লোভ পর্ব-০৬

0
1092

#লোভ
#পর্বঃ৬
লেখনীতে: #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

টানা ২৬ ঘণ্টা নির্ঘুম কাটিয়েছে, শাহেদ ইলিয়াস। কাঁধে তার সরকারের বিশেষ এক মিশনের ভার। মাত্রই মেজর, ক্যাপ্টেনসহ মোট ১২ জন লেফটেন্যান্ট নিয়ে শেষ করেছে গুরুত্বপূর্ণ এক মিটিং। রাত একটায় মেজরের নেতৃত্বে ১২ জন সৈন্য প্রস্তুত… মিশন শুরু হতে যাচ্ছে। এরমধ্যে, একজন রয়েছে লেফটেন্যান্ট ইরফান তালুকদার।

কিন্তু কোথায়? কী উদ্দেশ্যে? উপরমহলের বিশেষ কয়েকজন ছাড়া এখনো সেসব কেউ জানে না। হয়তো, পরবর্তী মিটিং এ তারা-ও জানবে।

শুধু ইলিয়াস জানে, এই অভিযানের পর সবকিছু আর আগের মতো থাকবে না। সৈনিকদের জীবন রয়েছে মহা সংশয়ে। তবুও, সৈন্যদল প্রস্তুত। প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। গোপনীয়তা বজায় রেখে পরিকল্পনা এগিয়ে চলছে, শ্বাস নেওয়ারও সময় নেই। মিনিটের মধ্যে পরবর্তী পদক্ষেপ আসবে, আর ইলিয়াস জানে—একটি সামান্য ভুলও মিশনের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। সমস্ত সিদ্ধান্ত সতর্কভাবে নিতে হবে, কারণ মিশনটির সাফল্য বা ব্যর্থতা এখন কেবল তাদের উপর নির্ভর করছে। উপরের নির্দেশনার সঙ্গে সবকিছু মিলিয়ে না আসলে, শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।

টেনশনে ইলিয়াসের মাথাটা ধপধপ করছে। দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টার নির্ঘুম কাজের পর শরীরটা একরাশ ক্লান্তিতে থিতিয়ে পড়েছে। মিশনের চাপ, দায়িত্বের ভার, প্রতিটি মুহূর্তে সতর্ক থাকার প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সে একটু বিশ্রাম নিতে চায়, কিন্তু কাজের ভীড়ে সে সেসব চায় না, চায় না কিছুই। মানুষটা মনেপ্রাণে কেবল চায়, মিশনটা সাকসেস হোক। কোনো মায়ের কোল আর খালি না হোক। হাতে এতোগুলা প্রাণের ভার নিয়ে তো আর ঘুমানো যায় না! ঘুম কি আসে?

অবশেষে, সামান্য বিশ্রামের জন্য মানুষটা নিজের চেয়ারটাতে একটু গা এলিয়ে দিলো। দু’টো চোখের পাতা আর কেবলই বন্ধ হতে চায়। কিছু সময়ের জন্য সে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে, যেন এক মুহূর্তের শান্তিতে ডুব দিতে পারে। তবে, ঠিক তখনই—বিশ্রীভাবে খটখট করে উঠলো ব্যাক্তিগত মুঠোফোনটা। ইলিয়াস খানিকটা বিরক্তবোধ করলেও ফোনের স্ক্রিণে “সিদরাতুল মুনতাহা” নাম দেখে, বাবা’র মুখে অজান্তেই স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল। অন্য কেউ হলে এইমুহূর্তে উনি কক্ষনো ফোন রিসিভ করতেন না, বরং বিরক্তিতে দু’চারটা গালি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতো। কিন্তু, এখন ব্যাপার ভিন্ন। মেয়ে’কে বাবা ফেরায় কি করে?

ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে মেয়ের কণ্ঠে শোনা গেল,

“গুড মর্নিং, বাবা!”

মুহূর্তে ইলিয়াসের মনের মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতি চলতে থাকলো। মেয়েরা তার প্রাণের স্পর্শ। একটু হাসি, একটুকরো আদর! তুখোড় ক্লান্তির মাঝেও একটুকরো স্বস্তির শ্বাস। বাবা ঠোঁটে সেইভাবেই হাসি ঝুলিয়ে বললো,

“গুড মর্নিং, মা।”

“আমি কি তোমাকে বিরক্ত করলাম, বাবা? লাস্ট তিন দিনেও তুমি আমাকে একটিবার কল করোনি। লাস্ট দু-মাসের মধ্যে তুমি একটাবারের জন্যও বাসায় আসোনি।”

মেয়ের কণ্ঠে গাঢ় অভিমান। যা শুনে মিনমিন করে বাবা মেয়ের অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কৈফিয়ত দিবার ভঙ্গিতে বোঝালো, ক্ষমা চাইলো।

“আমি ভীষণ ভীষণ দুঃখিত, মা। লাস্ট তিনদিন আমি প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম, তবুও আপনাকে কল দেওয়া উচিত ছিলো আমার। আপনি আপনার ছেলেকে শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন, আম্মাজান। এমন ভুল আর কক্ষনো হবে না।”

মেয়ের অভিমান এতেও টললো না। সেদিন তার কতো জ্বর গেলো… তবুও বাবা সেভাবে খোঁজ নেয়নি। একবার দেখতে আসেনি। মেয়েটা ফের ভেজা কণ্ঠে শুধালো,

“আচ্ছা বাবা,তোমার কাছে নিজের প্রফেশনাল বড় না-কি নিজের সন্তান বড়?”

এই মুহূর্তে মেয়ের কথাখানা এমন ছিল, যা শাহেদ ইলিয়াসের মতো এক অভিজ্ঞ সৈনিককেও ভীষণভাবে ব্যথিত করে তুললো। দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর শৃঙ্খলায় যিনি নিজের সবকিছু উৎসর্গ করেছেন, তার কাছে এই প্রশ্ন—নিজের পেশা বড়, না নিজের সন্তান—এটা ছিল এক অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব।একজন সৈনিকের কাছে বোধহয় এটাই দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। ইলিয়াস কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,

“একজন সৈনিক হিসেবে অবশ্যই আমার কাছে আমার দায়িত্ব বড়, আমার দেশ বড়, এবং দেশের মানুষ বড়।
একজন বাবা হিসেবে, অবশ্যই আমার কাছে আমার সন্তান বড়। তাহলে কি দাঁড়ায়, জানো মা? আমার কাছে দু’টোই বড়।”

বাবা’র কথায় সিদরার অভিমান একটু নরম হয়ে এলো, কিন্তু গললো না। সে ফের অভিযোগ করলো,

“আগামীকাল আমাদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান চলছে, সবার বাবারা এসেছে….,শুধু তুমি আসোনি বাবা। তোমার কি আমাদের জন্য একটা দিনও সময় হয় না?”

ইলিয়াস থম মেরে রইলো। কিছু বললো না। সময় নিয়ে মেয়েদের অভিযোগের কমতি নেই। তবুও, তার কিছু করার নেই। নিজের দেশ ও দায়িত্বের প্রতি সে সর্বদাই জাগ্রত। বাবা’র বলারও অপেক্ষা করলো না, সিদরা। ভোর থেকেই তার মেজাজ খারাপ। মেয়েটা সেভাবেই বাবা’কে হম্বিতম্বি দিয়ে বসলো,

“বাবা তুমি তো এলেই না, ছুটিতে ইরফান ভাই এলো তাকে-ও দু’টো দিন থাকতে দিলে না। কেনো বাবা? আগামীকাল বাড়িতে অনুষ্ঠান, এটা তুমি জানো না? তাঁকেও ফোন করে নেওয়া লাগে?”

“দিস ইজ অ্যান ইমার্জেন্সি, মা। আমার কিছু করার নেই।”

সিদরা ক্ষুব্ধ হয়ে চুপ রইলো। জগতে কি শুধু তাদেরই ইমারজেন্সি কাজ? দুনিয়ায় আর কেউ’ই তো কাজ-টাজ করে না। মেয়ে’র রাগ বুঝতে পেরে ইলিয়াস কোমল গলায় মেয়ে’কে ডাকলো,

“মা?”

সিদরা বিরশ কণ্ঠে বললো,

“বলো, বাবা?”

