কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
532

#কেন_মেঘ_আসে_হৃদয়_আকাশে
পর্ব- ৪ (শেষ পর্ব)

পুরোপুরি সুস্থ হতে জয়ার সময় লাগল প্রায় তিন বছর। বাচ্চাটাকে প্রথম এক বছর ও দুই চোখে দেখতে পারত না। মনে করত বাচ্চাটাই সব নষ্টের মূল। কিন্তু ধীরে ধীরে কাউন্সেলিংয়ের সাথে সাথে ওর মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল হতে থাকে। বাচ্চার সাথে বন্ডিং তৈরি হওয়ার সাথে সাথে জয়ার মানসিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হওয়া শুরু করে। বাচ্চাটার যখন চার বছর বয়স তখন জয়া অতীত ভুলে চমৎকার একজন মা হয়ে উঠেছে। পড়াশুনা শেষ করে সে একটা ছোটো চাকুরি করতে শুরু করেছে৷

এক বিকেলে সে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিল হাঁটতে। হঠাৎ ফুটপাতে এক মহিলাকে দেখে চমকে উঠল সে। মহিলাও ওকে দেখে চমকালো। তারপর দ্রুত ওড়নায় মুখ ঢেকে সেই জায়গা থেকে চলে গেল। জয়া যেন আবার অতীতের এক তীব্র ধাক্কায় জায়গায়ই দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেয়ের হাত ধরে টানাটানিতে সম্বিত ফিরল জয়ার। কয়েক সেকেন্ড থমকে থাকার পর বাস্তবে ফিরে এলো সে। নিজের চেষ্টাতেই নিজেকে সামলে নিল। তারপর মেয়ের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে পথ চলতে শুরু করল।

যে মহিলাকে সে দেখেছে সে আর কেউ নয়, সেই গৃহকর্মী যে আরাফকে মেরেছিল। আরাফ সেখানেই মারা যায়৷ মেয়েটাই পুলিশে ফোন করে পালিয়েছিল। পালিয়েছিল সেই বাড়ির প্রতিটা কাজের লোক। পুলিশ এসে বাথটাবে অজ্ঞান অবস্থায় জয়াকে আর মৃত অবস্থায় আরাফকে আবিষ্কার করে।

_____________________________

জয়ার অনেকদিন চেষ্টা করেও আরাফের ব্যাপারে চিন্তাটা থামাতে পারে না। না, আগের মতো ভালোবাসা ওর জন্য এখন নেই। আছে সীমাহীন কৌতুহল। কেন সে ওর সাথে এমন করেছিল? ওর এ ধরনের আচরণের পেছনে রহস্য কী ছিল? কিন্তু সেসব জানার কোনো উপায় নেই। মা বাবাকে জিজ্ঞেস করলে তারা কখনোই আরাফের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র তথ্য দেন না। আর সে নিজে তো শুরু থেকেই তিমিরে।

তবুও জয়া মাথা খাটাতে লাগল। যদি ছোট্ট কোনো সূত্র পাওয়া যায় যা দিয়ে আরাফের অতীতের গোপন রসহ্যময় দরজা খোলা যাবে! কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু মনে পড়ল না৷

এক রাতে গভীর ঘুমে জয়া একটা চেনা ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখল স্বপ্নে। আরাফের সেই বাড়ির অনেক ঘটনাই সে প্রায়ই স্বপ্নে দেখে। আজকের স্বপ্নটা যেন আরো গভীর, স্পষ্ট, বাস্তবের কাছাকাছি।

সে দেখল সোফায় কয়েকজন বসে আছে। সে আরাফের পাশে বসে মিহাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মিহাদ খুব মজার একটা গল্প বলছে। গল্পের শুরুটা এমন, “আমি প্লাটিনাম কোম্পানি, মানে যেটাতে এখন আছি সেখানে চাকরি পাই তখন একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল…”

ঘুম ভাঙার পরেও বেশ কিছুক্ষণ থম ধরে রইল জয়া। ব্যাপারটা যে স্বপ্ন ছিল সেটা বুঝতে কিছুক্ষণ লেগে গেল। স্বপ্নটা পুরোপুরি মনে আছে। মিহাদ! প্লাটিনাম কোম্পানি!

