প্রতিশোধের অঙ্গীকার পর্ব-৪২

0
278

#প্রতিশোধের-অঙ্গীকার
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_বিয়াল্লিশ

হানিয়া-কুলসুম মাত্রই হসপিটালে এসেছে। ড্রাইভার তাদের নিয়ে আসে। রিসেপশনিস্টের কাছে জাভিয়ানের কথা জিজ্ঞেস করতেই রিসেপশনিস্ট তাদের জানায় কোথায় যেতে হবে। রিসেপশনিস্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা ওটির সামনে পৌছায়। সেখানে গিয়ে মি.তালুকদার,,মিসেস তালুকদার আর রোজি বেগমকে দেখতে পায়। কুলসুম এসেই রোজি বেগমের পাশে বসে পরে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তিনজনই সেদিকে তাকায়। রোজি বেগম বসা থেকে উঠে হানিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

মি.তালুকদারের চোখেও পানি। মিসেস তালুকদার হানিয়াকে দেখে মনে হয় রাগে ফেটে পরে। সে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হানিয়ার কাছে গিয়ে তাকে রোজি থেকে টেনে একটু দূরে সরিয়ে আনে,, তারপর হুট করেই তাঁকে দু’টো থাপ্পড় মারে। থাপ্পড় খেয়ে হানিয়া ছিটকে নিচে পরলে পাশে রাখা সিটগুলোর হ্যান্ডেলে গিয়ে তার মাথা লাগে। তার এমন কাজে বাকি সকলে অবাক হয়ে গেলেও হানিয়া তখনও চুপ। তার নিস্তব্ধতা যেন সকলের কাছে এক অজানা রহস্যের মতো মনে হচ্ছে। আজ এতো নির্বিকার কেন মেয়েটা?

মি.তালুকদার তাকে হানিয়ার থেকে টেনে দূরে সরিয়ে আনে। রোজি বেগম আর কুলসুম হানিয়ার কাছে গিয়ে তাকে নিচ থেকে উঠিয়ে সিটে বসিয়ে দেয়। রোজি বেগম হানিয়া থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উপরে করলে দেখতে পায় হানিয়ার কপালের বাম পাশের এক কোণায় একটু চোট পেয়েছে। রক্তও বের হচ্ছে হালকা। রোজি বেগম আঁতকে উঠে তার রক্ত দেখে। কয়েকমাস পূর্বেই মেয়েটার ভয়ংকর এক্সিডেন্টের কথা এখনো ভুলেনি তারা কেউই। মিসেস তালুকদার তখনও চিল্লিয়ে হানিয়াকে দোষারোপ করেই যাচ্ছে। তার ভাষ্যমতে হানিয়ার জন্য নাকি জাভিয়ানের এমন এক্সিডেন্ট হয়েছে। কিন্তু হানিয়া এর কিছুই জানে না।

মি.তালুকদার তাঁকে কড়া গলায় ধমক দিলে তারপর সে চুপ হয় কিন্তু রাগ কমে না এক বিন্দুও। মি.তালুকদার মিসেস তালুকদারকে চুপ করিয়ে হানিয়ার কাছে যায়। হানিয়ার মাথার চোট দেখে সেও বিচলিত হয়ে পরেছে। তাড়াতাড়ি একজন নার্সকে ডেকে এনে হানিয়ার চোটের প্রাথমিক চিকিৎসা করায়। তাঁদের এইসব কাজের মধ্যেই জাভিয়ানের অপারেশন শেষ হয়ে যায়। ডাক্তার ওটি থেকে বের হয়ে আসলে,,সকলে ডাক্তারের কাছে জাভিয়ানের হেল্থ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এগিয়ে যায়। কিন্তু হানিয়া তার জায়গা থেকে নড়ে না। না কোন আগ্রহ প্রকাশ করে জাভিয়ান সম্পর্কে।

ডাক্তার জানায়,, জাভিয়ানের কোমরে ভালো চোট পেয়েছে। জাভিয়ানের ভবিষ্যতে হাঁটাচলা করতে পারবে কিনা তা এখনি বলা সম্ভব হচ্ছে না। ডান হাতটা ভেঙেছে। এত সব দুঃসংবাদের মধ্যে একটা ভালো সংবাদ হলো,,জাভিয়ান মাথায় তেমন চোট পায় নি এবং আপাতত তার অবস্থা আশংকা মুক্ত। ডাক্তার কথাগুলো শেষ করে চলে যায়। হানিয়ার পরিবারকে জাভিয়ানের কথা জানানো হয়েছিলো, কিন্তু তারা একটা কাজের জন্য কয়েকদিন আগে গ্রামে যাওয়ায় আসতে পারে না তাদের বড়কন্যার স্বামীকে দেখতে। কিন্তু বলেছে আজকেই রওনা দিবে,,কাল সকালের মধ্যে পৌঁছে যাবে তারা ঢাকায়।

______________________

দীর্ঘ বারো ঘন্টা পর জাভিয়ানের জ্ঞান ফিরে। সকলে একএক করে তার সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু যায় না একমাত্র হানিয়া। অনুভূতি শূন্য হানিয়া তার কাছে যাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পায় না। সবার শেষে মি.তালুকদার ছেলেকে দেখে বের হন কেবিন থেকে। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে এসে উপস্থিত হন কন্যাতুল্য পুত্র বধুর কাছে। সে ভাবছে তারা থাকায় পুত্রবধু হয়ত তার স্বামীর কাছে যেতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই সে হানিয়ার কাছে বসে তাকে বলে–

-যাও মা,,জাভিয়ানকে কাছে যাও। সে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর মা তুমি ভেঙে পরো না ওর সামনে,,জাভিয়ান আবারো হাঁটাচলা করতে পারবে ইনশা আল্লাহ। আমরা এখন বাসায় যাচ্ছি। কাল সকালে আমরা আবার আসবো,, তখন তুমি বাসায় চলে যেও।

হানিয়া মাথা নাড়িয়ে শ্বশুরের কথায় সম্মতি দেয়। মি.তালুকদার,, মিসেস তালুকদার,,রোজি বেগম আর কুলসুম চলে যায় বাসায়। মি.তালুকদার যাওয়ার আগে হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে হানিয়ার জন্য খাবার কিনে দিয়ে যান। সবাই আজ সারাদিন হসপিটালে থাকায় রান্নাবান্না কিছুই হয়নি।

_______________________

বাড়ির সকলে চলে যাওয়ারও অনেকক্ষণ পর হানিয়া জাভিয়ানের কেবিনে প্রবেশ করে। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেই দেখতে পায় রুগ্ন, ভাঙা হাত-পা নিয়ে শুয়ে থাকা জাভিয়ান দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার সত্যি সত্যিই তার জন্য অপেক্ষা করছে। হানিয়া দেরি করে কেবিনে আসে, এই কারণে যে, তার এখন জাভিয়ানের সাথে একটা বাক্যও ব্যয় করতে মন চাচ্ছে না। কিন্তু হানিয়াকে আরো একবার হতাশ করে দিয়ে জাভিয়ান না ঘুমিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

হানিয়া একবার ভাবে জাভিয়ানের সাথে আপাতত পুরোনো বিষয়ে কোন কথা বলবে না। কিন্তু তাকে কিছু কথা না বলে সে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। এইসব ভেবেই সে জাভিয়ানের কাছে গিয়ে তার বেডের পাশের টুলে বসে পরে। জাভিয়ান অসুস্থ চোখে হানিয়াকে দেখছে। হানিয়া টুলে বসে জাভিয়ানের চুলগুলো আলতো হাতের স্পর্শ দিতে দিতে বলে–

–শাস্তি ভোগ না করেই পালাতে চাচ্ছিলেন মি. তালুকদার? আমি যে আপনাকে কাপুরুষ বলেছিলাম দেখলেন কথাটা কিন্তু সত্য।

টানা ১৬ঘন্টা বা তারও বেশি সময় পর হানিয়া কথা বলছে। জাভিয়ান চুপ করে তার কথা শুনছে। কিছুই বলার নেই আজ তার। হানিয়া আবারও বলে–

–আপনার জন্য বিশাল এক সারপ্রাইজ আছে। উমমম একটা না বেশ কয়েকটাই। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। একবার ঘৃণা করি শুনেই আজ হসপিটাল পর্যন্ত পৌছে গেলেন,, যখন প্রতিনিয়ত আমার চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখবেন,,আমার কাজগুলো দ্বারা আমি আপনাকে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিবো যে,,আমি হানিয়া মির্জা সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যাকে ঘৃণা করি সে হচ্ছে জাভিয়ান তালুকদার তখন আপনার অবস্থা হবে মি. তালুকদার? (হাসতে হাসতে কথাটা বলে হানিয়া)

