কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব-০৩

0
443

#কেন_মেঘ_আসে_হৃদয়_আকাশে
পর্ব-৩

বিয়ের পর জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া জয়ার মনে আস্তে আস্তে আরাফের জন্য ভালোবাসার পাহাড় জমে গিয়েছিল। এই ভালোবাসার বৈশিষ্ট্যই যেন বিধ্বংসী, ভয়াবহ! আরাফ তার সাথে টুকটাক অন্যায় করলেও সে মেনে নিত৷ কিন্তু সেদিন মিহাদের সাথে হাসাহাসি করার জন্য তাকে যে চড়টা মারল সেটা জয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারল না। সে এত কষ্ট পেল যে কয়েকদিন পর্যন্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না, খেতেও পারল না। শুধু কাঁদল। আরাফও তার খোঁজ নেবার প্রয়োজন মনে করল না। সে অন্য ঘরে ঘুমালো।

এর পরের শুক্রবার পর্যন্ত এমনই চলল। শুক্রবার ভোরে কপালে কারো মৃদু ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙল জয়ার। চেয়ে দেখল আরাফ তার পাশে শুয়ে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অভিমানে ঠোঁট উল্টে এলো জয়ার। চোখ ছলছল হয়ে গেল। আরাফ তার অভিমানী ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল। সকল অভিমান মুছে দেবার চেষ্টা করল আদর করে। জয়াও যেন অভিমান ভুলে কাছে টেনে নিল আরাফকে।

আবারও কিছুদিন চমৎকার শান্তির জীবন। তবে টুকটাক এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগল যাতে জয়া প্রচন্ডভাবে মানসিক আঘাত পেত। আবার আরাফের ব্যবহারে সেসব ভুলে যাবারও চেষ্টা করত।

দিন পার হয়ে যেতে লাগল। জয়ার কাছে এখন আর সময়ের কোনো হিসেব নেই। যেন পৃথিবী থমকে গেছে একটা জায়গায়। মাস, বছর নাকি যুগ চলে যাচ্ছে তার কোনো খেয়াল থাকছে না। আজকাল তার বাড়ি থেকে বের হতেও ইচ্ছে করে না। আরাফ বাড়িতে না থাকলে সে বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকে, কখনো এলোচুলে ছাদে বসে আকাশ দেখে। মাথায় হাজারো কথা ঘোরে, সব আকাশের ছন্নছাড়া মেঘের মতো। এমন মেঘ দেখলে মনে হয় এটা শরৎকাল। সে মনে মনে আকাশী রঙা শাড়ি পরে কাশফুল দেখতে যায়৷ তার সাথে থাকে আরাফ।

আরাফ একদিন জানাল সে মাসখানেকের জন্য দেশের বাইরে যাবে। এখানে জয়ার কোনো অসুবিধা হবে না৷ সে যেন নিজের খেয়াল রাখে। জয়ার আরাফকে একটা জরুরি কথা জানানোর ছিল। কিন্তু সেটা বলার মতো সুযোগ বা অবসর সে পেল না। আরাফ হঠাৎই যেন চলে গেল তাকে রেখে।

আরাফ চলে যাবার দু’দিন পর হঠাৎ এক বিকেলে মাথা ঘুরে পড়ে গেল জয়া। কাজের লোকেরাই একজন ডাক্তারকে খবর দিল৷ ডাক্তার এসে দেখে কিছু টেস্ট করতে বললেন৷ কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ বলে টেস্টগুলো করা হলো না জয়ার। তবে ডাক্তার যেটা সন্দেহ করছেন সেটা জানিয়ে দিয়ে গেলেন ওকে। জয়া আগে থেকেই জানত কথাটা।

আরাফ ফিরে এলো মাসখানেক পর। এসেই জয়াকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ গুঁজল। জয়া আরাফের কানে ফিসফিস করে বলল, “তুমি বাবা হতে চলেছ।”

আরাফ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে গেল। “আমি? বাবা?”

মৃদু হেসে সায় দিল জয়া। আরাফ কেমন যেন অদ্ভূত চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হন্তদন্ত করে বেরিয়ে গেল। খানিক পরে আরাফ জানতে পারল সে যাবার দুদিন পর একজন ডাক্তার এসে দেখে গেছেন জয়াকে। এটা জানার পর যেন তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। সারাদিন সে জয়ার সাথে একটা কথাও বলল না। এতদিন দূরে থাকার পর এমন একটা খবর শুনেও আরাফের কাছে না আসাটা জয়ার মনে নতুন করে আঘাত করল। সে রাত জেগে অনেকক্ষণ আরাফের অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

তার ঘুম ভাঙল আরাফের ডাকে। ওর চোখ লাল টককটে হয়ে আছে। গা থেকে মদের গন্ধ আসছে। সরে গেল জয়া। গা গুলিয়ে আসছে তার শরীর। বমি করার জন্য সে ছুটে গেল বাথরুমে।

বমি করে সে হাঁপিয়ে উঠল একেবারে। কোনোরকমে বেসিনের কোণ আঁকড়ে ধরে নিজেকে খাড়া করল সে। মুখে পানি ছিটালো। বাথরুমের দরজাটা খোলাই ছিল। দরজার দিকে ঘুরতে গিয়েই আরাফের মুখোমুখি হয়ে পড়ল জয়া। লোকটাকে অপ্রকৃতিস্থ লাগছে। ওর হাতে একটা ভাঙা বোতল। চোখে রক্ততৃষ্ণা। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল জয়া। পিছিয়ে যেতে থাকল ক্রমাগত। একসময় গিয়ে বাঁধা পেল বাথটাবের গায়ে। আরাফ এগিয়ে আসছে। আবার পেছাতে গিয়ে বাথটাবে পড়ে গেল জয়া। গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল।

