বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-১৩

0
483

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১৩.
মহিউদ্দিন সাহেব বারান্দার এক কোণে বসে আছেন। তার মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। নিজের হাতে কপাল চেপে ধরে আছেন। শরিফা বেগম বললেন, “এসব কি শুরু হলো? একটার পর একটা বিপদ লেগেই আছে।”

মহিউদ্দিন সাহেব জবাব দিলেন না। শরিফা বেগম বললেন, “দারোগা এসেছে। আপনার খোঁজ করছিল।”

“এখন বলছ কেন?”

তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। এলোমেলো পায়ে হেঁটে ডাক্তারের কেবিনে ঢুকলেন। দারোগার বয়স বেশি নয়। শক্ত-সামর্থ্য চেহারার অল্প বয়সী যুবক। লোকটা মহিউদ্দিন সাহেব দেখে হাসলেন। উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আমি ইন্সপেক্টর শরাফত উল্লাহ।”

“মহিউদ্দিন।”

“বসুন। বসে কথাবার্তা বলি।”

মহিউদ্দিন সাহেব চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। ধপ করে শব্দ হলো যেন। শরাফত বললেন, “কে হয় আপনার?”

“জামাই। বড় মেয়ের বর।”

“ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন?”

“নাতির কাছে। এই হাসপাতালে ভর্তি আছে।”

“কারোর সাথে শত্রুতা আছে?”

“থাকলে জানা নেই। আমার জানা মতে আনিসের কোন শত্রু নেই।”

“আপনাদের পরিবারের সব সদস্যের সাথে কথা বলা হবে। সবকিছুর তদন্ত হবে।”

“সে হোক। আনিসের চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।”

“চিকিৎসা চলছে৷ প্রয়োজনে বিভাগীয় শহর কিম্বা রাজধানীতেও নেওয়া হবে।”

“ডাক্তার সাহেব বলছিলেন – পুলিশ আসার আগে রোগীর গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। এমন নিয়ম আছে কি?”

শরাফত শান্ত গলায় বললেন, “ফৌ’জ’দা’রি কার্যবিধির ৫০৯ ধারা মতে ডাক্তাররা (চিকিৎসক) আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন। খু’ন, ধ’র্ষ’ণে’র মা’ম’লা’য় ডাক্তারের রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৃ’ত্যুর কারণ কিংবা ধ’র্ষ’ণ নিরূপণের জন্যই ডাক্তারি পরীক্ষার প্রয়োজন।
ডাক্তারি রিপোর্টের পরও তাকে আদালতে সাক্ষী হিসেবেও তলব করা হয়ে থাকে।”

“তার জন্য একজন মানুষের চিকিৎসা আটকে থাকবে?”

“খু’নের মামলায় তদন্তের জন্য শরীরের অবস্থা জানার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আছে। সেজন্যই কড়াকড়ি করা হয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা!”

মহিউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। শরাফত বললেন, “আমায় যেতে হবে। প্রয়োজনে আপনাদের সবাইকে থানায় ডাকা হবে। আপনার মেয়ের সাক্ষ্য খুব জরুরি।”

“অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।”

“সমস্যা নেই। সুস্থ হবার পর কথা বলব।”

নাইমার জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ। ভ্রু কুঁচকে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় হালকা হালকা ব্যাথা অনুভব করছে। হাবিব তার পাশে বসল। সহজ গলায় বলল, “এখন কেমন লাগছে?”

“ঠিক লাগছে।”

“কি হয়েছিল? দুলাভাইয়ের এই দশা কিভাবে হলো?”

“জানি না। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়েছে যে কিছুই বুঝতে পারিনি।”

“আশেপাশে কাউকে দেখেছিলি? কোন মানুষ বা ছায়া?”

“না ভাইয়া। দুলাভাই বারবার করে বলছিল এসব ঝামেলায় না জড়াতে।”

“আর কিছু বলেনি?”

