ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-২০+২১

0
129

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বিশ

[১৮+এলার্ট]
“একজন ডিভোর্সি, সিঙ্গেল মাদারকে ভালোবাসা এত সহজ না, সায়র। একজন মাকে ভালোবাসতে হলে সবার আগে তার সন্তানকে আগলে রাখার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে৷”
মেহরিশের কথা শুনে সায়র পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আপনার কি মনে হয়, আমি সে ক্ষমতা নেই?”
মেহরিশ নড়েচড়ে বসল। বলল,
“সে কথা বলিনি, সায়র। আমি বুঝাতে চেয়েছি, আপনি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতে পেরেছেন?”
সায়র সামান্য হাসল। মেহরিশের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলে উঠল,
“ভালো না বেসেই বিয়ে করে ফেললাম?”
মেহরিশ সায়রের চোখে চোখ রেখে বলে উঠল,
“বিয়ে মানে ভালোবাসা না, সায়র। বিয়ে করতে হলে ভালোবাসতে হবে এটা কোথাও বলা হয়নি। বরং এরেঞ্জ ম্যারেজ যাদের হয় তারা কিন্তু বিয়ের পরেই একে অপরকে ভালোবাসে। ভালোবেসে বিয়ে করে আমার জীবনটা নরক হয়ে গেছে দেখছেন না?”
সায়র সাথে সাথে বলে উঠল,
“সে নরকটাকেই ভালোবাসা দিয়ে সর্গ সুখে পরিনত করব আমি।”
মেহরিশের কেন যেন বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে সব কেমন অচেনা। অজানা। চারপাশের সব কিছু কেমন তিক্ত লাগছে। মিথ্যে মনে হচ্ছে৷ তাইতো মেহরিশ সায়রকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু সায়র না নিজের মাকেও এখন মেহরিশের মিথ্যে মনে হয়। মেহরিশের দিকে খেয়াল করল সায়র। মুখটা চুপসে আছে। কি নিয়ে যেন চিন্তায় আছে। সায়র একটু গলা ঝেরে বলে উঠল,
“মেহরিশ, এনি প্রবলেম?”
মেহরিশ ছোট্ট করে উত্তর দিল,
“নো।”
সায়র এবার মেহরিশের দিকে ঘুরে বসল। মেহরিশের এক গালে হাত রাখল আলতো করে। সায়রের দিকে ঘুরিয়ে বসালো। দুই গালে হাত রাখল আলতো করে৷ শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আপনার কি মনে হয়, আমি আপনাকে ভালোবাসি না?”
মেহরিশ উত্তর দিল না। সায়র পুনরায় বলল,
“মেহরিশ, হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান না। তেমন সব ছেলে-মেয়েরাও এক না। পৃথিবীর সব মানুষ এক হলে কি পৃথিবী সুন্দর থাকতো? আমি আপনাকে ভালোবাসি, মেহরিশ। এই পৃথিবী, আলো বাতাস, চাঁদ-সূর্য যেমন সত্যি আমার ভালোবাসাও তেমন সত্যি। আমাকে আপনি জোর করে ভালোবাসবেন এটা আমি চাইনা। আপনি আমার পাশে থাকবেন, আমার দুঃখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন, আমার মন খারাপে আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিবেন। ব্যস! আর কিছু চাইনা। এইটুকু চাওয়া আমার পূরণ করবেন, মেহরিশ?”
