#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_২৭
সিডনির আকাশে চকচকে আলো নিয়ে সূর্যের দেখা মিলেছে আজ।হঠাৎ ভারী শীতের পর একটু উষ্ণতা সকলের মাঝে চাঞ্চল্যতার সৃষ্টি করেছে।রাস্তাঘাটেও গাড়ি এবং মানুষ দুটোর ই চাপ বেশি।বেড়েছে সকলের কর্মব্যস্ততা।সেই সাথে মুখে ফুটেছে প্রশস্ত হাসি।
নিজের কেবিনের সুইভেল চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে ক্রোধিত চোখে মুখে বসে আছে রেইন।তার মুখে আপাতত কোনো হাসির লেশ মাত্র নেই।তার সামনেই মাথা নত করে দাঁড়ানো বিদেশি এক যুবক।নাম তার ড্যান।তিহান কে খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়েছিলো তার উপর।অর্থারের বেশ বিশ্বস্ত সে।জাসুসি কাজে পারদর্শী বলেই আর্থার তাকে চোখ বন্ধ করে নিশ্চিত সাফল্য ভেবেই কাজটি করতে দিয়ে ছিলো।কিন্তু তিহানের খুজ তো দূর তার টিকির নাগাল ও পায়নি ড্যান।এদিকে অসফল লোক রেইনের পছন্দ নয়।সামান্য একটা মানুষ খুঁজে বের করতে পারেনি সে?এ আবার কেমন জাসুস?নীরব কেবিনে রেইনের রাগের পারদ তরতর করে আরো কিছুটা বাড়লো।তবে এটা তিহানের উপর বা ড্যানের উপর নয়।তার নিজের উপর ই।ছেলেটার চেহারা ভালো করে দেখা উচিত ছিলো তার।লক্ষ মিস করার লোক রেইন নয়।তবে এই তিহান নামক আপদ হাত থেকে ছাড় পেলো কিভাবে?ছেলেটি নিশ্চিত দেশে এই ব্যাপারে খবর পাঠাবে।এরপর সিডনি পুলিশ স্টেশনে কেস ফাইল করবে।বুদ্ধিমান হয়ে থাকলে যদি নম্বর প্লেট এর নম্বর ঠুকে নেয় তবে আরেক ঝামেলা।বিদেশি পুলিশ দের হাত থেকে তাথৈকে ছিনিয়ে নেয়া চ্যালেঞ্জিং ম্যাটার হয়ে দাঁড়াবে।উফ অসহ্য যন্ত্রনা।যেই যন্ত্রনা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত আনার সময় ও পোহাতে হয়নি সেটা এই নিজ দেশে এসে পোহাতে হচ্ছে।লম্বা এক উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রেইন।এরপর ধীর পায়ে ড্যানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো
“আই গেভ ইউ টু মোর ডেইজ।ইন দ্যা মিনটাইম আই ওয়ান্ট দ্যাট বয়।আদার ওয়াইজ…..
কথাটি বলে ড্যান এর এলোমেলো কলার ঠিক করতে করতে বিগলিত প্রাণ হীন হাসলো রেইন।ছেলেটি হাসি দেখেই বুঝে নিলো এই ভয়ানক লোকটি কি মিন করতে চাইছে।ছেলেটি কাঁপা জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠলো
“আ আ আ আ উইল ট্রাই…
“উহু নট ট্রাই।ইউ হ্যাভ টু গেট ইট।আন্ডারস্ট্যান্ড?