“না আর কিছু বলেনি।”

“গু’লি লাগার পর, হাসপাতালে- ইশারায় তোকে ডেকেছিল। কি বলেছে?”

নাইমা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। গলার স্বর অনেকখানি নিচু করে বলল, “বলেছে এরপর আমার পালা। ওস্তাদ সবাইকে মে’রে ফেলবে।”

হাবিব পকেট থেকে রুমাল বের কপালের ঘাম মুছল। এতসব ঝামেলায় তার শরীর খারাপ লাগছে। সে বলল, “হাসপাতালে থাকতে চাস নাকি বাড়িতে যাবি?”

“এখানেই থাকব। দারোগা সাহেব বললেন- কিসব জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।”

“সাবধানে থাকবি। কেমন? বাড়িতে গিয়ে নববীকে নিয়ে আসছি। ও তোর সাথে থাকবে।”

নাইমা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সামান্য মাথা দুলিয়ে বলল, “নিয়ে এসো। পারলে এক বাটি নুডলস রান্না করে আনবে। খেতে ইচ্ছে করছে।”

হাবিব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল। শরাফতের সাথে কথা বলে নিয়েছে। তিনি অনুমতি দিয়েছেন।

হাসপাতালের বিছানায় সাদা চাদর বিছানো থাকে। দেখে মনে হয় সাগরের ফেনা ভাসছে। নাইমা যে বিছানায় শুয়ে আছে তার চাদরও সাদা রঙের। পায়ের দিকে খানিকটা অংশে লাল লাল ছোপ, মনে হয় পানের পিক লেগেছে। সে বিছানায় উঠে বসল। শরিফা বেগম বললেন, “নববী না আসলে ঝামেলা হচ্ছে। কনক রোহানের সাথে একা। মেয়েটার ওপর দিকে যেসব যাচ্ছে। আল্লাহ মাফ করুক।”

“তুমি আপার কাছে যাও। আব্বাকে বলো আমার কাছে এসে বসতে।”

“তোর আব্বা দারোগার সাথে গেছে। ওই জায়গা খুঁজে দেখতে হবে।”

“থাকতে থাক। তুমি আপার কাছে যাও। আমার ঠিক লাগছে।”

শরিফা বেগম অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়ে দু’বার ফিরে তাকালেন। নাইমা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যে-ই গু’লি করুক, সে জানত তারা ওখানে আছে। এমনকি এটাও জানত কে কোন চেয়ারে বসা, কোন দিক থেকে গু’লি করবে, সবকিছু আগে থেকে ঠিক করা ছিল। অবাক করার বিষয় হচ্ছে জায়গাটা অন্ধকার। গু’লির শব্দ হয়নি। দুলাভাই কিভাবে জানলো বু’লে’ট আসছে। খালি চোখে বু’লে’ট দেখার সুযোগ নেই।
নাইমা নিজের মাথা চেপে ধরল। সন্ধ্যায় দেখা করার ব্যাপারটা সে, আনিস এবং হাবিব ছাড়া অন্যকেউ জানত না। নাকি জানত? সে লম্বা শ্বাস নিলো। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ডাইরিটা প্রয়োজন। সেভাবেই হোক ওই বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। সে ঠিক করল – সব কাজ একাই করবে। হাবিবকে আর কিছু জানাবে না। কেন যেন ভাইকেও আর ভরসা করতে পারছে না।

নববী রাতের খাবার সাজিয়ে বসে আছে। একা বাড়িতে তার কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে কেউ তার ক্ষ’তি করে ফেলবে।
এদিকে দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে হাবিবকে কল দিচ্ছে। সে কল রিসিভ করছে না। হঠাৎই কেউ একজন নববী কাঁধে হাত রাখল। নববী চমকে চিৎকার দিয়ে উঠল। হাবিব বলল, “আমি।”

“এভাবে কেউ ভয় দেখায়। আর একটু হলে হার্টফেল করতাম।”

“ঝামেলা হয়ে গেছে নববী। বিরাট ঝামেলা হয়ে গেছে।”

“কি হয়েছে?”

