#বছর_দুয়েক_পর
#অন্তিম_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
_________
আধ ভাঙা পরিত্যক্ত একটা রাসায়নিক কারখানা। কারখানাটির স্যাঁতস্যাঁতে ধুলো জড়ানো মেঝে আর খসে পরা দালানের জীর্ণ অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সচরাচর কোনো মানুষের যাতায়াত নেই।কারখানা টি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ থাকার কারনে চারপাশে কেমিক্যাল যুক্ত ভ্যাপসা দুর্গন্ধ আর গুমোট উত্তপ্ত।যেকোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এখানে দুদণ্ড অবস্থান করা মুশকিল।
ক্ষয়ে যাওয়া ছাদের উল্টো পিঠের মরিচা ধরা একটি চিকন রডের সাথে ঝুলিয়ে বাধা হয়েছে সাইফ আজমিকে।পিটানো শরীরের অধিকারী হওয়ায় বাড়তি ওজনে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে অল্প অল্প দুলে চলেছে দড়ি সমেত সাইফ আজমী।জীবন মরনের চান্স ফিফটি ফিফটি।খয়ে যাওয়া ভঙ্গুর রডখানা ভেঙে গেলেই দুনিয়াবী লীলা খেলা সাঙ্গ হবে নিচের গভীর নোংরা নর্দমা তুল্য হাউজটিতে পতিত হলে।আপাতত জ্ঞান হীন সাইফ আজমীর এহেন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই।দেয়ালে থাকা এডজাস্ট ফ্যান গুলো ঘটর ঘটর আওয়াজে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।তবুও সাইফ আজমীর সেসবে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।আজ যেনো সে ধরণীর শ্রেষ্ঠ বধির।
সাইফ আজমীর জ্ঞানহীন মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভিয়ান ,ইকবাল আর এরিক।মানুষগুলো যেনো নিজেদের ধৈয্যের চরম পরীক্ষা দিতে বসেছে আজ এই মুহূর্তে।ভন্ড সাইফ আজমীর জ্ঞান ফিরানোর সকল চেষ্টা করে সকলে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে চেয়ার টেনে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।কিন্তু সাইফ আজমী যেনো আজ পণ করেছ দুনিয়া ভেস্তে গেলেও সে চোখ খুলবে না।
নিজের তর্জনী আঙ্গুলি ঘর্মাক্ত ঠোঁটে ট্যাপ ট্যাপ করতে করতে ভিয়ান গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো
“বউ রেখে এতো সময় ধরে এখানে যেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি তার দায় কে নেবে?বুড়োটা বোধ হয় আমার হাতে প্রাণ দেবার জন্যই এতো ভং ধরেছে।
এরিক কিছুক্ষন উশখুশ করে বলে উঠলো
“আমার মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই এমন নাটক জুড়েছে।জীবনে এতো এত নাটক করেও লোকটা ক্ষান্ত হলো না।কবরে এক পা চলে গিয়েছে তবুও তার নাটক শেষ হচ্ছে না।
এতোক্ষন ইকবাল নিশ্চুপ থাকলেও এবার নড়েচড়ে উঠলো সে।এরপর গলা খাকরি দিয়ে বলে উঠলো
“উনার প্রেশার ঠিক নেই।মাহির এসে একবার দেখে গিয়েছে।বেশি স্ট্রেস এর কারনে শরীর প্রচন্ড দুর্বল।তাছাড়া ইদানিং উনি মনে হয় ইনসমনিয়া তে ভুগছিলেন।নির্ঘুম রাত কাটানোর কারনে এতো এতো ধকল সে নিতে পারছে না।
ইকবাল কে কথা শেষ করতে না দিয়েই ভিয়ান বলে উঠলো
“শয়*-তান টা এখনই এমন নেতিয়ে পরলে আমি একে চূড়ান্ত ক*-ষ্ট*-টা দেবো কি করে?উনার জন্য আমার অনেক প্ল্যান অবশিষ্ট আছে।এভাবে কিছুতেই আমার সকল প্ল্যানিং ভেস্তে যেতে পারে না।এ আমি কিছুতেই মানতে পারবো না।
কথা গুলো বলতে বলতে সাইফ আজমীর পানে হেটে গেলো ভিয়ান।এরপর নিচ থেকে গর্জে ডেকে উঠলো
“এই শু*-য়োরের বাচ্চা সাইফ আজমী জেগে উঠ।তুই কি ভেবেছিস?এসব অভিনয় করে খুব সহজেই পার পেয়ে যাবি আমার থেকে?তাহলে হিসব নিকেশ হবে কি উপায়ে?এখনো সময় আছে ভালোয় ভালোয় জেগে উঠ।না হলে গায়ের ছাল কিন্তু অবশিষ্ট রাখবো না বলে দিলাম।
বদ্ধ কামরায় ভিয়ানের গর্জন দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধনিত হলো।সেই সাথে চিপা চাপায় পরিত্যক্ত ড্রামে লুকিয়ে থাকা ইঁদুরের দল চুক চুক শব্দ তুলে পালাতে লাগলো।কিন্তু তবুও সাইফ আজমীর কোনো নড়চড় নেই।এবার নিজের ধৈর্য খোয়ালো ভিয়ান।এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এখানে এসেছে সে।গায়ে গত দুপুরের পরিধান করা পোশাক।ঘুম হীন মস্তিষ্ক থেকে থেকেই ভোঁতা যন্ত্রণায় ভোঁ ভোঁ করছে।শুধুমাত্র সাইফ আজমিকে এক নজর চোখের দেখা দেখার জন্য আসেনি সে এখানে।এই খুনি বিশ্বাসঘাতক,লম্পট হৃদয়হীন অমানুষটি যেনো আর কারো জীবনে বিষাক্ত শ্বাস না ছড়াতে পারে তার চূড়ান্ত ব্যাবস্থা করতেই এতো কাঠ খড় পুড়িয়ে এখানে আগমন করেছে সে।কিন্তু এখানে এসে এতো নাটক কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার।নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধমকে ইকবাল কে নির্দেশ করলো