“ই ই ইয়েস স্যার।
“গুড বয়,গেট টু ওয়ার্ক।
যাবার অনুমতি পেতেই আর দাঁড়ালো না ড্যান।কোনো রকম সম্মান প্রদশর্ন করে এক প্রকার দৌড়েই পালালো সে।ছেলেটির যাবার পানে তাকিয়ে রেইন বলে উঠলো
“দ্বিতীয়বার খালি হাতে ফিরে এলে নিজের পা দুটো নিয়ে আর দৌড়াতে পারবে না ড্যান রোজারিও।
********
সিডনি মাস্কট এয়ারপোর্ট এ মাত্রই ল্যান্ড করেছে ভিয়ান।টানা তেইশ ঘন্টা জার্নি করে শরীর ক্লান্তিতে ভরে উঠলো তার।নিজের সিক্স সেন্স এর ভিত্তিতে আসন্ন বিপদ অনুমান করে তিহানকে বাসা চেঞ্জ করিয়ে নিজের বাংলোতে পাঠিয়েছে ভিয়ান।রেইন তাকে এমনি এমনি ছাড়বে না এটা চতুর ভিয়ান ঠিক বুঝেছে।আর তিহানকে কেউ এই নামে চিনেই না এখানে।সেজন্য আর বেশি বেগ পোহাতে হয়নি।তিহান তাকে এয়ারপোর্ট এ নিতে আসবে না,ভিয়ান নিজেই মানা করেছে।নিজের সেক্রেটারি অভীক কে আগেই ফোনে সব জানিয়েছে ভিয়ান।অভীক নিউ ইয়র্ক থেকে সরাসরি সিডনিতে চলে এসেছে সেই সাথে এয়ারপোর্ট এর বাইরে গাড়ি নিয়ে তার অপেক্ষা করার কথা।সিডনিতে নিজের বাড়ি গাড়ি এবং রাজত্ব সবই ছিলো এক সময়।কিন্তু ভাগ্যের ধাক্কায় সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।সব কিছু বিক্রি করে নিউইয়র্ক চলে গেলেও নিজের বাবার বানানো বাড়িটা বিক্রি করেনি সে।ব্যাবসায়িক কাজে প্রায় ই এখানে আসা পরে তার।তখন সেই রাত গুলো নির্ঘুম কাটায় ভিয়ান।তাথৈকে জড়িয়ে এই বাড়িতে হাজারো স্মৃতি তার।দূতলা বিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাংলোটা তাথৈএর অনেক পছন্দের ছিলো।ভিডিও কলে প্রায়ই ভিয়ান তাকে বাড়িটা দেখাতো।বাড়িতে কোথায় কোন গাছ লাগাবে কোন ওয়ালে কি পেইন্টিং লাগাবে এসব বিষয় নিয়ে রোজ খুনসুটি হতো তাদের।সাইফ আজমী নোংরা খেলা না খেললে নিজের বাড়ি ছেড়ে কখনোই পর দেশে পাড়ি জমাতো না ভিয়ান।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে এসব ভাবনা ভেবে চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো মুহূর্তেই।মাথা নিচু করে পলক ঝাপটিয়ে চোখের জল গুলো আড়াল করে চোখে রোদ চশমা লাগিয়ে লাগেজ নিয়ে হনহন করে এক্সিস্ট এর দিকে এগুলো ভিয়ান।
গাড়ি নিয়ে রাস্তার পাশেই অপেক্ষা করছিলো অভীক আর অপেক্ষা করছিল তার বসের।দীর্ঘ অপেক্ষার পর সকলের মাথার উপর দিয়ে নিজের বসের মুখ চিনে নিতে একটুও সময় অপচয় হলো না তার।হাত নাড়িয়ে নিজের অবস্থান জানান দিলো অভীক সেই সাথে প্রশস্ত হেসে অভিবাদন জানালো।
“আপনাকে অনেক শুকনো লাগছে স্যার।রাস্তায় কোনো রেস্টুরেন্টে দাড়াবো নাকি সোজা বাংলোতে ফিরবো?
গাড়ির ডিকিতে নিজের ব্যাগ ভরে অভীকের পাশের সিটে বসে ক্লান্ত কন্ঠে ভিয়ান বলে উঠলো
“বাসায় চলো অভীক।আমার মন ভালো নেই।খাবার খেয়ে পেট ভরানোর চাইতে খা খা করা হৃদয় টা পরিপূর্ণ করা আগে জরুরি।আমি মানসিক ভাবে ডিপ্রেসড।খাবার খাওয়া তো দূর কথা বলার অবস্থাতেই নেই আমি
ভিয়ানকে এই প্রথম এতোটা অসহায় মনে হলো অভীকের কাছে।দুটো বছর ধরে লোকটির সাথে রয়েছে সে।অথচ কখনো তাকে এতোটা বিধ্বস্ত দেখেনি।সব সময় নিজের শক্ত কাঠামো ধরে রেখে নিপুণ ভাবে নিজেকে মানুষের সামনে প্রেজেন্ট করেছে।তবে কি মেয়েটা এতো টা গভীর হৃদয়ে বসবাস করে তার?
