#বড়োজা
#Nadia_Afrin
পর্ব ৪
সন্ধ্যার আগ দিয়ে,,,
ছেলেকে নিয়ে ধরাধরি করে কোনো মতে তোষকটা ঘরে নিলাম।
আগে থেকে চট বিছিয়ে রেখেছিলাম।সেখানে একটা চাদর বিছিয়ে দিলাম।চাদরটা আমার ব্যাগে ছিল।
ছেলে আমার নতুন বিছানা দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
উঠোনের এক কোণে একটা ভাঙা বাক্স মতো পড়ে ছিল।সেটাই ঝেড়ে-মুছে হালকা ঠিক করে ঘরে এনেছি।
কাথা গুলো ভাঝ করে রেখেছি ওখানে।
খালা এলেন এমন সময়।আমি তখন কম্বল ভাঝ করছি।
খালা কিছুক্ষণ কম্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,”বাহ কম্বলটি দেখছি নতুনই আছে।
ধুলো লেগে নোংরা লাগছিল।
জানো তন্নি,এমন একটি কম্বল আমার মায়ের ছিল।
মা মরে গেছে কতোবছর হলো।আজও কম্বলটির কথা ভুলতে পারিনি।
কম্বলটি যদি পেতাম,গায়ে দিয়ে একরাত ঘুমাতাম।”
আমি বুঝে গেলাম তার মতলব।
কিন্তু এবার আর সুযোগ দেব না।
বললাম,”না না খালা।তা কী করে হয়!
এটা আপনায় দিলে আপনার মায়ের কথা বেশি করে মনে পড়বে আপনার।কষ্ট পাবেন মায়ের কথা মনে করে।
এরচেয়ে বরং আপনার যা আছে তাতেই ঘুমান।কষ্ট কম হবে।”
আমার এহেম কথায় খালার মুখথানা ছোট করল।
চারপাশে তাকিয়ে ভাঙা সেই বাক্সটি দেখে বলল,”তুমি আমার বাক্স ঘরে এনেছ কেন তন্নি?
টাকা দিয়ে কিনেছ নাকি?”
“টাকা দিয়ে সবই তো কিনলাম। বাড়িওয়ালা হিসেবে আপনারও উচিৎ কিছু দেওয়া।
আপনার ঘর-বাড়ি সারালাম,সব ঠিক করলাম।এগুলো কিন্তু আপনার দায়িত্ব ছিল।
একটা বাক্সের জন্য এখন টাকা চাইতে আসবেন না দয়া করে।এটা তো ফেলেই রেখেছিলেন আপনি।”
খালা রাগে আগুন।
ঘর থেকে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল সে।
আমার ভীষণ হাসি পেল কেন জানি।
অনেকেই হয়ত ভাবছেন,আমি কেন এর বাড়ি থাকছি?
এখানে থাকার তেমন ইচ্ছে আমারও নেই।থাকছি বিপদে পড়ে।
দুনিয়াতে আপন কেউ নেই আমার।
এই বাড়ি থেকে আকাশের বাড়ি খুব বেশি দূরে না।একটা সাহস পাই অজানা কারণে।যদিও আকাশ অকৃতজ্ঞ।কিন্তু ঐ এলাকার কিছু মানুষ আসে যারা আমার পরিচিত।
মনে হয় কোনো বিপদে পড়লে তাদের কাছে গিয়ে স্বান্তনা পাব।
একবার হলেও তারা দেখবে আমায়।
নিজের জন্য ভাবিনা আমি।বাচ্চা দুটোর জন্য চিন্তা হয়।
অন্যত্র চলে গেলে যদি কোনো বিপদ হয়।চারদিকে কতো খু*নের ঘটনা শুনি।মনে ভয় হয় ভীষণ।
এখানেও এমন কিছু ঘটতে পারে।কিন্তু কাছে-পিঠে কজন পরিচিত লোক আছে ।সেই এক ভরসা।