“একে নিচে নামা।এবার জ্ঞান না ফিরলে ডিরেক্ট পুঁতে দিয়ে চলে যাবো।
ইকবাল সম্মতি জানিয়ে বাহিরে অবস্থান রত নিজের সহযোগী ফরহাদ কে ডেকে উঠলো।ছেলেটি বেশ ধুরন্ধর আর সাহসী।তরতর করে যেখানে খুশি সেখানে বেয়ে বেয়ে উঠে যেতে পারে চোখের পলকে।তার সহায়তাতেই সাইফ আজমিকে এখানে তোলা হয়েছিলো।সাইফ আজমিকে অধিক ভীত করতেই এমন ভাবে ঝোলানো হয়েছিলো।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পরিশ্রম বৃথা গেলো।ইকবালের নির্দেশ পেয়ে নীচে ঝুলানো দড়ি ঢিল দিয়ে দিয়ে সন্তপর্নে নামিয়ে আনা হলো সাইফ আজমিকে।মাটিতে তাকে শোয়াতেই চিলের ন্যায় ছো মেরে সাইফ আজমিকে চেপে ধরলো ভিয়ান।এরপর নিজের দুই হাতের থাবায় চেপে ধরলো সাইফ আজমীর নাক আর মুখ।কিছু সময় অতিবাহিত হতেই দাফরাতে লাগলো সাইফ আজমী এবং এক পর্যায়ে বড় বড় চোখ মেলে তাকালো।সাইফ আজমী চোখ খুলতেই নিজের হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো ভিয়ান সেই সাথে মুখে ফুটলো ডেভিল স্মাইল।
মাঝবয়সী সাইফ আজমী যেনো এক নজর মৃত্যুর ফেরেশতা কে দেখে এলেন।বুকে তার ক্রমাগত হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে।হৃদযন্ত্র এমন ভাবে লাফাচ্ছে যেনো বুকে ঘোড়া দৌড় হচ্ছে।শ্বাস গতি দ্রুত হওয়ায় জোরে জোরে কেশে উঠলেন তিনি।এরপর ঘোলাটে চোখে চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে ভীত চোখে সকলের পানে তাকালেন।ভিয়ান কে দেখে যতোটা না অবাক হলেন তার চাইতে অধিক ভয় পেলেন এরিক কে দেখে।যাকে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে চলে এলেন সে কি করে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
আরো কিছুক্ষন কেশে নিজেকে স্বাভাবিক করে মেঝেতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন সাইফ আজমী।এরপর এরিকের পানে বিস্ফারিত নজরে তাকিয়ে শুধালেন
“তুমি এখানে কি করে?তোমার তো…
সাইফ আজমীর প্রশ্নে তাচ্ছিল্য হাসলো এরিক।এরপর ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন বাণ ছুঁড়লো
“খুব অবাক লাগছে বুঝি পাপা?নিশ্চই এই মুহূর্তে এভাবে আমাকে আশা করো তাই না?
সাইফ আজমী কোনো কথা বললেন না।এই মুহূর্তে মস্তিষ্ক ফাঁকা তার।শরীর বড্ড ক্লান্ত।এডজাস্ট ফ্যানের বিশ্ৰী শব্দ কানের পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে।বুকেও চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে।কোথা থেকে কি শুরু করবেন সব কিছুর খেই হারালেন।তবুও ধূর্ত মানুষ বলে কথা।এই চুনোপুঁটি দুদিনের ছেলেদের হাতে নিজের এতো অপদস্থ মেনে নেয়া যায় না।কিছু সময় নীরব অতিবাহিত করে মাথা তুলে এরিকের পানে চাইলেন সাইফ আজমী।এরপর শক্ত গলায় শুধালেন
“এদের সাথে এখানে তোমার কি কাজ এরিক?জানোনা এই ইকবাল তোমার হবু স্ত্রী কে গুলি করে হত্যা করেছে?কোন লোভে এদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের বাবা কে এমন হেনস্থা করছো?
সাইফ আজমীর কথায় নিজের রাগ সংবরন করতে পারলো না এরিক।কাছে পরে থাকা একটা ছোট কন্টেইনার পা দিয়ে সজোড়ে লাথি মেরে সাইফ আজমীর দিকে ছুড়ে দিলো।মুহূর্তেই সেই কন্টেইনার সাইফ আজমীর মুখ বরাবর আঘাত করলো।সেই আঘাতে ঠোঁট কেটে অল্প রঞ্জনধারা ছুটলো।হাতের আঙ্গুলির সহিত সেই রক্ত মুছে সাইফ আজমী পুনরায় বললেন
“বাড়ি ফিরে চলো এরিক।আমি সব কিছু তোমাকে বুঝিয়ে বলছি।তার আগে এই নরক খানা থেকে আমাকে মুক্ত করো।
সাইফ আজমীর পানে এগিয়ে এসে সামান্য ঝুকে দাঁতে দাঁত পিষে এরিক বলে উঠলো
“আপনি আমার বাবা নন মিস্টার আজমী।আর আপনাকে এখান থেকে মুক্ত করতে আসিনি আমি।আপনি যেই অন্যায় করেছেন তার সলিল সমাধি করতে এসেছি আমি।আপনার জন্য আমার মা প্রচন্ড সাফার করেছে এতোগুলো বছর।আর নয়।এবার আমরা সবাই প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই।আমাদের লাইফে আপনি বিষাক্ত ভাইরাসের ন্যয়।তাই আপনাকে নির্মূল করতেই এতো আয়োজন।
এরিকের এসব ভালোমানুষি কথায় কিটকিটিয়ে হেসে উঠলেন সাইফ আজমী।বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে এরিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন
“ভিয়ান নাওয়াফ শকুনের চাইতেও চতুর এরিক।সে তোমাকে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যবহার করছে মাত্র।গিরগিটি ও।রঙ পাল্টাতে এক মুহূর্ত ও ভাববে না।পড়ে কিন্তু আফসোস রাখার জায়গা পাবে না।ভুলে যেও না তাকে হত্যা করার জন্য তুমিও কিন্তু আমার সাধ দিয়েছিলে।শুধু কি তাই?তাথৈকে কিভাবে কিডন্যাপ করে রেইনের কাছে পাঠিয়েছো তা নিশ্চয় ভুলে যাও নি।
সাইফ আজমিকে অবাক করে দিয়ে ভিয়ান বলে উঠলো
“এরিক কে ক্ষমা করে দিয়েছি আমি।কারন মূল নাটের গুরু তুই।এরিক ছোট মানুষ।ওর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ অভিমান নেই।সে পরিস্থিতির শিকার মাত্র।কিন্তু তোকে আমি ছাড়বো না আজমী।তোর কিমা দিয়ে বার্গার খাবো আমি।তুই জাস্ট অপেক্ষা কর।তোকে তিলে তিলে জাহান্নামের আযাব ভোগ করাবো আমি।প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রনায় দগ্ধ হয়ে মৃত্যু ভিক্ষা চাইবি আমার কাছে।কিন্তু তার বদলে আমি তোকে আরো কঠিন থেকে কঠিন তম সাজা দেবো।তুই আমার অনেক দিনের পুরোনো শিকার।আমার থেকে কোনো ভাবেই তোর মুক্তি মিলবে না।আর একটা খুশির খবর শুনবি?তোর ভাতিজি তাথৈ আমার বউ এখন।দুদিন পর তুই নানা হবি।রেইন কোনো পৃথিবীতে এমন কোনো বাস্টার্ড এর পয়দাই হয়নি যে আমার জিনিস হজম করে খাবে।
কথা গুলো শেষ করেই ভিয়ান ইকবালের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“আমার দাদা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে শিফট করার ব্যবস্থা কর একে।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবে সে।অসহনিয় কষ্টে বাঁচার জন্য চিৎকার করবে রাত দিন।কিন্তু আফসোস কঠিন দেয়াল ভেদ করে সেই আওয়াজ বাইরে আসবে না।কেউ কিচ্ছুটি জানবে না।আমি কতবড় জানোয়ার এটা সাইফ আজমিকে প্রমান স্বরূপ দেখানোর সময় এসেছে।ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে আমার আরো বহু আগে।কান দুটো অনেক দিন কারো আহাজারি শুনে না।এবার বোধ হয় মন তুষ্ট হবে।।।
ভিয়ানের এহেন হৃদয় হীনের ন্যয় কথায় ধরফড়িয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো সাইফ আজমী।এরপর এলোমেলো পায়ে হেটে এসে ভিয়ানের হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন
“এমন টা করো না আমার সাথে।আমাকে যেতে দাও।আমার অনেক কাজ বাকী।বিনিময়ে যা চাইবে তাই পাবে।ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স টাকা কড়ি, প্রোপার্টি সব।সব কিছু দিয়ে দেবো আমি তোমায়।
প্লিজ আমাকে যেতে দাও।
এক ঝটকায় সাইফ আজমীর হাত সরিয়ে ভিয়ান গর্জে উঠল
“নিজের কিছু থাকলে তবেই না দিবি আমাকে।আমার শ্বশুরের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আমাকেই দিবি তুই?মৃত্যুর দুয়ারে গিয়েও তোর ছল চাতুরী শেষ হচ্ছে না?
সাইফ আজমী চারপাশে নজর বুলিয়ে কি যেনো খুজলো।এরপর হঠাৎই দৌড়ে ভাঙা একটা স্টিলের পাইপ নিয়ে তেড়ে এলো ভিয়ানের দিকে।এমন ঘটনায় ভড়কে না গিয়ে বাঁকা হেসে ভিয়ান এরিক আর ইকবাল কে উদ্দেশ্য করে বললো
“দেখেছিস কতো বড় হারামজাদা?একে কি করতে ইচ্ছে করে বলতো?
সাইফ আজমী ভিয়ানকে আক্রমন করার আগেই নিজের হাত বাড়িয়ে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো ভিয়ান।মাঝ বয়সী আজমী সেই ঘুষির তোরে আর্তনাদ করে হাটু মুড়ে মেঝেতে বসে গেলো।
“একে এক্ষুনি আমার সামনে থেকে সরা।না হলে কে*-টে কুচি কুচি করতে দুমিনিট ভাববো না।
আর দাঁড়ালো না ভিয়ান।এবার তাকে গ্রামে যেতে হবে।আগামী কাল সাজিদ মেহমুদ আর মেহেরিনের জীবনে নতুন দিনের সূচনা হতে চলেছে।
************
#চলবে….
