বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-২২

0
170

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

২২.
শরিফা বেগম তাওয়ায় রুটি সেঁকছেন। নববী তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নরম গলায় বলল, “আম্মু, আপনার ছেলে চা চেয়েছে।”

তিনি কাঠখোট্টা গলায় বললেন, “সমস্যা কি? আর একটা গ্যাস জ্বালাও।”

“আপনি খাবেন কি-না জানতে চাচ্ছিলাম।”

“গলা দিয়ে আর কিছু নামে না আমার। তোমার শশুর বাইরে যাবে, তাকে দু’টো রুটি বানিয়ে দিলাম।”

“সবকিছু কেমন শেষ হয়ে গেল!”

শরিফা বেগম নববীর গায়ে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন, “হাবিবের সাথে আলাপ পরামর্শ করে দেখো। তোমরা যদি একটা বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা করতে তাহলেও বাড়িতে একটু সুখ-শান্তি ফিরতে পারত। তোমার শশুর রোহানকে এই বাড়িতে আনতে চায় না। বেয়াই সাহেব নাকি তার হাতে পায়ে ধরছে। সে-ও বয়স্ক মানুষ। মুখের ওপর কি করে না করি বলো?”

নববী লজ্জা পেয়ে গেল। মাথা নিচু করে বলল, “আল্লাহ চাইলে হবে আম্মু।” পরক্ষণেই সোহলের কথা মনে করে তার চোখজোড়া অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে চায়ের পানিতে চিনি ছড়িয়ে দিলো। শরিফা বেগম আঁড়চোখে সবটা দেখলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

হাসপাতালে কনকের অবস্থা ভালো বলা চলে। সকালের নাস্তায় এক প্যাকেট পাউরুটি, একটা সাগর কলা আর একটা সেদ্ধ ডিম দিয়েছে। সে কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “এখান থেকে ছাড়া পাচ্ছি কবে?”

মহিলা পুলিশ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “জেলের খাবার এত মজার হয় না। যে ক’দিন পারো, এখানে ভালো-মন্দ খেয়ে নাও।”

“অনেক খেয়েছি, আর খেতে ইচ্ছে করে না। এখন একটু শান্তিতে ঘুমুতে চাই।”

“যে পাপ করেছ, তোমার মনে হয় ক’ব’রে তুমি শান্তিতে ঘুমাবে? এ-ও কি সম্ভব?”

কনক এ কথার জবাব দিতে পারল না। কেমন যেন থেই হারিয়ে গেল। মলিন গলায় বলল, “একটা অনুরোধ রাখা সম্ভব হবে কি?”

“কি হয়েছে? দেখ, আগেই বলে দিচ্ছি – আমি কারোর হুকুম মানতে পারব না। টাকা-পয়সার অফার করবে না। আমি ঘু’ষখোর পুলিশ নই।”

“হুকুম করছি না। কারোর হুকুম মানতেও বলছি না। শুধু আমার ছেলেটাকে একবার দেখতে চাই। কোন ব্যবস্থা করা যাবে?”

“সে ডিআইজি স্যারের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। এসব কিছু আমার হাতে নেই।”

কনক নিজের কান থেকে সোনার দুল খুলে মহিলা পুলিশের হাতে দিয়ে বলল, “আর কিছু নেই, রোহানকে শুধু একবার দেখতে চাই। দূর থেকে দেখতে দিলেই হবে।”

মহিলা পুলিশ সরল চোখে তাকালো। নদীর মতো গভীর দৃষ্টি, ভাষা পড়া যায় না। সে কানের দুল জোড়া কনকের হাতে দিয়ে বলল, “আমি স্যারের সাথে কথা বলে জানাব। এসবের প্রয়োজন নেই।”

কনক ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার মন বলছে তাকে এই মুহুর্তে ফাঁ’সি দিয়ে দিলে মন্দ হতো না। কোনটা বেশি কঠিন -মৃ’ত্যুকে গ্রহণ করা নাকি মৃ’ত্যুর জন্য অপেক্ষা করা?
সে জবাব খুঁজে পেল না। শূন্য দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

হাবিব অফিসের কাজে মন লাগাতে পারছে না। তার মাথায় কাজ করছে না। মন খারাপ। ঠিক কি কারণে মন খারাপ তা-ও বুঝতে পারছে না। সে সবকিছু ভুলে যেতে চাইছে, কিন্তু আসলেই তা কি কখনো সম্ভব হবে? পিতা তার সন্তানের খু’নি ভুলে যাবে? সন্তান হারানোর যন্ত্রণা ভুলে যাবে। সে ঠিক করল – অফিস শেষে একবার হাসপাতালে যাবে। কনকের সাথে শেষ কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

তার অফিস শেষ হলো সন্ধ্যার পরপর। আগেই ছুটি চেয়ে রেখেছিল। অফিসের বস রাজি হয়নি। এমনিতেই তার বেশ কিছু কামাই পড়ে গেছে। যখন সে রাস্তায় নামল ততক্ষণে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তায় বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। হাবিব হাত উঁচু করে রিকশা ডাকল। সহজ গলায় বলল, “হাসপাতাল যাবে?”

