ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-০৬

0
400

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ছয়

“একটা ডিভোর্সি মেয়ের জন্য তোর এত কিসের দরদ, সায়র? মেহরিশ একটা ঘর ভাঙানি মেয়ে। তাকে নিয়ে তোর এত ভাবা লাগবে না। ওই মেয়ের কাছের থেকে যথাসম্ভব ডিস্টেন্স বজায় রাখবি।”
সায়র সবে মাত্র বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই শাহিনা বেগম কথাগুলো বলে উঠলেন। কথাগুলো সায়রের কানে যেতেই সায়র অগ্নীদৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। দাঁত কটমট করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
“ওই মেয়ে মানে? কি বুঝাতে চাইছো, মামনি?”
শাহিনা বেগম কফির মগটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে উঠলেন,
“মেহরিশের সাথে তোর মেলামেশা আমার পছন্দ না। আমি চাইনা ওইরকম ঘর ভাঙানি মেয়ের সাথে তোর কোনো সম্পর্ক থাকুক। যে মেয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীর ঘর করতে পারেনা, সে কেমন চরি…।”
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই সায়র পুরো রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল৷ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“মামনি! কী বলছো তুমি? আর একবার মেহরিশকে নিয়ে কোনো বাজে কমেন্ট করবে না, প্লিজ।”
সায়রের এমন রাগী স্বর শুনে শাহিনা বেগম বেশ অবাক হলেন। যে ছেলে আজ অব্দি কখনো মায়ের সাথে উচ্চবাক্যে কথা বলেনি। সে ছেলে আজ এভাবে কথা বলছে? শাহিনা বেগমের চোখের কোনে জল জমতে শুরু করল। মনে মনে মেহরিশকে নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। সায়রকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সায়র বলে উঠে,
“না তো মেহরিশ আমাকে ভালোবাসে, না আমার সঙ্গ জোর করে আদায় করে। মেহরিশকে আমি ভালোবাসি, মামনি। কাউকে সম্মান করতে না পারলে তাকে অসম্মান করার রাইট তোমার নেই। তুমি একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কত বড় ভুল করছো বুঝতে পারছো? তুমি কাকে ঘর ভাঙানি মেয়ে বলছো, যার স্বামী পরকিয়ায় আসক্ত হয়ে নিজের স্ত্রীকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় একা ফেলে চলে এসেছিল তাকে? যেই পুরুষ প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে ঘুরে সেই পুরুষকে ডিভোর্স দেওয়াটা তোমার চোখে অন্যায় হয়ে গেলো? বাহ! এতটা নিচ মানসিকতা তোমার মামনি? অথচ আমি আমার মাকে নিয়ে সবসময় গর্ব করে এসেছি।”
শাহিনা বেগম রাগে ফোসফাস করতে করতে বললেন,
“পুরুষ মানুষের ওমন একটু-আধটু দোষ থাকে, বাপু। তাই বলে নিজের সংসার ছেড়ে ছুড়ে চলে আসব? নিজের সন্তানের কথা ভাববো না? মেয়ে হলে একটু সেক্রিফাইস করতে হয়৷ মেহরিশের উচিত ছিল আহিলকে লাস্ট চান্স দেওয়া।”
শাহিনা বেগমের কথা শেষ হতেই সায়র হেসে ফেলল। হাস্যজ্বল বাক্যে বলল,
“একটা প্রশ্ন করি, মামনি?”
খানিক মুহূর্ত থেমে শাহিনা বেগমের কথার জবাবের আশায় না থেকে নিজেই বলা শুরু করল,
“বাবা যদি প্রতিদিন তোমার চোখের সামনে অন্য কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে ফুর্তি করতো, তখন তুমি কি করতে? অথবা, সানায়ার যখন বিয়ে হবে তখন ওর বর যদি চরিত্রহীন হয় তাহলে তুমি কি করবে?”
শাহিনা বেগম চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। উচ্চবাক্যে বললেন,
“তুই তোর বাবার সাথে ওইরকম একটা ছেলের তুলনা করছিস, সায়র? মাথার জ্ঞান বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে?”
সায়র আগের ন্যায় হেসে জবাব দিল,
“তুমি কথার জবাবে বুঝিয়ে দিলে ‘শিক্ষিত হলেই সুন্দর মানসিকতার হওয়া যায় না’। তার প্রমাণ তুমি, মামনি।”
শাহিনা বেগম পুনরায় গর্জে উঠার আগেই সায়র থামিয়ে দিল। বলল,
“তুমি এখন যাও, মামনি। আমার তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি একটু একা থাকতে চাই।”
বলেই সায়র শাহিনা বেগমকে এড়িয়ে বেলকনির দিকে পা বাড়াল। মাথায় চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়েছে। মায়ের এমন স্বার্থপর রুপ দেখবে ভাবতে পারছে না সায়র। কেন যেন মেহরিশের নামে এমন সব বাক্য শুনে বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আসছে। সায়র মনে মনে বলে উঠল,
“মামনি, আমি দুনিয়া উলোটপালোট করে হলেও মেহরিশকে চাই।”




রাত ১১টা বেজে ৫ মিনিট। মেহরিশ আনায়াকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও আনায়ার পাশে শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছিল। তখনি হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। ফোন স্কীনে সায়রের নাম দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। হুট করে মেহরিশের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি হানা দিল। চট করে ফোন কেটে সায়রকে ম্যাসেজ করল,
“ভাইয়া, আপুর খুব জ্বর। আপু ঘুমাচ্ছে। আমি মেহেনূর।”
সাথে সাথেই ম্যাসেজটা সিন হলো ঠিকই কিন্তু ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো না। প্রায় মিনিট ৫ কেটে যাওয়ার পরও কোনো রিপ্লাই আসলো না। কী আশ্চর্য! মেহরিশ অসুস্থ জানার পরেও সায়র কোনো রকম রিপ্লাই করলো না! ব্যাপারটা মেহরিশকে প্রচন্ড ভাবাচ্ছে। তাহলে কি সায়রের কিছু আসে যায়না মেহরিশকে নিয়ে? হুট করেই মনটা তিক্ততায় ভরে উঠলো। মিনিট দশেক ফোন স্কীনের দিকে তাকিয়ে থেকেও হতাশ হয়ে পড়ল৷ ফোনটা রেখে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিলো ভালো করে। অবাক করার বিষয় হলো মেহরিশের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন? মেহরিশ তো সায়রকে ভালোবাসে না। তাহলে কষ্ট হচ্ছে কেন? ভাবতে পারছে না মেহরিশ। কেন যেন ফুঁপিয়ে কান্না আসছে। সায়রের এই সামান্য অবহেলাটুকু মানতে পারছে না। মেহরিশ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সায়রের উপর বেশি দূর্বল হবে না৷ দূরত্ব বজায় রাখবে এখন থেকে। একবার বাজে ভাবে ঠকেছে, দ্বিতীয় বার ঠকলে যে সইতে পারবে না…



“এক্সকিউজ মি, গার্ল।”
সানায়া আজ ওর বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে এসেছিল৷ বাসা থেকে সায়র বার বার ফোন করছিল বিধায় সবার থেকে বিদায় নিয়ে সানায়া একাই বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এসেছে। পার্কিং লটে আসিতেই পেছন থেকে কেউ একজন উক্ত বাক্যে সানায়াকে ডেকে উঠল। সানায়া পেছন ঘুরে দেখল একটা ছেলে দাঁড়ানো। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। ফর্সা, লম্বা, দেহের গঠনও মারাত্নক সুন্দর। এক দেখায় যে কোনো মেয়ে প্রেমে পড়ে যাবে। সানায়াও এক দেখায় ছেলেটাকে বেশ ভাল লাগা শুরু করল। সানায়া মুখে হাসি টেনে নম্র ভাবে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে বলছেন?”
ছেলেটা হাসল। হাসিটাও কী সুন্দর! সানায়ার এই প্রথম কোনো ছেলের প্রতি তীব্র চাবে ভালো লাগা কাজ করছে। কী আশ্চর্য! প্রথম দেখায় কাউকে ভালো লাগেনাকি? আচ্ছা এটাকে কী ‘লাভ এইট ফাস্ট সাইড’ বলে? ছেলেটা এবার হেসেই জবাব দিল,
“আশে-পাশে কি কোনো পরি দেখতে পাচ্ছেন?”
সানায়া অবাক হলো। হেসে দিয়ে বলল,
“আপনি বাঙালি?”
“খাঁটি বাঙালি।”
সানায়া হেসে ফেলল। হাত বাড়িয়ে বলল,
“হাই, আমি সানায়া।”
ছেলেটা এবার হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। বলল,
“আপনার সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে, সানায়া।”
সানায়া সামান্য লজ্জা পেল। ছেলেটা কী ফ্লার্ট করছে? সানায়া লাজুক হেসে বলল,
“ফ্লার্টিং করছেন?”
“সুন্দরী মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করা যায় না, জানেন না?”
“তাহলে কি বলছেন, যারা সুন্দর না তাদের সাথে ফ্লার্টিং করা যায়?”
ছেলেটা হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“আপনি একটু বেশি ভেবে ফেলেছেন, সানায়া। আমরা কেউ অসুন্দর না। আর আপনি মনে করেন কাউকে সুন্দর বলে কমপ্লিমেন্ট দেওয়াকে ফ্লার্ট বলে?”
সানায় একটু নম্র স্বরে উত্তর দিল,
“তা নয়। এনি ওয়ে, আপনি কি আমাকে চিনেন?”
“না। তবে আপনার বান্ধবী সাহারার কাজিন আমি। আপনাকে নিয়ে এর আগেও ওর মুখে অনেক কথা শুনেছি। আজ চোখের সামনে দেখে কেন যেন মনে হলো একটু পরিচিত হওয়া দরকার। কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে আপনার সান্নিধ্যে যাওয়া আমার ভাগ্যে জুটলো না। ব্যাড লার্ক।”
বলেই হেসে ফেলল। সানায়াও হেসে ফেলল। বলল,
“বেশ ভালো কথা। আপনার নামটাই তো জানা হলো, জনাব। আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?”
ছেলেটা হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আগে বলুন আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”
সানায়া সাথে সাথে উত্তরে বলল,
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
দুজনের মধ্যে নাম্বার বিনিময় হলো। ছেলেটা এবার সানায়াকে অফার করল,
“কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি?”
সানায়া প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ, আমার সাথে গাড়ি আছে।”
বলেই সানায়া নিজের গাড়িতে উঠে পড়ল। জানালা দিয়ে পুনরায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“নামটা?”
ছেলেটা হ্যান্ডশেক করে হেসে বলল,
“আহিল। আহিল মির্জা।”

#চলবে