মেহরিশ অশ্রুসিক্ত নয়নে সায়রের দিকে চেয়ে রইল। সায়র হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল৷ মেহরিশের অশ্রুসিক্ত চোখের পাতায় চুমু খেয়ে ফেলল। মেহরিশ অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল৷ গা শিরশির করে উঠল। দুই হাতে খামচে ধরল সায়রের শার্টের কলার। মেহরিশের মুখপানে তাকিয়ে সায়রের কি যেন হলো। নিজের উপর কন্ট্রোল হারাল৷ উদাস মন কিসব ভাবছে। কিসব করতে চাইছে। মেহরিশকে আদর করার বড্ড স্বাদ জাগছে৷ মেহরিশের কম্পিত ঠোঁট দুটো সায়রকে ইশারায় ডাকছে৷ সায়র এবার ঠোঁট ছোয়ালো মেহরিশের কপালে। মেহরিশ হুট করেই কাঁপতে শুরু করল। পরনে ক্রপ টপস, গলায় ওড়না ঝুলানো, সাথে প্লাজু। সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসার জন্য প্লাজু বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে৷ টপসটাও কিছুটা উপরে উঠে যাওয়ায় নাভি স্পষ্ট হয়ে আছে। সায়রের বড্ড ইচ্ছে করছে সেখানটায় চুমু এঁকে দিতে। কিন্তু নিজের ভেতরে থাকা কোনো শক্তি আটকাচ্ছে। নিজের মনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নিজের হাতটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। হাত চলে গেল সেখানে৷ সায়রের শীতল হাতের স্পর্শ মেহরিশের উন্মুক্ত পেটে পড়তেই মেহরিশ প্রবল ভাবে কেঁপে উঠল। সামলাতে না পেরে সায়রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সায়র যেন এবার আকাশের চাদ হাতে পেয়ে গেল। মুখ ডুবাল মেহরিশের ঘাড়ে৷ অস্পষ্ট বাক্যে বলে উঠল,
“মেহরিশ, আমার নিজেকে সামলাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।”
মেহরিশ উত্তর দিল না। চুপটি করে রইল সায়রের বুকে। বরং আরো জড়োসড়ো হয়ে সায়রের কোল উঠে পড়ল। সায়র পুনরায় বলে উঠল,
“মেহরিশ, আমি আপনার আপত্তি কিছু করতে চাইনা।”
মেহরিশ উত্তর দিল না দেখে সায়রের রাগ হলো। মেহরিশের ঘাড়ে গাঢ় ঠোঁটের স্পর্শ লেপে দিল। বলল,
“মেহরিশ, আমাকে সামলানোর সুযোগ দিন। নয়তো কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে।”
মেহরিশ সায়রের বুকে আরো শক্ত করে নিজের জায়গা করে নিতে নিতে বলল,
“আমি শুধু আপনাকে খানিকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকতে চাই, সায়র।”
সায়র আগের ন্যায় বলল,
“মেহরিশ, কেরোসিন আর আগুন একসাথে হলে দাউদাউ করে জ্বলে, নিভে না। আমি একজন পুরুষ, মেহরিশ। আমার অনুভূতির জোয়ার বড্ড ধারাল। একবার সেই জোয়ারে ভাসা শুরু করলে সামলাতে পারবেন না।”
মেহরিশের কানে কথাটা যেতেই সায়রকে ছেড়ে দিল। ধ্যান ভেঙে গেল। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা খোলা। লজ্জায় চুপসে গেল। সায়রের দিকে লজ্জায় দৃষ্টি রাখতে পারল না৷ মিনমিন করে বলল,
“আমি এসবের জন্য এখনো প্রস্তুত না, সায়র।”
সায়র উঠে দাঁড়াল। শার্ট ঠিক করে, নিজেকে গুঁছিয়ে নিতে নিতে বলল,
“তাহলে আমাকে বেসামাল করে দিতে কাছে আসবেন না। প্রথম বলে ছেড়ে দিলাম। নেক্সট টাইম করলে আর ছাড়ব না। একদম…।”
মেহরিশও সাথে সাথে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
“একদম কি?”
সায়র মুচকি হাসল। মেহরিশের দিকে সামান্য ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
“বাসর সেরে ফেলব।”
বলেই শিস বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে গেল। সায়র চলে যেতেই মেহরিশ লাজুক হেসে উঠল৷ এক হাত ঘাড়ে রেখে, অন্য হাত গালে রেখে কল্পনায় ভেসে গেল। মিনমিন করে বলতে লাগল,
“আমিও আপনার প্রতি দিন দিন মারাত্নক ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছি, সায়র।”


“ডাঃ আংকেল, হঠাৎ ইমারজেন্সি ডাকলেন যে?”