আর ভাবলো না অভীক।দামি গাড়ি হাকিয়ে ছুটে চললো নাওয়াফ প্যালেস এ।
**********
নিজের একত্রিশ তম জন্মদিন উপলক্ষে নিজ বাড়িতে বিশাল এক পার্টির আয়োজন করেছে রেইন।সেখানে আমন্ত্রিত রয়েছে দেশ বিদেশের সকল বন্ধু এবং নিজেদের আত্মীয়।পুরো বাড়ি সেজে উঠেছে জাকজমক ভাবে।রেইন মনে মনে ভেবে রেখেছে আজকেই তাথৈকে এনগেজমেন্ট রিং পরাবে সে।মেয়েটা অনেক ভুগিয়েছে তাকে।আর কোনো চান্স মেয়েটাকে এক মুহূর্তের জন্য দেবে না সে।একবার তাথৈ তার হয়ে গেলে হাজার থানা পুলিশ করেও কেউ কিচ্ছুটি বাগাতে পারবে না তার।মেয়ে মানুষ টাকা আর সুদর্শন পুরুষের প্রতি বড্ড দুর্বল।কি নেই আয়াজ আমিরের?একবার সোহাগ রাত পার হলেই তাকে ভুলবে সাধ্য কি তার?যেসব নারী সঙ্গ উপভোগ করছে সে তাদের সকলেই দ্বিতীয় বার তার পা জড়িয়ে কেঁদেছে শুধু মাত্র তার ভালোবাসা পাবার জন্য।যেখানে সেধে সেধে সে মেয়েটাকে এতো এতো ভালোবাসা দিতে চাইছে সেখানে কোন যুক্তিতে গ্রহণ করবে না এই বোকা মেয়ে?
নিজ কক্ষে রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে রেইন গর্জে বলে উঠলো
“তবে কি তার প্রাক্তন পুরুষ আমার চাইতেও সুদর্শন আর টাকা ওয়ালা ছিলো?না যে কিছুতেই হতে পারেনা।পৃথিবীর চতুর্থ পয়সাওয়ালা লোক সে। তার মতো ধনীর দুলাল অবশ্যই দেশ বিদেশে ঘেঁটে এই দেশি মেয়ের পায়ে নিজের প্রেম নিবেদন করবে না।
নিজের দাম্ভিক ভাবনা ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলো নিজেকে তৈরি করতে।আজ তাকে সকলের চাইতে স্পেশাল লাগানো চাই।
তাথৈ এর বদ্ধ ঘরের দরজা খানা হঠাৎই খোলে গেলো সেই সাথে কক্ষে প্রবেশ করলো দুজন মেয়ে সার্ভেন্ট।তাদের হাতে একটা অফ সোল্ডার মেরুন রঙের গাউন আর ডায়মন্ড এর কিছু সিম্পল গহনা।উৎসুক আর ভাবুক হয়ে মেয়ে দুটোর দিকে তাকাতেই তারা বলে উঠলো
“আজ আমাদের স্যারের জন্মদিন।তৈরি হয়ে নীচে চলুন।
অসভ্য লোকটির জন্মদিন তাতে তার কি?তার কেনো যেতে হবে ওই পার্টিতে।আর এসব পোশাক সে কোন দুঃখে পরবে?সেকি বিদেশি কালচারে বড় হয়েছে?
মুহূর্তেই মেয়ে দুটোর উপর চড়াও হয়ে তাথৈ বলে উঠলো
“ইম্পসিবল।আমি কখনোই এই পোশাক পরবো না।বেশি বাড়াবাড়ি করলে সব কিছুতে আগুন জ্বালিয়ে দেবো আমি।
তাথৈ এর চিল্লাচিল্লি তে মেয়ে দুটো এক জন আরেক জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো সেই সাথে বেশ ভীত ও হলো।তাদের মালিক জানতে পারলে আস্ত কেলেঙ্কারি হবে।তাদের চাকরিও চলে যেতে পারব।তাহলে এই জেদি মেয়ের সাথে কিভাবে পারবে তারা?
