আমার হয়ে যা পর্ব-১২

0
282

আমার হয়ে যা _পর্ব-১২
.
আমি বাড়িতে ফিরে এসে নিজেকে শক্ত করি। হয়তো নূপুর আমার ভাগ্যে নেই। এই ভাগ্য পরিবর্তন করার ক্ষমতাও আমার নেই। চেষ্টা যতটুকু করার আমি করেছি। নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়েছি বিনামূল্যে। ওর জন্য পরিবারের সঙ্গে কম ঝামেলা করিনি। এতটা মাস ওর বাড়িতে ছুটে গিয়েছি। যখন যা সহযোগিতা দরকার করেছি। ওর বুঝার কোনো বাকি নেই আমি কতটা ভালোবাসি তাকে। তাহলে আর ছুটে যাব কীসের জন্য? সে রাজি হলে তো এমনিই হতো। হ্যাঁ আমি ওকে জড়িয়ে ধরে অন্যায় করেছিলাম। সেটার জন্য মেসেজ দিয়ে মাফও চেয়েছি। নিজের অপরাধটুকু স্বীকার করতে আজ ছুটেও গেছি। ও দেখা করেনি। চাচিও দেখা করতে দেয়নি। আমার আর কিইবা করার আছে। ওর বদনাম হোক তা আমি চাই না। বারবার ওদের বাড়িতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতেও পারবো না। আমি নিজেকে বুঝিয়ে, শক্ত করে দোকানে চলে যাই। সারাক্ষণ ও মাথার ভেতর ঘুর-ঘুর করলেও নিজের কাজে মনযোগ দেই। এভাবে দুইদিন কেটে যায় আমার। অবসরে আপু আর আম্মুর সাথে সময় কাটাই। ওরা নানানভাবে বুঝায় আমাকে। আমি তাতে আরও খানিকটা শক্তি পাই। রাতে ঘুমানোর আগে ওর কবিতা পাঠ শুনি, পোস্ট পড়ি, ছবি দেখি। কিন্তু কোথাও লাইক, কমেন্ট করি না। শুনি, একা একা অন্ধকার রাতে কাঁদিও। মাঝে মাঝে প্রতারিতও ফিল করি। চাচি যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিল। যেরকম কাজে-অকাজে ডাকতো ওরা। মনে হতো নূপুর বিয়ে করতেই চাইছে না। কিন্তু করলে আমাকেই করবে। না, তা হয়নি। আমার চিন্তা ভুল ছিল। আকাশ সাহেব শিক্ষিত, শহুরে বড়লোক মানুষ। তাকে রেখে ওরা আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। আমি এক সপ্তাহ ওকে কোনো মেসেজ দিলাম না। দিয়ে লাভও নেই। ও এমনিই সিন করে না। ও বাড়ির দিকে পা বাড়াইনি, বাড়িয়েও লাভ নেই, কেউ দরজা খুলে দেবে না। এক অদ্ভুত, অব্যাখ্যায় দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে আমি দিন গুজার করতে থাকি। ক’দিন পর একটা ঘটনা ঘটলো, আমি দুপুরে দোকান থেকে বাড়িতে এসে স্নান আর খাওয়া-দাওয়া শেষে বাইক নিয়ে বাজারে যাচ্ছি। রাস্তায় একটি কালো গাড়ি আমাকে দেখে থেমে আয়না নামিয়ে হাত নাড়লো। আমি বাইক থামিয়ে তাকিয়ে দেখি আকাশ সাহেব। ভদ্রতা থেকে আমি বাইক একপাশে রেখে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘আকাশ সাহেব যে, কেমন আছেন?’

– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি, কোথায় যাচ্ছেন?’

– ‘আমার তো বাজারে ব্যবসা, সেখানে যেতে হয়।’

– ‘ও আচ্ছা, তাহলে যান। আমি লেখিকার বাসায় যাচ্ছি।’

আমার বুকটা কেঁপে উঠে। পাশাপাশি ইচ্ছা করছিল লোকটিকে এখানেই শেষ করে দেই। তবুও মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললাম, ‘সেদিনও এসেছিলেন শুনলাম। আজ কি একাই এলেন? বিশেষ কোনো দরকারে না-কি?’

তিনি চশমাটি কপালে তুলে বললেন, ‘আপনি তো ব্যস্ত মানুষ। এদিকে লেখিকার বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে হবে ঢাকা গিয়ে। সে একা যেতে পারবে না বলছে। ভাবলাম নিজেই নিয়ে যাই। বেড়ানোও হয়ে গেল।’

সবই যে অজুহাত তা আমি বুঝি। বুঝি বলেই আমার দমবন্ধ অনুভূতিটা আরও প্রখর হয়। বিদায় নিয়ে এসে বাইকে উঠে টান দেই। নূপুর এই লোকটির সাথে একা ঢাকা যাবে? এমন একটা জার্নির পর ওদের সম্পর্কের গভীরতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবতেই আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। নূপুরকে তাহলে এবারও আমি আর পাব না, ও ঠিক আকাশ সাহেবের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। জলে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে আসে। বাইক থামাই, মানুষ আসছে-যাচ্ছে, তাই চোখে কিছু পড়েছে এরকম একটা ভান করে চোখের অশ্রু মুছে নিই।

পরদিন আমার কাজের মেয়ে লতিফার সাথে দেখা হয়৷ ওকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে জানি, আকাশ সাহেবের সঙ্গে নূপুর আর চাচি ঢাকা গেছেন। আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। ওকে সেখানে নিয়ে কী বিয়ে দিয়ে চলে আসবে? কে জানে হয়তো ওরা ভাবছে আমি ঝামেলা করবো, তাই হুট করে বিয়ে দিয়ে দেবে। ঢাকায় ও কি করছে, কোথায় যাচ্ছে সেটা আন্দাজ করার জন্য আমি দিনে কয়েকবার করে নূপুরের পেইজ ভিজিট করি। আকাশ সাহেবের আইডিতে যাই। পরদিন দুপুরে নূপুরের আইডিতে কিছু পোস্ট হয়। ওকে রকমারির অফিসে বসে নিজের বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দেখা যায়। অল্প একটু সান্ত্বনার উপলক্ষ্য পাই আমি। নূপুর এই কাজেই নিশ্চয় ঢাকা গেছে, আর কিছুই না। এতটুকু সান্ত্বনা নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে আবার কাজে যাই। দুপুরে গোসল করে খেতে এলে আপু বলেন, ‘দেখলি তো এখন ঢাকার এক ব্যাটার লগে লাইন করছে। বিশ্বাস না হইলে লতিফাকে জিজ্ঞেস কর। ওর কাছে বিয়া দিবে। বিয়ের কথাবার্তা চলতেছে।’

আমি কিছু বলি না। আম্মুও আপুর সাথে গলা মিলিয়ে নানান কিছু বলে বুঝান। আমি খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে যাই৷ এভাবেই আমার দিনগুলো কাটতে থাকে।

৫.
আমি লক্ষ্য করেছি সেদিনের পর থেকে নিষাদ আর আমাদের বাড়িতে আসে না। প্রথম কয়েকদিন হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে মাফ চেয়েছে। আমি মেসেজগুলো সিন না করেও দেখেছি। এরপর একদিন ভোরে এলো। আম্মু বারান্দা থেকে তাড়িয়ে দিলেন, রুম থেকে শুনে আমার খানিকটা খারাপ লেগেছিল। কিন্তু কি আর করার। ওর না আসাটাই তো উত্তম। আম্মুর অবশ্য হঠাৎ করে এই পরিবর্তনের একটা কারণ আছে। একদিন আকাশ সাহেবের বোন আমার ফোনে কল দিলেন। তাদের বাসায় ছিলাম হিসাবে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেই সুবাদে আমাদের কথাবার্তা হয়। কিন্তু সেদিন কথার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘তোমার আম্মুর কাছে ফোনটা দাও, একদিন কথা বলি উনার সাথে।’

আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল। তাই ইতস্তত করে মিথ্যা বললাম, ‘আম্মু বাথরুমে।’
তিনি একটু পর কল দিতে বলে রেখে দিলেন। আমি আর কল দিলাম না। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের ভেতরে নিজেই পুনরায় কল দিয়ে বসলেন। আমি আর কোনো অজুহাত খুঁজে না পেয়ে আম্মুকে ফোন নিয়ে দিলাম। এরপর আর কিছুই আমার হাতে রইল না। আকাশ সাহেবের বোন ভাইয়ের জন্য আমার কথা বললেন। আম্মুর নাম্বারও নিলেন। ফোন রাখার পর আম্মা গিয়ে আব্বুকে সব খুলে বললেন। দু’জনের চোখমুখ ঝলমল করতে শুরু করলো। সবশেষে আমার কাছে এসে বললেন, ‘আকাশ সাহেবের বোন বলছে তোকে তারা পছন্দ করে।’

আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম, ‘এত খুশি হওয়ার কি হয়েছে? এটা আমি আগে থেকেই জানি। আমি তো বিয়েই করতে চাই না।’

আম্মু ধমকে উঠলেন। অনেকক্ষণ বকাঝকা করলেন। তারপর নিজেই ঠান্ডা হয়ে বললেন, ‘দেখ মা, উনি নিজেই না-কি প্রকাশক না কি যেন। বই প্রকাশ করেন। তাইলে তো তোর সাথে ভালো মানাবে। তোর লেখালেখি নিয়ে কিছু বলবে না। তাহলে কেন বিয়ে করবি না?’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুমি না আমাকে নিষাদের কাছে বিয়ে দিতে চাইছিলে। এখন এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?’

– ‘তুই কি আগে বলেছিলি এরকম একটা পাত্র আছে? তাছাড়া নিষাদের পরিবার মানেনি তাইলে আমার চাওয়া দিয়ে কি হবে?’

– ‘দেখো আম্মা, আমি আর বিয়ে-শাদি করবো না। তুমি যাইই বলো। অকারণ জ্বালাবে না।’

– ‘তোর কথাই কি কথা? আমি আর তোর বাবা রাজি।’

