প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-২৯+৩০

0
372

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_উনত্রিশ

আজ বেশ কয়েকদিন ধরে হানিয়াকে অন্যমনষ্ক লাগছিলো জাভিয়ানের কাছে। লন্ডনে আসার শুরুতে শুরুতে জাভিয়ান যখন ফোন দিতো তখন হানিয়ার কণ্ঠে কেমন একটা উৎফুল্লতা থাকত ইদানীং তা পায় না জাভিয়ান কথা বলার সময়। ভিডিও কলেই তাদের বেশিরভাগ সময় কথা হয়। যখন ফোন দেয় তখন হানিয়া কেমন এক ধ্যানে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে,,মাঝে মধ্যে হুট করে তার চোখের কোণায় অশ্রুদের আনাগোনাও জাভিয়ানের নজরে পরে। জাভিয়ান তাকে বেশ কয়েকবার এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেও হানিয়া কথা কাটিয়ে দেয়। জাভিয়ান ভাবে হানিয়া তার আগের ব্যবহারগুলোর জন্য হয়ত এমন করে। কিন্তু কোথাও যেন একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

জাভিয়ানের অফিসের কাজটা ১৫-২০ দিনের হলেও জাভিয়ান আজ ১৩ দিনের মাথায় দেশে ফিরছে। বাসার কেউই জানে না,,একমাত্র মনি ছাড়া। তাকে জানিয়েছে কারণ জাভিয়ান চাইছে সে ফিরেই হানিয়াকে নিয়ে ঢাকার বাহিরে ঘুরতে যাবে। বলা চলে ছোটখাটো একটা হানিমুন আরকি। মনি যাতে হানিয়াকে আগে থেকে রেডি করিয়ে দেয় তাই তাকে জানানো। কিন্তু জাভিয়ান দেশে পা রাখার পর এয়ারপোর্টেই থাকতে যখন মনিকে ফোন দিলো,, তখন মনি জানায় হানিয়া নাকি সেই সকালে বের হয়েছে এখনো নাকি ফিরে নি। ফোনটাও বন্ধ বলছে। জাভিয়ান তার হাত ঘড়িতে সময় চেক করলে দেখে দুপুর একটার কাছাকাছি। জাভিয়ান ভাবে হানিয়ার কলেজ তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে তাহলে এখনো বাসায় কেন ফিরে নি হানি? তার চেয়ে বড় কথা ফোনটা কেন বন্ধ তার অপ্রিয় বউয়ের?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখটা বন্ধ করে। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে,,চোখ জোড়াও সেই অপ্রিয় বউটাকে দেখার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। হুট করে চলন্ত গাড়ি থেমে যায়। জাভিয়ানও চোখ খুলে। বুক করা ক্যাব ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে–

–কি হলো? গাড়ি থামালেন কেন?

–স্যার! সামনে অনেক মানুষের একটা জটলা পেকে আছে। মনে হয় কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে,, যেতে হয়ত সময় লাগবে।

ড্রাইভারের কথা শুনে জাভিয়ানের কপালে কয়েকটা ভাজ পরে। আসলেই কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে কিনা দেখার জন্য জাভিয়ান গাড়ি থেকে বের হয়। কয়েক কদম হাঁটার পর দু’জন ব্যক্তি কথা বলতে বলতে ওই পথ দিয়েই আসছিলো,,তাদের থামিয়ে জাভিয়ান তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করে–

–কি হয়েছে ওখানে??

–আরে ভাই কইয়েন না,,একটা মাইয়ারে একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়া গেছে। মাইয়া ডা ধাক্কা খাইয়া রাস্তার পাশের লেনের সাথে গিয়া মাথায় বারি খায়। মাথা ফাইট্টা অবস্থা খারাপ। ট্রাক ড্রাইভারও ট্রাক থুইয়া ভাগছে।

— কেউ মেয়েটাকে হসপিটালে নিয়ে যায় নি?

–কেডা নিয়া যাইবো? এক্সিডেন্ট কেস। গেলেই পুলিশি ঝামেলা ফাঁসা লাগবো তাই কেউ আগ বাড়াইয়া আইতাছে না মাইয়াডারে সাহায্য করার লেগা। তাও কেডা নাকি এম্বুলেন্সে কল করছে,,হেরা আইতে আছে।

কথাটা বলেই ব্যক্তিন দু’জন চলে যায়। জাভিয়ান তাদের কথা শুনে তাজ্জব বনে যায়। আজকালকার মানুষেরা কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছে। ঝামেলা পোহাতে হবে বলে একজন মানুষকে এভাবেই রাস্তায় ফেলে রেখে তামাশা দেখছে। জাভিয়ান আর বেশি কিছু না ভেবে ভীরের দিকে এগোতে থাকে। যতই এগোচ্ছে ততই তার বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট করে উঠছে। আশ্চর্য এমন হচ্ছে কেন? জাভিয়ান ভীর ঠেলে এক্সিডেন্ট স্পটে গিয়ে দাড় হয়। মেয়েটা উল্টো দিকে মুখ করে পরে আছে। জাভিয়ান কাঁপা কাঁপা পায়ে তার কাছে যেতে থাকে। ভীর থেকে একজন বলে উঠে–

–কই যান মিয়া? এক্সিডেন্ট কেস,,মইরা গেছে মনে হয়। ধইরেন না,,পরে ঝামেলায় ফাঁসবেন।

জাভিয়ান লোকটির কথায় পাত্তা দেয় না। হেঁটে এসে মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে,,তারপর আলতো হাতে মেয়েটির কাঁধ ধরে সোজা করে। মুখটার একপাশে রক্তে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। জাভিয়ান তার গালে হাত দিয়ে মুখটা সোজা করলে তার অর্ন্তআত্না কেঁপে উঠে। এ যে তার অপ্রিয় বউ। জাভিয়ান রিয়াকশন করতে ভুলে যায়। তার মাথা সম্পূর্ণ ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়। সে থম মেরে বসে থাকে।

তখনই এম্বুলেন্স এসে পরে। সেখান থেকে দু’জন লোক বের হয়ে হানিয়াকে স্ট্রেচারে উঠাতে যাবে তখন তার হুশ ফিরে। সে হানিয়াকে ঝাপটে ধরে নিজের বুকের সাথে। চিৎকার করে বলতে থাকে–

–দূরে সরে যাও সবাই। কেউ আমার বউকে ধরবে না,,কেউ না।(হানিয়ার গালে আলতো চাপড় মেরে বলতে থাকে) বউ উঠো,,কি হয়েছে? ব্যথা পেলা কীভাবে? উঠো,, দেখো তোমার বরসাহেব এসে পরেছে। তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি আসলাম আর তুমিই আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে দিলে? উঠ বধূয়া,,কত প্ল্যান করেছি তোর জন্য,, তুই বারবার আমার প্ল্যান ভেস্তে দিতে পারিস না। উঠ না বউ।

জাভিয়ান কেমন পাগলের মতো করতে থাকে আর হানিয়াকে ঝাঁকাতে থাকে। বারবার বলছে হানিয়াকে উঠতে কিন্তু হানিয়া কি আর উঠে। উপস্থিত জনতা তার এমন কান্ড দেখে বুঝতে পারে সে হানিয়ার স্বামী। একজন তো বলেই বসে–

–মরা মানুষ কেমনে কথা কইবো?

জাভিয়ান তাকে ধমক দিয়ে বলে–

–চুপপপপপ! আমার বউয়ের কিছু হয় নি। আমি ওকে এখনি হসপিটালে নিয়ে যাবো। কিচ্ছু হবে না ওর।

কথাটা বলেই জাভিয়ান হানিয়াকে কোলে তুলে নেয়। হসপিটাল থেকে আসা লোকেরা জাভিয়ানকে বলে হানিয়াকে স্ট্রেচারে শোয়াতে কিন্তু জাভিয়ান তা করে না। নিজেই হানিয়াকে কোলে তুলে এম্বুলেন্সে গিয়ে বসে। এম্বুলেন্সে ঢুকে হানিয়ার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দেয় একজন। অনেকটা রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে হানিয়া খুব আস্তে শ্বাস নিচ্ছে। সারাটা রাস্তা নিজের কোলে করেই রাখে জাভিয়ান। হসপিটালে আসার পর সে আরেক পাগলামি জাভিয়ানের।

জাভিয়ান হানিয়াকে কোলে করে তাড়াতাড়ি করে হসপিটালের মধ্যে ঢুকে পরে। চিৎকার করে ডাকতে থাকে ডাক্তারদের। নার্সরা জাভিয়ানকে বারবার বলছে হানিয়াকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিতে কিন্তু জাভিয়ানের এক কথা ডাক্তার ডাকেন আগে। বাধ্য হয়ে একজন নার্স দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার এসে জাভিয়ানকে বলে–

–পেসেন্টকে এভাবে রাখায় তার আরো প্রবলেম হতে পারে। আপনি প্লিজ তাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দেন। আমি দেখছি কি হয়েছে তার।

জাভিয়ান এবার আর কোন দ্বিরুক্তি করে না। হানিয়াকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে তার একহাত শক্ত করে ধরে রাখে। ডাক্তার হানিয়াকে এক্সামিন করে দেখে তার অবস্থা বেশি ভালো না। ডাক্তার নার্সকে বলে–

–উনাকে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দিয়ে ওটির জন্য রেডি করুন। পেসেন্টের কন্ডিশন বেশি একটা ভালো না।

নার্সটি ডাক্তারের কথা মতো হানিয়াকে নিয়ে যায়। হানিয়ার হাতটা যখন জাভিয়ানের হাত থেকে আলাদা করা হচ্ছিল তখন জাভিয়ানের মনে হয়,, তার কলিজায় হাজারটা সুচ গেঁথে দেওয়ার মতো কষ্ট হচ্ছিল। নার্সটি চলে গেলে ডাক্তার জাভিয়ানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–

–দেখুন মি. আপনাকে ভেঙে পরলে চলবে না। শক্ত হতে হবে এই কঠিন সময়ে। আপনার বাড়ির সকলকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিন। আর মনে হচ্ছে পেসেন্টকে ব্লাড দিতে হবে। পেসেন্ট আপনার কে হয় মি.?

জাভিয়ান নিস্তেজ গলায় বলে–

–আমার ওয়াইফ।

–ওহ্হ। আপনার ওয়াইফের ব্লাডগ্রুপ কি একটু জানিয়ে দিয়েন নার্সদের,,তাহলে আমরা আমাদের ব্লাডগ্রুপে চেক করে দেখবো সে গ্রুপের ব্লাড আছে কিনা।

–আমার সঠিক তার ব্লাডগ্রুপ সম্পর্কে জানা নেই।

ডাক্তারটি জাভিয়ানের এমন কথা শুনে একটু অবাকই হয়। হাসবেন্ড হয়ে ওয়াইফের ব্লাডগ্রুপ সম্পর্কে জানে না। তাও সে বেশি একটা মাথা ঘামায় না। চলে যায় নিজের কাজে। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর জাভিয়ান পাশে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পরে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না হানিয়ার এত বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। জাভিয়ান চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করতে চায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই হানিয়ার রক্তে ভেজা মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ধপ করে সে চোখ খুলে তাকায়। দু’হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে। না চাইতেও তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে তার অপ্রিয় বউয়ের জন্য। যে জাভিয়ান কিছুকাল অব্দিও চাইতো হানিয়ার বিষাদের কারণ হতে,, সেই জাভিয়ানই আজ হানিয়ার জন্য নিজের মূল্যবান অশ্রু ঝরাচ্ছে। এটা কি আদৌও বিশ্বাস যোগ্য?

______________________

ডাক্তারের কথা অনুযায়ী জাভিয়ান তার এবং মির্জা বাড়িতে ফোন দিয়ে হানিয়ার এক্সিডেন্টের খবর জানায়। সকলে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়ে পরেছে অলরেডি। জাভিয়ান তাদের ফোন নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো তখন একজন নার্স কিছু পেপারস নিয়ে জাভিয়ানের কাছে আসে। জাভিয়ান নার্সটিকে জিজ্ঞেস করে–

–এগুলো কিসের পেপারস সিস্টার?

–দেখুন স্যার!আপনার ওয়াইফের অবস্থা বেশি একটা ভালো না। এটা হলো বন্ড পেপার। এখানে আপনাকে সাইন করতে হবে,,যাতে অপারেশন চলাকালে যদি আপনার ওয়াইফের কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাদের হসপিটাল এটার জন্য দায়ী থাকবে না।

জাভিয়ানের অপ্রিয় বউয়ের অবস্থা এটাই ক্রিটিকাল যে কিছু হয়ে যেতে পারে? কথাটা জাভিয়ানের কান শ্রবণ করলেও মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ। নার্সটির কথা শুনে জাভিয়ান বসা থেকে দাড়িয়ে গিয়ে রেগে চিৎকার করে তাকে বলে–

–কিচ্ছু হবে না আমার হানির। আমার বউকে আমি সুস্থ সবল দেখতে চাই,,তাই আপনাদের হসপিটালে আনা। যদি কিছু হয় আমার বউয়ের আই সোয়্যার,,আপনাদের হসপিটাল আমি মাটির সাথে মিশিয়ে দিবো। যত টাকা লাগবে আমি দিবো কিন্তু আমার বউকে সুস্থ করে আমার কাছে ফেরত দিবেন আপনারা।

জাভিয়ানের এমন চিৎকার করে কথা বলায় আশেপাশের সকলে দাঁড়িয়ে পরে,,তার কথা শুনতে থাকে। জাভিয়ানের চিৎকার আর রাগ দেখে নার্সটি ভয়ে সিটিয়ে যায়। ততক্ষণে তালুকদার পরিবারের সকলে এসে পরেছে। মি.তালুকদার এসে জাভিয়ানকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরেন। জাভিয়ানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–

–শান্ত হও বাবা। কিছু হবে না হানিয়ার ইনশা আল্লাহ।

এতক্ষণে একজন ভরসা যোগ্য হাত আর কাদার মতো একটা কাঁধ পেয়ে জাভিয়ান নিজের কান্না ধরে রাখতে পারে না। সেও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। মি.তালুকদার তাকে সময় দেয় নিজেকে শান্ত করতে। নার্সি তাকে সাইন করার জন্য তাড়া দিলে জাভিয়ান মি.তালুকদারকে ছেড়ে নার্সের দেওয়া বন্ডপেপারে সাইন করে দেয়। সাইন শেষ হলে নার্সি চলে যায় নিজের কাজে।

পেপার সাইন হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হানিয়ার অপারেশন শুরু হয়ে যায়। অপারেশন শুরু হওয়ার মিনিট দশেক পরেই হানিয়ার বাবার বাড়ির লোকেরাও এসে পরে। হানিয়া মা-বোন কাদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে অলরেডি। হানিয়ার ভাবীও কাঁদছে,, কিন্তু একটা ছোট বাচ্চাও তার কান্না দেখে বলে দিতে পারবে সে জাস্ট নাটক করছে।

____________________

সাড়ে চার ঘন্টা পর ওটির লাইট বন্ধ হয়। সকলে অপেক্ষা করতে থাকে ডাক্তারের বের হওয়ার আর একটা সুসংবাদের। মিনিট দুয়েক পর ডাক্তাররা বের হন,,কিন্তু তাদের মুখটা কেমন একটা মলিন। জাভিয়ানের বুকটা ধুক করে উঠে। সকলে ডাক্তারের দিলে এগিয়ে গেলেও জাভিয়ান নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবরার ডাক্তারকে অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে–

–ডা. আমার বোনের কি অবস্থা? সব ঠিক আছে তো? অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে?

ডাক্তার বলে–

–দেখুন আপনাদের মিথ্যা আশ্বাস দিবো না। পেসেন্টের অবস্থা এতো ভালো না। মিরাক্কেল ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের।

ডাক্তারের কথা শুনে মিসেস মির্জা অজ্ঞান হয়ে পরে যেতে নিলে সোনিয়া ধরে ফেলে মাকে। রোজি বেগমও হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। সকলের মধ্যেই শোকের মাতম শুরু হয়ে যায়। কিন্তু একজন ব্যক্তি তখনও নির্বিকার। অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

শব্দসংখ্যা~১৫০০

~~চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ত্রিশ

শূন্য দৃষ্টি নিয়ে জানালার বাহিরের ব্যস্ত নগরীর দিকে তাকিয়ে আছে জাভিয়ান। আজকাল তার সকল অনুভূতিই যেন শূন্য হয়ে গেছে। কোথাও একটু শান্তি মিলছে না। কেন এমনটা হচ্ছে তার সাথে? মন বলে ওই অপ্রিয় রমনীর জন্য কিন্তু মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ। মন-মস্তিষ্কের এই লড়াইয়ের মস্তিষ্ক বারংবার জিতে যাচ্ছে। আর তাকে ফেলে দেয় অদ্ভুত এই অশান্তিতে।

জানালা থেকে চোখ সরিয়ে হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয় জাভিয়ান। সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। অফিস আওয়ার প্রায়ই শেষ। অফিসে তেমন কাজ না থাকায় বসা থেকে দাড়িয়ে চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখা ব্ল্যাক কালারের ব্লেজারটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নেয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় এখন,,বেশ কড়া শীত পরেছে এই ব্যস্ততার নগরী ঢাকায়। ব্লেজার গায়ে দিয়ে ল্যাপটপ ব্যাগ ও নিজের ফোনটা নিয়ে বাহিরে এসে পরে। নিজের পি.এ. শামীমকে বলে আসে বাকি কাজগুলো যেন সেই গুছিয়ে রাখে। কথাটা বলে নিচে পার্কিংলটে এসে নিজের গাড়িতে বসে। ড্রাইভার তাকে জিজ্ঞেস করে–

–স্যার কোথায় যাবো? বাসায় নাকি হসপিটালে?

জাভিয়ান অন্যমনষ্ক হয়ে কি জানি ভাবছিলো,, ড্রাইভারের কথায় তার ধ্যান ফিরে। সে ক্ষীণ স্বরে বলে–

–হসপিটালে চলেন।

ড্রাইভার জাভিয়ানের নির্দেশ মতো গাড়ি হসপিটালের দিকে নিয়ে চলে। আধাঘন্টার মাঝে তারা হসপিটালে এসে পৌঁছায়। হসপিটালের ভেতরে প্রবেশের পূর্বে জাভিয়ান ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিয়ে বলে–

–আপনি অন্য গাড়ি ভাড়া করে বাসায় চলে যান। আমার দেরি হবে ফিরতে। আপনার ততক্ষণ অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই,, গাড়িটা রেখে যান।

কথাটা বলেই সে চলে যায়। ড্রাইভারও তার কথামতো হসপিটালের পার্কিংয়ে গাড়িটা পার্ক করে চলে যায় বাসায়।

_______________________

প্রাইভেট হসপিটালের ফোর্থ ফ্লোরের ১২ নাম্বার কেবিনে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে জাভিয়ানের অপ্রিয় বউটি। সেদিন হানিয়া সার্ভাইভ করতে পারলেও চোখ মেলে দেখেনি তার বরসাহেবকে। বরং তার বুকের পীড়া বাড়িয়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে। মেডিকেল সাইন্সের ভাষায় একে “কোমা” বলা হয়। আমরা সকলেই কম বেশি এই নামটা শুনেছি এবং এর সম্পর্কে জানি।

জাভিয়ান হানিয়ার ডাক্তারের সাথে কথা বলে তার কেবিনে আসে। জাভিয়ান কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে,, দেখতে পায় অনেকগুলো যন্ত্রপাতির মধ্যে শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে থাকা তার রমনীকে। যে আজ ২০ দিন যাবত এইভাবেই ঘুমিয়ে আছে। কবে তার এই ঘুম ভাঙবে আর কবে জাভিয়ানের বুকের এই নাম না জানা পীড়া কমবে সে জানে না। জাভিয়ান হেঁটে এসে হানিয়ার বেডের পাশের টুলে বসে । সারাদিনের তৃষ্ণা মেটাতে থাকে হানিয়াকে দেখে। আগে তার দিন শুরু হতো হানিয়ায় আর শেষও হতো এই হানিয়ায়। কিন্তু আজ বিশদিন যাবত তা হচ্ছে না। প্রাইভেট হসপিটাল হওয়ায় এখানের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে সে তার অপ্রিয় বউকে দেখতে পারে। তাই আজকাল আর হানিয়াকে দিয়ে জাভিয়ানের দিন শুরু বা শেষ হয় না। আবার কবে এমনটা হবে জাভিয়ান জানে না। আদৌও আর হবে কিনা তাও জাভিয়ান জানে না।

__________________

কুলসুম জাভিয়ানের রুম থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে পেছনে ফিরে তখন শায়লা বেগমকে দেখে তার আত্মা ধক করে উঠে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পরেছে,,আর এখন তাকে রামধোলাই দেওয়া হবে। সে ভয়ে ঘামতে থাকে।

শায়লা বেগম তাকে এমন ঘাবড়ে যেতে দেখে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে–

–কি রে তোর কি হয়েছে? এই শীতের মধ্যেও এমন ঘামছিস কেন?

–না..খা.লাম্মা। গরম লাগতাছে তাই ঘামতাছি।

–এই শীতের মধ্যেও তোর গরম লাগছে? আর তুই জাভিয়ানের রুমে কি করছিলি?

–আসলে খা..লাম্মা..হইছে কি…

–কি আমতা আমতা করছিস? ভালো করে কথা বল গাধা।

বেশ জোরে ধমক দিয়ে কথাটা বলেন শায়লা বেগম। কুলসুম কি বলবে? সে আমতা আমতা করে বলে–

–আসলে ভাইজানের গাছগুলায় পানি দিতে আইছিলাম। অনেক দিন ধইরা পানি দেওয়া হয় না,, কেমন চুপসায় গেছিলো তাই ভাবলাম আইজ একটু পানি দেই। আগে তো ভাবীই দিতো তাই আমার আর আসা লাগত না ভাইজানের রুমে।

–ওহ্হ। যা নিচে যেয়ে আমার জন্য একটা কড়া করে ব্ল্যাক টি করে নিয়ে আয়। মাথা প্রচন্ড ধরেছে।

–আচ্ছা খালাম্মা।এহনি আনতাছি।

কথাটা বলে কুলসুম হুড়মুড়িয়ে নিচে নেমে আসে। তারপর কিচেনে এসে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। সে ভেবেছিলো আজ ধরাই পরে যাবে। সে চায়ের পানি চুলায় দিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে আসে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে একবার দেখে নেয় ধারেকাছে কেউ আছে নাকি কেউ। নাহ,,কেউ নেই। রোজি বেগম তার রুমে বসে থাকে এই সময়টায়। আর শায়লা বেগম তো মাত্রই নিজের রুমে গেলো আর আরসাল তালুকদার মসজিদে গেছেন। বলতে গেলে বাসা মোটামুটি ফাঁকাই। সে বাসার ল্যান্ডলাইনে একটা নাম্বার উঠিয়ে কল লাগায়। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি দুটো রিং হওয়ার পরই ফোন রিসিভ করে। কুলসুম তাকে সালাম দিয়ে বলে–

–ভাইয়া কাজটা হইয়া গেছে।

–কেউ তোমাকে দেখে নি তো? আর জিনিসটা জায়গা মতো রেখেছ তো?

–না ভাইয়া কেউ দেহে নাই। আর জিনিসটাও জায়গা মতো রাখছি।

–ধন্যবাদ বোন।

–ধন্যবাদ দিতে হইবো না। আমার মতো কাজের মেয়েরে আপনি আপনার বোনের আসনে বহাইছেন এডা আমার জন্য অনেক। দোয়া করবেন ভাইয়া আমার জন্য।

–অবশ্যই। ভাইয়েরা সবসময় বোনেদের জন্য দোয়া করে আর এটা ভাইয়েদের বলে দিতে হয় না। আর শুনো,,তোমার কোন হেল্প লাগলে হানিয়া যদি সাহায্য করতে না পারে তাহলে আমাকে কিন্তু অবশ্যই জানাবে। আমি আমার সাধ্য মতো আমার এই বোনকে সাহায্য করার চেষ্টা করবো।

–আচ্ছা ভাইয়া। এখন তাহলে রাখি। ভালে থাকবেন।

–আচ্ছা। তুমিও ভালো থেকো বোন।

কথা শেষ করে আবরার ফোনটা কেটে দেয়। ফোনটা কেটে তা ট্রাউজাটের পকেটে রেখে বুকে হাত বেঁধে ভাবতে থাকে তিনদিন আগের কথা।

~তিনদিন আগে~

আবরারে তার মায়াবতীর ডায়েরিটা পড়া শেষ করেছে আরো দুদিন আগে। হানিয়া বলেছিলো জাভিয়ান জানার আগেই যেন ডায়েরিটা তাকে দিয়ে দেয়,,সে জায়গা মতো রেখে দিবে। কিন্তু হানিয়া এখন কোমায়।তাহলে ডায়েরিটা কে রাখবে জায়গা মতো? তারউপর তাকে আবার তার কর্মস্থল রাজশাহীতে ফিরতে হবে। অফিস থেকে অনেক কষ্টে এই কয়েকটা দিন ছুটি নিয়েছিল। ছুটি শেষ হয়ে যাবে কাল। কাকে দিয়ে রাখাবে সে ডায়েরিটা?

প্রশ্নটা তাকে বেশ অস্থির করে তুলে,,তখনই তার মাথায় আসে কুলসুমের কথা। কুলসুম প্রতিদিন বিকেলের দিকে রোজি বেগমের সাথে হানিয়াকে দেখতে হসপিটালে আসে। মেয়েটা এই কয়েকদিনে হানিয়াকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছে,,তাই প্রতিদিন তার আসা লাগবেই। আবরার ঠিক করে তাকে দিয়েই ডায়েরিটা রাখাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আবরার পরেরদিন হসপিটালে আসে ঠিক সেই সময়টায় যখন রোজি বেগম আর কুলসুম হানিয়াকে দেখতে আসে। সে কৌশলে কুলসুমকে একা ডেকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে। তার কথা অনুযায়ী কুলসুম আজ কাজটা করে। আবরার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ডায়েরিটা যতক্ষণ তার কাছে ছিলো মনে হচ্ছিল আবারো পড়তে । কিন্তু যখনই ডায়েরিটা পড়ে তার চোখ দিয়ে অশ্রুরা বিনা অনুমতিতে গড়িয়ে পরে। এসব কিছুই ভেবে আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হালকা কুয়াশায় ছেয়ে থাকা আকাশ টার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে–

–যেখানেই থাকো ভালো থাকো আমার না হওয়া ভালোবাসা। এই দুনিয়ায় না হোক,,ওপারের দুনিয়ায় আমি তোমার দাবী ছাড়বো না।

______________________

–স্যার! ভিজিটিং আওয়ার শেষ। আপনাকে এখন যেতে হবে।

জাভিয়ান এতক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলো হানিয়ার দিকে। নার্সের কথায় তার ঘোর কাটে। সে ইশারায় নার্সকে বলে “সে যাচ্ছে “। নার্সটি তার ইশারা বুঝতে পেরে চলে যায় সেখান থেকে। জাভিয়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়,, তারপর হানিয়ার অনেকটা কাছে এসে তার দিকে ঝুঁকে হানিয়ার মাথায় তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ঠোঁটের ছোঁয়াটা ছিলো দীর্ঘক্ষণের। জাভিয়ান জানে না সে এটা কেন করে,,কিন্তু প্রতিদিন তার এটা করা লাগবেই,,নাহলে সে শান্তি পায় না। ঠোঁট ছোঁয়ানো হয়ে গেলে মুখটা কিছুটা নামিয়ে আনে কানের কাছে। তারপর ফিসফিসয়ে বলে–

–আমার শান্তিময় জীবনে অশান্তি নিয়ে আসার জন্য আপনার জন্য কঠিন পানিশমেন্ট আছে মিসেস তালুকদার। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন,,চোখ মেলে তাকিয়ে এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করুন। নাহলে পানিশমেন্ট কিন্তু বাড়তেই থাকবে। কাল জানি এসে আপনাকে চোখ খোলা অবস্থায় দেখি।

কথাটা বলে হানিয়ার কানে ঠোঁটের পরশ দেয়। মুখ তুলে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে,,তারপর হাঁটা শুরু করে বাড়ির উদ্দেশ্য।

________________________

সকালবেলা সকালে ধুমধাম শব্দে জাভিয়ানের কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যায়। কেউ একজন দরজায় ধুমধাম করে শব্দ করছে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় মাথা ভার হয়ে আছে। তারউপর সকালবেলা সকালে এমন শব্দে মেজাজের পারদ হাই হয়ে যায় তার। সে শোয়া থেকে উঠে প্রচন্ড রাগ দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। যেই হোক না কেন কিছু কড়া কথা না শোনানো পর্যন্ত সে শান্ত হবে না আজ। দরজাটা ঠাশ করে খুলে দরজা ধাক্কানো ব্যক্তিটিকে কিছু বলতে যাবে দেখে রোজি বেগম,,তাও আবার কান্নারত অবস্থায়। রোজি বেগম জাভিয়ানকে ধরে বলে–

–বাবু আমাকে হসপিটালে নিয়ে চল। ডাক্তার ফোন করেছিলো। হানিয়ার অবস্থা নাকি ভালো না। ভোর রাত থেকে রেসপন্স করছে না আমার মেয়ে।

কথাটা বলতে বলতে রোজি বেগম ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয়। জাভিয়ান তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। কথাটা শোনার পর তার বুক টাও কেমন ধকধক করছে। রোজি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলে–

–হানিয়াও কি স্পর্শের মতো আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে জাভিয়ান?

কথাটা শুনে জাভিয়ানের বুকে চাপ খায়। সত্যিই কি তার পাখি তাকে ফাঁকি দিয়ে উড়াল দিবে দূর আকাশে??

~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ত্রিশ(বর্ধিতাংশ)

জাভিয়ানসহ দুই পরিবারের সকলেই HBU ইউনিটের সামনে অপেক্ষা করছে। ব্রেন যখন আর রেসপন্স করে না বা কার্যকর হয় না, তখন তাকে সাধারণত Hypothermic Brain Unit (HBU)-তে রাখা হতে পারে। এটি একটি বিশেষায়িত ইউনিট যেখানে ব্রেনের কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য হাইপোথার্মিক থেরাপি (Hypothermia Therapy) ব্যবহার করা হয়।

সকলে নিজেদের বুকের ধুকপুক আওয়াজ যেন নিজেই শুনতে পারছে। হানিয়ার মা একটু পরপর গুনগুনিয়ে কেঁদে উঠছে। রোজি বেগমের অবস্থা অনেকটা তেমনই। ডাক্তাররা বলেছে”যেকোন খারাপ সংবাদ শোনার জন্য তাদের প্রসস্ত থাকতে” আবরার ঢাকায় না থাকায় আদরের বোনের এমন সংবাদ শুনেও উপস্থিত থাকতে পারে নি। সকলে যখন প্রায় ভেঙে পরেছে তখনও জাভিয়ান মনের মধ্যে একটা আশা নিয়ে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার মন বলছে তার অপ্রিয় বউয়ের কিছু হবে না।

প্রায়ই তিন ঘন্টার পর ডাক্তাররা বের হয়। সকলের চোখে মুখে কিছুটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। ডাক্তার তাদের সামনে এসে খানিকটা হাসি মুখে বলে–

–আলহামদুলিল্লাহ পেসেন্ট রেসপন্স করছে ভালোই। আশা করা যায় তার সেন্স তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

ডাক্তারের কথায় যেন সকলের অশান্ত হৃদয়ে শান্তির বাতাস লাগে। আরসাল তালুকদার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে–

–আমরা কি ওকে একবার দেখতে পারি?

–এখন না। একটু পরে তাকে কেবিনে শিফট করা হবে তখন যেকোন একজন গিয়ে দেখতে পারবেন। কিন্তু হ্যাঁ,,কোন আওয়াজ করা যাবে না। এটা তার ব্রেনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

–ওকে ডাক্তার। ধন্যবাদ আপনাকে।

–ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। ইটস মাই ডিউটি।

কথাটা বলে ডাক্তার চলে যায়। সকলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। জাভিয়ান সকলকে বলে বাসায় চলে যেতে। কেউ তার কথায় রাজি হয় না। জাভিয়ান অনেক কষ্টে সকলকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। একমাত্র সে থেকে যায় হানিয়ার কাছে।

_______________

সোনিয়া ফোন করে আবরারকে হানিয়ার কন্ডিশন সম্পর্কে জানায়। আবরারও স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। বোন দুটো তার অনেল আদরের। তার জন্মের এগারো বছর পর হানিয়া-সোনিয়া জন্মায়। তখন সে প্রায়ি সবই বুঝে। পুতুল দু’টোকে পেয়ে সে কত যে খুশি হয়েছিলো তা সে বলে বুঝাতে পারবে না। সারাদিন তাঁদের দু’টোকে নিয়েই আবরারের দিন কাটতো। সেই আদরের বোনটার আজ এই অবস্থা। আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়।

_________________________

হানিয়াকে নরমাল কেবিনে শিফট করা হয়েছে। জাভিয়ান তার হাত ধরে বসে আছে। নজর তার হানিয়ার মুখের দিকে। গোলগাল মুখের চাপাটা ভেঙে গেছে একদম। কোমড় সমান চুল গুলো ছেঁটে ফেলতে হয়েছে অপারেশনের জন্য। চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। বলতে গেলে জাভিয়ান ছোট্টখাট্ট গোলগাল বউটার অবস্থা অনেকটাই করুণ। আর সে এই করুণ অবস্থাটাই মেনে নিতে পারছে না।

জাভিয়ান যখন হানিয়াকে দেখতে ব্যস্ত তখনই জাভিয়ানের মনে হলো তার ধরে রাখা হাতটার আঙ্গুল গুলো হালকা করে নড়ে ইঠেছে। সে হানিয়ার হাতের দিকে তাকালে দেখতে পায় আসলেই হানিয়ার আঙুল একটু একটু করে নড়ছে। জাভিয়ানের অশান্ত চিত্ত উল্লাসে মেতে উঠে। হানিয়ার আঙুল থেকে চোখ সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালে দেখতে পায় চোখের পাতাও নড়ছে একটু একটু করে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হানিয়া আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। জাভিয়ান বসা থেকে উঠে হানিয়ার মুখের কাছে ঝুকে পরে। তার গালে হাত রেখে অস্থির হয়ে বলে–

–বধূয়া তুমি চোখ খুলেছো? এই দেখো তোমার বরসাহেব। খারাপ লাগছে?

হানিয়া জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। শুধু মাথাটা হালকা নাড়িয়ে বুঝায় তার খারাপ লাগছে,,কথাটা ঠিক করে বুঝাতে পেরেছে কিনা ঠিক জানা নেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। জাভিয়ান তাকে চোখ বন্ধ করতে দেখে ঘাবড়ে যায়। সে হানিয়াকে ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাক্তারদের ডাকতে থাকে। তার চিৎকারে একজন নার্স এগিয়ে এসে তার কাছে চিৎকারের কারণ জানতে চাইলে জাভিয়ান তাকে হানিয়া সম্পর্কে বলে। নার্সটি দৌড়ে গিয়ে একজন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসে।

ডাক্তার এসে হানিয়াকে চেকআপ করে জানায় তার অবস্থা আপাতত ভালো। চিন্তার কোন কারণ নেই। জাভিয়ান অস্থির হয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে–

–তাহলে ডাক্তার ও আবার কেন চোখ বন্ধ করে ফেললো? কোন কথাও তো আমার সাথে বললো না। আপনি কি সিউর ওর কন্ডিশন সম্পর্কে? দেখুন ডাক্তার আপনি নির্দ্বিধায় ওর সম্পর্কে আমাকে সব বলুন। আপনাদের যদি অন্যকোন বড় ডাক্তারের প্রয়োজন হয় সেটাও আমাকে জানান। আমি তাদের আনানোর ব্যবস্থা করবো কিন্তু আমি আমার ওয়াইফে সুস্থ চাই এট এ্যানি কস্ট।

ডাক্তারটা তার কথা শুনে হালকা হাসে। তার কাছে জাভিয়ানকে এখন বউ পাগল একজন লাগছে,,যে কিনা বউ বলতে জান দেয়। সে জাভিয়ানকে আশ্বাস দিয়ে বলে–

–আপনি হাইপার হবেন না মি.তালুকদার। আপনার মিসেস আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে। আর সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলার কারণ হলো,, ঔষধের কারণে। তার ব্রেনকে এখন যতটা সম্ভব রেস্ট দিতে হবে। আর ব্রেনকে রেস্ট দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ঘুম। সে যত বেশি ঘুমাবে তার ব্রেন তত তাড়াতাড়ি ক্ষতিটা রিকোভার করে উঠবে। আর আপনার আরেকটা প্রশ্ন,,আপনার সাথে কেন কথা বললো না? আপনি মনে হয় বউয়ের চিন্তা বাচ্চা হয়ে গেছেন মি.তালুকদার। সে মাত্রই কোমা থেকে বের হলো,,এখনি কি সে কথা বলার মতো অবস্থায় গেছে বলে আপনার মনে হয়?

ডাক্তারের প্রশ্নের কোন উত্তর জাভিয়ানের কাছে নেই। ঠিকই তো হানিয়া তো এখনো কথা বলার মতো সিচুয়েশনে যায় নি। ডাক্তারটি জাভিয়ানকে আরো কিছু বলতে চায় যা সে নার্সটির সামনে বলতে চাচ্ছে না,,তাই সে নার্সকে হানিয়ার কাছে রেখে জাভিয়ানকে নিয়ে তাট কেবিনে এসে পরে। তারা দু’জন কেবিনে আসার পর ডাক্তার জাভিয়ানকে বসতে বলে নিজেও বসে পরে। তারপর মুখে কিছুটা গম্ভীর্য নিয়ে এসে বলে–

–আপনাকে একটা পারসোনাল প্রশ্ন করি। আশা করি জবাব দিবেন মি.তালুকদার।

জাভিয়ান ডাক্তারের এমন গম্ভীর মুখ দেখে খানিকটা থতমত খায় কিন্তু তা ডাক্তারকে বুঝতে দেয় না। সে স্বাভাবিক গলায় বলে–

–জ্বি বলুন ডাক্তার।

–আপনার কি আপনাদের বিয়েতে মত ছিলো না বা আপনি কোন কারণে আপনার ওয়াইফে দেখতে পারেন না?

জাভিয়ান ডাক্তারের কথায় চমকে যায়। সে হয়ত কিছুটা বুঝতেও পেরেছে। তাও সে বলে–

–তেমন কিছু না ডাক্তার। আমাদের দুজনের সম্মতিক্রমে বিয়েটা হয়েছে।

–তাহলে আপনি আপনার ওয়াইফকে নির্যাতন করেন কেন? তার কি অন্য কোথাও অ্যাফেয়ার আছে?

হানিয়ার অ্যাফেয়ার? কস্মিনকালেও জাভিয়ান বিশ্বাস করবে না,,কারণ সে তো জানে হানিয়া এই কয়েকদিনে তাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে। আর নির্যাতন? কি-ই বা বলবে সে ডাক্তারকে? সে তো আর বলতে পারবে না যে হানিয়ার ভাইয়ের প্রতিশোধ সে হানিয়ার উপর নিচ্ছে।তাহলে ডাক্তার তাকে এখনি না পুলিশে দেয়। তাকে করা দু’টো প্রশ্নের একটারও উত্তর দেয় না জাভিয়ান। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল। ডাক্তার তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে–

–প্রশ্নটা আরো আগে করার ইচ্ছে আমার ছিলো কিন্তু তখন সিচুয়েশন ঠিল ছিলো না বলে করি নি। জানি প্রশ্নটা একটু বেশিই পারসোনাল হয়ে গেছে কিন্তু আমাকে আমার রোগীর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করতে হবে। দেখুন কিছু কথা বলি,,একটু ভেবে দেখবেন।

জাভিয়ান তখনও চুপ করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার বলতে থাকে–

–আপনি যদি তার সাথে সুখী না হন বা সে যদি আপনার সাথে না থাকতে চায় অথবা আপনিই যদি তার সাথে না থাকতে না চান তাহলে আলাদা হয়ে যান। মারপিট বা নির্যাতন কোন সলিউশন না। যে আপনার বা আপনি যার সে আপনার শত অবহেলার পরও থাকবে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। একটা সময় যখন দেখবেন না আপনার পার্টনার আপনার সাথে সুখী না বা আপনি তার দ্বারা সুখী হতে পারছেন না তখন সে আপনাআপনিই সরে যাবে। আপনি নিজেকে ও তাকে সময় দিন। সম্পর্কটাকে সময় দিন,,যদি আপনাদের মনে হয় – একে অপরের সাথে থাকা যাবে তাহলে তো ভালো,,নাহলে ডিভোর্স দিয়ে দেন। অপারেশনের সময় তাকে যখন ড্রেস চেঞ্জ করে ওটিতে নেওয়া হলো তার হাত-পা এবং শরীরে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে উপস্থিত সকলে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো। আমার সাথে ওটিতে থাকা আরেক ডাক্তার তখনই আপনার বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে চেয়েছিলো কিন্তু আমিই তাকে বললাম আগে পেসেন্টলর হেল্থ তারপর অন্য কিছু দেখা যাবে। আপনি হয়ত খেয়াল করেছেন আপনার মিসেসের হাতের কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত কালসিটে দাগ হয়ে আছে। এমন দাগ তার শরীরে অগণিত। আপনার ওয়াইফের ডাক্তার হিসেবে আমার একটা অনুরোধ থাকবে,, পরবর্তীতে এমন কিছু করবেন না। যদি করেনও তাহলে আপনার ওয়াইফের হেল্থ তা নিতে পারবে বলে মনে হয় না। আশা করি আমার কথাটা রাখবেন।

জাভিয়ান মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সম্মতি জানায়। ডাক্তার তাকে আর দু’একটা কথা বলার পর জাভিয়ান হানিয়ার কেবিনে এসে পরে। হানিয়া তখন ঘুমিয়ে আছে।

_______________________

হানিয়াকে হসপিটালে আরো এক সপ্তাহ রাখা হয় তার হেল্থের কথা চিন্তা করে। আজ তাকে হসপিটাল থেকে ছুটি দিবে। সকাল সকাল জাভিয়ান,,রোজি বেগম আর হানিয়ার বাসা থেকে তার বাবা-মা,,বোন এসে পরে। ডাক্তার হানিয়াকে টুকটাক পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেয়। বাসা রওনা হওয়ার সময় হানিয়ার বাবা আরসাল তালুকদারকে বলে–

–বেয়াই সাহেব,,আমরা চাচ্ছিলাম হানিয়াকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে। আপনারা যদি অনুমতি দেন।

আরসাল তালুকদার হাসি মুখে বলেন–

–মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু সম্পর্ক তো শেষ হয়নি মেয়ের সাথে আপনাদের। মেয়ে আপনাদেরও,, আপনারা আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যাবেন এতে আমরা অনুমতি দেওয়ার কে। হানিয়া যদি চায় তাহলে সে যাবে। কিন্তু আপনারা যদি মনে করেন হানিয়াকে শ্বশুর বাড়িতে অবহেলা করা হবে তাহলে আমি আমাদের বউমাকে দিবো না ভাইসাহেব।

হানিয়ার বাবা হাসি মুখে বলে–

–না না বেয়াই সাহেব। মেয়েটা অনেক দিন তো হলো যায় না বাসায়,,ওর মা আর আমি ভাবলাম মেয়েটাকে কিছু দিন আমাদের কাছে রাখি।

–ওহ্হ। আচ্ছা তাহলে যাক হানিয়া মা আপনাদের বাসায়। কিছুদিন বেড়িয়ে আসুক। জাভিয়ান না হয় কিছুদিন পর গিয়ে নিয়ে আসবে।

–আচ্ছা বেয়াই সাহেব।

হানিয়া এতক্ষণ চুপ করে বসে তার শ্বশুর বাবা আর নিজের বাবার কথা শুনছিলো জাভিয়ানের হাত ধরে। সে কয়েকবার নিজের হাত জাভিয়ানের থেকে ছাড়াতে চাইলেও জাভিয়ান ছাড়ে না। তাদের কথা শেষ হতেই হানিয়া জাভিয়ানের দিকে তাকায়। দেখে জাভিয়ান চোয়াল শক্ত করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হানিয়া তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আস্তে করে বলে–

–কিন্তু বাবা আমি তালুকদার বাড়িতে যেতে চাই।

সকলে তার কথায় কিছুটা অবাক হয়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় জাভিয়ান,, সেই সাথে খুশিও হয়। হানিয়ার মা এগিয়ে এসে বলে–

–যাবি তো। কিন্তু কয়েকদিন আমাদের কাছে থেকে তারপর যাবি।

–নাহ মা। তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমি তালুকদার বাড়িতেই যাবো। সুস্থ হয়ে তারপর না হয় ও বাড়িতে যাবো।

–কষ্ট কিসের? আমাদের সন্তান না তুই? সন্তানের জন্য কিছু করলে তা বাবা-মাকে কষ্ট দেয় না বরং স্বস্তি দেয়।

–আফসোস সেটা যদি তোমরা আগে বুঝতে। (হানিয়া নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। তার বাবা বুঝতে পারে হানিয়া কি বুঝিয়েছে) যাই হোক,, বেশি কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমি তালুকদার বাড়িতেই যাচ্ছি।

হানিয়ার মা-বাবা চেয়েও কিছু বলতে পারে না। যেখানে মেয়ে নিজেই চাইছে না সেখানে তারা আর কি বলবেন। হানিয়ার শরীর কিছুটা দূর্বল হওয়ায় একজন নার্স তার জন্য হুইলচেয়ার নিয়ে আসে তাকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য,, কিন্তু হানিয়া হুইলচেয়ারল যাবে না। তার কথা শুনে জাভিয়ান তাকে কোলে তুলতে নিলে হানিয়া তাকেও থামিয়ে দিয়ে বলে–

–সমস্যা আমার মাথায় হয়েছে,,পায়ে তো কিছু হয়নি। যদি আমি হাটা চলা করার মতো অবস্থাতে না থাকতাম তাহলে তো হুইলচেয়ারে করেই যেতাম। আমি নিজের পায়ে হেঁটে যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করা লাগবে না।

কথাটা বলে হানিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর সোনিয়াকে ইশারায় নিজের কাছে আসতে বলে। সোনিয়া তার কাছে আসলে সে সোনিয়ার সাহায্য নিয়ে আস্তে ধীরে হাঁটা শুরু করে। জাভিয়ান সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই হাতিয়ার যাওয়া দেখতে থাকে। মেয়েটা আজ এক সপ্তাহে প্রথম তার সাথে কথা বললো তাও এমন খোঁচা মারা। এ-ও বুঝি জাভিয়ানের সহ্য হয়?

শব্দসংখ্যা~১৬৪০

~~চলবে?