বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-০৪

0
642

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৪.
হেমন্তকাল শেষের দিকে। শীত পড়ে গেছে। জানালা গলে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। হাবিব একচুলও নড়ল না। খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। যেন সে মানুষ নয়, পাথরের মূর্তি। নাইমা নরম গলায় বলল, “কিছু বলছ না কেন? কি হয়েছে?”

হাবিব জবাব দিলো না। মিনিট পাঁচেক ওভাবেই বসে রইল। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল। নাইমাও তার পিছনে ছুটল। সে গোলাপের ঝাড়ের দিকে দৌড়াচ্ছে। সামান্য পথ অথচ আজ হঠাৎ এই দূরত্বকে কয়েকশ মাইল মনে হচ্ছে। হালকা গলায় নববীর নাম ধরে ডাকছে। আওয়াজ খুবই অল্প। ঠিকমতো কানে লাগে না। বাতাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। হাবিব বসরাই গোলাপের ঝাড়ের কাছে এসে থেমে গেল। একটু দূরে নববী বসে আছে। বসেছে মাটিতে এবং উদাসীন ভঙ্গিতে। কিছু চুল মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। হাবিব তার পাশে বসল। কোমল গলায় বলল, “এখানে বসে আছো কেন?”

“আমার বাবাটা ওইখানে ঘুমাচ্ছে। ও তো একা থাকতে ভয় পায়। কখনও একা ঘুমাতে চায় না। ঘুমালেও আমার হাত ধরে থাকে। আজ ওর ভয় করছে না?”

হাবিব নিজের স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে শান্ত রেখে বলল, “ঘরে চলো। তোমার ঠান্ডা লাগবে। বাবা ভয় পাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে না।”

“সত্যি ভয় পাচ্ছে না?”

“না, সত্যিই ভয় পাচ্ছে না। নিষ্পাপ মানুষের মৃ’ত্যুর পরে আর কোন ভয় থাকে না। ভয় থাকে পা’পী মানুষের। যারা অ’ন্যা’য় করে, জু’লু’ম -অ’ত্যা’চার করে। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?”

সে মাথা দোলালো। নরম গলায় বলল, “বুঝতে পারছি।”

“এবং আপনি নির্ভর করুন আল্লাহর উপর। আর অভিভাবক এবং সাহায্যকারী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।( সূরা আল আহযাব, আয়াত- ৩)
ঘরে চলো। ঠান্ডা লাগবে।”

“আর একটু সময় থাকি? শুধু জিয়ারত করব।”

“ঠিক আছে।”

হাবিব মোনাজাত ধরল। সে মিহি গলায় কুরআন তেলওয়াত করছে। শুনলে হৃদয় প্রশান্ত হয়ে যায়। নববীর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। হঠাৎই তার দু-চোখ নতুন করে ভিজে উঠল। লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল। বুকে জমা কষ্টগুলো গলা দিয়ে ওপরে উঠতে চাইছে। নাইমা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে-ও বোধহয় মোনাজাত ধরে আছে, অথবা মনে মনে দোয়া করছে। তার দু-চোখও ভিজে উঠছে।

দীর্ঘ সময় দোয়া কালাম পড়ার পর হাবিব ঘরে ফিরল। সে তার স্ত্রীর হাত ধরে আছে। এ হাত দু’টি বড্ড ভরসার এবং ভালোবাসার। নাইমা তাদের পেছন পেছন ঘরে ঢুকল। কনক বলল, “রাত দুপুরে দু-জনে মিলে কোথায় গিয়েছিলে? কিছুটা লাজলজ্জা অন্তত রাখো।”

হাবিব কড়া চোখে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না। তার কথা বলতে ভালো লাগছে না। গলা ধরে আসছে। নাইমা অবশ্য চুপ রইল না। কঠিন মুখে বলল, “কোন বিষয়ে লাজলজ্জা করা উচিত তুমি সেইটা শেখার চেষ্টা করো। ওরা বিবাহিত স্বামী স্ত্রী। রাত দুপুরে কোথাও যাক অথবা ভরদুপুরে। তোমার দেখার প্রয়োজনীয়তা নেই।”

