পাপমোচন পর্ব-০৯

0
168

#পাপমোচন (৯ম পর্ব)

-জব্বারের আকুতিভরা মুখের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রুর হাসলাম আমি। তারপর উদ্ভ্রান্তের মত মাথা দুলাইতে দুলাইতে পাশের একটা ঘরে ঢুকে, একটি ফাস্ট-এইড বক্স আর টুল বক্স নিয়ে এসে জব্বারের চেয়ারের সামনে রাখলাম।

বক্স দুটো দেখে জব্বারের চোখমুখে যেন রাজ্যের সমস্ত আতংক এসে জমা হলো এবার। ভয়ের চোটে মরিয়া হয়ে হাতের বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো সে।
মেঝেতে রাখা বক্স দুটোর সামনে হাটু ভেঙে বসলাম আমি,তারপর টুল বক্স থেকে একটা চাইনিজ প্লাস হাতে তুলে নিলাম এবার। প্লাসটা দু আঙুলের মাঝে নিয়ে জব্বারের দিকে শীতল চাহনিতে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম,
জব্বারের চোখেমুখে প্রাণে বাঁচার তীব্র আকুলতা এসে ভর করেছে। চাপা স্বরে ‘ হুসসসসস’ করে জব্বারকে চুপ করতে বলে জব্বারের ডান হাতটা আমার হাতে নিতেই জব্বার মিনতির স্বরে বলে উঠলো,’ শ্রাবণ ভাই আমার,এমনটা করিস না। আমি আর জীবনেও কোনো মেয়ের দিকে তাকাবো না। আমি তো তোর ভাইয়ের মত তাই না বল?
আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে এবারের মত ক্ষমা করে দে। আমাকে প্রাণে মারিস না ভাই আমার।’

ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে দু পায়ে ভরে দিয়ে উঠে বসলাম আমি,তারপর প্লাস দিয়ে জব্বারের ডান হাতের মধ্যমার নখটা ধরে ধিরে ধিরে টান দিতেই জব্বার মরণ যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বললো,’ এভাবে কষ্ট দেওয়ার থেকে ছুরিটা দিয়ে আমায় মেরে ফেল। তারপরও এত কষ্ট দিস না আমায়। এর থেকে মরণও ভালো। আমায় মেরে ফেল দয়া করে।’

জব্বারের কথাগুলো শুনে হিসহিসিয়ে হেসে উঠে বললাম,’ চুপ। একদম চুপ। তোকে তো এত সহজে মারবো না আমি। আমার আপুর চোখ থেকে ঝরে পড়া প্রতিটা চাপা কান্নার এক একটা ফোটার দাম তোদেরকে দিতে হবে। আপুও তোদের কাছে অনেক অনুনয়, বিনয় করে নিজের সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছিলো। দিয়েছিলি তোরা?’

জব্বারের মুখ থেকে এবার গোঙ্গানির সাথে চাপা কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে এলো।

বললাম,’ আচ্ছা এখন আমায় একটা কথা বল তো, আপুর লাগেজে সেদিন ওই বাচ্চা মেয়েটার লাশ কীভাবে এলো? কে ছিলো ওই বাচ্চাটা? বলবি নাকি নখটা উপড়ে ফেলবো?’

জব্বার কাতরাতে কাতরাতে ঠোঁট চেপে বিস্ময়ের চোখে জবাব দিলো,’ বাচ্চা! এখন আবার বাচ্চা কোত্থেকে আসলো? কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? বিশ্বাস করো আমি কোনো বাচ্চার ব্যাপারে জানিনা। আমি শুধুমাত্র তোমার আপুকে সেদিন রাতে বাগান-বাড়ি থেকে নিয়ে রুহুলের গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু আমি জানিনা,খোদার কসম।’

‘তারমানে বলবি না তাই তো।’

কথাটা বলে নখের মাথায় ধরে রাখা প্লাস টা ধরে খানিকটা টান দিতেই জব্বার অসহ্য যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠে বললো,’ আমাকে মেরে ফেল৷ তারপরও এত কষ্ট দিস না। আমি সত্যি বলছি, বাচ্চার ব্যাপারে কোনকিছু জানিনা আমি।’

‘জানিনা বললে তো হবেনা,একটু আগেই না বললি আপুকে সেদিন তুই নিজের হাতে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলি। তুই না জানলে ব্যাগটা কীভাবে আপুর কাছে এলো? সত্যিটা বলবি নাকি নখটাকে উপড়ে ফেলবো?’

‘আমি সত্যি বলছি লাগেজের ভিতরে বাচ্চা কীভাবে এলো জানিনা। হ্যাঁ সেদিন যখন মেয়েটাকে বাগান বাড়ি থেকে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম তখন তার সাথে একটা লাগেজও ছিলো। তবে লাগেজে কি ছিলো আমি জানতাম না। কারণ সেইদিন দিনের বেলায় আমি স্যারের বাসভবনে ছিলাম। সন্ধ্যায় স্যার ফোন দিয়ে বলেছিলো’ জব্বার বাগানবাড়িতে রাখা ওই মেয়েটাকে আজ রাতে ছেড়ে দিও।’ তখন স্যারের কথামত শুধু আমি মেয়েটাকে রুহুলের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু জানিনা আমি। বাড়ির ভিতরে কি হয়েছিলো না হয়েছিলো সেটা ওই বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করা মেয়েটা বলতে পারবে। কারণ সেদিন ওই পরিচারিকা মেয়েটায় লাগেজটা এনে আমার হাতে দিয়েছিলো।’

‘আপু মারা যাওয়ার আগে তার চিঠিতে লিখে গিয়েছিলো,লাগেজের ভিতরে নাকি টাকা ছিলো। কিন্তু আমরা আপুর মৃত্যুর দিন যখন লাগেজটা খুলি তখন ভিতরে শুধু বছর তিনেকের একটা বাচ্চা মেয়ের মৃত লাশ ছাড়া আর কোনকিছুই পাইনি। লাগেজে যদি বাচ্চায় থাকবে তাহলে আপু টাকার কথা উল্লেখ করেছিলো কেন?’

‘আমি সত্যিই জানিনা।’

‘আচ্ছা বুঝলাম। আচ্ছা আমাকে আরেকটা কথা বল তো,আপুকে যেদিন অপহরণ করে বাগান বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেদিন আপুর কাছে ঠিক কি কি ছিলো?’

জব্বার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললো,’ তেমন কিছুই না। থাকার ভিতরে শুধু একটা ছোট সাইজের হাত ব্যাগ ছিলো।’

‘তাহলে আপুর সেই হাত ব্যাগটা কোথায়?’

‘আমি সত্যিই কিছু জানিনা। হাত ব্যাগটা কোথায় গেলো আর বড় লাগেজটায় বা কেন দিয়েছিলো। সবকিছু ওই ড্রাইভার ব্যাডা রুহুল আর বাগান বাড়ির পরিচারিকাটা জানে। আমি তো শুধু স্যারের বাড়ি দেখাশোনা করতাম,ভিতরে কি হতো, কাকে আনতো এসবের কোনকিছুরই খোঁজ-খবর রাখতাম না আমি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে,তাহলে রুহুলকেই ডাকা যাক।’

জব্বারের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে জব্বারকে কন্ট্রাক লিস্ট দেখিয়ে তারপর রুহুলের নাম্বারে কল করলাম। কিন্তু নাম্বারটাতে কল দিতেই একটা যান্ত্রিবস্বর বলে উঠলো,’ আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

কলটা কেটে দিয়ে জব্বারের দিকে তাকাতেই জব্বার আবার বলে উঠলো, ‘লাগেজে কি ছিলো আমি সত্যিই জানিনা। সবটা ওই রুহুল বলতে পারবে। আমাকে ছেড়ে দে ভাই। অনেক কষ্ট হচ্ছে পা দুটোতে।’

কথাটা বলে হু হু করে ডুকরে কেঁদে ফেললো জব্বার।
জব্বারের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও কোনো মিথ্যে বলছে না। এমন মৃত্যু যন্ত্রনার মুখে কেউ মিথ্যা বলতে পারেনা। জব্বারের আকুতি মিনতি দেখে জব্বারের উপর কেমন মায়া হলো আমার। সিদ্ধান্ত নিলাম রুহুলকে না পাওয়া অব্ধি ওকে এখানেই বন্দী করে রাখবো। তবে ওর মুখ থেকে একটা জবানবন্দি নিয়ে রাখবো। কারণ এরা সাপের থেকেও ভয়ংকর। সুযোগ পেলেই ছোবল দিতে পিছুপা হবেনা।

কিছুক্ষণ জব্বারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর বললাম,’আচ্ছা তোকে একটা শর্তে ছেড়ে দিতে পারি…

আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই জব্বার বলে উঠলো,’ কি কথা কি কথা? আমি তোমার সব শর্ত শুনতে রাজি আছি।’

‘তোকে আগামীকাল আমি এখানকার থানায় নিয়ে যাব। তখন তুই যদি পুলিশকে তোদের সব অপকর্মের কথা নিজের মুখে স্বীকার করিস তাহলে তোকে আর মারবো না আমি।’

ব্যাথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখটাতে এবার সামান্য হাসি ফুটিয়ে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে,ঠিক আছে। আমি সবটা স্বীকার করে নিবো।’

‘ আপাততঃ এখন মোবাইলে সবটা স্বীকার কর। আমি রেকর্ডিং চালু করছি। তোর নিজের সকল অপকর্ম সহ বাকি দুজনারও সবটা খুলে বলবি।’

কথাটা বলে মোবাইলের ক্যামেরা অন করতেই জব্বার সহ বাকি দু’জন মিলে আপুকে বাগান বাড়িতে রাখা থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে আদ্যোপান্ত সবটা খুলে বললো।
বোনের উপর হওয়া অত্যাচারের বর্ণনা শুনে নিজের ভিতরের পিশাচসত্ত্বাটা যেন আবার জেগে উঠলো। এদের কে কি আদৌও মানুষ বলা চলে! এদেরকে মাফ করলে হয়তো মাফও আমাকে ব্যাঙ্গ করে হাসবে।