সায়র তড়িঘড়ি করে ডাঃ রুমির কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে উপরোক্ত প্রশ্নটি করল। ডাঃ রুমি সায়রের দিকে চেয়ে হাস্যজ্বল মুখে বলে উঠলেন,
“কাম ডাউন, ইয়াং ম্যান। এত হাইপার হওয়ার মতো কিছু হয়নি। বসো আগে৷ ”
সায়র বসতে বসতে হাঁফ ছাড়ল। শান্ত স্বরে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে এত ভোরে আসতে বললেন কেন, আংকেল?”
ডাঃ রুমি হেসেই জবাবে বললেন,
“তোমাকে একটা খবর দেওয়ার ছিল।”
“কি খবর, আংকেল?”
ডাঃ রুমি বললেন,
“আবির সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে।”
সায়রের চোখ মুখ খুশিতে ভরে উঠল। ঠোঁটের হাসিটা বেশ প্রস্তর হলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“সত্যি! সত্যি বলছেন, আংকেল?”
ডাঃ রুমি হাসলেন। বললেন,
“হ্যাঁ, সত্যি। তবে তাকে এখানে রাখা যাবে না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে নিয়ে যাও।”
সায়রও এবার চিন্তায় পড়ে গেল। ডাক্তারের সাথে কিছু পরামর্শ করে উঠে পড়ল।


নীলুফা বেগম আনমনে হয়ে রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিলেন৷ চা উতলে পড়ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। শাড়ির আঁচলটাও গ্যাসর উপর পড়ে আছে। আগুন ধরতে শুরু করে। মেহনূর রান্না ঘরে ঢুকতেই এহেন দৃশ্য দেখে মা বলে চিৎকার করে উঠল। তাড়াতাড়ি গ্যাস নিভিয়ে সামনে থাকা এক মগ পানি আঁচলে ঢেলে দিল। নীলুফা বেগমকে ছিটকে সরিয়ে আনল সেখান থেকে। নীলুফা বেগম হঠাৎ কান্ডে ভড়কে গেলেন। মেহনূরের ভয়ার্ত মুখখানা দেখে চমকে তাকালেন নিজের আচলে। কিছুটা পুড়ে গেছে। চা পড়ে চারদিকে একাকার অবস্থা৷ মেহনূর নীলুফা বেগমকে সামান্য জড়িয়ে ধরল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল,
“মা! কি হয়েছে তোমার? এক্ষুনি কতবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল!”
নীলুফা বেগম হঠাৎ কান্ডে কথা বলতে পারছেন না। তবুও কোনোরকমে বলল,
“একদম খেয়াল ছিল না রে, মা।”
মেহনূর কিছু বলতে যাবে তার মধ্যেই নীলুফা বেগমের ডাক পড়েছে। নীলুফা বেগম মেহনূরকে বলল,
“তোর বাবা ডাকছে। শুনে আসি।”
বলেই রুমের দিকে ছুটে গেলেন। সাবির সাহেব তৈরি হচ্ছেন। কোথাও বের হবে হয়তো। নীলুফা বেগমকে ঘরে ঢুকতে দেখে কঠিন বাক্যে জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় থাকো? কতক্ষণ যাবৎ ডাকছি।”
নীলুফা বেগম শান্ত স্বরেই বলল,
“কি বলবে, বলো।”
সাবির সাহেব নীলুফা বেগমের এক হাত ধরে টেনে সামনে এনে দাঁড় করালেন। নীলুফা বেগমের গালে হাত রেখে বলে উঠলেন,
“বের হওয়ার সময় তোমার মুখ না দেখে গেলে আমার দিন ভালো যায় না, নীলু।”
নীলুফা বেগম হেসে উঠলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসতে হাসতে বললেন,
“আমার জীবন ধ্বংস করে নিজে ভালো থাকবে আশা করো কিভাবে? আমার সংসার, আমার স্বামী সব কেড়ে নিয়েও ভালো থাকতে পারছো না?”