আমি চুপ করে রইলাম। এরপর আকাশ সাহেবের বোন নিয়মিত আম্মুর সাথে ফোনালাপ করেন। দুইদিন পর ওরা আমাদের বাড়িতেও এলো। আমি কেবল ভদ্রতা থেকে সৌজন্যের আলাপ করলাম। নাশতা-টাশতা দিলাম। তবে আকাশ সাহেবকে স্পষ্ট ব্যক্তিগতভাবে জানিয়ে দিলাম আমি বিয়েতে রাজি না। অকারণ আম্মুর সঙ্গে নাচবেন না। ওরা এসে সেদিন চলেও গেল। এরপরই আমার একদিন খালি বাসা ছিল। নিষাদ বৃষ্টিতে ভিজে এলো। আমি পাগলটাকে ভেতরে এনে বসালাম। ভেবেছিলাম চা খেয়ে খেয়ে শান্তি-মতো দুয়েকটা কথা বলবো। কিন্তু না, সে পাগলের মতো আচরণ করলো। গায়ে জোর করে স্পর্শ করলো। চুমু অবধি খেল। সেদিন আম্মু ফেরার পর মেজাজ খারাপ করে বলেছিলাম নিষাদকে আর আমাদের বাড়িতে আসতে দেবে না। তাই বলে আম্মু যে এত রূঢ় আচরণ করবে তাও ভাবিনি। এরপর থেকে নিষাদ আর আসেনি এদিকে। মেসেজও দেয়নি। ক’দিন পর আবার রকমারিতে অটোগ্রাফ দিতে যেতে তাড়া দিলেন আকাশ সাহেব। আমি না করলাম। ঢাকা একা যাব কীভাবে। এরপর সে নিজে চলে এলো নিয়ে যেতে। আমি না পারতে আম্মুকে সাথে নিয়ে গেলাম। পুরো রাস্তা এবং তাদের বাসায় কত যত্ন-আত্তি করলো। আকাশ সাহেবেরও কেয়ারিং এর শেষ নেই। তবুও আমার মন উদাস হয়ে থাকে এই পাগলটার জন্য। বাড়িতে ফিরে এসেছি গতকাল। এরপর থেকে কতবার ভেবেছি একবার কল দেবো নিষাদকে। আবার মনে হয় আশকারা দিয়ে পরে আমি সামলাবো কি করে? এমন তো না যে আমি রাজি হয়ে গেলেই বিয়ে করতে পারবে সে। তার পরিবার রাজি না। আমার পরিবার যদিও আকাশ সাহেবের দিকে মজেছে। তাদের না হয় আমি রাজি করাতে পারবো। সমস্যা তো তার পরিবার। তাই নিজের এই মন কেমন করা অনুভূতিকে পাত্তা দিলাম না। ও নিজেকে যদি গুটিয়ে নিতে পারে নিক না। এভাবে আরও দুইদিন গেল। একদিন মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কি যেন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে জেগে উঠে আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু নিষাদের জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল৷ মন কেমন করতে থাকলো। সেদিন আমাকে ওর জোর করে জড়িয়ে ধরার কথা মনে পড়লো। পাগলের মতো চুমু খাচ্ছিল ও। ইস এত যে কেন ভালোবাসে ছেলেটা। এখন যদি ওকে আমি কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে ফেলি কি করবে? রাগ তো নিশ্চয় করবে না। না-কি করবে? কিছুদিন থেকে আমাদের বাসায় না এসে, আমাকে মেসেজ না দিয়ে, আমার কোনো পোস্টে কমেন্ট না করে দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। আমি এভাবে ওর কথা ভাবতে ভাবতে রাত সাড়ে চারটা বাজিয়ে দিলাম। আমার চোখে আর ঘুম আসে না৷ বুঝতে পারছিলাম ওর জন্য মায়া হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। আম্মু সেদিন একটু বেশিই অপমান করেছে। ছেলেটা নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। আমার নিজের অজান্তে চোখে জল চলে এলো। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিয়ে বসলাম। দুইবার রিং হতেই ও রিসিভ করলো। ওর ঘুম ঘুম গলায়ও অস্থিরতার আভাস পাওয়া গেল। রিসিভ করেই বললো, ‘নূপুর তুই এত রাতে কল দিয়েছিস যে? কোনো সমস্যা?’

আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চুপ করে রইলাম। ও অস্থির হয়ে বলে যাচ্ছি ‘আরে কথা বল, কি হয়েছে? চোর-ডাকাত কিছু বাসায় ঢুকেছে না-কি, আমি আসব না-কি। কথা বল।’

আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘কিছু হয়নি নিষাদ, এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। এমনিই কল দিলাম।’

ওপাশ থেকে খানিকক্ষণ কোনো কথা শোনা গেল না। আমিই পুনরায় বললাম, ‘কি করছিস আজকাল, দেখা যায় না তোকে।’

– ‘আন্টি তো আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না নূপুর। তুই বিশ্বাস কর, আমি সেদিনের ঘটনার জন্য তোর কাছে মাফ চাইতে গিয়েছিলাম। আর হোয়াটসঅ্যাপেও দেখ আমি কতবার মাফ চেয়েছি।’

আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে পুনরায় চুপ করে রইলাম। ওপাশ থেকে নিষাদই বললো, ‘নূপুর প্লিজ তুই আকাশ সাহেবকে বিয়ে করিস না নূপুর। আমি মরে যাব এবার। প্লিজ নূপুর, আমি দেখি আব্বা-আম্মাকে যেভাবে হয় রাজি করাবো। তুই প্লিজ বিয়েটা করিস না।’

আমার সকল কথা যেন গলার কাছে এসে আঁটকে যাচ্ছে। আমি তবুও তাকে ‘আকাশ সাহেবকে আমি বিয়ে করবো না’ বলে কল কেটে দিলাম।

অনেকক্ষণ ও কল দিল না। নিশ্চয় ভয়ে দিচ্ছে না। কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসলে তাকে মানুষ প্রচণ্ড ভয়ও পায়। নিষাদের হয়েছে সেই অবস্থা। ক্ষীণ সময় পর মেসেজ এলো, ‘নূপুর, তুই আমাকে নিজ থেকে কল দিয়েছিস আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। সত্যিই তুই আকাশ সাহেবকে বিয়ে করবি না এটা কি আমি ভুল শুনেছি কি-না সেটা নিয়েও কনফিউজড হয়ে গেছি। তুই কলটা কেটে দিলি। এখন মনে হয় ঘুমিয়ে যাবি। যখন ফ্রি হবি, প্লিজ আবার আমাকে ক্লিয়ার করে বলিস আকাশ সাহেবকে বিয়ে করবি কি-না। আমার যে কি কষ্টে দিন যাচ্ছে তোকে বুঝাতে পারব না নূপুর। আমার ঘুম খাওয়া কিচ্ছু ভালো লাগে না।’

ওর মেসেজ দেখে ইচ্ছা করছে মাথায় খানিক হাত বুলিয়ে দেই ওর। ভালোবাসি কি-না জানি না। কিন্তু ওর প্রতি কেমন মায়া হয়। এটাকে করুণাও যে বলবো তাও বলতে পারছি না। সব সময় সকল অনুভূতির নাম দেয়া যায় না। আমি ওকে রিপ্লাইয়ে দৃঢ়ভাবে বলে দিলাম, ‘ঘুমা এখন, আমি আকাশ সাহেবকে বিয়ে করবো না।’

সে আর মেসেজও দিল না। মেসেজে কেবল লাভ রিয়েক্ট দিল। আমি ডাটা অফ করে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোরে একটু দেরিতে উঠেছি। উঠে দেখি আটটার দিকে মেসেজ দিয়েছে, ‘নূপুর তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে। আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে দেখার জন্য৷ আমি কি আসবো? চাচি একটু বকবে। তাতে আর কি হবে। তুই বারান্দায় এলে দেখে আমি পরে চলে আসবো।’

আমার বুকে খানিক শিরশির করে। আমি কোনো রিপ্লাই না দিয়ে আম্মুকে গিয়ে বললাম, ‘নিষাদ এলে আর বকবে না। ও তো এখন বেশি আসে না।’

আম্মু মাছি তাড়ানোর মতো বললেন, ‘আর আসবে না। আর আসলেও কেন ঢুকতে দেবো? ওকে প্রশ্রয় দিলে উল্টো বিপদ হবে।’

– ‘কীসের বিপদ?’

‘অন্য কোথাও তোকে বিয়ে দিতে হলে ঝামেলা করবে’ আব্বুও রুম থেকে শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, ওর পরিবার রাজি হয়নি। এলাকার মানুষও নানান কথা বলছে। ওর এখানে না আসাই ভালো, কি দরকারে আসবে।’

আমি আর কিছু বললাম না। হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করে মোবাইল হাতে নিয়ে ওকে আমাদের বাডিতে আসতে নিষেধ করে দিলাম। ও আর কিছু বললো না। দুপুরে একবার খেয়েছি কি-না জিজ্ঞেস করলো। আমি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম। এভাবে আরও দুইদিন কেটে গেল। ওর আমাকে দেখতে বুঝি একটু বেশিই ইচ্ছা করছিল। আজ রাত দেড়টার সময় মেসেজ দিয়ে বললো, ‘নূপুর, তুই তো বাড়ি থেকে বের হস না যে রাস্তায় বের হলে দেখবো। ফেইসবুকে নতুন ছবিও ছাড়িস না।’

