#পাপমোচন (৮ম পর্ব)
-রুদ্ধশ্বাসে একদৃষ্টিতে ওসি’র মৃত শরীরটার দিকে তাকিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আছি। পায়ের কাছে র*ক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধতে এখন ড্রইংরুমের একতৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে ভিজে গিয়েছে! পুরো বাড়ি জুড়ে পিন পতন নিরবতা ছেয়ে রয়েছে। নিজের নিঃশ্বাসের বেগ নিজের কানেই বাড়ি খাচ্ছে অনবরত। বুকটা হাপরের মত উঠানামা করছে! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে।
-যেই আমি কখনো স্বইচ্ছায় একটা পিঁপড়া পর্যন্ত মারিনি,সেই আমি আজ একটা জলজ্যান্ত মানুষকে…
হুশ ফিরতেই ভয়ে আতকে উঠলাম আমি। প্রতিশোধের তাড়নায় একজন পুলিশের লোককে এভাবে নৃশংসভাবে মে*রে ফেলেছি! জানাজানি হলে আমার অবস্থাটাও আমার পরিবারের মতনই হবে।
এমন সময় কানে কানে কেউ একজন অস্ফুট স্বরে জানান দিলো,’ শ্রাবণ এখন এসব ভাববার সময় নেই। রাত পোহানোর আগেই লাশটার একটা গতি করে জলদি এই বাড়ি থেকে পালাতে হবে।’
চটক ফিরতেই নড়েচড়ে উঠলাম। ভোর হওয়ার আগেই লাশটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে,যাতে করে ওসি’র মৃত্যুটাকে সবার দূর্ঘটনায় মৃত্যু বলে মনে হয়। চটজলদি উঠে দাঁড়ালাম এবার। তারপর ওসি’র গলা থেকে তারটা খুলে নিয়ে মৃত শরীরটাকে টানতে টানতে কিচেনের ভিতরে রেখে দিয়ে ড্রইংরুমের মেঝেতে থাকা রক্তগুলো ঠিকঠাকমত পরিস্কার করে নিলাম। তারপর রক্তমাখা কাপড়টা রুদ্র সেনের বুকের উপর রেখে একটা সরু সুতো কেরোসিনে চুবিয়ে নিয়ে সুতোর এক মাথা সিলিন্ডারের মুখে রেখে অন্য প্রান্ত কিচেনের জানালার বাইরে ফেলে দিলাম।
তারপর গ্যাস সিলেন্ডারের পাইপটাতে ছোট্ট একটা ছিদ্র করে দিলাম। বের হয়ে আসার সময় আরও একবার রুদ্র সেনের দিকে তাকালাম। চিরনিদ্রায় ঘুমোচ্ছেন ওসি সাহেব।
কিচেনের দরজাটা ঠেলে দিয়ে দ্রুত পায়ে যে পথ দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছিলাম সেই পথেই আবার বেরিয়ে গেলাম। তারপর কিচেনের বাইরে রাখা সুতোর মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলাম বাড়ির বাইরে।
পরদিন লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লো ওসি রুদ্র সেনের মৃত্যুর খবর। জোড়পুকুর থানার ওসি ‘রুদ্র সেন’ কিচেনে থাকা সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে মারা গিয়েছে।
খবরটা শুনে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটজুড়ে। সবে মাত্র একজনের পাপমোচন হয়েছে। বাকি তিন সদস্যেরও পাপমোচন হবে একে একে।
এরপর কেটে গিয়েছে আরও একসপ্তাহ। এই সাতদিনে
ফাইয়াজ হুসাইনের সব খবরা খবর নিয়েছি। কোথায় যায়,বাড়িতে কে কে থাকে। এমনকি তাঁর ড্রাইভার আর কেয়ারটেকারেরও।
কিন্তু এখান থেকে তার নাগাল পাওয়া দুষ্কর নয় দুঃসাধ্যও বটে। একটা কাজের বাহানায় কয়েকদিনের জন্য রিয়াদ ভাইয়াদের বাসায় থাকবো মনস্থির করলাম।