সাবির সাহেব রেগে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। হাসি টেনে বলে উঠলেন,
“এখন আমার হাতে সময় নেই, নীলু। ফিরে এসে তোমার প্রশ্নের জবাব দিব।”
বলেই নীলুফা বেগমের কপালে চুমু এঁটে বেরিয়ে গেলেন। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। নীলুফ বেগমের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সাবির সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই নীলুফা বেগম ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। ভেতর থেকে চিৎকার করে কান্না আসছে কিন্তু আফসোস কাঁদতে পারছেন না। ঠিক কত বছর ধরে এই কান্না চেপে আছে জানা নেই। কত বছর ধরে এই চারদেয়ালের মাঝে এক নারীর বদ্ধ চিৎকার জমে আছে কেউ জানেনা। এক নারী অনিচ্ছায় কত রাত নিজের সতিত্ব বির্সজন দিয়েছে কে জানে সে কথা? নীলুফা বেগম এবার ফুঁপিয়ে উঠলেন। ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন,
“ এতদিন তোমার ফেরার আশায় পথ চেয়ে চেয়ে সব অন্যায়, অত্যাচার মেনে নিয়েছিলাম, আবির। আজ আমি শূন্য। আমি মুক্ত। তুমি নেই। আমার অস্তিত্বও নেই। আমার অস্তিত্বের লড়াইয়ে আমি হেরে গেছি। বেঁচে থেকেও লাশ হয়ে ছিলাম। এখন না হয় সত্যি সত্যি লা°শ হয়ে যাব। এক দেহে এত কলঙ্ক নিয়ে আর বাঁচতে পারব না। উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানবে না, এক নারী তার ছোট্ট দেহে কত ব্যাথা লুকিয়ে রেখে নিরবে চলে গেল।”

#চলবে

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_একুশ
(রহস্য সমাধান -০১)

“দেবরের সাথে এত বছর ধরে বিয়ে ছাড়া সংসার করে যাচ্ছো, মা?”
উপরোক্ত বাক্যটি কানে আসতেই নীলিমা বেগম চমকে উঠলেন। কিছুটা কাঁপলেনও বটে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকালেন। মেহনূরকে দেখে চোখ দুটো আঁতঙ্কে বড় বড় হয়ে গেল। আঁতকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেহনূরের চোখে, মুখে ঘৃণা স্পষ্ট। তেতো স্বরে মেহনূর পুনরায় প্রশ্ন করে উঠল,
“আমার বাবা কোথায়, মা?”
নীলিমা বেগম ভয়ে জবাব দিতে পারলেন না। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে মেহনূরের দিকে ছুটে আসলেন। মেহনূরের হাত ধরে রুমের বাইরে টেনে নিয়ে আসলেন। মেহনূর হেচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন বাক্যে বলে উঠল,
“হাত ছাড়ো, মা। তুমি আমাকে ছোঁবে না।”
নীলিমা বেগমের গাল বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েকে এবার কি উত্তর দিবেন তিনি? মেহনূর এবার ঘৃণার বাক্যে বলে উঠল,
“ তুমি কি সত্যিই আমাদের মা? আমাদের মা হয়ে নিজের গায়ে এত বড় কলঙ্ক মাখলে কেন? লজ্জা করল না তোমার? আমাদের এত বাজে ভাবে ঠকালে? ছিহ, মা? আমার তো তোমাকে মা বলতেও ঘৃণা করছে।”
নীলিমা বেগম শব্দ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন,
“আমি তোদের ঠকাইনি, মা। আমি নিজেই বাজে ভাবে ঠকে গেছি।”
মেহনূর ধমকে উঠল। চিৎকার করে বলল,
“নাটক বন্ধ করো, মা। আমি এক্ষুনি গিয়ে আপুকে সবটা বলে দিব। আজ, এক্ষুনি আমি আর আপু এই বাড়ি ছেড়ে, তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। ভুলে যাব আমাদের মা বেঁচে আছেন। সব ভুলে যাব। শুধু যাওয়ার আগে একটা সত্যি জানতে চাই।”
নীলিমা বেগম প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাতেই মেহনূর প্রশ্ন করল,
“শুধু বলো আমাদের বাবা কে? সে কি বেঁচে আছে?বলো, মা।”
নীলিমা বেগম এবার উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লেন। কান্নারত বাক্যেই বলে উঠলেন,
“আমি জানিনা, মা। কিচ্ছু জানিনা।”
মেহনূর রাগে ফেটে পড়ল। বলল,
“ঠিক আছে তোমার জানা লাগবে না। আমরা নিজেরাই জেনে নিব। আমাদের বাবা যদি বেঁচে থাকে তাহলে আমরা ঠিক খুঁজে নিব।”
বলেই রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তৎক্ষনাৎ নীলিমা বেগম পেছন ডেকে উঠল। শান্ত, শীতল বাক্যে বলতে লাগলেন,
“আবির আর সাবির আইডেন্টিক্যাল টুইনস।”
এইটুকু বলে সামান্য থামলেন। মেহনূর চমকাল৷ পেছন ঘুরে তাকাল৷ নীলিমা বেগম পুনরায় বলতে লাগলেন,
“ মেহরিশ তখন ৫ বছরের৷ আর তুই তখন সবে মাত্র এক বছরের। মেহরিশ সবে মাত্র তখন স্কুলের গন্ডিতে পা রেখেছে। স্কুলের প্রথমদিন আমি আর তোর বাবা মিলে খুব শখ করে মেহরিশকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। তারপর তোর বাবার মেহরিশকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল। পথিমধ্যে একটা এক্সিডেন্টে আমার জীবনটাই সম্পূর্ণ উলোটপালোট হয়ে গেল।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেহনূর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। শরীর ভার হয়ে আসছে। কোন সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করাল জীবন! নীলিমা বেগম পুনরায় বলা শুরু করলেন,
“মেহরিশ বেঁচে গেলেও আবিরকে বাঁচানো গেলো না।এক্সিডেন্টে আবিরের মুখটা এত বাজে ভাবে ক্ষত হয়ে পড়েছিল রাস্তায় যে কেউ তাকাতেই ভয় পাচ্ছিল। আবির স্পট ডেড হয়ে যায়। মেহরিশের মাথায় আঘাত লাগে, দুইদিন পর মেয়েটার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু মেয়েটা ওর ছোটবেলা হারিয়ে ফেলল। ভুলে গেল সব কিছু। স্বামী হারানোর শোকে কাঁদার সময়টুকু আমি পাইনি। মেয়েকে বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল মেহরিশকে কোনোরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে রাখা যাবে না। তবে মেয়েটা সব ভুলে গেলেও বাবাকে ভুলল না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শুধু বাবাকে দেখতে চাইল। কিন্তু আমি তোর বাবাকে কোথায় পাব? সাবির সে সময় আমার সঙ্গ দিল। মেহরিশ একমাত্র সাবিরের ছায়াতলেই থাকতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হলো। মাস খানেক এভাবেই কাটল। বাড়ির গুরুজনরা মেহরিশের অবস্থা দেখে সাবিরের সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না। সাবিরও কেন যেন রাজি হয়ে গেল। সবার জোরাজুরিতে আমিও…।”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। তার আগেই মেহনূর তাচ্ছিল্যের বাক্যে বলে উঠল,
“সবার জোরাজুরিতে তুমিও আর না করতে পারলে না। বিয়ে করে নিলে নিজের দেবরকে, তাইনা মা?”