#বছর_দুয়েক_পর
#অন্তিম_বর্ধিতাংশ
#সারিকা_হোসাইন
ঝলমলে আলো মাখা সোনালী এক বসন্তময় সকাল।শীতের রিক্ততা থেকে মুক্তি নিয়ে বসন্তের আগমনে প্রকৃতি নতুন সাজে সেজেছে যেনো।বাহারি প্রস্ফুটিত হাজারো ফুলের মিষ্টি সুগন্ধি যুক্ত শীতল বাতাস এলোমেলো বয়ে চলেছে সর্বত্র।সেই বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে সবুজাভ কিশলয় আর অপরিপক্ক কুড়ি সমেত ফুটন্ত ফুলের দল।বসন্তের এহেন সৌন্দর্য বেষ্টিত সকালকে আরেকটু রোমাঞ্চকর করতে অনবরত ডেকে চলেছে অস্ট্রেলিয়ান ম্যাগপাই আর স্পাইনবিলস ।এসব পাখির মন মাতানো কিচিরমিচির সুর অনন্য মূর্ছনার সৃষ্টি করেছে পুরো অস্ট্রেলিয়া জুড়ে।
রেইন প্যালেস এর বিশাল খোলা থাই জানালার ভারী পর্দা গুলোকে বসন্তের দমকা হাওয়া এসে কিঞ্চিৎ দুলিয়ে দিলো সেই সাথে কক্ষে হুটোপুটি খেলো মৃদু আলো।ফুলেল সুবাসিত সমীরণে ঘুমের ঘোর কেটে এলো রেইনের।গায়ের পাতলা ব্ল্যাঙকেট খানা আঁটসাঁট করে গায়ে জড়িয়ে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো সুপুরুষ।চোখ বন্ধ রেখেই সকালের মুগ্ধতা অনুভব করতে চাইলো সে।কিন্তু দৃষ্টি যেনো মরিয়া হয়ে উঠলো এমন অপার সৌন্দর্য স্বচক্ষে উপভোগে।নিজের আরাম জনিত নিদ্রাকে বিদায় জানিয়ে চোখ মেললো রেইন।মুহূর্তেই ঝলমলে আলোর পরিবর্তে একরাশ অন্ধকার আর আবছা দৃষ্টি এসে ভীড় করলো অক্ষিপটে।প্রথমে ভারী ঘুমের রেশ ভেবে চোখ কচলে নিলো রেইন।এরপর ঝটপট উঠে বসে পুনরায় চোখ মেললো।কিন্তু এবার চারপাশ ঝাপসা আলোয় আলোকিত হলো সেই সাথে মস্তিষ্কে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভূতি হলো।মাথা চেপে ধরে ঠোঁট কামড়ে চোখ খিচে বন্ধ করে বিছানার হেডবোর্ড এ ধপাস করে হেলান দিলো রেইন।মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে কেউ সুচালো আঘাত করে চলেছে ক্রমাগত।
হাসপাতাল থেকে এসে থেকেই নিজের মধ্যে অনেক অস্বাভাবিক বিষয় খেয়াল করেছে রেইন।আজকাল হুটহাট নিজের শারীরিক অবনতি দেখছে সে।সামান্য দৌড়ালেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে,দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে।কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া বিষয় কিছু সময় গড়াতেই ভুলে যাচ্ছে,খাবার দাবার এও ভীষন অরুচি সেই সাথে অবর্ণীয় মস্তিষ্ক যন্ত্রনা।আবার থেকে থেকে মনে হচ্ছে তার শরীর অবশ হয়ে মাটিতে থুবড়ে পরতে চাচ্ছে।শুধু তাই নয় কথা বলার ক্ষেত্রেও জিভ জড়িয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব কিছু।
নিজের এমন অবস্থা মোটেও স্বাভাবিক ঠেকলো না রেইনের কাছে।হাতড়ে হাতড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে কোনো মতে হালকা একটা শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আর্থার এর সহযোগীতায় হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো রেইন।ভালো একজন নিউরোলজিস্ট এর থেকে এসব উপসর্গের হেতু জানতে হবে তাকে।বুদ্ধিমান আর্থার ধারণা করলো মাথায় সজোড়ে আঘাত পাবার কারনেই হয়তো রেইন এর এমন হচ্ছে।কিন্তু হসপিটাল থেকে তো সেই মুহূর্তে তেমন ভয়ানক কিছু বলা হয়নি।তবে এখন কেনো এসব উপসর্গ?
**********
ডক্টর এর চেম্বারে টেবিলে কুনুই ঠেকিয়ে অসহায়ের ন্যয় বসে আছে রেইন।সামনেই বসা মাঝবয়সী অভিজ্ঞ ডক্টর মার্কো।গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে রেইনের সমস্ত কথা তিনি শুনলেন।এরপর আর্থার এর থেকে পূর্বের রিপোর্টস গুলো নিয়ে সেগুলো পরখ করলেন।ভদ্রলোকের মুহূর্তে মুহূর্তে চেহারার পরিবর্তনে আর্থার বুঝলো জটিল কিছু হতে চলেছে।
“এনিথিং রং?
কিছুটা চিন্তিত স্বরে প্রশ্নটি করে উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলো আর্থার।রেইন অন্ধের ন্যয় আগের মতোই বসে রয়েছে।নিজের শারীরিক কন্ডিশন খুবই বাজে।আর্থার বা ডক্টর কাউকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে না সে।শুধু তাই নয় কারো মুখায়ব ভঙ্গি পর্যন্ত তার দৃষ্টি সীমানায় ধরা দিচ্ছে না।এই মুহূর্তে নিজেকে জড় বস্তু ব্যতীত আর কিচ্ছুটি মনে হচ্ছে না।অর্থারকে নিজের এমন দুর্বলতা দেখাতে ইচ্ছে করছে না তার।কিন্তু পরিস্থিতি যেনো এই দাম্ভিক মানুষটির প্রতিকূলে।
ডক্টর মার্কো কিছুক্ষন চিন্তিত থেকে বলে উঠলেন
“কিছু টেস্ট দিচ্ছি ইমিডিয়েটলি করার চেষ্টা করুন এবং আমাকে রিপোর্টস গুলো দেখান।যা ভাবছি তা সত্যি হলে এখানেই সব কিছুর সমাপ্তি।
ডক্টর এর মুখের এমন কঠিন নিদারুণ ইংরেজি বাক্য রেইনের শক্ত ভিত নাড়িয়ে দিলো।কিছু সময়ের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে ফাঁকা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো।এরপর কাঁপা গলায় শুধালো
“হুয়াট ইজ দ্যা নেইম অফ দ্যা ডিজিজ ডক্টর?
ডক্টর মার্কো কিছুক্ষন ইতিউতি করে ভারী গলায় বলে উঠলেন
“আই থিংক ইট ইজ ডিফিউস আ্যক্সোনাল!
রোগটি সম্পর্কে রেইন কিছুই অবগত নয়।এই রোগের কারণে কি হতে পারে সেটাও তার অজানা।তাই সবিস্তারে জানতে রেইন নিচু ধীর গলায় শুধালো
“আমার লাইফে কি কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য?
রেইনের প্রশ্নে ডক্টর মার্কো একটু নড়েচড়ে বসলেন।এরপর বলতে শুরু করলেন
“কোনো কারণে মস্তিষ্কে ভারী আঘাত পাবার কারনে ধীরে ধীরে এই রোগটি দেখা দেয়।যখন মস্তিষ্কের কোষ গুলো ফুলে উঠে তখন মারাত্মক যন্ত্রনা হয়।প্রথম স্টেজে এটা সুপ্ত অবস্থায় থাকে কিন্তু পরবর্তীতে প্রকট রূপ ধারণ করে।এই ডিফিউস সিস্টেম আপনাকে ধীরে ধীরে অক্ষম করবে ,প্রতিনিয়ত স্মৃতিভ্রম হবে সেই সাথে হতে পারে কষ্টদায়ক মৃত্যু।
ডক্টরের কথায় আর্থার যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো কিন্তু রেইন নির্বিকার রইলো।শুধু অল্প করে জিজ্ঞেস করলো
“এর চিকিৎসা কি?
