#গল্পঃ_গোপনে |০৬|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
সেদিন রাতেই চুপিচুপি নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে বের হলাম। নেত্রকোনায় যাবো এই বিষয়ে কেউ কিচ্ছু জানে না। কাউকে কিছুই বলিনি।বললেই ঝামেলা বাড়বে।কোন ভাবে যদি শানুর কানে এই খবর পৌঁছে যায় যে আমি তার কাছে আসছি তবে ওখানে সে বসে থাকবে না। হয়তো পালাবে, নয়তো ঝামেলা করবে!আমিই বিপদে পড়বো গিয়ে।
‘
ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। নেত্রকোনার তেমন কিছুই আমি চিনি না।শহর এক সময় ছোট ছিল। এখন বড় হয়েছে। শতো শতো গলি ঘুপচি হয়েছে শহরের। এখানে আন্দাজে ঘুরে ঘুরে কি শানুকে বের করা সম্ভব?
ওদেরও তো চোখ কান খোলা রাখা আছে। ওরা খুবই সতর্ক।যদি কোন ভাবে ঠাহর করে ফেলে আমি এখানে এসেছি তবেই তো সব শেষ। আমার বরং এটা জানা উচিৎ , কোথায় সে বাসা করছে আর কোথায় আপাতত থাকে সে। একেবারে নির্দিষ্ট করে ঠিকানা জানা উচিৎ।যেন এদিক ওদিক না তাকিয়ে, ঘোরাফেরা না করে, সরাসরি ওখানে চলে যেতে পারি।
কিন্তু এটা কিভাবে করবো? কে সাহায্য করবে আমায়?
এরমধ্যে শানুর ভাইয়ের কথা মনে পড়লো।ওর নাম হাসান। হাসানই তো আমায় জানালো তার বোন ওখানে। নেত্রকোনায়। হাসানদের বাসাও নেত্রকোনায়।সরকারি কলেজের পেছনে। বিলপাড়।
হাসানকে কল করলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম,’ হাসান তুমি কোথায়?’
হাসান বললো,’ বাসায়। ছাত্র পড়াই।কেন দুলাভাই? কোন প্রয়োজন আছে নাকি?’
আমি বললাম ,’ আমি কলেজ গেটে। তোমাদের শহরে।দেখা করতে পারবে আমার সঙ্গে।’
হাসান বললো,’ সে কি! ‘ বলে খানিক সময় চুপ করে রইলো হাসান। তারপর আবার বললো,’ দুলাভাই, আপনি সরাসরি বাসায় আসুন।’
আমি বললাম,’ না হাসান।আমি অন্য দরকারে এসেছি। তোমার সাহায্য প্রয়োজন আমার। তুমি কষ্ট করে আসো একটু ভাই!’
হাসান বললো, দশটা মিনিট শুধু বসুন আপনি।আমি ছাত্রদের ছুটি দিয়ে আসছি।
হাসান বললো, দশ মিনিটের মধ্যে আসছে। কিন্তু আধ ঘন্টা হয়ে গেছে। তার এখনও খোঁজ খবর নাই। খুব বিরক্তি লাগছে।
আমি আবার কল করলাম হাসানকে। হাসান বললো,’ আর দু মিনিট।আমি কলেজ মাঠে।’
এবার তার কথা ঠিক হলো। মাত্র দু মিনিটেই সে এসে পড়লো আমার সামনে।এসে কাঁচুমাচু মুখে বললো,’ সরি দুলাভাই! ছাত্রদের পরীক্ষা চলে।এস এস সি পরীক্ষা।শর্ট করে সব বুঝিয়ে দিতেও একটু সময় লেগে গেল।’
আমি বললাম,’ সমস্যা নাই।আসো একটু বসি আমরা’
আমরা বসলাম। বসে এটা সেটা নিয়ে কথা বলে এক সময় আসল কথাটা বললাম। বললাম ,’ শানু একটা ভুল পথে পা দিয়েছে। সে অনেক দিন ধরেই গোপনে একটা ভয়াবহ খেলা খেলছে। এই যে তুমি বললে এখানে সে বাসা করছে এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এটাও তার খেলার একটা অংশ।তুমি আমায় এগজেক্ট ঠিকানাটা দাও ভাই। কোথায় গেলে তাকে পাবো তা বলো।’
হাসান খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’ওর চরিত্র আগে থেকেই খারাপ দুলাভাই। আপনার মায়ের কাছে আমার মা আগেই সব বলেছিল। কিন্তু তিনি কিছুই শুনেন নি। ভাবলেন আমরা বানিয়ে বানিয়ে এসব বলছি। শত্রুতা থেকে বলছি। কিন্তু এখন তো সব সত্য হলো।সে যায়হোক, ও বাসা করছে জয়নগর। শহরের একটু বাইরের দিকে।সদর হাসপাতালের উত্তর দিকে।আরেকটু স্পষ্ট করে বলি। ওখানে একটা গরুর ফার্ম আছে।কানন এগ্রো ফার্ম।এর পাশেই বাসাটা হচ্ছে।এক রুমের কাজ শেষ। সেখানেই আপা থাকে।’
কানন এগ্রো ফার্ম।শুনে আমার শরীর শিরশির করতে লাগলো। সবকিছুতেই কানন। আশফাক মামুনের ছেলের নাম। তাহলে সবকিছুর পেছনে আশফাক মামুনই জড়িত?
‘
জয়নগরের দিকে যাবার সময় হাসানকে বললাম , ভাই এইসব কিছুর সঙ্গে আমার মান সম্মান জড়িয়ে আছে। কারণ শানু আমার স্ত্রী। তাছাড়া সে তোমার বোনও। তোমাদের মা দুজন হলেও বাবা কিন্তু একই। রক্ত এক। তাছাড়া ওর নামে মন্দ কথা বেরুলে সে তোমার সৎ না আপন বোন তা খুঁজবে না।বলবে, তোমার বোন এসব করেছে। ‘
হাসান বললো,’ দুলাভাই, আপনি এসব ভাববেন না।আমি অন্তত এটা বুঝি। আপনি খুব সাবধানে যান তাহলে। ‘
আমি বললাম,’ আচ্ছা।’
‘
হাসপাতালের সামনে রিক্সা থেকে নেমে খুব সাবধানে কানন এগ্রো ফার্মের দিকে এগিয়ে গেলাম।
তারপর কানন এগ্রো ফার্মের পেছন দিকে যে বাসাটা নতুন উঠছে ওদিকে এগিয়ে গেলাম। বাসার সামনে উঠোন আছে। এরপর মূল বাসা। বাসার একটা রুমের কাজ শেষ। সেই রুমটার দিকেই এগিয়ে গেলাম।ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।আমি ওখানে খানিক সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না।কি করা উচিৎ আমার?
হাসান কি সত্যি বলেছে? এখানে কি আসলেই শানু আছে? যদি অন্য কেউ হয় তখন কি হবে? যদি জিজ্ঞেস করে কি চাই? কেন এসেছি? তখন আমি কি বলবো?
ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা দিলাম। দরজা খুলছে না। এরপর আবার টোকা দিলাম।খুলছে না। তৃতীয়বারের সময় একটা মেয়েলি গলা ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কে? কি চায়? ‘
আমি অবাক হলাম।গলাটা শানুর না।অন্য কারোর।
তবে কি হাসান মিথ্যে বলেছে? নাকি শানু ইচ্ছে করেই গলার স্বর পরিবর্তন করছে যেন আমায় বোকা বানাতে পারে!
আমি খানিক সময় চুপ করে রইলাম। তারপর ভাবলাম যা হবার হবে। আমি দরজায় সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দিলাম। ভেতর থেকে মেয়েটি বললো, এইসব জোরাজুরি করে লাভ নাই ভাই। দরজা জোরাজুরি করে খুলতে পারবেন না।অতো পাওয়ার আপনার নাই।আর আপনারে আমি চিনি। আপনি শিহাব।শানু ম্যাডামের আগের স্বামী।’
রাগে আমার গা থরথর করে কাঁপছে।আগের স্বামী মানে? শানুর সঙ্গে কি আমার ছাড়াছাড়ি হয়েছে নাকি?
মেয়েটি আমায় অবাক করে দিয়ে দরজা খুলে দিলো।ভেতরে লাইট জ্বেলে দিয়ে বললো,’ আসুন।ভেতরে আসুন।’
ভেতরে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। মেয়েটিকে দেখে নয়।ঘরের ভেতরের সাজ সরঞ্জাম আর আসবাব দেখে।এ যেন পুরনো দিনের কোনো জমিদারের রাজঘর।রংমহল। এরচেয়ে অবাক করার বিষয় এখানে একটা কাঁচের সোকেশ ভর্তি বিদেশি ম*দের বোতল।একপাশে হারমোনিয়াম।আরো নানান বাদ্যযন্ত্র।এসব কে খায়? কে গান করে? এখানে কে থাকে? শানু?
মেয়েটি এতোক্ষণ আড়ালে ছিল। এবার সামনে এলো। তার মাথায় হিজাব। চেহারা সাদামাটা। তাকে দেখে রহস্যময় কেউ মনে হয় না! আর দশটা মেয়ের মতোই সে।অতি সাধারণ।
আমি বললাম,’ শানু কোথায়? ‘
মেয়েটি বললো,’ ম্যাডাম আধ ঘন্টা আগে এখান থেকে চলে গিয়েছেন।আমি তার চাকরানী।’
‘ কোথায় গিয়েছে?’
মেয়েটি বললো,’ রানীরা চাকর বাকরের কাছে কি বলে যায় নাকি তারা কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না।’
আমি বললাম,’ তুমি আগে কি বললে এসব? আমি শানুর আগের স্বামী হলাম কিভাবে?’
মেয়েটি হাসলো। হেসে বললো,’ ম্যাডামের আরেকটা বিয়ে হয়ে গেছে।এক মাস আগে বিয়ে হয়ছে। মসজিদের হুজুর আইসা বিয়ে পড়াইছে। তাইলে আপনি আগের স্বামী না তো বর্তমান স্বামী নাকি?’
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব কি বলছে মেয়েটি?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে শানুর?’
মেয়েটি কিছুই লুকোচ্ছে না।যা জিজ্ঞেস করছি ঠিক তাই বলছে। সে বললো,’ স্যারের সঙ্গে।’
আমি বললাম,’ কোন স্যার?’
মেয়েটি বললো,’ আশফাক মামুন স্যার।’
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।মেয়েটি বললো,’ এখন এখান থেকে যান।সব বলে দিছি।আর বিরক্ত করবেন না আমায়।আর শুনেন, ভয়ের কিছু নাই।স্যার দুই তিন মাসের উপর কোন মেয়েরে তার কাছে রাখে না।কয়দিন সহ্য করেন।মাস দুয়েক পর দেখবেন আপনার স্ত্রী আপনারই আছে!’
বলে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো মেয়েটি।আমি লম্বা সময় ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফিরে এলাম ওখান থেকে।
আমার সব কিছুই শেষ। সবকিছু।
কি ভয়ংকর এক খেলা শুরু করেছে শানু।নাকি সে খেলার পুতুল মাত্র?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি এসে একটা বেঞ্চের উপর পা ঝুলিয়ে বসলাম। অন্ধকার রাত।শহরের ভীড় আস্তে আস্তে কমে এসেছে। আমি বসে থেকে শুধু ভাবছি, মানুষ কিরকম ভয়ংকর হতে পারে! সত্যের আড়ালে কতো কি করে বেড়ায় এরা।অথচ এদের বাইরের মুখোশটা কি চিত্তাকর্ষক! কি পবিত্র!
আর ঠিক তখনই একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,’ তোমার হোয়াটসঅ্যাপ চেক করো।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ডাটা অন করলাম। তারপর হোয়াটসঅ্যাপ চেক করতেই মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার।যে নম্বর থেকে কল এসেছে ওই নম্বর থেকেই হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠিয়েছে আমায়। সেই ছবিতে জেবা আর শানু একসাথে। এই এগ্রো ফার্মের কাছের ঘরটিতে। তাদের দুজনের গায়ে নাচনেওয়ালীদের পোশাকের মতো বাহারি পোশাক। চোখে কাজল। মুখে চমকি।চন্দন। কপালে টিপ। হাত ভর্তি চুড়ি।পায়ঘুঙুর। কিন্তু সেই ছবিতে তৃতীয় একজনও আছে। লোকটির গলা পর্যন্ত ছবি আছে।মাথাটা নেই।মাথা কেটে ছবি দিয়েছে। কিন্তু গলা পর্যন্ত ছবি দেখেই আমি স্পষ্ট চিনতে পেরেছি এটা কে। আশফাক। আশফাক মামুন এটা।ছবিটা পাঠিয়ে এর নিচে লিখেছে, ‘আমার প্রতিশোধ আমি এভাবেই নিই। তারপর একটা হাসির ইমুজি।
‘
(চলবে)…
#গোপনে