#বড়োজা
#Nadia_Afrin
৬
খালার বাড়িতে আটদিন টিকতে পেরেছিলাম আমি জানেন?
আট দিনের দিন ঘটেছিল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।
এতে অবশ্য আমারই লাভ হয়েছে।
বলব সবই আজ।তবে একটু পর।
পরদিন সকালে বেশ ভোরে উঠেছি।মাছ কেটে অনেক রাত হয়েছে ঘুম আর হয়নি।
বিছানায় শুয়ে অলস ঘুম না ঘুমিয়ে উঠে পড়েছি।
নামাজ শেষে দোয়া পরছিলাম,এমন সময় খালা এলো।
বলল,”এতো সকালে ঘুম ভেঙেছে?
যাক ভালো।সকাল সকাল উঠবে কাজ করবে।ছেলেকেও উঠিয়ে দেবে।তুমি উঠোন ঝাড় দিলে ওকে ঘর ঝাড় দেওয়াবে।দুজন মিলে কাজ করবে সময় বাঁচবে।
আমার কাজ গুলোও করবে।কাজ করলে শরীর ভালো থাকে।
চলো তবে উঠোন ঝাড় দিয়ে সবজি কুটে দেবে।”
“আমি কেন আপনার বাষী উঠান ঝাড় দেব খালা?
যতোদূর জানি,যার বাষী তারই সারতে হয়।
আপনি বরং ঝাট-ঝাড় দিয়ে নিন।
আমি যেয়ে সবজি কেটে দেব।”
“একবেলা ঝাড় দিলে হাত ক্ষয়ে যাবে নাকি তোমার?”
“আপনি দিলেও তো ক্ষয়ে যাবেনা।”
খালা রাগ করেছে আমার কথায়।
তাতে আমার কী?যোগ্য জবাবই দিয়েছি আমি।
একটু পর তার বাড়ি গেলাম।
আজ আলু-বেগুন দিয়ে ছোট মাছ রান্না করবে।
কুচি করে কেটে দিয়েছি সব।
তিনি চুলোতে ভাত বসিয়ে বলল,”হিসেব মতো তোমার আজও আমার দোকানের সবজি কেটে দেওয়ার কথা।কাল বিকেলে রান্নার সময় চাল ধুয়ে দাওনি।কোথাও যেন চলে গেছিলে।
তাই ঐ কাজের বদলে আজ এটা করার কথা ছিল।
কিন্তু করতে বললে আবার ঝগড়া শুরু করবে।তোহ থাক।
তুমি সবজি কেটে বাথরুম-টয়লেট পরিষ্কার করে দেবে।শোধ হয়ে যাবে।”
“পারব না খালা।
একবেলা চাল ধুইনি দেখে বাথরুম পরিষ্কার করব?
কাল ঝাড় দিয়ে দিয়েছি।সেটার সঙ্গে শোধ দিন।”
“তুমি মেয়ে বড়োই কথা বলো।তোমায় ভালো ভেবেছিলাম।আচ্ছা থাক করতে হবেনা কিছু।
সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছ তো বুঝছো না।
কোন বাড়ির বাড়িওয়ালা নিজে রেধে খাওয়ায়?
আমি খাওয়াচ্ছি তোমায়।”
“আমিও টাকা দিয়ে খাচ্ছি খালা।”
খালা কিছু বলল না আর।আমি কুটা বাছা শেষ করে বের হতে যাব এমন সময় তিনি বলল,”কাল কোথায় গিয়েছিলে?”
বলি,”কাজের সন্ধ্যানে।একটা কাজ পেয়েছিও বটে।
নাইট ডিউটি।তবে,,,,”
আমার মুখের কথা খালা কেড়ে নিয়ে বলল,”তাহলে রাতে খাবেনা?অফিসে থাকবে?
ভালোই হলো।খাবার বেঁচে গেল আমার।”
“ডিউটি বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা।এরপর বাড়ি ফিরে আসব আমি।
রাতের খাবারও খাব।
আপনার যদি খাবার দিতে এতোই সমস্যা তো বলে দিন।
কাজ আমি পেয়েই গেছি।আলাদা খাই।
তবে এই একদিন খাবারের টাকা কিন্তু দিতে পারব না।”
খালা মুখ ছোট করে বলল,”আমি কী সে কথা বলেছি?
বেশি বোঝো তুমি।
বাড়ি যাও।খাবার দিয়ে আসব।”
আমি কিঞ্চিৎ হেসে চলে এলাম।মহিলা শিক্ষা পেয়েছে ভীষণ।
আজ দেখলাম তাড়াতাড়িই খাবার নিয়ে এসেছে।
মাছের সঙ্গে ডালও রান্না করেছে।কিন্তু তরকারির বাটি একটি।
ওনার সামনেই ঢাকনা খুললাম।যা ভেবেছিলাম তাই।বড়োমাছ সেদিন তাই শুধু তরকারি দিয়েছিল।আজ তরকারি টাও দেয়নি মাছ ছোট বলে।
শুধু ডাল-ভাত আর একটা বড়ো পেয়াজ।
খালা একগাল হেসে বলল,”পেয়াজ কামড়ে ডাল দিয়ে মাখিয়ে ভাত খাও।দেখবে হেব্বি মজা।”
এইটারই অপেক্ষা করছিলাম আমি।কাল এজন্য কিছু বলিনি।উনি ঠিক অযুহাত দেখিয়ে দিত একটা।এবার কী করবে?এবার হাতেনাতে ধরা।
আমি বুদ্ধি খাটিয়ে সম্পূর্ণ ডালটা ভাতের মাঝে ঢেলে বাটিটি তাকে দিয়ে বললাম,”মাছের তরকারি আনুন খালা।সঙ্গে মাছও।
কাল মাছ কাটিয়ে নিলেন খাওয়ার জন্য এখন দেবেন না?
বড়ো মাছ ও দেননি।আজ তো দিতেই হবে।
বলেছিলেন আপনারা যা খাবেন আমাকেও তাই দেবেন।আলাদা কিছু নয়।
তাহলে মাছের অংশীদার তো আমিও তাইনা?”
খালা খপ করে বাটিটি হাতে নিয়ে বলল,”আমি কী বলেছি দেব না।ওতো একসাথে আনা যায়না তাই আনিনি।
দাড়াও এনে দিচ্ছি।
খাবার নিয়ে কতো কথা বাবা।”
তিনি হনহন করে চলে গেল।
কিছুসময় পর বাটিতে তরকারি এনে দিল।
ছেলে নিয়ে খেতে বসলাম।তরকারি প্রচুর ঝাল।
বাটি উঠিয়ে ঝোলের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝলাম,আলগা গুড়ো মরিচ যুক্ত করেছে তরকারিতে।
যেন আমি খেতে না পারি।
সত্যিই খেতে পারিনি।ছেলেটা একবার খেয়ে আর খায়নি।
খালার হাসির শব্দ পেয়েছি।
খালা নামের ডাইনি ইনি।
ঘটি-বাটি কাল সবই আলাদা করব।যা হয় হবে।ছেলেটাকে না খাইয়ে রাখতে পারব না।
আবারো সেই কলা পাউরুটি কিনে এনেছি।সকাল দুপুরে খাব তাই বেশি করে এনেছি।
খালা ঘরে ঢুকে গল্প করার অযুহাতে দেখি একটা দুটো করে পাউরুটি নিয়ে খায় আর বলে,”যা খাবে আমায় দিয়ে খাবে।
আমি বয়স্ক মানুষ।”
প্রচন্ড রাগ হলো আমার।
এতো হ্যাংলা কেন ভাই?
সন্ধ্যায় ছেলেকে পড়তে বসিয়েছি।খালা এসে লাইট অফ করে দিয়ে যায়।
বলে বাইরে জোছনার আলো আছে।ঘরের দোয়ারে বসে পড়াও।ডাক্টার, ইঞ্জিনিয়ার হবে।
আমি বলি,আমার ওতো দরকার নেই।
সেদিন ঘরে দুটো সিদ্ধ ডিম কিনে এনে রেখেছি।
খালা খুঁজে খুঁজে একটা নিয়ে গেছে।
বিরক্ত হয়ে বললাম,”এভাবে চলতে থাকলে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব হবেনা এ বাড়ি।
কী শুরু করেছেন আপনি?
পাগল পেয়েছেন আমায়?
মুরগি রান্না করে আলু-ঝোল দিয়ে ভাত দেন।মাংস চাইলে মরিচ মিশিয়ে দেন।
ভাতের পরিমাণ এতো কম যে ছেলেরই খাওয়া হয়না এখন।সকালে পান্তাও দিচ্ছেন।নিজেরা ঠিকই গরম ভাত খাচ্ছেন।ছেলে নিয়ে পান্তা খাওয়া যায়?
আমার বেলা যতো অভাব আপনার তাই না?
আমার মাপের খাবার দেওয়ার কথা।দেন পাখির খাবার।
বাতি জ্বালাতে দেবেন না ঘরে,বিল ঠিকই নেবেন।ঘরে কিছু রাখলে নিয়ে যান।
কোথায় কী রেখেছি সারাদিন ঘুটে বেড়ান।
আটশ টাকা ধার নিয়েছেন দেওয়ার নাম নেই।
সবজি কিনতে গিয়ে বলেন আপনার ছেলেরা বিদেশ থেকে ডলার পাঠায়।সেই ডলার ভাঙিয়ে সামান্য সবজি কিনবেন না।দশ-বিশ টাকা আমায় দিতে বলেন।
ডলার ধুয়ে পানি পাবেন আপনি?
এমন বাড়িওয়ালা আমি জীবনে দেখিনি।
আমি সামনের মাসেই ছেড়ে দেব এই বাড়ি।প্রয়োজনে রাস্তায় গিয়ে থাকব।তবুও এই নরকে থাকব না আর।”
খালা কিছু না বলে চলে গেল।অপমানে বেচারার মুখ দিয়ে কথা নেই।
ঐদিন বিরিয়ানি রান্না করবে,চিকেন বিরিয়ানি।
সব গুছিয়ে করে দিয়ে এসেছি।
ছেলেকেও বলেছি।ছেলে আমার মহা খুশি।দুপুরেও খায়নি।বিরিয়ানি পেট ভরে খাবে তাই।
রান্না শেষ হয়েছে সন্ধ্যায়।মহিলা খাবার দিয়ে গেল দশটায়।
তাও রাইস আর হাড়গোড়।মানে উনারা হাড় চিবিয়ে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে গেছে।
খাবার দেখে ঘৃণা করতে নেই।কিন্তু আমার ঘৃণাই পাচ্ছে।মহিলার আসলেই লজ্জা নেই।
ছেলে ওখান থেকেই খেতে চাইল।ক্ষিদে পেট কিনা।
আমি খেতে দেইনি।
দু ভাই-বোনকে ঘরে রেখে প্লেট নিয়ে খালার বাড়ি গেলাম।
খাবারের থালাটা ওনার মুখের সামনে ধপ করে রেখে বললাম,”এসব কী দিয়েছেন?মানুষের খাবার দিয়েছেন নাকি কুকুরের খাবার?
আমায় কুকুর মনে হয় আপনার?”
আঙ্কেল ঘরেতেই ছিল তখন।আমার চিৎকারে এগিয়ে এলো।
খালা খাবার দেখে বলল,”ভুল হয়ে গেছে।এটা ফেলে দেওয়ার জন্য রেখেছিলাম।ভুলে তোমায় দিয়ে দিয়েছি।
তোমার জন্য বেড়েই রেখেছি।”
সবই মিথ্যা।উনি ভেবেছিল অন্য সময়ের মতো এবারও সবটা সহ্য করে নেব।
উনাদের এঠো খাবার খাব।
একটা মানুষ কতো সহ্য করতে পারে আর?