ডক্টর তার নিম্নভাগের গোলাপি ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে চ” সূচক শব্দ করলেন এরপর বললেন
“সরি টু স্যা ,এটার চিকিৎসায় সেরকম সুফল পাওয়া যায়নি।ডক্টরস ফলোআপে থাকলে আপনি কতোদিন ভালো থাকবেন সেটা লাক ফেভার করবে।আপনি প্লিজ টেস্ট গুলো করুন।আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত ও হতে পারে।
আর কথা বাড়ালো না রেইন।আর্থার কে নিয়ে বিষন্ন মনে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এলো।কেনো জানি আজ বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে তার।একাকী নির্জন কক্ষে গিয়ে চিৎকার করে বুকের জমে থাকা হাহাকার গুলো উগলে দিলে বুকটা হালকা হবে হয়তো।কিন্তু কিসের এই হাহাকার?
************
মেহেরিন আর সাজিদ মাহমুদ এর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধের আয়োজন সমাপ্তি ঘটেছে কিছুক্ষন আগে।মেহেরিন লজ্জায় মিইয়ে গেলেও তার চোখে মুখে খেলে যাচ্ছে প্রাপ্তির ঝিলিক।সাজিদ মাহমুদ এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা।দেরিতে হলেও ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে মাঝ বয়সী এই ব্যক্তি যেনো চব্বিশ বছরের যুবক হলেন।বৃদ্ধ মকবুল শেখ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে পূর্ণতার শ্বাস টানলেন।
“মা’রে এইবার বুঝি শান্তিতে মরতে পারবো।অনেক সুখী হ।দেরিতে হলেও নর পিচশের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিস এই অনেক।
মেহেরিন অস্ফুট কান্না জড়িত কন্ঠে আওড়ালো
“তোমার স্নেহের হাতটা আমার মাথায় রেখে শুধু দোয়া করো আব্বা।
মকবুল শেখ নিজের কুঁচকে যাওয়া বৃদ্ধ হাত খানা পরম মমতায় মেহেরিনের হাতে রেখে বলে উঠলেন
“আব্বার দোয়া সব সময় তোর জন্য।
ঘরোয়া ভাবে আয়োজন ছিলো মেহেরিন আর সাজিদের জন্য।উপস্থিত ছিল ভিয়ান তাথৈ, তিহান এর পরিবার,তুলতুল এর পরিবার।সকলের মুখেই প্রাপ্তির হাসি।এই হাসিটা আরো বছর সাতাশ আগে তাদের হাসার কথা ছিলো।বিধাতা চায়নি তাই জন্য হয়তো এতো এতো ঝড় ঝাপটা পাড়ি দিতে হয়েছে।নিজের চোখের জল মুছে মেহেরিনের কাছে এগিয়ে এলো তাথৈ।এরপর ভেজা কন্ঠে বললো
“শুভ কামনা তোমার জন্য আম্মু।
তাথৈ এর পানে তাকিয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হলেন মেহেরিন ।কিছুটা সংকোচ রেখেই অল্প হাসলেন।
“আমি কি এখনো তোমায় আম্মু বলে ডাকতে পারবো?নাকি আমার অধিকার এখানেই শেষ আম্মু?
তাথৈ এর কঠিন প্রশ্নে মেহেরিনের বুক কেঁপে উঠলো।চিনচিনে ব্যথায় হৃদয় মুষড়ে উঠলো।দ্রুত হাতে মেয়েকে বুকে টেনে কেঁদে উঠলেন মেহেরিন।
“জন্ম দেইনি বলে মা হতে পারবো না?এ কেমন কঠিন প্রশ্ন মা?তুই আমার মেয়ে।আমিই তোর আম্মু।এই অধিকার কেউ কখনো কেড়ে নিতে পারবে না।
তাথৈ আর মেহেরিনের এর কথার মাঝে হঠাৎ ভেসে উঠলো
“আমাকেও একবার বুকে টেনে নেবে মম?
কণ্ঠটি কার বুঝতে সময় নিলোনা কেউ।তাথৈকে ছেড়ে ছলছল চোখে সামনে তাকালেন মেহেরিন।ঐতো বিধ্বস্ত অবস্থায় এরিক দাঁড়িয়ে রয়েছে।হঠাৎই মাতৃ সত্তা কেঁপে উঠলো।এই এরিকের সাথে আগের এরিকের কোনো মিল নেই।নেশায় আসক্ত এলোমেলো এরিক আর এই এরিকের আকাশ পাতাল তফাৎ।নিজের পেটের না হোক জন্মের দিন থেকে মাতৃ স্নেহে বড় করেছে এই ছেলে মেয়ে দুটোকে সে।এরিকের আধো আধো বুলিতে ডাকা মা শব্দটি এখনো মেহেরিনের হৃদয় কে উৎফুল্ল করে।বাবার অপকর্মে ছেলে নোংরা পথে হেঁটেছে।তাই বলে এরিকের প্রতি যেই দরদ মেহেরিনের তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়।নিজের সামনে এরিক কে দেখে উত্তর দেবার পরিবর্তে কাঠের পুতুলের ন্যয় অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলেন মেহেরিন।এরিক ধীর পায়ে মেহেরিনের সামনে দাঁড়িয়ে অপরাধীর স্বরে পুনরায় শুধালো
“আমার ভুল গুলো ক্ষমা করে আমাকে আবার বুকে টেনে নিবে মম?শেষ বারের মতো?