ড্রেস আর গহনা গুলো ছুড়ে ফেলে তাথৈ চিৎকার করে বলে উঠলো
“গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার নাও।
হঠাৎই সব কিছু স্তব্ধ করে দিয়ে পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠলো
“আমাকে আরো কঠোর হতে বাধ্য করো না তাথৈ।পরে নিজেই পস্তাবে।ওরা ব্যর্থ হলে ড্রেস আর গহনা আমি নিজেই পরাবো তোমাকে।সেটাতে কি কমফোর্ট ফিল করবে তুমি?
রেইনের দিকে ঘৃনীত নজর বুলিয়ে তাথৈ শক্ত কন্ঠে বলে উঠল
“যেই জুলুম বিনা কারণে আমার উপর আপনি করছেন তা আল্লাহ কখনোই সইবে না।
“উপর ওয়ালা কি নিজ হাতে আমাকে বাধা দিতে পারবে তাথৈ শেহতাজ?
সৃষ্টি কর্তার উপর এহেন টিটকারি মূলক কথায় রেইনের প্রতি আরো বেশি ঘৃণার উদ্রেক হলো তাথৈ এর।রাগে দুঃখে মুখেফ সকল ভাষা হারিগে ঝাপসা চোখে আহত কন্ঠে শুধু বলে উঠলো
“আপনি ধ্বংস হোন।
তাথৈ এর কথায় তাচ্ছিল্য হেসে প্রস্থান নিলো রেইন।রেইন চলে যেতেই মেয়ে দুটো তাথৈকে তৈরি করার কাজে মন দিলো।প্রাণ হীন কাঠের পুতুলের ন্যয় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে এসব রঙ তামাশা দেখায় মগ্ন হলো তাথৈ।আর মনে মনে বলে উঠলো
“আমাকে আর কত কষ্ট দিবে তুমি মাবুদ?আমি কি আসলেই অনেক পাপী?আমি যে বেঁচে থেকেও জাহান্নামের আযাব ভোগ করছি।আর তো সহ্য হচ্ছে না।এবার তো একটু ক্ষমা করো আমায়।
রেইনের পুরো বাড়ি আজ উন্মুক্ত মেহমান দের জন্য।আজ কোথাও কোন বাধা নেই।শুধু বাড়ির চারপাশে কঠিন সিকিউরিটি পাহারা দিচ্ছে।তাথৈ চাইলে সব জায়গায় পা ফেলতে পারবে আজ।শুধু ডিঙাতে পারবে না মস্ত গেট টা।এক প্রকার নিশ্চিন্তে স্মিত হেসে আগত অতিথিদের সাথে কুশলাদি বিনিময়ে ব্যস্ত হলো সে।কিন্তু এদিকে নিজের জীবনের উপর বিরক্ত হয়ে জীবন মরন ত্যাগ স্বীকার করে পালানোর পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলো তাথৈ।
“আমাকে পালাতে আপনি নিজেই সাহায্য করবেন মিস্টার রেইন।এবং আজ রাতেই।
চলবে…..