প্লান মোতাবেক একদিন সন্ধ্যার সময় গিয়ে হাজির হলাম রিয়াদ ভাইয়াদের বাসায়। বেশ বড়সড় একটা বাড়ি নিয়েছে! আংকেল- আন্টি দুজনেই বেশ খুশি হলেন আমাকে দেখে। তবে রিয়াদ ভাইয়ার মুখটা পানসে দেখালো খানিকটা।
হয়তো আমার এভাবে না বলে হঠাৎ করে চলে আসাটা তার পছন্দ হয়নি। বাড়ির মাঝখানের ঘরেটাতে আমার থাকার বন্দবস্ত করা হলো। তবে খানিকটা বিশ্রাম নেওয়ার পর যখন ছাদে গিয়ে খালি হয়ে পড়ে থাকা একটা চিলেকোঠার ঘর দেখলাম,তখন চিলেকোঠার ঘরটাতে থাকার কথা বলতে আন্টি প্রথমে একটু সংকোচ করলেও রাজি হয়ে গেলেন। বেশ সুন্দর আর মস্তবড় ছাদের ঠিক মাঝখানে এই চিলেকোঠার ঘরটা। ছাদের উপরে অসংখ্য ফুল-ফলের গাছ লাগানো। অনেকদিন পর যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু শ্বাস নিতে গিয়েই মনে পড়লো এখনো আমার অনেক কাজ বাকি। কাজগুলোর সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত বুকের উপর চেপে থাকা ভারি পাথরটা কোনভাবেই নামবে না।
ফাইয়াজ নামের লোকটাও এই শহরেই থাকে। সিএনজি চেপে গেলে মিনিট বিশেকের রাস্তা। লোকটার বাড়ির ঠিকানা গ্রামের বাড়িতে থাকতেই জোগাড় করে নিয়েছিলাম,তাই এখানে আসার পর আর খুব একটা বেগ পেতে হলো না। আন্টিকে একটু ঘুরে আসার কথা বলে সে রাতেই একটা সিএনজি চেপে রওনা দিলাম ফাইয়াজ সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়িটার সামনে এসে সিএনজিটা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একবার বাড়িটাকে দেখলাম।
বিশাল মস্তবড় আলিশান বাড়ি!
গেইটের বাইরে কাঠের একটা টুলের উপর লাঠি হাতে ঢুলুঢুলু চোখে শীর্ণকায় দেখতে একজন বসে আছে।
আমাকে বাড়িটার সামনে নামতে দেখে শীর্ণকায় সেই লোকটা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ভ্রু কুচকে আমার দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো। আমি লোকটাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পকেট থেকে রিয়াদ ভাইয়ার বাসার ঠিকানাটা বার করে জানতে চেয়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম,’ আচ্ছা এই ঠিকানাটা একটু বলে দিতে পারবেন?’
লোকটা আমার হাতের কাগজটা তার হাতে নিলো। তারপর শার্টের পকেট থেকে একটা চশমা বার করে চোখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর বললো,’ না কইতে পারুম না।’
‘একটু দ্যাখেন না। এইখানে আমি নতুন,আজই এসেছি।’
লোকটা এবার খানিকটা খিটখিটে হয়ে বললো,’ আরে কইলাম তো চিনিনা। যাও তো এইহান থেইক্কা। মালিক দ্যাখলে ঝামেলা করবো।’
কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা, লোকটাকে বার-বার ঠিকানাটা ভালোমত দেখে চিনতে পারে কি না জোর দিতে থাকলাম ক্রমাগত। লোকটা আরও রেগেমেগে গলার স্বর দৃঢ় করে আমাকে হাটানোর চেষ্টা করতে লাগলো গেইটের সামনে থেকে।
লোকটার চিল্লাচিল্লি শুনে এবার ভিতর থেকে একজন মাঝবয়েসী লোক বেরিয়ে এলো। দোহারা শরীর, ফর্সা গোলগাল মুখয়ব।
আমাকে দেখে দারোয়ানের কাছে জানতে চেয়ে বললো,’ কি হয়েছে বদরুল? চিৎকার চেচামেচি করছো কেন?’
দারোয়ান এবার খানিকটা গলার স্বর নরম করে নিয়ে বললো,’ দ্যাখেন না,এই ছেলেটা সেই কখন থেইক্কা একখানা কাগজ দিয়া বলতাছে ‘ঠিকানাটা বলে দেওনের লাইগা। আমি ঠিকানাটা দেইখা বললাম চিনিনা,তারপরও শুনেনা।’
লোকটা এবার এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। তারপর একপলক আমার দিকে তাকিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললো,’ কোই দেখি কাগজটা।’
লোকটার হাতে কাগজটা দিতেই কাগজে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো,’ এইটা তো এখানকার ঠিকানা নয়। তুমি ভুল ঠিকানায় চলে এসেছো। একটা সিএনজি ধরে তারপর সিএনজি ড্রাইভারকে ঠিকানাটা দেখালেই নিয়ে যাবে।’
‘ওহ আচ্ছা। ধন্যবাদ ভাই।’
তারপর দারোয়ানের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললাম,’ এই ভদ্রলোকের থেকে ব্যবহারটা শিখে নিয়েন। দ্যাখেন মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়। রাত দেখে একটু সাহায্য চেয়েছিলাম,কি দুর্ব্যবহারটায় না করলেন তারপর।’
তারপর পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম,”ভাইয়া আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ। আমি এই বাড়ির কেয়ারটেকার। ‘
কথাটা শুনতেই সুপ্ত ক্রোধে চোখ জোড়া জলজল করে উঠলো আমার। লোকটাকে আরও একবার ভালোমতো দেখে নিলাম এবার।
তারপর জোর করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললাম,’ ভাইয়া আমি এই শহরে নতুন। তেমন কিছুই চিনিনা। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব ভালো মনের মানুষ। আপনার মোবাইল নাম্বারটা পাওয়া যাবে? ইয়ে মানে, আসলে এইখানে তো কাউকে চিনিনা আমি। রাস্তায় যদি আবার কোনো বিপদ আপদ হয়,তাই বলছিলাম আরি কি।’
লোকটা একগাল হেসে বললো,’ আরে সমস্যা নাই। আচ্ছা তুলো, বলছি।’
তারপর লোকটার নাম্বারটা নিয়ে বললাম,’ ভাইয়া আপনার নাম?’
‘জাকারিয়া ডাকনাম জব্বার।’
নামটা বলার পর আমাকে তাড়াহুড়ো করে সরে দাঁড়াতে বললো লোকটা। আমি গেইটের মুখ থেকে সরে দাড়াতেই দেখলাম একটা সাদা রঙের গাড়ি এসে স্পিড কমিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের সবাইকে গেইটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা লোকটা গ্লাস নামিয়ে বললো,’ জব্বার ভাই কি হয়েছে?’
জব্বার নামের লোকটা উত্তর দিলো,’ তেমন কিছু না। এই ছেলেটা একটা বাসার ঠিকানা খুজে পাচ্ছিলো না। তাই ঠিকানাটা বলে দিলাম।’
ড্রাইভার লোকটা এবার আর কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়িটা নিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে গেলে আমিও লোকটাকে আরও একবার ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে।
সেদিনের পর থেকে সময় অসময়ে জব্বার নামের লোকটার সাথে কানেক্টেড থাকার জন্য রোজ একবার হলেও কল দিয়ে খোঁজখবর নিতে লাগলাম।
এমন অমায়িক একজন মানুষ সে-ও কি-না আমার আপুর সাথে নোংরা কাজটা করেছিলো! ভাবতেই আমার প্রতি তার দেখানো সকল সহানুভূতিগুলো ক্ষোভে পরিণত হয় তখন। এই কয়দিনে লোকটার সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আমাকেও বেশ স্নেহ করে ‘ছোটভাই’ বলে ডাকে।
চারদিন পর জব্বার ভাইকে কল দিয়ে বললাম,’ ভাইয়া আমার একটা চাকরি হয়ে গিয়েছে। যেহেতু এই শহরে আপনিই একমাত্র আমার পরিচিত আর আমার বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন,তাই আজকে আপনাকে ট্রিট দিবো। আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না।’
জব্বার ভাই নানান কাজের ব্যস্ততা দেখালেও শেষমেশ আমার চাপাচাপির কাছে রাজি হয়ে গেলো। তাকে একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়ে ডিনারের জন্য ইনভাইট করে দিলাম।
জব্বার মিয়া একগাল হেসে আমার ডিনার একসেপ্ট করলে আমার ঠোঁটে পাষবিক সেই হাসিটা ফুটে উঠলো আবার।
এতদিন পর দ্বিতীয় শিকারটাও আজ শিকার হতে চলেছে।
জব্বার মিয়া তার সব কাজ মিটিয়ে প্রায় দশটা নাগাদ রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছালো। ঘাতকের মত পথ চেয়ে থাকা আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাকে দেখতে পেয়ে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জব্বার ভাইকে সাদরে আহ্বান জানিয়ে অপর চেয়ারটিতে বসার অনুরোধ করতেই তার মুখে চিরাচরিত হাসিটা ফুটে উঠলো।
রেস্টুরেন্টের একজনকে বলে এবার অর্ডারের খাবার গুলো আনাতেই জব্বার মিয়া চোখ কপালে তুলে বললো,’ আরে তুমি তো দেখছি একবারে এলাহি কান্ড করে ফেলেছো! এতকিছু করার কি দরকার ছিলো?’