মেহেরিনের কি হলো কে জানে?সকল ব্যথা অভিমান ভুলে হাত মেলে বুকে ডাকলেন এরিক কে।অপরাধী এরিক ঝড়ের গতিতে মেহেরিন কে জাপ্টে ধরে কেঁদে বুক ভাসালো।এরপর বললো
“দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি মম।চৌধুরী বাড়ির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই আর আমি বাস্টার্ড নই।আমার বাবা ছিলেন।উনি আপাতত মৃত।সাইফ আজমী আমার বাবা নন।
এরিকের কথায় ভিয়ান ব্যতীত সকলেই যেনো অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো।সাজিদ মাহমুদ এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার এগিয়ে এসে বললো
“থেকে যাও আমাদের সাথে।
নিজের চোখের জল মুছে এরিক বলে উঠলো
‘তা আর হয়না আংকেল।আমার জন্মদাত্রী মা এখনো বেঁচে আছেন।বাবার শেষ স্মৃতি টুকু নিয়ে আমরা আমাদের সুখের সন্ধানে পা বাড়াবো।আর মম কে যেই কষ্ট আমি দিয়েছি তা মুছিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই।তার শুধু শুধু এখানে থেকে ব্যথার ভার বাড়াতে চাই না।
মেহেরিন এরিক এর শুকনো মুখশ্রী নিজের হাতের আজলায় ভরে ভেজা কন্ঠে বললেন
“মা কোনো কষ্ট পাইনি।পূর্বের সব ভুলে গেছি।
এরিক মেহেরিন এর কপালে চুমু খেয়ে বলে উঠলো
“কথাটা শুনে অপরাধের বোঝা কিছুটা কমলো মম।বুকে খুব শান্তি পাচ্ছি।এবার আমি দ্বিধাহীন দেশ ছাড়তে পারবো।
কথাটি বলে মেহেরিনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এরিক আবার বললো
“নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা মম।কারো নজর না লাগুক।
মেহেরিনের থেকে সরে এসে ভিয়ানের সামনে নিচু চোখে দাঁড়ালো এরিক এরপর বললো
“আপনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার ভাষা আমার কাছে নেই ভিয়ান নাওয়াফ।আমার অপরাধ গুলো ক্ষমা করেছেন এই বেশি আমার কাছে।আসছি।
এরিক চলে যেতে নিলেই পিছন থেকে তাথৈ ডেকে উঠলো
“ভাইয়া!
মুহূর্তেই থেমে গেলো এরিকের ভারী পা জোড়া।তাথৈ এর সাথে যেই অন্যায় সে করেছে তার কোনো ক্ষমা হয়না।তাই সে নিজেও তাথৈ এর কাছে ক্ষমা চায়নি।কোন মুখে তাথৈ এর সামনে দাঁড়াবে সে?কিন্তু এই মুহূর্তে কি বলতে চায় তাথৈ?
এরিক পিছন ফিরে মাথা নিচু করে বলে উঠলো
‘ক্ষমা করে দিস তাথৈ।তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।যদিও সেসব ক্ষমার অযোগ্য।তবুও এটাই বলবো মানুষ মাত্রই ভুল।
এরিকের এসব কথায় মনোক্ষুণ্ণ হয়ে তাথৈ বললো
“সাইফ আজমী তোমাকে ফুসলে এমন করে ছিলো তা জানতাম আমি।আর পূর্বের কথা গুলো কেনো টানছ এখানে?ওসব কি আর মনে রেখেছি বলো?
একে একে সকলেই এগিয়ে এসে এরিক কে কাছে টেনে নিলো।বাদ গেলো না মকবুল শেখ ও।এরিক কে বড় নাতী মেনে অনেক ভালোবাসা জমা করেছিলেন তিনি।কিন্তু সেগুলো কখনো এরিককে দেয়া হয়নি।তাই আজ সকল ভালোবাসা উগলে দিয়ে জাপ্টে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।এরপর বললেন
“যেখানেই যাও ভালো থেকো।
*********
পেরিয়ে গিয়েছে একটি বছর।এই এক বছরে সকলের জীবন সকলেই খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিয়েছে।ভিয়ান তাথৈ আর এমিলি খুব ভালো আছেন।এমিলি পূর্বের তুলনায় অনেকটা সুস্থ।নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারেন এখন।স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট।তাথৈকে সারাক্ষন নিজের মায়ের মতো আগলে রাখেন।ইদানিং নাতি নাতনির খুব শখ হয়েছে তার।এমিলির ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ভিয়ান সুযোগ খুঁজে কিন্তু তাথৈ যেনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।ইকবাল আর মৌটুসী ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে।পারিবারিক বিশাল বিজনেস নিয়েই ব্যাস্ত ইকবাল আর মৌটুসী বাচ্চা বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ি আর সংসার নিয়েই ব্যাস্ত।রাঁধুনি টুটুল নিজেও বিয়ে করে সুখের সংসার পেতেছে।তিহান আর তূর্ণা পুনরায় নতুন বাবা মা হয়েছে।সাজিদ মেহেরিন খুবই ভালো আছেন সুখে আছেন।ছোট একটা সংসার তাদের।বৃদ্ধ মকবুল মেহেরিনের কাছেই থাকেন।সাজিদ বা মেহেরিন কেউ তাকে গ্রামে ফিরতে দেয়না।মেহেরিনের এক কথা আব্বা আমার সন্তানের ন্যয়।আব্বাকে লালন পালনের দায়িত্ব আমার।