আমার অসহ্য হয়ে গেছে।
আমি আবারো চেচিয়ে বললাম,”তাড়াতাড়ি ভালো,নতুন খাবার দিন।”
সে থালা নিয়ে রান্নাঘরে গেল।পিছে গেলাম আমিও।হাড়ি খুলতে চাইল না।
আমি নিজেই হাড়ির মুখের ঢাকনা তুললাম।
প্রায় অর্ধেক হাড়ি খাবার আছে এখনো।সকালে বাষী খাবে,অথবা ফেলে দেবে।তবুও আমায় দেবেনা।
টাকা নেওয়ার বেলা নেবে।
আমায় দিলে নাকি আমার লোভ হবে।মন্দ আর খেতে চাইব না।
খালা থালাতে খাবার বাড়ে।হাত তার কাপছে।খাবার যেন ওঠেই না হাত দিয়ে।
বাধ্য হয়ে আমি নিজেই চামচ কেড়ে নিলাম।
প্লেট ঠেসে খাবার নিয়েছি।মাংস ও নিয়েছি।
খালা চুপচাপ দেখেছে শুধু।
আমি খাবার নিয়ে ঘরের বাইরে আসব এমন সময় খালা কেমন যেন হয়ে গেছে।
বারবার বলছে,আমার সব খাবার নিয়ে গেল।
এই মেয়ের সঙ্গে জুদ হচ্ছেনা।একে সরাও।
আমি পাত্তা দেইনি।
খাবার নিয়ে ঘরে এসেছি।ছেলে নিয়ে পেট ভরে সবটা খেয়েটি।অনেকদিন পর তৃপ্তি করে খেয়েছি।
পরদিন শুনলাম খাবারের শোকে খালার জ্বর চলে এসেছে।
এই প্রথম কারো অসুস্থতা শুনে হাসি পেল।
খাবারের জন্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভাই।
দু-দিন খালার জ্বর ছিল।
দু-দিনের দিন তিনি আমার বাড়ি এলেন একজন মহিলা নিয়ে।
ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখাচ্ছেন।
আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে বসেছিলাম।
অপরিচিত কারো কন্ঠ শুনে বেড়িয়ে এলাম।
খালা আর ঐ মহিলা কথা বলছে।
খালার মুখে প্রচন্ড হাসি।কথা শেষে তিনি আমার কাছে এসে বলল,”তুমি তো নাকি আমার বাড়ি ছেড়েই দেবে।
ছেড়ে যখন দেবে আজই দাও।
ভাড়া এসেছে।এই মহিলা স্বামী নিয়ে থাকবে।মাস শেষে বারোশো টাকা দেবে।তোমার চেয়ে পাঁচশ বেশি।
জিনিস পত্র গুছিয়ে বের হও।”
বিশ্বাস করুন,আমি ঠিক এটাই চাচ্ছিলাম।
মেয়েকে ছেলের কোলে দিয়ে বাইরে এলাম।
চেচিয়ে চেচিয়ে বলতে লাগলাম,”আপনি কীভাবে আমায় বের করে দিতে পারেন?
এক মাসের ভাড়া অগ্রিম নিয়েছেন।কারেন্ট বিল দিয়েছি।
ভাঙা ঘর সেরে নতুন করেছি আর এখন বেশি টাকায় অন্য জনের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন?”
খালা আমায় আস্তে কথা বলতে বলে।
আমি চিৎকার করি দ্বিগুণ।
পাড়ার কিছু মহিলা যাচ্ছিল ওপথ দিয়ে।
আমার চিৎকার শুনে বাড়িতে ঢোকে।
আমি তাদের সামনে গিয়ে বলি,”দেখুন না,উনি আমার প্রতি অবিচার করছে।
আমার কেউ নেই।ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিপদে পড়ে এনার বাড়িতে থাকতে এসেছি।
ভাঙা ঘর ছিল,নিজের টাকায় সারিয়েছি।টিন কিনে বেড়া দিয়েছি।দরজা সেরেছি।টয়লেট, টিউবওয়েল বেড়া দিয়েছি, পরিষ্কার করেছি।
ঘরে মাটি এনে ঠিক করেছি।
সব যখন ঠিক করেছি,বেশি টাকার ভাড়া এসেছে।উনি আমায় বের করে দিচ্ছে।
অগ্রিম ভাড়া নিয়েছে আমার থেকে।কারেন্ট বিল নিয়েছে।লাইটের টাকা নিয়েছে।
আমার থেকে আটশ টাকা ধার নিয়েছে।
দশবিশ টাকা করে ষাট টাকা নিয়েছে।
এবার আমার সব ফেরত না দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।”
মহিলাগুলো একজোট হয়ে বলল,”ওর সব টাকা ফেরত দাও দ্রুত।ভাড়া দিয়ে নির্যাতন হচ্ছে নাকি!”
খালাও চেচিয়ে উঠে বলল,”আমি কোনো টাকা দিতে পারব না।ভাড়া অগ্রিম যেমন দিয়েছে থেকেওছে আটদিন।
ও নিজেই বলেছে একমাস পর চলে যাবে।সেই যাওয়া এখনই যাক।
আমি এনাকে বেশি টাকায় ভাড়া দেব।
আমার বাড়ি আমি যাকে ইচ্ছা দিতে পারি।”
এক প্রতিবেশি বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে বললেন,”বাড়ি তোমার ঠিক আছে।কিন্তু এলাকাটা আমাদের সবার।
তোমার জন্য এলাকার মান-সম্মান নষ্ট করব নাকি?
মাসের ভাড়া অগ্রিম নিয়েছো,আবার মাস না হতে তাড়িয়ে দাও কোন সাহসে?
মেয়েটা দুঃখী।কষ্টের টাকায় ঘর সারিয়েছে।থাকতে যখন দেবেনা ওর সব টাকা ফেরত দাও।তোমার আরো উচিৎ ওকে অগ্রিম দিয়ে বের করা।”
“আমি সারাতে বললেই ও সারাবে নাকি?
ঘরে আগুন দিতে বললে দেবে?
আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি।এখন আমার সঙ্গেই চালাকি হচ্ছে নাকি!খাবার দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম আমি।”
“খাবার কী ফ্রিতে দিতেন আমায়?
কাজ করিয়ে তারপর দু-বেলা খাবার দিতেন।মাস শেষে টাকাতো নেবেনই।
খাবারে যেই অকাজ করেছেন তাতে কোনো মানুষ এখানে থাকতে পারবে না।
বড়ো মাছ,মুরগি রান্না করেও কখনো এক টুকরো দেননি নিজের ইচ্ছায়।
চাইতে গেলে মরিচ মিশিয়ে দিতেন।
ছোট বাচ্চাকেও কম কষ্ট দেননি।
ছেলে আমার পাউরুটি খেয়ে খেয়ে দিন পার করেছে।
একবেলা খাবার দিয়ে গাধার খাটুনি খাটিয়েছেন।
মুখ খোলাবেন না আমায়।লোকে আপনায় ছি-ছিৎকার করবে।
আমার সব টাকা গুলো যদি আমায় না দেন আমি সব খুলে নিয়ে যাব।
টিনের বেড়া,টয়লেটের বেড়া,বাশ সব খুলে নিয়ে প্রয়োজনে তিনভাগের একভাগ দামে বিক্রি করে দেব।তবুও ছেড়ে যাবনা কিছু।এটাই আপনার শাস্তি।”
একজন মহিলা পেছন থেকে বলল,”কমে বেচতে হবেনা।টিনের বেড়াটা আমায় দিও।নতুন আছে একদম।কেটে সাইজ করাও আছে।
আমি আসল দামে কিনে নেব।
বাজারে কিনতে গেলে পরিশ্রমের সঙ্গে কতোটাকা গাড়ি ভাড়া লাগত।
তুমি আমাকেই দিও।”
সেই মহিলা অর্থাৎ যিনি খালার বাড়ি দোকানের সবজি কাটার কাজ করত,তিনি ও ছিলেন সেখানে।
তিনি এসে বললেন,”তন্নি ঠিক কথা বলছে।ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
মেয়েটা বড্ড ভালো।
উনিই শয়তান।মেয়েটার মা-বাবা নেই।এতিম।স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে।
উনার উচিৎ ছিল মেয়েটার পাশে দাড়ানো।
তিনি তা না করে আরো নিয়েছে ওর থেকে।
আমার কাছে তন্নির নামে মিথ্যা বলেছে।
দোকানের সব সবজি যা আমরা দুজন মিলে কাটতাম,তা ঐ মেয়েকে দিয়ে একা কাটিয়ে নিয়েছে।তাও বিনা পারিশ্রমিককে।
উনি চেয়েছিল তন্নিকে কাজের লোক বানিয়ে খাটাবে।বদলে দুটো ভাত দেবে।মাস শেষে আবার টাকাও নেবে।
মানে ওর স্বার্থ পূরণ করাবে অসহায় মেয়েটাকে দিয়ে।এজন্য আমায় কাজ থেকেও ছাড়িয়ে দিয়েছিল।”
আমি বলি,”হ্যা শুধু তাই নয়।আমায় বলেছে রান্নার কাজে সাহায্য করতে।কিন্তু উনি আমায় উনার বাড়ির কাজ পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছে।
রাত বারোটায় মাছ কাটিয়ে নিত।অথচ আমাদের সেই মাছ খেতে দিত না।
ছোট বাচ্চার জন্য কোনো খাবার এনে ঘরে রাখলে না বলেই নিয়ে যেত।খেয়ে নিত।”
এবার দেখছি খালার মুখ শুকিয়ে গেছে।
তবুও বড়ো গলায় বলছে,”আমার বাড়ির টিনে তুমি কোন সাহসে হাত দেবে?”
“যেই সাহসে সারিয়েছি বাড়িঘর,সেই সাহসেই।”
চেচামেচিতে আরো মানুষ এলো বাড়িতে।কিছু লোকও এলো দেখলাম।
খালা যেই মহিলাকে ভাড়া দেবেন সে খালার কানে কানে বলল,”সব খুলে নিয়ে গেলে তো আমি থাকতে পারব না।
ঐ মেয়ের মতো সারিয়ে নিতে পারব না আমি।
আপনি নতুন করে সারাতে গেলেও টাকা বেশি লাগবে কিন্তু।”
দুজন লোক চেচিয়ে বলল,”মেয়ে তুমি সব হিসেব করো।অগ্রিম ভাড়া,ধার,বিল,সারানো সব মিলিয়ে যা খরচ হয়েছে সব হিসেব করে আমাদের জানাও।
দ্বিগুণ টাকা দেবে উনি।
উনার জন্য আমাদের এলাকার সম্মান নষ্ট হচ্ছে।এই একটা মহিলা হলো এলাকার বিষ।
এর আগেও একই কাজ করেছে ইনি।কিছু বলিনি।ভাড়াটিয়া নিয়ে এসে অত্যাচার করা এর স্বভাব হয়ে গেছে।আগের ভাড়াটিয়াকেও এমন অত্যাচার করেছে।
এর নামে অনেক অভিযোগ।গরীব মানুষদের কাজ করিয়ে টাকা দেয়না।
এর ওর বাড়ি থেকে জিনিস নিয়ে খায়।
লোকের গাছের জিনিস চুরি পর্যন্ত করে।
নিজের টাকা-পয়সা থাকা সত্ত্বেও অসভ্যতা যাচ্ছেনা।শাসিয়ে গেছি আমরা দুবার।শোনেনি।এবার একে শিক্ষা দিতে হবে।প্রয়োজনে এলাকা ছাড়া করব।
টাকা আছে বলে মানুষকে মানুষ মনে করেনা।”
আমি হিসেব করে বললাম,”সব মিলিয়ে আমার খরচ হয়েছে তিনহাজার পাঁচশ টাকা।
ধার আটশত টাকা সহ হিসেব করেছি।”
খালা বললেন,”মিথ্যা কথা।ধার পাঁচশ নিয়েছি শুধু কিস্তির জন্য।”
আমি কিছু বলার আগেই একটা মেয়ে এসে বলল,”পরসুদিন না আপনি আমার সামনে তিনশ নিলেন ওর থেকে মাছ কিনে টাকা দিতে।মিথ্যে কেন বলছেন।”
খালার মুখ এবার বন্ধ।নেকা কান্না শুরু করলেন।
বললেন,”এই মেয়ে ইচ্ছে করে এমন করেছে।বিপদে একে আশ্রয় দিয়েছিলাম।এবার আমায় ফাঁসাচ্ছে।
সবাইকে আমার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে।”
“আপনি কেমন মানুষ সেটা সবাই জানে।আমাকে বলতে হবেনা।”
সব হিসেব বুঝিয়ে দিলাম আমি।কোথায় কতো টাকা কীভাবে খরচ করেছি সবই বললাম।
চোখের সামনে জিনিস গুলো প্রমাণ হিসেবেও ছিল।
আমার হিসেব মিলেছে।
লোকগুলো বলল,”আপনাকে আটহাজার টাকা দিতে হবে আমাদের সবার সামনে।না হলে সবাই মিলে গ্রাম ছাড়া করব।”
উপস্থিত সকলে একসঙ্গে তাল মেলায়।
খালা দমেনি তখনো।
বলল,”দ্বিগুণ টাকা কেন দিতে যাব আমি?