“দুলাভাই!”

“কি করেছে দুলাভাই? নাইমার কোন ক্ষ’তি করেনি তো? আগেই বলেছিলাম, এসব ঝামেলা করো না। পুলিশের জানাও।”

“নাইমা সুস্থ আছে। দুলাভাইকে কেউ বা কারা গু’লি করেছে?”

নববী বিস্মিত গলায় বলল, “ম’রে গেছে?”

“না, এখনও জীবিত। হাসপাতালে ভর্তি।”

“দুলাভাই মা’রা গেলে অনেক সত্য চাপা পড়ে যাবে।”

“যখন গু’লি লেগেছে তখন নাইমাও তার সাথে ছিল। আল্লাহর রহমত নাইমার কিছু হয়নি। তবে এসব দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।”

“এখন কি অবস্থা?”

“হাসপাতালে। তোমাকে নিতে এসেছি। ওর কাছে থাকবে। মা আপার কাছে থাকবে।”

“আপা ঠিক আছে?”

“কাঁদছে। এতকিছুর পরে কিভাবে ঠিক থাকবে? ঠিক থাকা সম্ভব না।”

“অল্প কিছুক্ষণ সময় দাও, সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আসছি। খাবার বেড়ে দেব? খাবে?”

“খিদে নেই। দ্রুত কাজ সারো।”

নববী বেশ দ্রুতই সব কাজ গোছালো। খাবার-দাবার টিফিনবাক্সে ভরে আলাদা করে রাখল। দু’টো কম্বল, বেডশিট, বালিশ নিলো। মোবাইল চার্জার, থালা-বাটিতে এমন অবস্থা যেন কেউ নতুন সংসার সাজিয়েছে।
অটোরিকশায় বসা যায় না। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে। নববী হাবিবের হাত চেপে ধরল। ভীতু গলায় বলল, “ভয় হয়। আল্লাহ না করুক তোমার কিছু হয়ে গেলে।”

হাবিব নববীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “চিন্তা করো না। আল্লাহ চাইলে আমি তোমার কাছেই থাকব।”

হাসপাতালে লোকের অভাব নেই। গিজগিজ করছে চারদিকে। ফিনাইলের কড়া গন্ধ, ওষুধের গন্ধ এবং রোগের গন্ধ। কিছুক্ষণ থাকলেই মাথা ভার ভার হয়ে যায়। আনিসের বাড়ির লোক এসেছে যাদের এখানে কোন কাজ নেই তারাও এসেছে। পুলিশ দেখে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। কনক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “নিজের ছেলের কথা শুনে সবাই এসেছেন। অথচ আমার ছেলে দু’দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। আসা তো দূরের কথা, কল দিয়েও খোঁজ নেননি।”

মিলি বলল, “রোহান অসুস্থ। এ খবর কি আমাদের জানিয়েছেন?”

শরিফা বেগম বিস্মিত গলায় বললেন, “আনিস কিছু বলেনি? আমরা তো ভেবেছি ও সব বলবে।”

“না আন্টি বলেনি। আংকেল কল না দিলে ভাইয়ার কথাও জানতে পারতাম না।”

“যা হবার হয়েছে। এখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া অন্য উপায় নেই।”

“এখানে চিকিৎসার কি প্রয়োজন? ভাইয়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল যেতেন। ভালো ভালো প্রাইভেট হাসপাতালগুলো আছে।”

“সময় হয়নি মা। ডাক্তার বলেছে- হাতে সময় কম। এখানেও ভালো ডাক্তার আছে৷ যা হবে ভালো হবে।”

মিলি বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলল। হাবিব যখন হাসপাতালে পৌঁছাল ততক্ষণে শরাফত ফেরত চলে গিয়েছিলেন। দু’জন কনস্টেবল আছে। রাতে তারা থাকবে। নববী গিয়ে নাইমার পাশে বসল। নুডলসের বাটি বের করে দিয়ে বলল, “এখনও গরম আছে। খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”

নাইমা শান্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়ালো। নববী বলল, “কি হয়েছিল? শুনলাম তুমি সাথে ছিলে। দুলাভাই আর কি বলেছেন?”

“কিছু বলেনি ভাবী। চটপটি খাবার নাম করে উনার সাথে বের হয়েছিলাম। কেউ একজন আগে থেকেই সবকিছু জানত।”

“কে জানত?”

“আমরা বাদে অন্যকারো কথা জানি না। দুলাভাই নিজেই আক্রান্ত, তাই তিনি এটা করবেন না। বাকি থাকলাম আমরা।”

“আমাদের মধ্যে কেউ হতে পারে?”

“আমিও হতে পারি।”

নববী চোখ ছোট হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “এটা তুমি কি বললে?”

“কি বললাম?”

“এই যে আমিও হতে পারি?”

“কথার কথা বললাম।”

“তোমার ভাইও এই একই কথা বলছিল। কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না।”

নাইমা গলার স্বর অনেকখানি নিচু করে বলল, “সেসব ছাড়ো। হীরের ব্যাপারে আর কিছু জানতে পারলে?”

“না, কিছু জানা যায়নি। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।”

“চিন্তার কিছু নেই। যে খেলা শুরু হয়েছে। তা আর থামবে না। এর শেষ দেখতে হবে।”

নববী বিষন্ন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। নাইমা সব কথা বলতে গিয়ে বলল না। চুপ রইল। অপরাধী সনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত সবাই অপরাধী। কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। আনিসের কাজকর্মে পরিষ্কার বোঝা যায়, নাইমাকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত সে খুব দ্রুতই নিয়েছে। তবে কি সে জানত কে কখন গু’লি চালাবে? নয়তো অন্ধকারে বুঝল কিভাবে!

নাইমা উঠে দাঁড়ালো। নববী বলল, “কোথায় যাচ্ছ? এভাবে হাঁটা-চলা করা ঠিক না। বিশ্রাম নাও।”

“আমি ঠিক আছি ভাবী। রোহানকে দেখতে চাই।”

“আচ্ছা বেশ। এসো, আমার হাত ধরো।”

নাইমা নববীর হাত ধরল। লিফট বন্ধ হয়ে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হবে। তারা দু’জন খুব সাবধানে এবং ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। কনক নাইমাকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “কি চাইছিস তুই?”

“কি চাইব আপা?”

“বুঝতে পারছিস না তাই না? দু-দিন আগেও রোহানের আব্বুকে সহ্য করতে পারতি না। দেখলে মুখ বেঁকিয়ে রাখতি। রোহান হাসপাতালে ভর্তি হবার পর কি এমন হলো যে সবটা পাল্টে গেল? গায়ে গা লাগিয়ে গল্প করতে শুরু করলি, কোথাও গেলে একসাথে যাওয়া। কি করেছিস তুই?”

নাইমা বরফ শীতল গলায় বলল, “যে মহিলা নিজের একটা বাচ্চা সামলাতে পারে না। তার স্বামী তো দ্বিতীয় অপশন খুঁজবেই। এতে অবাক হবার কি আছে?”

কনক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মিলি বলল, “রাগারাগি করো না নাইমা। ভাবী ওভাবে বলতে চায়নি।”

“আপনার ভাবী ওভাবেই বলতে চেয়েছে। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”

মিলি কনকের চোখের দিকে তাকালো। কনক চোখ সরিয়ে নিয়েছে। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “হাসপাতালে কে কে থাকবে?”

শরিফা বেগম মাথা নেড়ে বললেন, “জানি না। আমায় থাকতে হবে। নববী নাইমার কাছে থাকবে। দেখ তোমরা কি করবে!”

“আমি থাকছি। হাবিব বাড়ি ফিরে যাক। বাড়ি ফাঁকা রাখা ঠিক হবে না।”

হাবিব ভালো-মন্দ কিছু বলল না। যেন সে এ জগতে নেই, গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।

চলবে