বর্তমানে একটা ঘর-বাথরুম নিতে গেলেও পনেরোশোর নিচে নেই।আমি খুঁজেওছি।
অগ্রিম দিতে গেলে তিনহাজার।থাকব তবুও মনে ভয় নিয়ে।অনিরাপত্তা কাজ করবে ভীষণ।
একটা কাজের জোগাড় করব প্রথমে।
এরপর এখানেই কাছাকাছি একটা ভালো ঘর নেব।ছেলে-মেয়েকে ভালো পরিবেশে বড়ো করব।
এখানে এ্যাডভান্স টাকা দিয়ে দিয়েছি।সুতরাং গেলে আমারই লস।
সুখের সময় নেই আমার,হাতে অগুনতি টাকাও নেই যে একমাসের ভাড়া গচ্ছা দিলে সমস্যা হবেনা।
বাড়িটা না সারালেও পারছিলাম না।
জানিনা কতোদিন থাকতে হবে এখানে।কাজ খুঁজতে হবে।সময়ের ব্যাপার।
ভাঙা ঘরে থাকলে কোনো বিপদ হতে পারত।
আমরা বাচ্চার মায়েরা বাবুদের নিয়ে একটু বেশিই সেনসিটিভ।বাচ্চার সুস্থতার ব্যাপারে কখনো টাকা দেখিনা।
এসব ভাবতে ভাবতে কাজ শেষ করলাম।
ছেলেকে বললাম খেয়ে নিতে।
ছেলের আবারো একই প্রশ্ন, বাবা আসেনি আম্মু?
বললাম,”বাবার কাজ আছে তাই আসেনি।তুমি খেয়ে নাও।”
ছেলেটা আমার মন খারাপ করল।
খেতে লাগল চুপচাপ।
আমি খেলাম একটু।দরজা লাগিয়ে শুতে যাব এমন সময় খালা এলো আবারো।
বুঝলাম না,এতো আসার কী আছে।প্রয়োজনের সময় তো আসেনা।
খালা বিছানায় বসে।
আমার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”ঘুমাবে নাকি?ঘুমাও বাবু।বাচ্চাদের তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয়।”
আমি চুপচাপ বসে আছি।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”খেয়েছ তন্নি?
“হ্যা।”
“কী খেলে?ঘরে খাবার তো তেমন নেই।”
বললাম,”সেই বিরিয়ানি ছিল অর্ধেকটা।ওটাই খেলাম মা-ছেলেতে।”
এবার চুপ গেলেন তিনি।কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে বললেন,”একটা কথা বলি তন্নি।
আমার মেয়ের মতো তুমি।তোমার মায়া ভরা মুখটা দেখলে মায়া হয় ভীষণ।
এভাবে খাবার কিনে এনে কদিন খাবে?
বাচ্চার পেট খারাপ হবে।টাকাতেও কুলোবে না।
তোমার আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বললাম।তিনি একটা পরামর্শ দিলেন।
তুমি আমাদের সঙ্গে খাও।মাস শেষে হাজার টাকা দিও।
সমস্যা নেই,মাস শেষেই দিও।খাবার নিয়ে আমি আবার টাকা আগে নিতে পারিনা।মনটা আমার বড়ো কিনা!”
“নাহ খালা।তার প্রয়োজন হবেনা।
আমি কাল বাজারে গিয়ে চাল-ডাল আর সবজি কিছু কিনে আনব।”
“বোকা মেয়ে।সব কী এতোই স্বস্তা!
তোমার কোনো কাজ নেই হাতে।আগে কাজের জোগাড় করো,তারপর না হয় নিজে কিনে খেও।
জিনিস পত্রের খুব দাম।
একটা সংসারে কম জিনিস লাগে নাকি!
হাড়ি না হয় আছে কখান।হাড়িতে রান্নার সব কিনতে গেলে হাত তোমার একদমই খালি হবে।দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকবে,হাতে কিছু রেখে দাও।তোমায় তো আর দেওয়ার মতো কেউ নেই।যে বিপদে চাইলে।
এখন বাজার সদাই করতে গেলে তেল থেকে নুন,সব কিনতে হবে তোমার।
পাঁচ-সাত হাজারেও হবে কিনা সন্দেহ।
তোমার ছেলেকে যা বুঝলাম,ভালো-মন্দ ছাড়া খায়না।
বাচ্চা তো,এমন করবেই।
সবজির সঙ্গে মাছ-মাংস কিনতে গেলে অনেক টাকার ব্যাপার।
এর চেয়ে আমাদের সঙ্গে খাও আর কাজ জোগাড় করো একটা।তারপর নিজের মতো করে খেও।
ভেবে দেখতে পার,তোমারই লাভ এখানে।”
জানিনা ঠিক হলো কিনা।তবে এই মূহুর্তে খালার কথাগুলো আমার যুক্তিপূর্ণ মনে হলো।
সত্যিই তো আমার কেউ নেই সাহায্য করার মতো।
একদম হাত খালি হলে চলবো কী করে বাচ্চা নিয়ে?
বাচ্চা ওয়ালা মায়েদের হাতে সবসময় টাকা রাখতে হয়।স্বামী থাকলে এতো চিন্তা হতো না।
কিনতে গেলে সব কিনতে হবে।তেল,মসলা,সবজি,চাল-ডাল,মাছ-মাংস সব কিনতে হবে।অল্প করেও কিনতে গেলে টাকা লাগবে বেশ।
রান্নার চুলোটা পর্যন্ত নেই,লাকড়ি পযর্ন্ত কিনতে হবে।
এমনিতেই নির্দিষ্ট সময় পর আমি এ বাড়ি ছেড়ে যাব বলে ভেবেছি।বাচ্চা নিয়ে সব টানাটানি করা ঝামেলার।তারমাঝে আবার সব কিনলে টানা-নেওয়া সমস্যা হয়ে যাবে।
এরচেয়ে বরং খালার প্রস্তাবটাই মেনে নেই।
টাকা দিয়ে খেলে সমস্যা করার কথা তো নয়।খাবার জিনিস এটা।অন্য কিছু তো নয়।লাজ-লজ্জা একটু হলেও থাকবে।মানবিকতা অবশ্যই দেখাবে।
রাজি হয়ে গেলাম আমি।
খালা মুখে হাসি নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললেন,”আগে থেকেই বলে রাখি বাপু,তিন বেলা দুজকে খেতে দিতে পারব না।দু-বেলা ভাত-তরকারী দেব। আলাদা কিছু নয়,আমরা যা খাব তাই দেব।
তোমার জন্য খাবার দেব।ওখান থেকে মা-ছেলে মিলে খাবে।ছয় বছরের ছেলে কতোই বা খাবে।
নিজের থেকে কুড়িয়ে-পাড়িয়ে খাইয়ে দেবে।
সংসার তো করে এসেছ,জানোই তো বাজার-সদাইয়ের কেমন দাম!
হাজার টাকায় এরচেয়ে বেশি সম্ভব নয়।”
“ঠিক আছে খালা।সমস্যা নেই।একবেলা না খেলে কেউ মরবে না।
তিনবেলা ভালো-মন্দ খাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।”
“ ঠিক আছে।তাহলে কাল থেকেই বরং খেও।
আমি এখন যাচ্ছি।”
খালা উঠে দাড়ালেন।
দরজা অব্দি গেলেন।আবারো পেছন ফিরে বললেন,”শোনো তন্নি,তোমাকে কিন্তু আমার রান্নায় সাহায্য করতে হবে।
বাড়তি রাধতে হবে এখন থেকে।বয়স হয়েছে আমার,কষ্ট হয় কাজ করতে।
নিজে রান্না করে খেলে তো কাজ করতেই হতো।
আমার কাজে একটু সাহায্য করে দেবে।”
“তা করে দেব।কাজ করার অভ্যাস আছে আমার।
হাত ক্ষয়ে যাবেনা কাজ করলে।বরং কাজের মাঝে থাকলে মন ভালো থাকে।
এমনিতেই আমি বসেই থাকব বাড়িতে।”
খালা আমার উত্তর শুনে খুশি হলেন।
বেড়িয়ে গেলেন।
দরজা লাগিয়ে ছেলে নিয়ে শুয়ে পরলাম আমি।
আজ অনেক নিশ্চিন্ত লাগছে আমার।
মাথা গোজার ঠায় করেছি,খাবারেরও ব্যবস্থা হলো।বাকি রইল একটা কাজ।সব যেহেতু হয়েছে কাজও হবে।
ধীরে ধীরে আমি সব করব আমার সন্তানদের জন্য।কাল থেকে কাজের খোঁজে বের হবো ভেবেছি।
ছেলের দিকে তাকালাম।
নরম বিছানা পেয়ে,শান্ত মন নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
মেয়ে ঘুমিয়ে কাঁদা সেই কখনই।
দু-দিন ঘুমাইনি আমি।
আজ খেটেছিও ভীষণ।ক্লান্ত লাগছে,হাত-পা ব্যাথা করছে।
ঘুমের প্রয়োজন।
চোখ বুজলাম।ঘুমে হারিয়ে গেলাম।
খুব সকালে ঘরের দরজার প্রচন্ড ধাক্কার শব্দ।
আমি ভ্রু কুচকে দরজা খুললাম।ভোরের আলো এখনো পুরোপুরি ফোটেনি।
দরজার বাইরে খালা দাড়িয়ে আছে।
ব্রাশ করতে করতে এসেছেন তিনি।থুথু ফেলে বলল,”দিনরাত শুয়ে থাকলে হবে?
রান্নার কাজে সাহায্য করতে হবে তো।চলো আমার সঙ্গে।”
আমি বাইরে এসে বললাম,”এতো সকালে রান্না উঠিয়ে দেবেন খালা?
সকালই তো হয়নি ঠিক মতো।”
“ তাড়াতাড়ি রাধি আমি।তোমার আঙ্কেল সকাল সকাল খেয়ে,সব নিয়ে দোকানে যায়।
চলো।”
তিনি চলে গেলেন।
আমি চোখে-মুখে পানি দিয়ে দরজা হালকা চাপিয়ে দিয়ে গেলাম।
বাচ্চারা এখন উঠবেনা।গভীর ঘুমে আছে।মেয়েকে খাইয়েছি একটু আগেই।
দু-বাড়ির মাঝে একটা গেইট মতো আছে।একপাশে খালা থাকে,অন্যপাশে আমি।
তার বাড়ি যেতেই দেখলাম খালা মুখ ধুচ্ছে বাথরুমে।
আমায় দেখে বলল,”ওদিকে ঝাটা আছে।উঠোনটা আগে ঝাড়ু দিয়ে নাও।ঘরগুলো আমি ঝাড় দিয়েছি।”
“কিন্তু খালা আমার তো শুধু রান্নায় সাহায্য করার কথা।”
“রান্নাতেই তো সাহায্য করবে।জানো না,রান্নার আগে বাষি ঘর-উঠোন ঝাড় দিতে হয়।”
আমি আর কিছু বললাম না।সকাল সকাল ঝামেলা চাইনা।ছোট একটা উঠান ঝাড় দিলে হাতে ফোসকা পড়বেনা আমার।
ঝাড় দিয়ে উনার রান্নাঘরে গেলাম।খালা সবজি নামাচ্ছে।
এই প্রথম উপার বাড়ি আসলাম।চারপাশ দেখলাম।
বেশ বড়ো বাড়ি।দামী ফার্নিচার।ছেলেরা বিদেশ থাকে বলে কথা।ঘরে হরেকরকম জিনিস।
চার-পাঁচটা রুম।প্রতিটি রুমেই ছোট-বড়ো অনেক শোপিস,ফার্নিচার।ডিজাইনের আলমারি,খাট,ড্রেসিং টেবিল আরো কতো কিছু।মহিলা শৌখিন আছে বলতে হবে।
আমার ঘরেও একসময় এতোকিছু ছিল।নামী-দামি ফার্নিচার ছিল।এর চেয়ে বেশিই ছিল বলতে গেলে।
শখ করে কতো কিছু বানাতাম।
সাজানো-গোছানো সংসার আমার ধুলো হয়ে গেছে যেন।সবই আজ অতীত।
রান্নাঘরের একটা জিনিস দেখে ভীষণ অবাক হলাম।
বস্তাতে করে পেয়াজ,আলু রাখা।
এতো কেন?সামান্য দুজন মানুষের বছরেরও এতো লাগার কথা নয়।
খালা ডাক দিল আমায়।
বলল,”রান্নাটা আমিই করব।তুমি শুধু কুটে-বেছে দেবে।
রান্না করতে দিলে মসলাপাতি বেশি দিয়ে সব ফুরিয়ে ফেলতে পার।তাই আমিই করব।”
আমি মনে মনে ভাবলাম,যাক ভালোই হলো।রান্নাটা বেশি ঝামেলার।
বটি নিয়ে বসতে বলল আমায়।
ঝুড়িতে করে অনেক পেয়াজ নিয়ে এলো।প্রায় দু-তিন কেজি মতো হবে।
কাটতে বলল।
বুঝলাম না,এতো পেয়াজ কী করবে?
ভুনাতেও তো এতো লাগেনা।পেয়াজের কোনো রেসিপি করবে নাকি?শুধু পেয়াজে রেসিপি হয়?
একবার জিজ্ঞেস করব ভাবলাম।
কিন্তু করলাম না।কী করে দেখতে চাইলাম।
পেয়াজগুলো কাটতে লাগলাম।প্রচন্ড ঝাঝ।কেজি খানিক কেটে আর কাটতে পারলাম না।উঠে দাড়ালাম।
খালা ভাত রান্না করছিল।
আমায় দাড়াতে দেখে এগিয়ে এলো।
বলল,”চোখে পানি দিয়ে নাও।প্রথম তাই এমন হচ্ছে।
আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাথরুমে গিয়ে চোখ ধুয়ে এসে বাকিগুলো কেটে দাও।”
বাথরুম গেলাম।চোখে বেশি করে পানি দিলাম।মুখ ধুয়ে নিলাম।
জ্বালা কমেছে কিছুটা।
আবারো কাটতে বসলাম।
কষ্ট করে হলেও সবটা কেটে নিলাম।খালা পেয়াজ নিয়ে একটা বড়ো ব্যাগে উঠায়।
এবার কেজি দুয়েক মতো আলু নিয়ে এলো।
কেটে দিতে বলল টুকরো টুকরো করে।কুচি করতে নিষেধ করেছে।
এতো আলু দুজন মানুষ খাবে কী করে?যেন কোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যাচ্ছে।
মনে অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রথমদিন তাই কিছু বলছিনা।
আলু গুলোও কেটে দিলাম।
সেগুলোও ব্যাগে ভরছে তিনি।
এবার নিয়ে এলো দুটো বেগুন,তিনটি আলু।আর একটা পেয়াজ।
আমি বললাম,”মাত্র না কতোকিছু কেটে দিলাম।আবার এগুলো কেন আনলেন?”
খালা একগাল হেসে বলল,”আরে বাবা ওগুলো ছিল আমাদের দোকানের জন্য।তুমি হয়ত জানো না,আমাদের একটি দোকান আছে বাজারে। ভাঝা জিনিস বিক্রি হয়।দোকানের বড়া, সিঙ্গারার জন্যই কাটলে ওসব।
এবার এগুলো রান্না হবে।রান্না না হলে খাবে কী।তাই তাড়াতাড়ি কেটে দাও।
তুমি বাপু খুব ঢিলে।এইটুকু কাটতেই বেলা নটা বাজিয়ে দিলে।
রান্না করে খাব কখন আমি?
আজ তোমার জন্য তোমার আঙ্কেলকে না খেয়ে যেতে হবে।”
“কিন্তু খালা আপনি তো আমায় বলেন নি দোকানের জন্য তরকারি কাটতে হবে।আপনি বলেছেন নিজেদের জন্য রান্নার কাজ করতে হবে।
এতো জিনিস খামাখা আমি কেন কাটতে যাব?”
খালা মুখ বাকিয়ে বললেন,”মুখে মুখে কতো চোপা করো তুমি তন্নি।
তোমায় শান্ত ভেবেছিলাম।
মেয়ের মতো মনে করি।ভেবেছিলাম মায়ের কাজগুলো করে দেবে।
যাক গে সেসব,কাল থেকে আর করতে হবেনা তোমায়।
এখন সবজিগুলো কেটে দাও।মাছটা ধুয়ে দাও।”
সবজি কেটে দিলাম।মাছ ধুয়ে দিলাম।
সব করে দিয়ে বললাম,”বেলা অনেক হয়েছে খালা।
আমি গেলাম।বাচ্চারা মনে হয় উঠে গেছে।”
সে বলল,”যাও।রান্না হলে দিয়ে আসব খাবার।”
দৌড়ে ঘরে এসেছি।সত্যি সত্যিই মেয়ে কাঁদছে।
ছেলে মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
দ্রুত কোলে নিলাম মেয়েকে।ক্ষিদে পেয়েছে বেচারার।
ছেলে অভিমানী কন্ঠে বলল,”কোথায় গিয়েছিলে আম্মু?আপু কখন থেকে কাঁদছে।
আপু আমার ঘুমটাও ভাঙিয়ে দিয়েছে।”
“আমি কাজে ছিলাম।
আর ঘুমোতে হবেনা।পরে ঘুমিও।
কলপারে পানি ওঠানো আছে।মুখ ধুয়ে এসো সুন্দর করে।তোমার জন্য নতুন ব্রাশ-পেষ্ট কিনে এনেছি।
ফ্রেশ হয়ে এসো।খেতে হবে।”
ছেলে আমার বাধ্য বাচ্চার মতো কথা শুনল।
মুখ ধুয়ে মুছে বিছানায় বসল।
আমি ততক্ষণে মেয়েকে খাইয়ে মুখটা ক্লিন করিয়ে শুইয়ে দিয়েছি।সে এবার একা একাই খেলছে।
হাতে বোতল নিয়ে পানি আনতে গেলাম।
কলপাড় থেকে খালাদের রান্নাঘর দেখা যায়।
ওদিকে তাকালাম একবার।
চুলো জ্বলছে না।তারমানে রান্না শেষ।
হয়ত খেয়ে নিয়ে খাবার দিয়ে যাবে।
আমার খাবারটা আগে দিয়ে গেলেই হতো।ছোট বাচ্চা আমার,ক্ষিদে সহ্য করতে পারেনা।
পানি নিয়ে ঘরে গেলাম।
বেলা তখন দশটা।ছেলে চুপচাপ বসে আছে।মুখটা থমথমে।
আমি ঘর-বাইরে পাইচারি করতে লাগলাম।
কখন খালা খাবার দিয়ে যাবে,কখন ছেলের মুখে খাবার তুলে দেব।
সময় আরো কেটে গেল।
ছেলে বোতলের ছিপি খুলে দু-ঢোক পানি খেল।
ক্ষিদে পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে।কিন্তু প্রকাশ করছেনা।
বসে থাকতে থাকতে ছেলে আমার শুয়ে পরলো।
প্রচন্ড রাগ হলো আমার।বেলা বেজে গেছে সারে এগারোটা।
খাবার সকাল-রাতে দেওয়ার কথা।এখন দেখছি দুপুর হয়ে যাচ্ছে।
এমন তো না রান্না শেষ হয় নি।সিলিন্ডার গ্যাসের ডাবল চুলা।একচুলায় তরকারি কসাতে দিয়ে অন্যটায় মাছ ভাঝতে দিলে মিনিট দশেকের মাঝে তরকারি রান্না শেষ হবে।ভাত তো আগেই হয়েছে।
এক্সট্রা কিছুও করেনি।করলে কেটে দিতে বলত আমায়।
উঠে দাড়িয়ে দরজা পর্যন্ত এসেছি খালার বাড়ি যাওয়ার জন্য,এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে তিনি এলেন।
বললেন,”বড্ড দেরি হয়ে গেল মা।
আসলে খাবার খেয়ে পেটে ব্যাথা ধরেছিল।উঠতে পারিনি।
তাই খাবার নিয়ে আসতে দেরি হলো।”
“পেটে ব্যাথা তো আমায় ডাকতে পারতেন।
আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।আমার ছোট ছেলে ক্ষিদেতে কষ্ট পাচ্ছে।”
“মাফ করে দাও মা।খাবার আমিই দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম তাই আর ডাকিনি।কাল থেকে আর দেরি হবেনা।সময় মতো খাবার পেয়ে যাবে।প্রথমদিন তাই সবই একটু পিছিয়ে গেছে।
কাল থেকে আর এমন হবেনা।
খাবার নিয়ে ছেলেকে খাইয়ে দাও।”
আমি প্লেট হাতে নিলাম।
এমন সময় একটি মহিলা এলো।
খালাকে বাড়িতে না পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে।
মহিলাটি টাকা চাইতে এসেছে।
খালা শাড়ির আচলের গিট খুলে কিছু টাকা দিল তাকে।
মহিলাটি টাকা নিয়ে আমার দিকে রাগান্বিত চেহারায় তাকাল।
ফিসফিস করে বলল,”এর জন্যে আমার রোজগার বন্ধ হলো।”
আমি বুঝলাম না মহিলাটির কথা।একে তো আমি চিনিও না।আমার জন্য কীভাবে এর রোজগার বন্ধ হলো?
ওদিকে ছেলে খাবারের জন্য ডাকছে।
থালা নিয়ে ঘরে গেলাম আমি।
মহিলাটি সহ খালা চলে গেলেন।
পাশেই বেছানো চটে ছেলেকে নিয়ে বসেছি।
খাবার রেখে পানির বোতল নিলাম।
থালার ওপরের ঢাকনা উঠাই।
ভাত আর আলু-বেগুনের ঝোল শুধু।অথচ রান্না হয়েছে মাছ।
পরক্ষণে ভাবলাম,রাতে দেবে হয়ত।
হাজার টাকায় দু-বেলা মাছ-মাংস এমনিতেই হয়না।
থাক,যা দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্।
খেয়ে নেই।
ছেলে জিজ্ঞেস করল,”এটা কীসের তরকারি আম্মু?”
মিথ্যে বললাম,”সবজির তরকারি।ভাত দিয়ে মেখে খাও ভালো লাগবে।”
সত্যি বললে মাছ খাওয়ার বায়না করত।
ভাত মেখে নিজে নিজেই দু-বার মুখে দিল আমার বাচ্চাটা।
চিবিয়ে বলল,”এটাতে তো মাছ মাছ গন্ধ আসছে আম্মু।”
আমি জবাব দিতে পারলাম না কোনো।চুপ করে রইলাম।
ছেলে হয়ত আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারল।
আর কোনো প্রশ্ন না করে খেয়ে নিল।
আলিফের খাওয়া শেষ হলে থালাটা টেনে নিলাম।
অল্প ভাত আছে আর।রেখে দিলে ছেলের ও বেলা হয়ে যাবে।
এদিকে আমারও পেটে ক্ষিদে ভীষণ।
রাতে দু-তিন লোকমা বিরিয়ানি খেয়েছি শুধু।এক প্যাকেটে কতোবার খাওয়া যায়!
না খেলে মেয়েটার সমস্যা হবে।
তাই খেয়েই নিলাম।
ভাবলাম,দুপুরে আজ পাউরুটি আর কলা কিনে খেয়ে চালিয়ে দেব।
রাতে তো খাবার পাবই।
রাতে যা হলো এরপর,,,,,,,
হালকা বর্ণনা,সন্তান হিসেবে শুন্য তুমি,স্বামী হিসেবে কলঙ্ক,মানুষ হিসেবে অভিশাপ তুমি,এবার পিতা হয়ে কুৎসিত হইয়ো না।
তাহলে বিলীন হয়ে যাবে তুমি।
চলবে….