‘আপনার জন্য যতই করি কম হয়ে যায় জব্বার ভাই। আপনি আমার জন্য যা করেছেন,তা নিজের লোকও করেনা। নিন আগে খেয়ে নিন।’
প্রথম দিকে জব্বার মিয়া চুপচাপ থেকে খাচ্ছিলেন,পরে আমি একটা প্রসঙ্গ ওঠাতেই তিনি একদম সহজ গিয়ে অনর্গল বলতে লাগলো। দু’জন মিলে নানান গল্পগুজবে রাতের ডিনার শেষ করলাম। জব্বার ভাই তার না বলা অনেক কথায় আমার সাথে সেয়ার করলো। আমিও ফাইয়াজ হুসাইন সহ তার ড্রাইভারের ভিতরের খবর জেনে নিলাম কথার ছলে। জব্বারের তিনকুলেও কেউ নাই। টাকার পিছে ছুটতে গিয়ে বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি তার। তবে তাতে কি, রোজ রাতে তার নিত্যনতুন মেয়ে সঙ্গ না পেলে নাকি সেদিন রাতে ঠিকমত ঘুমই হয়না। শহরের নিষিদ্ধ গোলি গুলো তার একবারে ঠোঁটস্থ। আজও আমার সাথে ডিনার শেষ করে নিষিদ্ধ তল্লাটে হয়ে তারপর বাসায় ফিরবে।
ডিনার সেরে দু’জন মিলে একটা সিএনজিতে উঠে বসলাম এবার। জব্বার ভাইয়ের আবার রাতের খাবারের পর পান খাওয়ার অভ্যাস। পকেট থেকে একটা পান বার করে তার সামনে এগিয়ে ধরে বললাম, ‘ ভাই আপনার দশ পদের জর্দা দিয়ে পান।’
জব্বার মিয়া অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। তারপর ফ্যাচ করে হেসে দিয়ে বললো,’ আরেহ তুমি দেখি আমার সবকিছুই জানো। আমিও মনে মনে পান খাওয়ার কথাটায় ভাবছিলাম। রাতে ভরপেট খাওয়ার পর একটা পান না খেলে ঠিক জমেনা বুঝছো। দাও দাও,দাঁতের নিচে দিয়ে পিষে ফেলি ওটাকে।’
কাগজে মোড়ানো পানের প্যাকেট টা খুলতেই আসতে করে একটা ফু দিলাম। জব্বার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো তারপর হাত থেকে পানটা মুখে পুরে নিয়ে চোখ বন্ধ করে একমনে চিবোতে লাগলো। সিএনজিটা খানিকটা পথ যাওয়ার পর জব্বার ভাইকে ডাকলাম,’ জব্বার ভাই, ও জব্বার ভাই।’
জব্বার মিয়া কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো আমার দিকে। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে উদ্ভ্রান্তের মত বসে রইলো চুপচাপ।
‘জব্বার আমরা এখন কোথায় যাব বল তো?’
জব্বার মিয়া নেশা জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দিলো,’ কোথায় যাব বল তো?’
বুঝলাম স্কোপোলামিনের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।
ড্রাইভারকে অন্য একটা ঠিকানা দিয়ে সেদিকে সিএনজিটা নিয়ে যাওয়ার জন্য বলতেই সিএনজি বাঁক মুড়ে সেদিকে ছুটতে লাগলো এবার।
মিনিট বিশেক পর সিএনজিটা আমার দেওয়া ঠিকানায় এসে পৌঁছালে সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জব্বার ভাইকে আমার সাথে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
রাত তখন প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। দুজন পাশাপাশি হাঁটছি। তবে জব্বার মিয়ার মুখে কোনো কথা নেই। সে কাঠের পুতুলের মত আমাকে অনুসরণ করে আমার সাথে সাথে পা ফেলে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর জব্বারকে নিয়ে একটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম এবার। তারপর স্কোপোলামিনের নেশা কাটার আগেই জব্বারকে একটা চেয়ারের সাথে শক্ত দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে নিলাম।
জব্বারের তখনো ঘোর কাটেনি। একটা ধারালো ছুরিতে শান দিতে দিতে জব্বারকে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। জব্বার সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই খুব সহজভাবে দিয়ে দিলো। কিন্তু সুমনা নামটা মুখে নিতেই জব্বার যেন এবার খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো।
পুনরায় তাকে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু ততোক্ষণে জব্বারের উপর প্রয়োগ করা স্কোপোলামিনের কার্যকারিতা ধিরে ধিরে কমতে শুরু করেছে। জব্বারের এবার পুরোপুরি হুশ ফিরতেই সে যখন দেখলো তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে,তখন আমার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্জন করে উঠলো।
আমি মুখের কাছে একটা আঙুল দিয়ে শশশশ করে শব্দ করে তাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিতেই সে আরও অস্থির হয়ে উঠলো। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে হাতে থাকা ধারালো ছুরিটা সোজা জব্বারের বাম ঊরুর উপরে বসিয়ে দিলাম এবার। জব্বার গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করতে গেলে মুখ চেপে ধরে কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম,’ কিরে জব্বার এইটুকুতেই এত অস্থির হয়ে গেলে চলবে কীভাবে? সামনে তো তোকে নিয়ে অনেক খেলা বাকি আছে এখনো। একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে তো। এখান থেকে তুই চিৎকার করে গলার রগ ছিড়ে ফেললেও কেউ তোর চিৎকার শুনতে পাবেনা।’
জব্বার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’ শ্রাবণ এমন পাগলামি কেন করছিস ভাই আমার? আমি তো তোর কোনো ক্ষতি করিনি। কেন বেঁধে রেখেছিস এভাবে?’
