#প্রার্থনায়_রবে_তুমি
#পর্ব_২
#Saji_Afroz
বাড়িতে এসে সোজা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ইধা। পাঁচ তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর বেশ ক্লান্ত লাগছে। বাজার গুলো একপাশে রেখে ডাইনিং রুমে আসে ও। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে করে পান করে। এইবার যেন ক্লান্তিটা দূর হলো।
আবারও রান্নাঘরে আসে ইধা। বেশ গোছালো রান্নাঘর। আকারে বড়ো না হলেও, সব গুছিয়ে রাখার কারণে দেখতে ভালো লাগছে।
ও আশেপাশে তাকিয়ে চাল খুঁজতে শুরু করে। সহজেই চাল এর ড্রাম ও পেয়ে যায়। রাইস কুকারও চোখে পড়ে ওর। তাতে চাল নিয়ে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে; পরিমাণমতো পানি নিয়ে ভাত রান্নার জন্য বসিয়ে দেয় ও। এরপর ও পুরো ঘরটা ঘুরে দেখতে থাকে। এই বাসায় রান্নাঘর বাদে মোট চারটে রুম। ড্রয়িং, ডাইনিং, আর দুইটা বেডরুম। ড্রয়িংরুমে একটা ডিভাইন রাখা আছে। কোনো মেহমান এলে নিশ্চয় এটি কাজে লাগে। যেহেতু আর কোনো বিছানা এখানে নেই। এছাড়াও এক সেট সোফা ও ছোট্ট একটি টেবিল আছে। দেয়ালে রয়েছে মাঝারি সাইজের একটি টিভি। দেয়াল ঘড়িটা বেশ আকর্ষনীয়। রুমে কয়েকটা বড়ো ফুলের টব দেখা যাচ্ছে৷
ডাইনিং রুমে ফ্রিজ, শোকেস, ডাইনিং টেবিল ও পানির ফিল্টার ছাড়া কিছু নেই।
এইবার আসে ও মরিয়ম জান্নাতের রুমে। এসেই ও মুগ্ধ হয়। বিছানা, আলমারিসহ সচারাচর শোওয়ার ঘরে যেসব থাকে তা রয়েছে। তবে রুমের একপাশে তিনি ইবাদাতের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। একটা ছোট্ট বুকসেলফ ও ছোট আলনা দেখা যাচ্ছে। বুকসেলফ এ আছে ইসলামিক কিছু বই ও কয়েকটা কোরআন শরীফ। আলনাতে সম্ভবত তার নামাজের পোশাক, হিজাব রয়েছে। সাদা রঙ বলেই এমনটা ধারণা করেছে ও। আর রয়েছে কয়েকটা জায়নামাজ। ও পাশের দেওয়ালে আরবী লেখা থাকা কিছু পেইন্টিং রয়েছে। এসব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইধা। ও কিছুই ছুঁয়ে দেখে না। এভাবে না বলে অন্যের রুমে প্রবেশ করাটা কী ঠিক হলো? এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই বেরিয়ে পড়ে ও।
নিজের রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে। রুজাইনের কথা মনে পড়ে ওর। কী একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল! ছেলেদের প্রতি নেতিবাচক ধারণাটা একেবারে গেঁথে গেছে ওর মনে। তাই বলে সবাইকে এক ভাবে এটাও অনুচিত। রুজাইনের কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন ওর।
এদিকে নিজের রুমে বসে এখনো হেসে চলেছে রুজাইন। মেয়েটা বেশ ঘাবড়ে ছিল। ভেবেছিল রুজাইন ওর পিছু নিয়েছে। ওর এমন ব্যবহারের ব্যাপারটা রুজাইন বুঝেছে। তবুও গম্ভীরমুখে ছিল। সহজেই যদি কোনো ব্যাপার না ভাব ও করতো, তবে মেয়েটির মনে অনুশোচনা তৈরী করতো কিভাবে?
আচ্ছা! এখন কী তৈরী হয়েছে অনুশোচনা? আরেকটাবার সামনাসামনি না হলে বুঝবে কিভাবে? খুব দ্রুত যেন আবারও মুখোমুখি হয় দু’জনে।
মিলি স্কুল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে এল। মিলি ও নিজের জন্য খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এল ইধা। মাইশাকে ফোন করেছিল। ফুপুর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেছে ও। আসতে বিকেল হবে জানালো।
মিলি খাবার খেয়ে ইধাকে ধন্যবাদ জানালো। ইধা বলল, সব তোমার আম্মুই রান্না করেছে। আমি শুধু খাবার গরম করে এনেছি।
-তুমি না থাকলে আমি ঠান্ডা খাবার খেতাম। এইজন্য তোমাকে থ্যাংকস।
এই বলে রান্নাঘরে এসে নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে ফেললো মিলি। এরপর রুমে এসে শুয়ে পড়ে ও।
এতটুক বাচ্চা মেয়ের নিয়মাবলি দেখে অবাক হয় ইধা। বাসায় মা-বোন কেউ নেই। চাইলেই ও বসে টিভিতে কার্টুন দেখতে পারতো। এমনটা ও করেনি। শিক্ষিকার মেয়ে বলেই নিয়মে আবদ্ধ থাকে? জানা নেই ইধার। তবে মিলির জায়গায় ও থাকলে রিমোট নিয়েই বসে যেত। এই ভেবে হাসলো ও।
আজ দুপুরে আর ঘুম হয়নি ইধার। হয়তো গতকাল থেকে বেশি ঘুমিয়েছে বলে। শুয়ে বসে মোবাইল চালিয়ে কেটেছে দুপুরবেলা। বিকাল হতেই মিলির দেখা পায় ও। মিলি ওর পাশে এসে বলল, কখন উঠলে আপু?
-আমার ঘুম হয়নি।
-আমি আজান শুনে উঠলাম। সালাত আদায় করে এসেছি।
-এতটুক বয়সে নামাজ পড়তে পারো তুমি?
-পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আমি। বড়ো হয়েছি। তাছাড়া আরও আগে থেকেই শিখেছি।
-বাহ! বলো এখন কী খাবে?
-মাইশা আপু পথে আছে। বলল আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসছে। তোমার কষ্ট করতে হবে না।
-আচ্ছা। তবে তোমাকে কীভাবে জানালো?
-বাসায় একটা বাটন ফোন থাকে। ওটাতেই করেছে।
-ওহ!
-ছাদে যাবে?
-যাওয়া যায়।
ওরা ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাড়িটা সাত তলা। ওরা থাকে পাঁচ তলায়। এইজন্য ছাদে যেতে এত সময় লাগেনি।
ছাদে প্রবেশ করতেই পশ্চিম দিকের মিষ্টি আলো চোখে এসে লাগে ইধার। এক হাতে চোখটা ঢেকে নেয় ও।
মিলি হেসে বলল, এখনো রোদ আছে ছাদে।
ইধা হাত সরিয়ে রোদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মিলিকে নিয়ে ছাদের একপাশে আসে ও।
এই পাশে রয়েছে একটা ফুলের বাগান। অপরপাশে আছে সবজি বাগান।
ফুলের বাগানের পাশে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। মিলিকে নিয়ে সেখানে বসে ইধা।
মোবাইল বের করে একটি গান চালু করে ও। মিলি বলল, মাইশা আপুও এমন করে। তবে ও হেডফোনে বেশি শোনে। আমি এত করে বললেও এভাবে শোনে না। এভাবে শুনলে আমিও তো একটু শুনতে পারি বলো?
ইধা হেসে বলল, এখন থেকে এভাবেই শুনবে। আমি তোমায় শোনাব।
সময় অতিবাহিত হতে থাকে৷ গান গুলোও একের পর এক বদলাতে লাগলো।
হঠাৎ কারো আসার শব্দে পেছনে ফিরে তাকায় ইধা। রুজাইনকে দেখে গান বন্ধ করে দাঁড়ায় ও। রুজাইন ওকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ও চলে যেতে চাইলে ইধা থামায় ওকে। দ্রুত ওর পাশে এসে বলল, তখনের ঘটনার জন্য আমি দু:খিত।
রুজাইন গম্ভীরমুখেই বলল, বাড়িওয়ালার ছেলে জেনে এমন বলছেন তো?
-বিষয়টা ঠিক এমন না! আপনি যদি ভাড়াটিয়াও হতেন তবে আপনাকে দু:খিত জানাতে আসতাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি এই বাড়ির কেউ নন!
একটু থেমে রুজাইন বলল, ইটস ওকে।
-মন থেকে বলছেন?
-হু।
সূর্য ডোবার পথে। মিলি ছুটে এসে বলল, ইধা আপু? সন্ধ্যে নামবে! চলো বাসাই যাই?
-হু চলো।
মিলিকে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করে ইধা। ওর পথের দিকে চেয়ে রয়েছে রুজাইন। সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে ইধা। গা এর রঙের সাথে যেন মিশে গেছে তা। ছাদের বাতাসে চুল গুলো উড়ছিল ওর। রুজাইন আরও আগেই এসেছিল। দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ইধাকে। মোবাইলের গানের তালে সেও ঠোঁট মেলাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে গান গেয়েছে। ইচ্ছে করছিল ওর পাশে গিয়ে বসতে। ইচ্ছে হয়েছে, নিজের কাঁধে ইধার মাথা রেখে শুনতে ওর গান। ইধাকে দেখে হঠাৎ এসব অনুভূতির জন্ম নিলো কেন ওর মনে? তবে কী হুট করে ভালোবাসা ওর জীবনেও এসে পড়েছে!
ফুফুকে তার বাসায় রেখে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয় মাইশা। পথিমধ্যে ফুচকার দোকান দেখে থামলো ও। মিলির ফুচকা অনেক পছন্দের। ইধারও তাই। ও সবার জন্যে ফুচকা নেয়। আর মা এর জন্যে নেয় চটপটি। মরিয়ম জান্নাত চটপটি বেশি পছন্দ করে। এসব নিয়ে দোকানিকে টাকা দেওয়ার সময় বাধা দেয় আলিম। ওকে দেখে মাইশা বলল, কী হলো?
-তুমি যাও। টাকা আমি দেব।
অবাক হয়ে মাইশা বলল, কিন্তু কেন?
-ট্রিট মনে করো। আর কিছু নেবে?
-কিসের ট্রিট?
-তোমার বান্ধবী বাড়ি এসেছে, সেই উপলক্ষে।
ভ্রু কুচকে মাইশা বলল, তাতে আপনি কেন ট্রিট দেবেন?
-ভুল বুঝলো মেয়েটা আমায়। বলতে পারো মান ভাঙাছি।
-তাই বলুন! কিন্তু আমাকে কখনো ট্রিট দেননি, আমার বান্ধবীকে দিচ্ছেন। ঘটনা অন্যকিছু নয় তো!
-তুমি কী আমায় কখনো ভুল বুঝেছ নাকি! তাছাড়া নতুন মানুষ আমায় নিয়ে খারাপ ধারণা রাখুক চাইনা, এই আরকি!
-বেশ তবে!
মাইশা খাবার নিয়ে মুদি দোকানে আসে। বাকি বাজার গুলো নিয়ে বাড়ি আসে ও৷ মিলি ওর ফুচকা দেখে অনেক খুশি হয়। সাথে খুশি হয় ইধাও। তবে আলিম ওর জন্যে এসব পাঠিয়েছে জেনে বলল, উনি দিলো আর তুই নিয়ে নিলি?
-এলাকার ভাই হয়। বুঝিস তো তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তবে তুই দূরেই থাকিস তার থেকে। ওত সুবিধার না ছেলেটা।
-সেই আমি দেখেই বুঝেছি।
খাওয়া শেষে নামাজ সেরে পড়তে বসে মিলি। আগামীকাল ইধা ও মাইশা প্রথম কলেজে যাবে। এই নিয়ে দু’জনে কথাবার্তা বলছিল। কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে মাইশা। মরিয়ম জান্নাত তাড়াহুড়ো করে প্রবেশ করে বললেন, আজ জ্যামে আঁটকে দেরী হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি নামাজ সেরে আসি।
উনি নামাজ সেরে আসলে চটপটি নিয়ে হাজির হয় মাইশা। তিনি বললেন, আবারও এসব বাইরের খাবার এনেছ? ইচ্ছে হলে বাসায় বানিয়ে খেতে!
-লতিফ ভাইয়ার দোকানের মতো হয় না আমি বানালে।
ইধাও আছে পাশে। ও বলল, আমি বানিয়ে খাওয়াব একদিন। দেখিস তো আমার রান্না ভালো লাগে কিনা!
-পারিস?
-হু। টুকটাক সব রান্না পারি আমি।
মরিয়ম জান্নাত বললেন, মাইশাকে কিছু শেখাও। কয়েকটা ছাড়া কিছুই পারে না। করতেও চায় না। আমাকেই রান্না করে যেতে হয়।
-এখন থেকে আমি আপনাকে হেল্প করব আন্টি।
-শুনে অনেক ভালো লাগলো। তবে সবসময় প্রয়োজন নেই। পড়াশোনায় ফোকাস করো। ছুটির দিনে আর আমি ব্যস্ত থাকলে রান্না করলে চলবে। আর মাইশাকে মাঝেমধ্যে শেখানোর জন্য করবে।
-আচ্ছা।
-শুধু রান্না নয়, নামাজও ঠিকমতো আদায় করতে বলো। ফজরের নামাজ কবে আদায় করেছে সেও জানে কি-না সন্দেহ। তুমি আদায় করো তো ঠিক মতো?
এই প্রশ্ন শুনে মলীন হয়ে যায় ইধার মুখ। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না ও।
মাইশা ওর অবস্থা বুঝে বলল, হ্যাঁ ও করে৷ আজও করেছে।
-মাশাআল্লাহ! শেখো তুমি ওর কাছে কিছু।
ইধা আর কোনো কথা না বলে ফিরে আসে নিজের রুমে। কয়েকটা লম্বা নি:শ্বাস ফেলে ও।
যা হচ্ছে তা কী ঠিক হচ্ছে! এই ভাবনা মনে আসতে আরও একবার অস্থির হয়ে উঠলো ও।
.
চলবে