#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_১৫
#সারিকা_হোসাইন
********
গ্রীষ্মের উত্তপ্ততা বৃষ্টির প্রবাহে ধীরে ধীরে কমে এসেছে।রোদের তেজ ও আগের মতো নেই বললেই চলে।ক্যালেন্ডার এর পাতা হিসেবে এখন বর্ষাকালের সূচনা পর্ব।আকাশে প্রায় ই মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের তেজ দেখে মনে হয় এই বুঝি আকাশ ফুটো হয়ে ভারী বৃষ্টির আগমন হলো।আজকের আকাশটাও কুচকুচে কালো মেঘে আবৃত।চারিধারে শীতল বাতাস বইছে।মনে হচ্চে খুব করে বর্ষা নামবে।
এহেন মেঘ মেদুর দিনের শীতল দুপুরে ইকবালের বিশাল অফ হোয়াইট রঙা ফ্ল্যাটের সামনে এসে কালো রঙের একটি মার্সিডিজ গাড়ি থামলো।গাড়িটি দেখতে পেয়েই দৌড়ে এলো বাড়ির দারোয়ান মোতালেব।গাড়িটি মোতালেব এর ভীষন পরিচিত।মোতালেব এগিয়ে আসতেই গাড়ি থেকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নেমে দাঁড়ালো ভিয়ান।গাড়ি থেকে নেমেই পার্সোনাল ড্রাইভার কামরুল কে গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিলো
“গাড়ি পার্কিং শেষ হলে লাগেজ টা উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে”
আর দাঁড়ালো না ভিয়ান।বৃদ্ধ মোতালেব কে ও কিছু জিজ্ঞাসা না করে হনহন করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।চোখে মুখে তার চূড়ান্ত ক্লান্তির ছাপ।।।
ইকবাল কেবলই ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছেড়ে দেয়ালে থাকা ঘড়িতে নজর বুলালো।ঘড়ির কাঁটায় দুপুর দেড়টা বেজে পঁচিশ মিনিট।ঘুম ঘুম চোখে ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে পা বাড়ানোর আগেই খুট করে কক্ষের দরজা খুলে গেলো।কক্ষে প্রবেশ করতেই দ্রুত হাতে কাবার্ড থেকে একটা টাওয়েল আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকবার আগে ভ্রু কুঁচকে ভিয়ান শুধালো
“ভুত দেখছিস?এভাবে দেখার কি আছে?ভিডিও পাঠানোর সময় জানতি না আমি না এসে থাকতে পারবো না?
ইকবাল আর কিছু বলতে পারলো না।তার আগেই ভিয়ান মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।ওয়াশরুমের দরজায় হেলান দিয়ে ইকবাল তার ঘোর কাটানোর চেষ্টা করলো।এমনিতেই সারা রাত এক বিন্দু ঘুম হয়নি।ঘুম থেকে উঠেই এতো সব উদ্ভট কান্ড মস্তিষ্ক নিতে পারছে না জাস্ট।
কীয়তখন বাদেই লাগেজ সমেত কক্ষে প্রবেশ করলো কামরুল।কাবার্ড এর পাশে লাগেজ রাখতে রাখতে বলে উঠলো
“এয়ারপোর্ট এ যাবার সময় দেখি আপনি গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছেন এজন্য স্যারের ব্যপারে কিছু বলতে পারিনি।
ইকবাল ছোট করে শুধু বললো
“আচ্ছা তুই যা এখন”
কামরুল চলে যেতেই নিজের চুল খামচে ধরে বিছানায় বসে গেলো ইকবাল।গতকাল দুপুরে তাথৈ এর বৃষ্টি ভেজা কান্নার ভিডিও সেই ই পাঠিয়েছিলো ভিয়ান কে।কিন্তু এই বান্দা সেই ভিডিও দেখার সাথে সাথেই যে কারী কারী টাকা খরচ করে ইমারজেন্সি ফ্লাইটে চলে আসবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো।
ইকবালের ভাবনার মাঝেই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলো ভিয়ান।আহাম্মক ইকবালের বাহু চেপে বিছানা থেকে সরিয়ে ক্লান্তি জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো
“টানা বিশ ঘন্টা জার্নি করেছি।খুব টায়ার্ড লাগছে।আমাকে ঘুমুতে দে”
ইকবাল বিছানা থেকে নেমে বিস্ময় ভরা কন্ঠে শুধালো
“সপ্তাহ খানেক আগেই তুই গেলি,আবার কেনো এলি?
“কারন আমার বউ এর চিকিৎসার প্রয়োজন।এই রোগের চিকিৎসা আমি ছাড়া আর কোনো ডক্টর করতে পারবে না।
তাথৈ এর চিকিৎসা প্রয়োজন এটা শুনে ভীত হলো ইকবাল।জিহ্ববা দিয়ে লালচে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে উত্তেজিত স্বরে ইকবাল শুধালো
“কি হয়েছে তাথৈ এর?
গায়ে পাতলা কাঁথা জড়াতে জড়াতে ভিয়ান বলে উঠলো
“জ্বর হয়েছে”
“তা তোকে কে খবর পাঠালো যে তাথৈ এর জ্বর হয়েছে?
“ও বৃষ্টিতে ভিজতে পারেনা।বৃষ্টির সামান্য একটা ফোটা মাথায় পড়লেই ওর হাঁচি কাশি শুরু হয়ে যায় সেখানে টানা আড়াই ঘণ্টা ভিজেছে।বুঝতে পেরেছিস ঘটনা কতদূর?
ভ্রু কুঞ্চিত করে ইকবাল পুনরায় শুধালো
“তুই ডাক্তার হয়েছিস কবে?
শোয়া থেকে বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে ভিয়ান বলে উঠলো
“তুই বোধ হয় সারা রাত ঝোপের মধ্যে বসে থেকে মশার কামড় খাবার কথা ভুলে গিয়েছিস তাই না ইকবাল?
হঠাৎই বছর ছয় আগের কথা মনে পড়তেই ছোট বাচ্চার ন্যয় ইকবাল বলে উঠলো
“ওহ গড আজকে আবার?
ভিয়ান মুখে ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো
“সাথে করে গ্লুপ নিয়ে যাবি।একটা মশাও কাছে ঘেঁষবে না।কিন্তু বর্ষা দিন তো।সাপের গ্যারান্টি দিতে পারিনা।
আর কোনো কথা বাড়ালো না ইকবাল।ভিয়ানকে রুম ছেড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
*********
সারাটা রাত জ্বরে কাতর হয়েছিলো তাথৈ।ভোর বেলার দিকে তা কমার পরিবর্তে আরো মাত্রা ছাড়িয়েছে।সাময়িক ওষুধ হিসেবে প্যারাসিটামল দেয়া হয়েছে তবুও তাপমাত্রা কিছুতেই আয়ত্তে আসছে না।যেখানে মন মস্তিষ্কে এতো এতো অশান্তি সেখানে শরীর ভালো থাকবে কি করে?
এদিকে সকাল থেকেই এরিক বাড়িতে ঝামেলা শুরু করেছে।সে মেহেরিন চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে বার বার ধমকে ধমকে বলে যাচ্ছে
“তোমার মেয়ের সব নাটক মম।এসব নাটক দুটো বছরে অনেক সহ্য করেছি।আর ভালো লাগছে না পুরাতন ড্রামা।তাই ভেবেছি ওকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেবো।
এরিকের কথায় পাত্তা না দিয়ে তাথৈ এর সেবায় ব্যস্ত হলেন মেহেরিন চৌধুরী।কিন্তু একই কথা বার বার এরিক বলেই যাচ্ছে।শেষ মেষ নিজেকে রিজার্ভ রেখে শক্ত কন্ঠে মেহেরিন শুধালেন
“তুমি কি সত্যি ই মানুষ এরিক?
কন্ঠে তেজ ঢেলে এরিক শুধালো
“কেনো আমাকে মানুষের মতো লাগেনা?
“না লাগেনা।কোনো মানুষ এতটা নিকৃষ্ট হতে পারেনা।মেয়েটাকে কার কাছে পাঠাবে তুমি অস্ট্রেলিয়া?
“রেইন এর কাছে!
“রেইন আমাদের কি হয়?ভাই?বন্ধু?আত্মীয়?
“রেইন তাথৈকে বিয়ে করতে চায়।
“বিয়ে করতে চায় বলেই তার কাছে মেয়ে পাঠিয়ে দেবো?কোন কালচারে বড় হয়েছো তুমি?চিনি না জানিনা একটা ছেলের কাছে নির্ভয়ে মেয়ে পাঠিয়ে দেবো?
মেহেরিনের এতো কথা মোটেও ভালো লাগছে না এরিকের।আর দুদিন বাদেই তাথৈ এর পাসপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।সব কিছু প্রসেসিং এ আছে।এই মুহূর্তে মেহেরিন এসে যদি কোনো ঝামেলা বাধায় তবে এরিক মেহেরিন কে ও ছাড় দেবে না।মেহেরিনের এতো এতো প্রশ্নে ধমকে উঠলো এরিক
“এতো কিছু বুঝতে চাই না মম।ওই ছেলে আমাদের বিজনেস নিয়ে হিউজ ঝামেলা শুরু করছে শুধুমাত্র তাথৈ এর জন্য।আর পরের মেয়ের জন্য কিসের এতো দরদ?ও কি তোমার পেটে ধরা সন্তান?
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না মেহেরিন।এরিকের গালে শক্ত হাতে এক চড় বসিয়ে দিলেন মেহেরিন।চড়ের দাপটে এরিকের ফর্সা গালে আঙুলের ছাপ গুলো তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠলো।আহত বাঘের ন্যয় এরিক মেহেরিনের দিকে ধেয়ে এসে পাল্টা আক্রমণ করতে নিলেই মেহেরিন অগ্নি ঝরা চোখে বলে উঠলো
“দে নিজের জঘন্য পরিচয় দিয়ে দে।না হলে মানুষ জানবে কি করে তুই যে একটা বাস্টার্ড?
এরিক চিৎকার করে বলে উঠলো
“হাউ ডেয়ার ইউ মম?হাউ ডেয়ার ইউ টেল মি অ্যা বাস্টার্ড?আম সাইফ আজমি’স সন।ইউ নো ওয়ান থিং?ইউর ডটার ইজ অ্যা বাস্টার্ড।
এরিকের গলার উপর আওয়াজ তুলে মেহেরিন বলে উঠলেন
“তাথৈ এই বাড়ির সন্তান সেই সাথে চৌধুরী বংশের উত্তরসূরি আর তুই সাইফ আজমীর নোংরামির ফল!তাথৈ এর আগে তোকে এই বাড়ি থেকে বের করবো আমি।কারন তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।তুই এই বাড়ির উটকো বাড়তি ঝামেলা।
মেহেরিনের মুখে ক্রোধিত স্বরে এমন কথা শুনে থ হয়ে গেলো এরিক।করুন কন্ঠে ডেকে উঠলো
“মম!
মেহেরিন গর্জে উঠে বলে উঠলেন
“আমি তোর মা নই।তুই সাইফ আজমীর পাপের ফসল।তাই তোকে বার বার বলছি আমার মেয়েকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার ফল মোটেও ভালো হবে না।
এরিক যেনো তার কথা বলার সকল বুলি হারিয়ে ফেললো।এদিকে সাইফ আজমী সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন করলেন
“কিসের এতো চেঁচামেচি এখানে?
মেহেরিন তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে উঠলেন
“তোমার সন্তানকে নিজের জায়গা চিনিয়ে দিচ্ছি।
“হুয়াট?
“তাকে জানিয়ে দিলাম সে তোমার আর তোমার সেক্রেটারি সেলিনার অবৈধ কর্মের ফল।
মেহেরিনের মুখে এহেন কথা শুনে ক্রোধের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেহেরিনের চুলের মুঠি খামচে ধরে সাইফ আজমী দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন
“বেশি বাড়াবাড়ি করলে একদম পুতে দেবো।
সাইফ আজমীর চোখে চোখ রেখে মেহেরিন তেজী কন্ঠে বলে উঠলো।
“তোমাকে আমি ডিভোর্স দেবো সাইফ আজমী’
মেহেরিনের মুখে এমন বিধ্বংসী কথা শুনে সাইফ আজমীর হাতের মুঠি আলগা হয়ে এলো।নিজেকে হেচকা টানে ছাড়িয়ে আঙ্গুল তুলে মেহেরিন বলে উঠলেন
“তোমাদের বাপ ছেলে দুজনকেই আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।আমি ভুলিনি কিভাবে তুমি সাঈদ আর তনিমার জীবন নাশ করেছো।সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে তাথৈএর হবু বর কে কিভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় করেছো তোমরা বাপ ছেলে মিলে সেটাও অজানা নয়।কি ভেবেছো তোমরা?এমনি এমনি পার পেয়ে যাবে?উপরে যিনি আছে তার কোনো বিচার নেই?আমি নিজেই হবো তোমাদের ধংসের কারন।ক্ষমতা থাকলে আমার মুখ বন্ধ করে দেখাও।
আর দাঁড়ালো না মেহেরিন।হনহন করে ড্রয়িং রুম ছেড়ে কিচেনের দিকে চলে গেলেন।পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির কাজের মেয়ে চারু সবকিছুই শুনলো।শেষমেশ তপ্ত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাথৈ এর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।জ্বরে মেয়েটার চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।মাথায় বেশি করে পানি দিলে আরাম পাবে।
********
সন্ধ্যার একটু আগে আগে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে পড়লো।সেই সাথে বিকট বজ্রপাত।এরিক সেই সকালেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে এখনো ফিরেনি।অবশ্য কে ফিরলো কে না ফিরলো এসব এখন আর তোয়াক্কা করেন না মেহেরিন।সাইফ আজমী ছেলের পিছু পিছু বেরিয়ে গিয়েছেন।সেও ফিরে আসেনি।হয়তো কোথাও বসে বসে নতুন কুকর্মের ভাবনা ভেবে চলেছে।বাড়িতে শুধু তিনটে মেয়ে মানুষ।রাতের গভীরতা নামার সাথে সাথে বৃষ্টির দাপট ও বাড়লো।মেহেরিন তাথৈ এর সেবা শশ্রুষা করে নিজের কক্ষে ফিরে এলেন।কারন তাথৈ ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে।চারুও তার কাজকর্ম শেষ করে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
নিজ কক্ষে দরজা আটকে অতীত স্মৃতিতে ডুব দিলেন মেহেরিন।সাইফ আজমীর সাথে তার বিছানা আলাদা হয়েছে আরো এক যুগ আগে।কাগজে কলমেই শুধু তারা স্বামী স্ত্রী।বাস্তবে তো তাদের কোনো সম্পর্কই নেই।