জব্বারের কথাগুলো শুনে হিসহিসিয়ে বলে উঠলাম,’ না তুই কেন ক্ষতি করবি আমার। তবে তিনমাস আগে একটা মেয়েকে অপহরণ করার পর টানা ছয়দিন ড্রাগস দিয়ে সবাই মিলে গণধর্ষণ করেছিলিস মনে পড়ে কিছু?’
‘আমি কোনো মেয়েকে অপহরণ করিনি। কি বলছিস এসব? দ্যাখ ভাই তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কোনো মেয়েকে অপহরণ করিনি।’
প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একটা ছবি বার করে জব্বারের সামনে তুলে ধরে বললাম,’ দ্যাখ তো এই মেয়েটাকে চিনতে পারছিস কি-না। ‘
জব্বার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের যন্ত্রনা লাঘব করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বললো,’ আমি সত্যিই চিনিনা। কে ওই মেয়ে? তোর কোথাও ভুল হচ্ছে শ্রাবণ।’
বাম ঊরুতে বিঁধিয়ে রাখা ছুরিটা তুলে নিয়ে এবার ডান ঊরুতে স্ব জোরে বসিয়ে দিতেই জব্বার ঠোঁট কামড়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে বললো,’ শ্রাবণ সত্যি আমি ওই মেয়েকে চিনিনা। তবে একবারই ওই মেয়ের সাথে ছিলাম আমি। কিন্তু ওই মেয়েকে কোথায় থেকে নিয়ে এসেছে,কোথাকার কোনকিছুই জানতাম না বিশ্বাস কর ভাই আমার।’
‘ওই মেয়েটা আমার বোন। তোদের একটুখানি সুখের জন্য আমি আমার গোটা পরিবারটাকে হারিয়েছি।
তোরা তো নিত্যদিন নিষিদ্ধ পল্লিতে যেতিস, তারপরও কেন আমার সহজ সরল বোনের জীবনটাকে নষ্ট করতে গেলি? বোনের মৃত্যুর পর ন্যায় বিচার চেয়ে টানা তিনমাস থানার চক্কর কেটেছি তারপরও বিচার পাইনি। তোদের টাকার কাছে শেষমেশ থানার ওসিও বিক্রি হয়ে গিয়েছে।’
‘শ্রাবণ ভাই আমার, আমি এসবের কোনকিছুই জানতাম না বিশ্বাস কর। রুহুল সেদিন ওই মেয়েটাকে গাড়িতে করে স্যারের বাগান বাড়িতে এনেছিলো। রুহুল প্রায় দিনই স্যারের জন্য মেয়ে নিয়ে আসতো। তারপর একরাত থেকে মেয়েগুলো স্যারকে খুশি করে পরদিন সকালে আবার চলে যেতো। কিন্তু সেদিন ওই মেয়েটাকে আনার পর কেন জানি স্যার মেয়েটাকে আর যেতে দিলেন না।
আমাকে সকালে ডাক দিয়ে বললেন, মেয়েটাকে চোখেচোখে রাখতে। কিন্তু মেয়েটা কোনভাবেই থাকতে চাইছিলো না। তাই স্যারের কথামত মেয়েটাকে ড্রাগস ইনজেক্ট করে নেশাগ্রস্ত করে রাখতাম। এর বেশি কিছু আমি জানিনা। ‘
‘আর কোনকিছু যখন জানিস না, তখন আর তোকে বাঁচিয়ে রেখে কি করবো আমি? একটা কাজ করি তোকেও ওসি’র কাছে পাঠিয়ে দিই কি বলিস? দুজন মিলে গল্পগুজবে থাকবি তখন।’
কথাগুলো শুনে জব্বার মিয়া এবার প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে মরিয়া হয়ে উঠলো…
চলবে..
#আশিক_মাহমুদ