এরিক আর সেলিনাও নরওয়ে তে স্যাটেল হয়ে গিয়েছে।মাঝে মাঝে এরিক সকলের খুজ নেয়।খুব ভালো আছে তারা।
********
ভিয়ান এর দাদা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে মোটা দড়ির সাথে ঝুলছে এক শুকনো কঙ্কাল।কবে মরে পচে এমন কঙ্কাল হয়ে আছে কেউ তার খবর রাখেনি।অন্ন হীন,চূড়ান্ত পিপাসা আর হতাশা নিয়ে মৃত্যু হয়েছে মানুষটির।এটাই হয়তো তার প্রাপ্য ছিলো।নিজের কর্মফল এর শাস্তি দুনিয়াতে অল্প সময়ে ভোগ করেছে সে।শরীর বেশিদিন সায় দেয়নি।কিন্তু বিধাতার কাছে অনন্ত কালের শাস্তির আর্জি জানিয়েছে ভোক্ত ভুগী মানুষ গুলো।
**********
মেরুন রঙা দুটো ইনভেলপ।দুই ইনভেলপ এ দুটো চিঠি রয়েছে।চিঠি দুটো দুই প্রাপকের কাছে পাঠাতে পারলেই আর্থার এর দায়িত্বের অবসান হবে।অনেক খুঁজে প্রাপক দুজনের ঠিকানা জোগাড় করেছে সে।এবার নিজ হাতে তাদের হাতে চিঠি গুলো তুলে দেবার পালা।
নিজের ভার্সিটি থেকে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলো তুলতুল।বাসার গার্ডেন এরিয়ার লেটার বক্সে অদ্ভুত ইনভেলপ তার নজর কাড়লো।প্রেরক কে তা জানার জন্য ভ্রু কুঁচকে ইনভেলপ হাতে নিয়ে দ্রুত ইনভেলপ খুলে বের করে আনলো কালো রঙের একটা পেইজ।সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা
____ডিয়ার তুলতুল
“আমাদের আর কখনো দেখা হয়নি।আমরা কয়েক ঘন্টার জন্য বন্ধু হয়েছিলাম।আমার ওই একাকিত্ত্ব মুহূর্তের সঙ্গী হিসেবে তোমাকে পেয়ে বড়ই আনন্দিত হয়েছিলাম আমি।দিনটি আমার কাছে বড্ড স্পেশাল।কিন্তু দুর্ভাগ্য তারিখটি যদি মনে করতে পারতাম!তবে ফ্রেন্ডস ডে হিসেবে ওই দিনটাকেই ঘোষণা দিতাম।কিসব আবোল তাবোল বকছি তাইনা?তুমি চলে যাবার পর আমার কঠিন মনটা একটু খারাপ হয়েছিলো কি?হয়তো বা!এরপর মস্তিষ্কের বেখেয়ালে বেমালুম ভুলে ছিলাম তোমায়।দীর্ঘদিন পর ফাঁকা মস্তিষ্ক হঠাৎই তোমার স্মৃতি আমাকে মনে করিয়ে দিলো।তোমার জন্য কিছু তোফা রেখেছি।ধরতে পারো বন্ধু হিসেবেই এই সামান্য আয়োজন।প্লিজ নিচের দেয়া ঠিকানায় একটা সাদা গোলাপ নিয়ে এসো।অপেক্ষায় থাকবো আমি।
______রেইন
ভিয়ানের সাথে খুনসুটি তে মেতেছে তাথৈ।ইচ্ছে করেই তাথৈকে জ্বালিয়ে মারছে লাজ হীন পুরুষটি।দিনে দিনে যেনো তাথৈ এর প্রতি তার ভালোবাসা বেড়েই চলছে কমার পরিবর্তে।ছোট বাচ্চার ন্যয় এমিলি আর তাথৈকে আগলে নিয়ে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে সুখের সাম্রাজ্য গড়েছে ভিয়ান।
“আমার কি বাপ ডাক শোনার হক নেই নাকি?এমন পালিয়ে বেড়ালে পার্সেল টা কি টুপ করে আকাশ থেকে পরবে?
লজ্জায় রাঙা হয়ে তাথৈ বলে উঠলো
“আর কয়েকটা দিন যাক।
বড় বড় চোখ করে ভিয়ান জানালো
“বিয়ের দুই বছর পেরিয়ে গেছে।আর ভালো মানুষ হয়ে থাকবো না কিন্তু বলে দিলাম।
ভিয়ান কে কাঁচকলা দেখিয়ে তাথৈ বলে উঠলো
“দেখাও তো দেখি কেমন খারাপ মানুষ তুমি?
“দেখতে হলে কাছে আসতে হবে।
এক পা দু পা করে দুস্টু হেসে এগিয়ে এলো তাথৈ।এরপর ভিয়ানের গলা জড়িয়ে আহ্লাদী স্বরে বললো
“ধমকি দেয়া হচ্ছে আমাকে?
তাথৈ এর চোখে চোখ রেখে নেশাক্ত কন্ঠে ভিয়ান বললো
“আমার ধরে ক’টা মাথা আছে?
হঠাৎই টুং করে কলিং বেল বেজে উঠলো।ভালোবাসা ময় মুহূর্তে এমন জুলুম সহ্য হলো না ভিয়ানের।বাইরের ব্যক্তি কে উপেক্ষা করে আরেকটু তাথৈকে কাছে টেনে ভিয়ান বললো
“দুটো বেবি চাই আমাদের।
তাথৈ সম্মতি জানাবার আগেই দ্বিতীয় দফায় কলিং বেল বাজলো।ভিয়ানকে সরিয়ে নীচে নেমে দ্রুত পদে সদর দরজার কাছে এগিয়ে গেলো তাথৈ।চোখ মুখে অমানিশা ফুটিয়ে ট্রাউজার এর পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে ভিয়ান ও নেমে এলো পিছন পিছন।দরজা খুলতেই ভয়ে শিউরে উঠলো তাথৈ।মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই স্মিত হেসে আর্থার বললো
“ভয় নেই।
কথাটি বলেই মেরুন রঙা চিঠি খানা তাথৈ এর হাতে দিয়ে প্রস্থান নিলো আর্থার।আর্থার এর যাবার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলো তাথৈ।
“কে এসেছিলো?তোমার হাতে কিসের ইনভাইটেশন এটা?
ভিয়ানের ভারী গলার প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠলো তাথৈ।এরপর ইনভেলপ উল্টে পাল্টে দেখে বলে উঠলো
“আর্থার।
আর্থার এর নাম শুনেই চিঠিটা ছো মেরে নিয়ে নিলো ভিয়ান।এরপর দ্রুত খুলে বের করে আনলো কালো পেইজ।
“প্রিয় তাথৈ______
তোমাকে ভালোবেসে জীবনে চরম বোকামিটাই করেছি আমি।এই এক তরফা ভালোবাসা আমাকে নিঃশেষ করে দিলো।কিন্তু বিশ্বাস করো এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই আমার।সবার ভালোবাসাই পূর্ণতা পায়না।আর জোর করে কখনো ভালোবাসা হয় না তাই না?ভিয়ান নাওয়াফ লাকি পার্সন।নিঃসন্দেহে সে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ ।তোমার অল্প কিছু স্মৃতি আজো আমার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে।মাঝে মাঝে খুব করে তোমার উপস্থিতি টের পাই।আবার মাঝে মাঝে সব গুলিয়ে ফেলি।শুনেছি খুব সুখের দাম্পত্য জীবন তোমাদের।খুব ভালো লেগেছে শুনে।আবার হিংসেও হয়েছে।ইস তোমায় যদি আমি পেতাম!বাদ দাও সেসব কথা।অন্যের হালাল জীবন সঙ্গী তুমি।তোমার কাছে এসব অনুভূতি ভাগাভাগি না করাই উত্তম।
টাকা আর ক্ষমতার বড়াই করে এই পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে কিছুই হাসিল করা যায়না তাথৈ।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নিজের অজান্তেই সত্যি ভালোবেসে ছিলাম তোমাকে।ভিয়ান নাওয়াফ খুব ভালো একজন রক্ষক।আমার মতো দানবের ছায়া থেকে কতো অনায়াসেই তোমাকে রক্ষা করে নিয়ে চলে গেলো।অথচ কিচ্ছুটি টের পেলাম না আমি।চিঠিটা লিখতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।হাত কাঁপে।মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দেয় সব গুছিয়ে রাখা অনুভূতি।দৃষ্টি দুটোও আজ ঝাপসা।পা দুটোও যে অসাড়!মনের ক্যানভাসে যেই কথা গুলো ভেসে ভেসে উঠছে সেগুলোই লিখছি।হাতের লেখাটাও সাংঘাতিক বিশ্ৰী হয়ে গিয়েছে।চিঠিটা পড়তে কষ্ট হলে খুব দুঃখিত সেইসাথে তোমার মূল্যবান সময় অপচয়ে।যখন তুমি চিঠিটা পাবে তখন তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে থাকবো আমি।উহু ভয় পেয়ো না।আমার এই কুৎসিত কালো হাতটা আর কখনোই তোমার দিকে বাড়াবো না।কারন বাড়ানোর শক্তিই যে আর অবশিষ্ট নেই।তোমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে শেষ বারের মতো।বড্ড অন্যায় আবদার তাই না?
“রেইন।
এমন অদ্ভুত চিঠির কিছুই মানে বুঝলো না ভিয়ান।রেইন নতুন কি খেলা খেলতে চাইছে তা তার জানা দরকার।চিঠিটা হাতের করপুটে দুমড়ে মুচড়ে ভিয়ান শক্ত কন্ঠে বললো
“চলো রেইনের খাঁ খাঁ করা অন্তর কে শান্ত করা যাক।
**********
এক গুচ্ছ সাদা গোলাপের তোড়া নিয়ে কাঙ্খিত ঠিকানায় অপেখ্যা করছে তুলতুল।এমন রহস্যময় চিঠি পেয়ে সে কেনো ছুটে এসেছে এটা তার অজানা।কিন্তু এই ঠিকানায় এসে এমন কিছু দেখবে স্বপ্নেও ভাবেনি তুলতুল।কবরস্থান?রেইন তাকে হঠাৎ কবরস্থানে কেনো আমন্ত্রণ জানাবে?
তুলতুল এর ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে শুকনো প্রাণহীন হাসলো আর্থার ।এরপর তুলতুলকে নির্দিষ্ট স্থানে আঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে উঠলো
“আস্ক গড ফর পিস অফ সোল।
অর্থারের নির্দেশিত আঙ্গুলি অনুসরণ করে ভারাক্রান্ত হলো তুলতুল এর মন।সেই সাথে ঘন কালো চোখের কার্নিশ বেয়ে অল্প জল বিন্দু ও গড়ালো।সন্তপর্নে তা মুছে বাঁশের আধ কাঁচা বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে ফুল গুলো রেখে ভেজা অস্ফুট কন্ঠে তুলতুল বলে উঠলো
“ওপারে ভালো থাকবেন মিস্টার রেইন।কতো দ্রুত আপনাকে ভুলে গিয়েছি।অথচ আপনি আমাকে মনেই রেখে দিলেন।
রেইনের জন্য কিছু দোয়া মোনাজাত করে আর্থার এর সামনে এসে দাড়ালো তুলতুল।তুলতুল এর কাতর কষ্টে জর্জরিত মুখের পানে তাকিয়ে কিছু পেপার্স বের করলো আর্থার।এরপর সেগুলো তুলতুল এর কাছে সমর্পণ করে বলে উঠলো
“বন্ধু হিসেবে তার সম্পদের ফিফটি পার্সেন্ট আপনাকে গিফট করেছে সে।পেপার্স গুলোতে সাইন করে আমাকে দায়িত্ব মুক্ত করুন।স্যার হীন এই দায়িত্বের ভার বহন করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ম্যাম।এবার তাথৈ ম্যাম এর পালা।
মাস খানেকের ব্যাবধানে অস্ট্রেলিয়া ঘুরতে এসেছে ভিয়ান আর তাথৈ।উদ্দেশ্য রেইনের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ।কিন্তু আদেও কি আর তা সম্ভব?কবর থেকে কি কাউকে চাইলেই মন ভরে দেখা যায়?চোখের আর মনের তৃষ্ণাটা বুঝি কাল থেকে কালান্ত্রে রয়ে যায়।তাই না?ভালোবাসা কি কোনো বাধা মানতে চায়?হোক তা জীবিত বা মৃত?মৃত্যুর পরেও আমরা প্রিয় মানুষকে এক পলক দেখার লোভ সংবরণ করতে পারিনা।খুব করে সব কিছুর আবদার করি।ওই দূর আকাশ থেকে কি সত্যিই আমরা তাদের মন ভরে দেখতে পাই?
____★★★★★★★সমাপ্ত★★★★★★★____