প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
1173

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_ঊনচল্লিশ

[পর্বটা রোমান্টিক,, যাদের রোমান্টিক পর্ব ভালো লাগে না তারা প্লিজ স্কিপ করবেন।]

পয়তাল্লিশ মিনিট পর হানিয়া জাভিয়ানের অফিসে এসে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নেমে বহুতল ভবনের পুরোটা একবার দেখে নেয়। এগারো তলার এই ভবনটির একদম টপ ফ্লোরে তার নিষ্ঠুর জামাইয়ের কেবিন। হানিয়া ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে হাঁটা দেয় ভেতরের দিকে। রিসেপশনে গিয়ে জাভিয়ানের কথা বললে রিসেপশনিস্ট জানায় সে নাকি বিজি আছে,,আজ কারো সাথেই দেখা করতে পারবে না। হানিয়াকে অন্য একদিন আসতে বলে। কোন উপায় না পেয়ে হানিয়া রিসেপশনিস্টকে জানায় জাভিয়ান তার হাসবেন্ড। রিসেপশনিস্ট তার কথায় বিশ্বাস তো করেই না উল্টো গার্ডস ডেকে তাকে বের করে দেয় অফিস বিল্ডিং থেকে।

রাগে,,দুঃখে,,অপমানে হানিয়ার চোখ দিয়ে পানি পরতে থাকে। এতদিন নিজে অপমান করতো তাতে তার শান্তি হয়নি,, এখন অফিসে ডেকে এনে আরেকজনকে দিয়ে অপমান করে। হানিয়া রাগে ড্রাইভারকে ফোন না দিয়েই হাঁটা দেয়,, উদ্দেশ্য হেঁটেই বাড়ি যাবে আজ সে।

হানিয়াকে ফোন দিয়ে আসতে বলার একঘন্টা হয়ে যাওয়ার পরও হানিয়া আসছে না দেখে জাভিয়ান তাকে ফোন দেয়। হানিয়া রেগে বোম হয়ে আছে,,তাই জাভিয়ানের ফোন রিসিভ করে না। জাভিয়ান হানিয়াকে পুনরায় ফোন দিতে দিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়,, হেঁটে এসে দাঁড়ায় তার কেবিনের বড় জানালাটার কাছে। যেটা দিয়ে তার অফিস এরিয়াসহ আশেপাশের অনেকটা জায়গা দেখা যায়। জাভিয়ান হানিয়াকে আরো কয়েকবার ফোন দেয় কিন্তু হানিয়া রিসিভ করে না। হুট করে জাভিয়ানের নজর যায় তার অফিস এরিয়ার মধ্যেই একজন মেয়ের দিকে। এগারো তলার উপর থেকে মেয়েটা কে তা ভালোভাবে না বুঝা গেলেও মেয়েটার ড্রেসআপ দেখে জাভিয়ানের কাছে হানিয়ার মতো লাগে। জাভিয়ান সিউর হওয়ার জন্য আবার কল লাগায়,,তখন মেয়েটা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কলটা কেটে ফোনটা রাস্তায় আছাড় মারে। তারপর সেখানেই ধপ করে বসে পরে। জাভিয়ান এবার ১০০% সিউর হয় ওই মেয়েটাই তার অপ্রিয় বধূয়া। কিন্তু মেয়েটা উপরে না এসে চলেই বা যাচ্ছিল কেন? আর এতো রেগেই বা আছে কেন?

জাভিয়ান তার ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে ছুট লাগায় তার বউয়ের কাছে। তাকে এমন হন্তদন্ত হয়ে বের হতে দেখে তার পি.এ. রাসেলও [সম্ভবত আরেকটা পর্বেও জাভিয়ানের পি.এ.র নামটা উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু ওই নামটা ভুলে যাওয়ায় আজ এই নামটা দিলাম আবার] ছুট লাগায় তার পেছন পেছন। জাভিয়ান অফিসবিল্ডিং থেকে বের হয়ে একটু দূরেই মেয়েটাকে দেখতে পায়। মেয়েটার একটু কাছে গেলে পুরোপুরি সিউর হয় এটাই তার বউ। জাভিয়ান ফোনটা নিচ থেকে তুলে রাসেলের হাতে দেয়,,তারপর নিঃশব্দে হানিয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখে। হানিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো,, নিজের মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে সেই দিকে তাকালে দেখতে পায় তার শয়তান জামাই এসেছে। জাভিয়ানকে দেখে তার ভেতরে পিনপিন করে জ্বলতে থাকা রাগটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। সে জাভিয়ানের হাতটা নিজের মাথা থেকে সরিয়ে বসা থেকে উঠে দাড়ায়,,তারপর আবার হাটা লাগায়। রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়ালে গাড়ির হর্নের আওয়াজে চমকে যায়। ঘাড় ঘুড়িয়ে ডানে তাকালো দেখে সেদিনের মতো একটা মিনিবাস তার দিকে ধেয়ে আসছে। হানিয়া এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। জাভিয়ানও তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার কাছে যাওয়ার আগেই…….

________________

টেবিলে মাথা রেখে অনবরত কেঁদে চলেছে রমণীটি। কান্নার কোন যৌক্তিক কারণ নেই আবার আছেও বলা চলে। একটু আগেই একটা দাবাং হাতের চড় খেয়েছে যার ফলস্বরূপ তার এই কান্না। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে তাও কাঁদা থামায় নি। থামাবে কেন? আজ সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।

জাভিয়ান রিসেপশনিস্টকে বকাঝকা করে মাত্রই কেবিনে আসে। দেখতে পায় তার বধূয়া এখনো কেঁদেই চলেছে। মেয়েটাকে সে নিজের চেয়ারে বসিয়ে রেখে বাহিরে গিয়েছিলো,,কিন্তু তার অবস্থান এখন বিপরীত চেয়ারে। জাভিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা লক করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে একটু পানি পান করে গলাটা ভিজিয়ে নেয়। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে হানিয়ার গুনগুনিয়ে কান্না করা শুনতে থাকে। ক্রমেই তার মেজাজ খারাপ হতে থাকে। চোখটা বন্ধ করে মিনিট বিশেক আগের কথা ভাবতে থাকে।

২০মিনিট আগে~~

মিনিবাসটা যেই না হানিয়াকে হিট করতে যাবে তার আগেই রাসেল তার হাত ধরে টেনে পিছনের দিকে নিয়ে আসে,,আর মিনিবাসটা একদম তাদের সামনে দিয়ে ক্রস করে চলে যায়। জাভিয়ান যেহেতু বসে ছিলো তাই সে দাঁড়িয়ে হানিয়ার কাছে যাওয়ার আগেই রাসেল গিয়ে হানিয়াকে টান দিয়ে সরিয়ে দেয়। জাভিয়ান হানিয়ার কাছে এসে হানিয়ার ঘাড়ের পেছনে চেপে ধরে তার মাথাটা নিজের বুকের সাথে ঠেসে ধরে। হানিয়ার মাথা গিয়ে ঠায় পায় জাভিয়ানের বুকের বা পাশে। হানিয়া সেখানে কান লাগালে শুনতে পায় জাভিয়ানের ঘোড়ার ন্যায় দৌড়াতে থাকা হৃৎস্পন্দন। এতো জোরে বিট করছে জাভিয়ানের হার্ট যেনে বুক চিঁড়ে বের হয়ে আসবে। এক মিনিটের মতো সেখানে ঠাই হয় হানিয়ার,, এরপরই হুট করে জাভিয়ান হানিয়াকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে কসিয়ে একটা থাপ্পড় লাগায়। হানিয়া ছিটকে গিয়ে পরে কংক্রিটের রাস্তায়। মুখে একটু নোনতা নোনতা অনুভব হয়। বুঝতে পারে সেই তিনমাস আগের মতো একটা চড় পরেছে আজ তার গালে,,ফলাফল হিসেবে ঠোঁট কেটে গিয়েছে।

রাসেল তো বসের এমন হুটহুট করে মতিভ্রম হওয়ায় চমকের উপর চমকাচ্ছে। জাভিয়ান হানিয়ার বাম হাতের কনুই ধরে তাকে দাঁড় করায়। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে–

–কি করছিলি খেয়াল আছে তোর? রাসেল যদি তোকে টান না দিতো কি হতো বুঝতে পারছিস? আরে তোরে হসপিটালের নেওয়ার সুযোগটাও এবার পেতাম না আমি।

হানিয়া ডান হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছে বলে–

–আফসোস হতো তারপর আপনার। কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি যে চলে যেতাম। কিন্তু দেখেন আপনার ভাগ্যটা কতো ভালো। বরাবরই আপনার প্রতি সদয় হয়। আমার প্রতি এমন সদয় কবে হবে?