জয়ার এক দূর সম্পর্কের বোনও সেই কোম্পানিতে চাকরি করে। তাই তার মাধ্যমে সেই কোম্পানিতে চাকুরীরত মিহাদকে খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। মিহাদের ফোন নাম্বারটাও পেয়ে গেল জয়া। কল করে তাকে দেখা করার জন্য অনুরোধ করল। তবে নিজের পরিচয় গোপন করেই দেখা করতে চাইল।

নির্ধারিত সময়ে মিহাদের সাথে দেখা হলো জয়ার৷ একটা পার্কে দেখা করল তারা। মিহাদকে দেখেই চমকে উঠল জয়া। সমানভাবে মিহাদও চমকাল। সে জয়াকে কোনোভাবেই এখানে আশা করেনি। আর জয়ার চমকানোর কারন মিহাদের চোখ। ওর একটা চোখ পাথরের!

মিহাদই প্রথম কথা শুরু করল, “আপনাকে দেখে খুব অবাক হলাম। আমাকে কেন বা কিভাবে খুঁজে বের করেছেন জানি না। তবে আপনাকে সুস্থ দেখে ভালো লাগছে। শেষবার শুনেছিলাম আপনার মানসিক অবস্থা ভালো নয়।”

জয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এখন ভালো আছি। ট্রমা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু আপনার চোখে কী হয়েছে,?”

“আপনার আর আমার দুর্দশার কালপ্রিট একজনই। যেদিন আপনাদের সাথে দেখা করতে সেই বাগানবাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিনই কপালে চোখ হারানো লেখা ছিল। একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল আমাদের গাড়ির৷ আমার চোখে কাচ ঢুকে গিয়েছিল। এক্সিডেন্ট যে গাড়ির জন্য হয়েছিল সেটা আরাফের ছিল। আমরা জানতাম, কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না৷ এটা নিয়ে অনেক জলঘোলাও হয়েছে, কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না সেসব৷ আর আমরা তখন এটা জানতাম না যে সে আপনাকে আটকে রেখেছে। আমরা ভেবেছিলাম আপনি স্বেচ্ছায় সেখানে আছেন। অন্তত আপনার ব্যবহার দেখে সেটাই মনে হয়েছে। আমরা আগে জানলে আপনাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতাম।”

“আমি কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম সেটা নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারি না। লোকটা আমাকে একপ্রকার জাদু করে রেখেছিল। নিজের পুতুল বানিয়ে রেখেছিল। আমার সাথে যা খুশি তাই করত।”

“হ্যাঁ, পরে তো সবই জানতে পরেছিলাম। কিন্তু আপনি হঠাৎ আমাকে খুঁজে বের করে দেখা করতে চাইলেন যে?”

“আমি আরাফের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাই। সে কেন আমার সাথে এসব করল সেটা জানতে চাই।”

“এখন সেসব জেনে কী হবে?”

“মাথার ভেতর একগাদা প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর৷ আর এটা জানা আমার সেই ঘটনা থেকে পুরোপুরি বের হবার জন্য খুব দরকার। ধোঁয়াশা কেটে গেলেই তো আলো আসবে, তাই না?”

“হুম।”

“আপনি বলতে পারেন?”

“নাহ।”

“কেন?”

