লোভ পর্ব-০১

0
2008

#লোভ
#সূচনা_পর্ব
লেখনী: #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

মাঝরাতে মা তার যুবতী মেয়েকে ভাইপোর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,

“যেভাবেই হোক, আজ লেফটেন্যান্ট ইরফান তালুকদারকে হাত করবি। সেটা হোক মুখের বুলি দিয়ে নয়তো দেহ দিয়ে।”

অধরা মেয়েটা মায়ের প্ল্যান আঁচ করে ভীত কণ্ঠে শুধালো, “ইরফান ভাই কি ভুলবে আমাতে? আমার ভীষণ ভয় করছে, মা!”

মেয়ের কথা শুনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো মমতা। বললো,

“এতো সুন্দর দেহ দিয়ে করবিটা কি, যদি একটা জোয়ান ছেলেকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতেই না পারোস?”

“কিন্তু, ইরফান ভাই সবার মতো নয়, মা।”

“শোন, অধরা, পুরুষ মানুষ রাতের অন্ধকারে নারীর দেহ পাইলে মোম হইয়া যায়। সেই দেহটা হোক সুন্দর কিংবা কুৎসিত! উপরে উপরে পুরুষ যতই কঠোর হোক, এরা একবার নারীর দেহের স্পর্শ পাইলে সেই কঠোরতাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। শরীরের কা/মে ঠিকই ধরা দেয়। আমি কি বলছি, তুই বুঝতে পারছিস?”

অধরা চনমনে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,

“বুঝেছি।”

ভেতরে ভেতরে সে-ও ইরফান ভাইকে নিজের করে পেতে চায়। কিশোরী বয়স থেকেই মা তাঁকে লেলিয়ে দিয়েছে মানুষটার প্রতি। সেই থেকেই মানুষটাকে নিয়ে ওর কত কল্পনা-জল্পনা! কিন্তু, আফসোস, ইরফান ভাই তাঁর সঙ্গে সবসময় রাস্তার কু/কুরটার মতো ব্যবহার করেন। কখনো অধরাতে ভুলেনি সে, ভুলেও কখনো আশকারা দেয়নি। আজ যদি মায়ের কথাতে মানুষটা যদি সারাজীবনের জন্য ওর হয়, ক্ষতি কি? এসব ভাবতেই চকচক করে উঠছে অধরার লোভাতুর দু-চোখ। মানুষটাকে নিজের, একান্তই নিজের করে পাওয়ার বাসনায় যুবতী মেয়েটির বক্ষস্থল জুড়ে হিমশীতল শিহরণ বয়ে গেলো! “আহ্! মানুষটি ওর হতে চলছে!” এতটুকু ভাবতেই মেয়েটার ভেতরটা শীতল হয়ে এলো।

মমতা সতর্ক চোখে আশেপাশে একবার তাকিয়ে, মেয়ে’কে ঠেলে ইরফানের রুমে ঢুকিয়ে দিলো। নীরবে আরো একবার সতর্ক করে দিলো,

“এই ছেলেটাকে কোনোভাবে হাতছাড়া করা যাবে না, অধু!”

মেয়ে তাঁকে আশ্বাস দিলো। মমতা বাঁকা হেসে ওখান থেকে দ্রুত সরে গিয়ে সিঁড়ির পাশটাতে ঘাপটি মে’রে রইলো। ওর কোটিপতি বোনপতীর একমাত্র ছেলে, লেফটেন্যান্ট ইরফান তালুকদা। ছেলেটা দেখতে যেমন সুদর্শন, তেমনই বাপ-বেটা টাকা-পয়সার মালিক। এক বাপের এক পুত! কোনোভাবে একবার নিজের মেয়ে’কে কলকাঠি নাড়িয়ে ছেলেটার গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলেই, রাজপুত্র, রাজ্য দু’টোই থাকবে হাতের মুঠোয়। আর আজ সেটার মোক্ষম একটা সুযোগও রয়েছে। মমতার বড় বোন, মৌসুমি তালুকদারের বাড়িতে আজ একটা বিশেষ অনুষ্ঠান চলছে, সেই উপলক্ষে ওরা এসেছে। এছাড়াও, রয়েছে ঘরভর্তি মেহমান। এর মধ্যে, কোনোভাবে যদি মেয়েটা ঘটনাটা নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলেই আজ রাতে মমতার দুর্দান্ত প্ল্যানটা যুতসই মতো লেগে যাবে। এসব ভাবতেই মমতা আরো একবার বিজয়ী হাসলো আর মেয়ের সংকেতের অপেক্ষায় করতে লাগলো।

°
অন্ধকার রুমটাতে নিঃশব্দে হাতড়াতে হাতড়াতে ইরফানের খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, অধরা। খাটের একপাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে কেউ। সুনসান নিশুতি রাতে অধরা মানুষটির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে সেই মানুষটির অস্তিত্ব অনুভব করলো। অমনি তার কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ পড়ল। ইরফান ভাই ফিরেছে? কখন এলো উনি? অধরার জানা মতে, ইরফান বাহিরে, ফেরেনি এখনো। ওর তো আরো পরে আসার কথা ছিলো। মানুষটা কখন ফিরলো? হয়তো অধরা টের পায়নি, এই ভেবে নিজের ভাবনা গুলো থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। আগেপিছে আর কোনোকিছু না ভেবেই ঘুমন্ত মানুষটার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ সেই মানুষটা থম মে’রে চুপচাপ থাকলে-ও যুবতী মেয়ের কামু/কী আবদার উপেক্ষা করতে পারেনি। আচমকা, পুরুষালি দু’টো শক্ত হাত অধরার আপ’ত্তিকর জায়গাগুলো ছুঁয়ে দিলো।

ইরফান ভাই তবে টোপ গিলেছে?!

এই ভেবেই আচমকা অধরা সাজানো নাটক মতে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো,

“ইরফান ভাই, কি করছেন? ছাড়ুন, ছাড়ুন আমায়। প্লিজ…. আমার এতো বড় সর্বনা/শ করবেন, ইরফান ভাই!”

মমতা এতক্ষণ তোক্কে তোক্কে রয়েছিলো। লাগাতারে অধরার উচ্চস্বরের চিৎকার শুনতে পেয়েই সে বেরিয়ে এলো। সেই সাথে এমন ভাব করলো, যেন সে কিচ্ছুই জানে না। মমতা ঘুম ঘুম ভাণ ধরে বিচলিত কণ্ঠে মেয়ে’কে ডাকলো,

“অধরা? এই অধরা, কি হয়েছে? কি হয়েছে, কি হয়েছে মা?”

বলতে বলতে দরজার সামনে ছুটে গেলো মমতা। ভেতর থেকে ওদের দরজা আটকানো। মমতা কাঠের দরজাটায় শব্দ করে মেয়ের নাম ধরে অর্ণাগল ডাকছে। মুহূর্তেই বাড়িসুদ্ধ মানুষ এসে ঘিরে ধরলো ওদেরকে। মাঝরাতে অধরার এলোপাথাড়ি চিৎকার শুনে হতবুদ্ধ তারা। সবার চোখে-মুখে প্রশ্ন। সেই সঙ্গে সংশয়। ইরফান তালুকদারের রুমে অধরা কি করছে? দরজা ভেতর থেকে আটকানো কেন? ভেতরে কি চলছে?

তান্মধ্যে, ভীড় ডিঙিয়ে মৌসুমি তালুকদার বোনের কাছে ছুটে এলো। বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে, কি হয়েছে মমতা? অধরা চিৎকার করলো কেন?”

মমতা কান্না জড়িত কণ্ঠে জানালো, “জানি না, আপা।”

মৌসুমি তালুকদারের কপালে গোটা দুয়ে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। তার ছেলের রুম থেকে মধ্যরাতে একটা মেয়ে “ইরফান ভাই” বলে ডাকছে কেন? ঘটনা আঁচ করতে তার বেশিক্ষণ আর ভাবতে হলো না। তবুও, তিনি জানেন তার ছেলে কক্ষনো এমন কিছু করবে না। ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তার আছে। তার ছেলেটা যে একটু অন্যরকম। তাহলে ঘটনা কি? মৌসুমি আর কালবিলম্ব না করে, দরজা থেকে মমতাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই মিহি স্বরে ডাকলো অধরাকে,

“ভেতরে কি হয়েছে, অধরা? দরজাটা খোলো মা?”

বেশ কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো, অধরা। মুহূর্তেই, দরজা ডিঙিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলো একঝাঁক প্রশ্নবিদ্ধ মানুষ। পুরো রুম এখনো অন্ধকার। মৌসুমি এসে ত্রস্ত রুমের লাইট অন করে দিলো। মুহূর্তেই আলোকিত রুমটাতে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে গেলো। রুমে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ কিছু সময়ের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো।

খাটের মাঝখানে সটান হয়ে শুয়ে আছে এক যুবক। তার পুরো শরীরটাতে চাদর টানা, মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রুমের এক কোণায় ভয়ার্ত, এলোমেলো কাপড়ে অধরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। এরপর আর ঘটনা বুঝতে কারো বেশিক্ষণ লাগলো না। মুহূর্তেই, রুমভর্তি মানুষগুলোর মধ্যে চললো তুমুল উত্তেজনা, চাপা মুখ চাওয়াচাওয়ি। এসবের সবকিছু উপেক্ষা করে মৌসুমি এসে দ্রুত অধরাকে একটা বিছানার চাদর দিয়ে গা ঢেকে দিলো। অধরা ততক্ষণাৎ খালাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠলো,

“খালামনি…!”

মৌসুমি তালুকদার মেয়েটাকে বুকের মাঝখানটাতে টেনে নিলো। এরমাঝে, পাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে মৌসুমের শ্বাশুড়ি “ইসাবেলা” অধরাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,

“এ্যাই মেয়ে, তুমি ইরফানের রুমে কি করে এলে? তোমার তো ইরাদের সঙ্গে ঘুমানোর কথা ছিলো।

অধরার সেই উত্তর ছিলো ঠোঁটের আগায় সাজানো। সে বেশ রয়েসয়ে বললো,

“আসলে, এক রুমে এতজন শোয়াতে আমার খুব গরম লাগছিল। তাই আমি একটু বাহিরে আসছিলাম। এরপর, ইরফান ভাইয়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি রুমটা খালি। তাই, আমি আর ইরাদের কাছে না গিয়ে এখানেই শুয়ে পড়েছি। তাছাড়া, আম্মু বলছিলো ইরফান ভাই আজ রাতে বাসায় ফিরবে না। সেই ভেবেই আমি এখানে শুয়েছিলাম। কিন্তু, উনি উনি….. ”

বলতে বলতে ফের কেঁদে ফেললো, অধরা। এর পরেরটুকু বুঝতে কি আর কারো অসুবিধা আছে? মেয়ের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, পাশ থেকে মমতা বেগমও মেয়ে’কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। হা-হুতাশ শুরু করলো। সবটা দেখে গ;
/র্জে উঠলো, ইশতিয়াক তালুকদার। তার বাড়িতে এসব কি চলছে? বিছানায় শুয়ে থাকা যুবকটির এতবড় সাহস? কে সে? ইরফান? মাঝরাতে অধরার দিকে হাত বাড়িয়েছে? এতো অধঃপতন হয়েছে ওর? ইশতিয়াক তালুকদার তীব্র ক্রো’ধ নিয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলো আর ছুঁড়ে ফেললো যুবকটির গায়ে থাকা চাদরটি। মুহূর্তেই, অনাকাঙ্ক্ষিত আর অপ্রত্যাশিত ভাবে বেরিয়ে এলো একটি মুখ। ইরফানের জায়গায় রয়েছে তালুকদার বাড়ির চাকরটি। ইশতিয়াক তালুকদার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, সেই সঙ্গে মানুষটা ভারি বিস্ময়ও হলো। সে বিরশ কণ্ঠে বারকয়েক আওড়াল,

“আরাফাত, আরাফাত? তুমি, তুমি এখানে?”

আরাফাত থরথর করে কেঁপে উঠল। সবটা দেখে, মমতার মাথায় যেন বিশাল আকাশটা ভেঙে পড়লো। এসব কি হয়ে গেলো? ইয়া আল্লাহ! বেচারা মমতা, হতবুদ্ধ হয়ে মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতে ধপাস করে পড়ে গেলো। অধরা আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো,

“নাআআআআআ…..”

সবাই যখন এদের নিয়ে ব্যস্ত, আচমকা শুট-বুট পরিহিত গমগমে আওয়াজে রুমে উপস্থিত হলো এক যুবক। গায়ে তার এখনো পেশাদার ইউনিফর্ম। তাঁকে দেখেই ভীড়ের মাঝ থেকে হাসলো শ্যামময়ী একটি মুখ। সেই অবয়বের মেয়েটা দ্রুত ছুটে এসে যুবকটির পাশে দাঁড়ালো, মিহি কণ্ঠে ডাকলো,

“ইরফান ভাই?”

চলবে….