ঘড়ির কাটা বারোর ঘর পেরিয়ে একের ঘর ছুঁইছুঁই।এমন সময় ভারী বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাথৈ এর কক্ষে প্রবেশ করলো ভিয়ান।শরীরের বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে তার।এতোটা বৃষ্টি অনেক দিন পর দেখার ভাগ্য হলো তার।তাথৈ এর কক্ষের দরজা আটকে দুরু দুরু বক্ষে চারপাশে নজর বুলালো ভিয়ান।অসহনীয় ভালোলাগায় সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে তার।সেই সাথে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে শীতল স্রোত।ধীরে ধীরে তাথৈ এর বিছানার দিকে এগুতে লাগলো ভিয়ান।ডিম লাইটের আবছা হলদেটে আলোয় তাথৈ এর করুন শুকনো মুখশ্রী নজরে লাগছে।নরম বিছানায় গুটিশুটি মেরে ভারী ব্ল্যাঙকেট জড়িয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে তাথৈ।শীর্ন তাথৈকে দেখে ভিয়ানের চোখ থেকে খসে পড়লো দুফোঁটা হল।সেই জল মুছে পরম মমতায় হাতের উল্টোপি ছুঁইয়ে দিলো তাথৈএর ফর্সা ছোট কপালে।জ্বরের তাপমাত্রায় মনে হচ্ছে কপাল নয় যেনো উত্তপ্ত তাওয়া।
হতাশা মিশ্রিত তপ্ত শ্বাস ফেলে ব্ল্যাঙকেট সরাতেই দেখতে পেলো বুকের কাছটায় কিছু একটা জড়িয়ে ধরা।ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই নিজের পুরোনো ছবিটা নজর কাড়লো।নিজের প্রতি তাথৈ এর অপরিসীম ভালোবাসা দেখে নীলচে ব্যথা গ্রাস করলো ভিয়ান কে।সেই সাথে শক্ত করে তাথৈকে জড়িয়ে বুকে টেনে মাথায় চুমু খেয়ে সিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“আর কয়েকটা দিন সময় দাও সব ঠিক করে দেবো।জতো কষ্ট পেয়েছো তার চাইতে বেশি ভালোবাসা দিয়ে সকল কষ্ট উসুল করে দেবো।
জরের ঘোরে বিড়বিড় করে তাথৈ বলে উঠলো
“আজকের স্বপ্নটা সত্যি সত্যি লাগছে ভিয়ান নাওয়াফ।মনে হচ্ছে আপনি সত্যি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।আপনার গায়ের গন্ধটাও খুব করে টের পাচ্ছি আমি।
নিজের মসৃন ভেজা ঠোঁট তাথৈএর শুষ্ক ঠোঁটে চেপে ধরে ভিয়ান চোখ বন্ধ করে রইলো।
ভিয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে তাথৈ বলে উঠলো
“প্রতিদিন এভাবে সপ্নে আমাকে একটু ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হয়?আমি যে আপনাকে ছাড়া মৃতের ন্যয় বেঁচে আছি ভিয়ান।আপনি হীন শূন্যতায় আমার বুকটা সারাক্ষন ছটফট করে।বেঁচে থেকেও আমি মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করছি।প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না।আমি যে আর সইতে পারছি না।
তাথৈ এর চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরে যাওয়া জল নিজের উষ্ণ ঠোঁটে শুষে নিয়ে ভিয়ান ফিসফিস করে তাথৈ এর কানে কানে বলে উঠলো
“খুব শীঘ্রই সকল অপেক্ষার অবসান হবে বউ।এরপর তোমাকে আমার বুকে বন্দি করে রাখবো।কোনো বিপদ বাধা এসে তোমাকে ছুঁতে পারবে না।আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দাও।প্রমিস সব ঠিক করে দেবো।
ভিয়ানের বুকের মধ্যে ছোট চড়ুই ছানার ন্যয় গুটিয়ে তাথৈ নিভু নিভু কন্ঠে বলে উঠলো
“আজকের রাত টুকু আরো আরো দীর্ঘ হোক ।
নিজের পেশীবহুল হাত দিয়ে তাথৈকে আরো খানিকটা জড়িয়ে চোখে মুখে অজস্র চুমু খেয়ে ভিয়ান বলে উঠলো
“তোমাকে এই রাক্ষস পুরি থেকে খুব শীঘ্রই উদ্ধার করে নিয়ে যাবো আমি তাথৈ।সেই সাথে মুক্ত পাখির ন্যয় উড়িয়ে দেবো মেহেরিন আন্টিকে। শক্ত খাঁচায় বন্দি করবো দুস্টু রাক্ষস দুটো কে।তোমায় আমায় মিলে আমাদের সুন্দর এক ফালি সুখের ঘর হবে।সেই ঘরের মালকিন হবে তুমি ।আর আমি বাধ্য গোলামের ন্যয় সেই ঘরের মেঝেতে বসে তোমার তুলতুলে পা জড়িয়ে পরম তৃপ্তিতে দিন কাটিয়ে দেবো।
#চলবে
#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_১৬
#সারিকা_হোসাইন
পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটেছে নাকি ফুটেনি কালচে ঘন মেঘের কারনে তা অনুমান করা বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছে।ভোর রাতের দিকে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে এলেও এখনো ঝিরি ঝিরি ধারায় ঝড়েই যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এই ভারী বর্ষণ ধরণী থেকে সকল জঞ্জাল একদম ধুয়ে মুছে সাফ করে তবেই আকাশে ফিরবে।
ইকবালের বিশাল ফ্ল্যাটে একের পর এক হাঁচির ঝড় তুলেছে ভিয়ান।এদিকে বেচারা ইকবাল সারাটা রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার কারনে কখন জ্বরের কবলে পড়েছে নিজেই জানেনা।বাসাটির বিশাল লিভিং রুমের দুই পাশের দুই সোফায় মুখোমুখি বসে আছে ভিয়ান আর ইকবাল। ইকবালের কাশি ভিয়ানের হাঁচি খুব সুন্দর সুরের মূর্ছনা তুলেছে লম্বা সময় ধরে সেই বৃহৎ কক্ষটিতে।বাড়ির পঁচিশ বছর বয়সী পুরুষ রাঁধুনি টুটুল দুজনের মাঝখানে বাবু হয়ে বসে দুই গালে হাত রেখে উপভোগ করে চলেছে সেই দৃশ্য।কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো টুটুল এরপর টিপ্পনি কেটে বলে উঠলো
“আপনারা মেয়ে মানুষের থেকেও নাজুক।উপরওয়ালা ভুলে পুরুষ মানুষ বানিয়ে ফেলেছে আপনাদের।সামান্য বৃষ্টিতে ভিজে যেই কাহিনী আপনারা করছেন মনে হচ্ছে তামাম দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলেছেন।
কথাগুলো শেষ করে আর দাঁড়ালো না টুটুল।মহিলা মানুষ বিহীন এই প্রকান্ড বাড়িতে তার বহু কাজ।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দুই লোকের তামাশা দেখলে পুরো দিন এমনি এমনি বিনা কাজে কেটে যাবে তার।
টুটুলের যাবার পানে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ইকবাল শুধালো
“এমন নিমক হারাম কবে কবে হয়েছিস টুটুল?মনিবের এহেন অসুস্থতা তোর গায়ে লাগছে না?
রান্নার মেনু দেখতে দেখতে টুটুল বলে উঠলো
“আরেক জনের প্রেমিকা পাহারা দিতে গিয়েই যদি এমন ভারী জ্বর বাধে তবে নিজের প্রেমিকার বেলায় কি করবেন শুনি?
টুটুলের খোঁচা মারা কথায় মিইয়ে গিয়ে ইকবাল বলে উঠলো
“খুব শীঘ্রই তোকে দেখে নেবো আমি টুটুল।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ভিয়ানের নাক থেকে গড়িয়ে পড়লো তরল।সেই সাথে মাথাটা প্রচন্ড ভাবে ভারী হয়ে মগজ ধরে উঠলো।
নাক মুছতে মুছতে ফর্সা চোখা নাকের মসৃন ডগাটা রক্তিম বর্ন ধারণ করলো।সেই দৃশ্য দেখে তাচ্ছিল্য হেসে ইকবাল বলে উঠলো
“ওরে আমার ডক্টর এলেন নিউইয়র্ক থেকে রোগীর জ্বর সারাতে।এখন নিজের জন্যই ডক্টর এপয়েন্ট করতে হচ্ছে।সালা!
ইকবালের শুকনো মুখের পানে তাকিয়ে ভিয়ান ভাঙা নাকি কন্ঠে বলে উঠলেন
“বাসা থেকে ছাতা নিতে কিভাবে ভুলে গেলি ড্যামেয়েট?
আঙ্গুলি দিয়ে কপাল স্লাইড করতে করতে ইকবাল বলে উঠলো
“তোর তাড়াহুড়োতে কি ঘরে টেকা যাচ্ছিলো?বকবক করে তো মাথাই খারাপ করে দিয়েছিলি।
“আচ্ছা হসপিটালে চল, ডক্টর দেখিয়ে আসি।
ইকবাল বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো
“আমার আর ডক্টর প্রয়োজন নেই।আমি এমনি ই ভালো আছি।
কথাটি বলে চোখ বুজে সোফায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়লো ইকবাল।কিন্তু ভিয়ানের অস্বস্তি কমলো না কোনো ভাবেই।শেষমেশ উপায় হিসেবে টিস্যু ছিড়ে রোল করে নাসারন্ধ্রে ঢুকিয়ে চিৎ হয়ে মরার মতো পরে রইলো।
********
দূর আকাশের ঘন কালচে মেঘ সরে গিয়ে সামান্য আলোর দেখা মিলছে।এখন আর বৃষ্টি নেই।তাথৈ ঘুম থেকে উঠেছে খুব ভোরে।গায়ে ওতো জ্বর নেই।কিন্তু অসহনীয় অসস্তির কারনে শুয়ে বসে থাকা যাচ্ছে না।বিছানার সাথে বালিশে হেলান চোখ বুজে গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই দৃষ্টি ঝাপসা হলো।এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো সত্যি ভিয়ান তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে রেখেছে।নিজের মনের কল্পনা কে সাময়িক সত্যি ভেবে গায়ে জড়ানো কম্বল নাকের কাছে এনে গন্ধ নেবার চেষ্টা করলো।কিন্তু আফসোস প্রচন্ড ঠান্ডায় দুটি নাক ই বন্ধ।ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হেসে গত রাতের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা কে মনের ভ্রম ভেবে বিছানা থেকে উঠে দুর্বল পায়ে মেহেরিন চৌধুরীর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো তাথৈ।
তাথৈ এর ভবিষ্যৎ চিন্তায় পুরোটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছেন মেহেরিন।ভোর রাতের দিকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।মাথাটা খুব করে ধরে রয়েছে।বিছানা ছাড়তেও ইচ্ছে হচ্ছে না।বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে মেহেরিন চৌধুরী ভাবতে লাগলেন
“আদৌ কি এরিক আর সাইফ আজমীর কালো হাতের থাবা থেকে আমার মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবো আমি?নতুন কোন মুসিবত সামনে হাজির হতে চাইছে?কে এই আয়াজ আমির?ওরা বাপ ছেলে মিলে কি আমার মেয়েটার বড় কোনো ক্ষতি করে দেবে?যদি মেয়েটাকে কোনো ভাবে ছিনিয়ে নেয় তখন?
“আম্মু?
হঠাৎ ফ্যাসফ্যাসে মলিন কন্ঠের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ধরফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলেন মেহেরিন।হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে হাতের উল্টোপিঠে জ্বর মেপে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন
“থ্যাঙ্ক গড তোমার জ্বর কিছুটা কমেছে।সারা রাত তোমার চিন্তায় আমার চোখে ঘুম নেই।রাতে দু তিনবার তোমাকে দেখার জন্য উঠে গেলাম কিন্তু দেখি দরজা আটকানো।বেশ কয়েকবার ডেকেছি তবুও দরজা খোলোনি।ভাবলাম হয়তো ভালো ভাবে ঘুমাচ্ছ এজন্য আর বিরক্ত করিনি।
মেহেরিনের কথায় তাথৈ এর কপালে চিন্তার সূক্ষ্ণ ভাঁজ পড়লো।মনে মনে ভাবতে লাগলো
“আমি তো দরজা লক করিনি।তবে?
তাথৈ এর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে মেহেরিন উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালেন
“তোমাকে এমন লাগছে কেনো?খারাপ লাগছে?
তাথৈ মনের সন্দেহ মনে রেখে ভ্রু কুঁচকে এলোমেলো কন্ঠে বলে উঠলো
“আমি ঠিক আছে আম্মু।আমার খিদে পেয়েছে,ঝাল ঝাল ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে করছে।একটু রেঁধে দেবে প্লিজ?
মেহেরিন মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন
“আপাতত কিছু খেয়ে নে।এক ঘন্টার মধ্যেই টেবিলে হাজির করছি তোর পছন্দের খিচুড়ি আর গরুর মাংস।
মেহেরিনের কক্ষ থেকে বেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় নিজের কক্ষে দৌড়ে এলো তাথৈ।কক্ষের দরজা আটকে পুরো কক্ষে জহুরী নজরে কিছু খুঁজতে লাগলো।শেষমেশ কিছু না পেয়ে বিষন্ন মনে যখন চোখে জল জমলো ঠিক সেই সময়ে নজর আটকালো বেবি পিংক বালিশের কভারের উপর।তিন ইঞ্চি মতোন লম্বা বাদামি রঙের পুরুষালি চুল অস্তিত্ব দখল করে রয়েছে বালিশের কভারের উপর।সেই চুল দ্রুত গতিতে হাত বাড়িয়ে চোখের সামনে ধরতেই তিরতির করে কেঁপে উঠলো তাথৈ শুষ্ক ঠোঁট জোড়া।দুই চোখের কোল ঘেঁষে মোটা মোটা জলরাশির নোনতা ধারা ছুটলো কপোল বেয়ে।হৃদযন্ত্রের ধুকপুক ধ্বনি তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।টেবিলের উপর সযত্নে রাখা কাঠের বক্স থেকে ভাঙা রক্ত যুক্ত বাদামি ফিতার ঘড়ি চকলেটস আর শুকনো রক্তে জড়ানো রুমাল হাতে নিয়ে গায়ের স্লিপিং শার্ট আর ট্রাউজার পরেই আলুথালু ভঙ্গিতে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলো তাথৈ।কলের পুতুলের ন্যায় চারপাশে দৃষ্টি না মেলে সামনের দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেটে ড্রয়িং রুমে নেমে এলো।মেহেরিন চৌধুরী রান্নায় ব্যস্ত।মেহেরিনকে কিছু না বলেই মেইন গেট খুলে ডেকে উঠলো
“রহমান চাচা”
তাথৈ এর ডাক পেতেই বৃদ্ধ রহমান দৌড়ে এলেন।
“এই অবস্থায় কোথায় যাবেন আম্মা?
সিক্ত ভেজা কন্ঠে তাথৈ বলে উঠলো
“যেখানে আমার প্রাণ আছে সেখানে চলো।
বৃদ্ধ রহমান তাথৈ এর কথার আগামাথা না বুঝলেও এতটুকু বুঝতে পারলো অবশ্যই মারাত্মক কিছু হয়েছে।তাই আর কথা না বাড়িয়ে পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করতে চলে গেলো।
********
“কি রে এখনই চলে যাবি?এই সময়ে কিভাবে যাবি?আর এক রাতের জন্য ই বা কেনো এলি?
ভিয়ানের লাগেজ গুছানোর মুহূর্তে অবাকের সহিত এক সাথে এতোগুলো প্রশ্ন করে উত্তরের প্রতীক্ষায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো ইকবাল।
ব্যাগের চেইন লাগাতে লাগাতে ভিয়ান সর্দি জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো
“এই একটা রাত আমার কাছে হাজার বছরের চাইতেও মধুর।বুকে কতোটা শান্তি পাচ্ছি এটা তুই বুঝবি না।কাজের প্রচন্ড প্রেসার তাই যেতে হচ্ছে।অভীক একা সামলাতে পারছে না।আর অস্ট্রেলিয়ান
ডায়মন্ড ব্র্যান্ড “রেইন্স ড্রপ” আমার সাথে কাজ করার আগ্রহ পোষন করেছে।সে পার্সোনালি মিট করতে চেয়েছে আমার সাথে।তাই যেতে হচ্ছে আর কি।কিন্তু খুব শীঘ্রই আবার ফিরবো।পাখিটাকে রেখে যেতে বড্ড যে খারাপ লাগছে।
“তাই বলে এখনই বেরিয়ে যাবি?”
“আমি আসার আগেই যাবার টিকেট কেটে ফেলেছি ইকবাল।এগারোটা পঁচিশ এ আমার ফ্লাইট।এখন দশটা দশ বাজে।আর সময় কোথায়?
“তোর কি মনে হচ্ছে না তাথৈ অনেক বেশিই সাফার করছে?
ভিয়ান গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে অপরাধী কন্ঠে বলে উঠলো
“তাথৈ এর সাথে মেহেরিন আন্টি জড়িয়ে রয়েছে।উনি না থাকলে তাথৈকে কেউ শত চেষ্টা করেও আমার থেকে আলাদা করতে পারতো না।কিন্তু মেহেরিন আন্টির জন্য আমি বুকে পাথর বেঁধেছি এবং তাথৈকেও কষ্ট দিচ্ছি।
“তাথৈকে তুই তুলে নিয়ে গেলে মেহেরিন আন্টির প্রবলেম কোথায়?
“মেহেরিন আন্টিকে সাইফ আজমী জাস্ট মেরে ফেলবে।শুধু তাই নয় তাথৈ এর সকল দুর্বলতা ওর মা।মেহেরিন আন্টিকে কব্জা করে তাথৈকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে সাইফ আজমী।তাথৈ যেমন আমার আমানত ঠিক তেমনি মেহেরিন আন্টিও অন্য কারো আমানত।সাইফ আজমী তো শুধু জোর করে তার খিয়ানত করেছে।আমি যে সাজিদ মাহমুদ এর কাছে ওয়াদা করেছি যে করেই হোক মেহেরিন আন্টিকে তার হাতে তুলে দেবো!
ইকবাল দাঁত দিয়ে নখ খুটতে খুটতে চিন্তিত কন্ঠে শুধালো
“তাথৈকে দিয়ে সাইফ আজমীর কি কাজ?যেখানে তাথৈ তার মেয়েই নয়?আর তুই ও তো সোনার হরিণ ই ধরতে গেলে।তাহলে প্রবলেম টা কোথায়?
মুখে ফিচেল হাসি টেনে ধরে ভিয়ান ছোট কন্ঠে বলে উঠলো
“সাইফ আজমীর পুরো প্রপার্টি তাথৈ এর নামে।আর সাইফ আজমীর যেই প্রপার্টি দেখছিস এ সবকিছুই তাথৈ এর বাবার ছিলো।কারন সাইফ আজমীর জোয়ার নেশা ছিলো।নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স,বিজনেস, প্রোপার্টি সব হারিয়ে যখন সে দেউলিয়া হয়েছে ঠিক তখনই তাথৈ এর বাবা কে নিশানা করেছে সাইফ আজমী।তাথৈ এর বাবা ভাইয়ের কুকীর্তি আগেই টের পেয়ে গেছিলেন।এজন্য নিজের সমস্ত সম্পত্তি উইল করে দিয়ে ছিলেন দুই বছর বয়সী তাথৈএর নামে।ওই সম্পত্তি তাথৈ না লিখে দিলে সাইফ আজমী কখনো ছিনিয়ে নিতে পারবে না।আর আমার কাছে তাথৈকে বিয়ে দিলে সাইফ আজমিকে আমি ছাড়বো না।মূল ঘটনা এখানেই।এজন্যই আমাকে দুনিয়া ছাড়া করতে চেয়ে ছিলেন ওই ভদ্রলোক।কিন্তু বেখেয়ালি পনায় বিশ্ৰী ভাবে প্রাণ হারালো আমার সেক্রেটারি ‘তাইম তাইয়েফ’
কথা গুলো বলতে বলতে নিজেকে তৈরি করে নিয়ে ভিয়ান বলে উঠলো
“যাচ্ছি।খেয়াল রাখিস আমার জানের উপর।আর এরিক ওকে পুনরায় আঘাত করলে এরিকের চেহারার নকশা বদলে দিবি।বাস্টার্ড আমার বউয়ের শরীরে অমানুষের মতো আঘাত করেছে।তাথৈ এর পিঠে কতগুলো জখমের দাগ জানিস?
মুহূর্তেই চোখ মুখের ভাব পরিবর্তন হলো ভিয়ানের।যেই চোখে মুখে কিছুক্ষন আগেও কষ্টের ছাপ ছিলো সেগুলোতে এখন ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট।বিছানা থেকে লাগেজ হাতে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করতে করতে গম্ভীর ভরাট কন্ঠে ভিয়ান বলে উঠলো
“প্রথমে ভেবেছিলাম সাইফ আজমিকে পুলিশে দেবো সকল প্রমাণাদি সমেত।কিন্তু মনকে বদলেছি।ওই নর পশু দুটোকে আমার পার্সোনাল টর্চার সেল এ বন্দি করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তামাশা দেখবো।জত গুলো মানুষকে সে এই পর্যন্ত ভুগিয়েছে তার শোধ না তুলে পুলিশে দিলে আমার মন শান্ত হবে না।আর আমি না বলা পর্যন্ত আমার বিষয়ে তাথৈকে কিচ্ছু বলবি না।তীরে এসে তরী ডুবাতে চাইনা আমি।আসছি।বাই”
*********
তাথৈ এর দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী বাড়ির সামনে যখন গাড়িটা থামলো ঠিক ওই মুহূর্তেই আরেকটা গাড়ি ক্রস করে চলে গেলো ওদের বিপরীত দিকে।বৃদ্ধ রহমান কে কিছু না বলেই দৌড়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো তাথৈ।ভিয়ানকে বিদায় দিয়ে কেবলই সোফায় পিঠ এলিয়েছে ইকবাল।আচানক নিজের বাড়িতে বিধস্ত তাথৈ কে দেখে ধরফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো ইকবাল
“একি তাথৈ তুমি?
ইকবালের কথার উত্তর না জানিয়ে তাথৈ চিৎকার করে ডেকে উঠলো
“ভিয়ান”!
ইকবাল নিজের লম্বা ঝলমলে চুলগুলো হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ এর মত করে বিস্মিত হয়ে শুধালো
“এসব কি করছো তাথৈ?
শক্ত চোখে তাকিয়ে তাথৈ বলে উঠলো
“ভিয়ান আপনার বাড়িতেই আছে তাই না ইকবাল ভাই?
মেয়েটির অসুস্থ মলিন মুখের পানে তাকিয়ে ইকবালের মন গলে গেলো।হৃদয়ের কোথাও একটা সূক্ষ্ণ ব্যাথার উপস্থিতিও টের পেলো।তবুও উপরে কাঠিন্য ভাব এনে শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো
“বেঁচে থাকলে তবেই না আমার বাসায় থাকবে।তুমি এখানে কেনো এসেছো তাথৈ?তুমি কি ভুলে গেছো তোমার বাবার সাথে যে আমার ঝামেলা আছে? তুমি এবাড়িতে এসেছো জানলে পুনরায় ঝামেলা বাধাবে।ভুলে যেওনা তোমার বাপ কিন্তু আমাকে দু মাস জেল খাটিয়ে ছেড়েছে শুধু মাত্র তোমার সাথে ভিয়ানের ব্যাপারে কথা বলেছি বলে।ওই সাইফ আজমিকে তো আমি….
হাতে থাকা ছোট চুল টা ইকবালের সামনে তুলে ধরে তাথৈ আশা যুক্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“এটা ভিয়ানের চুল ভাইয়া।এটা আমি আমার কক্ষের বালিশে পেয়েছি।আমাদের বাড়িতে কারোর এই রঙের চুল নেই।আর আমার কক্ষে গিয়ে কারো শোবার সাহস ও নেই।গত রাতে আমি ভিয়ানের শরীরের গন্ধ পেয়েছি।ওই গন্ধটা যে আমার ভীষণ পরিচিত ইকবাল ভাই।
তাথৈ এর কথায় বেশ ব্যাথিত হলো ইকবাল।তবুও মুখে কিছু না বলে ইকবাল সেই চুলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
“একটা চুল দেখে তুমি ভিয়ানকে খুঁজতে এসেছো আমার বাড়িতে?
একটা চুল কিভাবে প্রমান করে যে এটা ভিয়ানের চুল?বাতাসে উড়েও তো আসতে পারে তাই না?আর ভিয়ান বেঁচে থাকলে লুকিয়ে কেনো থাকবে তুমি ই বলো?ও তোমাকে কতোটা ভালোবাসতো এটা তো আমার চাইতে তুমিই ভালো জানো।
এবার তাথৈএর মনে যেই আশার প্রদীপ জ্বলেছিলো তা দপ করে নিভে গেলো।সিক্ত ঝাপসা চোখে ইকবালের পানে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে তাথৈ শুধালো
“বাবা ভিয়ান কে মেরেছে তাই না ইকবাল ভাই?
#চলবে