“কারন আমি বা কেউই ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না। নিজের সম্পর্কে অলমোস্ট কিছুই বলত না সে। আমরা ওর ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলত না দেখে একসময় জিজ্ঞেস করাও ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ ওর পরিবারে কে কে আছে সেটাও জানতাম না। ও এখানে একা একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকত। সে ধনী ছিল এটা বুঝতাম, আর কোনো ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না, এখনো নেই।”

“তার মানে আমি আপনার কাছেও কোনো সাহায্য পাব না? কোনো সূত্রও নেই যা দিয়ে ওর অতীত পর্যন্ত যাওয়া যাবে? কিছু অন্তত বলুন? ও কখনো মুখ ফসকে কিছু বলেনি বা এমন কারো সাথে পরিচয় হয়নি আপনার যে ওর সম্পর্কে জানতে পারে?”

“আপাতত মনে পড়ছে না। মনে পড়লে অবশ্যই বলব। অন্য বন্ধুদেরও জিজ্ঞেস করে দেখি যদি কারো মনে পড়ে।”

“আচ্ছা। ধন্যবাদ।”

_____________________________

মিহাদের সাথে দেখা হবার প্রায় দিন পনেরো পর মিহাদের কল এলো। সে জানাল এমন একজনকে পাওয়া গেছে যে আরাফের সম্পর্কে জানে।

মিহাদের দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে জয়া এক বৃদ্ধা মহিলার সাক্ষাৎ পেল। মিহাদ জানাল সে আরাফের সেই পুরানো ফ্ল্যাট, যেটাতে সে ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে থাকত সেখানে খোঁজ নিয়ে সেখানকার রেজিস্ট্রার থেকে আরাফের একটা পারমানেন্ট এড্রেস পেয়েছে। সেই ঠিকানায় গিয়ে এই বৃদ্ধার দেখা পাওয়া গেছে যে আরাফের পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, সম্পর্কে ওর ফুপু হন।

মিহাদ বৃদ্ধাকেও সব খুলে বলেছে। জয়ার পরিচয় দিয়েছে। বৃদ্ধা জয়াকে পাশে বসিয়ে অনেক আদর করলেন। তারপর থেমে থেমে অনেক কিছুই বললেন আরাফের অতীত সম্পর্কে। যার সারমর্ম অনেকটা এমন,

আরাফ ওর মা বাবার একমাত্র ছেলে ছিল। একমাত্র সন্তান হবার কারনে তার প্রতি আদর যেমন মাত্রাতিরিক্ত ছিল তেমনই শাসনও ছিল প্রচন্ড। আরাফের মা কঠোর ধরনের মহিলা ছিলেন। তিনি আরাফকে ছোটো ছোটো ভুলের জন্যও বড় ধরনের শাস্তি দিতেন। কখনো বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দেয়া, কখনো সারাদিন পড়ার চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখা, আবার কখনো সারাদিন না খাইয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখা এসব ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। ছেলেটার মনে ভীষণ চাপ পড়ত। ওর মাকে বুঝিয়েও কাজ হতো না৷ এদিকে আরাফের বাবা ছিলেন ব্যস্ত মানুষ। তার সব মনোযোগ ছিল কাজে। বাড়ি গাড়ি সম্পত্তি করা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছেলের ব্যাপারটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন স্ত্রীর ওপর। স্ত্রী পুত্রকে সময় দিতেন খুবই কম। সারাক্ষণ নিজের আলাদাই একটা জগতে থাকতেন। এভাবে চলছিল ওদের জীবন।

আরাফের মা ছিলেন প্রচন্ড সুন্দরী। তার আরাফের প্রতি এমন কঠোর ব্যবহারের কারন কিছুটা ওর বাবার অবহেলাও ছিল। স্বামীর থেকে মনোযোগ কিংবা ভালোবাসা কিছুই না পাওয়া মহিলা দিন দিন কঠোর হয়ে উঠছিলেন। তবে তার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায় আরাফ যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন। আরাফকে পড়াতে আসত এক ছেলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ত ছেলেটা৷ আরাফের মা তখন এত বড় ছেলের মা হলেও তাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না৷ খুবই কমবয়সী মনে হতো। কেমন করে সে আরাফের শিক্ষকের প্রতি দুর্বল হয়ে যায়, কেমন করে দু’জনের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় তা কেউই বুঝতে পারেনি৷ ফলশ্রুতিতে একদিন আরাফের মা সেই ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায়।

আরাফের তখন বড় একটা ধাক্কা লাগে। যে মা তাকে সারাজীবন নীতির পাঠ শিখিয়েছেন সেই মা এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে এটা সে বহুদিন মেনে নিতে পারেনি।

শুধু আরাফই নয়, তার বাবাও ভীষণ ভেঙে পড়েন৷ কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে শুরু করেন৷ আরাফের তখন আরো বেশি করে মন ভাঙতে থাকে। বাবা সময় না দিলেও বাবাকে সে বড় ভালোবাসত। মায়ের কারনে বাবার এমন অবস্থা হয়েছে এটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত। দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছিল সে।

এরপর একদিন বাবাও মারা গেলেন। আরাফ একা হয়ে গেল। ফুপু তখন তার শ্বশুরবাড়িতে ব্যস্ত। একা আরাফ শহরে চলে গেল। ওর বাবা অনেক টাকাপয়সা রেখে গিয়েছিলেন৷ একটা ফ্ল্যাট কিনে সে একাই থাকতে শুরু করল। এরপর ফুপুর সাথেও খুব একটা যোগাযোগ সে রাখেনি।

তারপর তো ওর জীবনেরই শোচনীয় পরিসমাপ্তি ঘটল।

______________________________

“ম্যাম, সবই তো শুনলেন। কিছু বলতে চান?” জয়া প্রশ্ন করল।

মালিহা জাহান স্মিত স্বরে বললেন, “মানুষের ব্যবহার আসলে নির্ভর করে সে কেমন পরিবেশ থেকে এসেছে তার ওপর। ভালো পরিবার, পরিবেশ থেকে আসা মানুষ এক ধরনের হয়, আর ভাঙা পরিবার থেকে আসা মানুষ হয় আরেক রকম। আবার এই পরিবারই কারো কারো পুরো পার্সোনালিটিই বদলে দিতে পারে। যেমনটা হয়েছে আরাফের ক্ষেত্রে। ওর তোমার সাথে ব্যবহারের পুরোটাই ওর অতীত জীবনের প্রতিফলন ছিল।

সে তোমার ছোটো ছোটো অন্যায়েও প্রচন্ড রেগে শাস্তি দিত, যেটা ওর মা ওর সাথে করত। ও বিশ্বাসঘাতকতার ভয় পেত, সে কারনেই মিহাদের সাথে সামান্য হেসে কথা বলা বা তার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে একটা পুরুষ ডাক্তারের প্রবেশ সে সহজ চোখে দেখতে পারেনি। ভেবেছে তার মায়ের মতো তুমিও স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে পরকীয়ায় জড়িয়ে যাবে।”

“আর আমাকে জোর করে বিয়ে করার ব্যাপারটা?”

“তুমি তো একটা বাচ্চার মা। বাচ্চার জেদের সাথে নিশ্চয়ই পরিচিত? কখনো কখনো এরা কোনো জিনিসের জন্য জেদ করে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করে। আবার জিনিসটা পেয়ে গেলে সাথে সাথে কান্না বন্ধ হয়ে যায়।”

“জি। আমার মেয়েও করে।”

“যেসব বাচ্চা ধনী পরিবারে জন্ম নেয়, তাদের জেদ করার প্রবণতা বেশি থাকে। কারন চাইলে তারা সহজে জিনিসটা পেয়ে যায়৷ আর যারা অতিরিক্ত আদরে বড় হয় তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একসময় মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়৷ এরা বুঝে যায় চাওয়ামাত্র সব পাওয়া যাবে, তাই এরা প্রতিটা জিনিস নিয়ে জেদ করতে শুরু করে। যেহেতু আরাফ তার বাবা মায়ের আদরের সন্তান ছিল আর ধনীও ছিল তাই তার ছোটোবেলা থেকেই তার জেদ বেশি ছিল। তোমার থেকে রিজেক্ট হওয়াটা সে মেনে নিতে পারেনি। বিয়ে করে ছেড়েছে, সেটা যেভাবেই হোক।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল জয়া৷ “অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। আমার সব ধোঁয়াশা কেটে গেছে। এখন আর কোনো প্রশ্ন, আর কোনো খটকা আমার মনকে পেছনে নিয়ে যেতে পারবে না৷ এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পালা।

______________________________

জয়ার মেয়ে নির্ঝরা ক্লাস টেনে উঠেছে সদ্য। বাবা আর মায়ের রূপ মিলে অসম্ভব সুন্দর চেহারা হয়েছে তার। আর সেজন্যই জয়া ওকে নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকে। চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে। সময়টা ভালো না। কোথা থেকে কী হয়ে যায় তার কোনো ঠিক নেই। সে আরাফের ঘটনা শোনার পর থেকেই মেয়েকে নিয়ে ভীষণ যত্নশীল হয়ে উঠেছে। ওর মানসিক দিকটার আরো বেশি করে যত্ন নিতে শুরু করেছে। এখন জয়া অনেকটা ওর বন্ধুর মতো। নির্ঝরা মনের সব কথা আগে জয়াকেই বলে।

ইদানীং নির্ঝরার খুব বই পড়ার শখ জেগেছে মনে। জয়া খুশি হয়েই ওকে বইপত্র কিনে দেয়। আবার কী পড়ছে সেটা খেয়ালও রাখে।

একটা বই নিয়ে নির্ঝরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কয়েকদিন পড়ল। জয়া খেয়াল করল বই পড়ার সময় মেয়েটার চোখমুখ অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে কল্পনায়।

তার কিছুদিন পর নির্ঝরা স্কুলে থাকাকালীন সময়ে জয়া নির্ঝরার একটা খাতার কোণায় লেখা দেখতে পেল, “প্রতীক! এক স্বপ্নের পুরুষের নাম!”

প্রতীক নামটা চেনা চেনা লাগছিল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর মনে পড়ে গেল জয়ার। নির্ঝরা যে বইটা পড়ছিল সেটা চরিত্র প্রতীক।

নির্ঝরা স্কুলে থাকতে থাকতেই সেদিন পুরো বইটা পড়ে শেষ করল জয়া। বইয়ের কাহিনীর সাথে জয়ার নিজের কাহিনী যেন অনেকটাই মিলে গেছে। তবে বইতে সেই টক্সিক এবিউসিভ ছেলেটাকে প্রচন্ডরকমের রোমান্টিক হিরো হিসেবে দেখানো হয়েছে, এমনকি শেষে হ্যাপি এন্ডিংও দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তো এমন মানুষগুলোর সাথে হ্যাপি এন্ডিং হয় না! নির্ঝরার কি তবে এমন মানুষকে স্বপ্নের পুরুষ বলে মনে হচ্ছে? অবশ্য মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক না। গল্পে চরিত্রটাকে এত বেশি আকর্ষণীয় আর সুপুরুষ আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে যে যে কারোই মনে হতে পারে এরকমই তো চাই। জয়া নিজের জীবন দিয়ে জানে, এসব শুধু গল্প উপন্যাসেই ভালো লাগে। বাস্তবে না। আর এই স্বপ্নের জগত বাস্তবটাকেই বরং ধোঁয়াশা বানিয়ে দেয়। একটা কাল্পনিক জগত তৈরি করে দেয় পাঠকের মনে। আর বাস্তবতা যখন এই কাল্পনিক জগতে এসে ধাক্কা দেয় তখন ভেঙেচুরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

জয়া ভেবেছিল তার অতীতের ঘটনা নির্ঝরাকে বলবে ওর বয়স আঠারো হবার পর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। এখনই উপযুক্ত সময় বাস্তবতার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেবার।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু