বসরাই গোলাপের ঝাড় পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
491

#বসরাই_গোলাপের_ঝাড়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

(শেষ পর্ব)
মানিক মিয়া রোহানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। কনক বলল, “আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রাখবেন আব্বা। ওর তো আর কেউই রইল না।”

মানিক মিয়া ভরাট গলায় বললেন, “সন্তানের ভবিষ্যতের কথা আগে ভাবতে পারতে। অসৎ রোজগার এবং অপরিমিত লোভ নিয়ে ছেলে-মেয়ে মানুষ করা যায় না।”

কনক মাথা নিচু করে ফেলল। মানিক মিয়া বললেন, “রোহান আমার নাতি। কখনো ওর কোন অযত্ন করব না। চিন্তা করতে হবে না।”

কনক বেশ অনেক সময় নিয়ে ছেলেকে আদর করল। গালে মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দিয়ে বলল, “ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে বাবা, দাদা ভাইয়ের কথা মেনে চলবে, পড়ায় ফাঁকি দেবে না। বুঝেছ বাবা?”

রোহান মাথা দোলালো। কনক তার গালে চুমু খেয়ে বলল, “সাহসী ছেলে আমার। সবসময় মনে রাখবে মা তোমার পাশে আছে। তোমায় দেখছে।”

“তুমি আমার সাথে যাবে না মা? রাতে আমার ঘুম আসে না।”

“যাবে বাবা, মা নিশ্চয়ই তোমার যাবে।”

কনক ছেলের হাত ধরে কাঁদতে লাগল। ডিআইজি সাহেব একজন কনস্টেবলের কানে কানে বললেন, “এই ভালোবাসায় কি কোন ফাঁক থাকতে পারে? সন্তান আর মা’য়ের ভালোবাসা কি কখনও কলুষিত হয়?”

কনস্টেবল বলল, “হয় স্যার। ফেসবুকে দেখলাম একটা বাচ্চাকে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেছে৷ এটাও কোন না কোন মা’য়ের কাজ!”

“এমনও হতে পারে কেউ মা’য়ের কোল থেকে কেঁড়ে এনে ফেলে রেখে রেখে গেছে। সবটা না জেনে কখনো কাউকে দোষারোপ করবেন না। অভিযোগ মিথ্যে হলে আপনি নিজেই দোষী হয়ে যাবেন।”

কনস্টেবল মাথা নিচু করে ফেলল। মনে মনে ডিআইজি সাহেব দু’টো গালাগাল দিয়ে বলল, “শালা সুশীল! সারা দেশের মানুষ এক কথা বলছে। উনি আমায় জ্ঞান শেখাচ্ছে। কোন মেয়ে আকাম-কুকাম করে বাচ্চা ফেলে রেখে গেছে ঠিক নেই। আমি বললেই দোষ।”

ডিআইজি সাহেব কৌতুহলী চোখে তাকালেন। বললেন, “কিছু বলছেন আপনি?”

“না স্যার। হে হে। কিছু বলছি না। ভাবছি আপনি অনেক মহান। আসলেই ঠিক স্যার। না জেনে কাউকে দোষারোপ করা উচিত না। যুগ-জামানার কথা ভেবে বললাম আর কি!”

ডিআইজি সাহেব কথার জবাব দিলেন না। কনকের দিকে ইশারা করে বললেন, “যথেষ্ট হয়েছে। সময় শেষ।”

কনক শেষবারের মতো ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। কানের দুল খুলে রোহানের হাতে দিয়ে বলল, “রাতে ঘুমানোর সময় এটা বুকের কাছে রেখে দেবে, মনে হবে মা তোমার সাথে আছে বাবা। তুমি যেদিন বিয়ে করবে সেদিন এটা তোমার বউকে দেবে। বলবে-এটা আমার মায়ের দেওয়া উপহার। বলবে তো বাবা?”
রোহান কাঁদছে না। তার চোখ-মুখ শুকনো। সরল চোখে তাকিয়ে আছে। সে অল্প একটু মাথা দোলালো। অস্পষ্ট গলায় বলল, “বলব।”

মানিক মিয়া একটু সরে গিয়ে ডিআইজি সাহেবকে বলল, “আমাদের কি উকিল ঠিক করতে হবে?”

“ইচ্ছে আপনাদের। সামনের মাসে কোর্টের তারিখ পড়বে। আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে।”

মানিক মিয়া ক্রমাগত মাথা দোলাতে লাগলেন। থানা থেকে বের হবার পরপরই তাদের হাবিবের সাথে দেখা। হাবিব এগিয়ে এসে বলল, “কোথায় গিয়েছিলেন? শরীর ভালো আছে আপনার?”

মানিক মিয়া বললেন, “বউমা দাদু ভাইকে দেখতে চেয়েছিল। থানা থেকে কল দিয়ে জানালো। তাই নিয়ে এসেছি।”

“ওহ আচ্ছা। দেখা হয়েছে?”

“হ্যাঁ হয়েছে।”

হাবিব রাস্তায় হাঁটু ভাজ করে বসল। রোহানের কাঁধে হাত থেকে বলল, “মামা কেমন আছে?”

রোহান মাথা দোলালো। হাবিব বলল, “মামা কি একটা আইসক্রিম খেতে চায়?” রোহান আবারও মাথা দোলালো। হাবিব তাকে নিয়ে একটা দোকানের ভেতর ঢুকল। কিছু চিপস চকলেট আর একটা আইসক্রিম কিনে দিয়ে বলল, “মামা, মনে আছে পানিতে পড়ে গিয়েছিলে?”

“মনে আছে। বাবার সাথে মাছ ধরছিলাম।”

“কেউ তোমায় ফেলে দিয়েছিল?”

“না মামা। কেউ ফেলে দেয়নি। বাবা পাশে বসে ছিপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মা-ও অনেক দূরে বসে ছিল। হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। জানো মামা, গলাটা একদম সোহেলের মতো। ফিরে দেখতে গিয়ে পানিতে পড়ে গেলাম।” বলেই সে হাবিবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। হাবিব তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “কাঁদে না মামা। কাঁদে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মানিক মিয়া খানিকক্ষণ বাদে নাতিকে নিয়ে ফিরে গেলেন। তার কিছু কাজ আছে। যাবার আগে হাবিবকে বেড়াতে যেতে বললেন। হাবিব বলল, “সময় করে ঘুরে আসব।”

ডিআইজি সাহেব চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। আগুন গরম চা থেকে ধোঁয়া উঠছে। হাবিব তার সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।”

“এ কথা ফোনকলে বলে ফেলেছেন। কি কথা বলতে চান সেগুলো বলুন।”

“শরাফত সাহেবের কি হয়েছে? সে কি কোন শা’স্তি পাবে না?”

“নিশ্চয়ই শা’স্তি পাবে। আমি নিজে ওপর মহলে অভিযোগ জানিয়েছি। ইতিমধ্যে চাকরি হারানোর পত্র পেয়ে গেছে। এতদিন চাকরি করার পরও এখনো ঢাকায় একটা বাড়ি তুলতে পারিনি। অন্যকে কিভাবে এগিয়ে যেতে দিই বলুন তো?”

শেষ কথাগুলো রসাত্মক। তবে হাবিব হাসল না। সরু গলায় বলল, “সেদিন রাতে আমাকে শুধু ওই ডাইরি পড়তে ডেকেছিলেন? এ কথা কেমন যেন বিশ্বাস হতে চায় না।”

“এটাই একমাত্র কারণ ছিল। আপনাকে আগেও বলেছি মহিলা পুলিশ যিনি ছিলেন, উনি আমাকে সবকিছু বলেছেন। হাবিব সাহেব, মানুষ যতই ভালো আর নীতিবান হোক না কেন সন্তানের বেলায় অন্যরকম দূর্বল। আপনাকে অবিশ্বাস করিনি ঠিকই তবে রোহানকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম। সত্য বলতে কনককে দেওয়া হুমকি সত্য মনে করেছি। মানিক মিয়াকে বলা ছিল রোহানকে তিনি আপনার সাথে একা ছাড়তেন না।”

হাবিব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ডিআইজি সাহেব বললেন, “পুলিশের চাকরি করি, অনেক কিছু ভেবে রাখতে হয়। যাইহোক চা পান করতে চান?”

“না। আমার যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। এখন আসতে চাই।”

“নিশ্চয়ই, আবার আসবেন। আপনি বেশ সুন্দর করে কথা বলেন। আপনার সাথে কথা বলে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা যায়।”

হাবিব বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে পড়ল। ওই ছেলেটার বাড়িতে যেতে হবে। টাকা নিবে কি-না জানা প্রয়োজন। আজ সে কিছু ফল কিনল। বিশেষ ফল নয় – পেয়ারা আর কলা। সেগুলো নিয়ে তাদেট বাড়িতে গেল। মহিলাকে দেখে মনে হলো আগে থেকে তৈরি ছিল। হাবিব যেতেই চেয়ার পেতে দিলো। স্নিগ্ধ গলায় বলল, “বড় ছেলেটাকে বুঝিয়ে বলেছি। রাজি হয়েছে। সামান্য বাজার-সদাই করেছে। রান্নাবান্না করেছি। একটু মুখে দিলে খুব খুশি হব।”

হাবিব হাত ধুয়ে খেতে বসল। বাচ্চা ছেলে দু’টো জিনিসপত্র এগিয়ে এনে দিচ্ছে। আয়োজনের কমতি নেই। সরু চালের সাদা ভাত- কিসমিস বাদাম দিয়ে রান্না করেছে, চিংড়ি শুটকি ভর্তা, ফার্মের মুরগী, বেশ কয়েক পদের সবজি, ডাল। দু পদের পিঠাও আছে। সে বেশ আয়েশ খাবার খেলো। তৃপ্ত গলায় বলল, “আপনার রান্নার হাত খুব ভালো। আমি একটা পিঠা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি?”

মহিলা খুশি মনে বেশ কয়েকটা পিঠা পলিথিনে ভরে দিলো। বলল, “ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। জানুয়ারি মাস চলে। এখন ভর্তি করা যাবে।”

“ঠিক আছে, ভর্তি করে দেন। মাসের শুরুতে একদিন আপনার হাতের রান্না খেতে আসব। আমার ঘরণীকেও নিয়ে আসবে। তার জানা উচিত সে ছাড়াও আরো অনেক বিখ্যাত রাঁধুনি আছে।”

মহিলা হাসল। ছেলে দু’টোও মা’কে ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসছে। আর কি এমন সুখের সময় এই পৃথিবীতে আছে?

দরজা খুললেন মহিউদ্দিন সাহেব। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “অফিস কেমন কাটলো? শরীর সুস্থ?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আব্বা। আপনার শরীর কেমন?”

“এই আছে। হাতে কি?”

“পিঠা এনেছি আব্বা। অনেক কথা। পরে গুছিয়ে বলল। খাবেন?”

মহিউদ্দিন সাহেব হাবিবের হাত থেকে পিঠার প্যাকেট নিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। হাবিবের মতো হলো এই মুহুর্তটাও বেশ সুন্দর।

দুই মাস পরের কথা,

আজ কনকের কে’সের তারিখ। মহিউদ্দিন সাহেব, নববী, নাইমা, প্রায় সকলেই কোর্টে হাজির হয়েছে। শুধু হাবিব আসেনি। তার অফিসে জরুরি কাজ পড়ে গেছে। কনকের চেহারা ভেঙে গেছে। বোধহয় ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে। রোহান মা’কে দেখে হাত নাড়াতে লাগল। কনক তার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। মনে মনে বলল, ‘এর কি আমার ছেলেটা না নিয়ে আসলে পারত না? ওকে ওর মায়ের শা’স্তি দেখাতে চায়!’
ভেবেই চোখে পানি মুছল। আজ-কাল হুটহাট চোখে পানি চলে আসে। বিচারপতি বয়স্ক ভদ্রলোক। বেঁটে-খাটো মানুষ। মাথার বেশিরভাগ অংশে টাক পড়ে গেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তিনি বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে সব কাগজপত্র দেখে নিলেন। কঠিন মুখে বললেন, “কাগজপত্র যা দেখার দেখে নিয়েছি। এক্ষুণি রায় দিলেও কোন সমস্যা হবে না। তবে সবাইকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত। আসামি পক্ষের উকিল বা কনক দেবীর কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আসামি পক্ষের উকিল বেশ ভাবসাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কনক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আমার সব দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি। মৃ’ত্যুর অপেক্ষায় ধুঁকে ধুঁকে ম’রার থেকে একবারে ম’রে যাওয়া ভালো। আদালতের কাছে আবেদন করব যেন আমাকে ফাঁ’সি দেওয়া হয়।”

বিচারপতি একদম চুপ করে গেলেন। শান্ত চোখে কনকের দিকে তাকিয়ে রইল। শ্যামলা গড়নের মায়াময়ী চেহারার এক মেয়ে। সাদাসিধে, বোকা-সোকা ধরনের। যে এক ছেলেকে ভালোবেসে, পরিবারকে রাজি করিয়ে বিয়ে করেছে। ভেবেছিল সুখী হবে। হতে পারেনি! ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস! এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষই ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। যাদের সাথে সবকিছু ভালো হয়। কখনও কাঁদতে হয় না। মনের ভেতর চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয় না। তাদের হাসি মিথ্যে নয়। ক্ষ’তবি’ক্ষ’ত হৃদয় লুকিয়ে প্রাণবন্ত হাসি হাসতে হয় না। তারা সত্যিকার অর্থে সুখী। এই মেয়েটাও সুখী হতে চেয়েছিল। পারেনি। নিদারুণ নি’ষ্ঠু’র কষ্ট তাকে পাথর করে দিয়েছি। একসময়ে মানুষের আ’ঘা’তে ছি’ন্নভি’ন্ন হয়ে যাওয়া হৃদয় অন্য মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু কি লাভ? কেউ আমায় কষ্ট দিলে বিনিময়ে যদি তাকে কষ্টই ফেরত দিই তবে তার সাথে আমার কিসের তফাত থাকতে পারে? কি দিয়ে আলাদা করা যাবে আমাদের? কোন তফাতই যে আর রইল না!

বিচারপতি রায় পড়তে বেশ সময় নিলেন। পক্ষের উকিল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়ের তারিখ পিছিয়ে গেল। তাতে কি! বিচারপতি যে ফাঁ’সির রায় লিখেছেন। এ সিদ্ধান্ত বদলাবে না।

কোর্ট থেকে ফেরার পথে নববী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। শরিফা বেগম বললেন, “কেমন লাগছে তোমার? সকালে খেয়ে আসতে বলেছিলাম। আমার কথা শুনলে না।”

নববী বলল, “খেতে ইচ্ছে করে না মা। কেমন বমি আসে।”

মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “এভাবে বাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। পাশে একটা ক্লিনিক আছে। সেখানেই চলো।”

নাইমার নববীর হাত ধরল। ডাক্তার সাহেবা বেশ সময় নিয়ে নববীর পরীক্ষার করলেন। মুচকি হেসে বললেন, “আল্ট্রাসোনোগ্রাম করিয়ে দেখতে হবে। সুখবর মনে হচ্ছে।”

নববীসহ বাকিদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শরিফা বেগম বললেন, “সত্যি বলছেন?”

ডাক্তার সাহেবা বললেন, “ব্লা’ড প্রেশার, নাড়ির গতি, বাকিসব লক্ষণ দেখে এটাই মনে হচ্ছে। নিশ্চিত হবার জন্য আল্ট্রাসোনোগ্রাম করতে হবে। আপনারা চাইলে এখানেই করাতে পারবেন। ব্যবস্থা আছে। হাতে-হাতে রিপোর্ট দিয়ে দেবে।”

নববীকে নিয়ে আল্ট্রাসোনোগ্রাম রুমে ঢুকল। ধারনা সত্যি। নববী অন্তঃসত্ত্বা। সে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালো। নাইমা বলল, “যে-ই আসুক। নাম আমি ঠিক করব।” বলেই হাসল। শরিফা বেগমের সে হাসি সহ্য হলো না। আজ তার একটা বোন আদালতে মৃ’ত্যুফরমানের অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে এই মেয়ে হাসছে। তবে খবর শুনে তিনি নিজেও বেশ খুশি হলেন। আয়া মহিলাকে পাঁচশ টাকা বখশিশও দিলেন। মিষ্টি খাবার জন্য। অবশ্য নাইমার কথা ভিন্ন। যে তাকে মা’র’তে চায়, তার জন্য শোক পালন করা নেহাৎ ভণ্ডামি ছাড়া অন্যকিছু নয়।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই নববী হাবিবের নম্বরে কল দিয়ে যাচ্ছে। হাবিব কল রিসিভ করছে না। ম্যাসেজ দেখছে না। নববী এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ফেলল খাটের ওপরই। নিজের হাত কামড়াতে লাগল। মনে মনে ভাবল- থাকুক কাজ নিয়ে। আমার খোঁজ নিচ্ছে না। কল রিসিভ করছে না। আমিও খোঁজ নেব না। কেন নেব?”

সে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। রাতে খেতে গেল না। নাইমা অনেক জোরাজুরি করেও তাকে খাওয়াতে পারল না। শরিফা বেগম বললেন, “খেতে না চাইলে জোর করিস না। কিছু শুকনো খাবার ঘরে দিয়ে আয়। রাতে খিদে পেলে নিজেই খাবে।”

হাবিব বাড়ি ঢুকলো বারোটার পর। চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখল নাইমা বসে আছে। হাবিব বলল, “কি হয়েছে? এখানে বসে আছিস কেন?”

নাইমা তার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “বসে আছি কয়েকটা কথা জানাতে। আর”

“কি কথা তাড়াতাড়ি বলবি।”

“এক. আজ আপার রায় দেয়নি। তারিখ পিছিয়ে গেছে।
দুই. ভাবী তোমার ওপর ভীষণ রেগে গেছে। রাতে খাবারও খায়নি। আমি জোর করেছিলাম রাজি হয়নি।
তিন. একটা সুখবর আছে। আমি ফুফু হচ্ছি। কাজেই তোমার উচিত আমাকে কিছু বখশিশ দেওয়া।
চার. আমি যে কথাটা বলেছি তা ভাবীকে বলতে পারবে না। সে নিজেই তোমায় সারপ্রাইজ দেবার জন্য বসে আছে।
এবার আমার বকশিক দাও। চার পাঁচ হাজার দেবে। কম হবে না।”

হাবিব নাইমার দিকে কড়া চোখে তাকাল। বলল, “ফাজিল হয়েছিস অনেক। যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। টাকা পয়সা নেই। পরে দেব।”

নাইমা দাঁত কটমট করতে করতে ঘরে চলে গেল। হাবিব দরজা সরিয়ে বসরাই গোলাপের ঝাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। দু’টো আঁধফোটা কলি ছিঁড়ে ঘরে চলে এলো। শুনেছে রাতের বেলা ফুল ছিঁড়তে হয় না। তবে আজ সে কথা মানল না।

নববী বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। ঘরের বাতি নেভানো। হাবিব গিয়ে বাতি জ্বালালো। নববীর সামনে বসে বলল, “মিটিংয়ের সময় মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছি। পরে আর মনে করতে পারিনি। প্রচুর কাজ ছিল।”

নববী জবাব দিলো না। হাবিব তার দিকে ফুলের কলি দু’টো এগিয়ে দিলো। নববী মুখ ফিরিয়ে নিলো। সে একটু হেসে বলল, “ফুল নাও প্রিয়তমা, তোমার বিরহে একগুণ পু’ড়’লে তুমি আমার বিরহে হাজার গুণ পু’ড়’বে।”

“কি হয়েছে? কেন রাগ করে আছো? কাজ থাকতে পারে না?”

“আরে কথা বলো। কথা বলবে নাকি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসব?”

নববী অল্প হেসে ফুল দু’টো হাতে নিলো। লাজুক হেসে কিছু বলল। হাবিব চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো। নববীর মাথায় হাত রেখে বলল, “আল্লাহ তোমার ভালো করুক। সুস্থ রাখুক।”

চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জানালা গলে জোছনা ঘরে ঢুকছে। মেঝেতে সরল ধরনের নকশা তৈরি হয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে সবটা। এ সৌন্দর্য কি এ ঘরের দম্পতির খুশির থেকেও সুন্দর। হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। জীবন অনিশ্চিত, চলার পথে থমকে যায়। অথবা বেঁচে থাকে কারোর হৃদয়ে, কারোর ভালোবাসায়!

সমাপ্ত