#বছর_দুয়েক_পর
#পর্ব_২৮
সারিকা হোসাইন
********
সুন্দর বর্ণালী এক সন্ধ্যা।এই সন্ধ্যায় সিডনির ধন কুবের আয়াজ আমিরের বিশাল বাড়ি সেজে উঠেছে বিভিন্ন বাহারি লাইটস আর তাজা ফুলে।চারপাশে গিজগিজ করছে আগত মেহমানে।পূর্বের পার্টি গুলোর তুলনায় আজকের পার্টি তাদের কাছে আরো আভিজাত্য পূর্ন মনে হচ্ছে।সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন শুরু হবে মেইন পার্টি।কিছু সময় গড়াতেই সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফুলে সজ্জিত স্টেজে উঠে এলো আয়াজ আমির।তার বেশভূষা আর জৌলুস যেনো সকলকে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।ধনীর দুলালী গুলো একবার হ্যান্ড পার্সে থাকা মিনি আয়নায় নিজেদের গ্ল্যামার দেখে নিলো।বলা যায়না কখন কার উপর চোখ পরে যায়।রেইন এগিয়ে আসতেই একজন গার্ড তার হাতে একটা ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন এগিয়ে দিলো।সেটা হাতে নিয়ে লাজুক হেসে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো
“লেডিস এন্ড জেন্টল ম্যান ,টুডে ইজ এ ভেরি স্পেশাল ডে ফর মি।টুডেজ পার্টি ইজ নট এবাউট মাই বার্থডে,টুডেজ পার্টি ইজ ফর মাই এনগেজমেন্ট।
কথাগুলো বলে স্মিত হেসে সকলের পানে নজর বুলালো রেইন।কথাগুলো এনাউন্স করার সাথে সাথেই চারপাশ মুখরিত হলো করতালিতে।সেই সাথে কিছু সুন্দরী বিদেশিনীর মুখ কালচে আধারে ভরে উঠলো।চাপা গুঞ্জনে গুনগুন করে উঠলো পুরো হল রুম।দুই হাতের ইশারায় সকলকে থামতে অনুরোধ করে রেইন পুনরায় বলে উঠলো
“আই রিকোয়েস্ট মাই ফিয়েন্সি টু এপেয়ার ইন ফ্রন্ট অফ এভরিওয়ান।
ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন এ এই এনাউন্স শুনে থরথর করে কেঁপে উঠলো তাথৈ।বার বার চোখ থেকে মোটা মোটা জল গড়িয়ে পড়ছে তার।কঠিন বিষাদ যুক্ত ব্যাথায় শরীর মন দুই ই জর্জরিত হয়ে উঠেছে দীর্ঘ সময় ধরে।তার সাদা কালো জীবনে এসব কি রঙিন তামাশা জুড়েছে এই লোক?জোর করে কিসের অধিকার আদায় এ মরিয়া হয়ে উঠেছে সে?ভালোবাসা কি জোর করে হয় কখনো?যাকে দেখলেই ঘৃণায় শরীর ঝলসে যাচ্ছে তার সাথে কিসের বিয়ে?বিধাতা কি তার জীবনের সকল সুখ কেড়ে নিয়ে এই দূর দেশে মৃতের ন্যয় বেঁচে থাকার জন্য প্রেরণ করেছে?
রেইনের দুই মেয়ে বন্ধু মুখে প্রশস্ত হাসি মেখে আল্ট্রা মডার্ন পোশাকে উপস্থিত হলো তাথৈ এর কক্ষে।মেয়ে দুটোকে দেখে অসহায় নেত্রে তাথৈ তাদের পানে অশ্রু সজল চোখে নিরুপায় হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।মেয়ে দুটো তাথৈ এর চোখের পানে তাকিয়ে নিজেদের প্রশস্ত হাসি থামিয়ে অবাক মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করলো।তাদের মধ্য থেকে একজন মেয়ে দ্রুত পায়ে তাথৈ এর কাছে দৌড়ে এসে তাথৈ এর হাত চেপে ধরে ভীতি মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞাস করলো
“হুয়াট হ্যাপেন?ইউ ডোন্ট এগ্রি টু একসেপ্ট রেইন?
মেয়েটির প্রশ্নে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল তাথৈ এর চোখ থেকে।সহসাই মেয়েটির পা জড়িয়ে তাথৈ হুহু করে কেঁদে উঠলো।মেয়ে দুটো এই দৃশ্যে চোখ বিস্ফারিত করে নির্বাক হয়ে তাথৈ এর পানে নজর দিলো।
“লেট মি গো ফ্রম হেয়ার প্লিজ।আম নট হিজ ফিয়েন্সি।হি কিডন্যাপড মি।আই লাভ সাম ওয়ান ইলস।
মেয়েটির কান্নায় নোয়াহ নামের মেয়েটি তাথৈ এর বাহু খামচে বুকে জড়িয়ে আহত কন্ঠে বলে উঠলো
“প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।উই উইল ট্রাই টু হেল্প ইউ।প্লিজ স্টপ ক্রাইং।
তাথৈকে আরো কিছু বুঝিয়ে মেয়ে দুটো বলে উঠলো
“আপাতত আমাদের সাথে চলো।আমরা তোমাকে অবশ্যই হেল্প করার চেষ্টা করবো।কিন্তু খবরদার রেইন যেনো কিচ্ছুটি টের না পায়।
এই বিদেশবিভুঁইয়ে মেয়ে দুটোর কথা তাথৈ এর মরে যাওয়া মনে আশার ফুল ফুটালো।কিন্তু তাদের মধ্যে আরেকজন মেয়ে বলে উঠলো
“বাট তুমি পালিয়ে যাবেই বা কোথায়?পাসপোর্ট ছাড়া রাস্তায় বের হলেই পুলিশ তোমাকে এরেস্ট করবে।তখন রেইন আবার তোমাকে কব্জা করবে।
নিজের চোখের জল দুই হাতে দ্রুত মুছে তাথৈ দুর্বল কন্ঠে বলে উঠলো
“আমার মামাতো ভাই থাকে আশেপাশে।আমি ঠিক তাকে খুঁজে নিতে পারবো।আপনারা শধু আমাকে এখান থেকে বের হবার জন্য একটু সহযোগিতা করুন প্লিজ।আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনাদের প্রতি আমি।
মাথা ঝাকিয়ে মেয়ে দুটো সম্মতি প্রকাশ করে তাড়া দেখিয়ে বলে উঠলো
“এখন তাড়াতাড়ি চলো।না হলে সে সন্দেহ করবে।আর সকলের সামনে একদম নরমাল বিহেভ করবে।রেইন যাতে তোমার উপর কঠিন নজরদারি না করে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে তোমাকে।
মেয়ে দুটোর কথায় ভরসা পেয়ে মুখে হালকা কমপ্যাক্ট পাউডার এর টাচ দিয়ে ড্রেস ঠিক করে তাথৈ বলে উঠলো
“চলুন।
ফুলে সজ্জিত রেড কার্পেট বিছানো সিঁড়ি ধরে নেমে চলেছে তাথৈ।লং গাউনের টেইল ধরে রেখেছে নোয়াহ আর হেলেন।তিন জনের মুখেই তৃপ্তির হাসি।কাউকে দেখেই বুঝার উপায় নেই কি চলছে তাদের মনে।তাথৈ কে দেখে সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো ওয়াও।
ধনী পুত্রের পছন্দের তারিফ করতে অনেকেই মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো
“বেস্ট চয়েস এভার।
বাকি মেয়ে গুলো হিংসেয় জ্বলে পুড়ে ছারখার হলো।তাথৈ কে দেখে পলক ফেলতে ভুলে গেল রেইন।তাথৈ এর হলদেটে ফর্সা শরীরে মেরুন রঙের গাউন আর ডায়মন্ড জুয়েলারি গুলো ঝকঝক করছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য ফিকে এই মোহনীয় মানবীর পদতলে।বুকের ভেতর অজানা তোলপাড় শুরু হলো সহসাই তার।পুরো শরীরে খেলে গেলো অমায়িক ভালো লাগার শিহরণ।শ্বাস নিতেও যেনো ভুলে গেল সে।আরেকটু হলেই বুঝি হার্ট এট্যাক এসে যাবে।
স্টেজে রেইনের সামনে দাঁড়িয়ে চুটকি বাজিয়ে বিগলিত হেসে তাথৈ বলে উঠলো
“পলক তো ফেলুন।
মেয়েটির এহেন আচরণে বেশ অপ্রস্তুত হলো রেইন।সেই সাথে লাজুক হেসে বলে উঠলো
“আমাকে মেনে নিচ্ছ তাহলে?
সন্দিহান মিশ্রিত কন্ঠে তাথৈ বলে উঠলো
“না মানলেও আপনি মানাতে বাধ্য করবেন।তাই মেনে নিতে হলো।
তাথৈ এর গালে স্লাইড করে রেইন বলে উঠলো
“গুড গার্ল।
রেইনের এহেন স্পর্শে শরীর রিরি করে উঠলো তাথৈ এর।হাজারো অপরাধ বোধ এ মন হলো বেতাল।চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো তার।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো
“চলুন পার্টি শুরু করা যাক।
ধীরে ধীরে জমে উঠলো পার্টি।কেক কাটার আগ মুহূর্তে আংটি বদলের কাজ সারতেও ভুললো না এই লোক।
আংটি বদলের মুহূর্তে রেইনের মুখে উজ্জ্বল প্রাপ্তির হাসি খেলে গেলো আর তাথৈ নিজের কান্না লুকিয়ে বলে উঠলো
“মনের জোর না থাকলে আংটির জোর কতোক্ষণ?
বিভিন্ন মিডিয়া গুলো একে একে তুলে যাচ্ছে হাজার হাজার ছবি সেই সাথে চলছে ভিডিও।বড়লোক ব্যাপারে তারা নাক গলাতে পেরে জীবন ধন্য মনে করে।এসব চাটুকার মিডিয়া দেখে অসহ্য রাগে শরীর ফেটে উঠলো তাথৈ এর।
কেক কাটার পর যখন খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষের পথে তখন রেইনের কিছু বন্ধু আবদার করলো ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবে।এবং যেই ডেয়ার দেয়া হবে ওটাই করতে হবে।
সকলেই সমস্বরে রাজি হলো খেলতে।
বাড়ি যখন প্রায় মেহমান শূন্য তাথৈ তখন পালানোর পথ খুজতে লাগলো।কিন্তু চারপাশে কড়া সিকিউরিটি।নোয়াহ আর হেলেন ও খুঁজতে লাগলো ফাঁকফোকর।
ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার এক পর্যায়ে হুইস্কি বোতল ঘুরে গেলো রেইনের পানে।বন্ধুরা সুযোগ লুফে নিতে হঠাৎই এক বেফায়েশ প্রশ্ন করে বসলো
“হাও মেনি গার্লস হ্যাভ ইউ স্লেপ্ট উইথ ইন ইউর লাইফ?
প্রশ্নটি করার সাথে সাথে মুহূর্তেই যেনো হাসিখুশি পরিবেশ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো।একবার তাথৈ এর ভ্রু কুঁচকানো মুখের পানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে রাগ গিলে খাবার চেষ্টা করলো রেইন।কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বসিয়ে দিলো এক ঘুষি।আনন্দ পার্টি মুহূর্তেই রূপ নিলো মারামারি তে।বাকি বন্ধুরা থামানোর পরিবর্তে রেইনের উপর হামলে পড়লো।বাইরের সিকিউরিটি পর্যন্ত দৌড়ে এলো সেই মারামারি থামাতে।পরিস্থিতি যখন এলোমেলো সুযোগ বুঝে নোয়াহ আর হেলেন আড়াল করে দাঁড়ালো তাথৈ কে এবং ফিস ফিস করে বলে উঠলো
“রান…..
********
নিজের বাড়িতে সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের শেষে ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলো ভিয়ান তা টেরই পায়নি।যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি।নিজের এমন বেখেয়ালি আচরণে বেশ অবাক হলো সে।তার ভালোবাসার মানুষটি অন্য কারো হাতে বন্দি অথচ সে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে?এ কি করে সম্ভব?
সকল ভাবনা ফেলে গায়ে জড়ানো মখমলি ব্ল্যাংকেট ছুড়ে ফেলে ভিয়ান বলে উঠলো
“বাড়িতে এতো গুলো মানুষ অথচ কেউ ডাকেনি আমাকে?নাকি ডেকেছে আমি শুনিনি?
অবচেতন মনে আরো নানান প্রশ্ন এলো,হাই তুলতে তুলতে ঢুলু ঢুলু শরীরে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো ভিয়ান।এক মগ ব্ল্যাক কফি ছাড়া শরীর সতেজ করার আর কোনো ওয়ে নেই।সিঁড়ি বেয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই অভীক আর তিহান কে নজরে পড়লো।তারা টিভিতে নিউজ দেখছে।
ফাঁকা ভোঁ ভো শব্দে উদ্বেলিত মস্তিষ্ক নিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে ভিয়ান তাদের দুজনের উদ্দেশ্যে ভ্রু কুঁচকে শুধালো
“এতো রাত পর্যন্ত ঘুমালাম তোরা কেউ ডাকলিনা পর্যন্ত আমাকে?
