#লোভ
#পর্বঃ৪
লেখনীতে: #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। বসার ঘরটা নীরব—নিঃশব্দ, নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও স্পষ্ট শোনা যায়। কেউ নড়ছে না, কেউ কথা বলছে না। চোখে বিস্ময়ের ছায়া, মুখে থমকে থাকা অভিব্যক্তি। কারও আঙুল শক্ত হয়ে গিয়েছে, কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। সময়টাও যেন এই মুহূর্তে থমকে গেছে, শব্দহীন এক অদৃশ্য আবরণে ঢেকে গেছে চারপাশটা।
তারই মাঝে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌসুমি তালুকদার। বোনের করা ঘৃণ্য কাজের ভার যে এবার তার কাঁধে নেমে এসেছে। সবার সামনে লজ্জায় অবনত সে, অথচ বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারছে না। মুখের কথা ফুটছে না,শব্দগুলো আঁটকে আছে।
একবার আলগোছে মায়ের দিকে তাকায় ইরফান। মায়ের চোখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, যেন মানুষটা শত প্রশ্ন আর অপমানের ভার একসঙ্গে নীরবে বয়ে চলেছে।
চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে,ধীরপায়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায় ইরফান। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গুমোট নৈশব্দ বিদীর্ণ করে তার কণ্ঠস্বর। গভীর অথচ দৃঢ় স্বরে সে বলে ওঠে,
“আমার মায়ের দিকে কেউ আঙুল তুলতে যাবেন না। তার বোন যা করেছে, তার দায়ভার মা বহন করবেন না। সবার জন্য আজকের নাটকের পরিসমাপ্তি এখানেই। গেইম ইজ ওভার। এখন যে যার রুমে চলে যান।”
ঘরজুড়ে আবারও নীরবতা নেমে আসে। কিন্তু এবার সেই নীরবতার ভার অন্যরকম—একটি অপ্রতিরোধ্য দৃঢ়তার ছায়া ফেলে রেখে যায় ইরফানের শেষ বাক্য। কেউ আর কিছু বলে না,দাঁড়িয়ে রয়। ফের ইসাবেলা আরো একবার সবাইকে যে যার রুমে যাওয়ার কথা বলে, নিজেও চলে যান ওখান থেকে।
একে-একে সবাই চলে গেলো, শুধু মা’কে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো, ইরফান, আরাফাত আর ইরা। হঠাৎ, তিন ভাইবোন একসঙ্গে মা’কে চারপাশ থেকে নীরবে জড়িয়ে ধরলো। আরাফাত মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আদুরে সুরে ডাকলো,
“মা… মা…”
মা চুপচাপ ওদের দিকে কিয়ৎ ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। ক্লান্ত দৃষ্টি, তবু চোখের কোণে একরাশ মায়া। ছেলেমেয়েদের আদুরে স্পর্শে, তাদের নিঃশব্দ সান্ত্বনায়, মায়ের মলিন ঠোঁট জোড়ায় হঠাৎ মৃদু হাসি ফুটলো।
কত অপমান, কষ্ট, দুঃখ—সব যেন এক নিমেষে হালকা হয়ে গেল এই একটুকরো ভালোবাসায়। মৌসুমি হঠাৎ অনুভব করলো, এরা তার একটুকরো সুখ।
°
তালুকদার বাড়ির গেইটের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মমতা। তীব্র গা-জ্বা/লা অপমানে মাথাটা তার ভনভন করে ঘুরছে। এতো রাতে কোথায় যাবে সে? গাড়ি নেই, হাতে টাকা নেই, রাস্তায় মানুষ নেই। কেবল রয়েছে, নিঃশব্দ আর ল্যাম্পপোস্টের ফিনফিনে আলো। মমতা কিয়ৎক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, সামনের পথটায়।
তারই পিছনে রক্তশূণ্য- ফ্যাকাসে মুখে, নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অধরা। মেয়েটা হঠাৎ অনুভব করলো, তার কিছু পাওয়া হলো না। গল্পের আসল লেখিকা, সুমাইয়া আফরিন ঐশী। না ইরফান ভাইকে, না নিজের নিজস্ব সত্তাটাকে। ছোটবেলা থেকে মায়ের আঁচলের তলায় থেকেছে সে। মা যা বলেছে, যা বুঝিয়েছে সেটাই সে “দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে” মেনে নিয়েছে। আর আজ, সে মায়ের কথাতেই সব হারিয়েছে। এতো লজ্জা, অপমানের দায়ভার নিয়ে তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না, একটুও বাঁচতে ইচ্ছে করছে না! থেকে থেকে কেবল নিশ্বাসটা আঁটকে আসছে। অধরা কেমন অতল ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে।
আচমকা, মেয়ের গালে ধারাম করে চড় বসায় মমতা। তার এতক্ষণের সমস্ত রাগ-ক্ষোভ উগড়ে নিয়ে বলে উঠলো,
“শু/য়োরের বাচ্চা, তোকে দিয়ে একটা কাজও ঠিকঠাক হয় না। তখন ভালো করে দেখে নিবি না,ওখানে কে আছে? গিয়ে, চাকরটার উপ্রেই ঝাপিয়ে পড়তে হলো?
আমার বোঝা উচিত ছিলো, তোরা ফকিন্নির জাত, তোদের পেটে ঘি হজম হবে না। খামাখা আমার রেপুটেশনটা নষ্ট হলো। রাজ্য আর রাজপুত্র দু’টোই হাতছাড়া হলো।”
অধরা গালে হাত দিয়ে, ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর তার মনে হলো, তার মা একজন সাই/কো মহিলা অথবা মানসিক রোগী। নয়তো টাকা লোভী একজন নোংরা মস্তিষ্কের উদ্ভট মহিলা। যার কোনো মানসম্মান নেই, বিবেক নেই। এদের কাছে টাকাটাই সব। অধরা আজ ক্ষণে ক্ষণে বুঝলো, তার মা নিজ হাতে তার জীবনটা নর/কে ফেলে দিয়েছে। তার বাবা মধ্যবিত্ত হলে-ও, তার সম্মান ছিলো। তাদের ঘরে শান্তি ছিলো। কিন্তু, আজ সব শেষ! অধরা চট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“তোমার করা পাপের জালে আমি আঁটকে গিয়েছি, মা। আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ, মা….”
নিজের প্রতি মেয়ের চোখে-মুখে ঘৃণার তোপে ছারখা/র হয়ে গেলো, মমতা। আচমকা, তার দুনিয়াটা থমকে গেলো। অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় ভেতরটা দ গ্ধ হলো! তেজওয়ালী মমতা ফুস করে নিভে গেলো। এ-কি করলো সে? মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে, সবচেয়ে খারাপটাই করলো সে? ছি! নিজের প্রতি আজ তার ঘৃণা হচ্ছে। নিজের মুখে থুথু ফেলতে ইচ্ছে করছে। সব হারিয়ে মমতা অনুভব করলো, লোভ মানুষকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দেয়। এরপর তার কিছু থাকে না, সে কিছু পায় না। এই যে, সে-ও সব সব সব, হারালো। সন্তানের চোখের ঘৃণা নিয়ে মমতা সারাজীবন কীভাবে কাটাবে? কীভাবে বাঁচবে সে? এই ঘৃণার ভার যে তার আজীবন বইতে হবে….
__________
কিছুক্ষণ হলো,ফজরের আজানের স্নিগ্ধ ধ্বনি ভোরের নীরবতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। সাদা দফেদফে বিছানায় সটান শুয়ে আছে এক যুবক, মাত্রই দু’চোখ বুঁজেছে। কিন্তু তার আগেই বিছানার পাশ থেকে বেসুরো শব্দ তুলে বেজে ওঠে ফোনটা। বিরক্তিতে যুবকটির কপালে ভাঁজ পড়ে, একপাশে কুঁকড়ে গিয়ে হাত বাড়ায় সে—ঘুম আর বাস্তবতার মাঝের সেই বিরক্তিকর টানাপোড়েন নিয়ে। স্ক্রিনের তাকিয়ে সংক্ষেপে লেখা , “লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ ইলিয়াস” নামটাতে নজর পড়তেই তার মস্তিষ্ক পুরোপুরি সচল হলো। এই লোকটা প্রফেশনালের দিক থেকে তার স্যার হয়, আনপ্রোফেশনালের দিক থেকে মেজো চাচা। হঠাৎ, এই ফজরের দিকে উনি কল করলো কেন? যুবকটি আর কালবিলম্ব না করে ফোন রিসিভ করে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“হ্যালো, মেঝো আব্বু?”
অপাশ থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠে শোনা গেলো,
“দিস ইজ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ ইলিয়াস স্পিকিং।”
ইরফান ফোঁস করে শ্বাস টানলো। এই লোকটা সবসময় তাকে বিভ্রান্ত করতে পছন্দ করে। যখন ইরফান প্রফেশনাল ভাষায় স্যার বলেন, তখন উনি বলেন, “আই অ্যাম অ্যাট দিস মোমেন্ট ইয়োর, মেঝো আব্বু।” আর যখন ইরফান কথোপকথনটা একটু বেশি আনুষ্ঠানিক করতে যায়, তখন উনি পুরো উল্টোটা বলেন।
মানুষটার সঙ্গে কথা বললে ইরফানের জন্য সবকিছু বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। শাহেদ ইলিয়াস সঠিক সময়ে ইরফানকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্ত করতে থাকে। বিশেষ করে যখন দাম্ভিক ইরফান তালুকদার গম্ভীর কণ্ঠে “সরি স্যার” বলে, তখন সেটা সে বেশ উপভোগ করে।
ইরফান সব কিছু বুঝলেও, প্রফেশনাল দিক থেকে তার তকমা আঁটকে যায়। আর তাই আজও তাকে বলতে হলো,
“সরি স্যার। আই অ্যাম লেফটেন্যান্ট ইরফান তালুকদার, লিসেনিং।”
কিন্তু, আজ ব্যাপারটা ভিন্ন। ওপাশ থেকে কর্নেল শাহেদ ইলিয়াস অত্যান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“লেফটেন্যান্ট ইরফান, গেট টু দ্য ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার্স ইমিডিয়েটলি। দিস ইজ অ্যান ইমার্জেন্সি। আই অ্যাম অর্ডারিং ইউ, মুভ কুইকলি।”
ইরফানের আর ছুটিতে থাকা হলো না। দেশের কাজে ডাক পড়লো। সে কোনো প্রকার দেরি না করে দ্রুত সশ্রদ্ধ কণ্ঠে বললো,
“রজার দ্যাট, স্যার। আই’ম রাইট নাও।”
°
সাজ ভোরে, পুরো তালুকদার বাড়ি ঘুমন্ত। শুধু জেগেছেন, বাড়ির তিন গিন্নি, ইরা আর ইসাবেলা। যৌথ পরিবার হওয়ার সুবাদে ওরা সবাই একসাথেই থাকছেন। ইসাবেলার তিন পুত্র। বড় পুত্র, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক তালুকদার। মেঝো পুত্র, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ ইলিয়াস। ছোট পুত্র, ডক্টর ইয়াসিন ফারুক। এছাড়াও উনার রয়েছে, তিনজন কন্যা।
তিন ছেলে, তিন বধূ আর তাদের ছেলে-মেয়ে নিয়েই বিশাল তালুকদার পরিবার। স্বামী ম/রার পর, ইসাবেলাই দক্ষ হাতে পুরো পরিবারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। উনার ছেলে-মেয়েরা বড়বড় সাহেব হলেও, মায়ের মতামতকে এখনো সম্মানের সঙ্গে প্রধান্য দেন।
দক্ষ হাতে, ত্রস্ত ত্রস্ত ব্যাগ-প্যাক গোছগাছ করে নিজের কর্মস্থানে যাওয়ার জন্য রেডি ইরফান। সকালের নাস্তাটা খাওয়ার জন্যও অপেক্ষা করলো না ছেলেটা। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই, ফজরের সময়টাতে ছেলেকে বিদায় দিতে মায়ের মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে। মা ছলছল চোখে ছেলের কাছে অবুঝ এক আবদার করলো,
চলবে…..