ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-০২

0
990

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দুই

নিজের বর মধ্যপান অবস্থায় অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ঢলাঢলি করে হাসতে হাসতে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকছে। বিচ্ছেদের বছর দুই পর জীবন এমন এক দৃশ্য দেখার জন্য দাঁড় করাবে ভাবতে পারছে না, মেহরিশ। কোলে থাকা ছোট্ট আনায়াকে বুকে চেপে ধরে মেহরিশ সামনে থাকা মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মেয়েটার হাত আহিলের কোমরে আর আহিলের হাত মেয়েটার কোমরে। মেয়েটা যে ফরেনার তা বুঝতে বাকি রইল না মেহরিশের। আচমকা মেহরিশ সামনে পড়ায় আহিলের চোখে, মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলেও, মেয়েটার চোখে মুখে কোনো রেসপন্স দেখা গেলো না। বছর দুই পর মেহরিশকে সামনে দেখে আহিলের নেশা যেন এক মুহূর্তেই কেটে গেল। মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বার কয়েক চোখ ঝাপটালো। সত্যি দেখছে? নাকি বেশি নেশা হয়ে গেছে? কই আগেও তো আহিল কতবার ড্রিংকস করেছে তখন তো নেশায় বুদ হয়ে মেহরিশকে দেখেনি। তাহলে আজ কেন দেখছেন? মেহরিশ শূন্য চোখে আহিলের দিকে তাকিয়ে। মুখে অন্যরকম এক হাসি। যেন মনে হচ্ছে এই সন্ধিক্ষণের অপেক্ষায় ছিল এতগুলো দিন। আহিল হঠাৎ আচমকা এক প্রশ্ন ছুড়ে মা’রল মেহরিশের দিকে,
“হু আর ইউ?”
মেহরিশ হাসল। খুব শান্ত বাক্যে শুধাল,
“ইউর ওয়াইফ, মিস্টার আহিল মির্জা। চিনতে পারছেন না বুঝি?”
আহিল তব্ধা খেয়ে গেল। দুই পা সরে দাঁড়াল। মাথা দুই বার ঝাঁকিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। মেহরিশের পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ বুলিয়ে নিতেই চোখ আটকাল কোলে থাকা বাচ্চা মেয়েটার দিকে। কী সুন্দর মেয়েটা! চোখ দুটো একদম আহিলের মতো। ব্রাউন রঙের। মেয়েটার হাসিটার মধ্যে আহিল নিজেকে খুঁজে পেল। কী আশ্চর্য! তার মানে এটা আহিল আর মেহরিশের মেয়ে? ভাবতেই আহিলের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। সব কিছু যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আহিল বিস্ময় ভরা বাক্যে পুনরায় বলে উঠল,
“মেহরিশ! তুমি মেহরিশ! আমার মেহরিশ?”
মেহরিশ শব্দ করে হেসে ফেলল। এবার আহিলের পাশে থাকা মেয়েটা মুখ খুলল। কিছু না বুঝার মতো করে প্রশ্ন করল,
“এই মেয়েটা কে, আহিল? কেন সে নিজেকে তোমার বউ বলে পরিচয় দিচ্ছে? বুঝতে পারছিনা কিছু। দয়া করে, পরিষ্কার করে বলো।” (ইংরেজি বাক্যে)
মেয়েটার কথা শুনে মেহরিশ এবার নিশ্চিত হলো মেয়েটা ফরেনার। আহিল পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। সবকিছু গোলমাল করে ফেলছে। মেহরিশ এখানে কী করে? কী বলে এখন ম্যানেজ করবে সবটা। মেহরিশ আহিলকে চুপ করে থাকতে দেখে শান্ত বাক্যে প্রশ্ন করল,
“কী ভাবছেন? আমি এখানে কী করে? আপনি বোধহয় আমাকে এখানে আশা করেননি তাইনা, মিস্টার আহিল?”
আহিল চোখে তুলে তাকাল। মেহরিশের চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলল। মেয়েটার মুখে আগের মতো শান্ত ভাবটা নেই। এখন আর কথার মধ্যে নমনীয়তা খুঁজে পাওয়া যায় না। কাঠকাঠ স্বরে কথা বলছে। আহিলের পাশে থাকা মেয়েটা পুনরায় প্রশ্ন করল,
“আহিল, তুমি কি বিবাহিত? উনি তোমার বউ?”
আহিল তড়িঘড়ি করে মত পাল্টে ফেলল। আমতা আমতা করে বলে উঠল,
“নো, এঞ্জেলা। আমি অবিবাহিত।”(ইংরেজি বাক্যে)
এঞ্জেলাকে প্রশ্নের উত্তর দিয়েই আহিল মেহরিশের উদ্দেশ্যে কঠিন বাক্যে বলে উঠল,
“এই যে, কে আপনি? কী বলছেন আবোলতাবোল? কে স্বামী? কার স্বামী? আমি তো আপনাকে চিনিই না। আর আপনি আমাকে স্বামী বলে দাবী করছেন? আর ইউ ম্যাড? রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছেন কেন? প্লিজ, সাইড।”
বলেই আহিল পুনরায় এঞ্জেলার কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল। হেচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে মেহরিশের দিকে তাকালো বাঁকা চোখে। মুখে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। যেন এসব মেহরিশকে দেখানোই এখন ওর এক মাত্র উদ্দেশ্য। মেহরিশ এক পলকে আহিলের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি। আহিল যখন পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকার জন্য পা বাড়াল, তখনি সায়র এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সায়র আহিলের সামনে হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মুখে হাসি টেনে সৌজন্যতার স্বরে বলে উঠল,
“স্যরি, স্যরি। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড।”
বলেই আহিলকে পাশ কাটিয়ে মেহরিশকে নাম ধরে ডেকে উঠল। সায়র মেহরিশকে ডাকতেই আহিল থমকে দাঁড়াল। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল সায়র আর মেহরিশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মেহরিশ আড় চোখে আহিলের দিকে একবার তাকিয়ে আনায়াকে সায়রের কোলে দিতে, সায়রের বাহু প্যাঁচিয়ে ধরল। তা দেখা মাত্র আহিল এঞ্জেলাকে ছেড়ে দিল। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল মেহরিশের দিকে। আচমকা এসে এক টানে সায়রকে সরিয়ে ফেলল। উচ্চবাক্যে প্রশ্ন করল,
“কে এই ছেলে? কেন তুমি ওর হাত ধরলে? কে হয় তোমার?”
সায়র অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কী হলো বুঝতে পারছে না। অবুঝের মতো প্রশ্ন করল,
“কে আপনি? এভাবে কথা বলছেন কেন?”
আহিল চোখ গরম করে তাকাল সায়রের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“স্টপ। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আপনি কথা না বললে খুশি হবো।”
‘স্বামী-স্ত্রী’ শব্দ দুটো যেন সায়রের কানে বোমা ফাটার মতো বিস্ফোরণের শব্দ করে বেজে উঠল। তার মানে এই ছেলেটা আহিল? এর মধ্যেই মেহরিশ শান্ত বাক্যে আহিলের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“সায়র কথা বলবে। একশো বার বলবে। কারণ, সায়র আমার বর্তমান স্বামী। আর একজন স্বামী হিসেবে সায়রের সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার বিষয় কথা বলার।”
এক ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে সায়র দ্বিতীয় ধাক্কা খেলো। মাথার দশ হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। আহিল যেন আকাশ থেকে পড়ল। অবাক পানে প্রশ্ন করল,
“স্বামী মানে? কে তোমার স্বামী?”
মেহরিশ আহিলের দিকে চোখ গরম করে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
“আপনি কে, মিস্টার? কে আপনি? আমি তো আপনাকে চিনি না। তাহলে আপনাকে কেন প্রশ্নের জবাব দিব? লন্ডনের মতো একটা শহরে অচেনা একটা মেয়ের সাথে কীভাবে আচরণ করতে ভুলে গেছেন নিশ্চয়ই? মনে করিয়ে দিব? ভদ্রতা কী বাসায় রেখে এসেছেন নাকি? নাকি পরিবার থেকে ভদ্রতার শিক্ষাটুকু পাননি?”
আহিল মেহরিশের দিকে তর্জনী আঙ্গুল উঠিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“মুখ সামলে কথা বলো মেহরিশ। আ…।”
মেহরিশ এবার আহিলের থেকেও দ্বিতীয় চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“আঙ্গুল নিচে। নয়তো আমার হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ আপনার গালে বসতে বেশি সময় লাগবে না।”
আহিল কটমট দৃষ্টিতে তাকাল মেহরিশের দিকে। নিজেকে কিছুটা সামলে শান্ত বাক্যে বলল,
“আমি তোমার স্বামী, মেহরিশ। আমাকে এভাবে রাস্তার মাঝে অপমান করার রাইট তোমার নেই।”
মেহরিশ হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“স্বামী! কে আমার, স্বামী? আপনি? স্বামী, মাই ফুট। আপনার মতো রাস্তার কুকুর আমার স্বামী হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। রাস্তার কুকুরের সাথে তুলনা দিলেও কুকুর গুলোকে ছোট করা হবে। একটা রাস্তার কুকুরকেও যদি কয়েকদিন আদর, যত্ন করা হয় তাহলে সে তার মনিবকে ছেড়ে যায় না। আর আপনাকে তো আমি পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম। ঘর ছেড়েছিলাম। আদর, যত্নের কোনো কমতি রাখিনি। তবুও নিজের সন্তানকে অস্বীকার করে মুখের উপর ডিভোর্স লেটার ফেলে, প্রেমিকার হাত ধরে চলে এসেছিলেন। তাহলে কোন মুখে এখন নিজেকে আমার স্বামী হিসেবে দাবী করছেন?”
মেহরিশের চোখের কোনে অশ্রু কণা টলমল করছে। পুরনো সব ক্ষত জেগে উঠছে। সায়র অসহায় দৃষ্টিতে মেহরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। আহিল নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এঞ্জেলাও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ওরা বাংলায় কথা বলছে তাই বুঝছেনা। শুধু বুঝেছে ওদের মধ্যে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। মেহরিশ নিজেকে সামলে সায়রের উদেশ্যে বলল,
“সায়র, চলুন এখান থেকে। আমার আনায়ার উপর কোনো কুকুরের নজর পড়ুক আমি চাই না।”
বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আহিল মেহরিশের হাত ধরে ফেলল। অধিকার খাটিয়ে বলে উঠল,
“তুমি এই ছেলেটার সাথে যাবে না৷ এই ছেলেটা তোমার স্বামী হতে পারে না।”
মেহরিশ ঝাড়ি মে’রে আহিলের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। কিছু কড়া বাক্য শুনানোর জন্য মুখ খুলতেই, সায়র থামিয়ে দিল। এবার আহিলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,
“কেন হতে পারি না? আপনি তো মেহরিশকে বছর দুই আগেই ডিভোর্স দিয়েছেন। তাহলে আমি কেন মেহরিশের স্বামী হতে পারিনা?”
আহিল বাঁকা হাসল। হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“আপনি ভুল জানেন, মিস্টার সায়র। আমি তো মেহরিশকে ডিভোর্স দেইনি। তাহলে মেহরিশ কী করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে? আইন নত এখনো আমি মেহরিশের স্বামী। মেহরিশের উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।”
সায়রের বুকটা ধক করে উঠল। চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। হৃদযন্ত্রটা ভয়ে লাফানো শুরু করল। তবে পাওয়ার আগেই মেহরিশকে হারিয়ে ফেলবে? পথ আলাদা হয়ে যাবে? নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে কি নিজের করে পাওয়ার স্বপ্নটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে?

#চলবে