#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_একত্রিশ
রাস্তায় অতিরিক্ত জ্যাম থাকার কারণে হানিয়ারা এখনো বাসায় পৌঁছাতে পারে নি। জ্যামে বসে আছে তারা। জাভিয়ান একটু পরপর লুকিং গ্লাসে পেছনে বসা হানিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। হানিয়া তখন রোজি বেগমের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে তার অস্বস্তি হচ্ছে। জাভিয়ান কোন রাখঢাক না রেখেই হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–হানিয়া তোমার কি খারাপ লাগছে?
জাভিয়ানের প্রশ্ন শুনে গাড়িতে থাকা মি.তালুকদার আর রোজি বেগম হানিয়ার দিকে তাকায়। হানিয়া জাভিয়ানের প্রশ্নে চোখ খুলে তাকায়। কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন দেখায় হানিয়াকে। ঔষধের রিয়াকশনের কারণে তার অনেক ঘুম পায়। হানিয়া কিছুটা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে–
–খারাপ লাগছে না কিন্তু ঘুম পাচ্ছে অনেক। বাসায় কখন যাবো আমরা?
রোজি বেগম হানিয়ার কথা শুনে তাকে টেনে নিজের বুকে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–
–ঘুম পাচ্ছে? ঘুমা তাহলে আমার বুকে। বাসায় পৌছানোর পর ডেকে দিবো তোকে। এখন ঘুমা।
হানিয়া রোজি বেগমকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আবারও চোখ বন্ধ করে। জাভিয়ান তখনও তার দিকে তাকিয়ে থাকে লুকিং গ্লাসের মাধ্যমে। রোজি বেগমের জায়গায় তার থাকার কথা ছিলো কিন্তু আজ সে চেয়েও সেই জায়গাটায় থাকতে পারছে না। সবই তার নিজের জন্য হচ্ছে। একটু পর জ্যাম ছেড়ে দিলে জাভিয়ানও গাড়ি স্টার্ট দেয়।
_______________________
তারা বাসায় আসার পর রোজি বেগম হানিয়াকে ধরে গাড়ি থেকে নামায়। কলিং বেল দেওয়া হলে কুলসুম এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে কুলসুম হানিয়াকে দেখে অনেক বেশি খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। হানিয়া একটু চমকে গেলেও পরবর্তীতে সেও খুশি হয়ে কুলসুমকে জড়িয়ে ধরে। কুলসুম খুশি হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে–
–ভাবী আপনি কেমন আছেন এহন? খারাপ লাগতাছে না তো?
–না রে পাগলী। আমি ঠিক আছি আলহামদুলিল্লাহ।
তাদের কথায় মাঝেই জাভিয়ান বলে–
–কুলসুম তোর ভাবীকে ভেতরে তো ঢুকতে দিবি নাকি এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবি।
কুলসুম হানিয়াকে ছেড়ে দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কেটে বলে–
–শরি শরি ভাবী। বেশি খুশির ঠেলায় মিশটেক হইয়া গেছে।
হানিয়া কুলসুমের এমন ভুলভাল ইংরেজি শুনে হেসে দেয়। তারপর সকলে একসাথে ভেতরে প্রবেশ করে। রোজি বেগম তাকে সোফায় বসিয়ে দেয়। মি.তালুকদার,, জাভিয়ান তারাও সেখানেই বসে পরে। কুলসুম তাদের সকলের জন্য পানি নিয়ে আসে। টুকটাক কথা বলার পর মি. তালুকদার হানিয়াকে বলে–
–এখন তোমার রেস্ট নেওয়া উচিত মা। যাও নিজের রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। (জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে তাকে বলে) ওকে রুমে নিয়ে যাও জাভিয়ান।
জাভিয়ান যেন এই কথা শুনার জন্য বসে ছিলো। মি.তালুকদারের কথা শেষ করতে দেরি কিন্তু সে বসা থেকে উঠে হানিয়াকে কোলে তুলে নিতে দেরি হয় না। ঝট করে হানিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা দেয়। ঘটনাটা এতটাই তাড়াতাড়ি হয় যে সকলে হা হয়ে যায় তার কাজে।
হানিয়া আহাম্মকের মতো জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে,,আর জাভিয়ান নিজের মতো হেঁটে রুমের দিকে যেতে থাকে। কয়েক সিড়ি উঠার পর নিচ থেকে হাসির শব্দ শুনা যায়। হানিয়া নিজের ঘোর থেকে বের হয় এখন। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। শ্বশুর আর ফুফু শাশুড়ির সামনে এমনে করে কেউ কোলে তুলে? লজ্জা বলতে একটা বাক্য এখনো পৃথিবীতে আছে। হানিয়া দাঁতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে–
–আপনাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। নিজের বাবা আর ফুফুর সামনে কেউ বউকে কোলে তুলে? হসপিটালেও দেখলাম কোলে তোলার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। সমস্যা কি আপনার? এমন কোলে তোলার বাতিক উঠলো কেন?
হানিয়ার কথার মাঝেই তারা রুমে এসে পৌঁছায়। জাভিয়ান তাকে আস্তে করে বেডে বসিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে করে হানিয়ার হিজাব খোলার জন্য হাত বাড়ায়। হানিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে–
–আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমার হাত ঠিক আছে,,আমি করতে পারব।
জাভিয়ান তার কথা শুনে একটু কষ্ট পায় কিন্তু তা প্রকাশ করে না। নিজেই হানিয়ার হিজাব খুলে দিতে থাকে হানিয়া বাঁধা দেওয়া সত্বেও। হিজাব খোলা শেষ হওয়ার পর বাথরুমে গিয়ে মগে করে পানি এনে একটা রুমাল ভিজিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দেয়। হানিয়া তাকে বাঁধা দিতে গেলে হানিয়ার দাঁত দু’টো এক হাতের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাত দিয়ে কাজটা করে। হানিয়ার শরীর এমনিতেও ভালো লাগছে না তাই জোর খাঁটিয়ে নিজের হাতটা ছাড়াতে পারে না। কিন্তু তার ভীষণ রাগ পাচ্ছে। মানে আছে এমন কাহিনীর? হানিয়াকে রুমেই ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে তাকে শুইয়ে দেয়,,তার নিজের একটা ট্রাউজার আর ফুল হাতার টি-শার্ট নিয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
অন্যদিকে হানিয়া শুয়ে শুয়ে ভাবতে — সুস্থ হয়ে তাকে সব সত্যি বের করতে হবে। তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে আবরারের কারণে জাভিয়ান হানিয়ার উপর এতদিন নির্যাতন করেছে। যদি তাই হয় হানিয়াও তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। দোষটা হয়ত তার ভাই করেছে,,কিন্তু সে কেন এর ফল ভোগ করলো? আর স্পর্শের রহস্যও সে খুঁজে বের করবে বলে ঠিক করে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই হানিয়া ঘুমিয়ে পরে।
জাভিয়ান শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে হানিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। সে মাথা ভালো করে মুছে,,ঘরের ডোর লক করে এসে হানিয়ার একদম গা ঘেঁষে শুয়ে পরে। তার মাথাটা ভার লাগছে,, তাই সেও ঘুমাবে বলে ঠিক করে। ফোনের ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে দুই ঘন্টা পরের এলার্ম সেট করে চোখ বন্ধ করে। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। চোখে ঘুম কিন্তু ঘুম আসছে না ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না? সে কতক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে,,তাতেও কাজ হয় না।
কি মনে করে হানিয়ার দিকে তাকায় জাভিয়ান। দেখে হানিয়া শান্ত ভাবে এক গালের নিচে হাত রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । কি মনে করে হানিয়ার মাথাটা আলতো করে ধরে নিজের বাহুতে রাখে। তারপর একহাত হানিয়ার পিঠে রেখে আরেক হাত তার মাথায় রেখে চোখ বন্ধ করে। নাহ,,এখন তার ঘুম আসছে। এই একটা মাস সে এমন শান্তির ঘুমের জন্য ছটফট করেছে কিন্তু যার কাছে এতো শান্তি তার জীবনই তো ছিলো টানাটানির মাঝে। কিছুক্ষণ পর জাভিয়ানও ঘুমিয়ে যায়।
________________________
হানিয়াকে বাসায় আনার পর থেকে জাভিয়ানই তার সব কাজ করে দেয় বা করতে চায়। হানিয়া তার হেল্প নেয় না একদমই। তার কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে কুলসুম বা রোজি বেগমকে ডাকে। জাভিয়ান আগ বাড়িয়ে তাকে সাহায্য করতে আসলেও হানিয়া তাকে মানা করে দেয়। হানিয়ার এমন ইগনোর জাভিয়ানকে ভীষণ কষ্ট দেয়, কিন্তু কেন দেয় সে নিজেও জানে না?