আমি রিপ্লাইয়ে বললাম, ‘ছবি তোলা হয় না এখন।’

ও ক্ষীণ সময় পর বললো, ‘একবার ভিডিয়ো কলে আয় না যদি সমস্যা না থাকে। প্লিজ রাগ করিস না, তোর ইচ্ছা।’

কি ভেবে যেন আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। চোখ খানিকটা ছলছল করে উঠলো। খুব অসহায় লাগছে ছেলেটাকে। ওর অসহায়ত্ব টের পাই আমি। আমার নারী মনটা মমতায় ‘হু-হু’ করে উঠে। ক্ষীণ সময় পর মেসেজ দিয়ে বলি, ‘তুই এক কাজ কর। আমার রুমের জানালার কাছে এসে মেসেজ দে। কেউ যেন না দেখে। কিন্তু এসে পাগলামি করবি না। বাইরে থেকে দেখে চলে যাবি, ওকে?’

ও সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাইয়ে বললো, ‘আচ্ছা আমি এখনই আসছি।’

ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই ও চলে এসে মেসেজ দিল এসেছি। আমার রুমের জানালা উত্তর দিকে। জানালার পরে উঁচু দেয়াল। বাইরে থেকে কেউ কিছু দেখতে পাবে না, তাই নিঃসন্দেহে আমি বাতি জ্বালিয়ে জানালা খুলে দিলাম। ও ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পরে পাগলটাকে দেখছি। ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। জানালা ধরে আমার দিকে ক্ষুধার্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। আমি জানলার বাইরে হাত নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘রাতে কি ঘুমাস না? চেহারার এই অবস্থা করেছিস কেন?’

ওর চোখ ছলছল করে উঠলো৷ ছেলেটা এটুকু মমতাও নিতে পারছে না। ধরে আসা গলায় বললো, ‘আমার সারাক্ষণ তোকে হারানোর ভয় লাগে নূপুর।’

– ‘কেন?’

– ‘আমি তো ভেবেছিলাম তুই আকাশ সাহেবকে বিয়ে করে নিবি।’

– ‘তোর পরিবার মানলে তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম আম্মু বলেনি?’

– ‘বলেছিল।’

– ‘তাহলে আকাশ সাহেবকে বিয়ে করে নেব ভাবিস কেন?’

ওর চেহারা ঝলমল করে উঠলো। পকেট থেকে একটা স্মার্ট ওয়াচের বক্স বের করে ইতস্তত করে বললো, ‘তোর জন্য সেদিন কিনেছিলাম। প্লিজ না করবি না।’

আমি আজ না করলাম না, বললাম, ‘সেদিন কোনদিন?’

– ‘তুই যেদিন রাতে কল দিলি। সেদিন একটা কাজে শহরে যাওয়া হয়েছিল।’

আমি ক্ষীণ সময় চুপ করে থেকে বললাম, ‘আচ্ছা দে।’

ও বক্স বাড়িয়ে দিল ঘড়ি হাতে রেখে। আমি সেটা বিছানায় রাখলাম। তারপর সে লাজুক মুখে বললো, ‘তুই রাগ না করলে আমি একটু পরিয়ে দেই হাতে?’

আমার বুকে শিরশিরানি টের পাই। আমি জানালা দিয়ে বাঁ হাত বের করে দেই। ও কাঁপা কাঁপা হাতে আমার বাঁ হাতে ঘড়ি পরিয়ে দিয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘কি সুন্দর লাগছে তোর হাত।’

আমি মুচকি হাসলাম। ও ঘড়ি পরিয়ে দেয়ার পরও হাতটা ছাড়ছে না।

___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম