চিত্তে অঙ্কিত কৃষ্ণরেখা পর্ব-৪+৫

0
890

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|০৪|
#ফাহমিদা_নূর

অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে মাত্রই নিজের কেবিনে এসেছে শাদাত।কেবিনে পাতানো চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে হুহ শব্দ চারণ করে প্রলম্বিত শ্বাস ত্যাগ করে।চেহারার ভাবমূর্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতোটা ক্লান্ত। ইতোপূর্বে গাত্র জড়ানো সবুজ পোশাক ছেড়ে পরিধান করেছে সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট।

-“ আসবো?

কপালের ভ্রু লেখার উপরে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে স্লাইড করছিল শাদাত। পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে কপাল থেকে হাত সরিয়ে দ্বারের অভিমুখে লক্ষ্য করে। চোখ মুখ শক্ত করে গম্ভীর স্বরে বলে-“ আয়!

ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসে শ্রেয়াণ।দু’ভাইয়ের মধ্যে নিরবতা চলে ক্ষণকাল। অতঃপর মুখ খুললো শাদাত-“ ব্যস্ততার কারণে কয়েক দিন বাসায় যেতে পারিনি।এরই মাঝে এটা কি ঘটিয়েছিস তুই?প্রথা কে দুঃখ দিয়েছিস?তোর কাছ থেকে তো এটা আশা করিনি!

মৌন রইলো শ্রেয়াণ।নিচ উষ্ঠ কামড়ে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কাঁচের টেবিলের উপর চকচক করা মুক্তর পাথরের ন্যায় ত্রিকোণ শো-পিসে’র দিকে। শান্ত গলায় বলল-“ ইমার্জেন্সি লন্ডন যাচ্ছি বাবাকে ফিরিয়ে আনতে।পরশু দিন ফ্লাইট ।বাড়ির দিকে খেয়াল রেখো!

কথা শেষে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়াণ।পা বাড়ায় দ্বারের দিকে। তারপর বেরিয়ে গেলো কেবিন ছেড়ে।পুরোটা সময় ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করে গেলো শাদাত। পুনরায় দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে হেলান দেয় চেয়ারে।শাদাত শ্রেয়াণ একই বাড়িতে থাকলেও তারা একি মায়ের সন্তান নয়। শাহিন জাওয়ানের বড়ো ভ্রাতা ওমর ফারুকের একমাত্র ছেলে শাহাদ। একদিন শখের বশে ওমর তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন । পথিমধ্যে রোড় এ্যাক্সিডেন্টে স্বামী স্ত্রী দুজন স্পট ড্যাথ হলেও পাঁচ বছরের শাদাত ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরে।সে দিন থেকে সায়লা তাকে নিজের সন্তানের মতোই লালন পালন করেছেন এবং তার বড়ো জা য়ের স্বপ্নপূরণ করতে তাকে ডাক্তারও বানিয়েছেন।

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে দিকবিদিক পলক না ফেলে কারে চড়ে বসে শ্রেয়াণ।আগে থেকেই ড্রাইভিং সিটে আফিফ বসা ছিল।বস কে বসতে দেখে গাড়ি স্ট্যার্ট দেয় সে।স্ট্রেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলে-“ গাড়ি কোন পথে নিয়ে যাবো স্যার?

-“ অফিসের দিকে।

ফট করে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রেয়াণের মুখ দর্শনের প্রয়াস চালায় আফিফ-“বাসায় ফিরবেন না?

-“ বাবা কে নিয়েই একেবারে ফিরবো।

আফিফ কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে শ্রেয়াণ বলে-“ মন মেজাজ ভালো নেই আফিফ।আর কোন প্রশ্ন নয়। চুপচাপ গাড়ি চালাও।

-“ ইয়েস বস!

কেটে যায় পাঁচ দিন।বাবাকে ফিরিয়ে আনার তাগিদে পরিবার কে দেখা না দিয়েই লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছে শ্রেয়াণ।তার ভাবনা শাহিন জাওয়ানের মুখনিঃসৃত বাণী দিয়েই তার সম্পর্কে প্রথার ভুল ধারণা চিরতরে মিটিয়ে নেবে।শ্রেয়াণ যে দেশে নেই সেটা যাওয়ার পরে দিনই খবর পেয়েছে প্রথা। বর্তমানে চোধুরী বাড়ির লিভিং রুমে বসে আছে প্রথা।তার সামনে প্রতাপ চৌধুরী এবং তার পার্শ্ববর্তী সোফায় সায়লা খানম। থমথমে পরিবেশ সকলের কন্ঠে নিরবতা।

-“ সিদ্ধান্তটা ভেবে চিন্তে নিচ্ছো তো মামনি?তুমি আমার একমাত্র সন্তান।তোমার কিছু হলে আমি কি নিয়ে__

-“ বাবা! কিচ্ছু হবে না আমার? তোমার মেয়ে যেমন দুর্বল চিত্তের তেমনি পরিস্থিতি সাপেক্ষে কঠোরও হতে পারে এটা নিশ্চই জানো?
আমি সব মেনে নেবো কিন্তু বিশ্বাস ঘাতক , চরিত্র হীনতা বরদাস্ত করবো না!

শেষের কথা মুখ দিয়ে বের করতেও তার চোখে মুখে শ্রেয়াণের প্রতি একধরণের ধীক্ষার,ঘৃণা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল। সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলল প্রতাপ চৌধুরী।সায়লা খানম ও নিরুপায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রথার দিকে। হানিফা বেগম নাতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন -“ আরেক বার ভেবে দেখলে হয়না দাদুভাই?তোমাকে দূরে রেখে আমরা কিভাবে থাকবো?

প্রথা তার দাদির দিকে হতাশ চোখে তাকায়। তাদের পাশে কিঞ্চিৎ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা চম্পাও তাল মিলিয়ে বলে-” দাদি ঠিক কইতাছে আপা। আপনে দূরে চইলা গেলে কারোরই ভালা লাগবো না?

তার উদ্দেশ্যে চোখ তুলে তাকায় প্রথা। হেঁয়ালি স্বরে বলে-“ এমনিতেও কি তোদের কাছে থাকি?

-“ তা অবশ্য থাহেন না। কিন্তু আবার দূরেও তো থাহেন না।শেয়াণ ভাইদের বাসায় থাকলে মনে হইতো আপনে আমাদের কাছাকাছিই আছেন কিন্তু এহন তো আপনে মাইল কে মা-ইল দূরে বিদ্যে-শে যাইতে চাইতাছেন?

শ্রেয়াণের নামটা শুনেই দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে নেয় প্রথা।এই কয়দিনে তার কাছে শ্রেয়াণের নামটাও যেনো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। চম্পার বিদ্যে-শে বলার ভঙ্গি দেখে সবাই হাসতে চেয়েও প্রথার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে একে অপরের দিকে তাকায়। পরমুহূর্তে তার কারণ বুঝতে পেরে সায়লা খানমের পূর্বের মন খারাপিটা আরো গভীরতর হয়।যতই হোক মায়ের মন তো?ছেলের জন্য প্রথার চোখে এতোটা ঘৃণা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। আবার শ্রেয়াণের ব্যবহারের কথা মনে পড়লে প্রথা যা করছে তাই ঠিক বলে মনে হয়!মনে মনে যা চলছে চলতে থাকুক বলে বুক ভর্তি শ্বাস টেনে নিজেকে সামাল দেয় সায়লা।প্রথা কে তাড়া দিয়ে বলে-“ ঠিক আছে তুমি যা চাইছো তাই হবে।এখন চলো ফিরে যায়?

-“ আমি আর ও বাড়িতে ফিরবো না মা?
তড়িৎ জবাব করে প্রথা।অবাক হয় সায়লা, তেমন কন্ঠেই বলে-“ ফিরবে না মানে?

পুরোনো ক্ষতটা যেনো আবারো তাজা দিয়ে উঠলো প্রথার।আঁখি পল্লবে জমাটবদ্ধ হয় অশ্রু বিন্দু।ছলছল চোখে ক্লান্ত,কোমল গলায় বলে -“ আমার বলতে কোন দ্বিধা নেই যে আমি শ্রেয়াণ কে এখনো ভালোবাসি। আমার হৃদয়ে যে শ্রেয়াণ আছে তাকে। কিন্তু আপনার ছেলে শ্রেয়াণ কে আমি ঘৃণা করি।খুব খুব খুব বেশী।তার ঘর বাড়ি ,তার ছোঁয়া লাগা জিনিস সবকিছু ই ঘৃণা করি __

-“ তাহলে তার মা কেও নিশ্চই ঘৃণা করো?

অসহায় চোখে চেয়ে সায়লার দিকে আলগোছে এগিয়ে যায় প্রথা।তার গা ঘেঁষে বসে এক হাতে জড়িয়ে বলে-“ মা কে কী ঘৃণা করা যায়?
জন্মদাত্রী মাকে দেখার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি আমার!মায়ের স্নেহ কেমন তাও জানতাম কিন্তু আপনি আমায় উপলব্ধি করিয়েছেন মায়ের আদর মমতা কেমন হয়। আপনাকে কি করে ঘৃণা করি?

একটু থেমে আবারো বলে-“ যখন আশপাশে কারো মুখে মুখে শুনতাম শাশুড়িরা জল্লাদের মতো ভয়ঙ্কর হয়।তারা ছেলের বৌ দেয় অত্য!চার , নির্যা!তন করে!তখন আফসোস হতো না জানি আমার শাশুড়ি কেমন হয়? কিন্তু এখন নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হয় আপনার মতো মা কে পেয়ে।আমি আপনাদের হারাতে চাইনা কিন্তু __

কান্না আটকাতে ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে উঠে প্রথা।সায়লা মৃদু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে-“ তাহলে মায়ের আদেশ মেনে বাসায় ফিরে চলো।পরের টা পরে দেখা যাবে!

চোখের অশ্রু মুছে নিজেকে সংযত করলো প্রথা।না করতে চেয়েও কিছু একটা ভেবে যাবে বলে সম্মতি দেয়।
_

সময় যেনো খুব দ্রুতই কে-টে যায়।তার সাথে কমে আসে মানব দেহের প্রাণবায়ু। কে’টে গেছে প্রায় পনেরো দিন।শ্রেয়াণ যেদিন লন্ডনে পা রেখেছিল সেদিন এয়ার পোর্টের বাইরে হোইল চেয়ারে বসা শাহিন জাওয়ানের দেখা পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার আশেপাশে কাউকে দেখতে পায়নি। শাহিন জাওয়ানের অবস্থা ছিল শোচনীয়।মুখ দিয়ে র!ক্ত ঝরছিল টুপটাপ। অচেতন অবস্থায় মাথা হেলিয়ে ছিল একপাশে।ঘাড়ে হাতে রক্তের ছুপছুপ কালসিটে দাগ।তার এই করুন পরিণতি দেখে প্রথমে তাকে সেখানে একটি হসপিটালে এ্যাডমিট করে শ্রেয়াণ।তার সুস্থ হতে লেগেছে প্রায় দশদিন মতো।
_
আজ শ্রেয়ার মন ভালো নেই। অবশ্য এই কয় দিনেও তেমন ভালো ছিল না কিন্তু আজ বিগত দিনের তুলনায় মনটা একটু বেশী ই খারাপ।বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে।মনে হচ্ছে আশপাশে মূল্যবান কিছু একটা নেই।গালে হাত দিয়ে অদৃশ্যে তাকিয়ে ছিল সে।হুট করে শুনতে পায় কলিং বেলের ডাক।অলস ভঙ্গিমায় ছোট ছোট চোখে এধার ওধার পলক ঝেড়ে কেউ দ্বোর খুলতে যাচ্ছে কিনা অবলোকন করে। কিন্তু কাউকে যেতে না দেখে অগত্যা নিজেই উঠে দরজা খুলে দিতে যায়।কপাট খুলেই সামনের জনকে দেখে তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠলো শ্রেয়া-“ বাবা একি অবস্থা হয়েছে তোমার?

#চলবে ইনশা-আল্লাহ!

#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|০৫|
#ফাহমিদা_নূর

কপালের কোণে,ঠোঁটে হাতে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে শ্রেয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাহিন।বাবার এই অবস্থা দেখে চুপ থাকতে পারে না শ্রেয়া। অধৈর্য গলায় ফিরতি প্রশ্ন করে-“ তোমার কি হয়েছে বলো না বাবা?এই অবস্থা হয়েছে কিভাবে?

মেয়ের চোখে কৌতুহল আর শঙ্কিত মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসল শাহিন,বলল-“ বলছি আগে ভেতরে চলো?
-“হু এস_
বলতে বলতে সামনে তাকিয়ে থেমে যায় মেয়েটা।শাহিনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে শ্রেয়াণ।তার চোখে মুখে প্রফুল্লতা ছড়াচ্ছে অজানা উত্তেজনায়।
হাসার চেষ্টা করলো শ্রেয়া, ইশারায় ভেতরে আসতে বললো দুজন কে।তারা ভেতরে প্রবেশ কালে আফিফও আসে পিছু পিছু দুটো লাগেজ হাতে। এয়ার পোর্টে সেই গিয়েছিল বাবা-ছেলেকে রিসিভড করতে।

-“ প্রথা মা কোথায়?তাকে দেখছি না যে?
অবাক ই হয় শ্রেয়া।এমনিতেই বাবা ভাই দুজন কে একসাথে ফিরতে দেখে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল মাথায়। তারউপর ঢুকতে না ঢুকতেই প্রথার কথা জানতে চাইছে বাবা?শাহিন জাওয়ান তখনো জবাবের আশায় তার দিকে তাকিয়ে।আড়চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায় শ্রেয়া।সেও একি কৌতুহলে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

-“ জানি না আমি!
কোমল গলায় বলা কথাটা যেনো বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তড়িৎ বলে উঠে শ্রেয়াণ -“ জানিস না মানে?ও তো কালও এবাড়িতেই ছিল।

-“ ছিলো!এখন নেই!

-“ নেই মানে কী?কোথায় গেছে?
শাহিন শুধালো। বিস্মিত চোখে তার দিকে চাইলো শ্রেয়া -“ক্লান্ত মুখশ্রী, শরীরে আঘাতের চিহ্ন অথচ সেসব আমলে না নিয়ে সবাই প্রথার কথা জানতে চাইছে?কেন?“নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে শ্রেয়া।
শ্রেয়া’র গা ছাড়া ভাব দেখে ধৈর্য্য ধারণ করতে পারে না শ্রেয়াণ। উঠে দাঁড়ায় নিজস্ব ভঙিমায়। দ্রুত কদমে পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। পেছন থেকে তার যাওয়ার পানে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রয় শাহিন, শ্রেয়া।

সর্ব প্রথম প্রথার ঘরে ঢুকে শ্রেয়াণ।রুম ,ব্যালকনিতে বাথরুমের উম্মাদের মতো অনুসন্ধান করে প্রথাকে খুঁজে পেতে ব্যার্থ হয়। বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠে তার অজানা শঙ্কায়।বড়ো বড়ো শ্বাস টেনে ক্ষণকাল স্থির দাঁড়িয়ে থেকে অগোছালো কদমে দৌড়ে যায় তাদের বেডরুমে।রুমটা তখনো অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল‌।শ্রেয়াণ কালবিলম্ব না ঘরে ঘরের সব লাইট জ্বালিয়ে দেয়। শুভ্র আলোয় আলোয় ভরে উঠে কক্ষটা।সম্পূর্ণ রুমে নজর বুলিয়ে বাথরুম, ব্যালকনিতে খুঁজে দেখে কিন্তু কোথাও দেখা মেলে না প্রথার।অপারগ হয়ে ব্যালকনি থেকে ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে শ্রেয়াণ। বেডে বসে দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে জোরে জোরে শ্বাস ত্যাগ করে ফের মাথা তুলে সামনে থাকায়। পুণরায় এদিক ওদিক দেখতে গিয়ে হঠাৎ আঁখি স্থির হয়ে যায়। অজানা শঙ্কারা গ্রাস করতে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে।সটান দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের অভিমুখে।আয়নায় লাল রঙে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা-“হারিয়ে বুঝবে কী ছিলা“
হৃদযন্ত্র টা ধ্বক করে উঠলো শ্রেয়াণের। আলগোছে হাত বুলিয়ে দেয় আয়নায়। লেখাগুলো থেকে রঙ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ে শুকিয়ে গেছে।একটু লক্ষ্য করেই দেখলো এটা কোন লাল রঙ নয় বরং রক্ত।আয়নার সামনে থাকা নীল ফাইল টার দিকে চোখে পড়তেই থমকে যায়।এই সেই ফাইল যেটা সেদিন অফিসে প্রথার হাতে দেখেছিল।তার মনের ভেতর এক অজানা শঙ্কা যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কৌতূহল চেপে ধরে ফাইলটি হাতে তুলে নেয়। পাতা খুলতেই স্তব্ধ হয়ে যায় শ্রেয়াণ। অনুভব করছে হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে চলেছে হুরহুর গতিতে।চোখের সামনে পেপার্সের লেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে আসে। পেশেন্টের নাম প্রথা। প্রেগন্যান্সি দুমাস চলমান। মনের মধ্যে এক প্রবল গর্জন দিয়ে উঠে তার—”আ আমি বাবা হবো?টের পাচ্ছে গলা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে তার। হাত কাঁপতে থাকে থির থির, ভেতরে যেন এক অশান্ত ঝড় শুরু হয়েছে।সে একদৃষ্টিতে লেখাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। একটা অনাবিল আনন্দ মনের গভীরে জন্ম নিতে চাইছে। যার বহিঃপ্রকাশে ঠোঁটের কোণে খেলে যায় আনন্দ মিশ্রিত এক প্রাপ্তির হাসি।বাবা হওয়ার কথাটা যেনো তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ ই মনের কোণে বেদনার এক অমোঘ স্রোত বয়ে যায়, অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে -“ প্রথা!প্রথা কই?
ফাইল হাতে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় কক্ষ ছেড়ে।হাক ছেড়ে ডাকে-“ প্রথা!প্রথা প্লিজ সামনে এসো।

নিচ থেকে সবাই তার গতিবিধি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেও শাহিন জাওয়ানের মুখে শঙ্কার ছাপ। ধূর্ত পায়ে উপর তলার প্রতিটি কক্ষ পর্যবেক্ষণ করে নিচে নেমে আসে শ্রেয়াণ।প্রথার দেখা না পেয়ে এই কয়েক মিনিটে তার চেহারা হয়েছে অনুভূতিশূন্য। চোখে ভার করেছে হারানোর ভয়।
-” মা! আমার প্রথা কোথায়?কেউ কিছু বলছো না কেন?

এক প্রকার হুংকার দিয়ে উঠে শ্রেয়াণ। ততক্ষণে সেখানে সবাই উপস্থিত হয়।সায়লা খানম একবার শাহিন জাওয়ানের দিকে তাকিয়ে পর পরই শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে বলে-“ প্রথা কে দিয়ে তোমার কী কাজ? সেদিন না ওকে যা নয় তা বলে অপমান করেছিলে?তাকে এখন আর ভালো লাগেনা বলে অন্য নারীর _

তাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে দেয়না শাহিন।থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলে উঠে-“ ও নিজ থেকে প্রথার সাথে এমন আচরণ করেনি।হয়তো কারো হুমকিতে বাধ্য হয়ে করেছিল!

-“ মানে?
স্ত্রীর প্রশ্নের জবাব দেয় শাহিন -“আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু একদিন পর রাতের আঁধারে আমার ফ্ল্যাটে এসে কারা যেনো আমাকে অজ্ঞান করে নিয়ে যায়।পরে জানতে পারি আমার পূর্ব শত্রু ফায়াজ খানের ছেলেই এটা করেছে।তার সাথে শ্রেয়াণের কী দ্বন্দ্ব আমি জানি না, সে চায় শ্রেয়াণের কাছ থেকে তার ভালোবাসার মানুষগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে সর্বশান্ত করতে।তাই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েই___

-“ আমি এসব জানতে চাইনি আমি শুধু জানতে চা য় আমার প্রথা কোথায়?তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

আবারো হুংকার ছাড়ে শ্রেয়াণ।এই পর্যায়ে শ্রেয়া ভয়ে গুটিয়ে যায়। আহত চোখে তাকায় মায়ের দিকে।শাহিনের কথা শুনে তারা বুঝে গেছে এই কয়দিন যা হয়েছে সব ভুল বোঝাবুঝি।সায়লা খানম নিজেও অপরাধবোধে হাঁসফাঁস করতে থাকে, অপরাধি গলায় নিভে আশা কণ্ঠে থেমে থেমে বলে-“ প্রথা এখানে নেই।এমন কি এই দেশেও?

-“ কিহ!
তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কঠোর গলায় বলল শ্রেয়াণ।শ্রেয়া সবার দিকে একপলক নজর বুলিয়ে বলে-“ বৌ মণি আজ ভোর ০৬:০০ টার ফ্লাইটে নিউইয়র্ক ল্যান্ড করেছে।

মুহূর্তেই যেন শান্ত হয়ে গেল পরিবেশ। স্তব্ধ হয়ে গেল উপস্থিত সকলে।শ্রেয়া ছলছল চোখে গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে আছে। রক্তঝড়া চক্ষু নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে শ্রেয়াণ।বাহুতে টান দিয়ে ফের বলে -” কি বললি তুই?

ভাইয়ের এই রূপে শ্রেয়া ভয়ে চোখ খিচে নেয়।

-” শ্রেয়া সত্যি বলছে শ্রেয়াণ!প্রথা তোমাকে শাস্তি স্বরুপ এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে!

মায়ের দিকে এগিয়ে যায় সে। বাঁ হাতে ফাইল চেপে ডান হাতে কপালের চুল পিছে ঠেলে দেয়। কণ্ঠনালী যেনো কেউ চেপে ধরেছে তার।কি বলা উচিৎ কি করা উচিৎ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।সায়লার সামনে গিয়ে আঙ্গুল তুলে কান্না মিশ্রিত গলায় বলে-“ কেউ না জানুক তুমি তো জানতে ও আমার প্রাণ ছিল মা?তোমার ভরসায় ওকে রেখে গিয়েছিলাম আমি !তুমি তাকে আগলে রাখতে পারোনি মা?আমি এখন কী করবো? কোথায় খুঁজবো তাকে?

আঁচলে মুখ গুঁজে চোখের পানি মুছে ধরে আসা গলায় সায়লা বলে-“ আমিও তোমায় অবিশ্বাস করেছিলাম তাই তার চাওয়ায় না করতে পারিনি__

হাতের ফাইল সামনে তুলে ধরে শ্রেয়াণ-” তুমি নিশ্চই জানতে ওর প্রেগন্যান্সি ব্যাপারে? সেদিন এটাই নিশ্চই বলতে চেয়েছিলে?

নিরবে আশ্রু বিসর্জন দেয় সায়লা।এই মুহূর্তে বড্ডো আফসোস হচ্ছে নিজের কাজে।কেনো প্রথা কে ওভাবে যেতে দিলো ভেবে।শ্রেয়াণ চেঁচিয়ে উঠে-” ওর কতো বড়ো সাহস এমন কঠিন সিদ্ধান্ত একা একা নিয়েছে? আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কেন করলো না?ও আমার বাচ্চা কে নিয়ে যাওয়ার হিম্মত কিভাবে পেলো? চোখের সামনে পেলে আমি ওকে খু্!ন করে ফেলবো!

একটু থেমে আবারো বলে-“ আমি!আমি এয়ার পোর্ট যাবো ওকে ফিরিয়ে আনতে!
আনমনে বলে দরজার দিকে দু কদম বাড়ায়।শুনতে পায় সায়লার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠ -“ ও ভোর ছয়টার ফ্লাইটে চলে গেছে। এতোক্ষণে হয়তো গন্তব্যে পৌঁছেও গেছে!

তড়িঘড়ি করে হাতের ঘড়ি দেখে শ্রেয়াণ। বিকেল চারটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট এখন। হাতের ফাইল পাশে ফেলে নিজ চুল খামচে ধরে। আকষ্মিক শক-য়ে মাথা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। পেছনে ফিরে এসে আফিফের সামনে দাঁড়ায়।কথা ব্যয় না করে তার হাত থেকে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নিয়ে আবারো কদম রাখে দরজার দিকে-“ স্যার এখন গেলেও ম্যামের দেখা পাবেন না!
আহত স্বরে শ্রেয়াণের পিছু ছুটতে ছুটতে আফিফ বলে।থেমে গেল শ্রেয়াণ,ফট করে তার দিকে তাকায়। দুহাতে কলার আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে-“ তোকে বলেছিলাম না এদিকে নজর রাখতে।কি করেছিস তুই,আমাকে একবারো জানাস নি কেন প্রথা চলে যাচ্ছে আমাকে ছেড়ে?

-“ আমি নজর রেখেছিলাম স্যার কিন্তু কুনাক্ষরেও টের পায়নি ম্যাম এভাবে চলে যাবে।

কলার ছেড়ে দেয় শ্রেয়াণ। অধৈর্য ভঙ্গিতে লম্বা লম্বা কদম ফেলে গাড়িতে চড়ে বসে।আফিফ যেতে নিলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মাটিতে।

পুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করছে শ্রেয়াণ। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে চলছে গাড়িটি।ক্ষণকাল পূর্বে কিঞ্চিতের জন্য এ্যাক্সিডেন্ট করেনি গাড়ি কিন্তু তাতেও সতর্ক হয়নি শ্রেয়াণ।তার মস্তিষ্কে একটি মাত্র কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, যেভাবেই হোক তাকে এয়ার পোর্টে পৌঁছাতে হবে।সে আদৌ জানে না প্রথা কে পাবে কিনা শুধু এটুকু জানে শেষ বার প্রথা যে জায়গায় ছিল ঔ জায়গাটা সে দেখবে।ঔ জায়গায় প্রথার সাথে তাদের অনাগত সন্তানের অবস্থান ও ছিল।একটা নিষ্পাপ ছোট প্রাণ! সেখানে নিজে দাঁড়াবে। ছুঁয়ে দিবে একটুখানি।ভাবতেই চোখের কোণে জমা জল গড়িয়ে পড়লো তার।এই মুহূর্তে সে একসঙ্গে পিতা হওয়ার গর্ব আর প্রিয়জন হারানোর শূন্যতার গভীরতায় ডুবে যাচ্ছে সে।

#চলবে__