নিজের ক্ষুব্ধ রাগটাকে দমন করে নিয়ে বললাম,’আজকের রাতটা এখানেই থাক,কাল সকালে এসে তোকে থানায় নিয়ে যাব আমি।’

কথাগুলো বলে জব্বারকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বাড়িটাতে রেখে বেরিয়ে আসলাম আমি।

রাত করে বাসায় ফেরায় আংকেল কড়া ধমকের সাথে কারণ জানতে চাইলে,তাকে একটা কাজের কথা বলে কোনরকম বুঝিয়ে দিলাম। আংকেল প্রত্যুত্তরে কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করলেও, হুশিয়ারী দিয়ে বজ্রকণ্ঠে জানালো, ভদ্রলোকের বাড়িতে এভাবে এতরাতে ঢোকা চলবেনা। আমিও সুবোধ বালকের মত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম।

রাত তখন প্রায় শেষের দিকে। দু’চোখে ঘুম থাকলেও মস্তিষ্ক যেন ঘুমের সাথে বাধ সেধেছে আজ। চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে থাকা জানালাটা খুলে দিতেই হিমেল হাওয়া গায়ে এসে লাগলো। চারপাশটা এখন বেশ শান্ত আর নিস্তব্ধ এক মায়া পুরির স্বপ্নরাজ্যের মত নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। সেই রাজ্যের প্রতিটা প্রজা গভীর ঘুমের অতলে নিমগ্ন। কয়েকঘন্টা পরই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালাম। রাতের আকাশে এখন অসম্ভব এক মায়াবী স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। আকাশের বুকে জ্বলতে থাকা অজস্র তাঁরাগুলো এখন প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। নীল নদের মত শান্ত আকাশটাতে এখন হাতে গোনা কয়েকটা তাঁরা চাঁদের পাশে উঁকি মারছে।

জানালা থেকে মুখ সরিয়ে মাথার নিচে বালিশটা দিয়ে ভাবতে লাগলাম। যেভাবেই হোক সকাল হওয়ার পর জব্বারকে দিয়ে রুহুলকে ওই বাড়িতে আনতে হবে। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।

পরদিন সকালে আবার বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার সময় স্থানীয় থানায় গিয়ে আপুর মৃত্যুর ব্যাপারে থানার ওসি হাফিজুর রহমানকে সবটা খুলে বললে তিনি আমায় আশ্বস্ত করলেন ঠিকি তবে ফাইয়াজ হুসাইনকে গ্রেফতার করতে গেলে তার পক্ষে যে জোরালো প্রমাণ লাগবে সেটাও জানিয়ে দিলেন।
আমি প্রমাণ ব্যবস্থা করার কথা বলে ওসির মোবাইলটা নাম্বারটা নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে জব্বারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আবার।

যাওয়ার সময় জব্বারের জন্য কিছু খাবারও কিনে নিলাম। তারপর প্রায় দশটা নাগাদ আবার সেই বাড়িটার সামনে গিয়ে পৌঁছালাম। পরিত্যক্ত বাড়িটার চারপাশে সূর্যের ঝলমলে আলো খেলে বেড়াচ্ছে। শুকনো পাতার সরু রাস্তাটা ধরে সটান পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই বিস্ময়ে চমকে উঠলাম আমি।

চেয়ারে বসে থাকা জব্বারের সাদা শার্ট টা রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে! চোখজোড়া বিস্ফারিত, মুখটা সামান্য উপরের দিকে তোলা। গলায় কণ্ঠনালী বরাবর সরু একটা দাগ খানিকটা কালচে হয়ে ফুটে উঠেছে। সেখান থেকেই রক্তের ধারা নেমে এসেছে পুরো শার্টের উপরে। হাতে ধরে রাখা খাবারের প্যাকেট টা ফেলে দিয়ে ছুটে গেলাম জব্বারের কাছে।

গলার কাছটাতে কেউ ধারালো কিছু একটা দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে চিরে দিয়েছে! জব্বারের গায়ে হাত দিলাম, পুরো শরীরটা বরফের মত ঠান্ডা! চুইয়ে পড়া রক্তের বিন্দুগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হাত-পা বাধা অবস্থায় জব্বারকে এই নির্জন বাড়িতে কে খুন করলো?

‘এইযে ভায়া।’

হঠাৎ পিছন থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই লাঠির মত ভারি কিছু একটা সপাটে নেমে এলো কপাল বরাবর! অসহ্য যন্ত্রনায় দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম আমি। তারপর কপালে হাত চেপে ধরে সামনের দিকে তাকাতেই আরও একবার সেই ভারি বস্তুটা নেমে এলো মাথা বরাবর। আকস্মিক পর পর আঘাত খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম আমি।
মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ঝাপসা চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দন্ডায়মান মূর্তিটাকে একবার দেখার চেষ্টা করলাম,কিন্তু অসহ্য যন্ত্রনায় বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখা সম্ভব হলো না।
আবছা একটা মূর্তি মানবকে কয়েকপলক দেখার পর চোখের সামনে গাঢ় কালো অন্ধকার নেমে এলো মুহুর্তেই।
চলবে…

#আশিক_মাহমুদ