#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৪|
#ফাহমিদা_নূর
–
একে অন্যের কাছাকাছি দুজন। খুবই নিকটে। উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়া এসে লাগছে প্রথার কপালে। ধুকপুক ধুকপুক শব্দ আসছে হৃদযন্ত্র ভেঙে। নিজেকে শক্ত রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে প্রথার। তবুও যথাসম্ভব ছুটার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সে।শ্রেয়াণ আরো নিকটে নিয়ে আসে তার মুখ।ডান হাতে প্রথার থুতনি ধরে চেহারা উপরে তুলে নজরে নজর মেলায়। অতঃপর কিঞ্চিৎ ঝুঁকে ঠোঁটের কাছাকাছি নিয়ে যায় নিজ ঠোঁট। বেশি দূরত্ব নেই চার ওষ্ঠের মাঝে। দুজনে চোখ বুজে নেয় আবেশে। শ্রেয়াণের ওষ্ঠা যখন ই প্রথার ওষ্ঠ স্পর্শ করবে তখন ই ভেসে উঠে মৃদু আর্তনাদের বাণী–আহ!
শ্রেয়াণ চোখ মুখ কুঁচকে হাঁটুতে হাত রেখে ফের অসহায় চোখে প্রথার দিকে তাকায়।রমণী বুকে দুহাত ভাঁজ করে গুঁজে তার দিকে চেয়ে সরু নেত্রে। চক্ষু হাসছে তার।এ হাসিতে যেনো বিজয়ের হাসি উঁপচে পড়ছে।
–’ এটা কি হলো?
–’ কি হলো?
কাঁধ দুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে প্রথা।শ্রেয়াণ দাঁতে দাঁত চেপে বলে–“ পায়ে পাড়া দিলে কেনো?
–“ তো কি করবো?মিস্টার শ্রেয়াণ কাছে আসুন,প্লিজ আমার ঠোঁটে পাপ্পি দিন!–এমন বলবো?
–“ বললেও বলতে পারো আমি মোটেও মাইন্ড করতাম না।ইউ নো হোয়াট?আমি ফ্রি মাইন্..
–“ আপনার মাইন্ড সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে আসিনি।কাজ করতে এসেছি।
বলতে বলতে চেয়ারে গিয়ে বসল প্রথা।সামনে চলে আসা বেবী চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে।এখনো কঠিন নজরে চেয়ে আছে প্রথার দিকে।মাছি তাড়ানোর মতো করলো প্রথা।বলল–“ কি হলো মিস্টার?আজ যেহেতু মিটিং আমাদের দু’পক্ষের হবে।কারো জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলে আমার মনে হয়না। স্ট্যার্ট করুন।
শ্রেয়াণ নিজের আসনের দিকে পতিত হতে হতে বলে–“ হেয়ালি করছো? আজকের অসম্পূর্ণ কাজটা খুব শিঘ্রই সম্পূর্ণ হবে,আই প্রমিজ ইউ!
চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে প্রথা। ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে ক্ষণকাল চেয়ে রয় অনিমেষ।ওই দৃষ্টিতে না আছে ক্ষোভ,না আছে রাগ আর না ভালোবাসা কিংবা মুগ্ধতা। কেবল অনুভূতিহীন দেখালো। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলে প্রথা–“ জাস্ট একবার ছুঁয়ে তো দেখুন?
–“ দুবার ছুঁয়েছি না?
চোখ টিপ জবাব দেয় শ্রেয়াণ।কটমট দৃষ্টিতে দেখে যায় প্রথা। মেজাজের কারণে হাত নিশপিশ করছে কাউকে আঘাত করার।
–“ মারতে টা-রতে ইচ্ছে করছে নাকি আমায়?
মুহূর্তেই শান্ত হয়ে আসে প্রথা।শীতল চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলে–“ ইচ্ছে তো অনেক কিছুই ছিল কিন্তূ পূর্ণ হলো কই?
শ্রেয়াণের ঠোঁটের দুষ্টু হাসিটা মিলিয়ে যায় তৎক্ষণাৎ।প্রথা কি বুঝাতে চাইছে তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক সেটা ঠাহর করে নিয়েছে তীর্যক ভাবে।ফের আগের ন্যায় অপরাধ বোধ, নিরুপায়, আর আফসোসেরা ঘিরে ধরলো তাকে। প্রমাণ ছাড়া কি করে বুঝাবে যে, সেদিন..? দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শ্রেয়াণ। সরাসরি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রথার চোখে।মানবীর অনুভূতিশূন্য চোখ জোড়া তখন এপাশ ওপাশ চলছিল।
–“ তোমাকে কিছু বলার আছে আমার। বিশ্বাস করবে তো আমার মুখের কথা।
চকিতে তাকায় প্রথা। বিশ্বাস?আর শ্রেয়াণ জাওয়ান?
প্রশ্নাতীত চাহনিতে তাকাতেই শ্রেয়াণ বলে উঠে –“ সেদিন তুমি ততটুকুই দেখেছিলে যেটা তোমায় দেখানো হয়েছিল। বিশ্বাস করো শুধু ঔ মেয়ে কেন,এ জীবনে তুমি ছাড়া..
প্রথা বুঝে যায় শ্রেয়াণ পাঁচ বছর আগের সেই দিনের কথাই উপস্থাপন করছে। কিন্তু এ বিষয়ে তার কিছু শুনার বা বলার নেই!কথা পাল্টে বলল–“ শুরু করুন?
কথা বলতে বলতে কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো শ্রেয়াণ। মাঝখানে প্রথার কথা শুনে নির্বোধ চাহনি দিয়ে বলে–“ উুঁ?
ফাইল হাতে তুলে ফের বলে প্রথা–“ কাজ শুরু করুন!
—
সময় চলে আপন নিয়মে।এ যেনো স্রোতের ন্যায়। একবার চলে গেলে আর ফেরার নয়। কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। আজকাল প্রথার সাথে প্রায়ই দেখা হয় শ্রেয়ার,কথাও চলে অনেক্ষণ।তবে সবকিছুই অজানা থাকলো পরিবারের কাছে শ্রেয়াণের মতানুযায়ী। কিন্তু সত্য কতোদিন চাপা থাকবে? একদিন না একদিন তা প্রকাশ হওয়ারই ছিল?
গাড়ি থেকে হন্তদন্ত বেরিয়ে এলো প্রথা। এলোমেলো দেখাচ্ছে তাকে। চোখে হারানোর ভয়। মুখ জুড়ে অজানা শঙ্কা। পিছু ছুটছে আদওয়া।তার চেহারায় ও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।সদর দরজার সামনে এসে অনবরত কলিং বেল চেপে যায়। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চম্পা এসে দ্বোর খুলে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে প্রথাকে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। চোখ তুলে একবার তার দিকে তাকায় — যে মেয়েটা বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই কথার বাণ খুলে বসে,সে আজ এতো চুপচাপ কেনো? ঠোঁটে হাসিটা পর্যন্ত নেয়?মাথা ঝাঁকিয়ে উদগ্রীব গলায় প্রথা জানতে চাইলো–“ নেহমাত ফিরেছে?
–“ না তো!আপনেই তো নিয়া আসেন প্রতিদিন!
প্রথার চোখ বুজে মুখ চেপে ধরে। চোখে পানি চিকচিক করছে তার। বুকের ভেতরটায় যন্ত্রণা হচ্ছে। চম্পাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দ্রুত পায়ে। ড্রয়িং রুম অব্ধি পৌঁছাতেই পা থমকে যায় তার। সোফায় আসন পেতে থাকা আগন্তুক কে দেখে শীতল হয়ে আসে হাত পা।ঢুক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয় যতদূর সম্ভব। চোখের পলক এদিক ওদিক ঝেড়ে এগিয়ে যায় সেদিক। আগন্তুক ততক্ষণে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
–“ ম্ মা!
শব্দ সম্পূর্ণ করতে পারে না প্রথা তার আগেই এক মমতাময়ী মায়ের শক্ত চড় পড়ে তার নরম গালে।গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় প্রথা। কিছু বলবে তার আগে দ্বিতীয় বারের মতো চড় পড়ে।তাল সামাল দিতে না পারায় দু কদম পিছিয়ে যায়।
–“ মাকে ঘৃ/ণা করা যায় না। আপনার ভালোবাসা না পেলে কখনো উপলব্ধি করতে পারতাম না শাশুড়িও মার মতোন হয়?যতো দূরেই থাকি না কেন সবসময় আপনার সাথে যোগাযোগ থাকবে! নিউইয়র্ক পৌঁছাতেই আপনাকে জানাবো!–অথচ আজ পাঁচ বছরেও তার খুঁজ নেই?আজ যদি ভাইসাব কে মার্কেটে না দেখতে পেতাম,তাহলে তোমরা যে দেশে ফিরেছো সেটাও জানতে পারতাম না!– কেনো সেদিন বড়ো বড়ো কথাগুলো বলেছিলে প্রথা!
অপরাধী চোখে প্রথা কেবল শুনে গেলো সায়লা খানমের কথা।নিরবে আশ্রু ঝড়ছে তার।অপলক চেয়ে আছে সায়লা খানমের মুখশ্রীতে। কতোদিন পর ,আজ এই মমতাময়ী মুখটা দেখতে পাচ্ছে প্রথা?প্রায় অর্ধেক চুলে পাক ধরেছে মার।চেহারায় বয়সের ছাপ বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। সাদাকালো মিশেলে শাড়ি পরিধানে। চোখের অশ্রুতে সব গোলা দেখছে প্রথা।হাতের তালু দিয়ে অশ্রু মুছে ফের তাকায়।সায়লা খানমের চোখেও পানি।
–“ একটুও মনে পড়েনি আমাদের কথা? একবারো না? আমার ছেলে নাহয় ভুল করেছিল কিন্তু আমার তো কোন দোষ ছিল না!তাহলে কেনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলে প্রথা?
কন্ঠণালী কাঁপছে প্রথার।ভাষা নেই জবাব দেয়ার!কিই বা দেবে?
–“ গত পাঁচ বছর যাবত একটা ফোনের আশায় থেকেছিলাম সে কথা জানো?আমার নাতিকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে কবার সে হিসেব রেখেছো?হয়তো রাখো নি!রাখবেই বা কেনো?কে আমি? একটা ভুল সিদ্ধান্ত কে সাপোর্ট করেছি বলে ছেলে আমার সাথে কথায় বলতে চায়না অন্যদিকে ছেলের বৌ তো লাপাত্তা। কষ্ট শুধু তোমাদের হয়, আমাদের হয়না?
–“ স্যরি ম্ মা!
সায়লা খানম কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠে প্রথা–“ ভুল করে ফেলেছি মা! প্লিজ রাগ করে থেকো না!
কঠোর চিত্তে দাঁড়িয়ে রয় সায়লা। একবারের জন্যও ধরে না প্রথাকে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে–“ আমার নাতি কোথায়?
নেহমাতের কথা উঠতেই আর জোরে কেঁদে উঠলো প্রথা।সায়লা কে ছেড়ে দিয়ে দুহাতের আজলে মুখ ডুবিয়ে কান্না করতে করতে বলে–“ শ্ শ্ শ্রেয়াণ স্কুল থেকে ওকে নিয়ে চলে গেছে কোথাও। আমার ফোন ও তুলছে না। সেদিন ও বলেছিল নেহমাত কে নিজের কাছে নিয়ে যাবে।
পরপর সায়লার হাত ধরে বলে–“ আমার মেয়েকে শ্রেয়াণের কাছ থেকে এনে দিন না মা?ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই!ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না মা!
–“ শ্রেয়াণ জানে তোমরা দেশে ফিরেছো?
ক্রন্দনরত মুখশ্রীতে উপর নিচ মাথা নাড়ে প্রথা।সায়লা খানম নিভে গেলেন।হয়তো কষ্ট পেয়েছে কিঞ্চিৎ!
–“ মা ম্ মা আপনি খুঁজ নিয়ে দেখুন না শ্রেয়াণ কোথায়!
–“ ও তো আমার সাথে তেমন একটা কথা বলেনা।আমি বরং শ্রেয়া কে দিয়ে জিজ্ঞেস করি।
প্রথা সায় দেয় তার কথায়।সায়লা যখন শ্রেয়ার নাম্বারে কল দেবে তার আগেই শুনতে পেলো একটা বাচ্চা মিষ্টি কন্ঠস্বর –“ মাম্মি!
#চলবে ইনশা-আল্লাহ
#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৫|
#ফাহমিদা_নূর
…
হৃদয় ভাঙা নিঃশব্দ আর্তনাদে ঘেরা পরিবেশ থমকে গেছে মুহূর্তেই।ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।সমস্ত শব্দ কোথাও হারিয়ে গেছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে সময়ও।প্রথার আর্তনাদের শেষ সুরটি মিলিয়ে যেতে থাকে হঠাৎ এক পরিচিত কণ্ঠস্বরের বিনিময়ে।এ যেন এক চির-প্রত্যাশিত প্রতিধ্বনি,দীর্ঘ অপেক্ষার পর মরুভূমিতে প্রথম বৃষ্টির স্পর্শ।বিশ্বাস আর সংশয়ের মাঝে দোল খাওয়া বুকের ভেতরের ঝড় নিমেষেই শান্ত হয়ে আসে তার।কান্নায় অবসন্ন হৃদয় নিয়ে মুহূর্তের জন্য থমকে যাওয়া রমণী কালবিলম্ব না করে অশ্রুভেজা চোখে তড়িৎ পিছে ফিরে।তাকাতেই দেখা যায় নেহমাতের খুশী খুশি মুখশ্রী।হাঁটি হাঁটি পা পা করে পার হয়ে আসছে সদর দরজা। অধর কোণে স্নিগ্ধ হাসি,যেনো আজকের দিনের সমস্ত খুশি তাকে ধরা দিয়েছে নিঃশব্দে ।সে সত্যিই এসেছে?
দিকবিদিক না তাকিয়ে ছুটে যায় প্রথা।মেয়ের সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় মুখ জুড়ে।সমস্ত ব্যথা যেন এক নিমেষে গলে গেছে মেয়েকে ছুঁতে পেরে।ঠিক যেমন অন্ধকারের বুক চিরে ভোরের আলো উঁকি দেয়?তেমনই আর্তনাদ পরিণত হয় নিঃশব্দ বিস্ময় আর থরথরে সুখের আতঙ্কে।
মেয়েকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বহু প্রলাপ বকছে প্রথা –“ কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? কিছু হয়নি তো তোমার?মাম্মি কে না জানিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়েছিলেন কেনো?
–“ ওহহো মাম্মি তোমায় না বলেছিলাম আমার বড়ো একটা হ্যান্ডসাম ফ্রেন্ড আছে,তার সাথেই তো গেছিলাম!আমি বুঝতেই পারিনি আমাকে না পেয়ে তোমার এমন অবস্থা হবে? এত্তো গুলা স্যরি।–হাত দিয়ে মেপে দেখায় নেহমাত।প্রথা আবার চুমু দেয় মেয়ের গালে।বুকে জড়িয়ে নেয় তৃপ্তি সহকারে।
ক্ষণকালের জন্য দুনিয়ার চিন্তা ধারা ভুলে বসেছিল প্রথা।টনক নড়তেই চোখ তুলে তাকায়, কিঞ্চিৎ দূরত্বে শ্রেয়াণ দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত অথচ গম্ভীর দৃষ্টি তাদের উপর ন্যস্ত। দাঁতে দাঁত খিঁচে উঠে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুক্ষ গলায় হিসহিসিয়ে বলে–“ কোথায় নিয়ে গেছিলেন ও-কে?আমাকে না জানিয়ে? ফোন তুলছিলেন না কেনো?
প্রথার অশ্রুভেজা মুখে কিছুকাল চেয়ে থেকে ফু দেয় শ্রেয়াণ। ভ্রু কুঁচকে নির্বিকার গলায় বলে –“ আধাঘণ্টা মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে নিজের এই হাল করেছো? অথচ আমার কেমন লেগেছিল বিগত পাঁচ বছর? আমি হতভাগা তো অবগত ও ছিলাম না আমার সন্তান ছেলে না মেয়ে!
–“ ভুল তো আমার ছিলনা তখন? নিজের ভুলের জন্যই এমন হয়েছে,সেটা স্বীকার করবেন কখন?
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া জবাব করে না শ্রেয়াণ।কিই বা দেবে? উত্তর তো জানা নেই! দুজনের নিরব তর্ক বিতর্কের সমাপনী করতে মাঝখানে ঢুকে পড়ে নেহমাত। মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে উপরে মুখ উঁকি দিয়ে গালে তর্জনী ঠেকিয়ে ভাবনাময় ভঙ্গিতে বলে–“ তোমরা ফিসফিসিয়ে কি বলছো বলোতো?মাম্মি তুমি কী আমার ফ্রেন্ড কে চেনো?
দুকদম সরে এসে প্রথা জবাব দেয় –“ পরিচয় করিয়ে না দিলে চিনবো কিভাবে?
পড়নের নীল কোটের কলার ঝাঁড়িয়ে গা ছাড়া ভাব নিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল শ্রেয়াণ।নেহমাত উচ্ছ্বাসিত মুখে শ্রেয়াণের হাত আঁকড়ে বলে–’ এই হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড শ্রেয়াণ জাওয়ান আর এই হচ্ছে ফিহা!
শ্রেয়াণের পেছন থেকে ফিহাকে টেনে বার করে বলল।কুঞ্চিত কপালে দেখে যায় প্রথা। এতোক্ষণ সে ফিহাকে খেয়ালি করেনি। অবুঝের মতো শ্রেয়াণের দিকে তাকালে জবাব আসে –“ ভাইয়ের..
এটুকু বলে বাকিটা ইশারায় বুঝিয়ে দেয়।চতুর প্রথা নিজ উদ্যোগে বুঝে নিয়ে ফিহার সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে দু’হাতে মুখ উপরে তুলে। ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে থাকে ফিহা।
–“ আররে ফিহা বেবী তো দেখতে বেশ মিষ্টি।আমি নেহমাতের মাম্মি, তুমি আমাকে আন্টি বলে ডাকতে পারো।
ফিহা ক্ষণকাল পর হাসি ফুটিয়ে তুলে ঠোঁটের কোণে।প্রথার গালে টুপ করে চুমু দিয়ে বলে –“ আন্টি তুমিও স্যুইট?
-“ ওলে বাব্বা!
নেহমাতের হঠাৎ চোখ যায় ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মুখশ্রীর উপর।যার আকুল দৃষ্টি তার দিকেই। অধর কিনারায় অদ্ভুত বিচলিত হাসির ঝিলিক।সন্দিহান চোখে এগিয়ে যায় একপা দু’পা। কাছাকাছি যেয়ে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সায়লা খানমের দিকে।সায়লা নিজের উম্মাদের মতো–“ দা.. শব্দাচারণ করে ছুঁতে যাবে তখন ই সিঁড়ির অভিমুখে দৌড়ে যায় নেহমাতের চঞ্চল পা জোড়া।তার চোখে কৌতুহল, পদচারণ অস্থির।অবাক চোখে তাকিয়ে রয় সায়লা।নাতি কী তার কাছে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেনা?তাকে ভালো লাগেনি? নির্বোধ নজরে প্রথার দিকে তাকিয়ে দেখে সে নিজেও মেয়ের অস্থির চিত্তে ছুটে যাওয়ার পানে চেয়ে আছে।
ক্ষণকাল পর নেহমাত কে ফিরতে দেখে বিমূঢ় ই হলো সায়লা খানম।বধির মুখে বোকা চোখে কেবল দেখে যাচ্ছে অথচ বোধগম্য হচ্ছে না কোন কিছুই।নেমাতের হাতে বড়ো ফ্রেমের ফটো।খুব সম্ভবত কারো চেহারার সাথে সায়লার চেহারার মিলন খুঁজে বেড়াচ্ছে ফটোতে। একবার সায়লার দিকে পরপর ফটোতে তাকাচ্ছে নেহমাত।আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো –“ দিদুন?
ফটো টি টেবিলে রেখে সায়লা খানম কে ততক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে–“ তুমি আমার দিদুন?এতো দিন কোথায় ছিলে তোমরা?জানো কতো খুঁজেছি তোমাদের?কতো মিসড করেছি?
সায়লা ঠোঁট কামড়ে নাতিকে দুহাতে আগলে ধরে। চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।এ যেনো আনন্দাশ্রু।খুশিতে বুলি হারিয়ে ফেলেছে সে।
রোজ ফোনের পাশে বসে থাকতো সায়লা। অপেক্ষায় থাকতো একদিন প্রথার কল আসবে। ভিডিও কলে তার নাতির সাথে পরিচয় করিয়ে বলবে –“ এটাই তোমার দিদুন। কিন্তু এমন কিছুই ঘটেনি।প্রথা একবারের জন্য ভুলেও কল করেনি।আর না তাকে খুঁজে পাওয়ার কোন বিকল্প পথ বাকি রেখেছে!
–“ আমরাও তোমাদের অনেক খুঁজেছি।আর অনেক মিসড ও করেছি দাদুভাই!
দুহাতে সায়লার গলা আঁকড়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুপটি করে রয় নেহমাত। যেনো বহু সাধনার পর মূল্যবান কিছুর হদিস মিলেছে,ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে।
অপলক তাকিয়ে রয় প্রথা। আঁখি জোড়া টলমল।আজ কিছুটা আফসোস হচ্ছে মেয়ের জন্য।যদি সেদিন না চলে যেতো,হয়তো তার মেয়েটা পরিবারের অভাব বোধ করতো না!ফিহা,ফারিহার মতো সেও দিদুন,দাদু,ফুফু,বড় বাবা-মার আর ভাই বোনেদের মাঝে থাকবো! তাছাড়া আরো একজন আছে–বাবা!শ্রেয়াণ? শ্রেয়াণের কথা উঁকি দিতেই ,যা হয়েছে ভালোই হয়েছে বলে নিজেকে শুধরে নেয়! ওখানে থাকলে একদিন না একদিন মেয়ে নিশ্চই বাবার চরিত্র সম্পর্কে অবগত হতো। তখন তার উপর কেমন প্রভাব পড়তো?কি জবাব দিতো প্রথা? হঠাৎ ই মেয়ের কান্না মিশ্রিত করুন সুর ভেসে আসে–“ আমার পাপ্পা কই?আমি পাপ্পা কে দেখবো।দিদুন আমি পাপ্পার কাছে যাবো।পাপ্পা..পাপ্পা..
পাপ্পা বলতে গিয়ে উচ্চস্বরে কাঁদছে মেয়েটা?তার প্রতিটি কথায় ফুটে উঠছে বাবাকে কাছে পাওয়ার তিব্র আবেদন। নিষ্পাপ হৃদয়ে লোকায়ত নম্র হাহাকার। সন্তর্পণে চোখ মুছে সাহসা পাশে ফিরে তাকায় প্রথা।শ্রেয়াণ ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।তার চোখের দৃষ্টি স্পষ্টতই বলে দিচ্ছে– প্রথাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে সে।
–“ মাম্মি দিদুন কে তো পেয়ে গেছি!পাপ্পা নিশ্চই তাদের সাথেই থাকে?আমি পাপ্পার কাছে যাবো। তুমি পাপ্পা কে এখানে আসতে বলো না মাম্মিইই!
তীর্যক চোখে একপল প্রথাকে দেখে অন্যদিকে চলে যায় শ্রেয়াণ। হৃদয়ের কোথাও ভাঙচুর হচ্ছে তার।সেই সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করছে অপরাধবোধে।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধরে আসা গলায় প্রথা বলে–“ পাপ্পা আসবে! ধৈর্য্য ধরো!
–“ আসতে পারি?
আরো একটি পুরুষালী কন্ঠস্বর। তড়িৎ উৎস খুঁজতে সকলে তাকায় সদর দরজার অভিমুখে।দ্বোর পূর্বে হতে খোলা ই ছিল,তাই আগন্তুক কে কলিং বেল বাজানোর মতো অতিরিক্ত কাজটা করতে হয়নি। এতোক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করছিলেন প্রতাপ চৌধুরী।এই পর্যায়ে আগন্তুক কে দেখে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করে।
–“ ভাইসাব?আপনাকে খবর কে দিলো?
শাহিন জাওয়ানের উত্তর –“ কে আবার আমার গিন্নী ছাড়া?সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে দিতে আমাকে তো আসতেই হতো!
–“ ভুল বুঝাবুঝি?
পরপরই মাথা ঝাঁকিয়ে বলে–“ সেসব পরে দেখা যাবে, চলুন বসা যাক?
–“ অবশ্যই!
প্রথাকে ছেড়ে দেয় নেহমাত। শাহিন জাওয়ানের দিকে কিছু পল চেয়ে থেকে এগিয়ে যায় অনতিবিলম্বে। দরজার বাইরে উঁকি ঝুঁকি মেরে শাহিনের সম্মুখে এসে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলে–“ সবাই আসছে কিন্তু পাপ্পা আসেনি কেনো!
বিমুগ্ধ হয়ে খানিকটা সময় মিষ্টি শ্রীতে চেয়ে থেকে বাকিদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় শাহিন জাওয়ান।সায়লার ইশারায় তিনি এটুকুন বুঝে নিয়েছে যে এটাই তার নাতনি। কিঞ্চিৎ ঝুঁকে নেহমাতের উদ্দেশ্যে আদুরে গলায় বলেন–“ অবশ্যই আসবে পাপ্পা তার প্রিন্সেসের কাছে।
–“ তোমার ছেলেকে বলে দিও আমি তাকে অন্নেক ভালোবাসি আর এতোও অভিমান করেছি!
ঠোঁট ভেঙে হেসে ফেলে শাহিন।নেহমাতের মাথায় চুমু দিয়ে নাক টেনে ঘ্রান নেয়ার মতো করে।প্রথা বুক ভর্তি শ্বাস টেনে আদওয়া কে বলে–“ ওদের দুজন কে উপরে নিয়ে যাও।
আদওয়া করলোও তাই।নেহমাত,ফিহা কে নিয়ে চলে যায় উপরে। যদিও নেহমাত কে জোর খাটিয়েই নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
শাহিন জাওয়ান প্রথার সামনে এসে থামে। তার দৃষ্টি স্থির। হেরফের হচ্ছে না মোটেও।মাথা নত করে নেয় প্রথা।কেনো যেনো সাহস পাচ্ছে না শির উঁচু করে তাকাতে।
–“ কেমন আছো মা?
সেই পূর্বের মতো কথার ধরন।মায়ের মতো কি তারো অভিযোগ আছে প্রথা দূরে ছিল বলে?হয়তো আছে,হয়তো নেই?প্রথা চোখ তুলে ঠোঁট ভিজিয়ে ছোট স্বরে বলে–“ ভালো! আপনার শরীর কেমন?
–“ মন ভালো না থাকলে শরীর কী আর ভালো থাকে?
প্রথা নির্বোধ তাকায়। শাহিন জাওয়ান বলে–“ তোমাকে কিছু জানানোর আছে।যেটা তুমি পূর্বাগত নও!
–“ বলুন না বাবা! আপনি যা বলবেন তা শুনতে বাধ্য আমি!
–“ তাহলে বসে কথা বলা যাক।শ্রেয়াণ তুইও আয়!
শেষের কথাটি বাঁ পাশে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয়াণের উদ্দেশ্যে বলল গম্ভীর গলায়। ঠোঁট এলিয়ে সামান্য হাসে শ্রেয়াণ। কাঁধ দুলিয়ে এসে বসে একটি সোফায়।তার সম্মুখের আসনে প্রথা।প্রথার ডানদিকে শাহিন আর প্রতাপ।শ্রেয়াণের পাশে সায়লা খানম।ছেলেকে বহু বছর পর নিজের পাশ ঘেঁষে বসতে দেখে মাতৃ হৃদয় প্রফুল্ল হয়ে উঠল সায়লার। উচ্ছ্বাসিত চোখে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থেকে শাহিন জাওয়ানের কথা শুনতে নড়েচড়ে বসে।
—
বিমূঢ় প্রথা অশ্রুসিক্ত পলকে চেয়ে আছে অদৃশ্যে।সকল সত্য তার চোখের দৃশ্যপট স্পষ্ট। স্বচ্ছ গঙ্গা জলে প্রতিচ্ছবি যেমন পরিষ্কার,?ঠিক তেমনি!তার মানে এতো দিন সে যা করেছে,যা বুঝেছে,সব মিথ্যে? ভুল? সেদিন শ্রেয়াণ কেবল তার হৃদয় ভাঙার জন্য সাময়িক অভিনয়ে নিমজ্জিত ছিল?এমনকি বিগত পাঁচ বছর যাবৎ শ্রেয়াণের জন্য যে ঘৃণা, ক্ষোভ জমাটবদ্ধ ছিল সবকিছুই অপাত্রে?
যখন সম্পূর্ণ সত্যি সামনে এলো,আসল সত্যিটা প্রকাশিত হলো। চারপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছিল প্রথার! বিস্তৃর্ণ পৃথিবীটা সংকীর্ণ হয়ে আসছিল ক্রমশ। হৃদয় যেনো থমকে গেছে তার। সেদিন ভুল কার ছিল?হয়তো দুজনেরই।একটু ভুল বোঝাবুঝির জন্য জীবন থেকে পাঁচ পাঁচটি বছর হারিয়ে গেলো? এমন হওয়ার কী খুব জরুরী ছিল?
সম্বিত ফিরতেই হতচকিতে ঘরময় নজর বুলিয়ে নেয় প্রথা।স্ব স্ব অবস্থান হতে সায়লা,প্রতাপ, শাহিন চেয়ে আছে তার দিকে।হয়তো সবাই অধীর অপেক্ষায় আছে প্রথা কিছু বলুক! চোখ সরিয়ে শুষ্ক ঢুক গিলে ধীরে ধীরে শ্রেয়াণের দিকে তাকালো রমণী। অন্যদিকে নজর ফিরিয়ে রেখেছে শ্রেয়াণ। অভিমান করেছে কী?
নিজেকে সংযত করে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে প্রথা। মস্তিষ্ক ঘেঁটেও কিছু বলার ভাষা খুঁজতে অক্ষম হচ্ছে বারে বারে।সকলে তার কন্ঠে শুনতে উত পেতে আছে অথচ সে নিশ্চুপ, ভাষাহীন?গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ খুলতে যাবে তখন ই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শ্রেয়াণ –“ আমি কি এখান মেয়ের কাছে যাওয়ার অনুমতি পেতে পারি?
কন্ঠে তাচ্ছিল্য ভাসমান।চঞ্চল মণি দ্বয় ক্রমাগত এদিক ওদিক ছুটিয়ে ঘনঘন উপর নিচ মাথা নাড়ে প্রথা।মানে– যেতে পারে!কথা বাড়ায়নি শ্রেয়াণ।কোট ঠিক করতে করতে দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় সিঁড়ির দিকে। যাওয়ার আগে প্রথাকে কঠোর চোখে তাকাতে ভুলে না।
#চলবে ইনশা-আল্লাহ
#চিত্তে_অঙ্কিত_কৃষ্ণরেখা
#পর্বঃ|১৬+সার্প্রাইজ|
#ফাহমিদা_নূর
…
পা যেন অদৃশ্য শৃঙ্খলে আবদ্ধ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করছে অদ্ভুত এক সংকোচ,অজানা ভীতি। কেন হচ্ছে এমন? সত্যিটা আজ চোখের সামনে বলে শ্রেয়াণের নিকটে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে?ভিতরে প্রবেশের ইচ্ছা থাকলেও প্রথার শরীর সাড়া দিচ্ছে না। একটু উঁকি দিয়ে ভেতরকার পরিস্থিতি দেখাই যায়!ভেবে সামান্য ঝুঁকে উঁকি দিতেই ভেতর হতে মেয়ের গলা ভেসে আসে –“ মাম্মি উঁকি দিয়ে কী দেখছো?ভেতরে আসতে ভয় পাও?
তড়িৎ সটান দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে প্রথা। কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে অগোচরে শ্রেয়াণের দিকে তাকায়।লোকটা বাচ্চাদের সাথে বল ছুড়ে খেলায় মত্ত।প্রথা কে যেনো দেখেইনি!ফিহার দিকে বল ছুটতে ছুটতে নেমহাত বলে–“ দেখো আমরা কত্তো মজা করে খেলছি, তুমিও এসো?
–“ নাহ!না না!তোমরাই খেলো।
তেরছা নজরে শ্রেয়াণ কে দেখে গুটি গুটি পায়ে কাবার্ডের দিকে এগুয় প্রথা। একপল পেছনে তাকিয়ে কাবার্ড খুলে তিনটি মাঝারি সাইজের ফটো হাতে ফিরে আসে বেডের কিনারায়। শুষ্ক ঢুক গিলে মেয়েকে ইতস্তত গলায় জিজ্ঞেস করে–“ তুমিই পাপ্পা ক্ কে দেখতে চাইছিলে না!
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে আসে বুঝি ছোট অস্তিত্বের।হাতের বল পেছনে ফেলে তড়িৎ মায়ের দিকে ফিরে চায়।
–“ কোথায় পাপ্পা?
কন্ঠে একরাশ প্রফুল্লতা।চোখে পাপ্পা নামক মানব কে দেখার তৃষ্ণা।
–“ ওনা -কে তোমার ক্ কেমন লাগে?
প্রথার ইঙ্গিত শ্রেয়াণের উপর। চোখ তুলে তাকায় শ্রেয়াণ,তবে কিছু বলে না। বরং গম্ভীর বেশ ধরে বসে থাকে।নেহমাত তাকায় একবার শ্রেয়াণের দিকে পরপর প্রথাকে। অতঃপর শ্রেয়াণের কোলে চড়ে বলে –“ হি লাইক অ্যা মিস্টার প্রিন্স।আই লাভ হিম ভেরি মাচ!
হাসির ঝিলিক খেলা করে শ্রেয়াণের ঠোঁটময়।প্রথা দেখলো সেটা।
–“ পাপার চেয়ে বেশি ভালোবাসো?
দোনামোনায় পড়লো বোধ বাচ্চা মেয়েটা। ঠোঁট উল্টে অসহায় চোখে তাকায় শ্রেয়াণের দিকে।কি করে বোঝাবে সে!যে– পাপাকে সে কখনো দেখেনি ঠিক, তার সাথে কথা হয়নি, তাও ঠিক! কিন্তু তার ছোট্ট হৃদয় না দেখেও তার পাপাকেই বেশি ভালোবাসে!সবার চেয়ে বেশি!প্রথা বুঝে মেয়ের মনোভাব। ফটোগুলোই একপল চেয়ে তন্মধ্য থেকে একটা এগিয়ে দেয় মেয়ের পানে।ফটোটা তাদের ফ্যামিলির। যেখানে স্পষ্ট প্রদর্শিত হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের মুখশ্রী। মাঝখানে শ্রেয়াণ জাওয়ান তার পাশে সায়লা খানম।দুধারে দুই পুত্রবধূ এবং তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দুই পুত্র শ্রেয়াণ জাওয়ান আর শাহাদ জাওয়ান। ভাই দের মাঝখানে মুখ ফুলিয়ে আছে শ্রেয়া।নেহমাত কে পূর্বে যে ফটো দেখানো হয়েছে,সেটা এমন ই কিন্তু সেখানে শ্রেয়াণের অস্তিত্ব ঠাহর করা যায় না কোন মতেই।এই ফটোতে এমন পরিবর্তন দেখে নেহমাত চেয়ে রয় গভীর নেত্রে।পরপর হাতে তুলে বাকি ফটো দুটি।একটাতে বিয়ের সাজে সজ্জিত প্রথা এবং শ্রেয়াণ। বাকিটায় প্রদর্শিত হচ্ছে কোন এক শিশির ভেজা ভোরে ঘাসের উপর খালি পায়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে হেঁটে আসছে শ্রেয়াণ,তার পিঠে ভর করে আছে প্রথার উচ্ছ্বসিত প্রতিমা।প্রতিটি ফটো জুড়ে হাত বুলিয়ে নির্বোধ চোখ জোড়া শ্রেয়াণের মুখশ্রীতে স্থির করে নেহমাত।মায়ের ইশারানুযায়ী ছবিতে প্রজ্বল্লিত পাপার চেহারার সাথে মিলে যাচ্ছে খুব নিকটে থাকা মুখটি! সন্তর্পণে কোল থেকে নেমে কিছুটা দূরত্বে চলে যায় নেহমাত। অনিমেষ চেয়ে রয় শ্রেয়াণের দিকে।
–“ কি হয়েছে আমার এ্যাঞ্জেল? ওদিকে চলে গেলে যে পাপার কাছে আসবে না!
এই প্রথম নিজেকে মেয়ের সামনে পাপা দাবি করলো শ্রেয়াণ! কন্ঠণালী কাঁপছে তার।দেহে অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করছে, চোখ দুটোও জ্বলে উঠছে বোধহয়! কান্না আসবে? কিন্তু পুরুষ মানুষের তো এতো সহজে কান্না সাজে না? তাদের চোখে জল আসতে নেই ঠুনকো বিষয়ে! অল্পক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো শ্রেয়াণ। সম্বিত ফিরে নেহমাতের কান্না জড়িত কথায়–“ তোমরা সবাই পঁচা, কেউ ভালোবেসো না আমায়!
প্রথা কে একবার দেখে মেয়েকে দ্রুত কাছে টেনে আনে শ্রেয়াণ। বাহুডোরে আবদ্ধ করে অস্থির চিত্তে বলে–“ অ্যাঞ্জেল কাঁদছো কেনো?কে ভালোবাসে না তোমায়?
ঠোঁট বাঁকিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছে মেয়েটা কিন্তু শ্রেয়াণে ঘাড়ে মুখ গুজে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে।
–“ তুমিই আমার পাপা আগে বলো নি কেনো?কতো মিসড করতাম তোমায়, জানো তুমি? স্কুলে সবার পাপা আসে কিন্তু আমার পাপা আসে না, তখন তোমার কথা কতো বার মনে পড়েছে সে খেয়াল রেখেছো তুমি?
নাক টানতে টানতে ক্রন্দনরত গলায় পাপার জন্য জমিয়ে রাখা কথাগুলো উগলে দিচ্ছে নেহমাত।আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে চোখ বুজে নেয় শ্রেয়াণ। গভীর মনোযোগে মেয়ের অভিযোগ, অভিমানের বহিঃপ্রকাশিত বাণী শ্রবণ করছে।
–“ কথা বলছো না কেনো?
–“ স্যরি মাম্মা ভুল হয়ে গেছে পাপার।আর কখনো তোমায় ছেড়ে হারিয়ে যাবো না–এই পাপা প্রমিজ করলো!প্লিজ অ্যাঞ্জেল আর কাঁদে না।দেখো অ্যাঞ্জেল কাঁদছে তাই তার পাপা’রও কান্না আসছে। তুমি তো পাপা কে অনেক ভালোবাসো?তুমি কি চাও পাপাও কান্না করুক?
ঘাড় থেকে মুখ তুলল নেহমাত। নিষ্পাপ চোখ জোড়ায় নির্মল অশ্রু চিকচিক করছে। কান্না থামিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে আছে।শ্রেয়াণ বিমোহিত হেসে কপালে, দু গালে পরম মমতায় চুমু এঁকে দেয়। বিনিময়ে নেহমাত ও চুমু ফেরত দিয়ে বলে–“ আর কখনো হারিয়ে যাবে নাতো আমাদের ছেড়ে?
–“ এই যে,কানে ধরেছি আর কখনো হারিয়ে যেতে দেবো না তোমাদের আর না আমি হারিয়ে যাবো!
–“ প্রমিজ!
–“ পিঙ্কি প্রমিজ।
বুকে লেপ্টে থাকে নেহমাত।কোমল হাতে যথাসম্ভব আঁকড়ে ধরে গভীর ভাবে, যেনো ছুটে যেতে না পারে।
আশপাশে সবার পাপা কে দেখে মাম্মিকে জিজ্ঞেস করেছিল–সবার পাপা আছে,তার পাপা কোথায়?প্রথমে জবাব না মিললেও পরবর্তীতে মাম্মি বলেছিল– একটা এক্সিডেন্টে মাম্মি আর ছোট্ট নেহমাত তার পাপার কাছে থেকে হারিয়ে গেছে অজানায়। তখন প্রথা আরো অনেক কিছুই বলেছিল কিন্তু ছোট নেহমাতের মাথায় কেবল একটা কথায় ঢুকেছিল –পাপা হারিয়ে গেছে! এবং তাকেই পাপা কে খুঁজে বার করতে হবে! পরদিন থেকেই মেয়েটা নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরতো আর হাজারো অপরিচিত মুখশ্রীতে খুঁজে বেড়াতো পাপা নামক স্বত্তাটিকে।
চোখে জমায়েত পানি মুছে নিয়ে অধর কোণে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে তুলে প্রথা।মেয়ের কাছে পাপাকে দিতে পেরে সার্থক মনে হচ্ছে!আজ এতো সুখী সুখী লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র সুখী সে নিজেই!অন্তর স্থল থেকে গর্বে যেনো হৃদয় চিরে আসতে চাইছে!
প্রথার গা ঘেঁষে বসে মিধিরমিধির চোখে এদিক থেকে ওদিক নজর বুলিয়ে বেড়াচ্ছে ফিহা।কিছু কিছু বোধগম্যও হয়েছে ইতোমধ্যে।বাড়িতে ছোট মায়ের ছবি প্রায়ই দেখেছে সে,প্রথা কে প্রথম দেখায় চিনতে ভুল হলেও নেহমাতের পাপা ডাক আর সম্মুখে ছিটিয়ে থাকা ছবি দেখে বুঝতে বাকি নেই এরাই দিদুনের ভাষ্যমতে তার ছোট মা আর বোন। যাদের কথা বলে দিদুন তার সাথে গল্প করতো। আবার মাঝে মাঝে ছোট মার ছবিও দেখাতো।
ফিহার মাথায় হাত বুলিয়ে কোলের কাছে বসিয়ে আদর করে দেয় প্রথা।মেয়েটা সেই থেকে চুপচাপ বসে মাথা দুলিয়ে যাচ্ছিল এদিক ওদিক।
–“ নিহাত ,তুমি তো দাদুভাইয়ের সাথে কথায় বলো নি একবারো। যাওনা নিচে, কথা বলে এসো!তোমার সাথে গল্প করতে দাদুভাই অপেক্ষা করছে হয়তো!
শ্রেয়াণ কে ছেড়ে প্রথার উদ্দেশ্যে চোখ তুলে নেহমাত। পিটপিট করে কতক্ষন তাকিয়ে শ্রেয়াণের গলা জড়িয়ে আহ্লাদি গলায় বলে–“ পাপা!
–“ পাপা আছে তো এখানে। কোথাও যাবে না!
কেমন যেনো ভ্রু কুটি করে চায় শ্রেয়াণ। চোখাচোখি হতেই নজর সরিয়ে নেয় প্রথা।শ্রেয়াণ তপ্ত শ্বাস টেনে নেহমাত কে বলে –“ গুড অ্যাঞ্জেল।পাপা এখানেই থাকবে,তুমি বরং দাদুভাইয়ের সাথে কথা বলে এসো, কেমন?
ঠোঁট উল্টে ক্ষণকাল চেয়ে থেকে –“ ওকে!বলে ফিহার হাত ধরে দুজনে প্রস্থান করে কক্ষ হতে।প্রথা উঠে গিয়ে দ্বোর লক করে পিছে মুড়ে তাকায়। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। বুকের ভেতর এক চাপা ধুকধুকানি চলছেই। ধীরস্থির পায়ে শ্রেয়াণের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কথাগুলোও যেনো পেট থেকে গলা অব্দি এসে আটকে আছে,মুখে ফুটতে যতো দ্বিধা।এতো দ্বিধা কিসের? মনে হচ্ছে শ্রেয়াণ কে আজ নতুন করে চিনেছে,দেখছে!গলা পরিষ্কার করে আরো নিকটে চলে যায় প্রথা। ইতস্তত মুখাবয়বে চুলে হাত বুলিয়ে কিছু বলবে তার আগেই একটানে বেডের উপর ফেলে তার উপর শরীর এলিয়ে দেয় শ্রেয়াণ। আকস্মিক আগ্রাসনে থমকে যায় প্রথা। আকষ্মিকতার রেশ কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় আক্রমণের শিকার হয় রমণী। অনতিবিলম্বে শ্রেয়াণ অধরে অধর ডুবিয়ে দিয়ে গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় আস্বাদন করছে অধর মিঠা। চোখ দুটো খিচে রয় প্রথা। প্রতিবাদ করে না আজ। মনের ঘৃণা ভিড়িয়ে এসে একটু ভালোবাসার ছোঁয়া অনুভব করতে ক্ষতি কী?
এভাবে কতোক্ষণ ছিল কে জানে! হাঁপিয়ে উঠতেই শ্রেয়াণ উবু হয়ে মুখ তুলে তাকায়। আঁখি যোগল বন্ধ প্রথার অধর কাঁপছে থির থির।ভারি নিঃশ্বাস নেয়ার ফলে বক্ষস্থল ওঠানামা করছে চরম হারে। খুব গভীর চোখে দেখলে দেখা যায়,তার চোখ বেয়ে একবিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। শ্রেয়াণ চেয়ে রয় অপলক।মুখ বাড়িয়ে দুচোখে ঠোঁট ছুঁইয়ে পাশে শুয়ে পড়ে সিলিংয়ের দিকে নজর নিবদ্ধ করে।উপরের ভারি অস্তিত্ব সরে যেতেই মিটমিট চোখ খুলে তাকালো প্রথা। ঠোঁটে হাত দিতেই জ্বলে উঠল কিঞ্চিৎ।ঘাড় কাত করে পাশে নজর স্থির করে।মুখটায় লাজে আবিরের মেলা ভার করেছে।বহু বছর আগে শ্রেয়াণের প্রথম ছোঁয়ায় যেভাবে লাজ রঙা হয়েছিল?অনেকটা তেমনি।
অন্ধকার রুমে মোমের স্নিগ্ধ রূপালী আলো ঝকঝক করছিল তখন। চারপাশে গোলাপের পাপড়ির ছড়াছড়ি। বিছানা ভরে আছে বেলী, গোলাপ সহ নানা ফুলের সমারোহে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বধুবেশী কন্যা দাঁড়িয়ে আছে শির নিচু করে।চোখে তার অজানা উত্তেজনা,কিছুটা ভীতি। দু’পাশের গাল লজ্জায় লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।তার ঘাড়ে চোয়াল ঠেকিয়ে দুহাতে কোমর জড়িয়ে বন্দিনী করে রেখেছে শ্রেয়াণ।চোখের মোহনীয় দৃষ্টি আয়নায় ভেসে উঠা লজ্জা রাঙ্গা বধুর প্রতিবিম্বের উপর ন্যস্ত।পিঠের গোমড়া সরিয়ে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াতেই নড়েচড়ে উঠে রমণী।এই প্রথম কোন পুরুষালী গভীর ছোঁয়ায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে অজানা শিহরণ বইছে তার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। অস্থিরতা বাড়ছে রক্ত সঞ্চালনে। চোখ খিচে শ্রেয়াণের হাত কামচে ধরে মেয়েটা। দম রুদ্ধকর পরিস্থিতি প্রায়। মৃদু হাসে শ্রেয়াণ।
–“ সেই প্রথম থেকে হাজার বার ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছি অথচ মহারাণী মুখ ফুটে একবারো বলেননি–ভালোবাসি!
–“ তো?
–“ বলো ভালোবাসি!
–“ মুখে হাজার বার ভালোবাসি বললে ভালোবাসা হয়ে যায় না মিস্টার।তাকে অনুভব করতে হয় নিঃশব্দে। উপলব্ধি করতে হয় হৃদয়ে হৃদয়ে!
–“ চিঁড়ে ভিজবে না এমন সাহিত্যক কথায়। ফটাফট বলে ফেলো–শ্রেয়াণ জান আমি তোমাকে ভালোবাসি!
প্রথাকে চুপ দেখে তাড়া দেয় শ্রেয়াণ –“ কী হলো তাতাড়ি বলো?দেখো আমার কান নিসফিস করছে তোমার মুখে –ভালোভাসি শব্দটা শুনতে।
আরেকটু গভীর হয় শ্রেয়াণ। কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রথা বলে–“ ভালোবাসি!
–“ উহু,হয়নি!আরো রোমান্টিক ভাবে বলো?
–” ভালোবাসি ঠিক ততোখানি, যতখানি ভালোবাসা পেলে শ্রেয়াণের এ জনম সার্থক!ভালোবাসি ঠিক ততোখানি, যতখানি ভালোবাসা পেলে শ্রেয়াণের প্রতিটি ভোরের সূচনা হবে এক অমল সোনালি আলোয় ভাসা সুরভিত প্রভাত। তোমাকে ভালোবাসি সেই অনন্ত নীলে হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের মতো,
যার আলো শেষ হয়ে গেলেও তার অস্তিত্ব থেকে যায় অসীম মহাকাশের বুকে।
বিমুগ্ধ হয়ে প্রথার নিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে শ্রেয়াণ সন্দিহান গলায় বলে–“নিজেকে ক্রেডিট দিলে নাকি আমায় ভালোবাসি বললে?
–“ যা ধরে নাও? উপন্যাস প্রেমি ছিলাম তো একসময়!
–“ তাইতো বলি,এতো কঠিন ভাষা প্রয়োগ করে কিভাবে আমার প্রাণ?
মৌন রইলো রমণী।বন্দি হতে মুক্ত করে নৈঃশব্দে প্রথাকে দাঁড় করায় মুখোমুখি। তারপর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে দুটো গিফট বক্স তুলে ধরে।একটাতে রূপালী রঙের স্বর্ণের ব্রেসলেট, অন্যটায় সিলভার রঙের পায়েল। বাক্যবিনিময় ছাড়া প্রথার ডান হাতের কব্জিতে ব্রেসলেট পড়িয়ে দিয়ে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে শ্রেয়াণ।পায়েল হাতে প্রথাকে ইঙ্গিত দিয়ে বলে –“ পা টা রাখো এখানে?
চোখের ইশারায় হাঁটুর দিকে পা রাখতে বললে দুকদম পিছিয়ে যায় প্রথা–“ অসম্ভব!পা রাখতে পারবো না আমি!
–“ আমি যখন অনুমতি দিয়েছি অবশ্যই রাখতে পারবে ,(মজার ছলে বলে–পরে না হয় সালাম করে নিও!দাও দাও তাতাড়ি।রাত কিন্তু পেরিয়ে গেছে অর্ধেক! বাসর হবে কখন?
ইঙ্গিত বুঝে ফের লজ্জায় মিইয়ে গেল প্রথা।তাড়া পেয়ে কম্পনরত পা বাড়িয়ে দেয় শ্রেয়াণের ঊরুতে। নিজ হাতে পায়েল পড়িয়ে দিয়ে যেই মুখটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়েছে ,ওমনিই প্রথা মিনতি সুরে বলে উঠে –’’ প্লিজ মুখ ঠেকিয়ো ধরে পায়ে?
বিরক্তিতে তাকায় শ্রেয়াণ –“ এতো দ্বন্দ্ব কিসের,তুমি তো বাধ্য করোনি আমায়? ভালোবেসেই দিচ্ছি ইয়ার!
কথা শেষে পায়ে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায় শ্রেয়াণ।প্রথা চোখ মুখ খিঁচে মাথার চুল খামচে ধরে শ্রেয়াণের। শিরদাঁড়া বেয়ে শিতল কিছু বয়ে যাচ্ছে তার। হৃদযন্ত্রটাও আলোড়ন তুলেছে অস্থিরতার আন্দোলনে।
শ্রেয়াণ কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।দেখতে থাকলো টকটকে লাল বেনারসী শাড়িতে মুড়ে থাকা অর্ধাঙ্গিনী কে। যেন এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। রূপের অপার মহিমায় বিমোহিত করছে শ্রেয়াণ কে। সূক্ষ্ম জরির কাজ করা শাড়ির আভা তার মোহময় উপস্থিতিকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলছে। সোনালি অলঙ্কারে অলংকৃত।প্রথাও তাকায় শুভ্র রঙা শেরোয়ানি পরিহিত সুদর্শন পুরুষের উদ্দেশ্যে।
হুট করে কোলে তুলে ব্যালকনির দিকে হাঁটা ধরে শ্রেয়াণ। নির্দ্বিধায় তার গলা আঁকড়ে রাখে প্রথা।কাউচে বসে শক্ত আলিঙ্গন করে প্রথার ঘাড়ে মুখ গুঁজে অস্থির চিত্তে বলে উঠে –“ আমি মনে হয় উম্মাদ হয়ে যাচ্ছি প্রাণ।অবশেষে তুমি আমার।আমৃত্যু আমারই থাকবে। ইচ্ছে করছে এই বক্ষ পিঞ্জরে লুকিয়ে ফেলি তোমায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরো না প্রাণ!
সেদিন দুজন কপোত কপোতী একে অপরের রঙে নিজেদের রাঙিয়েছিল। ভালোবাসার দ্বিতীয় ধাপের সাথে নতুন পরিচতি লাভ করেছিল প্রথা। যন্ত্রণাময় এক সুখের সাগরে পাড়ি দিয়েছিল শ্রেয়াণের হাত ধরে।
—
ঘরটি নিস্তব্ধ কিন্তু নিস্তেজ নয়। এক পুরুষ,এক নারী দুজনেই নিশ্চুপ অথচ তাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সূক্ষ্ম স্পন্দন বা কখনো দৃষ্টির অদৃশ্য বিনিময়,কখনো বা দীর্ঘশ্বাসের মৃদু আঁচ। মৌনতা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয় শ্রেয়াণ।বুক ভর্তি শ্বাস টেনে সিলিংয়ে দৃষ্টি সেঁটে নির্বিকারে বলে–“ মানছি যে ভুল আমিই করেছি কিন্তু সেদিন আমাকে সবকিছু এক্সপ্লেইন করার সুযোগ না দিয়ে পালিয়ে গেছিলে অধরায়। পাঁচটি বছর এমনতেই চলে গেলো,যাও ক্ষমা করে দেবো, এখন ফটাফট –স্যরি বলে ফেলো?
তেড়ে আসে প্রথা। যদিও স্যরি শব্দটা ঠোঁটের কিনারায় এসে ভার করেছিল কিন্তু শ্রেয়াণের কথায় যেনো উবে গেল সেটা।
–“ সেদিন আপনি ওই বা!জে মেয়ের সাথে ইন্টি!মেট না হলে আজ পরিস্থিতিটাই হতো ভিন্ন। চরিত্রহীন পুরুষ!আমি আজো মানতে পারিনা যে আপনি আমাকে ছেড়ে আমারই সামনে অন্য একটা মেয়ের সাথে –ছিঃ।আমি..আমি
বলতে বলতে পুরোনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে সূর্যোদয় ন্যায়। গলা ধরে আসছে তার কান্নার দাপটে। চোখের কোণে অশ্রু বিন্দুর উপস্থিতি দেখা দিয়েছে। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে প্রথার নিকটে চলে আসে শ্রেয়াণ। দুহাতে বাহু ধরে অস্থির গলায় বলে –“ বিশ্বাস করো ঔ মেয়েকে আমি ওতোটা গভীর ভাবে টাচ করিনি যতোটা তুমি দেখেছো। ব্ ব্যাস…
–“ বিশ্বাস করিনা আমি! আপনি তার সাথে চুম্মা চাটি করছিলেন আমি নিজে দেখেছি।
–“ ট্রাস্ট মি।ঔ রাস!ক্যালের হায়ার করা ছিল ঔ মেয়েটা। তোমাকে দেখেছিলাম অফিসে ঢুকতে তাই আগে থেকেই পজিশন নেয়া ছিল। ট্রাস্ট মি ওকে চুমু খাইনি আমি ব্যাস কাছাকাছিই ছিলাম, তাই দূর থেকে ব্যাপারটা বা!জে দেখাচ্ছিলো।বাবা তো বলেছে না?আমি নিরুপায় ছিলাম!
–“ আমি বন্ধ্যা?
দুহাতে কান ধরে তড়িৎ দুদিকে মাথা দুলিয়ে–না! জানায় শ্রেয়াণ।প্রথা ফের বলে–“ এক শরীরে আপনার পোষায় না?
প্রথার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে শ্রেয়াণ –“ স্যরি!আমি তো ইচ্ছে করে ওসব বলিনি,না?যাতে তুমি হার্ট হও তাই বলেছিলাম!এখনো মনে আছে ওসব কথা?
–“ থাকবে না?গত পাঁচ বছরে রোজ উঠতে বসতে কথাগুলো তাড়া করে বেড়াতো আমায়! মনে হতো আপনি আমার আশেপাশেই আছেন আর কথাগুলো চিৎকার করে বলছেন কানের কাছে!ঔই বাজে দৃশ্যটা? কাজের ব্যস্ততা থেকে বেরিয়ে যখন স্বস্তির জন্য একলা বসে চোখ বুঝতাম তখন ই ভেসে উঠতো চোখের সামনে। তখন কী ইচ্ছে করতো জানেন?পুরো পৃথিবীটা তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করতো। আপনার কলার ঝাঁকিয়ে বলতে মন চাইতো–কেনো ঠেকালেন আমায়?এতো বড় শাস্তি দিলেন? আপনার কী একটুও এই প্রথার জন্য মন কাঁদেনি?তার চেহারা টা একবারের জন্যও ভেসে উঠেনি যখন অন্য মেয়ের সান্নিধ্যে যেতেন?
শ্রেয়াণের বাহুডোরে আবদ্ধ থেকে ডুকরে কেঁদে কেঁদে উঠছে প্রথা।মেয়ের মতো তার মাও যেনো হৃদ গহীনে জমায়েত কষ্ট উপড়ে ফেলছে শ্রেয়াণের বুকে।হালকা করতে চাইছে নিজেকে।দহন কমাতে চাইছে হৃদয়ের।
কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয় শ্রেয়াণ –“ ভুল করে ফেলেছি আমি! বড্ড বেশি! প্লিজ শাস্তি দাও? কেঁদো না প্রাণ!সহ্য করতে কষ্ট হয় বুকে। ফেটে আসতে চাইছে দেখো।
#চলবে ইনশা-আল্লাহ