#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|০৮|
#ফাহমিদা_নূর
বিশাল বড়ো অফিস কক্ষে মুখ গুঁজা করে দাঁড়িয়ে আছে নেহমাত।তার হাত আঁকড়ে রয়েছে রাউনাফ। মুখোমুখি আসফি আর রাইসা দাঁড়ানো।একে অপরকে ক্রুদ্ধ নজর নিক্ষেপ করছে অনবরত।খানিক দূরে ফিহা কে নিয়ে আছে শ্রেয়া।নেহমাত রাউনাফের হাত টেনে তাকে খানিকটা ঝুঁকিয়ে কানে কানে নিরপরাধ সুরে বলে-“ ট্রাস্ট মি আঙ্কাল,আমি ওই পঁচা মেয়েটা টাচ্ ই করিনি।আমাকে ধাক্কা দিয়ে এসে সে নিজেই পড়ে গিয়েছিলো!তুমি আমায় ট্রাস্ট করো না?
হাসার চেষ্টা করলো রাউনাফ,বলল-“ হ্যাঁ, আমার প্রিন্সেস কে চোখ বন্ধ করে ট্রাস্ট করি তো! একদম হাঁড়ে হাঁড়ে ট্রাস্ট করি!
-“ থ্যাঙ্কস!
-” ওয়্যালকাম!
দুজনের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন শেষে সিধে হয়ে দাঁড়ায় রাউনাফ।নজর নিক্ষেপ করে প্রিন্সিপালের দিকে। চশমার আড়ালে তিনি গভীর দৃষ্টিতে কক্ষে উপস্থিত সবাইকে দেখে যাচ্ছেন প্রথম থেকেই। পানির গ্লাসে চুমুক শেষে দুহাত টেবিলে রেখে এবার মুখ খুললেন প্রিন্সিপাল সুনয়না মেহজাবিন -” সবার বক্তব্য শুনলাম! এখন মিমাংস হচ্ছে তোমরা একে অপরকে স্যরি বলবে এবং দুজনে ফ্রেন্ডশিপ করবে।
বাঁধ সাধলো নেহমাত,বলে উঠলো-“ আমি কোন দোষ করিনি,স্যরি বলবো কেন ম্যাম?
তার সাথে সায় দেয় আসফি -“ আমিও দোষ করিনি তাই আমিও স্যরি বলবো না!
অভিভাবকের উদ্দেশ্যে তাকালেন প্রিন্সিপাল। বিচক্ষণ রাউনাফ বুঝে গেলো তার চাহনি। পূর্বের ন্যায় ঝুঁকে নেহভানের মুখোমুখি হয়ে বিনয়ী গলায় বলে-“ লক্ষি সোনা! সামান্য স্যরি ই তো? বলে দাও প্লিজ। ম্যামের কথা শুনতে হয়!
অপর দিকে আসফিকেও তার মা বুঝিয়ে রাজি করায় স্যরি বলতে। দুজন একে অপরের দিকে টেরা চোখে তাকিয়ে দুদিকে মুখ বাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।বুকে দুহাত বেঁধে একি সুরে বলে -” স্যরি!
-” এভাবে বললে হবে না। মুখোমুখি হয়ে বলো!
সেকেন্ড দুয়েক অনড় থেকে পিছনে ঘুরে নেহমাত।আসফির উদ্দেশ্যে মুখের ভেতর গুগগুনিয়ে বলে-” স্যরি এক্সেপ্ট করে নাও!
ক্ষণকাল নিরবতা পর আসফি স্যরি এক্সেপ্ট করে নেয়।অতঃপর দুজনের ঝগড়া মিমাংসা করে প্রিন্সিপালের সাথে প্লে ক্লাস রুমের দিকে যায় নেহমাত।তার সাথে রাউনাফও যায়।
–
-” আঙ্কাল?মাম্মি আসে নি কেনো?
রাউনাফের গলা জড়িয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো নেহমাত।
-” মাম্মি আস্লে তোমার খবর করে ছাড়তো তাই আমিই আসতে দেইনি!ভালো করেছি না?
-” হান্ড্রেড পার্সেন্ট!
দাঁত কেলিয়ে তড়িৎ বলল নেহমাত।বিনিময়ে তার একগাল টেনে আদর করে দিলো রাউনাফ।কথা বলতে বলতে প্রিন্সপালের পিছু পিছু নেহমাতের ক্লাসের সামনে এসে পৌঁছায় তারা।রাউনাফ তাকে কোল থেকে নামিয়ে ফ্লোরে দাঁড় করিয়ে দেয়। এরপর এক হাত আঁকড়ে ক্লাসে প্রবেশ করে।
-” এ্যাঁটেনশন এভরিওয়ান!গেট ট্যু মিট ইউর নিউ ফ্রেন্ড নেহমাত।গাইজ স্যে হাই?
প্রিন্সিপালের কথানুযায়ী ক্লাসের সবাই সমস্বরে হাই বলে।বিনিময়ে নেহমাত নিজের ডান হাত বিচিয়ে বলে হ্যালো।
-” নেহমাত। এখন তুমি নিজের সিটে গিয়ে বসো!
-” ইয়াহ ম্যাম!
–
কেটেছে আরো তিনদিন।
বর্তমানে মিটিং রুমে বোর্ড অফ ডিরেক্টর দের সাথে বিদেশি কোম্পানির সেই সিইও এর জন্য অপেক্ষা করছে শ্রেয়াণ। কাঙ্ক্ষিত মানুষটি কিছুক্ষণ পর উপস্থিতি জানান দিলো গলা খাঁকারি দিয়ে কিন্তু চোখ তুলে না তাকিয়ে আপনমনে নিজের বরাদ্দকৃত চেয়ারে আসন পেতে বসল।নিচে ঝুঁকেছিল শ্রেয়াণ,মাথা তুলে আগন্তুকের উপর দৃষ্টি পড়তেই সাহসা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে বাকহারা নয়নে কেবল তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ,অতঃপর অস্ফুট স্বরে অজান্তেই বলে উঠলো-” প্রথা!
প্রথা তখনো সামনে তাকায়নি। দুহাতে পরিধানের সাদা শার্টের উপরের কালো লেডিস কোটের কলার ঠিক করে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। পেছন থেকে তার সহকারী আদওয়া একটি ফাইল এগিয়ে দিলে প্রথা তা হাত বাড়িয়ে নিজের আয়ত্তে এনে চোখের সামনের টেবিলে রাখে। এরপর সামনে তাকিয়ে সে নিজেও শ্রেয়াণের মতো অবাক লোচনে চেয়ে রয় শ্রেয়াণের দিকে।তার কল্পনাতীত ছিল যে চোখ তুললেই পাঁচ বছর আগে যেই চেহারায় মায়া ত্যাগ করেছিল তাকে আবারও দেখতে পাবে,তাও এমন পরিস্থিতিতে।
অপলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয় দুজন।কতো দিন,কতো মাস,কতো বছর পর আজ দুজন মুখোমুখি? হঠাৎ ই চোখ সরিয়ে নেয় প্রথা । চোখের মণি দ্বয় ক্রমাগত এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কালো সানগ্লাস টা চোখে পুরে দেয়।আফিফ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়াণের।তার চোখে এক ধরণের দ্যুতি ছড়াচ্ছে।এটারই তো অপেক্ষায় ছিল সে আর বার বার আর.জে.এস কোম্পানির প্রেজেন্ট সিইও ওরফে প্রথার ছবি দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু শ্রেয়াণ তো ছবিটা দেখলোই না বরং তাকে কথা বলতে নিষেধাজ্ঞা নিয়েছিল!
জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় প্রথা।গলা শুকিয়ে আসছে তার। হৃদযন্ত্রে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে শ্রেয়াণের চাহনিতে।প্রথা চোখ ফিরিয়ে নিলেও শ্রেয়াণ নজর স্থির রেখেছে।এক মুহুর্তের জন্যেও পলক ফেলে নি!
-” লেটস্ স্ট্যার্ট দ্যা মিটিং ওয়ান!
অস্বস্তিবিদ্ধ গলায় বলে উঠে প্রথা।শ্রেয়াণ তখনো নিশ্চুপ।সকলের নজর এখন তার উপর।আফিফ এগিয়ে আসে শ্রেয়াণের কাছাকাছি, কানাকানি করে বলে-“ স্যার?
-” হুঁ।
আনয়নে জবাব দেয় শ্রেয়াণ।আফিফ ফের ডাকলে শ্রেয়াণের হুঁশ ফিরে। এতোক্ষণ যেনো অন্য জগতে ছিল সে।
শ্রেয়াণ গলা খাঁকারি দিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে নেয়। এরপর মিটিং স্ট্যার্ট করে।
পুরো একঘন্টা অস্বস্তি নিয়ে মিটিং সম্পন্ন করে দ্রুত পায়ে কক্ষ ছেড়ে বের হয় প্রথা। যথাসম্ভব বড় বড় কদমে করিডোর পার করে লিফটের কাছাকাছি যেতেই পা থেমে যায়।যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো।মাথা ঝাঁকিয়ে ফের চলতে নিলে পেছন থেকে শ্রেয়াণ আবারও ডাক দিলো -” প্রথা স্টপ!
পেছনে ফিরে না প্রথা কিন্তু সামনেও আগায় না, স্থির দাঁড়িয়ে রয়।টের পাচ্ছে পেছনের পুরুষটি এক পা এক পা করে তার নিকটে এগিয়ে আসছে।আর সে যতই নিকটে আসছে প্রথার হৃদস্পন্দন ততই তীব্র হচ্ছে।একসময় শ্রেয়াণ তার নিকটে পৌঁছে যায়। মুখোমুখি দাঁড়ায় প্রথার।নিকটে,খুব নিকটে কিঞ্চিৎ দূরত্বের ব্যবধানে।প্রথা বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এধার ওধার পলক লুকিয়ে ডান হাতে ঘাড়ে ম্যাসাজ করতে লাগে আর শ্রেয়াণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।যেনো পাঁচ বছরের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। ফর্সা ত্বকে সামান্য প্রসাধনী, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। চুলগুলো কানের লতি বেয়ে কিঞ্চিৎ নিচে নেমেছে।পড়নে সাদা শার্টের উপর লেডিস ব্ল্যাক কোট।কালো লেডিস জিন্স। ব্ল্যাক হিল।প্রথার উপর থেকে নিচ জহুরি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে শ্রেয়াণ এবার তার চঞ্চল চোঁখে চোখ রাখে।নিরবতা চলে আরো কিছুক্ষণ, অতঃপর শান্ত গলায় বলে-“ আমার বাচ্চা? আমার সন্তান কই?
#চলবে ইনশা-আল্লাহ
#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|০৯|
#ফাহমিদা_নূর
—
শরীর যেনো ক্রমশ বিবস হয়ে আসছে প্রথার। পিপাসা ও পেয়েছে।ঢুক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয় যতদূর সম্ভব।নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছে বারংবার।কম্পিত গলায় তুতলিয়ে বলে-“ ক্ কিসের সন্তান? আপনার সাথে আজই পরিচয় হলো ?আমি কিভাবে জানবো আপনার সন্তান কোথায়?
প্রত্যুত্তর বিহীন চিত্তাকর্ষক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয় শ্রেয়াণ।তার চোখ গম্ভীর অথচ শান্ত।ক্ষণকাল নজর স্থির রেখে স্নিগ্ধ হাসল সে।এক পা আগে বাড়িয়ে প্রথার আরো নিকটে পৌঁছে গেলো। চোখ খিচে প্রথা নিজেও যথাসম্ভব পিছিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেসে গিয়ে ধীরস্থির চোখ মেলে তাকায়। তখনো শ্রেয়াণ তার দিকে তাকিয়ে।
-“ এটা কেমন অসভ্যতা মি.শ্রেয়াণ?সরে দাঁড়ান।
নারী ডিলারদের কী প্রতিবার এভাবেই ট্রিট করেন?
পরপরই তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলে-” কাকেই বা বলছি?এটাই তো আপনার চরিত্র….
বলতে বলতেই চোখ মুখ খিঁচে নিজের ডান বাহুর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় প্রথা।কারণ শ্রেয়াণ এবার খুব নিকটেই এসে দাঁড়িয়েছে।তার উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়া প্রথার ঘাড়ে বাড়ি খাচ্ছে।
-“ লাস্ট বারের মতো জিজ্ঞেস করছি আমার সন্তান কই?
শ্রেয়াণের ঠান্ডা কন্ঠে অজানা শঙ্কায় চিত্ত কেঁপে উঠে প্রথার।মনে ভয় ঢুকে ভার করে শ্রেয়াণ যদি তার সন্তান কেড়ে নিয়ে যায়? মস্তিস্কে ভাবনাটা হানা দিতেই আচমকা এক কান্ড ঘটিয়ে বসে প্রথা।শ্রেয়াণ কে এক ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিয়ে কালবিলম্ব না করে লিফটের বাটন প্রেস করে গ্রাউন্ড ফ্লোরের। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় শ্রেয়াণ। অল্পক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে আফিফের বাঁধন হতে সরে এসে তার দিকে তাকায় নির্বোধ নয়নে।প্রথা যখন তাকে ধাক্কা দিয়েছিল তখন কিঞ্চিৎ দূরত্বে আফিফ দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় শ্রেয়াণ কে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রথার আকস্মিক কাজে শ্রেয়াণ নির্বোধ বনে গেছে।যখনই বিষয় টা মাথায় এলো তখন প্রথা লিফট নিয়ে চড়ে গেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে হন্তদন্ত সিঁড়ির উদ্দেশ্যে এগুয় শ্রেয়াণ।পিছু পিছু ছুটে আফিফও।
ভাগ্য হয়তো শ্রেয়াণের সহায় ছিল না। সিঁড়ি পেরুতে পেরুতে প্রথার গাড়ি পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে যায়।শীট শব্দ উচ্চারণ করে মুষ্টিবদ্ধ হাতে পাশের গাড়িতে আঘাত করতে যাবে তখন ই দেখতে পায় প্রথার সহকারী আদওয়া গাড়ির পেছনে দৌড়াচ্ছে আর নিজের ম্যাম কে ডেকে যাচ্ছে এক নাগাড়ে।শ্রেয়াণ আফিফ দুজনেই অবলোকন করলো বিষয়টা। অতঃপর বাঁকা হাসল শ্রেয়াণ।আফিফের কাঁধে হাত রাখে আয়েশ ভঙ্গিতে। ওষ্ঠ কোণে তার মৃদু হাসির ঝিলিক।হাহ,আজ কতোদিন পর মন খুলে হাসছে সে! হৃদয় যেনো অজানা শান্তিতে বাকুম বাকুম করে উঠছে।
-“ আফিফ?
-” ইয়েস বস?
-“ আমার বউ রাণী নিশ্চই কোলাবারেশন ক্যান্সেল করতে চাইবে কিন্তু পারবে না।কেনো জানো?
-“ ইয়েস বস!
-“ কেনো!
-“ কারণ ম্যাম হচ্ছে কোম্পানির সিইও।মালিক তো অন্যকেউ!
-“ ব্রিলিয়ান্ট!
দীর্ঘ শ্বাস টেনে এই পর্যায়ে আদওয়ার দিকে তাকায় শ্রেয়াণ। দৃষ্টি সেদিকে বজায় রেখেই বলে-“ কী করতে হবে বুঝতে পেরেছো?
-“ ইয়েস বস!
-“ কোন ক্রুটি হবে না তো?
-“ নো বস!
-“ ভেরি গুড! এজন্যই তোমাকে আমার এতো পছন্দ।
-“ থ্যাঙ্কস বস!
-“ ওকে বস!কাজে লেগে পড়ো ফটাফট!
—
বিকেলের সূর্য তার আলোক রশ্মি অনেকটাই কমিয়ে আনে।অস্ত যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। স্নিগ্ধ হাওয়ায় ভরিয়ে দেয় সবুজ পৃথিবীকে।
চলছে বিকেলের সময়।স্কুল থেকে বেরিয়ে সতর্কতার সহিত রাস্তার ওপাশে অবস্থিত ক্যাফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শ্রেয়া। প্রতিদিন ফিহাকে নিয়েই বাড়ি ফিরে তবে আজ ফিহাকে ড্রাইভারের সাথে পাঠিয়ে নিজে ক্যাফের দিকে যাচ্ছে কারণ ওখানেই অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি।
রাস্তা ভিড়িয়ে ক্যাফেতে ঢুকে গভীর নেত্রে আশপাশ পরখ করে শ্রেয়া।ক্ষণকাল নজর চালানোর পর একটি টেবিল দৃষ্টি স্থির রেখে সেদিকে এগিয়ে যায়।
-“ ডাক্তার সাহেব আপনি এসে গেছেন?
-“ আধা ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করিয়ে এখন মজা নেয়া হচ্ছে?
শ্রেয়ার কথার পিঠে মেকি মেজাজ দেখিয়ে বলে উঠে ড.আনার্স।শ্রেয়া টেবিলের বিপরীত চেয়ারে বসতে বসতে অনুনয় গলায় বলে-“ স্যরি পর লেইট। এ্যাকচ্যুয়েলি ফিহা বেবী আমাকে ছাড়া ফিরতে চাইছিল না__
-“ হয়েছে আর এক্সকিউজ দেখাতে হবে না।
-“ এক্সকিউজ দেখাচ্ছি না সত্যি বলছি!
-“ ওকেহ।মেনে নিলাম.
-“ ধন্য হলাম!
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা চলল দুজনের মাঝে। ফাঁকে ওয়্যেটার এসে কফি সার্ভ করে যায়।যা আনার্স পূর্ব থেকেই অর্ডার করে রেখেছিল। কৃতজ্ঞ হেসে কফিতে চুমুক বসায় শ্রেয়া। অনার্স সেদিকে তাকিয়ে বলে-“ আমাদের সম্পর্কের কথা কবে শেয়ার করছো বাড়িতে?
আনার্সের কথা শুনে মুখে নেয়া কফি টুকুন শব্দ করে গিললো শ্রেয়া। এরপর চোখ তুলে সন্দিহান চোখে তাকায় সম্মুখে আসনরত পুরুষটির দিকে। ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলে -“ বন্ধু হয়েও শাহাদ ভাইয়া কে বলতে পারছেন না যে,তোর বোন কে আমি ভালোবাসি__
-“ তাকে কাছে পেতে আমার আর তর সইছে না প্লিজ দোস্ত কিছু একটা কর!এটাই বলতে হবে তো?
-“ অফকোর্স!
-“ শা*লা কে শ’বারের উপর আকারে ইঙ্গিতে বুঝানোর ট্রাই করেছি। গর্দভ শা*লা কিছুই বুঝলো না বরং অন্য মিনিং ধরে বসে থাকে। তা থেকেই সন্দেহ জন্মে শা*লায় মেধা খরচ করে ডাক্তার হইছে নাকি তুশ ধান বেচে ঘোষের টাকা যোগাড় করে সে টাকায় ডা. সার্টিফিকেট অর্জন করছে।
বিড়বিড় করে এসব বলছিল আনার্স।সামনে থেকে তার মুখাভঙ্গি দেখে সুচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে শ্রেয়া বলে উঠে -“ বাই এ্যানি চান্স। আপনি বিড়বিড় করে আমায় কিংবা ভাইয়া কে বকছেন না তো?
-“ শুধু তুই বা তোর ভাই কেন?মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তোর সামনে বসে তোদের চৌদ্দ গুষ্টি কে সিরিয়াল বাই সিরিয়াল নাম ধরে ধরে রোষ্ট করি। কিন্তু আফসোস, পরিবারের ছোট মেয়ে আর দুভাইয়ের এক বোন বলে কথা? মুখের বুলি একটাও মাটিতে পড়তে দিবি না, তার আগেই কুঁড়িয়ে নিয়ে তার চেয়ে দুগুন ফেরত দিবি।তাছাড়া টাচ করলে তো কথাই নাই?রিয়্যাক্ট এমন করবি যেনো ঔ জায়গাটা ধ্বসে পড়ছে!
আপনমনে বিড়বিড় শেষে সামনে চেয়ে দেখে শ্রেয়া ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে আছে।তা দেখে হাসার চেষ্টা করলো আনার্স,বলল-“ কি হয়েছে প্রাণ?এভাবে চেয়ে আছো যে?আজ কি বেশিই আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে আমায়?
এক ভ্রু উঁচিয়ে ক্ষণকাল নিরব থেকে নাক উঁচু করে শ্রেয়া বলে উঠে-“ শুধুমাত্র আপনার জন্য আমি আজ শাড়ি পড়ে এসেছি!আর আপনি এই প্রতিদান দিলেন?
আশ্চর্য কন্ঠে শুধালো আনার্স -“ কি করেছি আমি?
-“ আমাকে বাজে দেখতে লাগছে বলে মুখের ভেতরে এতোক্ষণ বকাঝকা করে এখন জিজ্ঞেস করছেন কি করেছি?
-” কখন বললাম তোমায় বাজে দেখতে লাগছে?আমি তো মনে মনে এটাই বলছিলাম যে আমার প্রণয়ীনি কে আজ প্রতিদিনের চেয়ে স্নিগ্ধ লাগছে!
কথাগুলো কানেই তুললো না শ্রেয়া, বরং নিজে নিজেই বলে চলল-“ প্রথমে প্রপোজ করেছিলেন আপনি। ভালোবাসি বলেছিলেন ও আপনি।আর আজ ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে আমাকেই আগে পরিবারকে শেয়ার করার পরামর্শ দিচ্ছেন?এটাই আপনার ভালোবাসা?
হা করে তাকিয়ে রইলো আনার্স।কথার বুলি কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেটা কেবল চোখ পাকিয়ে শ্রবণ করছে সে।আর প্রতিবারের ন্যায় মনে মনে ভাবছে“ সবার সামনে ভদ্র , সভ্য,নম্র সেজে থাকা মেয়েটা তার সামনে আসলেই কেন রূপ পাল্টে ঝগড়াটে আর বাচ্চামু হয়ে যায়।আনার্স তো আর এটা যানে না, মেয়েরা পুরো দুনিয়ার সামনে ভদ্র সভ্য নম্র রূপে থাকলেও ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যে আল্হাদি হয়ে উঠে,আচরণে বাচ্চমু ফুটিয়ে তুলে, আবার ঝগড়ুটেও হতে দুবার ভাবে না!
-” ওকে!ওকেই তোমায় বলতে হবে না!আমিই বলবো সবাই কে!
নিজের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে শ্রেয়া।যাক;ছলে,বলে, কৌশলে পরিবারের কাছে ’ আমি একজন কে ভালোবাসি এবং তাকেই আমার লাগবে!’ এটা মুখ ফুটে বলতে হবে না আর।যা করার আনার্স ই করবে। মিষ্টি হাসলো শ্রেয়া।বলল-“ থ্যাঙ্ক ইউ চ্যু মাচ ডাক্তার বাবু!
আনার্স গম্ভীর মুখ ধরে রাখতে পারে না বেশীক্ষণ, নিজেও হেসে ফেলে শ্রেয়ার মুখাবয়ব দেখে।এটাতেই ভালোবাসা নিহিত।
—
রাত যত গভীরে ডুব দেয় প্রকৃতি যেনো ততই গাঢ় হয়। মনে হয় চারদিকে ঝিমঝিম শব্দ হচ্ছে, অথচ তার উৎস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দূরের বিস্তির্ণ আকাশে উঁকি দিচ্ছে চন্দ্রিমা।তাকে পাহারায় রেখেছে হাজারো অধিক তারকারাজি। হিমশীতল বাতাস বইছে প্রকৃতিতে।
রাত আড়াইটা ছাড়িয়েছে ঘড়ির কাঁটা।প্রথা তখনো জেগে আছে নিজ কক্ষে। জানালার ধারে বসে অপলক তাকিয়ে রয়েছে চন্দ্রের পানে।গায়ে জড়িয়ে আছে নীলাভ সাদা মিশেলে শিফন শাড়ি। একদৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে স্মৃতি চারণ করছে শ্রেয়াণের সাথে হঠাৎ সাক্ষাৎ হওয়ার মুহূর্তে গুলোর।ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্কে জাগরণ দিয়ে উঠে তার নাড়ি ছেঁড়া ধনের কথা। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল তৎক্ষণাৎ।ও ই তো এখন প্রথার জগৎ।তার বেঁচে থাকার সম্বল।
শুয়ার আগে একপল তাকে দেখার অযুহাতে নিজ কক্ষ ত্যাগ করে নেহমাতের কক্ষের দিকে ধাবিত হয় প্রথা। দুতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছে বিগত পাঁচ বছর যাবত। উপর তলার করিডোর পেরিয়ে নেহমাতের রুমের দ্বোর খুলে এক পা এগুতেই থমকে দাঁড়ায় সে। অজান্তেই মুখে হাত চলে যায় অনতিবিলম্বে। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে গিয়েও দ্বার ঠেসে নিজেকে সামলে নেয়। স্থির স্তব্ধ চোখে দুটো দিয়ে পুরো কক্ষ পর্যবেক্ষণ করে নেয়,দেখে যে ব্যালকনির দরজা খুলে রাখা। শুষ্ক ঢুক গিলে প্রথা। নজর স্থির রাখে বেডে শায়িত নেহমাতের উপর। অতঃপর তার পাশে তাকাতেই বুকের ভেতর যেনো ছলাৎ করে উঠল।শ্রেয়াণ নেহমাতের শিয়রে বসে তার দিকে ঝুঁকে আছে। মুগ্ধ, বিমোহিত, তৃষ্ণার্ত চোখে জুড়া নেহমাতের স্নিগ্ধ মুখে সীমাবদ্ধ। আশপাশের কোন কিছুতেই যেন খেয়াল নেই তার।ক্ষণে ক্ষণে নেহমাতের ছোট মুখটায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়াণ।চোখে চিকচিক করছে বিন্দু কণা অথচ ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি।চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মোহিত চোখে দ্বারের ওপ্রান্ত থেকে তাকিয়ে থাকে প্রথা। কান্না,হাসি,সুখ সবটা ই একত্রে আসতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে বোধহয়। সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার। অস্থির অস্থির ঠেকছে নিজেকে নিজের কাছে।
নেহমাত প্রায় জানতে চাইতো আশপাশে সবার বাবা আছে কিন্তু তার বাবা নেই কেনো?বুক ভর্তি দীর্ঘ শ্বাস টেনে প্রথা তখন জবাব দিতো তার বাবা হারিয়ে গেছে।কেনো জানি প্রথার এখন ঘুমন্ত নেহমাত কে জাগিয়ে তুলে চিৎকার করে বলতে ,এটাই তোমার বাবা!যাকে তুমি না দেখেও মায়ের চেয়ে বেশী ভালোবাসো।প্রতিনিয়ত মিস করো, আমার বাবা কোথায়? আমার বাবা কেমন দেখতে? নিশ্চই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর?
চোখ বেয়ে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে প্রথার অথচ সে একবার মুছে নিচ্ছে না। দুচোখ জুড়িয়ে বাবা মেয়েকে দেখছে আর অশ্রু গুলো কে বিরামহীন ছেড়ে দিয়েছে।
একদিন এমন দৃশ্যই তো কল্পনা করেছিল সে। যেখানে ছিল প্রথা, শ্রেয়াণ আর তাদের ছোট্ট প্রাণ।কিন্তু সেদিন ই আবার সব কল্পনা মিছে প্রমাণ করে দিয়েছিল স্বয়ং শ্রেয়াণ।যাকে প্রথা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস, ভরসা করেছিল।সেই এক নিমিষে সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল নিজ হাতে।সেদিনের সেই দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সন্তর্পণে চোখের জল মুছে নেয় প্রথা। চোখ বন্ধ বুকে হাত রেখে প্রলম্বিত শ্বাস টানে কিন্তু চোখের অবাধ্য জল বাঁধা মানতে চাইছে না আজ।
কারো গুঙ্গানির আওয়াজ কর্ণকোঠরে পৌঁছাতেই সতর্কতার সহিত চোখ কান সজাগ করে শ্রেয়াণ। তীর্যক দৃষ্টিতে উৎস খুঁজতে দ্বারের দিকে তাকিয়ে প্রথা কে দেখতে পায়। মোটেও অবাক হয়নি শ্রেয়াণ বরং শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়। অতঃপর বেড থেকে উতরে একপা দু’পা এগিয়ে আসে প্রথার দিকে।অন্যদিক থেকে প্রথাও চোখের অশ্রু মুছে নিজেকে সংযত করে এগিয়ে যায়। মুখোমুখি হয় দুজন দুজনার। দৃষ্টি বিনিময় করে খানিকটা সময়।
-“ কেনো এসেছেন?
প্রথা জানতে চায়।
দাঁতে দাঁত নিষ্পেষিত করলো শ্রেয়াণ।বলল-“ ইচ্ছে করছে এখুনি তোমায় গলা টিপে শ্বাস রুদ্ধ করে দিতে কিন্তু আমি পারবো না তা।কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি!
একটু থেমে ফের বলে,“তোমার সাহস কি করে হয় পাঁচ পাঁচটি বছর আমার মেয়েকে তার বাবার কাছ থেকে আলাদা রাখার?
মাছি তাড়ানোর মতো শ্রেয়াণের কথা উড়িয়ে দিল প্রথা।
-“ আজকে এসেছেন এসেছেন।নেক্সট টাইম ভুলেও আমাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে চেষ্টা করবেন না।
-“ ঘেঁষতে হবেও না_
এইটুকু বলে প্রথার চোখের দিকে তাকায় শ্রেয়াণ।পরপরই বলে-” কারণ এক্ষুনি এই মুহূর্তে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব!
কথা শেষ করেই বেডে ঘুমন্ত নেহমাতের দিকে এগিয়ে যায় শ্রেয়াণ। আতঙ্কে খেই হারিয়ে ফেলে প্রথা।কী করবে না করবে বুঝতে না পেরে দ্রুত পায়ে শ্রেয়াণের সামনে বাঁধ সেজে দাঁড়ায়। আক্রোশ মিশ্রিত কন্ঠে কম্পিত গলায় বলে উঠে….
#চলবে ইনশা-আল্লাহ