#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল
২১.
রাতে আকাশ পরিষ্কার। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। সে গায়ের চাদর একটু টেনে দিলো। হিসহিসিয়ে বলল, “মামা একটু জোরে চালান।”
বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা পেছন ফিরে তাকালো। সরু গলায় বলল, “হাওয়ার মধ্যে চালানো যায়! স্যারের তাড়া আছে নাকি?”
“একটু ছিল। সমস্যা নেই। আপনি চালান।”
সে আগের থেকে অনেক ধীরে রিকশা চালাতে লাগল। হাবিব বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলল কিন্তু কিছু বলল না।
ডিআইজি সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। তার চোখ রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে। মাথার ভেতর সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। এক কাপ কফি পান করতে পারলে মন্দ হতো না। অফিসে পিওন আছে। তাকে বললেই বানিয়ে দিয়ে যাবে। কেন যেন এই কষ্টটুকুও করতে ইচ্ছে করছে না। তিনি হাবিবকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। হাবিব চেয়ারে বসল। নরম গলায় বলল, “কেন ডেকেছেন?”
“কিছু ফর্মালিটি বাকি আছে। কয়েকটা কাগজপত্র সই-স্বাক্ষর করতে হবে। এগুলো বিশেষ জরুরি নয়। ডেকেছি একটি বিশেষ কথা বলার জন্য।”
“কি কথা? যা বলবেন একটু দ্রুত বলুন।”
ডিআইজি সাহেব ড্রায়ার টেনে আনিসের ডাইরি বের করলেন। পৃষ্ঠা বের করে হাবিবের সামনে রেখে বললেন, “পড়ুন।”
হাবিব সরু চোখে তাকিয়ে পড়তে আরম্ভ করল। হাতের লেখা আনিসের। সে এই লেখা চেনে। লেখার শুরুটা এমন,
শুনেছি মা মাত্রই ভালো মানুষ। মায়েরা খুব মমতাময়ী, সন্তানকে আগলে রাখতে জানে। খারাপ কাজে বাঁধা দেয়, ভালো কাজে উৎসাহ দেয়। সাহিত্যের সব কথা আমি বিশ্বাস করি না। সাহিত্যের বেশিরভাগেরই বায়বীয় কথাবার্তায় ভরপুর। তবে মায়ের ব্যাপারে এই কথাগুলো আমি বিশ্বাস করতাম। আজ আমার সেই ভুল ভাঙলো। আমার স্ত্রী কনক, সে যেমন একজন খারাপ স্ত্রী -তেমনই একজন খারাপ মা। স্বামী হিসাবে আমি নিজেও অত ভালো নই। খাঁটি কথায় জ’ঘ’ন্য। তবে বাবা হিসাবে বেশ ভালো। খারাপ মানুষ নই।
আজ হঠাৎই রোহান আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। অভিমানী মুখে বলল, “আমি মা’য়ের কথা শুনি না বলে তুমি মা’কে ভীষণ কষ্ট দাও বাবা। কেন দাও?”
আমি নিচু হয়ে তার দিকে ঝুঁকলাম। বললাম, “কি হয়েছে? কি বলেছে তোমার মা?”
রোহান বলতে চাচ্ছিল না। অনেক জোর করার পর বলল, “মা বলেছে আমি সোহেলকে পানিতে ফেলে না দিলে তুমি মা’কে খুব মা’র’বে। কেন মা’র’বে?”
ছেলেকে আর বেশি জোর করলাম না। কনকের কথা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। সে কি বলতে পারে আমি খুব ভালো বুঝি। সোহেলের মতো একটা নিষ্পাপ সরল ছেলেকে কেউ কিভাবে মা’র’তে পারে? প’র’কী’য়া করা, খারাপ কাজ করা, এসব কি বাচ্চা হ’ত্যার থেকে বেশি কিছু? অবশ্যই না! সব অপরাধ, তবে কিছু সীমানা নিশ্চয়ই আছে।
কনক যখন কিছু ভাবে তখন সে কাজ শেষ না করে ক্ষ্যান্ত হয় না। সোহেলকেও নিশ্চয়ই মে”রে ফেলবে। আজ বা কালই করবে। কে জানে হয়তো রোহানের হাত দিয়েই এমন কিছু করাবে। আমি তা হতে দিলাম না। বাচ্চা ছেলেটার জীবনে হ’ত্যাকারীর দাগ লাগতে দিলাম না। নিজেই সোহেলকে মে’রে ফেললাম। ছেলেটা পুকুরপাড়ে খেলছিল। তার কাছে গিয়ে আলতো করে ধাক্কা দিলাম। নিশ্চিত হয়েই দিয়েছিল গভীর পানিতে পড়বে, উঠতে পারবে না। জানি আমার অপরাধ হয়েছে। অন্যায় করেছি। তবে ওকে বাঁচানো সম্ভব হত না। যতটুকু পারলাম নিজের ছেলের হাতে খু’নটা হতে দিলাম না। এই আমার শান্তি!