কনক এগিয়ে এসে নাইমার চুলের মুটি চেপে ধরল। দাঁত দাঁত চিপে বলল, “বড্ড জ্ঞান দিচ্ছিস যে। ভাই ভাবীর কেনা গো’লা’ম হয়ে গেছিস নাকি নববীর ছোট ভাই, কি যেন নাম? ও হ্যাঁ! আরিফের প্রেমে পড়েছিস?”

নাইমা অল্প হাসল। বরফ শীতল গলায় বলল, “আমাকে তোমার নিজের মতো ভাবলে ভুল করবে আপা। আমি তোমার মতো নই। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে জানি এবং নিজের সম্মান রাখতে জানি। চুল ছেড়ে দাও।”

কনক একটু অবাক হলো। নাইমার চুল ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে এলো। ঠিক তখনই আনিস ঘর এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। অন্তরঙ্গ সুরে বলল, “শালিকা, কেমন আছো তুমি? সকাল থেকে দেখা নেই কেন?”

“ভালো আছি। আমার নাম নাইমা।” বলেই সে নিজের ঘরে চলে গেল। কনক লজ্জা মেশানো চোখে বিব্রত ভঙ্গিতে আনিসের দিকে তাকালো। আনিস সেদিকে খেয়াল করেনি। নিজের মনে ঠোঁট চেপে হাসছে। কনক বলল, “নাইমার কথায় কিছু মনে করো না। বাচ্চা মেয়ে তো।”

“সমস্যা নেই। তাছাড়া তোমার বোন অতটাও বাচ্চা নয়। দেখছ কেমন শরীর ঢেকে ওড়না পরে।” তার কথার ধরনের অতিরিক্ত রকমের কুৎসিত হলেও কনক কিছু বলল না। মেকি হাসল। বলল, “সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। নাস্তা এনে দেব? লেবু পাতা দিয়ে চা করে দিই?”

“চা এক কাপ দিতেই পারো। অন্য কোন নাস্তা লাগবে না। একবারে রাতের ভাত খাবো। শাশুড়ি মা’কে দেখলাম খাসির গোশত রান্না করেছে। আর কি কি বেঁধেছে বলো তো?”

“ওই তো! বাটি চাপা গরম ভাত, খাসির গোশত, কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, বরবটি-আলু ভাজি আর পাবদা মাছ। পাবদা মাছ আলাদা করে শুধু তোমার জন্য রান্না করেছে।”

“চলনসই। সাথে একটু দই মিষ্টির পদ রাখলে ভালো হত। যাইহোক তুমি চা বানিয়ে নিয়ে এসো। আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”

“এই ঠান্ডায় বাইরে যাবে? রোহানের কাছে বসলেই তো পারতে।”

“এমনি দোকানে গিয়ে চা খেতে চেয়েছিলাম। তুমি বললে তাই আর যাব না।”

চা অথবা তরল পদার্থ খাওয়া যায় না। পান করতে হয়। কনকের ইচ্ছে হলো স্বামীর ভুল ধরিয়ে দিতে। কিন্তু কিছু বলল না। স্বামীর ভুল ধরা তার স্বভাবে পড়ে না। ব’জ্জা’ত মেয়ে মানুষেরা স্বামীর ভুল ধরে। আনিস আবছা অন্ধকার ঠেলে মিলিয়ে গেল। কনক কিছু একটা ভেবে মা’য়ের ঘরে উঁকি দিলো। নাহ তার বাবা এখনও ফেরেননি। মহিউদ্দিন সাহেব সন্ধ্যার পরপরই বাড়িতে ফেরেন। আজ ফেরেননি। কোথায় গেছেন বলেও যাননি। বলেছেন ফিরতে দেরি হবে।

কনক সোজা মা’য়ের ঘরে ঢুকল। শরিফা বেগম তখন তসবি হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। কনক তার পাশে গিয়ে বসল। খানিকটা কাঁদুনি ভাব করে বলল, “মা, তোমার ছোট মেয়ে খুব বে’য়া’দ’ব হয়েছে। সারাক্ষণ নববীর হয়ে কথা বলে। একটু আগে কি করেছে জানো?”

শরিফা বেগম জিজ্ঞেসু চোখে তাকালেন। কনক গোটা ঘটনা মা’কে খুলে বলল। সত্যের সাথে কিছু কথা জোড়াতালি দিয়ে বেশ অনেকখানি গল্প তৈরি করে ফেলল। খেয়াল করল গল্পটা বলতে তার ভালো লাগছে। কেমন যেন উত্তেজনা কাজ করছে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মায়ের বকুনি শোনার পর নাইমা চুপসে যাওয়া মুখের কথা ভেবেই বোধহয় সে খুব মজা পাচ্ছে।
সবকিছু শোনার পর শরিফা বেগম বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কঠিন মুখে বললেন, “সব ব্যাপার নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কি? হতে পারে ওরা দু’জন সোহেলের ক’ব’র জিয়ারত করতে গেছিল। বা যেখানেই যাক। তাছাড়া নাইমাকে তো চিনিসই। ছেলেদের সাথে মিশতে পছন্দ করে না। বাবা আর আপন ভাই ছাড়া তোর কোন মামাতো ভাইয়ের সাথেও ভালো করে কথা বলে না। এটা নতুন কি?”

“নতুন ছাড়া আর কি মা? এখনও দেখি তোমার নাইমা রোহানের আব্বুর হাত ধরে মেলায় ঘুরঘুর করছে। বেলুন কিনে দিতে বলছে।”

শরিফা বেগম কয়েকটা কড়া কথা বলতে গিয়েও বললেন না। চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। কনক উঠে চলে গেল। সে নিশ্চয়ই এখন কোন নির্জন জায়গা খুঁজবে। তারপর খানিকক্ষণ কাঁদবে। কনক নাইমার মতো শক্ত মনের না। সামান্য কথায় কেঁদে ফেলে। হুটহাট রেগে যায়। তার দুই মেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রকমের হয়েছে। অথচ তিনি তা ধরতে পারেন না। কোন এক জায়গায় দু’জনকে এক করে ফেলেন।

আনিস বাড়ির সামনের রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। কয়েকবার উঁকি দিয়ে বাড়ির ভেতরে দেখল। তারপর পকেট থেকে সিগারেট বের ধরে তাতে আ’গু’ন ধরালো। সিগারেটখানা ঠোঁটের মাঝখানে চেপে ধরতেই কেউ একজন বলে উঠলেন, “আনিস না? এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

আনিস ভদ্রলোকের গলা শুনে চমকে উঠল। ঠোঁট থেকে সিগারেট ফেলে পা দিয়ে চেপে ধরল। মেকি হেসে বলল, “কিছু না আব্বা। আপনি এখন কোথা থেকে ফিরছেন?”

মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “শুক্রবারের অনুষ্ঠানের জন্য কিছু সদাই-পাতি বায়না করতে গিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে ফিরছি।”

“বড্ড খারাপ লাগে আব্বা। বাচ্চা ছেলেটা। কয়দিনই বা বয়স।”

“সোহেলের জন্য শোক প্রকাশ করছ- অসুবিধা নেই। তবে নববী তুলে কোন কথা বলবে না। জানোই তো! মায়ের থেকে মাসীর দরদ কখনও বেশি হয় না।”

মহিউদ্দিন সাহেব দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। আনিস পায়ে পি’ষে ফেলা সিগারেটের দিকে তাকিয়ে হালকা নিঃশ্বাস ফেলল। জিনিসটা বেশ দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে। দোকানী বলেছে – ভেতরে পাতার গুঁড়ো দেওয়া আছে। শরীরের জন্য উপকারী। টান দিলেই শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠবে। পুরো টাকাটা জলে চলে গেল। খুবই আফসোসের বিষয়। সে এক বুক হতাশা নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। বসরাই গোলাপের ঝাড়ের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে লাগছে। গন্ধ তার মোহনীয় ক্ষমতা বলে আনিসকে তার দিকে আকর্ষণ করছে। আনিস কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বুকে থুথু ছিটিয়ে ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে সদর দরজা ভেজিয়ে দিলো। শীতের মাঝেও তার কপাল ঘেমে গেছে। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। অদ্ভুত গলায় কনকের নাম ধরে ডাকলো। কনক তখনও রান্নাঘরের দেওয়ালে পিঠ চেপে ধরে কাঁদছে। স্বামীর গলা শুনে ট্যাপ ছেড়ে মুখ ধুয়ে ফেলল। শব্দ করে নাক ঝাড়ল। ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “কি হয়েছে রোহানের আব্বু? ডাকছ কেন?”

আনিস তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, “ভাত দাও। রাত বাড়ছে। ঝামেলা করে লাভ নেই। খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ি।”

“আমি খাবার বাড়ছি।”

“অল্প করে বাড়বে। খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“শরীর খারাপ লাগছে নাকি? ডাক্তারকে আসতে বলব?”

“নাহ, তেমন সিরিয়াস কিছু নয়।৷ ভাত দাও।”

আনিস বলেছিল তার খিদে নেই। তবে সে বেশ অনেকটা ভাত খেয়ে ফেলল। বেশ কয়েকবার ভাত চেয়ে নিয়ে খেলো। কনক ছয়টা পাবদা মাছের সবগুলোই স্বামীকে খাইয়ে দিলো। এ ব্যাপার নিয়ে তার মনে কোন দ্বিধা কাজ করল না।
আনিস খাবার পরপরই শুয়ে পড়েছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে মোবাইলে ফেজবুক চালাচ্ছে। কনক গিয়ে তার পাশে বসল। গায়ের ওপর একটা হাত রেখে বলল, “শুনছ তুমি।”

আনিস ক্ষীণ গলায় হু বলল। কনক বলল, “রোহান তো বেশ বড় হয়ে গেছে। এবার একজন মায়ের চিন্তা করলে হতো না।”

আনিস প্রায় লাফিয়ে উঠে বসল। উৎসুক গলায় বলল, “হ্যাঁ, তা তো ভাবাই যায়। সত্যিই রোহান বড় হয়ে গেছে। তবে কি বলো তো। আমার বেতন অল্প। এই দিয়ে চারজনের সংসার চালানো যাবে না। তারপর তোমার আর সিজার। কত টাকা পয়সার ব্যাপার।”

“তাতে কি? একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।”

“হ্যাঁ গো। আমার শশুর আব্বাকে বলো না- লাখ দুয়েক টাকা ম্যানেজ করে দিতে। একটা ছোট ব্যবসা শুরু করি। আমারও খুব শখ! তোমার মতো সুন্দর, মায়াবী, ফুটফুটে একটা মেয়ে থাকবে। কানের পাশে কোঁকড়া চুল গুঁজে রাখবে।”

কনক মিইয়ে যেত। তবে আনিসের শেষ কথাগুলোর জন্য স্বাভাবিক রইল। এক রাশ লজ্জা তার মুখে এসে জড় হলো।

“বলছি কি? শোনো না- শশুর আব্বার হাতটান নেই। কত টাকা খরচ করে সোহেলের মিলাদ মাহফিল করছে। তুমি কিছু চাইলে না বলবে না।”

“আচ্ছা বলে দেখবক্ষণ। শুয়ে পড়ো। দেখি রোহান কি করছে।”

“তুমি এসো না। একা ঘুম হয় না।”

কনক দাঁড়াল না। চাপা হাসি ঠোঁটে লাগিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় দরজা ভেজিয়ে দিলো।

চলবে