পুলিশের কাছে সহায়তা নেব প্রয়োজন পরলে।
সবকটাকে জেল খাটাব।
আর তন্নি তোমাকেও।”
লোকটা আরো বলল,”ডেকে আনুন পুলিশ।পুলিশ আসলে আরো ভালো।আইনি মাধ্যমে গেলে আপনার শাস্তি বেশি হবে,জরিমানাও হবে।
আমরা গ্রামবাসিরা সবাই বলব তোমার অকাজের কথা।
মানহানি ও নির্যাতনের মামলা দেব”
এক মহিলা বলল,” টাকা আত্মসাত ও জালিয়াতির কেস দেব।”
“তন্নিকে আসল টাকা সমেত জরিমানা তোমার দিতেই হবে।তাহলে তোমার শিক্ষা হবে।”
আমি বললাম,”থাক।আমায় শুধু আমার আসল টাকা দিলেই হবে।অন্যের টাকার কোনো লোভ নেই আমার।”
সেই লোকটি আমায় ধমক দিয়ে চুপ করতে বলল।
এতোক্ষণে বুঝলাম,এই লোকগুলো আসলে টাকা খেতে এসেছে।ঝামেলার মাঝখানে টাকা হাতিয়ে নেবে।
এতে আমার দোষ নেই।খালা যদি ভালোই ভালো আমার টাকাটা দিয়ে দিত এমন হতোনা।
নিজের দোষে এবার শাস্তি পাবে তিনি।
বেশি বেড়েছিল।এবার বুঝবে।
অপমানের অপমান ও হলো।টাকাও জরিমানা গেল।
একটা শাস্তির খুব দরকার ছিল এর।যাতে অন্যকারো সঙ্গে এমন আর না করতে পারে।
খালা উপায় না পেয়ে আমার কাছে দৌড়ে এলো।
হাত ধরে বলল,”মা ও তন্নি মা।
আমি তোমার মায়ের মতো।
তোমার ধারের টাকা দিয়ে দেব।তুমি এখানে থেকে যাও।কোথাও যেতে হবেনা।আর ওমন করব না।ঠিক সময়,ঠিক ভাবে খাবার দেব।
তুমি চাইলে আলাদাও খেতে পার।
এদেরকে চলে যেতে বলো মা।”
আমি তার হাত ঝাংটা দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম,”নেড়া বেলতলায় একবারই যায় খালা।
আপনি কম অত্যাচার করেননি আমার ওপর।
আমার ছোট ছেলের ওপরও অন্যায় করেছেন।
ঘৃণা হয়ে গেছে আমার আপনার ওপর।”
লোকগুলো চেচিয়ে বলল,”জরিমানা দশহাজার হলো।ইনি যতো দেরি করবে ততো বাড়বে।”
খালা এবার দৌড়ে টাকা আনতে গেল।
এতো কিছুর মাঝে ভাড়া নিতে আসা সেই মহিলাকে দেখলাম চুপচাপ।
তিনি শুধু খালার বাড়ি দেখছে।
টাকা নিয়ে এলো খালা।
লোকটার হাতে দিল।আমায় তিনি চার হাজার টাকা দিলেন।পাঁচশ বেশি দিয়েছেন।
আমি নিতে চাইনি।উনি বললেন,”এটা রেখে দাও
তুমি না নাও তোমার ছেলেকে কিছু কিনে দিও।
ছেলেটাও কম অত্যাচার হয়নি।এটা ওর ক্ষতিপূরণ।
বাকি টাকা দিয়ে আজ পাড়ার মাঝে খিচুড়ি রান্না করে খাব।
তুমি আসবে কিন্তু।”
টাকা তো নিলাম।
এবার যাই কোথায়?
ঘর তো ছেড়েছি।কিন্তু থাকব এবার কোথায়?
দুঃখ থেকে বেড়িয়েছি।সুখ কী এবার আদৌ পাব?
চলবে,,??