ইলিয়াস মৃদু হাসলো। একটু রয়েসয়ে বললো,

“একজন সৈনিকের কাছে ডিফেন্সের পেশাটা শুধু তার পেশাই নয়, বরং তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ,এক বিশাল গর্ব এবং সম্মানের। এটি শুধু শৃঙ্খলা, সাহস এবং আত্মত্যাগের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং একটি ধৈর্যের পরীক্ষাও বটে। আমি বুঝি, একজন সৈনিকের মায়ের জন্য, স্ত্রীর জন্য, সন্তানের জন্য এই পেশা শুধুমাত্র কাজ নয়, এক অবিরাম সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তাদের প্রতিটি মুহূর্তে থাকে অপেক্ষা, উদ্বেগ এবং প্রার্থনা, কারণ তারা জানে, তাদের প্রিয়জন দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সংগ্রাম করছে।
তাদের এই স্যাক্রিফাইসের মধ্যেই দেশ নিরাপদ থাকে, আর তোমাদের মতো লক্ষ সন্তান নিশ্চিন্তে ঘুমায়।

মা, তুমি তো একজন সৈনিকের মেয়ে, তাই না? তুমি যদি এখনই এতটুকু অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে যাও, তাহলে কী হবে? অপেক্ষা শিখতে হবে, দুরত্বকে মেনে নিতে হবে। ধরো, ভবিষ্যতে তুমি যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন লেফটেন্যান্টকেই চাও, তাহলে তোমাকে আরও বেশি ধৈর্যশীল হতে হবে। তোমাকে শিখতে হবে, কীভাবে অপেক্ষা করতে হয়, কীভাবে দূর থেকেও ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়।”

বাবা’র কথা খুব মন দিয়ে শুনছিলো, সিদরা। কিন্তু, শেষ সময়ে বাবা কি বললো? কিসের ইঙ্গিত দিলো? বাবা’র কথার অর্থ বুঝতে পেরেই মেয়েটা এলোমেলো হয়ে যায়। তীব্র লাজে মাথাটা নুয়ে এলো, গলাটা ধরে এলো। বাবা কীভাবে টের পেলো তার অনুভূতি? কীভাবে কি বুঝলো? ছি, কি লজ্জা। বাবা কি ভাবছে এখন?
সিদরা ধরা পড়া চোরের ন্যায় লজ্জায়, অস্বস্তিতে কেঁচোর মতো মুচড়িয়ে উঠলো। অজানা হাস-ফাঁ স থেকে বাঁচতে ত্রস্ত বলে উঠলো,

“মা ডাকছে। তুমি সাবধানে থেকো, বাবা। আমি এখন রাখছি।”

সিদরা দ্রুত ফোন কাটলো। ইলিয়াস মেয়ের মিছেমিছি তাড়াহুড়ো দেখে, ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বললো,

“পাগলি…..”

°

তীব্র ক্রো-ধ নিয়ে বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন, তোফাজ্জল ভুঁইয়া। অর্ধ অফিস করেই ভরদুপুরে তিনি আজ বাসায় ফিরেছেন। মেজাজ তার তুঙ্গে। পড়নে এখনো তার অফিসের ফর্মাল ড্রেস, এর পাশেই অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে কাঁধের ব্যাগটা।
অথচ মানুষটার মুখাবয়ব স্রোতের ন্যায় শান্ত। অসময় স্বামীর উপস্থিতি টের পেয়ে ভীষণ ঘাবড়ে গেলো, মমতা। তোফাজ্জল কি সবকিছু জেনে গেলো? যদিও গতকাল রাতের বিষয়টা তিনি মানুষটাকে কিচ্ছু বলেনি, টের পেতে দেয়নি। তবে, কি হলো উনার? বাহির থেকে কিছু জেনে যায়নি তো? অজানা ভয়ে মমতার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠল। বিশ বছর সংসার জীবনে এই প্রথম মমতা অনুভব করলো, সে স্বামীকে ভয় পাচ্ছে। তার সামনে যেতেও আজ হাঁটু কাঁপছে। তবুও, বসে থাকা যাবে না। মানুষটার কি হলো, জানতে হবে। মমতা নিজেকে যথাযথ সামলে নিলো। তবুও, ভয় করছে। সে সেভাবেই এক ক্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে বসার ঘরে গেলো। স্বামীর পাশে বসলো।শরবতের ক্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,

“কি ব্যাপার? তুমি আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?”

এতক্ষণ নিজেকে দমিয়ে রাখা তোফাজ্জল আচমকা গ/র্জে উঠলো। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে শুধালো,

“তুমি জানো না?”

মমতা ফাঁকা ঢোক গিললো। তবুও, নিজেকে সামলে বললো,

চলবে……