো ওপাশ থেকে। তারপর বললো,’ টাকা হলে মানুষ বদলে যায়। কাউকে চিনে না।যায়হোক, আপনি ভালো লোক। আপনার মন ভালো। শুনলাম, জায়গা নাকি শানু আপার নামে দলিল করিয়েছেন।বিল্ডিংয়ের কাজও তো আপাই তদারকি করছে!’
আমি বললাম,’ হাসান, তুমি এসব কি বলছো? তোমার মাথা কি ঠিক আছে? ‘
হাসান হাসলো আবার। হেসে বললো,’ ও বুঝেছি। দুর্নীতির টাকায় এসব করছেন তাহলে। এই জন্যই তো নিজের নামে কিছু করেননি।বউয়ের নামে করছেন। মানুষকে আইনকে ধোঁকা দিচ্ছেন। বিরাট ধুরন্ধর লোক আপনি। বেসরকারি চাকরি করেই এই অবস্থা, সরকারি চাকরি করলে তো দেশটা বেচে দিতেন! ‘
আমি ফোন কেটে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। ফালতু কোথাকার! কিন্তু একটা বিষয় ঠিকই বুঝে ফেললাম, সামনে আমার বিপদ! ভয়াবহ রকমের বিপদ!
আর হাসান যেহেতু বলেছে তাদের শহরে জায়গা কেনা হয়েছে, বাসা ওখানেই হচ্ছে,তার মানে শানু এখন নেত্রকোনায় আছে। আমাকে খুব দ্রুত নেত্রকোনায় যেতে হবে!
তাকে ধরতে হবে গিয়ে!

কিন্তু এরমধ্যে আরেক সমস্যা দেখা গেল।জেবা হঠাৎ করেই আমার বাসায় এলো। এসে বললো, ‘ শিহাব ভাই, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম ‌। কিন্তু এখন দেখি ঘটনা ভিন্ন।সব কিছুর মূলে অফিসের বস আশফাক সুমন। আমি আগে জানতাম না। এখন জেনেছি। আমার স্বামীর সঙ্গে ওর পরিচয় আছে।এটা সাধারণ কোন পরিচয় না। আশফাক সুমন গোপনে বিভিন্ন ধরনের ব্লাক বিজনেসের সঙ্গে জড়িত।এমনকি আমার স্বামী তার একজন সামান্য কর্মচারী মাত্র। আমার স্বামী তার কাছেই আমাকে পাঠাতে চেয়েছিল তার মনোরঞ্জনের জন্য।আমি আগে জানতাম না কিছুই। আমার স্বামী শুধু বলেছিল, উপর মহলের একজনের কাছে আমায় পাঠাবে। কিন্তু এই উপর মহলের এই একজনই যে আমাদের অফিসের বস আশফাক সুমন তা কোনদিন কল্পনাও করিনি!

(চলবে)…
#গোপনে