রিকশাওয়ালা মাথা দোলালো। যার অর্থ না। তবুও সে রিকশায় উঠে বসল। বলল, “বাড়িয়ে দেবে, চলো।”

রিকশা চলতে আরম্ভ করল। বাচ্চা ছেলে রিকশা চালাচ্ছে। বয়স খুব বেশি হলে বারো চোদ্দ হবে। হাবিব বলল, “পড়াশোনা করো না তুমি?”

“না স্যার, পেটের দায়ে রিশকা চালাই। ঘরে অসুস্থ মা, বাপ নাই। পড়ব কেমনে?”

“আমি যদি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিই। পড়বে?”

“মায়ের চিকিৎসাপাতি কে দেখব স্যার? তয় আমার খুব ভাল্লাগে পড়াশোনা করতে। ছোট একটা ভাই আছে আমার। অ আ শেখে, ওকে স্কুলে দেবে ভেবেছি।”

“কোথায় থাকো?”

“বাসস্ট্যান্ডের পাশে এক বাসা ভাড়া নিয়া থাকি। পলিথিনের চাল, তা-ও পাঁচশ উপরে ভাড়া।”

দীর্ঘ সময় ধরে তারা তাদের আলাপচারিতা চালিয়ে গেল। হাবিব পকেটে হাত ঢুকিয়ে ম্যানিব্যাগ বের করল। পাঁচশ টাকা দু’টো নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, “বাড়ির জন্য ভালো-মন্দ কিছু কিনে নিয়ে যেও।”

ছেলেটা টাকা নিতে রাজি হলো না। অনেক বোঝানোর পরও এক পয়সা বেশি নিলো না। ভাড়ার টাকা নিয়ে চলে গেল। কি অদ্ভুত জটিলতা এই পৃথিবীতে!

কনক বাথরুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে হাবিবকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। বিস্মিত গলায় বলল, “তুই এখানে?”

হাবিব ভাবলেশহীন গলায় বলল, “আপনাকে দেখতে আসিনি। সে প্রয়োজনীয়তা নেই। একটা খরব দিতে এসেছি।”

“কি খবর দিতে এসেছিস?”

“রোহানের ব্যাপারে। রোহান সোহেলকে পানিতে ফেলেনি। আনিস ফেলেছিল। তার ডাইরি পড়ে জানতে পেরেছি।”

কনক উজ্জ্বল গলায় বলল, “হে আল্লাহ আপনার রহমত। আপনার দরবারে অশেষ শুকরিয়া।”

পৃথিবীর ভালো মানুষ আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়, খারাপ মানুষেরাও তা-ই। ইয়া আল্লাহ! আপনি কিভাবে সহ্য করেন। নিশ্চয়ই আপনি শ্রেষ্ঠ ধৈর্যশীল।

হাবিব বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। কথা শেষ হবার পরপরই বেরিয়ে গেল। রাস্তার পাশে ফুল বিক্রি করছে। সে বেশ অনেকগুলো সদ্য ফোটা গোলাপ কলি কিনলো। আগুন টকটকে রঙের ফুল।

নববী রাতের খাবার খাইনি। হাবিবের জন্য অপেক্ষা করছে। সে দরজা খুলে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। বলল, “ফুল কেন কিনেছ?”

“তোমার জন্য। পছন্দ হয়নি?”

“খুব পছন্দ হয়েছে। তবে এখন এসব দেখলে মা অনেক কষ্ট পাবে। ভাববে তার মেয়ের জীবন-সংসার শেষ হয়ে গেছে আর আমরা!”

“শুধু মা না নববী, কষ্ট আমিও পাচ্ছি। আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি। মা কাঁদতে পারছে, আমি কাঁদতে পারছি না। মা বাড়িতে থাকছে, কাজে সাহায্য করার জন্য তুমি আছো, নাইমা আছে। আমার অফিসের কাজের জন্য কেউ নেই নববী। কেউ না। আমার অনুভূতি তুমি বুঝতে পারছ না, আমি তোমায় বোঝাতে পারছি না।”

নববী মাথা নিচু করে ফেলল। হাবিব তার গালে হাত চেপে ধরে অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “কিছু সময়ের জন্য হলেও কি আমায় সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়া যাবে? তুমি কি আমায় তোমার রাজ্যে হারিয়ে রাখতে পারো না?”

নববী কি বলবে বুঝতে পারল না। তার উচিত হ্যাঁ বলা কিন্তু সে কিভাবে এমন করবে? সামান্য সময় কি সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে? হাবিব করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের অস্পষ্ট ভাষা যেন বলছে – তোমায় কখনো বলতে পারব না আমাদের ছেলেকে হ’ত্যা করা হয়েছে। তুমি সইতে পারবে না। কে জানে হয়তো মানসিক সমস্যা দেখা দেবে। ফল হারিয়েছি, গাছ হারানোর সাধ্য নেই আমার।

আজ আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। কিছু তারা দেখা যাচ্ছে। নববী ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলো। একটা জানালা খুলে পর্দা টেনে দিলো। হাবিব বলল, “ঠান্ডা আসবে। জানালা বন্ধ করে দাও।”

নাইমার ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। সে বিছানায় উঠে বসল। বাইরেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। রোদ চড়া হয়েছে। নববী এক কাপ চা নিয়ে তার ঘরে ঢুকল। বলল, “চা পান করে নাও। কিছুটা ভালো লাগবে।”

নাইমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, “তোমায় খুশি খুশি দেখাচ্ছে। আল্লাহ এই খুশি অটুট রাখুন।”

“আমিন। তোমার কি অবস্থা? কেমন আছো?”