–চুপপপপপ। আর একটা কথা বললে জীবনের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দিবো।

–হলাম চুপ। ছাড়েন এখন আমায়। অপমান করার জন্য ডেকে এনেছিলেন না? হয়েছি আমি অপমানিত। এবার আপনার শান্তি তো। তাহলে যেতে দিন আমায় এখন।

কথাটা বলতে বলতে জাভিয়ানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে হানিয়া। কিন্তু তার বেয়াদব জামাই এমন ভাবে হাতটা ধরে রেখেছে মনে হচ্ছে একটু পর কনুই থেকে হাতটা ছুটে যাবে। নিজেকে জাভিয়ানের হাত থেকে মুক্ত করতে না পেরে হানিয়া এবার কেঁদেই দেয়। ভালোই তো সে বাসায় যাচ্ছিল,,শুধু শুধু তাকে নিজের অফিসে ডেকে এনে আরেকজন দিয়ে অপমান করালো এখন আবার কার না কার সামনে গায়ে হাতও তুললো। সহ্য হয় এতো অত্যাচার? কোন দোষ করলে সেটার জন্য শাস্তি ভোগ করলে মানা যায়। কিন্তু বিনাদোষে এতো অপমান, অত্যাচার, কষ্ট আসলেই কি সহ্য করা যায়?

অন্যদিকে জাভিয়ান হানিয়ার কথা শুনে একটু চমকে যায়। তার অফিসে তার বউকে অপমান করেছে অন্য কেউ। বিষয়টা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শুরু থেকেই সে এইদিক দিয়ে একটু অন্যরকম। তার অপ্রিয় বউটাকে সে ব্যতীত অন্যকেউ কষ্ট দিলে বা অপমান করলে তার মাথায় আগুন জ্বলে যায়। এমনকি সে ব্যতীত অন্যকেউ হানিয়াকে আদর করলে বা ভালোবাসলেও তার সহ্য হয় না। এটা কেন হয় সে নিজেও জানে না। হানিয়ার কথা আর তার কান্না দেখে জাভিয়ানের বাড়ন্ত রাগটা পড়ে যায়। সেখানে এসে জমা হয় সহানুভূতি,, আদর,, প্রশ্রয়। সে হানিয়ার ধরে রাখা হাতটা এবার আলতো করে ধরে,,তারপর তাকে টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে। ডান হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে–

–কে কি বলেছে? আমায় বলো, তাকে আজই অফিস থেকে বের করে দিবো।

হানিয়া জাভিয়ানের আদরে নরম তো হয়ই না বরং আরো গরম হয়ে যায়। সে কন্ঠে প্রচন্ড তেজ নিয়ে বলে–

–আমি এমন কেউ নই যে তাকে অপমান করা ব্যক্তিটিকে আপনি নিজের অফিস থেকেই বের করে দিবেন। বরং আমার থেকে আপনার কাছে সে বেশি মূল্যবান। কেউ কিছু বলেনি। বাসায় যেতে দিন আমায়। অপমান আর মা’র খেয়ে পেট ভরে গেছে আমার,,এবার বাসায় গিয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমাবো। ছাড়ুন আমাকে,,মাথা ব্যথা করছে। অসহ্য!

জাভিয়ান হানিয়ার কথায় রাগতে গিয়েও রাগে না। সে রেগে গেলে বিষয়টা আরো ঘেঁটে যাবে। তাই নিজেকে শান্ত রেখে হানিয়াকে কোলে তুলে নেয়। তারপর হাঁটা লাগায় অফিসের ভেতরে যাওয়ার জন্য। রাসেলও তার পেছন পেছন আসতে থাকে। এতক্ষণে বস আর রমণীটির কথপোকথন শুনে বুঝতে পেরে গেছে এই রমণীটি তার বসের ঘরণী।

জাভিয়ান অফিসে একজন রমনীকে কোলে করে নিয়ে আসায় সকলে ভয়াবহ রকমে চমকে যায়। সবার থেকে বেশি চমকে যায় রিসেপশনে থাকা মেয়েটি। সে জাভিয়ানের কোলে হানিয়াকে দেখে বুঝতে পারে সে কতবড় একটা ভুল করে ফেলেছে। রাসেল তার পেছন পেছন আসে লিফট পর্যন্ত। জাভিয়ান লিফটে ওঠার আগে রাসেলকে বলে যায় রিসেপশনে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার গত একঘন্টার ফুটেজ চেক করতে। রাসেল তার কাজে লেগে পরে আর জাভিয়ান চলে আসে তার কেবিনে। কেবিনে এসে জাভিয়ান হানিয়াকে তার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজে আবার কেবিনের বাহিরে চলে আসে। তার অপ্রিয় বউটাকে যে অপমান করেছে তাকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না। কন্ট্রোলরুমে এসে গত একঘন্টার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে বিষয়টা জাভিয়ান বুঝতে পারে। তারপরই রিসেপশনিস্টকে আচ্ছা করে ঝাড়তে থাকে।

প্রেজেন্ট~~

জাভিয়ান টেবিল দুইহাত দিয়ে বারি দিয়ে বলে–

–ফর গড সেক,,এবার তোমার ভাঙ্গা রেডিও থামাও। হয়েছে তো।

হানিয়া টেবিলের উপর থেকে মাথা তুলে জাভিয়ানের দিকে তাকায়। হানিয়া মাথা তুললে জাভিয়ান তাকে দেখতে চমকে যায়। হানিয়ার চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শ্বাসও কেমন টেনে টেনে নিচ্ছে। জাভিয়ান তার আধ খাওয়া পানিটা হানিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়,,হানিয়া সেটা একবার দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। ব্যাগ থেকে ইনহেলার বের করে দু’বার স্প্রে করে মুখে। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে মাথায় ঠেকায় টেবিলে। শ্বাসকষ্টের সমস্যা তার বহু আগের। ইনহেলার ব্যবহার করে বছর দুয়েক ধরে। জাভিয়ান তাকে সময় দেয় স্বাভাবিক হতে। দশ মিনিট পর হানিয়া নিজে থেকেই মাথা উঠায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে–

–বাসায় যেতে পারি এখন?

–নাহ।

–কারণটা কি?

–আমার লাঞ্চ করা বাকি,,সাথে তোমারও।

–আমায় নিয়ে ভাবেন বুঝি?

–দেখো…

জাভিয়ান কথা শেষ করতে পারে না কারণ তখনই কে যেনো নক করে। জাভিয়ান বসা থেকে উঠে দরজা খুলে,, দেখতে পায় পিয়ন খাবারের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে পিয়নের কাছ থেকে ট্রেটা নিয়ে আবার দরজা লক করে দেয়। লক করার আগে পিয়নকে বলে দেয়” আগামী দুই ঘন্টা যাতে কেউ তাঁকে ডিস্টার্ব না করে,,যদি কেউ করে তাহলে তার কপালে দুঃখ আছে।” জাভিয়ান খাবারের ট্রে’টা তার কেবিনে রাখা সেন্টার টেবিলের উপর রাখে। তারপর হানিয়ার কাছে এসে তাকে বসা থেকে দাঁড় করায়। নিজেই হানিয়ার পরিহিত হিজাবের পিনগুলো এক এক করে খুলতে থাকে। হিজাব খুলে বোরকাটাও নিজেই খুলে দেয়। তারপর হানিয়াকে টেনে কেবিনের এটার্চ ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ হতে বলে। হানিয়া ফ্রেশ হয়ে আসলে তাকে খাবারের কাছে নিয়ে আসে,,নিজেও তার পাশে বসে খাবার মাখিয়ে তার মুখের সামনে ধরে। হানিয়া প্রথমে মানা করলেও আবারও এক রামধমক খেয়ে খাবার মুখে তুলে। নিজের ভেতরের পিনপিনে রাগটা এখনো আছে। সুযোগ পাচ্ছে না বের করার তাই রাগটা ভেতরে ভেতরে আরো বাড়ছে। জাভিয়ান নিজেও খেতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে পিয়নকে ডেকে এঁটো থালাগুলো নিয়ে যেতে বলে আর রাসেলের থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে আবারও দরজা লাগিয়ে দেয়। হানিয়া চোরা চোখে একবার সেই প্যাকেটের দিকে তাকায়। দেখতে পায় জাভিয়ান সেই প্যাকেটের ভেতর থেকে তার ঔষধগুলো বের করছে। সবটাই হানিয়া নিরবে দেখে,,মুখ বুঁজে সহ্য করে। সময় একদিন তারও আসবে।

জাভিয়ান হানিয়াকে ঔষধ খাইয়ে দেয়। সব কাজ শেষ করে হুট করে হানিয়াকে টেনে নিজের বুকের উপর ফেলে। হানিয়া সেখান থেকে সরে আসতে চাইলে জাভিয়ান নিজের বল না বুদ্ধি প্রয়োগ করে। সে হানিয়ার ঘাড়ের পেছনে চেপে ধরে মাথাটা হালকা উঁচু করে তারপর হানিয়ার খয়েরী রঙের ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর দিতে থাকে নিজের পুরুষালি দ্বারা। হানিয়ার পিনপিনে রাগটা এবার জোয়াল মুখী হয়ে বের হয়ে আসতে চায়। হাত চালিয়ে জাভিয়ানকে সরিয়ে দিতে চাইলে জাভিয়ান তার হাতদুটো নিজের একহাত দ্বারা চেপে ধরে। হানিয়া উপায় না পেয়ে এবার নিজের দাঁত চালায়। শরীরে সব শক্তি দিয়ে জাভিয়ানে ঠোঁট কামড়ে ধরে। সেকেন্ডের ব্যবধানে ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে থাকে। হানিয়া তা টের পেয়েও ছাড়ে না। সে মনে মনে বলছে” আমাকে তখন বিনা দোষে মেরে রক্তপাত করেছিলি না,,এবার আমিও করবো। শোধবোধ। ”

জাভিয়ান তার ঠোঁটের পীড়া সইতে না পেরে হানিয়ার ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে আনে। হানিয়ার ঘাড়ের পেছনে রাখা হাতটা নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সেই হাতটা সামনে এনে দেখে রক্তিম লাল পদার্থ। চোখ তুলে হানিয়ার দিকে তাকালে হানিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে–

–শোধবোধ।

–এতো তাড়াতাড়ি না বধূয়া। নাউ ইটস মাই টার্ন।

কথাটা বলেই হানিয়াকে নিজের কোল থেকে নামিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে সোফায় শুইয়ে দেয়। তারপর নিজের অর্ধেক ভার হানিয়ার উপর দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘাড় থেকে একটু জামা সরিয়ে সজোরে কামড়ে ধরে উন্মুক্ত সেই জায়গায়। হানিয়া সইতে না পেরে জাভিয়ানের চুল খামচে ধরে।

___________________

আদিয়াতকে আজকাল প্রায়ই অন্যমনস্ক দেখা যায়। নিজের কাজের প্রতি অনুগত আদিয়াত আজকাল একটু বেশিই ভুল করছে। বাসার লোক থেকে শুরু করে অফিসের কলিগ সকলে তার এমন পরিবর্তনে অবাক। এই যেমন এখন, সে স্টুডেন্টদের মান্থলি টেস্টের খাতা দেখছে তাও আবার খাতা বা কলম কোনটাই না খুলে। উপরন্তু খাতার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। নজরকাড়া সেই হাসিতে মহিলা কলিগসদের ঘায়েল করলেও পুরুষ কলিগরা বিষয়টা একটু ভিন্ন নজরেই দেখছেন। তারা সকলেই স্বীকার করেন আদিয়াত তাদের কলেজের সবচেয়ে ইয়াং,,ব্যাচেলার আর হ্যান্ডসাম স্যার। বিয়ের বয়স প্রায়ই পেরিয়ে যাচ্ছে যাচ্ছে কিন্তু আদিয়াত এখনো বিয়ের পিড়িতে বসতে নারাজ। কেন নারাজ একমাত্র সেই জানে।

একজন সিনিয়র কলিগ মি.আবেদীন এসে আদিয়াতের ডেস্কে। নিজের সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আদিয়াত চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। দেখতে পায় হাস্যজ্জ্বোল আবেদীন সাহেবকে। আদিয়াত নিজেও হাসিমুখে তাকে জিজ্ঞেস করে–

–কিছু বলবেন আবেদীন স্যার?

–বলতে তো চাই অনেক কিছুই কিন্তু জায়গাটা সঠিক মনে হচ্ছে না। ক্যান্টিনে যাবেন নাকি?

আদিয়াত তার কথায় একটু চমকেই যায়। হুট করে ক্যান্টিনে যাওয়ার অফারে একটু বেশিই চমকায়। তাও আবেদীন সাহেবের কথাগুলো শোনার আগ্রহ দমাতে না পেরে অগ্যাত সম্মতি জানায় তার অফারে। দু’জনে চলে যায় ক্যান্টিনে,,নিজেদের কিছু সিক্রেট কথোপকথন করতে।

শব্দসংখ্যা~১৯৯০

~~চলবে?

#প্রতিশোধের_অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_চল্লিশ

আদিয়াত আর আবেদীন স্যার দু’টো চা নিয়ে বসেন গল্প করতে। আদিয়াতই প্রথমে জিজ্ঞেস করে–

–কি যেন বলতে চেয়েছিলেন আবেদীন স্যার?

–ওহ্হ,, ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা শুনুন।

আদিয়াত অনেক মনোযোগ দেয় আবেদীন স্যারের কথা শুনতে।

–আপনি আমাদের কলেজে আছে আজ প্রায়ই দেড় বছরের বেশি হবে। এতোদিন ধরে আপনার সাথে কাজ করছি কখনো আপনার নামে তেমন কোন কানাঘুষা শুনি নি। সত্যি বলবো,,আমাদের কলেজের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম,,কম বয়সী,,ব্যাচেলার স্যার হওয়ায় আমাদের মহিলা কলিগ থেকে শুরু করে মেয়ে স্টুডেন্টরা অনেক বেশি পছন্দ করে আপনার। তাদের ভাষায় দে আর ক্রাশড অন ইউ,,আদিয়াত স্যার।

কথাটা বলে আবেদীন স্যার একটু জোরে হেসে দেয়। আদিয়াত নিজের কলিগের কাছ থেকে এমন প্রশংসা পাওয়ায় যেমন লজ্জা পেয়েছে,, তেমনি হকচকিয়ে গেছে। কথা সে নিজেও জানে কিন্তু মানতে চায় না তার মন। আদিয়াত একটু লজ্জা পেয়ে ঘাড়ের পেছনে চুলকে বলে–

–কি যে বলেন স্যার। তেমন কিছুই না।

আবেদীন স্যার হাসতে হাসতে বলেন–

–যা বলছি সত্যি বলছি স্যার। কথাটা কিন্তু আপনিও জানেন। কিন্তু ইদানীং আপনাকে নিয়ে যে টিচার্সরুমে ফিসফিসানি হয় সেই খবর কি আপনি জানেন?

আবেদীন স্যারের কথা শুনে আদিয়াত অবাক হয়ে যায়। সে এই বিষয়ে বেখবর। সে মুখটা গম্ভীর করে বলে–

–কেমন ফিসফিসানি হয় তা বললে আমার জন্য সুবিধা হতো।

–টিচার্সদের মধ্যে বেশির ভাগ টিচার ধারণা করছেন আপনি নাকি প্রেমে পরেছেন। যেহেতু আমাদের মহিলা কলিগরা সকলে বিবাহিত তাই তাদের কারো প্রেমে পরার প্রশ্নই আসে না। তাহলে প্রেমে পরার জন্য বাকি থাকে ফিমেল স্টুডেন্টরা। আপনি নাকি কলেজের কোন ছাত্রীর প্রেমে পরেছেন। এই হলো ফিসফিসানির বিষয়।

আবেদীন স্যারের কথা শুনে আদিয়াত নিজেই ভাবনায় পরে যায়। মন তো তারও বলছে আদিয়াত তার এতো বছরের রেকর্ড ভেঙে কোন রমণীর প্রেমে পরেছে,,কিন্তু মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ। ছাত্রীর সাথে প্রেম? বিষয়টা নিজের কাছেই জঘন্য লাগে আদিয়াতের। কিন্তু সেই জঘন্যজনক কাজটা নাকি আদিয়াত নিজেই করেছে? হায় রে মন! আদিয়াত নিজের মনে মনেই এসব ভাবছিলো,,তখন আবেদীন স্যার তাকে ডেকে উঠেন–

–কোথায় হারিয়ে গেলেন আদিয়াত স্যার?

–হা,,না না কোথাও হারিয়ে যায় নি। আমি আপনার বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। আমার মধ্যে কি এমন পরিবর্তন এলো যার কারণে আমার কলিগরা এমনটা ভাবছে সেটাই মনে করার চেষ্টা করছিলাম।

আবেদীন লোকটা ভীষণই হাসিখুশি একজন মানুষ। কথায় কথায় তার মুখ দিয়ে হাসি বের হয়। সে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলেন–

–অনেক পরিবর্তন এসেছে।এই যেমন ধরুন,, আজ স্টুডেন্টদের মান্থলি টেস্টের খাতা দেখতে বসলে অথচ না খুলেছিলেন খাতা আর না কলম। বরংচ খাতার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছিলেন। এই হাসার নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ আছে।

আদিয়াত আবেদীন স্যারের কথা শিনে থতমত খেয়ে যায়। সে এমন কাজ করেছিলো? হায় আল্লাহ! নাহ তাকে নিজের কাজের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। আদিয়াত হালকা হেসে বলে–

–আপনারা যা ভাবছেন তেমন কিছুই না স্যার। যাই হোক,,আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি অনেক কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। আপনি আমায় ভবিষ্যতের একটা বড় কনট্রোভার্সি থেকে বাঁচালেন।

–তা স্যার শুঁকনো ধন্যবাদে তো কাজ হবে না। আমি ম্যাথের টিচার। সবকিছুর পাই টু পাই হিসাব রাখি। আপনি কিন্তু আমার কাছে ঋণী হয়ে গেলে আর আমি আপনাকে ঋণী করে রাখতে চাই না।

আদিয়াত একটু জোরে হেঁসে দিয়ে বলে–

–তাহলে বলুন কি করলে আমার ঋণ পরিশোধ হবে?

–ইমমমমমম,, এই চায়ের বিলটা দিয়েই না হয় ঋণটা পরিশোধ করলেন। পরেরবার আমিই না হয় দিবো বিলটা।

–অবশ্যই।

কথা বলতে বলতে তাদের চা ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আদিয়াত আর আবেদীন স্যার বসা থেকে উঠে। তারপর চায়ের বিল দিয়ে চলে যায় নিজেদের ক্লাস নিতে।

________________________

জাভিয়ান মিটিং শেষ করে এসে নিজের কেবিনে প্রবেশ করলে কেবিনটাকে অন্ধকার অবস্থায় পায়। বুঝতে বাকি থাকে না হানিয়া এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। সে পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে তারপর সুইচবোর্ডের কাছে যায়। সবগুলো লাইট না জ্বালিয়ে শুধু তার ডেস্কের উপরের লাইটগুলো জ্বালায়। সেই লাইটের আলোতেই অন্ধকার রুম টার অর্ধেকটা আলোকিত হয়ে যায়। জাভিয়ান তার ডেস্কের উপর রাখা ফাইল আর ল্যাপটপ গুছিয়ে অফিস ব্যাগে ভরে নেয়। গোছানো হয়ে গেলে তার মনে হয়,,এবার তার বউকে ঘুম থেকে জাগানোর সময় হয়ে গেছে।

বউয়ের কথা মনে পরতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে ফিরে সোফায় নজর দেয়,,যেখানে এখন অবস্থান করছে এক ঘুমন্ত রমণী। জাভিয়ান ভীষণই আস্তে আস্তে হেঁটে হানিয়ার সামনে উপস্থিত হয়,,তারপর হাঁটু গেড়ে তার সম্মুখে বসে পরে। মেয়েটা দুটো পিলো মাথার নিচে দিয়ে আরেকটা পিলো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।ঠান্ডা লাগার কারণে হাত-পা গুটিয়ে রেখেছে। জাভিয়ান হাত বাড়িয়ে হানিয়ার গুটিকয়েক এলোমেলো চুল কানের পেছনে গুঁজে দেয়। কাজটা শেষ করে সময় নিয়ে হানিয়াকে দেখতে থাকে। সে বুঝে পায় না এই মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা তাঁকে এতো শান্তি দেয় কেন? দেখা শেষ হলে মনটা বলে উঠে একটু আদর করে দিতে ওই গোলুমোলু আদুরে মুখটায়। এক্সিডেন্টের পর হানিয়া কিছুটা শুঁকিয়ে গেলেও ইদানীং আবার আগের মতো টমেটো লাগে তার কাছে। দেখলে আদর আদর পায়,,আদরের সাগরে ডুব দিতে মন চায় এই রমনীকে নিয়ে।

জাভিয়ান নিজের মুখটা হানিয়ার কাছে নিয়ে গিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। শুধু কপালে দিয়ে তার মন শান্তি পায় না তাই হানিয়ার পুরো মুখশ্রীতে নিজের পুরুষালী ঠোঁটের স্পর্শ দিতে থাকে। সময় নিয়ে কাজটা করে সে,,কোন তাড়াহুড়ো নেই তার। হুট করে নজর যায় তার হানিয়ার ডান কাঁধের লালচে জায়গাটার দিকে। ব্যথাটা তারই দেওয়া। ঘন্টা দুয়েক আগের ব্যথা এটা। জাভিয়ান জায়গাটায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে আদর দেয়,,তারপর মুখের মতো সেখানেও নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। একবার,,দু’বার বেশ কয়েকবার। হানিয়া ব্যথা জায়গায় উত্তক্ত করায় ডিস্টার্ব বোধ করে ঘুমের মধ্যেই গুঙিয়ে উঠে। জাভিয়ান তার গোঙানির আওয়াজ শুনে কাঁধ থেকে মুখ সরিয়ে আনে। হানিয়ার ডান গালে আলতো হাতে স্লাইড করতে করতে বলে–

–কেনো তুমি আমার জীবনে আরো আগে আসলে না? তোমার ভাই আর আমার আপুর দেখা হওয়ারও আগে। তাহলে আমাদের সম্পর্কটা আজ এমন হতো না। ট্রাস্ট মি,, এই জাভিয়ান তোমাকে এতো ভালোবাসত তুমি তা কল্পনাও করতে পারতে না। কিন্তু উপরওয়ালা পরিকল্পনা হয়ত অন্য কিছু। তার জন্যই হয়ত আমার তোমাকে আজ প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করে তারপর কষ্ট দিতে হচ্ছে। জানো বধূয়া,,মাঝে মাঝে মনে হয় আর কষ্ট দিবো না তোমাকে। একদম আমার বুকের খাঁচায় বন্দী করে রেখে দিবো তোমায়। সারা দিনরাত শুধু আদর করবো,,ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো। কিন্তু যখনই তোমায় ভালোবাসতে চাই,,আমার বোনের সেই করুন চাহনি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ভেসে উঠে সেইদিনের প্রতিচ্ছবি যেদিন তোমার ভাই আমার বোনকে নষ্ট করেছিলো,, সে হয়ত মেরেও ফেলত আমার বোনকে কিন্তু আমি ঠিক সময়ে পৌছে যাওয়ায় আমার বোনটা প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু বেঁচে থেকেও আজ সে মৃত। কেন এমন হলো আমার বোনের সাথে হানি? সে তো তোমার ভাইকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিলো তাহলে তোমার ভাই কীভাবে আমার বোনের সাথে এমনটা করতে পারলো?

কথাগুলো বলতে বলতে জাভিয়ানের বামচোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে। ঘুমানোর আগে হানিয়ার প্রচন্ড মাথা ব্যথা থাকায় সে ডাক্তারের সাজেস্ট করা একটা ঘুমের ঔষধ নিয়েছিলো,, জাভিয়ান ভাবে হানিয়া গভীর ঘুমে। এই ফাকে সে মনের লুকানো অনেক কথা ঘুমন্ত হানিয়াকে বলতে থাকে। বলতে থাকে তাকে বিয়ে করার কারণ সহ তার বোনের সাথে হওয়া ঘটনা এবং তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার সমস্ত কারণ। নিজের মতো বকবক করে অনেকক্ষণ পর থামে জাভিয়ান। আজ এই বুকটা হালকা লাগছে। তার ভেতরে কথা জমতে জমতে কথার পাহাড় হয়ে গিয়েছিলো। আজ সেই কথা গুলোর অনেকটা ঘুমন্ত হানিয়ার সাথে শেয়ার করে তার বুকটা হালকা হয়ে গেছে। নিজের কথা শেষ করে জাভিয়ান পুনরায় হানিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। হানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে–

–তুমি অনেক লক্ষী মেয়ে হানি। আমি তোমাকে ডিজার্ভ করি না। আমার বোনটা সুস্থ হোক,, তোমার ভাইকে আমার মতো কাঁদিয়ে তারপর তোমায় মুক্ত করে দিবো। তুমি তোমার যোগ্য একজনকে বেছে নিয়ে তার সাথে সুখের সংসার করো। আমিও না হয় অন্য কারোর সাথে সুখের ঘর করার চেষ্টা করবো।

________________________

মাঝে আরো একটাদিন চলে যায়। কাল সকালে জাভিয়ান ঢাকার বাহিরে যাবে। সময়টা এখন রাত তিনটে। জাভিয়াম বর্তমানে অবস্থান করছে স্পর্শ রুমে। বোন তার একটু আগেই ঘুমিয়েছে। স্পর্শকে আজ জাভিয়ানের কাছে অনেকটাই শান্ত লেগেছে। আগের মতো এগ্রেসিভ আচরণ করেনি আজ তার সাথে। বোনের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন দেখে জাভিয়ান বেজায় খুশি। সে খুশি মনেই মিসেস জুলিয়াকে জিজ্ঞেস করে–

–মিসেস জুলিয়া,,আজ আমার মনে হলো স্পর্শ অনেকটাই শান্ত ছিলো। আগে তো আমাকে দেখলেই রেগে যেতো,,জিনিস ছুড়ে মারত। আজ আমার বোন তা করেনি উল্টো আমার সাথে হেঁসে হেসে কথা বলেছে। মনে হচ্ছে ঔষধ গুলো কাজে দিচ্ছে।

–জ্বি স্যার। ঔষধ গুলো কাজে দিচ্ছে। ইদানীং আগের মতো পাগলামি বা এগ্রেসিভ আচরণ করে না।

–কথা মি.চৌধুরীকে জানাই কি বলেন?

কথাটা বলতে বলতেই জাভিয়ান তার পকেট থেকে ফোন বের করে মি.চৌধুরীকে ফোন দিতে যায়। তখন মিসেস জুলিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে–

–না না স্যার। এই কাজটা করবেন না ভুলেও।

মিসেস জুলিয়ার কথায় জাভিয়ান অবাক হয়। মিসেস জুলিয়াও কাজটা করার থতমত খেয়ে যায়। সে আমতাআমতা করে বলে–

–আমরা তাকে এখনি কিছু বলবো না। কয়েকদিন যাক,,ম্যামের স্বাস্থ্যের আরেকটু উন্নতি হোক তারপর বলি। মনে করেন,,ম্যামের এই রিয়েকশন গুলো ঔষধের কারণে হচ্ছে কিন্তু এটা স্থায়ী না তাহলে বিষয়টা মি.চৌধুরীকে ভীষণ কষ্ট দিবে। আপনি তো জানেনই মি.চৌধুরী ম্যামকে কতটা ভালোবাসে। লোকটা ভীষণ ভেঙে পরবে যদি ম্যামের পরিবর্তনটা ক্ষণস্থায়ী হয়। এই জন্য আপনাকে এখনি মি.চৌধুরীকে ম্যামের কথাটা বলতে মানা করছিলাম। বাকিটা আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করেন।

জাভিয়ান মিসেস জুলিয়ার কথাগুলো শুনে ভাবনায় পরে যায়। সে ভাবে “মিসেস জুলিয়া খারাপ কিছু বলেনি। ছেলেটা আমার পুতুলকে কতটা ভালোবাসে তা আমি এই কয়েক বছরে দেখেছি।” সে হাসি মুখে মিসেস জুলিয়াকে বলে–

–ধন্যবাদ মিসেস জুলিয়া সঠিক পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আমরা বিষয়টা আরো কয়েকদিন দেখি তারপর মি.চৌধুরীকে জানাবো।

মিসেস জুলিয়া হালকা হেঁসে মাথা নাড়ায়। জাভিয়ান চলে যাওয়ার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মিসেস জুলিয়াকে বলে–

–আজ আমি একটা কাজে ঢাকার বাহিরে যাবো। চেষ্টা করবো আজকের মধ্যেই ফেরার। কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবেন। আমাকে ফোনে না পেলে আমার পি.এ রাসেলকে ফোন দিয়ে আমাকে চাইলেই হবে।

–আচ্ছা স্যার। আপনি যদি কিছু না মনে করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

–অবশ্যই। এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হয় বুঝি?

–মি.চৌধুরী অনেকদিন হলো ম্যামকে দেখতে আসছে না। উনি কি বেশি বিজি?

–আসলে ও তো দেশেই নেই। লন্ডনের একটা কোম্পানির সাথে বড় একটা প্রজেক্ট সাইন করেছে,,এর জন্য ওকে তিনমাসের জন্য লন্ডন যেতে হয়েছে। এখনো একমাস পুরোপুরি শেষ হয়নি ওর লন্ডনে যাওয়ার। আরো অনেকদিনই আসবে না।

–ওহ্হ। তাই তো বলি উনি প্রতিদিন না আসুক সপ্তাহে একদিন অন্তত আসত কিন্তু এই মাসে একবারও আসেনি দেখে কথাটা আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।

–আচ্ছা ব্যাপার না। আর কিছু জানার আছে মিসেস জুলিয়া?

–না স্যার।

–তাহলে আমি এখন আসি।

–ওকে। গুড বায়।

–আল্লাহ হাফেজ।

জাভিয়ান মিসেস জুলিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এসে পরে। তারপর হানিয়াকে জাপ্টে ধরে ঘুমিয়ে পরে। জাভিয়ানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলে হানিয়া বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে পরেছে। হানিয়া ঘাড় ঘুড়িয়ে জাভিয়ানকে একবার দেখে সেও ঘুমিয়ে পরে।

______________

সকাল দশটায় জাভিয়ান বের হয়ে যায়। জাভিয়ান বাসা থেকে বের হওয়ার মিনিট বিশেক পরেই হানিয়াও বের হয়। এগারো টায় তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ইনায়া জায়গা মতো গাড়ি নিয়ে এসে পরেছে। হানিয়া চটজলদি বাসা থেকে বের হয়ে ইনায়ার কাছে যায়। তারপর কল লাগায় মিসেস জুলিয়াকে। উনি ফোন রিসিভ করে জানান সেও স্পর্শকে নিয়ে আসছে।

মিসেস জুলিয়া তার কিছুক্ষণ পরই স্পর্শকে নিয়ে আসে। এতোদিন পর বাহিরের পরিবেশ দেখে স্পর্শ অনেক এক্সাইটেড। তার চেয়েও বেশি এক্সাইটেড হানিয়াকে দেখে। ফোনে তার সাথে কত আদর দিয়ে কথা বলে ছোট্ট আপুটা। জুলিয়া আন্টির কাছে তার জন্য চকলেটও পাঠায়। এই জন্য সে হানিয়াকে আরো বেশি পছন্দ করে। আগে তো কেউ তাকে এমন আদর করত না,,শুধু ইলেকট্রনিক শক দিতো আর মারত। আবরারের কথা জিজ্ঞেস করলেও কেউ বলত না। কি ছোট্ট আপুটা বলেছে সে আবরারের কাছে নিয়ে যাবে। এতে সে বেজায় খুশি,, ইমম খুশি না মহাখুশি।

ইনায়া-হানিয়া গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। স্পর্শ দূর থেকে হানিয়াকে দেখে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। হুট করে কেউ জড়িয়ে ধরায় হানিয়া হকচকিয়ে যায়। হানিয়া জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিটির দিকে তাকালে দেখতে পায় স্পর্শ। সেও খুশি মনে স্পর্শকে জড়িয়ে ধরে। টুকটাক কথা বলে তারা রওনা হয় সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে।

দু’ঘন্টার কাউন্সিলিং শেষ করে ডাক্তার যখন বের হয় তখন হানিয়া তার সাথে কথা বলতে তার কেবিনে যায়। হানিয়ার বেশ উদ্বিগ্ন স্পর্শের হেল্থ সম্পর্কে। সে ডাক্তারকে স্পর্শর হেল্থ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান–

–তিনি ভালোই ইম্প্রুভ করছে। নিয়মত ঔষধ আর কাউন্সিলিং করালে আশা করা যায় খুব শীঘ্রই উনার নরমাল লাইফ লিড করতে পারবে।

হানিয়া কথাটা শুনে ভীষণ খুশি হয়ে যায়। সে খুশি হয়ে বলে–

–আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের জন্য কোন পরামর্শ থাকবে কি ডা.?

–হুম। আপনারা তাকে মেন্টাল সাপোর্ট দিবেন,, যতটা সম্ভব তাঁকে হাসিখুশি রাখবেন। উনার সাথে কথা বলে আরেকটা জিনিস বুঝতে পারলাম,, সে কিছু স্মৃতিও হারিয়ে ফেলেছে। এই মাসটা যাক,,আরেকটু হেল্থে ইম্প্রুভ হোক তারপর টুকটাক পুরানো স্মৃতি মনে করানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করবেন বেশি প্রেশার দিয়ে মনে করাতে যাবেন না কিন্তু।

–আচ্ছা ডাক্তার।

হানিয়া আরো কিছু কথা বলে ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হয়ে স্পর্শের কাছে যায়। স্পর্শ কাছে গিয়ে দেখে সে ইনায়ার সাথে দুষ্টুমি করছি। ইনায়াও তার সাথে একদম মিশে গেছে। হানিয়া তাদের কাছে এগিয়ে যায়। তারপর অনেল বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্পর্শকে নিয়ে বের হয়ে আসে ক্লিনিক থেকে। কষ্ট করার কারণ হলো,,স্পর্শর জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়ে গেছে সে এখানেই থেকে যেতে চায়। কিন্তু এখানে তো থাকা যাবে না।

বাসায় আসার সময় একটা পার্ক পরে রাস্তায়। স্পর্শ গাড়িতে বসে সেই পার্কে কিছু বেলুন আর হাওয়াই মিঠাই ওয়ালাকে দেখে বায়না ধরে তাকেও সে সব জিনিস কিনে দিতে হবে। আবদার না মানতে চাইলে স্পর্শ হাইপার হয়ে যায়। হানিয়া অগ্যাত গাড়ি থেমে নামলে স্পর্শও তার পেছন পেছন নেমে পরে ছুট লাগায় পার্কে। বেশ কিছুক্ষণ ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি করে তারপর আবার গাড়িতে আসে।

শব্দসংখ্যা~২০৩২

~~চলবে?

#প্রতিশোধের-অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_একচল্লিশ

হানিয়ার আজকাল দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে। স্বামীর ভালোবাসা না পেলেও বাকিদের থেকে সে যথেষ্ট ভালোবাসা,,সম্মান,,আদর পায়। সে বুঝতে পেরে গেছে সবার কপালে স্বামীর ভালোবাসা পাওয়ার সুখ জুটে না। সেও সেই দলেরই একজন। জাভিয়ান তার কাছে কেমন জানি একটা চরিত্র। এই ভালো তো এই খারাপ। নিজে শত আঘাত করবে,,কথার বিষাক্ত তীর দ্বারা তাকে নির্মমভাবে ক্ষতবিক্ষত করবে। কিন্তু অন্য কেউ যদি হানিয়াকে একটু ধমক দিয়ে কথা তাহলে তার সেটা সহ্য হয় না।

ইদানীং হানিয়ার মনে হচ্ছে এভাবে হয় না। কোন সম্পর্ক এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। নিজের জীবনের প্রথম পুরুষ হিসেবে সে জাভিয়ানকে নিজের সবটা দিয়েই ভালোবেসেছিল কিন্তু জাভিয়ান? সে যে হানিয়াকে বিয়ে করেছে শুধু মাত্র প্রতিশোধের জন্য। তার মনে হচ্ছে,, খুব শীঘ্রই তাদের বিচ্ছেদের করুণ সুর বাজতে চলেছে। এবং কাজটা হানিয়ার দ্বারাই সংঘটিত হবে বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু সে নিজের মনের কথাও জাভিয়ানকে জানাতে চায়। জানতে চায় তাদের সম্পর্ক নিয়ে জাভিয়ানের মতামত। যদি জাভিয়ান প্রতিশোধ ভুলে তাকে আপন করে নেয় তাহলে সেও নিজেকে নির্লজ্জ,,মেরুদন্ডহীন প্রমাণ করে থেকে যাবে জাভিয়ানের কাছেই। দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে এই পাঁচ মাস সাতাশ দিনের স্মৃতি গুলো। ভালোবাসলে একজনকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই ছাড় দিতে হয়। একটু বেশিই মানিয়ে নিতে হয়,, করতে হয় স্যাক্রিফাইজ।

হানিয়া নিজের মনের কথাটা জানাবে আর তিনদিন পর স্পেশাল দিনটায়। তিনদিন পর কি? এই দিনেই তাদের বিয়ের ছ’মাস পুরনো হবে। তাদের এক সুতোয় বাঁধা পরার ছ’মাস দেখতে দেখতে পূরণ হয়ে গেলো। সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায়,,তাই না?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ইনায়ার আগমন ঘটে। আরেকটা আজকে তাদের লাস্ট এক্সাম ছিলো। মোটামুটি পর্যায়ের হয়েছে এক্সামটা। দুজনে কথা বলতে বলতে হাটা দেয় বাসার উদ্দেশ্য।

–তুই কি এখনি রওনা হবি ভাইয়ার বাসার উদ্দেশ্য??

–হুম রে। পাগলটা রাগ করে বসে আছে। তার সেই পাগলামিতে সাথ দিচ্ছে কে জানি? আমার শ্বাশুড়ি মা। সেও অভিমান করে বসে আছে এতদিন ওই বাড়িতে না যাওয়ায়। তাই এখনি রওনা হবো। (হাত ঘড়িতে সময় দেখে ইনায়া বলে) যেতে যেতে মাগরিবের আজান পরে যেতে পারে,, ব্যাপার না। সাহেব আমার রাগ করে আছেন। তার সেই রাগ না ভাঙানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না নিজের ভেতর।

কেমন অস্থির কণ্ঠে কথাটা বলে ইনায়া।হানিয়া ইনায়ার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। মেয়েটার চোখমুখের উদ্বিগ্নতাই বলে দিচ্ছে মেয়েটা গভীর প্রণয়ে বাধা পরে গেছে তার অর্ধাঙ্গের প্রতি। হানিয়া আনমনেই জিজ্ঞেস করে–

–খুব ভালোবেসে ফেলেছিস ভাইয়াকে?

হানিয়ার প্রশ্ন শুনে থমকে যায় ইনায়া। হাঁটা থামিয়ে হানিয়ার দিকে তাকায়,,তারপর গলায় উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে–

–ভীষণ, ভীষণ,, ভীষণ। তাঁকে ছাড়া নিজেকে আমি এখন আর কল্পনাই করতে পারি না।

হানিয়ার ইনায়ার কাছে এসে তার হাতদুটো ধরে বলে–

–সারাজীবন এমনই একে অপরের সঙ্গে বাঁধা পরে থাক। আর বছর বছর আমাকে খালা মনি হওয়ার সুযোগ করে দিস। মন থেকে দোয়া করলাম।

লাস্টের কথাটা মজা ছলে বলেছে। হানিয়ার কথা শুনে ইনায়াও হেসে দেয়। দুই বান্ধবী একটু ঘুরাঘুরি করে যে যার বাসার দিলে রওনা হয়।

___________________

হানিয়া নিজের অনুভূতি জাভিয়ানকে জানাতে চায় এটা সে শুধু কুলসুমকে বলেছে। তাকে জানানোরও একটা কারণ আছে। সে নিজেদের রুমটা একটু রোমান্টিক ভাবে ডেকোরেট করে তারপর জাভিয়ানকে জানাবে। এবং এ’কাজের জন্য একজনের সাহায্য লাগবে তার। রোজি বেগমকে বললে সেও সাহায্য করত কিন্তু তার বয়স হয়েছে বেশি দৌড়ঝাঁপ তার জন্য একটু কষ্টকর বটে।

____________________________

আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি। আজ রাত বারোটায় তাদের বিয়ের ছ’মাস পূরণ হবে এবং তখনই সে জাভিয়ানকে কথাটা জানাবে। সকাল থেকেই ভীষণ এক্সাইটেড সে। জাভিয়ান রুটিন মাফিক ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যায়। হানিয়া আজ তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে কুলসুমকে নিয়ে একটু মার্কেটে যায়। টুকটাক কেনাকাটা শেষ করে বাসায় এসেই দু’জনে লেগে পরে ঘর সাজানোর কাজে।

কাজ শেষ হয় রাত আটটার দিকে। হানিয়া ঘড়িতে একবার তাকিয়ে সময় দেখে নেয়। জাভিয়ান প্রতিদিন সাতটা বড়জোর সাড়ে সাতটায় এসে পরে। কিন্তু আজ আটটা বেজে যাওয়ার পরও যখন সে আসে নি তখন হানিয়ার টেনশন হতে থাকে। সে ফোনটা হাতে নেয় জাভিয়ানকে কল লাগানোর জন্য তখনই দেখে জাভিয়ানই তাকে কল দিচ্ছে।

হানিয়া ফোনটা রিসিভ করে কথা বলার আগেই জাভিয়ান বলে–

–ড্রাইভার তোমাকে একটা শপিং ব্যাগ দিবে। ভেতরে যা পাবে তাই পরে ড্রাইভারের সাথে চলে আসবে আধাঘন্টার মধ্যে।

কথাটা শেষ করেই সে ফোনটা কেটে দেয়। হানিয়াকে কোন কথা বলার সুযোগই দেয় না। জাভিয়ান কল কাটার মিনিট পাঁচেক পরেই ড্রাইভার কুলসুমকে দিয়ে একটা শপিং ব্যাগ পাঠায়। হানিয়া কুলসুমের সাহায্যে রেডি হয়।

জাভিয়ান হানিয়াকে একটা নেভি ব্লু কালারে শাড়ি দিয়েছে। পুরো শাড়ি জুড়ে হোয়াইট স্টোনের কাজ। হানিয়ার মনে পরে আজ জাভিয়ানও নেভি ব্লু কালারের সুট পরে অফিসে গিয়েছে। তারমানে সাহেবের সব আগে থেকেই ঠিক করা। তাহলে আমাকে জানালো না কেন আগে? কথাটা ভাবে হানিয়া।

______________

হানিয়া ড্রাইভারের সাথে জাভিয়ানের বলা জায়গায় এসে পরে। বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই। কারো বাসা মনে হচ্ছে। সুন্দর করে সাজানো হয়েছে বাসার বাহিরে। ভেতরেও হয়ত সাজানো হয়েছে। গাড়ি থামতেই জাভিয়ান গাড়ির কাছে এসে হানিয়ার সাইডের ডোর খুলে দেয়। ডোর খুলে হানিয়ার দিকে না তাকিয়েই ভীষণই রূঢ় স্বরে বলে–

–আধা ঘন্টা বলেছিলাম পৌনে একঘন্টা লাগিয়ে তারপর আসলে। সব জায়গায় লেট না করলে হয় না?

হানিয়া ভেবেছিলাে জাভিয়ান তার প্রশংসা না করলেও একটু মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে অন্তত তাকাবে।কিন্তু কিসের কি? মুগ্ধ দৃষ্টি তো দূরের কথা তাকালোই তো না তার দিকে। হানিয়া মন খারাপ করে বলে–

–শাড়ির ব্লাউজ তো দিয়েছিলেম আসতাগফিরুল্লাহ মার্কা। হাতাকাটা ব্লাউজ আমাকে জীবনেও পরতে দেখেছেন? এই ব্লাউজ মনির। এটা খুঁজতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। আর আশেপাশে দেখে তো মনে হচ্ছে কোন পার্টি চলছে। আপনি আমায় কেন নিয়ে আসলেন এই জায়গায়? জানেন না আমি কমফোর্টেবল না এসব পার্টিতে?

–না জানি না আর জানতেও চাই না। সব কিছু কি তোমার কথা মতো করতে হবে? বেশি মুখ না চালিয়ে এবার পা’টাও চালাও।

জাভিয়ান হানিয়ার ডান হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যেতে থাকে ভেতরে। হানিয়া বুঝতে পারছে না জাভিয়ান এমন ব্যবহার করছে কেন তার সাথে? এমন ব্যবহার সে বিয়ের পরের দুমাস পেয়েছিলো জাভিয়ান থেকে,, তারপর আজ পাচ্ছে। কিন্তু কেন?

হানিয়ার মন বলছে আজ খারাপ কিছু হতে চলছে। বিচ্ছেদের সময় কি তবে এসে পরলো?

___________

আবরার একটু আগে বাসায় ফিরেছে। নিজের রুমে ঢোকার আগে এশার রুমে উঁকি দেয়। দেখতে পায় এশা জানালার পাশে আনমনে বসে আছে। আবরার গলা খাঁকারি দিয়ে তার ধ্যান নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে। কাজও হয়। এশা তার গলা খাঁকারি আওয়াজ শুনে তার দিকে ফিরে তাকায়। আবরারকে দেখতে পেয়ে জানালার পাশ থেকে সরে আবরারের সামনে আসে। আবরারকে জিজ্ঞেস করে–

–কিছু বলবেন?

–জ্বি। পরশু কোর্টে শুনানি আছে আমাদের ডিভোর্সের। আমাদের দু’জনকেই যেতে হবে। সকাল সকাল রেডি থাকবেন।

এশা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর সেই অবস্থাতেই মাথা নাড়িয়ে তার কথার সম্মতি দেয়। আবরার চলে যায় নিজের রুমে ফ্রেশ হতে।

______________________

হানিয়া বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখে এলাহি আয়োজন। ডুপ্লেক্স বাড়িটাকে এতো সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। সে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছে জাভিয়ানের হাত ধরে। হুট করে জাভিয়ান তার কোমড় ধরে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে। হানিয়া তার এমন কাজে অস্বস্তিতে পরে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে বেশ কিছু মানুষ। হানিয়া জাভিয়ানের হাত সরানোর চেষ্টা করে,,কিন্তু জাভিয়ান তো তাকে ছাড়েই না বরং আরো শক্ত করে চেপে ধরে তার কোমড়। হানিয়া এভাবে ধরা ব্যথা পায়। সে তার গলা চাপিয়ে জাভিয়ানকে বলে–

–ছাড়ুন। এতো মানুষের সামনে কি করছেন? আপনার লজ্জা শরম তো বেঁচে দিয়েছেন,,কিন্তু আমিতো দেই নি।

–চুপচাপ চলো আমার সাথে। একটা কথাও বলবে না।

জাভিয়ানের কণ্ঠটা ভীষণ রূঢ় শোনালো। এমন করছে কেন বেটা? হানিয়া এবার নিজের মনে প্রশ্ন না চেপে রেখে জিজ্ঞেসই করে ফেলে জাভিয়ানকে–

–এমন করছেন কেন আজ?

–কেমন করছি?

–এমন রূঢ়ভাবে কথা বলছেন কেন?

–যে যেটা ডিজার্ভ করে তার সাথে সেরকমই করা উচিত।

–আচ্ছা? তা কি এমন মহান কাজটা করলাম যার জন্য এমন ব্যবহার?

–বেশি মুখ চালাচ্ছো। ওদের সামনে একদম চুপ থাকবে। তোমার মুখ চললেই আমার হাত চলবে কিন্তু।

হানিয়া জাভিয়ানের এমন কথা শুনে কথা বলা ভুলে যায়। আজ পর্যন্ত জাভিয়ান তার সাথে যাই করেছে তা ছিলো বাড়িতে তাদের রুমে। কিন্তু আজ এতো মানুষের সামনেই তার গায়ে হাত তোলার কথা বলছে। হায়রে ভালোবাসার পুরুষ!!

তারা দু’জন ততক্ষণে সেই লোকদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। জাভিয়ান সকলের সাথে হানিয়ার পরিচয় করিয়ে দেয়।কিন্তু তার বউ না গার্লফ্রেন্ড হিসেবে। হানিয়া হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে যায়। গার্লফ্রেন্ড? সে হানিয়াকে নিজের বউ হিসেবে পরিচয় না দিয়ে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো। হানিয়া কি এতোই অযোগ্য যে সকলের সামনে নিজের বউ হিসেবেও পরিচয় করে দিতে জাভিয়ান লজ্জা পাচ্ছে?? আজকে তার এই কাজ টায় হানিয়া সেই সোহাকে রুম থেকে বের করে দেওয়ার জন্য মেরে ছিলো ওই দিনের মতো কষ্ট পায়। কষ্টে সে চোখের পানিও ফেলতে ভুলে যায়।

হানিয়া জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে সুন্দর তাদের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। অথচ তার জন্য যে একজনের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে সে বেখবর। তারা একটা টেবিলে বসে ছিলো,,হুট করে হানিয়া নিজের পায়ে অন্য কারো পায়ের স্পর্শ পায়। মুহুর্তেই গা ঘিনঘিন করে উঠে তার। হানিয়া চোখ তুলে সামনে তাকালে দেখতে পায় মাঝবয়সী একজন টাকলু আঙ্কেল তার দিকে তাকিয়ে বিটকেলের মতো হাসছে। হানিয়া বুঝতে পারে এই টাকলুই তার পায়ে নিজের পা বুলাচ্ছে। হানিয়া দাঁতে দাঁত চেপে আশেপাশে একবার দেখে নেয়। তারপর নিজের জুতোর সামনের চোখা অংশ দিক দিয়ে নিজের সব শক্তি দিয়ে লাথি মারে। টাকলু আঙ্কেলটা ব্যথায় ককিয়ে উঠে। হানিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে তারপর মাথা তুলে ইনোসেন্ট মুখ করে বসে থাকে। উপস্থিত বাকি সকলে টাকলুর জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়।

টাকলু আঙ্কেল নিজেকে সামলে বলে–

–আমি ঠিক আছি। আপনারা ব্যস্ত হবেন না।

সকলে আবার কথা বলতে শুরু করে। হানিয়ার সেখানে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই সে জাভিয়ানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে–

–আমার ভালো লাগছে না। আমি একটু গার্ডেনের দিকে যাই?

জাভিয়ান চোখ ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকায়,,তারপর ঘাড় নাড়িয়ে তাকে যাওয়ার পারমিশন দেয়। হানিয়া সম্মতি পেয়ে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করে না। সেখান থেকে উঠে বাড়ির বাহিরে গার্ডেনে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ হাটাহাটি করার পর তার নজর যায় গার্ডেনে রাখা একটা দোলনার দিকে। সে দোলনায় গিয়ে বসে পরে। দোলনার দড়িতে মাথা রেখে একটু আগের কথা ভাবতে থাকে। নিজের অজান্তেই চোখ ফেটে পানি বের হয়ে যায়। আজ সে অনেক কষ্ট পেয়েছে।

হানিয়া বসে বসে নিজের দুঃখবিলাস করছিলো তখনই একটা শক্তপোক্ত হাত তাকে হ্যাচকা টান দিয়ে বসা থেকে দাড় করায় তারপর টেনে নিয়ে যেতে থাকে বাসাটার পেছনের দিকে। হানিয়া হুট করে এমনটা হওয়ায় ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে ব্যক্তিটির থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ব্যক্তিটি এত শক্ত করে হাতটা চেপে ধরেছে যে কব্জি ব্যথা করে উঠেছে এতটুকু সময়েই। হানিয়া লোকটার হাতে মারতে মারতে চিৎকার করে বলতে থাকে–

–কে আপনি? ছাড়ুন আমাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?

লোকটা সামনের দিকে ফিরে থাকায় হানিয়া লোকটির মুখ দেখতে পায় না। লোকটি হানিয়াকে ছাড়ে না। হানিয়া আরো চিৎকার চেচামেচি করছে দেখে হাতিয়ার পেছনে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে তাকে নিয়ে যায় একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে। লোকটির ছোঁয়ায় হানিয়া বুঝতে পেরেছে এটা জাভিয়ান না। তাহলে কে? আর কোথাই বা হানিয়াকে নিয়ে আসলো? ভয়ে হানিয়ার হাত-পা কাঁপা শুরু করে দিয়েছে। লোকটি হানিয়াকে রুমে এনে ধাক্কা মেরে নরম কিছুর উপর ফেলে। হানিয়া উপুড় হয়ে পরে যায়। পরে যাওয়ার সাথে সাথেই হানিয়া নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায় তারপর দরজার দিকে ছুট লাগালে লোকটি আবারও হানিয়ার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তারপর অন্য হাত দিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটায় সামান্য আলো যাও আসছিলো ওই দরজা দিয়ে কিন্তু দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ায় এবার পুরো রুমটা অন্ধকার হয়ে যায়। রুমটা অন্ধকার হয়ে গেলে লোকটা তার বিশ্রি হাতের স্পর্শ দিতে থাকে হানিয়ার শরীরে। হানিয়া ছটফট করতে থাকে সেই হাতের স্পর্শ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। লোকটাকে সমান তালে ধাক্কাচ্ছে কিন্তু ছাড়াতে পারছে না নিজেকে। হানিয়া আশেপাশে হাতড়ালে শক্ত একটা বস্তু খুঁজে পায়। হানিয়া আর বেশি কিছু না ভেবেই সেই বস্তুটা তুলে নিয়ে লোকটার মাথায় বারি মারে। আকস্মিক আঘাতে লোকটা দূরে ছিটকে যায়। হানিয়াও তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দ্রুত সরে যায় সেখান থেকে। তারপর ঘরের দেওয়াল হাতড়াতে থাকে লাইটের সুইচের খোঁজ পেতে। পেয়েও যায়। দ্রুত সুইচগুলো টিপে লাইট অন করে। অন্ধকার রুমটা নিমিষেই আলোকিত হয়ে যায়। অন্ধকারে থাকা সেই লোকটার মুখশ্রীও হানিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়। লোকটিকে দেখে হানিয়ার চোখগুলো রসগোল্লার মতো বড়বড় হয়ে যায়। হতভম্ব হয়ে মুখ থেকে একটা কথাই বের হয় তার–

–আপনি?

_______________________

হানিয়া ফ্লোরে বসে বেডে মাথা দিয়ে রেখেছে। মাথাটা অন্যদিনের চেয়ে তুলনামূলক বেশি ব্যথা করায় বসা থেকে উঠে বসারও শক্তি পাচ্ছে না। গোটা রাত সে এভাবে ঠান্ডা ফ্লোরেই বসে ছিল,,তাই হাত-পা তার ঠান্ডা হয়ে আছে অনেকটা। তারউপর কাল দুপুরের পর থেকে না খাওয়া। শরীরে বিন্দু পরিমাণে শক্তি নেই। একটু পরেই কুলসুম হন্তদন্ত হয়ে তার রুমে আসে। চোখ দিয়ে পানি পরছে তার। কুলসুম রুমে এসেছিলো একটা কথা বলতে কিন্তু সাজানো গোছানো রুমটার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে নিজের বলতে চাওয়া কথাটাই বলতে ভুলে যায়। সে অবাক হয়ে হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে–

–রুমের এই অবস্থা কেন ভাবী?

হানিয়া কোন উত্তর দেয় না। চোখ তুলে তাকায়ও না কুলসুমের দিকে। কুলসুম হানিয়ার থেকে উত্তর না পেয়ে তার সামনে এসে বসে পরে। তাকে আলতো ঝাঁকি দিয়ে বলে–

–ভাবী?

হানিয়া আগের অবস্থায় থেকেই বলে–

–কি বলতে এসেছিস সেটা বলে রুম থেকে বের হ।

হানিয়ার এমন কথায় কুলসুম হতভম্ব হয়ে যায়। এই ছ’মাস হানিয়া কোনদিন তাকে “তুমি” ব্যতীত অন্য কিছুতে সম্বোধন করেনি। কিন্তু আজ সে তাকে “তুই” করে সম্বোধন করছে আবার রুম থেকেও এমন ভাবে বের হতে বলছে। কি হয়েছে ভাবীর?

–ভাবী,,কি হয়েছে আপনার?

–কিছু না। কি বলবি বল।

–ভাবী,,একজন ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিলো। ভাইজান গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে।

কথাটা বলে কুলসুম হুহু করে কেঁদে দেয়। হানিয়া তখনও নিরুত্তর,, নির্বিকারভাবে বসে থাকে।

শব্দসংখ্যা~২০৫০

~চলবে?