বলেই হাসল খানিকটা। নীলিমা বেগম চুপ রইলেন৷ খানিক থেমে পুনরায় বলে উঠলেন,
“সাবিরকে বিয়ে করেছিলাম ঠিকই কিন্তু কখনো মানতে পারিনি। বিয়ের পর থেকেই সাবির আমাকে নিয়ে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেল। ভাইকে হারানোর শোক ভুলে আমাকে ভোগ করার উন্মাদনায় মেতে উঠল। বশ করতে না পেরে জোর খাটানো শুরু করল। যখন জোরটাও আমার কাছে হেরে গেল তখন জানতে পারলাম এক কঠিন সত্য। আমার আবির বেঁচে আছে। সুস্থ আছে। সেদিনের এক্সিডেন্টটা সাবির করিয়েছিল। সব কিছু জেনেও আমি সবাইকে সবটা জানাতে পারিনি। সাবিরের কথার অবাধ্য হলে প্রতিমুহূর্তে আমাকে হুমকির সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। বলতে পারিস আবিরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমার এই মিথ্যে সংসার।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই মেহনূর তাচ্ছিল্যের বাক্যে বলল,
“তুমি সম্পূর্ণটাই মিথ্যে, মা। তুমি কি এসব বলে নিজেকে অসহায় প্রকাশ করলে? বাট স্যরি, আমার তোমাকে কোনোভাবে অসহায় মনে হয়নি। তুমি বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাবার ছোট ভাইয়ের সাথে সংসার পেতেছো, তার মেয়েদের মিথ্যে শিখিয়ে বড় করেছ___এসব শুনলে বাবার বেঁচে থাকার স্বাধ থাকবে? তুমি অন্যায় জেনেও প্রতিবাদ করোনি। এসব থেকে বাঁচার কোনো স্টেপ নেওনি। তারমানে তুমিও সমান দোষী। তুমিও অপরাধী।”
নীলিমা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। মেহনূর যা বলছে ঠিক বলছে। কি উত্তর দিবেন তিনি? মেহনূর এবার একটু ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা মা, চাচি কোথায় ছিল? সুহা আপু কোথায়, মা?”
নীলিমা বেগম শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“ সুহা খেলতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়, একমাত্র মেয়েকে হারানোর কষ্ট মোহিমা সহ্য করতে পারেনি। হার্ট অ্যাটাক করে চলে গেল।”
মেহনূর এবার প্রশ্ন করল,
“এই ঘটনার কতদিন পর বাবা মা°রা যায়?”
“মাস খানেক।”
মেহনূর এবার কঠিন বাক্যে আওড়াতে লাগল,
“আমি বিশ্বাস করিনা তোমার কথা। তোমরা তো বলেছিলে ওরা নাকি একটা এক্সিডেন্টে মা°রা গেছে। তাহলে আজ কেন আবার অন্য কথা বলছো? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এসব তোমাদের সাজানো নাটক। তোমার আর চাচ্চুর মধ্যে আগের থেকেই কিছু ছিল। নয়তো দেখো চাচিমা, সুহা আপু আবার আমার বাবা আর আপুও? শুধুই কাকতালীয় নাকি চক্রান্ত?”
নীলিমা বেগম শিউরে উঠলেন। আর্তনাদ করে বললেন,
“কি বলছিস তুই?”
মেহনূর চিৎকার করে বলে উঠল,
“ঠিক বলছি, মা। আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা। তুমি একজন জঘন্য স্ত্রী। জঘন্য মা। আমি তো সব সত্যি খুঁজে বের করবই। বাবা যদি বেঁচে থাকে তাহলে বাবাকেও খুঁজে বের করব। সাবির মির্জাকেও ফাসির দড়িতে ঝুলাব। সাথে তোমাকেও…।”
বলেই মেহনূর আর সেখানে দাঁড়াল না। ছুটে বেরিয়ে গেল। নীলিমা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।


একটা পার্কে সায়রের পাশাপাশি বসে আছে মেহরিশ। আনায়া সায়রের বুকে। শীতের বিকেলে হিম শীতল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা মন্দ লাগছে না। মুহূর্তটাও সুন্দর। সুন্দর মুহূর্তে মেহরিশ প্রশ্ন করল,
“সায়র, আমি আপনাকে কিছু ব্যাপার শেয়ার করতে চাই।”
সায়র শান্ত বাক্যে বলল,
“মন খুলে মনের কথা শেয়ার করুন, মেহরিশ। আপনার সুখ, দুঃখের গল্প শোনার জন্যই তো সায়র আজীবন রাজি।”
মেহরিশ হাসল। বলে উঠল,
“আমার কেন মনে হয় আমার আশেপাশের সব মিথ্যা, সব ঘোলাটে? কেন মনে আমার মা, বাবা মিথ্যা? আমার কাছ থেকে কিছু লুকানো হচ্ছে, সায়র। কিন্তু কি? কোন অজানা সত্য আমি জানিনা। এসব প্রশ্ন প্রতিদিন আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমাকে একমাত্র আপনি সাহায্য করতে পারেন, সায়র।”
সায়র হাফ ছাড়ল। মনে মনে বলে উঠল,
“আমি আপনার জীবনের সেই অজানা সত্যগুলো জানি, মেহরিশ। কিন্তু এখনো আপনাকে বলার সময় আসেনি।”
সায়রকে চুপ থাকতে দেখে মেহরিশ আলতো করে হাত রাখল সায়রের কাঁধে। অতঃপর বলল,
“কিছু ভাবছেন?”
সায়র প্রসঙ্গ মুহূর্তেই পাল্টে ফেলল। হাসি মুখে বলে উঠল,
“ভাবছি তো শুধু আপনাকে।”
মেহরিশ হেসে ফেলল। বলল,
“ফাজিল ব্যাটা ছেলে।”
সায়র মুখ ভার করে বলল,
“আমি তো ব্যাটা ছেলেই, আমি কি মেয়ে ছেলে নাকি? অবশ্য, এখন নিজেকে মেয়ে ছেলেই মনে হয়। বিয়ে করেও বউয়ের মধু খাওয়া হলো না।”
মেহরিশ জিভে কামর দিয়ে সাথে সাথে সায়রের মুখ চেপে ধরল, ফিসফিস করে বলল,
“আমরা এখন বাড়ির বাইরে।”
সায়র মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলল। ঠোঁট উল্টে বলল,
“তো কি হয়েছে? এখন বাইরে আছি, বউ রাজি থাকলে বাসায় গিয়ে মধু খেয়ে আসব।”
মেহরিশ জোরে হেসে ফেলল। বলে উঠল,
“আপনি তো ঠোঁট কা°টা হয়ে যাচ্ছে বেশ।”
সায়র উত্তরে বলল,
“মেহরিশ, আনায়ার একা একা ভালো লাগছে না। ওর একটা খেলার সাথী দরকার। চলুন না, আনায়ার একটা ভাই আনার ব্যবস্থা করি।”
মেহরিশ এবার লজ্জা পেল। লাজুক হেসে বলে উঠল,
“ঠিক আছে, আপনার প্রস্তাবটা ভেবে দেখব।”
বলেই উঠে দাঁড়াল। সামনে হাঁটা শুরু করল। সায়রও হেসে ফেলল। আনায়ার গালে খুশিতে চুমু খেল। আনায়াও সায়রের গালে চুমু খেতে ভুলল না।


“আবির যদি বেঁচে যায় তাহলে আমার এতদিনের সাজানো সব কিছু ভেস্তে যাবে।”
সাবির রুমের এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারি করছে। কিছুতেই মাথায় খেলছে না এখন কি করবে? পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল। নিজে নিজে বলে উঠল,
“আচ্ছা পুরো মির্জা পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিলে কেমন হয়? না থাকবে বাশ আর না বাজবে বাঁশি।”
অতঃপর কোনো একজনকে ফোন করে সবটা জানাল৷ ফোন কেটে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“আজ রাতে মির্জা বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলবে৷ মেহরিশ, মেহনূর, সায়র, আর ছোট্ট আনায়ার পুড়ে যাওয়া ছাঁই দিয়ে আমি গোসল করে নিজেকে শান্ত করব।”

#চলবে