“ঠিক আছি। আমি খুব দ্রুতই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারি। খু’,নিদের জন্য মায়া মহব্বত বাঁচিয়ে রাখতে হয় না। তবে রোহানের জন্য খুব খারাপ লাগে।”

“একবার গিয়ে দেখে আসলে হয় না?”

“তা অবশ্য যাওয়া যায়। ওই মেহরিমার সাথেও একটু দেখা করা প্রয়োজন। তাকে আনিসের মা বাবার কাছে নিয়ে যেতে হবে। অন্তত একটা খোঁজ দেওয়া জরুরি।”

“কোন বিপদ হবে না তো?”

“একা কিছুই করব না। ভাইয়াকে বলে নেব। দরকার পড়লে পুলিশও আমাদের সাথে থাকল।”

“এটা বেশ ভালো হবে। চা শেষ করো। আমি পরে এসে কাপ নিয়ে যাব। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ নাইমা?”

নাইমা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি ব্যাপার?”

“তুমি বড়লোকদের মতো বাসি বিছানায় বাসি মুখে চা পান করছ। একদম খবিশ!”

নাইমা একটু ভাব নিয়ে বলল, “ওহ ভাবী! তুমি খবিশ কাকে বললে? জানো তুমি? আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি, হাত-মুখ ধুয়ে ফজরের নামাজ পড়েছি। তারপর বিছানায় শুয়ে একটু মোবাইল ঘাটাঘাটি করছিলাম।”

“ওহ ননদী! হাত-মুখ ধুয়ে কেউ ফজরের নামাজ পড়ে না। নামাজ পড়তে হলে ওজু করতে হয়।”

বলেই তারা দু’জনে শব্দ করে হেসে উঠল। শরিফা বেগম রান্নাঘর থেকে হাসির শব্দ শুনলেন। বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে কটমট করে বললেন, “মেয়েগুলোর আর কখনও বুদ্ধি হবে না। এই অবস্থায় কে হাসে?” পরক্ষণেই সে তার কথা ফিরিয়ে নিলেন। ভাবলেন – কষ্টের মধ্যে একটু হাসাহাসি করলে মন হালকা হবে। তাছাড়া নাইমার ওপর দিয়ে যা গেল। মন ম’রা হয়ে থাকলেই বরং সমস্যা হবে।

হাবিব অফিসের কাজ সেরে বাসস্ট্যান্ডের দিকে গেল। আগেরদিন ছেলেটার থেকে গোটা ঠিকানা জেনে নিয়েছে। কোন সমস্যা হবে না। ময়লা ছেঁড়া বিছানায় জীর্ণ শীর্ণ এক মহিলা বসে আছে। সে হাবিবের গলা শুনে গায়ের কাপড় টেনে দিলো। চেয়ার টেনে দিতে দিতে বলল, “কে? কে এসেছে?”

হাবিব বলল, “আপনি আমাকে চিনবেন না। গতকাল আপনার ছেলের রিকশায় উঠেছিলাম। ওর থেকে সবটা শুনলাম। আপনার ছেলে খুব আত্মসম্মানী। ভাড়ার টাকা বেশি নেয়নি।”

মহিলা ঝলমলে গলায় বলল, “ছেলেটা ওর বাপের মতো হয়েছে। মানুষের কাছে হাত পাতে না।”

“আত্মসম্মান থাকা খুব ভালো কথা মা। আমি এসেছিলাম একটা প্রস্তাব নিয়ে।”

“কি প্রস্তাব বাবা? আগেই বলে রাখি- আমার দুই মানিককে দূরে পাঠাতে পারব না।”

“না মা, কাউকে কোথাও পাঠাতে হবে না। আপনাদের মাসিক যত টাকা খরচ হয় তা আমি দেব। পরে ধীরেসুস্থে একটা দোকান তুলে দেব। ছেলে হিসাবে নিতে পারেন। তা না হলে না হয় ধার হিসেবেই নিলেন। আপনার ছেলে দুটোকে স্কুলে ভর্তি করে দিবেন।”

মহিলা অমত করল না। তবে বলল- ছেলেদের সাথে কথা বলে জানাবে। হাবিব খাটের ওপর কিছু টাকা রাখল। বলল, “আগামীকাল আবার আসব। যদি এই টাকাগুলো গ্রহণ করেন, তাহলে মনে করব আপনি আমার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। তার ফিরিয়ে দিলে কি বলল!”

মহিলা তাকে এক গ্লাস পানি এনে দিলো। পরিষ্কার স্টিলের গ্লাসে বরফ শীতল পানি। হৃদয় জুড়িয়ে যায়।

চলবে