আরাফ খুব কাছে চলে এলো তার। বসল পাশে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তুই কী ছিলি বল তো? একটা সিম্পল মিডল ক্লাস মেয়ে। তোকে আমি তুলে এনে এই প্রাসাদের রাণী বানিয়েছি। এত ভালোবাসা দিয়েছি যা সারাজীবন সাধনা করলেও পাবি না। বিনিময়ে আমি কী চেয়েছি? স্রেফ লয়্যালিটি। তোকে আর কেউ দেখবে না, আর কেউ পাবে না, আর কারো ছুঁয়ে দেখার সাহস হবে না, তুই শুধু আমাকে ভালোবাসবি, আর কারো দিকে ফিরেও তাকাবি না। আর তুই কী করলি? আমার বিদেশ যাওয়ার সুযোগে পেট বাঁধিয়ে ফেললি?”

জয়া প্রচন্ড বিষ্ময়ে আর আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল এসব কী বলছে আরাফ? পাগল হয়ে গেছে নাকি সে?

আরাফ এরপর অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে শুরু করল। জয়া এমন গালি কোনোদিন শোনেনি। সে কানে হাত চেপে ধরল। আরাফ অপ্রকৃতস্থের মতো হাসতে হাসতে বলল, “এখন শুনতে পারছিস না কেন? যখন অন্য লোকের সাথে শুয়েছিলি তখন মনে পড়েনি এমন দিন আসতে পারে? নিজেকে বে** মনে হয়নি? তোর মতো মেয়েরা এমনই হয়। তোর আর তোর জারজ বাচ্চার বাঁচার কোনো অধিকার নেই। তোদের আজকেই শেষদিন…”

আরাফ কাচের বোতলটা উঁচু করে নামিয়ে আনল জয়ার পেট বরাবর।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাথটাব। যেন রক্তের নদী। আরাফের মাথাটা হেলে পড়ে আছে বাথটাবের ওপরেই। ওর পেছনে একটা ফুলদানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়িরই এক গৃহকর্মী। কাচের আঘাত জয়ার গায়ে লাগার আগেই মেয়েটা আরাফকে আঘাত করেছে।

_____________________________

“আমি বুঝতে পারছি না এতকিছুর পরেও জয়া ওই ছেলেকে ভুলতে পারছে না? দিনরাত শুধু বিড়বিড় করে বলে, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ আরাফ, আমি তোমাকেই ভালোবাসি। বাচ্চাটা তোমার৷ তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না কেন? প্লিজ বিশ্বাস করো, আমি কারো সাথে কিচ্ছু করিনি।” জয়ার মা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন স্বরে কথাগুলো বললেন সাইকিয়াট্রিস্ট মালিহা জাহানকে।

মালিহা জাহান জয়াকে দেখছেন। জয়ার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। সে সারাদিন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। আরাফের সেই বাড়িটা থেকে তাকে উদ্ধারের চার মাস হয়ে গেছে। জয়া এখন প্রায় ছয় মাসের গর্ভবতী। অথচ বাচ্চার বা নিজের কোনো খেয়াল নেই, সে ভেতরে ভেতরে যেন এই দুঃখে মরে যাচ্ছে যে আরাফ তাকে অবিশ্বাস করেছে।

মালিহা জাহান বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখছি।”

“ওই শয়তানটা ওকে জাদু করে ফেলেছে। নইলে ওর প্রতি এত টান আসবে কেন ওর?”

মালিহা জাহান মৃদু হেসে বললেন, “এটা কোনো জাদুটোনা নয়। এই রোগটার নাম স্টকহোম সিন্ড্রোম। সুইডেনের স্টকহোমে একবার এক ডাকাত দল ব্যাংক কর্মীদের বন্দি করে রেখেছিল বেশ কিছুদিন। এই সময়ের মধ্যে বন্দিদের সেই ডাকাতদের প্রতি এক ধরনের সিম্প্যাথি তৈরি হয়েছিল। তাই এই রোগটাকে স্টকহোম সিন্ড্রোম ডাকা হয়। আরাফের কাছে আটকে থাকা অবস্থায় জয়ারও তার প্রতি সহানুভূতি আর প্রেম তৈরি হয়েছে। জয়া আমাকে কিছু কিছু বলেছে লোকটা তার সাথে কেমন আচরণ করত। সে তাকে ভালোবাসা দেখাত, আবার একই সাথে মানসিক অত্যাচারও করত। জয়ার মানসিক অবস্থার অবনতি হয়েছে ধীরে ধীরে। এই একটা বছর পুরোটা সময় ও এই মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে।”

“ও কি সুস্থ হবে না? মেয়েটাকে না পেয়ে আমাদের যে কী অবস্থা হয়েছিল তা আর না বলি। এখন পেয়েও যদি ওকে সুস্থ করতে না পরি তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ কী থাকবে বলুন? একদিকে লোকের কথা, একদিকে মেয়ের এই অবস্থা। কী করব বুঝতে পারি না আজকাল।” বলতে বলতে চোখ মুছলেন জয়ার মা।

মালিহা জাহান সান্ত্বনার সুরে বললেন, “জয়া নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে। শুধু নিয়মিত ট্রিটমেন্ট দরকার। ও প্রেগন্যান্ট বলে ব্যাপারটা আরো জটিল, তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আমি ভেঙে পড়বেন না প্লিজ। এতদিন যেমন শক্ত ছিলেন, তেমনই থাকুন। আমরা দুর্যোগ কাটিয়ে উঠব ঠিকই।”

জয়ার মা জয়ার দিকে চাইলেন। সে পাশেই আছে। তাদের কথাবার্তায় ওর কোনো আগ্রহ নেই। একদৃষ্টিতে সে চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু