প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
468

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চব্বিশ

কাক যদি ময়ূরের মতো পাখা লাগায় তাহলেই কি সে ময়ুরের মতো হয়ে যায়? তার স্বভাব-চরিত্র তো আগের মতোই থাকে,, তাই না? তেমনটাই হচ্ছে এশার ক্ষেত্রে। প্রত্যন্ত এক অজঁপাড়া গায়ের মেয়ে এশা,,বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে আবরারের সাথে বিয়ে হওয়ার পরই জীবনে প্রথমবারের মতো শহরে পা দেয়। বিলাসিতা,, সৌন্দর্য ও চাকচিক্যতে ঘেরা এই শহরকে প্রথমবার দেখেই তার মনে হয়েছিলো সে কোন স্বপ্নপূরীতে চলে এসেছে। আস্তে আস্তে এই শহরের মোহে এমনভাবে আটকা পরে যায় যে আজ প্রায়ই এক বছর ধরে বাবার বাড়ি যায় না। সেখানে যাওয়া এখন তার জন্য এক কঠিন শাস্তি। পড়ালেখাও বেশি দূর করে নি। এসএসসি দেওয়ার পর কোন এক কারণে হুট করে তার আর আবরারের বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের পর আবরার তাকে পড়ালেখা আবার শুরু করতে বললেও সে করে না।তার না আছে চালচলনের ঠিক না আছে জ্ঞান।

_______________________________

রাতের আধার কেটে এক নতুন দিনের সূচনা হয়।আস্তে আস্তে সকলে ঘুম থেকে উঠতে শুরু করে,,কেউ কেউ নিজেশতর কাজেও চলে গেছে। হানিয়া ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজের সময়,,শোয়া থেকে উঠেই প্রথমে তার নজর যায় বিছানায় ঘুমন্ত জাভিয়ানের দিকে। কাল কখন এসেছে সে হানিয়া জানে না। জানার ইচ্ছাও আপাতত হচ্ছে না। শোয়া থেকে উঠে নামাজ পড়ে,,কিছুক্ষণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে নিচে যাবে তখনই জাভিয়ানের ঘুমু ঘুমু কণ্ঠ শুনে একটু চমকে যায়। জাভিয়ান হানিয়াকে বলছে–

–আমাকে নামাজের জন্য ডাকলে না কেন হানি?

হানিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে বলে–

–বিয়ের এতগুলো দিনে তো আপনাকে আগে কখনো নামাজ পড়তে দেখি নি তাই আজ যে হুট করে নামাজের জন্য ডাকা লাগবে বুঝতে পারি নি।

জাভিয়ান নিজের ঘুম সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া দিয়ে আলসেমি দূর করে। তারপর ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে–

–আজ থেকে রোজ ডাক দিবে। এতদিন শুরু করি নি বলে শুরু করব না এমন তো নয়। স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব তোমার এটা।

কথাটা বলে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। হানিয়া চুপ করে তার কথা শুনে তারপর নিচে চলে যায় তার প্রত্যহিক কাজগুলো করতে।

_________________________________

হানিয়ার ভার্সিটির ক্লাস সপ্তাহে চারদিন,,একদিন পরপর করে ক্লাস। কাল ক্লাস ছিলো আজ নেই,, তাই হানিয়া আজ বাসায়ই আছে। জাভিয়ান চলে গেছে তার অফিসে। ব্রেকফাস্ট শেষ করে অনেকটা সময় ফ্রি থাকে হানিয়া। দুপুরের রান্না আরো পরে শুরু করবে। কি করবে ভেবে না পেয়ে হানিয়া গার্ডেনে চলে যায় অবসর সময় কাটাতে। গার্ডেনে বেশ অনেক ধরনের ফুলের গাছ আছে সেগুলোই ঘুরেফিরে দেখছে। হাঁটতে হাঁটতে আজও সে বাড়ির পেছনে চলে যায়।

হানিয়া আশেপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছিলো,, হুট করে একজন মাঝ বয়সী মহিলা তার সামনে এসে পরে। হানিয়া তাঁকে দেখে বেশ চমকে যায় সেই সাথে ভয়ও পায়। মহিলাটি নিজেও হানিয়াকে দেখে ভয়+চমকে গেছে। হানিয়া নিজের বুকে থুঃথুঃ দিয়ে মহিলাটির উদ্দেশ্য করে বলে–

–আপনি কে? আর এখানে হুট করে কোথা থেকে আসলেন?

–আসলে…ইয়ে মানে..

হানিয়া এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলে–

–আপনি কি বাই এনি চান্স চুরি করতে আমাদের বাড়িতে এসেছেন? কিন্তু বাসার ভেতরে ঢুকলেন কীভাবে? দারোয়ান চাচা কই ছিলো?? অ্যাঁই সত্যি করে বলেন নাহলে এখনি পুলিশ কল করবো।

মহিলাটি হানিয়ার পরপর এতগুলো হুমকিধামকি শুনে ভয় পেয়ে যায়। মহিলাটি তাড়াহুড়ো করে বলে–

–না না,, আমি চোর নই। আমি আসলে আমার সাহেবের বাচ্চার বলটা নিতে তোমাদের বাড়িতে ঢুকেছিলাম। আমি তোমাদের বাসার পাশের বাসায় নতুন কাজে এসেছি,,সে বাড়ির মালিকের বাবুর বলটা খেলতে খেলতে বেলকনি দিয়ে ছুঁড়ে মারলে তোমাদের বাসার বাগানে এসে পরে। ওটা নিতেই এসেছিলাম।

মহিলাটি তার লম্বা বক্তব্য শেষ করে তারপর থামে। হানিয়া এবার নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে বলে–

–দুঃখিত,,আমি বুঝতে পারি নি। কিন্তু একটা প্রশ্ন।আপনি বাসার ভেতরে ঢুকলেন কীভাবে?

মহিলাটি আমতা আমতা করে বলে–

–আসলে এই দিকে (পেছনের দিকে দেখিয়ে বলে) আরেকটা গেট আছে,, ওটায় কোন তালা লাগানো ছিলো না,, এখান দিয়ে এসেছি।

–ওহ্হ,, পেয়েছেন বলটা?

–নাহ,,খুঁজতেই তো পারলাম না।

–আমি কি সাহায্য করবো?

–না না। আমি খুঁজে নিবো আপনাকে কষ্ট করা লাগবে না।

হানিয়া আর কিছু বলবে তখনই বাসার ভেতর থেকে রোজি বেগমের ডাক শুনতে পায়। তাকে ডাকছে,, তাই সে আর কথা মা বাড়িয়ে মহিলা টির থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে যায়।

______________________________

–ইনজেকশনটা আবার কবে আসবে?

–এই সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসবে

–আচ্ছা। আর রিপোর্ট গুলো আমাকে দিও তো। আমি নতুন একজন ডাক্তারের খবর পেয়েছি তাকে রিপোর্ট গুলো দেখাবো।

অজ্ঞাত ব্যক্তিটি জাভিয়ানের এই কথা শুনে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু তা জাভিয়ানের সামনে প্রকাশ করে না,, যদি জাভিয়ানের এক বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ হয় তাহলে সে ওই সন্দেহকে পুঁজি করে এর গোড়া পর্যন্ত যাবে। তখন সে ধরা পরে যাবে,,এই সব ভেবেই লোকটি জাভিয়ানকে বলে–

–তুমি দাড়াও আমি রিপোর্ট গুলো নিয়ে আসি।

লোকটা একটা রুমের ভেতর চলে যায়,, মিনিট দুয়েক পর হাতে কিছু হসপিটালের কাজ নিয়ে এসে জাভিয়ানকে দেয়। জাভিয়ান অজ্ঞাত লোকটির সাথে টুকটাক কথা বলে চলে আসে।

বাসায় আসার পর হানিয়া জাভিয়ানের জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে আসে। জাভিয়ানের হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে সে জাভিয়ানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর নিজেই খুলে দিতে থাকে জাভিয়ানের পরিহিত ব্লেজার,,হাত ঘড়ি। বাহিরের কাপড়গুলো বিনব্যাগে রেখে জাভিয়ানের বাসায় পরার কাপড়গুলো এনে তার হাতে দেয়। জাভিয়ান এতক্ষণ চুপ করে হানিয়ার কাজগুলো দেখছিলো। কেন জানি মনটা তার খুশিতে ভরে যায়। সে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে হানিয়াকে বলে–

–ব্যাগে কিছু ফাইলস আছে ওগুলো বের করে টেবিলের উপর রাখো,, কিছু কাজ বাকি আছে ওগুলো শেষ করে তারপর ডিনার করবো।।

হানিয়া এবারও চুপচাপ তার কথা মেনে নেয়। অফিসের ব্যাগ থেকে কয়েকটা ফাইলস বের করে। সেগুলো টেবিলের উপর রাখতে গেলে কার্পেটে পা বেঝে পরে যায় সে আর তার হাতে থাকা ফাইলগুলো। তার এই একটা সমস্যা ছোট থেকে,,শুকনো-ভালো জায়গায়ও সে আছাড় খায়। দু’পায়ের হাঁটুতে কত অগণিত কাটা ছেঁড়ার দাগ যে আছে তার কোন ইয়াত্তা নেই।

হানিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে ফাইলগুলো উঠাতে শুরু করে। হঠাৎ একটা ফাইলে তার চোখ আটকে যায়। হসপিটালের ফাইল এটা। হানিয়া ভাবে
“অফিসের ফাইলের মধ্যে হসপিটালের ফাইল কি করছে?” সে কৌতূহল সামলাতে না পেরে বাকি ফাইলগুলো নিচ থেকে উঠিয়ে টেবিলে রেখে ওই ফাইলটা হাতে নেয়। ফাইলটা খোলার পর রোগীর জায়গায় একজনের নাম দেখে সে থমকে যায়। রোগীর নামের জায়গায় লেখা “স্পর্শীয়া তালুকদার আভা” রিপোর্ট গুলোর তারিখে নজর দিলে দেখতে পায় কিছুদিন আগের রিপোর্ট এগুলো। এবার সে আরো চমকে যায়। আড়াই বছর আগে মারা যাওয়া ব্যক্তির রিপোর্ট কিছুদিন আগল দিবে কোন হসপিটাল?? অবশ্যই না। তাহলে এইগুলো কোন স্পর্শীয়ার।

কি মনে করে হানিয়া সবগুলো রিপোর্টের ছবি তুলে নেয়। যখন বুঝতে পারে জাভিয়ানের শাওয়ার হয়ে গেছে সে তাড়াতাড়ি করে সব গুছিয়ে রেখে নিচে চলে যায়।

_________________________

পরের দিন হানিয়ার ক্লাস থাকায় সে সকাল সকাল সব কাজ শেষ করে নেয়। তারপর রেডি হয়ে বের হলে দেখতে পায় জাভিয়ান আজও তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। হানিয়া কোন কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে। জাভিয়ানের বিষয়টা ভালো লাগে না। সেদিন ওইরকম শাসানোর পর থেকে হানিয়া জাভিয়ানের সাথে একদমই কথা বলছে না। টুকটাক যা একটু বলে তা না বললেই নয়।

জাভিয়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর জ্যামে আটকা পরে তারা। জাভিয়ান যেন একটা সুযোগ পায়। সে হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–

–তুমি কি আমার উপর রেগে আছো হানি?

হানিয়া তখন ফোন চালাচ্ছিলো। সে তার দৃষ্টি ফোনে রেখেই জাভিয়ানের কথার জবাব দেয়–

–আপাত দৃষ্টিতে আপনার আমার সম্পর্কটা রাগ,,অভিমান,,খুনসুটির হলেও আপনি আর আমি তো জানি আমাদের মধ্যে এমন কোন সম্পর্ক নেই যার জেরে আমি আপনার উপর রাগ-অভিমান করবো। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

কথাটা বলে হানিয়া চুপ হয়ে যায়। হানিয়ার কথা শুনে জাভিয়ানের বুঝতে একটু সমস্যা হয় না হানিয়া তার ওইদিনের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে। সেও বা কি করবে,? ওটা হানিয়া পড়ে ফেললে তো অনেক কিছু জেনে যেত। বুঝে যেত তাকে বিয়ে করার আসল কারণ। তাই তো সে ওইদিন ওমন ব্যবহার করেছিলো।

গাড়িতে তাদের আর কোন কথা হয় না। হানিয়ার কলেজের সামনে গাড়ি এসে থামলে হানিয়া বিনা বাক্য বেয়ে চুপচাপ চলে যেতে নেয়,,কিন্তু জাভিয়ান তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে–

–আমি আজ নিতে আসবো তোমায়।

হানিয়া তার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

–আচ্ছা। আর কিছু?

–নাহ।

–আমি আসি তাহলে?

–যাও। আল্লাহ হাফেজ।

–আল্লাহ হাফেজ।

বিদায় নিয়ে হানিয়া গাড়ি থেকে নেমে পরে। জাভিয়ান তখনও তার দিকে গাড়িতে বসে তার যাওয়া দেখছে। কলেজের গেটে প্রবেশের সময় হঠাৎ করে হানিয়ার দেখা হয়ে যায় তারই ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ইয়াং,, ব্রিলিয়েন্ট একজন স্যারের সাথে,,আদিয়াত মাহবুব। লোকটার যেমন ব্যবহার তেমনই তার জ্ঞান। এক কথায় পারফেক্ট একজন মানুষ। হানিয়ার ডিপার্টমেন্ট সহ অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের মেয়েরাও আদিয়াত বলতে পাগল প্রায়ই। তাদের কলেজের সবচেয়ে সুন্দর,, ইয়াং,, অবিবাহিত টিচারদের মধ্যে সে সবার প্রথমে এগিয়ে আছে। দু’বছর হবে হানিয়াদের কলেজে যোগ দিয়েছে।

হানিয়া স্যারকে দেখে স্বভাবতই সালাম দেয়। আদিয়াতও হাসি মুখে তার সালামের জবাব নেয়। তারপর তারা দু’জন কথা বলতে বলতে কলেজের ভেতরে ঢুকে যায়। আর তাদের দু’জনকে দূর থেকে শকুনের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করছিলো জাভিয়ান। এমন একজন ইয়াং টিচারকে হানিয়ার সাথে কথা বলতে দেখে তার কলিজা জ্বলে কয়লা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আদিয়াতের গেটআপ দেখেই জাভিয়ান বুঝতে পেরে যায় হানিয়া যার সাথে কথা বলছিলো সে তাদের কোন শিক্ষক। সে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ভাবে–

–শিক্ষক হবে পেট মোটা ভুরি ওয়ালা,, মোটামোটা গোঁফ থাকবে আর খবিশের মতো কথা বলবে। এত সুন্দর টিচার থাকলে মেয়েরা তো তার পড়া বাদ দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে,,তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে। না জাভিয়ান বউকে নজরে নজরে রাখতে হবে,,এমনিতেই বউয়ের উপর যা টর্চার করিস দেখা গেল তোর টর্চারে অতিষ্ঠ হয়ে বউ তোকে ডিভোর্স দিয়ে এই সুন্দর টিচারের গলায় ঝুলে পরল। নাহ,,আর হাত-পা চালাবো না।

আরো বহু কথা আওড়াতে আওরাতে জাভিয়ান তার অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হয়।

_______________________________

হানিয়ার কলেজে একটা মাত্র বেস্টফ্রেন্ড আছে যার সাথে সে সব কিছু শেয়ার করে। ইনায়া মেয়েটির নাম। সে হানিয়ার এতটাই ক্লোজ যে হানিয়া তার বিয়ের পর থেকে হওয়া সব ঘটনা তার সাথে শেয়ার করেছে। আজও একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য তারা কলেজের মাঠে বসেছে। ইনায়া বাদামের খোসা ছাড়িয়ে হানিয়ার হাতে দিয়ে বলতে থাকে–

–কি বলবি বল? আর এটা খা।

–তুই জানিস না বাদামে আমার এলার্জি? তাও মারার জন্য বাদাম খাওয়াচ্ছিস?

–ওপপস সরি জানু। ভুলে-চুলে হয়ে গেছে। এটা বাদ দিয়ে বল কি বলবি?

–তোকে আমার ননদ স্পর্শ আপুর কথা বলেছিলাম না? মনে আছে?

–হুম,,কার থেকে ধোঁকা পেয়ে নাকি সুইসাইড করেছে। মনে আছে,, কিন্তু উনাকে নিয়ে আবার কি বলবি?

–কাল উনি মানে তোর ভাইয়া অফিস থেকে ফিরে আমাকে তার অফিস ব্যাগ থেকে ফাইল বের করতে বলে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। তো আমি ফাইলগুলো বের করলে সেগুলোর সাথে একটা হসপিটালের ফাইলও বের হয়ে আসে।

–কি বলছিস? অফিসের ফাইলের সাথে হসপিটালের ফাইল আসবে কিভাবে? হয়ত তোদের বাড়ির কারো?

–আরে না রে ছেমড়ি। আমিও তোর মতো এমন অবাক হয়েছিলাম পরে কৌতূহল নিয়ে ফাইলটা খুললে রোগীর নামের জায়গায় কার নাম দেখতে পাই জানস?

ইনায়া অনেক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে–

–কার নাম?

–স্পর্শীয়া তালুকদার আভা। মানে আমার ননদের নাম।

–কিহহহহহহহহহহহ!

ইনায়া হানিয়ার কথাটা শুনে অবাক হয়ে একটু বেশি জোরেই চিৎকার করে উঠে। তার এমন কাজে আশেপাশের কয়েকজন তাদের দু’জনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। হানিয়া তাড়াতাড়ি করে ইনায়ার মুখ চেপে ধরে তাকে থামায়।

–আস্তে বল গাধা।

–সরি সরি। তোর কথাটা শুনে একটু বেশিই ঝটকা খেয়ে গিয়েছিলাম।

–আমিও তোর মতো এমন ঝটকা খেয়েছিলাম।

–কিন্তু আড়াই বছর আগে মৃত মানুষের মেডিকেল ফাইল দিয়ে ভাইয়ার কি কাজ?

–আমারও এটাই ভেবেছিলাম। পরে ফাইলটায় তারিখ চেক করলে দেখি যে সেখানে রিসেন্ট কয়েকদিন আগের ডেট দেওয়া।

হানিয়ার এই কথায় ইনায়া আরো বেশি অবাক হয়ে যায়। হানিয়া তাকে বলে–

–দেখ আমি রিপোর্ট গুলোর ছবিও তুলে রেখেছি।

ছবি গুলো ইনায়াকে দেখিয়ে বলে হানিয়া। ইনায়া রিপোর্ট গুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখে আসলেই ডেটে জায়গায় ১০/১২ দিন আগের ডেট দেওয়া। সে হানিয়াকে বলে–

–আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না রে ভাই। ভাইয়াকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিস নি?

–তাকে জিজ্ঞেস করলে আজ আর আমার তোর সামনে বসে থাকা লাগত না। মেরে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দিতো।

হানিয়ার কথা শুনে ইনায়ার ভীষণ খারাপ লাগে। জালিম একটা স্বামী এমন কিউট একটা মেয়ের ভাগ্যে কেমনে জুটলো। হানিয়া তাকে আবারও বলে —

–শুন তোকে একটা কাজ করতে হবে।

–বল কি কাজ?

–তোর চেনা পরিচিত একজন নিউরোলজিস্ট থাকলে আমায় তার ঠিকানা দিস তো। আমি কাল একটু রিপোর্টটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছিলাম,,সেটা থেকে বুঝতে পারলাম এখানে কিছু ব্রেনের টেস্ট ও তার রিপোর্ট দেওয়া আছে।

–আচ্ছা। আমি তোকে জানাচ্ছি এই বিষয়ে।

ইনায়ার মা একজন ডাক্তার তাই হানিয়া ইনায়াকে এই কাজটা দেয়। তারা কথা বলছিলো তখনই হানিয়ার ফোন বেজে উঠে। হানিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে জাভিয়ান ফোন দিয়েছে। সে রিসিভ করে সালাম বিনিময়ের পর জাভিয়ান তাকে বলে–

–আমি কলেজের বাহিরে দাড়িয়ে আছি,,তাড়াতাড়ি আসো।

কথাটা বলে কল কেটে দেয়। হানিয়াও ইনায়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ির উদ্দেশ্য হাটা দেয়। কিন্তু পথে এমন কিছু ঘটে যার কারণে হানিয়া আর জাভিয়ানের কাছে পৌঁছাতে পারে না।

শব্দসংখ্যা-১৮৯২

~~চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_পঁচিশ

জাভিয়ান হানিয়ার কলেজের গেট থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে। গাড়িতে বসেই সে সহজেই হানিয়ার আসা দেখতে পারবে। হানিয়াকে ফোন দেওয়ার ১৫ মিনিট হয়ে যাওয়ার পরও যখন হানিয়া আসে না,, তখনই জাভিয়ানের ফুরফুরে মেজাজ খারাপ হতে থাকে। আজ সে প্ল্যান করেছিলো হানিয়াকে নিয়ে একটু ঘুরবে। বিয়ের পর হানিয়াকে নিয়ে একবারই বাহিরে বের হয়েছিলো তাও তারই বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য। কথাটা ভেবেই আজ ঘুরাঘুরি প্ল্যান করা,,সেই সাথে হানিয়ার মুডটাও ঠিক করার জন্য করেছে এমন প্ল্যান। কিন্তু যার জন্য জাভিয়ানের প্ল্যান করা সে কই?

জাভিয়ান হানিয়ার জন্য আর অপেক্ষা না করেই নিজেই গাড়ি থেকে বের হয়ে রওনা হয় হানিয়ার কলেজের উদ্দেশ্য। গেট দিয়ে প্রবেশের পর কিছুটা দূরে একটা জটলা দেখতে পায় জাভিয়ান। কি মনে করে সেই ভীরের কাছে গিয়ে একটু উঁকি দিলে দেখতে পায় হানিয়া নিচে পা ধরে বসে আছে আর তার ডান হাত দিয়ে রক্ত পরছে। জাভিয়ানের বুকটা মোচড় দেয় এমন দৃশ্য দেখে। সে ভীর ঠেলে হানিয়ার কাছে এসে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে অস্থির কণ্ঠে বলতে থাকে–

–হানি কি হয়েছে তোমার? এত ব্যথা পেলে কীভাবে? বলো কীভাবে পেলে ব্যথা?ইডিয়েট!!

বেশ জোরে ধমক দিয়ে শেষের কথাটা জিজ্ঞেস করে জাভিয়ান। হানিয়া সহ আশেপাশের কয়েকজন কেঁপে উঠে তার ধমকে। হানিয়া কিছু বলার আগেই ভীরের মধ্যে একজন বলে–

–ভাইয়া কয়েকজন ছেলে ঝামেলা করতে করতে এইদিক দিয়ে যাচ্ছিল আপুও এদিকেই আসছিল তখন ওই ছেলেরা আপুকে না দেখতে পেয়েই ধাক্কা দিলে আপু বেফাঁসভাবে পরে যায়। তাতে তার হাত ইঁটের উপর পরায় হাতে চোট পায় আর পায়েও মনে হয় ভালোই ব্যথা পেয়েছে।

কথাটা শুনে জাভিয়ানের চান্দি জ্বলে উঠে। একমাত্র অপ্রিয় বউ তার,,তাকে মারবে-কাটবে,,বকবে যা করবে সে করবে। অন্যকেউ এই অপ্রিয় বউকে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট দিলেও তার মাথা ঠিক থাকে না,,না চাইতেও বুকের বাম পাশে হৃদপিণ্ড নামক যন্ত্রটা জ্বলে ছাড়খাড় হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলে–

–কোন কু*ত্তার বাচ্চার সাহস আমার বউকে ফেলে দিয়েছে? ওদের আমি ছাড়বো না। জেলের ভাত না খাইয়ে আমি জাভিয়ান তালুকদার শান্ত হব না।

কথাটা বলতে বলতে জাভিয়ান ফোন বের করে পুলিশ কমিশনরকে লাগায়।

–হ্যালো কমিশনর সাহেব,,ইমিডিয়েট আপনার ফোর্স….

জাভিয়ান কথাটা শেষ করতে পারে না। তার আগেই হানিয়া তার কান থেকে ফোনটা নিয়ে কেটে দেয়। জাভিয়ানকে শান্ত করতে করতে বলে–

–আপনি শান্ত হন। তারা হয়ত ভুলে করে ফেলেছে। ঝামেলা করে কি লাভ বলুন? বাসায় চলুন।

জাভিয়ান রেগে হানিয়াকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন ভীর থেকে আরেকজন বলে–

–ভাইয়া এখন ঝামেলা না করে আপুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তাদের পরেও শাস্তি দেওয়া যাবে কিন্তু আপুর এখন ট্রিটমেন্ট দরকার। আপুর হাত থেকে এখনো র//ক্ত পরছে। দেরি করা ঠিক হবে না।

কথাগুলো শুনে জাভিয়ানের টনক নড়ে। হানিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে র//ক্তে হানিয়ার হাতটা ভেসে যাচ্ছে। আসলে হানিয়ার হাত-পায়ের ত্বক একটু বেশিই পাতলা। বাচ্চাদের ত্বকের মতো। ছোট থেকেই তার এই অবস্থা,,এটাকে এক ধরণের রোগও বলা চলে। একটু কিছু হলেই ত্বক ফেটে রক্ত বের হয়। জাভিয়ান যে কয়েকবার তার হাত ধরেছে সে কয়েকবারই এত নরম হাত দেখে অবাক হয়েছে।

জাভিয়ান তার প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে হানিয়ার ক্ষত হাতটা আলতো করে বেঁধে দেয়। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে ঝট করে কোলে তুলে নেয়। উপস্থিত সকলে তাকে যাওয়ার জায়গা করে দিলে সে হানিয়াকে নিয়ে হাটা দেয় গাড়ির উদ্দেশ্য। গাড়ির কাছে এসে তাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজেই সিট বেল্ট লাগিয়ে দেয়। তারপর নিজেও জায়গা মতো বসে স্টার্ট লাগায় গাড়ি,, ছুটিয়ে নিয়ে চলে হসপিটালে।

রাস্তায় হানিয়া আর জাভিয়ান দু’জনেই চুপ করে ছিলো। হানিয়া চুপ ছিলো তার ব্যথার তাড়নায়,, আর জাভিয়ান চুপ ছিলো চিন্তায়। সে একটু পরপর ঘাড় ঘুড়িয়ে হানিয়াকে দেখছিলো,,চোখে মুখে তার দারুণ চিন্তার ছাপ। হানিয়া তার এমন অস্থিরতা দেখে ধীর ও শান্ত কণ্ঠে বলে–

— এত চিন্তার কিছু নেই। আপনি এর থেকেও বেশি কষ্ট দেন,,রক্তাক্ত করে তুলেন এর চেয়ে হাজার গুণ। তার তুলনায় এই চোট কিছুই না।

হানিয়া কথাটা তাচ্ছিল্য করে না বললেও কথাটা সেই উদ্দেশ্য বহন করছে। জাভিয়ানের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হয়ে যায়। ভিতরে চলতে থাকা ঝড়টা যেন আরো তীব্র হলো,, কিন্তু তা বাহিরে প্রকাশ পেলো না। তাদের মধ্যে আর কোন কথা হয় না। দেখতে দেখতে তারা নিকটবর্তী হসপিটালে এসে করে। জাভিয়ান গাড়ি থেকে নেমে হানিয়াকে কোলে তুলতে নিলে,, হানিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে–

–এত মানুষের সামনে কোলে তুলতে হবে না। হাতটা ধরুন,,আমি আস্তে আস্তে করে হাঁটতে পারব।

জাভিয়ান ভ্রু কুঁচকে তার কথাটা শুনে,,কিন্তু আমলে নেয় না। নিজের মতো হানিয়াকে কোলে তুলে হসপিটালের ভেতরে হাঁটা দেয়। আশেপাশের অনেকেই তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে হানিয়া প্রচন্ড লজ্জা ও অস্বস্তিতে পরে যায়। সে তার গলা চাপিয়ে বলে–

–জীবনে আমার কোন কথা শুনবেন না বলে ঠিক করে রেখেছেন? এতগুলো মানুষের সামনে কোলে না তুললে হচ্ছিল না? দেখেন তো কেমনে করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে?

হানিয়া আশেপাশে নজর দিতে দিতে কথাগুলো বলে। জাভিয়ান এখনো তার কথা কানে তুলে না। সামনে দিলে তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলছে।

–নামিয়ে দেন না,, প্লিজ। আমার ভীষণ লজ্জা করছে।

–আর একটা কথা বলবে হানি তাহলে কোল থেকে ঠাশ করে ফেলে পায়ের সাথে এবার কোমড়টাও ভেঙে রাখব। পরে সারা জীবন আমার কোলে করেই তোমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে। যদি সারাজীবন কোলে চড়ে না ঘুরতে চাও তাহলে চুপ করে থাক।

জাভিয়ান চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে হানিয়াকে। হানিয়া তার কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়। এই পাগল লোকের উপর কোন ভরসা নেই,,দেখা গেলো মেজাজ বেশি খারাপ হলে তাই করতে পারে। এদিকে তার লজ্জাও করছে,,তাই হাত বাড়িয়ে বাম হাত দিয়ে জাভিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়।জাভিয়ান তার হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে হানিয়াকে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে।

ডাক্তারের কেবিনে আসার পর আরেক কান্ড শুরু হয়। ডাক্তার হানিয়ার হাতে ড্রেসিং করছে,,কাটা জায়গায় বালু গিয়েছে একটু ভালো করে ক্লিন না করলে পরে ইনফেকশন হতে পারে। ডাক্তার সিজার দিয়ে খুচিয়েখাচিয়ে ভালো করে জায়গাটা ক্লিন করছে। স্বাভাবিক ব্যথা একটু লাগবেই,,সেই ব্যথায় হানিয়া একটু ককিয়ে উঠলে জাভিয়ানের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারকে শাসানোর মতো করে বলছে–

–এত রুড ভাবে করছেন কেন ডাক্তার? ব্যথা পাচ্ছে তো ও,,একটু আস্তে ধীরে করুন।

এমনই হাজারো কথা বলে ডাক্তারকে নিজের কাজ ঠিক মতো করতে দিচ্ছে না। জাভিয়ানের কাজে হানিয়াও একসময় বিরক্ত হয়ে যায়। ডাক্তার না পারতে বলেই দেয়–

–আপনিই না হয় করুন আমাকে না বলে।

একথার পর জাভিয়ান আর ডিস্টার্ব করে নি। হাতের ড্রেসিং করে পায়েও ট্রিটমেন্ট দেয়। পা’টা মচকে না গেলেও অনেকটা ওই পর্যায়েই চলে গেছে। কম করে পনের দিন হাটা চলা একদমই নিষেধ,,যদিও করে তাহলে পা ভালো হতে সময় লাগবে আরো। পায়ের ও হাতের ব্যথায় জ্বর আসতে পারে বলে ডাক্তার হানিয়াকে একটা ইনজেকশন দেওয়ার পরামর্শ দেয়। জাভিয়ান তাই করতে বলে। ইনজেকশন দেওয়ার সময় জাভিয়ান ভেবেছিলো হানিয়া ভয় পাবে তাই নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে আগলে নেয়। হানিয়া হঠাৎ করে তার জড়িয়ে ধরায় হকচকিয়ে যায়। সে চাপা স্বরে বলে–

–কি করছেন আজব? ডাক্তারের সামনে তো একটু লজ্জা করুন। জড়িয়ে ধরলেন কেন হঠাৎ?

— ইনজেকশন দেখে তোমার ভয় করবে বলে জড়িয়ে ধরলাম।

হানিয়া জাভিয়ানের দিকে এমন একটা লুক দেয় যে জাভিয়ান দুনিয়ার অদ্ভুত সব কথা গুলোর মধ্যে একটা বলেছে। হানিয়াকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জাভিয়ান বলে–

–কি হয়েছে এমন ভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

–আপনার কি আমাকে বাচ্চা মনে হয়? ইনজেকশন তো ভয় পায় বাচ্চারা।

জাভিয়ান হানিয়ার কথায় বুঝতে পারে হানিয়া ইনজেকশন ভয় পায় না,,তাও সে হানিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখে।

ডাক্তার জাভিয়ানকে হানিয়াকে দেওয়া ঔষধ গুলো তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যায়,,যাওয়ার সময় একজন নার্সকে বলে যায় তার কাছে থাকতে। জাভিয়ান চলে গেলে নার্সটি হানিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলতে থাকে। কথা বলার এক পর্যায়ে নার্সটি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে–

–ম্যাম আপনার হাসবেন্ড বুঝি আপনাকে অনেক ভালোবাসে? কেমন পাগলামিটাই না করলো।

হানিয়া মলিন হেঁসে জবাব দেয়–

–অনেকসময় আমরা চোখে যা দেখি তা কিন্তু সত্যি হয় না সিস্টার।

হানিয়ার কথা শুনে নার্সটির হাসি মুখটা চুপসে যায়। হয়ত সে কিছু বুঝতে পেরেছে। নার্সটির সাথে আরেকজনের মনটা মলিনতায় ছেয়ে যায়। ব্যক্তিটি হলো জাভিয়ান। সে ডাক্তারের কাছ থেকে এসে পরেছিলো তখনই নার্স আর হানিয়ার লাস্টের কথাগুলো শুনে ফেলে। হানিয়ার কথাটায় জাভিয়ানের মনও কেমন করে উঠে। আসলেই কি চোখের দেখা সবসময় সত্যি হয় না? তাহলে জাভিয়ানও কি কোন ভুল করছে হানিয়াকে কষ্ট দিয়ে? কথাগুলো নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে জাভিয়ান।

ডাক্তার দেখানো শেষ হলে তারা বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে আসার পর সকলে হানিয়ার এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় পরে যায়। জাভিয়াম শর্টকাটে তাদের ঘটনা খুলে বলে হানিয়াকে নিয়ে উপরে তাদের রুমে এসে পরে। শায়লা বেগম অলরেডি চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে।

–বলেছিলাম আর পড়ালেখা করার দরকার নেই,, নাহ তার বৌমা তো পড়ালেখা করে বিদ্যাসাগর হবে না।এখন দেখো পা ভেঙে বসে আছে লাটসাহেবের বেটি।

আরসাল তালুকদার তাকে ধমকেধামকে চুপ করায়।

________________________

ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান যেহেতু ক্যান্সেল তাই জাভিয়ান দুপুরের পর আবার অফিসে চলে যায়। হানিয়ার পাশে রোজি বেগম আর কুলসুম বসে থাকে সারা বিকাল। আসরের নামাজের সময় হানিয়াই তাদের জোর করে পাঠিয়ে দেয় নিজেদের রুমে রেস্ট নেওয়ার জন্য। তারা চলে গেলে সে ফোন লাগায় ইনায়াকে।

–আসসালামু আলাইকুম।

–ওয়া আলাইকুমস সালাম। কিরে কি খবর? হঠাৎ এই সময়ে ফোন দিলি?

–আরে একটা কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম। শুনবি তো নাকি?

–ওহ্হ,, বল। আমারও একটা কথা বলার ছিলো।

–আমারটা আগে শুন।

–হুম বল।

হানিয়া তারপর আজকে কলেজে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টটার কথা বলে ইনায়াকে। ইনায়া কথাটা শুনে ভীষণ টেনশনে পরে যায়। সে হানিয়াকে বলে–

–এখন কি অবস্থা তোর?

–আলহামদুলিল্লাহ এখন বেটার ফিল করছি। তুই বল কি জানি বলবি?

–ওহহ,,তুই নিউরোলজিস্টের খোঁজ নিতে বলেছিলি না,,একজনের খোঁজ পেয়েছি। আমার আম্মুর স্টুডেন্ট ছিলো সে,, এখন একজন নামকরা নিউরোলজিস্ট। ডাক্তার এহসান কবির তার নাম,,বিশ্বস্তও হবে সে। তার কাছে আমরা যেতে পারি।

–গ্রেট। কিন্তু আমার পা?

বেশ মন খারাপ নিয়ে কথাটা বলে হানিয়া। ইনায়া তাঁকে মন খারাপ দেখে বলে–

–আরে দোস্তো মন খারাপ করিস না,,আরেকটা কথা তো বলিই নি।

–কি?

–ডাক্তার এহসান এক সপ্তাহের জন্য আউট অফ কান্ট্রি আছে। তাই তোর মন খারাপ করা লাগবে না,,সে দেশে আসতে আসতে আমার মনে হয় তোর পা-ও ইনশা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।

কথাটা শুনে হানিয়ার মনটা খুশি হয়ে যায়। আল্লাহ আজ তার প্রতি একটু বেশিই সদয় মনে হচ্ছে। সে খুশি মনে ইনায়ার সাথে আরো কয়েকটা কথা বলে ফোন রেখে দেয়। শরীরটা ভালো লাগছিলো না বিধায় বেডের পেছনের হার্ডবোর্ডে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে,,মনে মনে ঠিক করে নেয় আজ রাতে রোজি বেগমের কাছে থাকবেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হানিয়া ঘুমিয়ে পরে।

~~চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ছাব্বিশ
#রহস্যের_সমাধান_০১

রাতের খাবার হানিয়াকে রোজি বেগম রুমে এসে খাইয়ে দেয়। জাভিয়ান তার ডিনার শেষ করে এসে দেখে হানিয়াকে রোজি বেগম ঔষধ খাইয়ে দিচ্ছে। ঔষধ খাওয়ানো শেষ হলে রোজি বেগম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখন হানিয়া তাকে পেছন ডেকে বলে–

–মনি প্লেটটা রেখে এসে আমাকে নিয়ে যেও। আজ রাতে আমি তোমার সাথে ঘুমাবো।

তার এমন কথা শুনে জাভিয়ান আর রোজি বেগম উভয়ের কপালে ভাজ পরে। জাভিয়ান তাঁকে ধমকে জিজ্ঞেস করে —

–নিজের রুম থাকতে অন্যের রুমে কি তোমার এতো?

–কাল আপনার অফিস আছে,, রাতে আমার জন্য সমস্যা হতে পারে। তাই মনির সাথে থাকব আজ।

রোজি বেগম তার কথায় একমত হয়ে বলে–

–ঠিক বলেছিস হানিয়া। আচ্ছা আমি আসছি তোকে নিতে,,খবরদার পাকনামি করে একা একা হাটতে যাবি না। আমি এসে নিয়ে যাবো।

এইদিকে তাদের দু’জনের কথা শুনে জাভিয়ানের মাথা গরম হয়ে যায়। সে রোজি বেগমকে বলে–

–মাম্মাম তোমার আসা লাগবে না আর। আমি ম্যানেজ করে নিবো।

হানিয়া তার কথা শুনে বলে–

–আপনার সমস্যা হতে…

হানিয়াকে কথা সম্পূর্ণ করতে দেয় না জাভিয়ান,,তার আগেই একটা রামধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। তারপর রোজি বেগমকে বলে–

–মাম্মাম অনেক রাত হয়ে গেছে তুমি খেয়ে শুয়ে পরো। যাও।

রোজি বেগম ভেবে দেখলেন জাভিয়ান যেহেতু নিজ থেকেই হানিয়ার দায়িত্ব নিতে চাইছে তাই তার এখানে টেনশন করা লাগবে না। তাদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছে এটাই অনেক। কথাগুলো ভেবে রোজি বেগম তাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। হানিয়া মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। জাভিয়ান তার মুখ ফুলানো ইগনোর করে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে যা দেখে তাতে তার শান্ত মেজাজটা সেকেন্ডের মাঝে অশান্ত হয়ে যায়।

হানিয়া বেড থেকে নেমে একা হাঁটার চেষ্টা করছে। এতে তার পায়ে চাপ পরে ব্যথা পেলেও সে ব্যথাটাকে অগ্রাহ্য করে সোফার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে পায়ের ব্যথাটা আর সহ্য করতে না পেরে পরে যেতে নিলে জাভিয়ান দৌড়ে এসে তাকে নিচে পরা থেকে বাচিয়ে নেয়। হানিয়া ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে সামনে যা পায় তা ধরেই বাঁচার চেষ্টা করে। কয়েক সেকেন্ড পর যখন সে বুঝতে পারে সে নিচে পরেনি তখন আস্তে করে এক চোখ খুলে দেখে সত্যিই সে পরেনি। সাহস করে দুই চোখ খুলে সামনে তাকানে দেখতে পায়,, সে জাভিয়ানের টি-শার্টের কলার ধরে ঝুলে আছে আর জাভিয়ান একহাত দিয়ে তার কোমড় আরেক হাত দিয়ে তার ডান হাত আগলে ধরে আছে। জাভিয়ানের চোখের দিকে তাকালো দেখতে পায় সেখানে আজ কোন ক্রোধ নেই,,আছে এক প্রকার ঘোর। যে ঘোর অনায়াসে একজনকে প্রেমে পরতে বাধ্য করবে।

কয়েক মুহূর্ত এভাবেই চলে যাওয়ার পর জাভিয়ানের খেয়াল হয় হানিয়া কি করতে যাচ্ছিল। নিমিষেই আগের রাগটা মাথা চড়া দিয়ে উঠে। হানিয়াকে আস্তে করে সোজা করে দাড় করায়। তারপর কোলে তুলে বেডে বসিয়ে দেয়। হানিয়া তখনও ঘোরে ডুবে আছে। বেডে বসিয়ে দিয়ে জাভিয়ান হুট করে হানিয়ার চোয়াল চেপে শক্ত করে। হানিয়া হকচকিয়ে যায়,,গুঙিয়ে উঠে ব্যথায়।

জাভিয়ান তার চোয়াল চেপে ধরেই বলে–

–কই যাচ্ছিলি? পরে গিয়ে পা’টা একেবারে ভেঙে ফেলার পায়তারা করছিস? সোফায় যাচ্ছিলি কেন?

হানিয়া জোর খাটিয়ে নিজের মুখে ছাড়ায় জাভিয়ান থেকে,,তারপর ত্যাড়াভাবে বলে–

–তো কোথায় ঘুমাবো আমি? মনির রুমেও তো যেতে দিলেন না,,এখন কি আমি সারারাত না ঘুমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব? যদি এমন কিছু ভেবে থাকেন তাহলে আপনার জন্য এক বালতি সরি,, কারণ আমার ভীষণই খারাপ লাগছে আর ঘুমও পাচ্ছে।

হানিয়ার কথা শুনে জাভিয়ান ভাবে,,আসলেই তো হানিয়া কোথায় ঘুমাবে? সোফার দিলে আড়চোখে তাকালে খেয়াল করে সোফা প্রয়োজনের চেয়ে একটু ছোট্ট। হানিয়া সোফায় সবসময় গুটিয়ে শুয়ে থাকলেও আজ তো আর তেমন গুটিয়ে শুতে পারবে না। পায়ে ব্যথা থাকার কারণে পায়ের নিচে একটা বালিশ দিয়ে পা টান করে ঘুমাতে হবে। কোথায় ঘুমাবে হানিয়া তাহলে এখন? কথাটা ভাবতে ভাবতেই হানিয়া আবার উঠতে গেলে জাভিয়ান তাকে ঠেসে ধরে বসিয়ে দেয়। হানিয়া এবার রেগে গিয়ে বলে–

–আমার শরীরটা ভালো লাগছে না,,একটু তো শান্তি দেন। সুস্থ হই তারপর আবার মে”রেন। এখন একটু রেস্ট নিতে দেন। হয় মনির রুমে যেতে দেন,, নাহলে সোফা শুতে দেন কিন্তু কিছু একটা করতে দেন। দয়া করুন আমার উপর,,ভালো লাগছে না আর।

লাস্টের কথাগুলো হাত জোড় করে বলে হানিয়া। হানিয়ার এমন ভাবে বলায় জাভিয়ানের খারাপ লাগে। সে তো এখন তার উপর অত্যাচার করছে না বরং তাকে একটু স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে। এমন ভাবে বলার কি ছিলো আজব? জাভিয়ান হানিয়ার কথার জবাব না দিয়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দরজা লক করে দেয়। তারপর আবার হানিয়ার কাছে এসে তাকে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে তার ব্যথাওয়ালা পায়ের নিচে একটা পিলো দিয়ে দেয়। হানিয়া বুঝতে পারে জাভিয়ান তাকে এখানে শোয়ানোর পায়তারা করছে তাই সে বলে উঠে —

–আমি এখানে শুয়ে পরলে আপনি কই ঘুমাবেন? যেই লম্বু আপনি অতটুকু সোফায় আপনি আটবেন? তার চেয়ে ভালো আমি আমার জায়গায় শুয়ে পরি আর আপনি আপনার জায়গায়।

কথাটা বলে হানিয়া উঠতে গেলে জাভিয়ান আবার তাকে ঠেসে ধরে শুইয়ে দেয় তারপর সে-ও হানিয়ার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে। জাভিয়ানের এমন কাজে হানিয়া হতভম্ব হয়ে যায়। বাম হাত দিয়ে জাভিয়ানকে ঠেলে সরাতে গেলে জাভিয়ান তার সে হাতের আঙ্গুলের কাজে নিজের আঙুল গুঁজে বিছানার সাথে চেপে ধরে। হানিয়া এবার কিছুটা চিল্লিয়ে বলে–

–অ্যাঁই অ্যাঁই কি করছেন? উঠেন।

জাভিয়ান হানিয়ার বুকের উপর থেকে মাথাটা হালকা উঠিয়ে শান্তস্বরে বলে–

–হয় এখন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরো,, না হয় সারারাত অশান্তির মাঝে দিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করে নাও। কোনটা করবে তুমিই ভেবে দেখো?

জাভিয়ানের এমন শান্তস্বরের কথায় কিছু একটা ছিলো যা হানিয়াকে ভয় পাইয়ে দিতে সক্ষম। তাছাড়া জাভিয়ান কিসের ইঙ্গিত করেছে তাও হানিয়া বুঝতে পেরেছে,, তাই এখন বেশি বাড়াবাড়ি করলে দেখা যাবে জাভিয়ান সত্যি সত্যি তাকে সারারাত অশান্তির মাঝে রাখল। সে শান্ত হয়ে বলে–

–আচ্ছা থাকলাম এখানে কিন্তু আপনি আমার উপর থেকে উঠে বালিশে গিয়ে ঘুমান। আমার বুকে শোয়ার কি আছে? উঠুন আমার উপর থেকে।

জাভিয়ান হানিয়ার বুকে আরেকটু ভালো করে শুয়ে বলে–

— মনে হলো শান্তি আছে এখানে তাই শুয়েছি। এখন দেখি সত্যি সত্যি অনেক শান্তি আছে এই জায়গাটায়
(কথাটা জাভিয়ান হানিয়া যাতে না শুনতে পায় তাই ভীষণই আস্তে বলে,,কিন্তু হানিয়া যেহেতু জাভিয়ানের অনেকটাই কাছে তাই সে শুনে ফেলে) আমি জানি তুমি নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য আমি ঘুমালে এখান থেকে উঠে যাবে তাই আমি এভাবেই ঘুমাবো আজ। হয়েছে? পেয়েছ নিজের জবাব,, এখন যদি আর একটা কথা বলো হানি,,আই সোয়্যার আজ সারারাত তুমি ঘুমাতে পারবে না।

কথাটা বলে জাভিয়ানের হানিয়ার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে টুকুশ করে একটা কামড় দেয়। হানিয়া জাভিয়ানের এমন কাজে চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নেয়। জাভিয়ান এসে আবার হানিয়ার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে। মিনিট খানিক পর ঘুমিয়েও পরে। হানিয়াকে দেওয়া ঔষধ গুলোর মাঝে ব্যথানাশক ঔষধ থাকায় সে-ও না চাইতে একসময় ঘুমিয়ে পরে।

___________________________

কেটে যায় আট দিন। এই আটদিনে জাভিয়ান হানিয়াকে না কলেজে যেতে দিয়েছে আর না বাসার কাজ করতে দিয়েছে তেমন একটা। উল্টো ভীষণ যত্ন নিয়েছে হানিয়ার। এই কয়েকদিনে তার এমন কাজে সবাই ভীষণ,, ভীষণ এবং ভীষণই অবাক হয়েছে। যেই জাভিয়ান দিন বিশেক আগেও হানিয়াকে অমানুষের মতো মেরে রক্তাক্ত করেছে,, সেই জাভিয়ান কিনা হানিয়াকে কেমন পাগল করা যত্ন নিচ্ছে।।
হানিয়া জোর করে কাজ করতে গেলেও ধমকেধামকে তাঁকে বসিয়ে রেখেছে। বলতে গেলে ফুল বেড রেস্টে ছিলো সে,,তাই পা’টাও সময়ের সাথে সাথে অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে। আজ হানিয়া ঠিক করে রেখেছে কলেজে যাবে। যেতে যে তাকে হবেই,,কারণ আজ সে আর ইনায়া ডা.এহসানের সাথে দেখা করতে যাবে রিপোর্ট গুলো সম্পর্কে কথা বলতে।

গতকাল রাতে হানিয়া জাভিয়ানকে ইনিয়েবিনিয়ে কলেজে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল,,তখন জাভিয়ান তাকে সাফসাফ মানা করে দিয়েছে। বলেছে পনের দিন আগে সে হানিয়াকে বাসা থেকেই বের হতে দিবে না আর কলেজে যাওয়া তো দূরের কথা। জাভিয়ানের এমন কথা শুনে হানিয়া ভেবে ছিলো ডা.এহসানের সাথে কয়েকদিন পর দেখা করতে যাবে,,কথাটা ইনায়াকে বললে ইনায়া জানায় ডা.এহসান নাকি ১মাসের একটা মেডিকেল ক্যাম্পিংয়ে চট্টগ্রাম যাবে দু’একদিনের মাঝে। সে এতদিন অপেক্ষা করতে পারবে না দেখে আজই যাবে আর সেটাও জাভিয়ানকে না জানিয়ে।

জাভিয়ান ব্রেকফাস্ট করে বের হয়ে যাওয়ার পরপরই হানিয়া বাসা থেকে বের হয়। রোজি বেগমকে বলে গেছে “আজ কলেজে যাওয়া লাগবেই,, ম্যামরা ইমার্জেন্সি যেতে বলেছে”। আর শায়লা বেগম তো হানিয়ার কোন কিছুতেই নেই,, সে থাকে নিজের মতো। হানিয়াকে অবশ্য রোজি বেগম বাসার গাড়িতে করে পাঠিয়েছেন আর বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলো আসতে,, জাভিয়ান জানতে পারলে তাদের দু’জনের খবর করে ছাড়বে। হানিয়াও তাকে তাড়াতাড়ি ফেরার আশ্বাস দিয়ে কলেজে চলে যায়।

কলেজে এসে তারা একটা ক্লাস করে কলেজ থেকে বের হয়ে যায়। ইনায়ার বাসার গাড়িতে করে তারা ডা.এহসানের হসপিটালে এসে উপস্থিত হয়। রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে তাদের আসতে আসতে বেশ অনেকটা লেট হয়ে গেছে। হসপিটালে এসে শুনে ডা.এহসান নাকি ওয়ার্ড পরিদর্শনে গিয়েছেন,, তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। হানিয়া একদিকে অজানা কিছু জানার জন্য কৌতূহলে মরে যাচ্ছে অন্যদিকে জাভিয়ানের ভয়। এই কয়েকদিনে জাভিয়ান প্রায়সই দুপুরে বাসায় আসত,,আজও যদি আসে তাহলে হানিয়ার খবর শেষ। সে মনে মনে দোয়া করছে জাভিয়ান যেন আজ দুপুরে বাসায় না আসে।ইনায়া তাঁকে শান্ত হতে বলছে কিন্তু এত এত চিন্তার মাঝে কি শান্ত হওয়া যায়?

প্রায় এক ঘন্টা পর ডা.এহসান তার কেবিনে আসে। সে আসার পর ইনায়া-হানিয়াকে তার কেবিনে ডাকা হয়। তারা কেবিনে আসলে ডা.এহসান তাদের হাসি মুখে বসতে বলে। তারা দু’জন বসে পরলে ডা.এহসান বলে–

–আপনাদের কথা ম্যাম(ইনায়ার আম্মু) আমাকে বলেছিল। সরি আপনাদের অপেক্ষা করানোর জন্য কিন্তু আমি আমার দায়িত্বকে অবহেলা করে পারসোনাল কাজকে আগে রাখতে পারি না।

হানিয়া বুঝতে পারে ডা.এহসান কতটা দায়িত্ববান মানুষ। সে হাসি মুখে বলে–

–না না ডা. আপনার ডিউটি আগে তারপর পারসোনাল লাইফ। আর আপনাকে সরিও বলা লাগবে না।

ডা.এহসান হাসিমুখে তাদের জিজ্ঞেস করে–

–বলেন কি নিবেন আপনারা? ঠান্ডা নাকি গরম? এখন অবশ্য গরমটা নেওয়াই ভালো হবে।

তার কথা শেষ করতে না করতেই ইনায়া ডা.এহসানকে ধমকের সুরে বলে–

–আপনিই যদি ঠিক করে দিবেন তাহলে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন কেন? আমরা ঠান্ডা নিবো,,আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখেছেন কতটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।

ডা.এহসান শান্ত চোখে ইনায়াকে দেখে। ছোট থাকতেও মেয়েটা তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে,,এখন বড় হয়েও প্রণয়ের আগুনে জ্বালাচ্ছে। সে একা কেন এত জ্বলবে? নাহ,,যত তাড়াতাড়া সম্ভব এই মিষ্টি মধুর জ্বলনে এই বিচ্ছুটাকেও জ্বালাবে। হানিয়া ইনায়াকে চুপ করিয়ে বলে–

–ডা. আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হবেন না আর ওর কথায়ও কিছু মনে করবেন না। আমাদের কাজটা হয়ে গেলেই আমাদের যেতে হবে,,একটু আর্জেন্ট আর কি।

ডা.এহসান ইনায়ার থেকে চোখ সরিয়ে হানিয়ার দিলে তাকায়। গোলগাল চেহারার মেয়েটার মুখে ভীষণ উৎকন্ঠা,, কিছুটা চাপা ভয়। সে হানিয়াকে বলে–

–আপনি আমার বোনের বয়সী আপনাকে “বোন” বলেই ডাকছি আর “তুমি” করে সম্বোধন করছি। আশা করছি কিছু মনে করবে না বোন?

হানিয়া হাসি মুখে তাকে সম্মতি দেয় ডাকার। তারপর ডা.এহসানকে তার তোলা রিপোর্টের ছবি গুলো দেখায়। ডা.এহসান রিপোর্টের ছবি গুলো দেখে গম্ভীর গলায় বলে–

–এই রিপোর্ট গুলো নিয়েই তো কাল একজন আমার কাছে এসেছিলো।

তার এমন কথায় হানিয়া-ইনায়া চমকে যায়। হানিয়া বলে উঠে —

–কে সে? সে কি পুরুষ নাকি মহিলা ছিলো?

–হুম। সে একজন পুরুষ ছিলো।

–তার নাম কি ডাক্তার?

–জাভিয়ান তালুকদার,, ব্রাদার অফ স্পর্শীয়া তালুকদার।

ডা.এহসানের এমন কথায় তারা দু’জন একটা বড়সড় ঝটকা খায়। জাভিয়ান এসেছিলো? হানিয়া নিজেকে শান্ত করে বলে–

–সে কেন এসেছিলো? আর রিপোর্ট গুলোতে কি আছে একটু ব্যাখ্যা করলে ভালো হয় ডাক্তার।

–মি.জাভিয়ানও এই রিপোর্ট নিয়েই কথা বলতে এসেছিলো। আর সে জানতে চেয়েছিলো এই রিপোর্ট অনুযায়ী পেসেন্ট কবে ভালো হবে? মানে তার সে নরমাল লাইফ লিড করতো সক্ষম কিনা নাকি তাকে আরো ট্রিটমেন্ট নিতে হবে?

ডা.এহসানের একের পর এক কথা শুনে হানিয়া-ইনায়া যেন কথা বলতে ভুলে গেছে। পেসেন্ট ভালো হবে মানে? যে আড়াই বছর আগে মারা গেছে সে কীভাবে ভালো হবে? হানিয়া হতভম্ব হয়ে তাকে জিজ্ঞেসি করে ফেলে–

–ভালো হবে মানে? এই রিপোর্ট গুলোর পেসেন্ট কি বেঁচে আছে?

–হ্যাঁ। পেসেন্ট বেঁচে আছে,,ইভেন পেসেন্টের বর্তমান মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে আমি মি.জাভিয়ানের কাছে পেসেন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে সে আমাকে তার কয়েকটা ভিডিও ফুটেজ দেখায়। সেখানে আমি দেখি যে,, পেসেন্ট মানে স্পর্শীয়া তালুকদার ফিজিক্যালি সুস্থ থাকলেও মেন্টালি সুস্থ নেই।

ডা.এহসান এক নিশ্বাসে তার কথাগুলো শেষ করেন। আর তার কথাগুলো শুনে হানিয়া-ইনায়া বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী স্পর্শীয়া বেঁচে আছে? তাহলে আড়াই বছর আগের ও-ই লাশটা কার ছিলো? আর তার চেয়েও বড় কথা জাভিয়ান যদি জানেই স্পর্শীয়া বেঁচে আছে তাহলে সকলকে বলছে না কেন? কেনই এমন লুকোচুরি খেলা খেলছে সে?

শব্দসংখ্যা~১৮৩৫

~~চলবে..?