#গল্পঃ_গোপনে |০৭|
#লেখাঃ_অনন্য_শফিক
হোয়াটসঅ্যাপে জেবা আর শানুর ছবিটা দেখার পর বিস্ময়করভাবে আমি চমকে গেলাম! তার মানে জেবাও এখানে।শানু যা করছে জেবাও ঠিক তাই করছে। তাহলে জেবা যে সেদিন ফোন করে যা তা বললো আমায়?
নাকি জেবাও দাবার গুটি? আচ্ছা জেবা যদি দাবার গুটি হয়ে থাকে তাহলে শানু কি? শানু কি কোনভাবে নির্দোষ হতে পারে?
এমন কি হতে পারে না শানু কোন ভাবে ফেঁসে গিয়েছে? অথবা তাকে ফাঁসানো হয়েছে? আর সে এখন বাধ্য হয়েই এসব করছে?
আমার মন কোন ভাবেই মানতে চায় না যে শানু অপরাধী। আমার মনকে আমি কিছুতেই বোঝ দিতে পারি না যে, শানু নিজে ইচ্ছে করে আমার সঙ্গে প্রতারণা করে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে এসব করে বেড়াতে পারে?
আমার কি করা উচিৎ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। শরীর এতো খারাপ লাগছে! প্রচন্ড ব্যথা করছে।সারা শরীরে ব্যথা হচ্ছে। সম্ভবত জ্বর আসবে।
কি মনে করে যেন জেবাকে কল দিলাম।জেবার নম্বর বন্ধ। বার কয়েক ডায়েল করেও সংযোগ পাওয়া গেল না!
‘
ফোনের সময়ের দিকে তাকালাম।রাত বাড়ছে। এখানে বসে বসে সময় নষ্ট করে ফেলেছি অনেক।একটু পর আর গাড়ি পাওয়া যাবে না। তাড়াহুড়ো করে হেঁটে গিয়ে একটা সিএনজি ধরলাম। বাসায় যাবো। সিএনজির পেছনে উঠে বসলাম। ওখানে আমি ছাড়া আরো একজন আছে। লোকটার মুখ অন্য দিকে রাখা।মুখ দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই।
সে যেই হোক, মুখ দেখে কি করবো।এটাই সম্ভবত শেষ সিএনজি। এরপর আর গাড়ি পাওয়া যাবে না। ভাগ্যিস এটা পাওয়া গেল। তাড়াহুড়ো করে সিএনজিতে উঠে বসতেই মনে হলো আমার বমি হবে।পেটে বার বার পাক দিচ্ছে। তখনই মনে হলো কেবল, সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। উদাসীন হয়ে গেছি আমি।নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে ছুড়ে একটা খেলায় নেমেছি যেন। সেই খালার নাম কি? শানুকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনা? নাকি অন্য কিছু?
কি জানি!
সিএনজি আধঘন্টা চলার পর অদ্ভুত এক কান্ড করলো ড্রাইভার। ময়মনসিংহের রাস্তায় না গিয়ে সিএনজি ঘুরিয়ে দিলো সরু একটা রাস্তার ভেতর।রাস্তাটা একে বেঁকে গহীন একটা বনের দিকে চলে গিয়েছে।মেটে রাস্তা।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।মাথা ঠিকভাবে কাজ করছে না। নাকি জ্বরের জন্য এমন হচ্ছে? সব কি ভুল দেখছি!
ভুল না ঠিক দেখছি তা বুঝতে পারলাম আরো মিনিট দশেক পর। ততোক্ষণে সিএনজি বনের ভেতর ঢুকে গেছে। ওখানে একটা বাঁশঝাড়ের কাছে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার সামনে থেকেই আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। অন্ধকারে সিএনজির লাইটের একটু আলোতে আমি তার মুখে রহস্যময় এক হাসি দেখলাম। কিন্তু ততোক্ষণে টের পেলাম আমার মাথায় শক্ত কি দিয়ে যেন কেউ আঘাত করেছে। খুব জোরে নয়, কিন্তু আস্তেও নয় একেবারে।পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমার পাশে বসা লোকটাকে। তার হাতে চকচকে কালো রঙের পি*স্তলটি। কিন্তু তাকে কোন ভাবেই চেনার উপায় নাই। মুখ রঙিন কাপড় দিয়ে এমন ভাবে ঢেকেছে মে কেউ কোনভাবেই একে চিনতে পারবে না!
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন কোনদিন আমি হইনি। চোখের সামনে নিজের মৃত্যুকে দেখছি আমি।কি করবো আমি এখন?
শেষে কি এভাবেই আমার কপালে মৃত্যু লিখা ছিল!
কাঁদছি আমি। কাঁদছি কেন বুঝতে পারছি না!
মৃত্যুকে কি আমি এতো ভয় পাই? ছিঃ! কতো বড় কাপুরুষ আমি! ভাবতেই নিজের উপর ঘেন্না হয়!
তারপর হঠাৎ করেই মনে হলো, কাপুরুষ না আমি। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না।ভয় পাই মায়ের জন্য। আমার মা তো একা। এই পৃথিবীতে তার আর কেউ নাই।আজ এভাবে যদি ওরা আমায় মে*রে ফেলে তখন আমার মায়ের কি হবে? কে দেখবে আমার মাকে? কে তার ওষুধ কিনে দিবে? কে তাকে খাবার দিবে?
দু হাত জোড় করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। এই প্রথম কারোর সামনে এরকম নতজানু হয়েছি। কাঁদতে কাঁদতে আমি ওদের বললাম,’ আমায় জান ভিক্ষে দাও তোমরা। আমার মায়ের জন্য। শুধু আমার মায়ের জন্য আমায় বাঁচিয়ে দাও।’
আমার পাশের লোকটা হাসলো। হেসে বললো,’ আপনারে মা*রার জন্য এই রাত নিশিতে জঙ্গলে নিয়ে আসার প্রয়োজন নাই আমার।আপনারে মা*রা একটা মশা মা*রার চেয়ে সহজ! আপনারে এইখানে আনছি ভয় দেখাইতে।’
আবার হাসলো লোকটি।কি ভয়ংকর এবং বিকৃত এই হাসি। তারপর সে বললো,’ শানু ম্যাডামের আশা বাদ দেন ভাইসাব। আপাতত ভুইলা যান এই নাম।উনি এখন আমার স্যারের ওয়াইফ। এক মাস অলরেডি হয়ে গেছে।আরো দুই মাস স্যার তার লগে ডলাডলি করবো। এরপর শেষ। পঁচা ডিম যেমনে মানুষ অনেক দূরের ময়লার বাগাড়ে ফেলায় দেয় ওই রকম শানু ম্যাডামরেও ফেলায় দিবো দুই মাস পর স্যার। তখন তুইলা তারে ঘরে নিয়েন আপনি। তখন ভালোবাসা বাসি কইরেন বউয়ের সাথে ইচ্ছে মতো। আপাতত এইসব দৌড়ঝাঁপ আর বৃথা চেষ্টা তদবির বন্ধ করেন।’
আমি কিছুই বলতে পারছি না।হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু।
লোকটি আবার কথা বললো।বললো,’ আমাদের লোক বলের অভাব নাই ভাই সাহেব। আপনি আগামী দুই মাস আর কোন চেষ্টা ফিকির কইরেন না। চুপচাপ ঘরে বইসা থাকেন গিয়ে।এইটা শেষ সতর্ক বার্তা। এরপরেও যদি চেষ্টা করেন তাইলে –‘
কথাটা শেষ না করে পি*স্তলটা আমায় দেখালো। তারপর সিএনজি থেকে আমায় এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিয়ে তারা সিএনজি স্টার্ট করে উধাও হয়ে গেল।
‘
ওখান থেকে বাসায় ফেরার পর গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হলো আমার। সেই জ্বর রইলো তিনদিন।জ্বর যখন কিছুটা কমে এলো তখন মাথায় আবার শানু এলো। কেন জানি এখন মনে হচ্ছে, শানু নির্দোষ।ও বড় বিপদে পড়েছে। আশফাক সুমন নামের কুকুরটা হয়তো ওকে দিনের পর দিন ধ*র্ষণ করে যাচ্ছে! বেচারি কিছুই করতে পারছে না। হয়তো ওখান থেকে মুক্তির জন্য তীব্র চেষ্টা করছে সে। হয়তো শানু এই আশায় আছে যে আমি তাকে মুক্ত করবো। হঠাৎ করেই মৃত্যুর চিন্তাটা মাথা থেকে সরে গেল। ভাবলাম, কপালে যা আছে ঠিক তাই হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে, মাকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে আমি ফোন করলাম থানায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু এস আই নাঈমকে। ফোন করে নাঈমকে সব বললাম।নাঈম শুনে বললো,’ গতকাল রাতে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে যে নম্বরে ছবি পাঠালো ওই নম্বরটা দে এক্ষুনি।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে নম্বর পাঠিয়ে দিলাম।
নাঈম বললো, ‘ আধঘন্টা সময় লাগবে শিহাব।আধ ঘন্টার মধ্যেই আমি খুঁজে বের করবো এই নম্বর কার।ওর ছবি সহ সব তথ্য বের করতে পারবো।’
বলে নাঈম কল কেটে দিলো।
আমি বসে আছি।ঘরের দরজা জানালা সবকিছু বন্ধ করে বসে আছি। নিজেকে এখন ঘোর পাগল মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে এই ঘরে দম আটকে ম*রে যাবো আমি আজ, এক্ষুনি!
‘
ঠিক আধ ঘন্টা পর নাঈম কল করলো নিজ থেকেই।কল রিসিভ করতেই সে বললো,’ পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি।’
তার গলার স্বরে প্রবল উত্তেজনা।
আমি কাঁপছি। থরথর করে কাঁপছি।কেন কাঁপছি বুঝতে পারছি না।
আমি কিছু না বললেও নাঈম নিজ থেকেই আবার বললো।বললো,’ একটা মেয়ের নামে নম্বরটা রেজিস্ট্রেশন করা।নাম অলকা দেবনাথ।স্বামী – অসীম দেবনাথ। ঠিকানা ভাটিকেশ্বর। ময়মনসিংহ।’
এসব কি শুনছি আমি? নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।আমি বললাম,’ নাঈম, ভালো করে দেখ তো।তোর বোধহয় ভুল হচ্ছে।নম্বরটা ভালো করে দেখ তুই।’
আমি নিজেও ওকে পাঠানো নম্বরটা চেক করলাম। ভাবলাম, ভুলে অলকা ভাবীর নম্বর দিয়ে ফেললাম কি না আবার!
কিন্তু না খুব ভালো করেই দেখলাম, ওই নম্বরটিই দিয়েছি।যে নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছিল।
নাঈম নিজেও চেক করলো। তারপর বললো,’ আমি আবার চেক করে দেখেছি। কোন ভুল হয়নি। কেন? কোন সমস্যা? তুই চিনিস নাকি অলকা নামের মেয়েটিকে?’
আমি এই কথার কোন উত্তর দিলাম না। বললাম,’ তুই ইমেইল কর ওর ছবিটা। এক্ষুনি দে।’
নাঈম বললো,’ ওকে।’
সে সঙ্গে সঙ্গে ইমেইল করলো। ইমেইল ওপেন করতেই আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল।এ কি দেখছি আমি।
এ যে আমার নিজের প্রতিবেশী অলকা ভাবী।
তার মানে এই সবকিছুর মূলে সে।
ওই যে গতকাল হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠালো। তারপর এর নিচে লিখলো, প্রতিশোধ এভাবেই নিতে হয়।তার মানে শানু যে তার উপর কানের দোল চুরির অভিযোগে দিয়েছিল আর আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম। সেই প্রতিশোধ কি অলকা ভাবী নিচ্ছে এখন? প্রতিশোধ এভাবেই নিতে হয়?
ছিঃ!
কি ভয়ংকর মানুষ!
নাঈম আবার কল করলো।বললো,’ তুই মামলা কর।সব দায়িত্ব আমি নিবো। কিচ্ছু হবে না।আমি খুঁজে ওদের বের করবো।সব কটাকে জেলে ঢুকিয়ে ছাড়বো।’
আমি কি করবো তা ঠিক করতে পারছি না।যেদিকেই তাকাই সেদিকেই শুধু সাপ দেখি। সবার আগে দেখলাম এর সঙ্গে শানু জড়িত। এরপর বস । এরপর জেবা। এবার দেখি আমার প্রতিবেশী অলকা। এসবের মধ্যে কারা ভুক্তভোগী আর কারা অপরাধী কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! সবকিছুতেই কেমন যেন একটা ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এটা তো বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট যে অলকা ভাবী এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমার থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নাঈম বললো,’ ভয় পাচ্ছিস তুই তাই না? ভয়ের কিছু নাই শিহাব।প্রয়োজনে তোর বাসায় এসে আমি নিজে থাকবো। তোকে পুলিশ পাহারায় রাখবো। কোন বিপদ হবে না।আর এখানে তো অনেক কিছুই স্পষ্ট। ওদের ধরতে খুব বেশি সময় লাগবে না! আমি তিন দিনের মধ্যে সব কটাকে ধরবো।সব রহস্যের সমাধান করে দিবো। তোকে কথা দিলাম।’
‘
(চলবে)…
#গোপনে