সময়টা এখন সন্ধ্যা। জাভিয়ান অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র। ঘরে ঢুকেই এমন একটা দৃশ্য সে দেখে যা তার বুকটা ভীষণ ভারী করে তুলে। হানিয়ার মাথার বেন্ডেজটা দুদিন আগেই খোলা হয়েছে। অপারেশনের জন্য তার মাথার সবগুলো চুল ছেটে ফেলা হয়েছিলো। হানিয়া আয়নার সামনে বসে, থমথমে চোখে একবার নিজের কাটা জায়গাটায় আঙুল বোলায়, আবার একবার নিজের চুলহীন মাথার প্রতিচ্ছবি দেখে। চুলহীন এই রূপ যেন তাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় তার হারানোর গল্প। একটি মেয়ের কাছে তার চুল কেবল সৌন্দর্যের অংশ নয়, এটি তার ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া, তার আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। চুলের প্রতিটি আঁচড়, প্রতিটি ভাঁজে যেন লুকিয়ে থাকে তার শৈল্পিকতা। আজ সেই শূন্যতায় হানিয়া নিজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, কারণ নারীর সৌন্দর্য তো কেবল বাহ্যিক নয়, বরং তার গভীর অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে অশ্রু। জাভিয়ানের কাছে দৃশ্যটি খুবই হৃদয়বিদারক লাগে।
জাভিয়ান গুটি গুটি পায়ে হেঁটে হানিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ায়। আয়নার মাধ্যমে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জাভিয়ানকে দেখে হানিয়া চট করে নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। সে তার দুর্বলতা কাউকে দেখাতে চায় না,বিশেষ করে জাভিয়ানকে। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় তারপর সেই জায়গা ছেড়ে বেলকনির দিকে যেতে চায়। কিন্তু জাভিয়ান তা করতে দেয় না। সে তার হাত ধরে আঁটকে দেয়। হানিয়াকে নিজের মুখোমুখি করে দাঁড় করিয়ে,,তার দু’গালে হাত রেখে কন্ঠে কিছুটা মায়া নিয়ে বলে–
–কষ্টে মন ভারী করো না, বধূয়া। যা হারিয়েছে, তা সময়ের স্রোতে ফিরে আসবে অন্য রূপে, অন্য গভীরতায়। হারানোর শূন্যতা পূরণ হবে নতুন প্রাপ্তির দীপ্তিতে। মনে রেখো, জীবনের প্রতিটি ক্ষতি তার চেয়ে বহুগুণ আশীর্বাদ এনে দিতে জানে। অপেক্ষা করো, তুমি যা হারিয়েছ, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি কিছু নিয়েই তুমি আবার উজ্জ্বল হবে।
জাভিয়ানের কথায় কিছু একটা ছিলো যা হানিয়ার অশান্ত মনে শান্তির বাতাস বইয়ে দেয়। জাভিয়ান তার বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয় দ্বারা হানিয়ার চোখের অবশিষ্ট পানিটুকু মুছে দেয়। তারপর তার কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দেয়। জাভিয়ান হানিয়াকে ছেড়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালে হানিয়া বলে উঠে–
— যেগুলোর প্রাপ্য আমি ছিলাম না কিন্তু ভাগ্য আমাকে সেগুলো দিয়েছে। সেগুলোর পরিবর্তে আমি এবার কি পাবো? অতীতে আমার যেসব সুখ পাওয়ার কথা ছিলো তা যে কতটা পেয়েছি তা আপনি আমি দুজনেই জানি। এবার ভাগ্য আমাকে কি দিবে? সুখের নরম পরশ নাকি অভিশপ্ত অতীতের ছায়া পুনরায় আমাকে গ্রাস করবে?
জাভিয়ান শান্ত চোখে হানিয়ার কথাগুলো শুনে কিন্তু কোন জবাব দিতে পারে না। তার শব্দভাণ্ডারের কোন শব্দ খুঁজে পায় না,, যার দ্বারা সে হানিয়ার প্রশ্নগুলোর জবাব দিবে। হানিয়া বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়,,যখন দেখে জাভিয়ান নিরুত্তর তখন সে চলে যায় বেলকনিতে। সেখানে গিয়ে বসে পরে নিজের দুঃখবিলাস করতে।
__________________________
সেদিন রাতে তাদের মধ্যে তেমন একটা কথা হয় না। হানিয়া আস্তে ধীরে নিজের সব কাজ নিজেই করে নেয়। জাভিয়ান তাকে সাহায্য করতে চাইলে হানিয়া গম্ভীর কণ্ঠে তাকে নিষেধ করে দেয়। রাতে দুজনেই ঘুমিয়ে পরে নিজেদের মনে কিছু জমানো কথা নিয়ে। মাঝরাতে হানিয়ার ঘুমটা ভেঙে যায় কিছু একটা পরে যাওয়ার শব্দে। চোখ মেলে পাশে তাকিয়ে দেখে জাভিয়ান পাশে নেই। শোয়া থেকে উঠে বসে ওয়াশরুমের দিকে উঁকি দিয়ে দেখে ওয়াশরুমের দরজাও বন্ধ,, তারমানে জাভিয়ান ওয়াশরুমে যায় নি। হানিয়া বেড ছেড়ে দাঁড়ায়। বেলকনি থেকে জাভিয়ানের গলায় আওয়াজ পাওয়ায় সে বেলকনির উদ্দেশে হাটা দেয়। জাভিয়ানের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হানিয়া দাঁড়ায়। রাত গভীর হওয়ায় জাভিয়ানের চাপা স্বরে বলা কথা গুলোও হানিয়া সহজেই শুনতে পায়। জাভিয়ান ফোনে কাউকে ধমকে বলছে–
–আপনি কই ছিলেন? ও নিজের ক্ষতি করলো কীভাবে?
–………..
–আমি আপনার কোন এক্সকিউজ শুনতে চাই না। আপনার মানতে হবে এবার ভুলটা আপনার।
–……….
–যাই হোক,,ইনজেকশনটা দেওয়ার সময় তো হয়ে গেছে। কালকে ইনজেকশনটা দিয়ে দিয়েন।
–………..
–ও নেই তো কি হয়েছে? আমি স্পর্শর ভাই এখনো বেঁচে আছি। স্পর্শর জন্য আমিই যথেষ্ট,, আপনি আমাকে ইনজেকশনটার নাম মেসেজ করে দেন আর অবশিষ্ট ডোজটা কালকেই দিয়ে দেন। সামনের ডোজ দেওয়ার সময় হওয়ার আগেই আমি ওটা নিয়ে আসবো।
জাভিয়ানের মুখে স্পর্শের নাম শুনে হানিয়া চমকে যায়। তার উপর জাভিয়ানের কথা এটাই ইন্ডিকেট করছে যে স্পর্শ বেঁচে আছে। তাহলে কোথায় স্পর্শ? হানিয়া আবার শুনতে পায়,,জাভিয়ান বলছে–
–আচ্ছা আমি এখন রাখছি। ওর খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ হাফেজ।
কথাটা বলে জাভিয়ান ফোনটা কেটে দেয়। হানিয়া জাভিয়ানের ফোন কাটা দেখে তাড়াতাড়ি করে রুমে এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পরে। জাভিয়ান আরো কিছুক্ষণ বেলকনিতে থেকে রুমে এসে হানিয়ার পাশে শুয়ে পরে। হানিয়া তখন ঘুমের ভান ধরে শুয়ে ছিলো। হানিয়া এটা অন্তত বুঝতে পেরেছে যে,, জাভিয়ান স্পর্শর বেঁচে থাকার কথাটা কাউকে জানাতে চাচ্ছে না। আর এটাও বুঝতে পেরেছে ফোনে এতক্ষণ স্পর্শকে নিয়েই কথা হচ্ছিল। কিন্তু স্পর্শকে নিয়েই যদি কথা হয় তাহলে ওকে কিসের ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলছিলো জাভিয়ান? আর জাভিয়ান কেনই বা সকলের থেকে স্পর্শর বেঁচে থাকার কথাটা লুকাচ্ছে??
শব্দসংখ্যা~১৫৮০
~~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_বত্রিশ
আজ জাভিয়ানের আগেই হানিয়ার ঘুমটা ভেঙে গেছে। কিন্তু উঠতে পারছে না,,জাভিয়ান তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। হানিয়ার মন চাচ্ছে জাভিয়ানকে ধাক্কা মেরে খাটে থেকে ফেলে দিতে। জড়িয়ে ধরে ঘুমানো ইটস ওকে,,কিন্তু এমন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলে কার না মেজাজ গরম হয়? এমন করে ধরেছে বলেই তো ঘুমের মধ্যে হাসফাস লাগায় ঘুমটা ভেঙে গেছে তার।
হানিয়া শুয়ে শুয়ে ভাবছে কিভাবে সব সত্য বের করবে। আর স্পর্শকেই বা জাভিয়ান লুকিয়ে রেখেছে কেন দুনিয়া থেকে? হঠাৎই তার কালকে রাতে জাভিয়ানের বলা কথাগুলো মনে পরে। জাভিয়ান ফোনে কাউকে বলেছিলো কি একটা ইনজেকশনের নাম মেসেজ করে দিতে। ব্যক্তিটি হয়তো নামটা মেসেজ করে দিয়েছে। তাই তার এখন কাজ হলো জাভিয়ান উঠার আগেই হানিয়াকে ওই ইনজেকশনের নামটা দেখতে হবে। কিন্তু এরও আগে তাকে শোয়া থেকে উঠতে হবে।
হানিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে জাভিয়ান তার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে,,জাভিয়ানের দু’হাতের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হানিয়া। হানিয়া কাত হয়ে শুয়ে ছিলো,,এখন উঠার জন্য সোজা হয়ে শোয়। জাভিয়ানের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়াতে মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। এতে করে জাভিয়ানের বাহু থেকে ছাড়া না পেলেও জাভিয়ানের হাতের বাঁধন হালকা হয়। হানিয়া আস্তে আস্তে জাভিয়ানের হাত সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে,,কিন্তু যেই না বিছানা থেকে নামতে যাবে তখনই পেছন থেকে টান অনুভব করে। হানিয়া এই পর্যায়ে ভয় পেয়ে যায়। জাভিয়ান যদি এখন উঠে পরে তাহলে সর্বপ্রথম সে তার ফোন হাতে নিবে,,প্রতিদিনই এটা করে। জাভিয়ান ফোন হাতে নেওয়া মানে হানিয়া আর কস্মিনকালেও ইনজেকশনটার নাম জানতে পারবে না। কীভাবে পারবে? জাভিয়ানের ফোনের তো লক দেওয়া।
হানিয়া ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে দেখে জাভিয়ানের ঘুম ভাঙেনি বরং তার ওড়নার কিছু অংশ জাভিয়ানের পিঠের নিচে চলে গেছে। হানিয়া ফুস করে শ্বাস ফেলে। ওড়নাটা জাভিয়ানের কাছে রেখেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়,, বিড়াল পায়ে হেঁটে জাভিয়ানের অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে ফোনটা তুলে নেয়,, স্টাডি টেবিল থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক আর কলম নিয়ে চলে যায় বেলকনিতে। বেলকনিতে গিয়ে সেখানে রাখা বেতের চেয়ারে বসে পরে হানিয়া,,এতক্ষণ নিজেকে পাড়ার ছিঁচকে চোর লাগছিলো। হানিয়া জাভিয়ানের ফোনের পাওয়ার অন বাটান চেপে স্ক্রিন অন করে। একটা মেসেজ দেখতে পায়। “মিসেস জুলিয়া” নামের একজন মেসেজটা পাঠিয়েছে। ইংরেজিতে একটা নাম লেখা। হানিয়া বুঝতে পারে এটাই হয়ত ইনজেকশনটার নাম হতে পারে। কিছু না ভেবে নামটা খাতা টুকে নেয়। হানিয়ার ইচ্ছে হয় জাভিয়ানের ফোনটা একটু ঘেঁটে দেখতে,,কিন্তু ফিঙ্গার লক আর পাসওয়ার্ড লক দেওয়া।
হানিয়া আজ একটু বেশিই সাহস দেখায়। সে বসা থেকে উঠে রুমে আসে,,জাভিয়ান তখনও গভীর ঘুমে। গভীর ঘুমে হবেই বা না কেনো? একে তো কাল রাতে জেগে ছিলো কোন এক টেনশনে,,দুয়ে সকালই বা হয়েছে কতো? মাত্র পৌঁনে সাতটা বাজে। জাভিয়ান উঠে আটটা বা তারও পরে। তাই সে এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। হানিয়া জাভিয়ানের কাছে যাওয়ার আগে নোটবুক আর পেনটা ড্রেসিংটেবিলের একটা ড্রয়ারে রাখে যেটাতে শুধু হানিয়ার কসমেটিকসই থাকে,, আর জাভিয়ানও এই ড্রয়ারে হাত দেয় না কোন সময়।নোটবুক রেখে যাওয়ার কারণ হলো বাই এনি চান্স,, যদি জাভিয়ান ঘুম থেকে উঠে পরে তাহলে যেন এটা না বুঝতে পারে যে হানিয়া তার কোন সিক্রেট জেনে গেছে। নোটবুক রাখা হলে হানিয়া এসে জাভিয়ানের পাশে এসে বসে। কাঁপা কাঁপা হাতে জাভিয়ানের পেটের উপর রাখা ডান হাতটা ধরে তর্জনি আঙুলটা নিয়ে যেই না ফোনের স্ক্রিনে রাখবে তখনই জাভিয়ান নড়েচড়ে উঠে। জাভিয়ান নড়ে উঠতেই হানিয়ার আত্মা লাফ দিয়ে উঠে,, সে জাভিয়ানের হাত ছেড়ে উঠে যেতে নিলে জাভিয়ান উল্টো হানিয়ার ধরে রাখা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে করে চেপে ধরে তার দিকে কাত হয়ে শোয়। হানিয়া ভেবেই নেয় জাভিয়ানের ঘুম ভেঙে গেছে আর সে ইচ্ছে করে এমন করছে। হানিয়া ভয়ে ভয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে তার চোখ খোলার অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও যখন জাভিয়ান চোখ খুলে তাকায় না তখন হানিয়া বুঝতে পারে জাভিয়ানের ঘুম ভাঙে নি। সে আস্তে করে জাভিয়ান থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরুমে।
_____________________________
হানিয়ার ঘুমটা আজ তাড়াতাড়ি ভেঙে যাওয়ায় সে ভাবে আজকের সকালে ব্রেকফাস্টটা সেই বানাবে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসলে দেখা হয় কুলসুমের সাথে। কুলসুম এত সকালে হানিয়াকে দেখে একটু অবাকই হয়। সে হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–ভাবী আপনে এতো সক্কাল সক্কাল উইঠা পরলেন যে?
হানিয়া হাসি মুখেই জবাব দেয়–
–ঘুমটা আজ তাড়াতাড়ি ভেঙে গেলো তাই ভাবলাম আজকের ব্রেকফাস্টটা আমিই বানাই।
হানিয়ার কথা শুনে কুলসুম চোখ বড়বড় করে তাকায় তার দিকে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে হা-হুতাশ করে বলে–
–কি কন ভাবী? আপনার জন্য রান্নাঘরে যাওয়া নিষেধ আর সেই আপনে নাকি বেরেকফাস্ট বানাইবেন? ভাইজান হুনলে আমার গর্দান নিবো। আর আমি নিজেও আপনারে করতে দিমু কেমনে ভাবলেন? জীবনেও না। আপনি আমারে কন কি কি বানানো লাগব আমি করতাছি কিন্তু রান্নাঘরে ঢোকা যাইব না আপনার।
হানিয়া কুলসুমের কাছে এগিয়ে এসে তার দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে আদুরে সুরে বলে–
–কতদিন তোমাদের রান্না করে খাওয়াই না। আজ করি প্লিজ,,তুমি আমায় সাহায্য করো। তাও করতে দাও।
–যতোই তেল মারেন না কেন আমি শুনমু না আপনার কথা। না মানে না,,যদি আপনে আমার কথা না হুনেন আমি ভাইজানের কাছে কইয়া দিমু।
কুলসুমের এমন কথায় হানিয়ার যেমন হাসি পায় তেমন ভয়ও লাগে। জাভিয়ান ইদানীং তার প্রতি একটু বেশিই প্রসেসিভ,,সে একটু উহ্ করলেও জাভিয়ান পারে না তাকে আবার হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে রাখতে। হানিয়া জাভিয়ানকে বুঝে পায় না,,এই ভালো তো এই খারাপ।
কুলসুমের কথা মতো হানিয়া রান্নাঘরে যায় না। ডাইনিং টেবিলেই বসে বসে কুলসুমের কাজ দেখতে থাকে। কুলসুম অবশ্য একা করছে না,,রান্নার জন্য আরেকজন হেল্পিংহ্যান্ড রাখা হয়েছে। সে এবং কুলসুম হাতে হাতে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। হানিয়া বসে বসে তাদের কাজ দেখছিল তখনই উপর থেকে জাভিয়ানের চিৎকারের আওয়াজ শোনা যায়। হানিয়ার নাম ধরে ডাকছে জোরে জোরে। হানিয়া তার এমন ডাকে একটু ভয়ই পায়। কিছু জেনে গেলো নাকি জাভিয়ান? সে তো জাস্ট পাওয়ার অন করেছিলো ফোনের,,আর তো কিছু করেনি। তার ভাবনার মাঝেই জাভিয়ানের গলা শোনা যায় আবারও। হানিয়া আর বসে থাকতে পারে না,,আস্তে ধীরে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
উপরে এসে হানিয়া যেই না রুমে ঢুকবে ঠিক সেই সময় জাভিয়ানও হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হতে নেয়,,ফলস্বরূপ দু’জনের টক্কর লেগে হানিয়া পরে যেতে নেয়। কিন্তু ফ্লোরে পরার আগেই জাভিয়ান তার কোমর ধরে পরা থেকে বাঁচিয়ে নেয়। হানিয়া ভেবেই নিয়েছিলো সে পরে যাবে তাই ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। কয়েক মুহূর্ত চলে যাওয়ার পরও যখন কোন ব্যথা অনুভব হয় না তখন সাহস করে চোখ খুলে তাকায়। জাভিয়ানের রাগান্বিত মুখটা তার একদম কাছে দেখতে পেয়ে সে খানিকটা ভরকে যায়। সে বুঝতে পারে জাভিয়ান তাকে পরার আগেই ধরে ফেলেছে। হুট করে জাভিয়ান তাকে কোলে তুলে রুমের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। তারপর তাকে ধমক দিয়ে বলে–
–এমন উল্লুকের মতো দৌড়াচ্ছিলে কেন? না ধরলে কি হতো বুঝতে পারছ?
–কি আর হতো অক্কার মা চক্কা হয়ে যেত।
ব্যঙ্গ করে কথাটা বলে হানিয়া। জাভিয়ান তার এমন ব্যঙ্গাত্বক কথা শুনে একটু হকচকিয়ে যায়। হানিয়া তাকে নিজের থেকে সরাতে সরাতে বলে–
–এমনে লেগে লেগে থাকেন কেন সবসময়? ভাল্লাগে না,,আগের মতো দূরে দূরে থাকতে পারেন না। আজব তো!!
হানিয়ার কথাটা শুনে জাভিয়ানের উত্তপ্ত মেজাজ আরো উত্তপ্ত হয়ে যায়। সকালবেলা সকালে ঘুম থেকে উঠে হানিয়াকে না দেখতে পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো,,এখন আবার এসব বলছে। হাসবেন্ড হয় সে হানিয়ার,,সে নাকি লেগে লেগে না থেকে দূরে দূরে থাকবে। হানিয়া এতক্ষণে জাভিয়ানকে সরিয়ে বসা থেকে দাড়িয়েও পরেছিলো কিন্তু জাভিয়ান তাকে আবার বসিয়ে দেয়। হানিয়া জোর খাঁটিয়ে উঠতে গেলে এবার জাভিয়ান তাকে একদম শুইয়ে দেয়,,তারপর হানিয়ার উপরে নিজের হালকা ভার ছেড়ে শুয়ে পরে। পুরোটা ছাড়ে না কারণ হানিয়ার শরীর এখনও ভালো হয়নি,,যথেষ্ট দুর্বল। হানিয়া তাকে ধাক্কাতে লাগলে জাভিয়ান তার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বেডের সাথে চেপে ধরে,, তারপর দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে–
–হাসবেন্ড হই আমি তোমার,,আমি লেগে থাকব না তো তোমার কলেজেরে ওই হ্যান্ডসাম স্যার থাকবে?
হানিয়া জাভিয়ানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়,,হ্যান্ডসাম স্যার বলতে তাদের কলেজে আদিয়াত স্যারই আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে জাভিয়ান আদিয়াত স্যারকে কেন জাভিয়ান টেনে আনছে সে বুঝতে পারছে না। সে স্বাভাবিক ভাবে বলে–
–আপনি আমার হাসবেন্ড,, লেগে থাকার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা কি সেরকম পর্যায়ে আছে? নাকি আপনি থাকতে দিয়েছেন? আর আদিয়াত স্যারের কথাই বা আসছে কেন? সে আমার শিক্ষক হয়,,শিক্ষক হয়ে সে কেন আমাদের মধ্যে আসছে?
–আসবে না কেন? ওই স্যারের সাথে কথা বলার সময় মুখ থেকে তো হাসি সরেই না আর আমার সাথে কথা বলার সময় মনে হয় কেউ নিমপাতা খাইয়ে দিয়েছে তোমাকে,,এমন ভাব করো।
হানিয়া জাভিয়ানের এমন বেহুদা মার্কা জেলাসিতে বিরক্ত। সে জাভিয়ানকে বলে–
–ডাকছিলেন কেন তখন ওমন ভাবে সেটা বলে আমাকে উদ্ধার করেন।
জাভিয়ানের এখন মনে পরে সকালে ঘুম থেকে উঠে হানিয়াকে না দেখতে পাওয়ার কথাটা। সে বলে–
–আজ এত সকালে উঠে পরেছ কেন? আর উঠলে ভালো কথা রুম থেকে বের হয়েছ কেন?
–আপনার জলহস্তীর মতো হাত দু’টো দিয়ে যেভাবে চেপে ধরেছিলে,,ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছিলো পটলের ক্ষেতে যাওয়ার ডাক পরে গেছে আমার,, অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো আর ঘুম আসছিল না বলে নিচে গিয়ে বসে ছিলাম। পেয়েছেন উত্তর,, এবার উঠুন আমার উপর থেকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার আপনার ভারে।
হানিয়ার লাস্টের কথা শুনে জাভিয়ানের খারাপ লাগে। সে হানিয়ার উপর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়,,তারপর থমথমে গলায় বলে–
–সকাল বেলা আমি উঠার আগে তুমি ঘুম থেকে উঠবে না। যদি ঘুম ভেঙে-ও যায় তাহলে রুমেই থাকবে। এই কথার হেরফের যেন না হয় আমি তোমাকে ওয়ার্ন করে দিলাম হানি।
কথাটা বলে জাভিয়ান ওয়াশরুমে চলে যায়। হানিয়া তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে বেড গুছাতে থাকে। তারপর জাভিয়ানের প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে দিয়ে আবারও নিচে চলে যায়।
________________________
বিকেলে ইনায়া দেখা করতে এসেছে হানিয়ার সাথে। দুই বান্ধবী গার্ডেনে বসে কথা বলছিলো। হানিয়া তাকে কাল রাতের কথা জানায়। ঘটনাটা শুনে ইনায়া ভাবনায় পরে যায়। ইনায়া হানিয়াকে বলে–
–তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ভাইয়া(জাভিয়ান) ইচ্ছে করে কোন কারণে স্পর্শ আপুকে লুকিয়ে রেখেছে। আর আমার এটাও মনে হচ্ছে তুই যেই ইনজেকশনের কথা বলছিস ওটাও স্পর্শ আপুকেই দেওয়া হয়।
–আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু আপুকে নিয়ম করে কিসের ইনজেকশনটা দেওয়া হয়? সে কি অসুস্থ?
–হতে পারে,,নাহলে ভাইয়া তাকে পরিবারের সামনে আনছে না কেন?
–আর দোস্ত আমি মনে হয় ইনজেকশনটার নাম জানতে পেরেছি।
–কীভাবে?
হানিয়া গার্ডেনে আসার সময় নোটবুকটা নিয়ে এসেছিলো নিজের সাথে করে,,সেটাই দেখায়। ইনায়া লেখাটার ছবি তুলে নেয়। তারপর হানিয়াকে বলে–
–এহসানকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবো এই ইনজেকশনটা কেন দেওয়া হয়?
ডা.এহসান হানিয়া-ইনায়ার চেয়ে কম করে ৬/৭ বছরের বড় হবে। সেইবার তারা দেখা করতে গিয়েছিলো যখন,, তখনও ইনায়া তাকে ডা. বা ভাইয়া বলে সম্বোধন করছিলো। কিন্তু আজ ডাইরেক্ট নাম ধরে ডাকছে। বিষয়টা হানিয়ার সুবিধাজনক লাগে না। সে চোখ ছোট ছোট করে বলে–
–ডা.এহসান ছেলেটা অনেক ভালো না?
ইনায়া বেখেয়ালিতে বলে দেয়–
–ভালো মানে ওর মতো ছেলে দু’টো খুঁজে পাবি না। এতো কিউট,, সুইট আর কেয়ারিং। জানিস আমাদের যখনই দেখা হয় আমার কপালে একটা চুমু…
কিছু কিছু মানুষ কথা বলতে এতো ভালোবাসে যে তাদের সারাদিন কথা বলতে বললে তারা হাসিমুখে সেটা করবে। সেই ক্যাটাগরির একজন ইনায়া। হানিয়া তাকে সন্দেহবসত একটা কথা জিজ্ঞেস করতেই সে গড়গড়িয়ে পেটের সব কথা বলে দেয়। এদিকে ইনায়ার কথা কথা শুনে হানিয়া হতভম্ব হয়ে যায়। সে নিজের উত্তেজনা চাপিয়ে রাখতে না পেরে অনেকটা জোরে চেচিয়ে বলে–
–কিহহহহহহ? উনি তোকে চুমু খায়?
অন্যদিকে জাভিয়ানের অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়ায় সে বিকেলের দিকেই বাসায় এসে পরে। মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে বাসায় ভেতরে প্রবেশ করবে ঠিক সেই সময় গার্ডেন থেকে হানিয়ার এই কথাটা শুনে ফেলে। সে দৌড়ে সেখানে গিয়ে আহাম্মকের মতো জিজ্ঞেস করে–
–কে কাকে চুমু খাচ্ছে?
তাঁদের দু’জনের এমন প্রশ্ন শুনে ইনায়াও হকচকিয়ে যায়।
শব্দসংখ্যা~১৭৩৭
~~চলবে?
#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_তেতত্রিশ
#রহস্যের_সমাধান_০৩
–আবরার আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।
আবরার রেডি হয়ে অফিসের জন্য বের হচ্ছিল তখনই এশা উপরোক্ত কথাটি বলে। আবরার এশার কথা শুনার জন্য দাঁড়িয়ে পরে।
–জ্বি বলুন।
এশা ওড়নার কোণায় আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে বলে–
–ফাহিমের চাকরিটা পার্মানেন্ট হয়ে গেছে এই মাসে। ও এখন আমায় ওর ঘরে তুলতে চাইছে,,আপনি যদি আমাদের ডিভোর্সের ব্যাপারটা একটু দেখতেন তাহলে ভালো হতো।
সাতসকালে এমন একটা কথা শুনে আবরারের চিত্ত আনন্দে উল্লাস করে উঠে। সেও ক্লান্ত এই মিথ্যা সম্পর্কটাকে সমাজের সামনে বইতে,,মুক্তি চায় এই ছলচাতুরী থেকে। আবরার মনে মনে বেশ খুশি হলেও তার মুখভঙ্গি দেখে কেউ তার ভেতরের খবর টের পাবে না। আবরার বরাবরের মতোই গম্ভীর স্বরে বলে–
–আমি আজ উকিলের সাথে কথা বলে আসবো। আমার জানা মতে, কম করে হলেও তিনমাস লাগবে। তাও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তাড়াতাড়ি পেপারস রেডি করার। আর কিছু বলবেন?
এশা নিস্তেজ গলায় বলে–
–নাহ।
–আচ্ছা, আমি তাহলে আসছি। আল্লাহ হাফেজ।
বিদায় নিয়ে আবরার চলে যায় অফিসে। এশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখে। কাল রাতে ফাহিম তাকে ডিভোর্সের কথাটা বলার পর থেকে মনে মধ্যে কেমন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেন করছে সে জানে না। এশা জানে এবং নিজেও মানে আবরারের মতো ছেলে যে মেয়ের ভাগ্যে আছে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কারণ,,সে আবরারের বউ হয়েছে আজ প্রায়ই তিন হতে চললো,,কিন্তু আবরার কোনদিন তার কাছে স্বামীর অধিকার দাবী করে হাত বাড়ায় নি। সমাজের চোখে তারা সুখী দম্পতি হলেও এই বদ্ধ ফ্ল্যাট জানে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও নেই। সে থাকে তার মতো আবরার থাকে তার মতো।
এশা এটাও জানে আবরার এক রমনীকে তার মনপ্রাণ সব দিয়ে ভালোবাসে। আর তার জন্যই হয়ত বউ হওয়া সত্বেও এশার প্রতি কখনো কোন অধিকার খাটায় নি। এশা ভাবে” ইশ! ওই রমনীটা যদি আমি হতাম। এই সুদর্শন, সুচরিত্রের হৃদহরণী যদি আমি হতাম তাহলে কতই না ভালো হতো!!” পরক্ষণেই সে ভাবে” না না,,কি ভাবছি এসব আমি? আমার মনেপ্রাণ,,শরীর সব জুড়ে তো আমার ফাহিমের বিচরণ। আবরারের কথা ভাবাও আমার জন্য পাপ।” এসব ভংচং বুঝ দিয়ে নিজের মনকে শান্ত করে এশা।তারপর মেইনডোর লক করে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরে ফাহিমের সাথে।
________________________
হানিয়া আর ইনায়া এই অসময়ে জাভিয়ানকে দেখে অবাক হয়ে যায়। তার উপর তার এদমন আহাম্মকের মতো কথা শুনে আরো অবাক হয়ে যায় তারা। হানিয়া নিজেকে সামলে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে —
–আজ এই অসময়ে বাসায় আসলেন যে? শরীর খারাপ করেছে নাকি?
–এসেছিলাম তো সুস্থভাবেই কিন্তু তোমাদের অশ্লীল সব কথা শুনে মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পরছি।
হানিয়া আর ইনায়া জাভিয়ানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। জাভিয়ান তাদের চাহনি দেখে থতমত খেয়ে যায়। হানিয়া চোখ ছোট ছোট করে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–
–আমরা কি এমন অশ্লীল কথা বলছি যে সেটা শুবে একদম অসুস্থই হয়ে পরছেন?যদিও ধরেও নেই অশ্লীল কথা বলছি,,তাহলে আপনাকে জানাতে চাই আমরা তো বলছি শুধু আর আপনি তো তা আমার উপর প্রয়োগ করেন। তখন আমার অবস্থা কেমন হয় বুঝেন এবার।
এবার হানিয়ার কথা শুনে জাভিয়ান আর ইনায়ার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর হানিয়াও বুঝতে পারে মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। সে শুকনো একটা কাশি দিয়ে জাভিয়ানকে ধমকের সুরে বলে–
–এখানে কি আপনার হ্যাঁ? দেখছেন না আমরা পারসোনাল কথা বলছি,,মেয়েলি কথার মধ্যে আপনার কি কাজ? যান রুমে গিয়ে ফ্রেশ হন। আমরা আসছি।
আজকে জাভিয়ান সকাল থেকেই হানিয়ার ঝাড়ির উপর আছে। সে কড়া করে কিছু বলতে চাইলে ইনায়াকে চোখে পরে তার।মেয়েটা টুকুর টুকুর করে তাকিয়ে তাদের দেখছে। বাহিরের লোকের সামনে নিজেদের ঝামেলার কথা জানাতে চায় না জাভিয়ান,, তাই সে হানিয়ার কথা মতো চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে–
–বউটা আমার ভীষণই নাজুক শালিকা সাহেবা। শুনলে না,, আমি ধরলেই তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাই একটু দেখে শুনে যা করার করো। আর হ্যাঁ,,আমার অধিকারে বেশি ভাগ দিও না আবার। আমি কিন্তু ভীষণ হিংসুটে মানুষ।
কথাটা শেষ করে হানিয়াকে একটা চোখ টিপ দিয়ে সিটি বাজাতে বাজাতে বাসার ভেতরে চলে যায় জাভিয়ান। দুই রমনী আহাম্মক হয়ে তার যাওয়া দেখে।
_________________________
সন্ধ্যার একটু আগ দিয়ে ইনায়া তার বাসায় চলে গেছে। রোজি বেগম আর হানিয়া তাকে অনেক করে বলে রাতের ডিনার করে যেতে কিন্তু তার বাসা থেকে বারবার ফোন আসায় তাকে চলে যেতে হয়। হানিয়া আর কুলসুম রোজি বেগমের রুমে বসে গল্প করছিলো,, তখনই জাভিয়ান এসে উপস্থিত হয় সেখানে।
জাভিয়ান তার হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে–
–তোমার বাসা থেকে ফোন করেছে। কথা বলো নাও।
হানিয়ার মুডটা আজ ভীষণই ফুরফুরে ছিলো। এখনো কতো মজা করে গল্প করছিল তারা তিনজন,,এর মধ্যে জাভিয়ান এসে তার বাসার মানুষদের সাথে কথা বলতে বললে তার ফুরফুরে মেজাজের বারো দু’গুনে চব্বিশটা বেজে যায়। সে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বলে–
–এখন কথা বলতে মন চাচ্ছে না। আর তাদের আমার সাথে কি কথা?
জাভিয়ান অবাক হয়ে যায় তার এমন বিরক্তি দেখে। সে এতদিন জেনে এসেছে বিয়ের পর সব মেয়েরাই বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে,,কিন্তু তাদের এই চার মাসের সংসারে তারা মির্জা বাড়ি গিয়েছে মাত্র একবার। জাভিয়ানও হানিয়াকে নিয়ে যায় নি আর হানিয়াও কখনো ও বাড়ি যাওয়ার জন্য আগ্রহ দেখায়নি। তারউপর ওবাড়ির মানুষদের সাথে তেমন কথাও বলে না জাভিয়ান। বললে শুধু সোনিয়া আর আবরারের সাথে বলে। বাবা-মার সাথে কথা একদমই বলে না হানিয়া। কিন্তু কেনো সেটা বুঝে পায় না জাভিয়ান।
জাভিয়ান বেশ জোরে ধমকে বলে–
–কথা বলতে মন চাওয়া না চাওয়ার কি আছে। ধরো,, কথা বলো বেয়াদব। বাবা-মা ফোন দিয়েছে তার কথা বলতে মন চাচ্ছে না।
হানিয়া জাভিয়ানের কথা শুনে তার হাত থেকে ফোনটা ঝটকা মেরে নেয়। তারপর বসা থেকে উঠে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে যায় ফোন নিয়ে। মনি আর কুলসুমের সামনে তাকে বেয়াদব বলায় তার মন খারাপ হয়েছে। তার ইচ্ছের দাম তার বাবা-মা’ই দিলো না, সেখানে জাভিয়ানের কাছে দাম আশা করা একটু বেশিই হয়ে গেছে তার। জাভিয়ানের এই কয়েকদিনের ব্যবহারে সে তার আগের কাজগুলো ভুলতে বসেছিলো,,তাই হয়ত আজ সকাল থেকে একটু বেশিই ন্যাকামি করছিলো। জাভিয়ান তো আর হানিয়াকে ভালোবাসে না বা বউ হিসেবে মানে। সে তো হানিয়াকে বিয়ে করেছে প্রতিশোধের জন্য। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের প্রতিই রাগ হয় হানিয়ার। হানিয়া চলে যাওয়ার পর জাভিয়ান রোজি বেগম আর কুলসুমের দিকে তাকায়। তারপর হালকা হাসি দিয়ে কুলসুমকে বলে–
–আমাকে একটু কফি করে দিবি কুলসুম?
–এহনি আনতাছি ভাইজান।
পাখির মতো ফুরুত করে চলে যায় কুলসুম জাভিয়ানের জন্য কফি বানাতে। জাভিয়ানও চলো আসছিলো রোজি বেগমের রুম থেকে কিন্তু তখনই রোজি বেগম পেছন থেকে ডাক দেয় জাভিয়ানকে।
–জাভিয়ান শুনো।
রোজি বেগম তাকে “বাবু” বা “বাবাই”বলে ডাকে সাধারণত। কিন্তু সে জাভিয়ানের উপর যখন রেগে যায় তখন তাকে নাম ধরে আর “তুমি” করে বলে। রোজি বেগমের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণটা জাভিয়ান বুঝতে পারে না। সে রোজি বেগমের দিকে ফিরে বলে–
–বলো মাম্মাম।
–তোমার এখন বিয়ে হয়েছে আর হানিয়া তোমার স্ত্রী। তোমাদের বদ্ধ রুমের কি হচ্ছে তা কখনোই বাহিরের লোককে বুঝতে দিবে নাহ,,এতে করে তোমাদের ঘেঁটে যাওয়া সম্পর্ক আরো ঘেঁটে যাবে। নিজের স্ত্রীকে সম্মান দিতে শিখো,,নাহলে সময় গেলে সাধন হবে না। তুমি আমার বুদ্ধিমান ছেলে,,আশা করি বুঝতে পেরেছ।
–জ্বি মাম্মাম।
–নিজের রুমে যাও।
জাভিয়ান রোজি বেগমের রুম থেকে এসে পরে। তাদের রুমে আসলে রুমের কোথাও হানিয়াকে দেখতে পায় না। এতে করে জাভিয়ানের কপালে কয়েকটা ভাজ পরে। সে হানিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে বেলকনিতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে তার ঘরণীকে পায়। সে হেঁটে হানিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালে শুনতে পায়,, হানিয়া ফোনে বলছে–
–বিয়ে দিয়ে ঝামেলা নিজেদের ঘাড় থেকে নামিয়েছ। ভালো কথা,,আমি তোমাদের প্রতি বরাবরের মতো কোন অভিযোগ করি নি। তাহলে তোমরা কেন আমার প্রতি অভিযোগ রাখছো?
–……………
–ছিলাম তো তোমাদের কাছেই তখন তো সহ্য করতে পারতে না এই লুজারকে,, নিজেরাই তো ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিলে। এখন আবার ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য এত জোর করছো কেন? সংসার করতে পাঠিয়েছ তাই তো করছি,,তাহলে এখন আমার সংসার ছেড়ে ওই বাড়িতে যেতে বলছ কেন?
–……………
–উনার সময় হবে না আমায় নিয়ে যাওয়ার আর আমারও কোন ইচ্ছে নেই ওই বাড়ি যাওয়ার। আর কখনো যেতে বলবে না,, আমি এখন তোমাদের পর। কথাটা মনে রাখবে আর তোমার স্বামীকেও বলে দিবে। দুই ঈদে গিয়ে দেখা করে আসব। ভালো থেকো আর দোয়া করো পরের বার কিছু হলে যাতে হসপিটালে নেওয়ার আগেই পাখি উড়াল দিতে পারে।
কথাটা বলেই হানিয়া ফোনটা কেটে পাশের চেয়ারে রেখে দেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয় চেয়ারে। অন্যদিকে জাভিয়ান অবাক হয়ে যায় হানিয়ার এমন রুক্ষভাবে কথা বলা শুনে। তার কথা শুনে জাভিয়ান বুঝতে পারে সে তার মায়ের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু মায়ের সাথে এতটা ক্ষোভ নিয়ে কেউ কথা বলে? আর কি বললো? ধরে বেধে বিয়ে দিয়েছে, তারমানে এই বিয়েতে হানিয়ার মত ছিলো না।
হানিয়ার বন্ধ চোখের কোণ থেকে অশ্রুরা স্বাধীনভাবে গড়িয়ে পরছে। জাভিয়ান এসে তার পাশে বসে পরে। নিজের পাশে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে হানিয়া আস্তে করে নিজের অশ্রুশিক্ত চোখজোড়া মুছে নেয়। জাভিয়ান শান্ত গলায় হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–
–এই বিয়েতে তোমার মত ছিলো না হানি?
–(নিশ্চুপ)
–নিজের মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?
এবার হানিয়া মুখ খুলে। সে বলে–
–কেউ বলে না,, আমিও বলতাম না। কিন্তু তারাই আমাকে বাধ্য করেছে এমন হতে।
–কেন? তারা কি এমন করেছে যে এত ক্ষোভ তাদের প্রতি তোমার?
–কিছু করেনি। আমাকে একটু একা থাকতে দেন। ভাল্লাগছে না।
নিজের মাথা টিপতে টিপতে কথাটা বলে হানিয়া। জাভিয়ান বুঝতে পারে উত্তেজিত হয়ে কথা বলার জন্য মাথায় প্রেশার পরেছে হানিয়ার, যার কারণে আবার ব্যথা শুরু হয়েছে। জাভিয়ান কথা বাড়ায় না। চুপ করে হানিয়ার পাশে বসে থাকে। হানিয়া চোখ খুলে জাভিয়ানকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেগে যায়,, জাভিয়ানকে কিছু না বলে নিজের বসা থেকে উঠে রুমে এসে শুয়ে পরে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঘুমিয়েও পরে।
_________________________________
হানিয়া সেই যে সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছে তাকে আর ঘুম থেকে উঠানো যায় নি। রাতের ঔষধ খাওয়ানোর আগে যখন খাবার খাওয়ানো হয় তাকে তখনও অর্ধেক ঘুম আরও অর্ধেক জাগ্রত অবস্থায় খাবারটা খায় হানিয়া। রোজি বেগমই তাকে রাতের খাবারটা খাইয়ে দেয়। হুট করে গতকাল রাতের মতো আজও হানিয়ার ঘুমটা ভেঙে যায়। চোখ খুলে কালকের মতো আজও সে জাভিয়ানকে পাশে পায় না। সে ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে পুরো রুমে চোখ বুলায়। নাহ, জাভিয়ান নেই। বেড থেকে উঠে তাড়াতাড়ি করে বেলকনিতে যায়। সেখানেও জাভিয়ানকে পায় না আজ। রুমে নেই,বেলকনিতেও নেই। তাহলে গেলো কোথায় জাভিয়ান? কথাটা ভাবতে ভাবতে বেলকনির একদম কিনারে রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। গরম গরম কম্বলের নিচ থেকে উঠে এই হীম শীতল বেলকনিতে কোন গরম কাপড় গায়ে না দিয়ে আসায় হানিয়ার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে ঠান্ডায়। আনমনে সে বেলকনি থেকে নিচে গার্ডেনের দিকে তাকালে একটা জিনিস দেখে ভীষণ চমকে যায়।
–জাভিয়ান!
হানিয়ার মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে নামটা বের হয়। হ্যাঁ,,জাভিয়ান। সে গার্ডেন দিয়ে হেটে তাঁদের বাসার পেছনের দিকে যাচ্ছে। হানিয়া ভাবে “আজ জাভিয়ানের পিছনে আমিও যাবো,,দেখবো সে এতো রাতে কোথায় যায় হাঁটতে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সে হাঁটতে না,,অন্য কোথাও যায়।” হানিয়া তাড়াতাড়ি করে রুমে এসে বালিশের পাশ থেকে শালটা নিয়ে নেয়। তারপর সেটা গায়ে পেচিয়ে তাড়াতাড়ি করে নিচে নামে। নিচে নেমে মেইনডোরের কাছে না গিয়ে সে তাদের কিচেনে এক্সট্রা একটা বাহিরে যাওয়ার দরজা আছে সেটা দিয়ে বের হয়। কিচেনের এই দরজা দিয়ে তাঁদের বাড়ির পেছনের দিকে বের হওয়া যায়। জাভিয়ান যেহেতু বাড়ির পেছনের সাইডে যাচ্ছে তাই সে সামনের দরজা দিয়ে বের না হয়ে শর্টকাটে এই দরজা দিয়ে আসে।
হানিয়া বাসা থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হাঁটার পর জাভিয়ানকে দেখতে পায়। সে ওই স্টোররুমটার দিকে যাচ্ছে। হানিয়াও কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে জাভিয়ানের পিছু নেয়। হানিয়া দেখতে পায় জাভিয়ান স্টোররুমটা ক্রস করে এটার পেছনের দিকে যাচ্ছে। হানিয়াও তার পেছন পেছন যায়। স্টোররুমের পেছনের দিকে এসে হানিয়া তো একদম অবাক। স্টোররুমটার ভেতরে আলো জ্বলছে। কিন্তু সামনের দিকে তো একদম অন্ধকার ছিলো। জাভিয়ান স্টোররুমের পেছনের দরজায় এসে আশেপাশে নজর বুলায় কেউ আছে কিনা দেখার জন্য। তারপর দরজায় নক করে হাত দ্বারা। হানিয়া এবারও অবাক হয়ে যায়। বন্ধ রুমে জাভিয়ান এমনভাবে নক করছে কেন?-এটা ভাবতে থাকে হানিয়া। কিন্তু তার তো অবাক হওয়া এখনও বাকি।
কয়েক সেকেন্ড পর দরজাটা ভেতর থেকে খুলে দেওয়া হয়। রুমটায় পর্যাপ্ত আলো থাকার জন্য হানিয়া দরজা খুলে দেওয়া ব্যক্তিটিকে দেখতে একটুও অসুবিধা হয় না। সেইদিন তাদের গার্ডেনে বল নিতে আসা মাঝবয়সী মহিলাটি দরজাটা খুলে দিয়েছে। হানিয়া তাকে দরজা খুলতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। জাভিয়ান মহিলা টির সাথে দু’একটা কথা বলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলে মহিলাটি দরজাটা লাগিয়ে দেয়। হানিয়ার মাথা ঘুরতে থাকে এমন দৃশ্য দেখে। সে পা চালিয়ে রুম টার সামনে এসে উপস্থিত হয়। রুমটার আশেপাশে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু একটার খোঁজ করে। হ্যাঁ পেয়েছে হানিয়া। একটা জানালা। হানিয়া দরজার সামনে থেকে সরে জানালাটির কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালার একটা থাই সামান্য একটু খোলা। হানিয়া হাত দিয়ে আরেকটু খোলার চেষ্টা করে,,কিন্তু পারে না। অনেক শক্ত,,জ্যাম ধরে গেছে থাই’য়ে। হানিয়া ওই সামান্য খোলা জায়গা দিয়ে ভেতরে উঁকি মারে,, দেখতে পায় জাভিয়ান একজন মেয়ের হাত ধরে তাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। হানিয়ার বুকের মধ্যে একটা মোচড় মারে। মেয়েটির মুখ হানিয়া দেখতে পারছে না তার মুখের উপর চুল দ্বারা ঢেকে থাকায়। জাভিয়ান যার হাত ধরে বসে আছে সে ঘুমন্ত বা সজাগ না। কিছুক্ষণ পর জাভিয়ান নিজেই হাত বাড়িয়ে মেয়েটার মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। মেয়েটার মুখটা স্পষ্ট হয় হানিয়ার নজরে। মেয়েটিকে দেখে হানিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠে। টাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নিলে পাশের ওয়াল ধরে ফেলে হানিয়া। মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বের হয়–
–স্পর্শ আপু।
চলবে।