হাবিব শব্দ করে ডাইরি বন্ধ করল। আরবিতে কুৎসিত কিছু গালাগাল দিলো। ডিআইজি সাহেব বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে রইলেন। হাবিব বলল, “আমার এক সাদাসিধে বোন – কনক। যে ছোট বোনের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে মার্কেটে চলে যায়। সারাদিন ঘুরে-ঘুরে জিনিসপত্র কেনে, স্বামীর ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে, মায়ের কথায় ফ্যাঁচফ্যাঁচ কাঁদে। সে চোরাকারবারি সাথে জড়িত! সবকিছু সে করছে! এ-ও কি বিশ্বাস করা সম্ভব?”
ডিআইজি সাহেব ভাবলেশহীন গলায় বললেন, “অসম্ভবের তো কিছু দেখছি না। প্রমাণ তার বিরুদ্ধে। সে-ই অপরাধী।”
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”
“দেখুন হাবিব সাহেব, অপরাধী সবসময় এমন ভান করে চলবে যেন কেউই তাকে বুঝতে না পারে, ধরতে না পারে। আপনাদের কাছে কনক ছোটবেলা থেকে এমন। ছিচকাঁদুনি স্বভাবের, এলোমেলো চলাফেরা করে৷ হঠাৎই তার পরিবর্তন সবার চোখে পড়ত। তখন উল্টো সবাই তাকে সন্দেহ করত। বুঝতে পারলেন?”
হাবিব মাথা দোলালো। সে বুঝতে পারেনি। ডিআইজি সাহেব বললেন, “নওরীন আমায় সবটা বলেছিল। রোহানের ব্যাপার নিশ্চিত করা জরুরি ছিল, আবার নববীর সামনে আসল কারণ বলতে পারছিলাম না। আশা করি আপনি তাকে কিছু জানাননি।”
“না জানাইনি। জানালে সহ্য করত পারত না।”
ডিআইজি সাহেব হাবিবের হাতের ওপর হাত রাখলেন। স্বান্তনার ভঙ্গিতে চোখের ইশারা করলেন। হাবিব মলিন হাসল। তার মনে খানিকটা স্বস্তি মিললেও শান্তি পাচ্ছে না। রোহানের দিকে তাকাতে যে ঘৃ’ণাবোধ কাজ করত, তার কিছুটা কমবে। তবে সন্তানের হ’ত্যা ভুলে যাওয়া কি সহজ কাজ? কেউ কি কখনও ভুলতে পারে?
নববী অস্থির ভঙ্গিতে বারান্দায় পায়চারি করছে। রাত বারোটা বাজতে চলল। হাবিব এখনও বাড়ি ফেরেনি। কল রিসিভ করছে না। মহিউদ্দিন সাহেব শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুটঘাট শব্দ শুনে উঠে এলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, “এখনও ঘুমাওনি কেন? রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে।”
“আপনার ছেলে এখনও বাড়ি ফেরেনি আব্বা। ডিআইজি সাহেব ডেকে নিয়ে গেছে। আমার খুব ভয় করছে।”
“চিন্তা করো না। এমনি কোন কাজে ডাকবে হয়তো।”
“জিনিসগুলো ফেরত দিতে গেছিল। হাসপাতালে গিয়ে সবকিছু দিয়ে এসেছে। তখন আবার থানায় যেতে বলল। থানার আবার কি কাজ?”
“ফাইলপত্রের নানান কাজ থাকে। চিন্তা করো না। চলে আসবে।”
উনার কথা শেষ হবার পরপরই হাবিব বাড়ি ঢুকলো। নরম গলায় বলল, “মোবাইল সাইলেন্ট ছিল। খেয়াল করিনি। খুব কাশি আসছে৷ ঠান্ডা লেগে গেছে।”
নববী বলল, “তুমি গিয়ে কাপড় বদলে নাও। আমি আদা কুঁ’চি দিয়ে চা করে আনছি। গলার খুসখুসে ভাবটা একটু কমবে।”
হাবিব ঘরে চলে গেল। সে খুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। যেন এখুনি পড়ে যাবে। নববী চায়ের পানি বসালো। ফ্রিজ খুলে আদা বের করল। চায়ে সামান্য মধুও মেশালো। ওড়না দিয়ে কাপের ধার মুছে ফেলল। হাবিব বলল, “আর কিছু ভালো লাগে না রে। সবদিক থেকে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”
নববী তার পিঠে হাত রাখল। কোমল গলায় বলল, “রোহানের জন্য খুব খারাপ লাগছে। মা বাবা ছাড়া কিভাবে ওর জীবন কা’ট’বে!”
“এ বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি? ভেবেছিলাম তোমার থেকে শুনব।”
“বিশেষ কোন আলোচনা হয়নি। তবে অবশ্য কিছু কথা হয়েছে। মানিক মিয়া বলেছেন – নাতিকে তার কাছে রাখতে চান। শত হলেও ছেলের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। আম্মু বললেন- ওকে এই বাড়িতে আনবেন। সোহেল নেই, ওর জায়গাটা পূরণ হবে। আব্বু কোন মত দেননি।”
“সোহেলের জায়গা আর কাউকে দিয়েই পূরণ হবে না।”
নববী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাবিব বলল, “ আমার মত থাকবে রোহান তার দাদাবাড়িতে থাকুক।”
“এখানে থাকলে কি সমস্যা? বাড়ির ভেতর ঘুরঘুর করল।”
“ওকে দেখলে সোহেলের কথা মনে পড়বে।”
নববী কথায় মানে বুঝল না। বলল, “বুঝিনি।”
“অন্যের বাচ্চা দেখলে নিজের কথা মনে পড়বে। হ্যাঁ, আমি ওর মামা, তবুও মানিক মিয়ার কথাটা একবার ভাবো। ঘরে অবিবাহিত মেয়ে। এরপর হয়তো বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। কত চিন্তা! এর মধ্যে যদি নাতির মুখ দেখে একটু শান্তি পায়, পাক না! নাইমা কোথায়?”
“ঘুমিয়ে পড়েছে। মায়ের কাছে শুয়েছে আজ। খুব ভয় পেয়েছে।”
“ওর ওপর দিয়ে যে ধকল গেল। আমিও অতটা সহ্য করতে পারতাম কি-না সন্দেহ।”
“রাতে আর একটু খাবে না? তখন তো বেশি খেলেও না।”
“খিদে পায় না নববী। খিদে পায় না। বাতি নিভিয়ে দাও। চোখে আলো লাগে।”
সে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে গেল। লেপ-কাঁথা জমে বরফ হয়ে গেছে। কম্বলটা যাইহোক একটু গরম। হালকা হাওয়া লাগছে গায়ে। বোধহয় জানালা দরজার ফাঁকা গলে ঢুকছে। হাবিব গায়ের কম্বল আর একটু টেনে দিলো।
নাইমা বেশ আয়েশ করে ঘুমিয়েছে। বহুদিন বাদে সে এমন ঘুম পড়ল। ঘুমানোর আগে বেশ অনেক সময় নিয়ে নামাজ পড়েছে। আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়েছে। শরিফা বেগম মেয়ের গায়ে হাত রাখলেন। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলেন- এই মেয়েটাকে যার তার সাথে বিয়ে দিবেন না। খুব দেখেশুনে খোঁজ খবর করে তারপর বিয়ে ঠিক করবেন। ছেলের আহামরি টাকা পয়সা থাকার প্রয়োজন নেই, মেয়েটাকে একটু দেখে রাখলেই হবে। তার এই মেয়েটা আলাদা। কথায় কথায় কাঁদে না। কষ্ট পেলে মুখ বন্ধ করে সহ্য করে। অভাবে থাকলেও চাহিদা নেই, বিলাসিতা নেই। এমন মেয়ে যে কাউকে সুখী করতে পারবে। তিনি মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
সকাল হয়ে গেছে। চারদিকে সূর্যের আলো। হাবিব আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। সে সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়। যেখানে এসবের কষ্টের ছায়া থাকবে না, আপনজনের বিশ্বাসঘাতকতা থাকবে না, সম্পত্তির লোভ থাকবে না। নববী তখনও ঘুমুচ্ছে। হাবিব তার কপালে হাত রাখল। নরম গলায় বলল, “সকাল হয়ে গেছে। ওঠো।”
নববী চোখ খুলল৷ বলল, “আজ আবার সোহেলকে স্বপ্নে দেখেছি। একই জায়গায় খেলা করছে।”
“আজ আমাদের নিয়ে যাবার কথা বলেনি?”
“না, সে কথা একবারও বলেনি। আমার দিকে তাকিয়ে খুব হাসছিল।”
“কেন হাসছিল?”
“জিজ্ঞেস করেছি। বলেনি।”
“ছেলেকে দেখে মন ভালো হলো?”
“যদি ওকে একটু ছুঁয়ে দেখা যেত। কোলে নিয়ে একটু আদর করতে পারতাম।”
“নববী, কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়?”
“এতসব কিছু ভেতর কোথায় যাবে? আম্মু শুনলে কষ্ট পাবেন।”
“এই বাড়িঘর ছেড়ে খুব দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া প্রয়োজন। মন শান্তি পাচ্ছে না। এমন হলে কাজ করতে পারব না। অফিসে সমস্যা হবে।”
“কোথায় যাবে কিছু ভেবেছ? কার সাথে যাবে?”
“তোমায় নিয়ে যাব। নাইমাকেও নিয়ে যাওয়া যায়। ওর মন-মেজাজও অতো ভালো নেই।”
“দেখো, তুমি যা ভালো মনে করো। আম্মু আব্বুকে জানিয়ে নিও।”
“জানাব। তুমি একটা কাজ করো। এক কাপ চা বানিয়ে আনো। মাথা যন্ত্রণা করছে।”
নববী উঠে গেল। হাবিব দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘোরার পরিকল্পনা করল। আজকাল কিসব প্যাকেজ বের হয়েছে। তার একটা নিয়ে নিলেই ঝামেলা মিটে যাবে। কক্সবাজার যাওয়া যায়, আবার কুয়াকাটাও মন্দ হয় না। সে জায়গা ঠিক করতে পারল না।
চলবে