ভিয়ানের কথায় তিহান আর অভীক দুজন দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।এরপর নিস্তব্ধতা ভেঙে মাথা নিচু করে অভীক বলে উঠলো
“স্যার অনেক বার ডেকেছি আপনাকে।আপনি রেসপন্স করেন নি।তাই ভাবলাম আপনি ক্লান্ত।এজন্য আমরা আর কেউ আপনাকে ডিস্টার্ব করিনি।
হঠাৎই সিডনির ফ্যামাস নিউজ চ্যানেল টুডেজ নিউজ এ চোখ আটকালো সকলের।সেখানে আয়াজ আমিরের জন্মদিন এর কিছু অংশ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে।পার্টির আয়োজন ছিলো সন্ধ্যায়।এখন সেটারই কিছু চিত্র বিনোদন এর জন্য প্রচার করা হচ্ছে।
“আজকালকার নিউজ চ্যানেল গুলো বড় লোকদের টয়লেট এর খবর পর্যন্ত প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না।রাবিশ জত্তসব।
এক প্রকার তাচ্ছিল্য জনক হেসেই কথাটি বললো অভীক।কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন দেখতে পেলো জন্মদিন এর পার্টি চোখের পলকে এনগেজমেন্ট পার্টিতে রূপ নিলো।এবং ফিয়েন্সি হিসেবে মডার্ন গাউন এ তাথৈকে দেখা গেলো তখন যেনো সকলের শ্বাস গট করে বুকের কাছে আটকে গেল।রেইন তাথৈ এর সরু সুশ্রী অনামিকা আঙুলে ডায়মন্ড রিং পড়াচ্ছে এই দৃশ্য ভিয়ানের বুকে শেল হয়ে বিধলো।মুহূর্তেই পুরো দুনিয়া উলট পালট লাগলো তার কাছে।সকলের সামনে টপটপ করে খসে পড়তে লাগলো অশ্রু বিন্দু।মুখের ভাষা পর্যন্ত গায়েব হয়ে গেলো।
নিজের বিবেক বোধ হারিয়ে কেবিনেট ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবি নিতে নিতে ভিয়ান গর্জে উঠা কন্ঠে বলে উঠলো
“আ উইল কিল হিম।বাস্টার্ড….
*******
দুই হাতে বিশাল ঘের ওয়ালা লম্বা গাউন খামচে ধরে প্রানের মায়া ত্যাগ করে দৌড়ে চলেছে তাথৈ।দরকার পড়লে গাড়ির নীচে পরে জীবন দিয়ে দেবে তবুও ওই নারী পিপাসু লোকের হাতে নিজেকে সমর্পণ করবে না সে।বাইরে হিম জড়ানো কুয়াশা।ভেতরে সেন্ট্রাল রুম হিটারের কারনে এতটা শীতের মাত্রা বুঝতে পারেনি তাথৈ।কিন্তু বাইরে শীত যেনো শরীরের রক্ত জমিয়ে দিচ্ছে।অসুস্থ শরীর আরো খানিক অসুস্থ হয়ে উঠলো তাথৈ এর ।ভয় আর দুর্বলতা দুটো একসাথে কাবু করলো তাকে।অধিক দৌড়ানোর কারনে শ্বাস বন্ধ হতে চাচ্ছে।কুয়াশায় চারপাশ ঝাপসা।শীতল বাতাসে কাশি চলে এলো তার।হাঁপানি রোগীর মতো হা করে শ্বাস নিতে নিতে আরো কিছুক্ষন দৌড়াতেই মস্তিক ঘুরতে লাগলো।আকস্মিক অতি কাছে একটি গাড়ির হর্ণ আর হেডলাইটের আলোয় দিকবিদিক হারিয়ে নিজের ভর ছেড়ে দিলো তাথৈ।মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই কংক্রিটের স্মুদ রাস্তায় ঢলে পড়লো সে।চুল পরিমাণ দূরত্বে ব্রেক কষলো গাড়িতে থাকা ব্যক্তি আর নিথর হয়ে পড়ে রইলো তাথৈ।
#চলবে