হানিয়া চোখে পানি চলে এসেছে। জাভিয়ান তা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করে। তার চোখেও অশ্রুরা ভীর করছে। হানিয়া আবারও বলে–

–আপনাকে ঘৃণা করতেও আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। দেখবেন আপনার জানায়,,দেখায়,,শোনায় ঠিক কতটা ভুল আছে। কার শাস্তি কাকে দিয়েছেন। তারপর নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করার জন্য প্রস্তত হন। আমি হানিয়া মির্জা কারো ধার রাখি না। আপনি আমাকে ঠিক যতটা কষ্ট,, অসম্মান,,অত্যাচার করেছেন তা সুন্দর ভাবে পাই টু পাই আপনাকে ফিরিয়ে দিবো। ইনশা আল্লাহ।

কথাগুলো বলতে বলতে হানিয়ার চোখ দিয়ে পানি পরতে থাকে কিন্তু কন্ঠ তার ইস্পাত কঠিন। জাভিয়ানের চোখের কোণ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পরে। হানিয়া আর কোন কথা বলে না জাভিয়ানের সাথে। জাভিয়ানের পাশ থেকে উঠে কেবিনে রাখা সোফায় গিয়ে বসে পরে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে জীবনের সবচেয়ে ঘটে যাওয়া নিকৃষ্ট সেই ঘটনাগুলোর কথা,,যা সংঘটিত হয়েছে আজ থেকে ঠিক ২৪ঘন্টা আগে।

__________________

২৪ ঘন্টা আগে~~

রুমে লাইট জ্বলে উঠলে হানিয়া ব্যক্তিটিকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। রাহাত!! এখানে? রাহাত নিজের মাথা ডানে বায়ে ঝাঁকি দিয়ে পুনরায় হানিয়ার কাছে আসতে থাকে। ঠোঁটের কোণে বিশ্রী হাসি,যা দিয়ে সহজেই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে। হানিয়া রাহাতকে এগোতে দেখে পিছাতে থাকে। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে।

হানিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় রাহাতকে জিজ্ঞেস করে–

–আপনি এখানে কেন রাহাত?

রাহাত নিজের হাসি বজায় রেখে বলে–

–আমার বাসায় আমিই তো থাকবো সুইটি।

–আপনার বাসা?

–হুম আমার বাসা।

–ভালো কথা আপনার বাসায় আপনি থাকেন। কিন্তু আপনার বাসায় আসা ফিমেল গেস্টের সাথে এমন অসভ্যতামি করার কারণ কি?

–গেস্টটা যদি এমন হট হয় তাহলে তো…… ।

কথাটা বলো রাহাত জোরে জোরে হাসতে থাকে। সেই হাসি শুনে হানিয়ার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। হানিয়া কোন মনে নিজেকে সামলে গলায় তেজ নিয়ে বলে–

–ভালোয় ভালোয় বলছি আমায় যেতে দিন। নাহলে জাভিয়ান জানতে পারলে কিন্তু আপনার খবর করে ছাড়বে।

–তোমার জন্য আমি দুনিয়াও ছাড়তে পারি হ*টি কিন্তু তার আগে একবার বেড শেয়ার করতে চাই তোমার সাথে।

রাহাতের কথা শুনে হানিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠে। নিজেরে ভেতরের সব ডরভয় ভুলে গিয়ে রাহাতের সামনে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারে। হুট করে গালে থাপ্পড় পরায় রাহাত নিজেকে সামলাতে না পেরে নিচেই পরে যায়। বিষয়টা বুঝতে তার একটু সময় লাগে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে হানিয়া তাকে থাপ্পড় মেরেছে তখন তার ভেতরের দানবটা বের হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়িয়ে হানিয়ার গলা চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে ফেলে। রাহাত একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে হানিয়ার গলা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে,,ফলস্বরূপ হানিয়ার শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়ে পরেছে। হানিয়া তার একহাত দিয়ে রাহাতের মুখ চোখ খামচে দিতে থাকে যাতে রাহাত তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু রাহাত রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। হানিয়া আতংকে এটা ভুলে গিয়েছিলো যে তার বাম হাতে এখনো স্টিলের একটা কিছু আছে। হানিয়া কিভাবে নিজেকে ছাড়াবে ভাবতে ভাবতেই চোখ যায় নিজের হাতের দিকে। একটা ফ্লাওয়ার ভাস স্টিলের তৈরি। নিজের জীবন বাচানো ফরজ কথাটা ভেবেই আর কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই স্টিলের ভাস’টা দিয়ো আবারো মাথায় বারি মারে হানিয়া। একি জায়গায় পরপর দু’বার আঘাত পাওয়ায় জায়গাটা কেটে সেখান থেকে অল্পস্বল্প রক্ত পরতে শুরু হয়। ব্যথায় রাহাত হানিয়ার গলা ছেড়ে নিজের কপাল চেপে ধরে।

হানিয়া রাহাতের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের গলায় হাত বুলিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। শ্বাস-প্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হলে হানিয়া রাহাতকে স্বজোরে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে যাওয়ার জন্য দৌড় লাগায়। বিধস্ত হানিয়া বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে উদভ্রান্তের মতো এদিকসেদিক তাকিয়ে জাভিয়ানের খোঁজ করে। একটু দূরেই কিছুক্ষণ আগের লোকগুলোর সাথে ড্রিংকস নিতে নিতে কথা বলা অবস্থায় দেখতে পায় তাকে। ছুটে গিয়ে পেছন থেকে দু-হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জাভিয়ানকে সে। হুট করে কেউ একজন জড়িয়ে ধরায় জাভিয়ান একটু থতমত খেয়ে যায়। ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো হানিয়াকে দেখলে জাভিয়ান এবার আরো বেশি থতমত খায়। যে মেয়ে কিছুক্ষণ আগে একটু ক্লোজ হয়ে বসায় তাকে নির্লজ্জ উপাধি দিলো সেই মেয়ে নাকি এখন নিজ থেকে তাকে এসে জড়িয়ে ধরেছে।

জাভিয়ান তার পুরো শরীর হানিয়ার দিকে ফিরিয়ে হাত বাড়িয়ে নিজেও জড়িয়ে ধরে হানিয়াকে। হানিয়ার মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–

–কি হয়েছে?

হানিয়া কোন উত্তর দেয় না। শুধু জাভিয়ানকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে থাকে। জাভিয়ান শান্তভাবে বেশ কয়েকবার হানিয়াকে জিজ্ঞেস করে তার কি হয়েছে? কিন্তু হানিয়া তার ভয় কাটিয়ে কোন জবাবই দিতে পারে না। একপর্যায়ে জাভিয়ান তাঁকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে তার দু’হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে ধমকে বলে–

–কি হয়েছে জিজ্ঞেস করছি না? কাহিনী বাদ দিয়ে বলবে? সবাই তোমার নাটক দেখছে সেদিকে তোমার খেয়াল আছে?

হানিয়া এতক্ষণ আশেপাশের লোকদের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। জাভিয়ানের কথায় তার মনে পরে পার্টির কথা। সে একবার আশেপাশে চোখ বুলায়। হ্যাঁ,,সকলে তাদের দু’জনের দিকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হানিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে জাভিয়ানকে বলে–

–রাহাত ভাইয়া আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে? আমাকে… আমাকে একটা অন্ধকার রুমে টেনে নিয়ে গিয়ে কুপ্রস্তাব দিয়েছে।

কথাটা বলতে বলতে হানিয়া তার এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্নাটা উগড়ে দেয়। জাভিয়ান হতভম্ব হয়ে যায় তার কথা শুনে। হানিয়া যখন জাভিয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো তখনই পাশ থেকে শুনতে পায়,,একজন বলছে–

–মিথ্যা বলছেন কেন ভাবি? আমি আপনাকে কখন এসব করলাম?

কথাটা শুনে হানিয়া জাভিয়ানের বুক থেকে মুখ তুলে কথা বলা ব্যক্তিটির দিকে তাকায়। দেখতে পায় তাদের থেকে দুয়েক হাত দূরেই দাঁড়ানো রাহাত। কিন্তু সে একদম অক্ষত। কিভাবে? হানিয়া তাকে অক্ষত দেখে এবার নিজেই কনফিউজড হয়ে যায়। হানিয়ার পূর্বের বক্তব্য শুনে পার্টির আমেজ শেষ হয়ে সেখানে রূপ নেয় ফিসফিসানি আর চাপা গুঞ্জনের। কয়েকজন রাহাতকে ভালোমন্দ শোনাতে থাকে তো কয়েকজন হানিয়াকে দোষারোপ করতে থাকে। রাহাতের বাবা-মাও ততক্ষণে সেই জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে। ছেলের উপর এমন অপবাদ কোন বাবা-মা’ই সহ্য করতে পারবে না। হাসিখুশি জায়গাটা নিমেষেই বিষাদেরূপ নেয়।

অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে জাভিয়ান হানিয়াকে শক্ত গলায় বলে–

–তোমার সাথে কি হয়েছে তার এ টু জেড সব বলো আমাকে।

হানিয়া জাভিয়ানের বাহুডোরে থেকেই তার সাথে হওয়া ঘটনার সবটা বলে। রাহাত তার হানিয়ার কথার প্রতিবাদ করলে হানিয়াও জোর গলায় জানায় ব্যক্তিটি রাহাতই ছিলো। তখন জাভিয়ান তাঁকে বলে–

–কিন্তু রাহাত তো গত এক ঘন্টা ধরে আমাদের সাথে ছিলো। সে তোমার সাথে এসব করবে কীভাবে তাহলে?

জাভিয়ানের এই একটা কথায় হানিয়া একদম চুপ হয়ে যায়। জাভিয়ানের কথা শুনে বুঝাই যাচ্ছে সে হানিয়ার কথা বিশ্বাস করছে না। হানিয়া তাও নিজের কথা প্রমাণ করার জন্য বলে–

–আচ্ছা আমি আপনাকে সেই রুমটাতে নিয়ে যাচ্ছি যেটায় আমার সাথে জোরজবরদস্তি করা হয়েছিলো।

কথাটা বলে হানিয়া জাভিয়ানের হাত টেনে নিয়ে যায় সেই রুমটায়। সেখানে গিয়ে হানিয়া আরো অবাক। রুমটা তালা দেওয়া বাহির থেকে। জাভিয়ান তাও রাহাতকে বলিয়ে রুমটা খুলায়। রুমে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পায় রুমটা বেশ গোছানো। রাহাত তাদের জানায় এটা একটা আউট হাউজ। যখন দেশের বাড়ি থেকে তাদের সব আত্মীয় স্বজন কোন ভ্যাকেশন বা অনুষ্ঠানে তাদের বাড়িতে আসে তখন তার সব কাজিন ব্রাদার্সরা এখানে এসে থাকে। রুমটা বেশ বড়সড়। একটা বড় খাট আর বড় একটা বিভানসহ আরো অনেক কিছুই রাখা আছে রুমটায়।

হানিয়া জাভিয়ানকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে ভেজা গলায় বলে–

–জাভিয়ান শুনেন আপনি আমার কথা। আমি মিথ্যা বলছি না। আপনি আমার গলা…..

জাভিয়ান হানিয়ার আর কোন কথা শুনতে নারাজ। সে সকলের সামনেই হানিয়াকে ধমক দেয়। তারপর রাগে হিসহিসিয়ে বলে–

–আর একটা কথাও তুমি আমাকে বলবে না। কিছুই তো প্রমাণ করতে পারলে না। রাহাতকে নাকি আঘাত করেছ তাহলে তার চোটের দাগ কই?

হানিয়া ভেঙে ভেঙে বলে–

–আমিও সেটাই বুঝতে পারছি না।

–তোমার আর কিছি বুঝতে হবে না বা বুঝানো লাগবে না। তুমি এখনি রাহাতকে সরি বলবে তোমার বিহেভিয়ারের জন্য।

হানিয়া এতক্ষণ কাঁদলেও এবার সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে–

–আশা করছেন কিভাবে সরি? আমারে কি পাগল মনে হয়? আমি নিজের চরিত্রে কালি লাগানোর জন্য এসব বলছি এটা মনে হয় আপনার?

–পাগল মনে হবে না তো কি মনে হবে? যা বললে তার একটাও তো প্রমাণ করতে পারলে না।

–আমার মুখের কথা আপনার বিশ্বাস হয় না?

–না হয় না। আমি প্রমাণে বিশ্বাসী। আমাকে তুমি তোমার কথার প্রমাণ দাও আমি এই মুহূর্তে রাহাতকে মাটির সাথে পিষে ফেলবো।

হানিয়া এবার চিল্লিয়ে বলে–

–নেই তো প্রমাণ। মিটিয়ে দিয়েছে সব প্রমাণ। কিভাবে প্রমাণ করবো নিজের কথাগুলো আমি?

–প্রমাণ না করতে পারলে ক্ষমা চাও ওর কাছে। ওকে অপমান করার জন্য আর ওর পার্টি নষ্ট করার জন্য। এই মুহূর্তেই চাইবে তুমি ক্ষমা। ইটস মাই অর্ডার।

–পারলাম না আপনার এই আদেশ মানতে। চাইবো না কোন ক্ষমা। আপনি আমাকে আজও চিনলেন না,, একটু বিশ্বাসও করলেন না।

হানিয়ার অবাধ্যতা জাভিয়ানকে আরো রাগিয়ে দেয়। সে নিজের রাগকে কনট্রোল করতে না পেরে হানিয়ার গায়ে হাত তুলতে যায় কিন্তু হাতটা ধরে ফেলে হানিয়া। চোখে মুখে তার বিধ্বংসী কারী ক্রোধ। কণ্ঠে আগের থেকেও প্রখর তেজ,,রাগ নিয়ে বলে–

–আজ আমার কথা বিশ্বাস করলেন না তো,,একদিন এটার জন্য আফসোস করবেন আপনি। আমি একদিন না একদিন ঠিকই প্রমাণ করে দিবো আমি আজ মিথ্যা বলি নি। তারপর? তারপর নিজের এমন ব্যবহারের জন্য কি বলবেন আপনি আমাকে? আজ এতগুলো মানুষের সামনে আপনি আমায় উনার(রাহাতকে দেখিয়ে বলে) চেয়েও বেশি অপমান করলেন। নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে এতগুলো মানুষের সামনে মারার জন্য হাত তুললেন,,আমায় অবিশ্বাস করলেন। আমি একদিন এসব কিছুর জবাব অবশ্যই দিবো। আর সেই দিন হবে আপনার জীবনে আমার শেষ দিন। কথাটা মাথায় রেখেন মি.তালুকদার।

কথাটা বলে হানিয়া জাভিয়ানের হাতটা ঝাড়ি মেরে ছেড়ে দেয়। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে পুনরায় জাভিয়ানের সামনে এসে দাড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলে–

–হ্যাপি সিক্স মান্থ এ্যানিভার্সিরি মি.তালুকদার। আজকে আপনাকে নিজের মনে কথাটা জানাতে চেয়েছিলাম। জানিয়েই দিয়ে যাই এই এতগুলো মানুষের সামনে। (একটু থেমে শ্বাস নেয়,, তারপর একদম শীতল কন্ঠে বলে) আই জাস্ট হেইট ইউ মি.হাসবেন্ড।

হানিয়ার এতো এতো কথার মধ্যে এই শেষের কথাটা জাভিয়ানের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। হানিয়া কথাটা শেষ করে আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাড়িয়ে দৌড়ে সেই রুম থেকে বের হয়ে আসে। এবং সবশেষে সেই অভিশপ্ত বাড়ি থেকেই এতো রাতে একা একাই চলে আসে।

___________________

বর্তমান~~

চোখ বন্ধ করে এতক্ষণ হানিয়া তার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সময় গুলোর কথা ভাবছিলো। নিজের অজান্তেই তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। সে মনে প্রাণে চাইছে, ওই ঘৃণিত মানুষটির জন্য তার মূল্যবান অশ্রু বিসর্জন না দিতে কিন্তু কনট্রোল করতে পারছে না নিজেকে। কাল সেখান থেকে বের হয়ে হেঁটেই অনেকখানি রাস্তা পারি দিয়েছিলো সে। চোখের পানি বির্সজন দিতে দিতে কখন যে অজানা এক রাস্তায় চলে এসেছিলো সে নিজেও জানে না। তারপর সেখান থেকে অনেক কষ্টে একটা রিকশা জোগাড় করে তারপর বাসায় ফিরেছে সে। রিকশাওয়ালার ভাড়া টাও দারোয়ানের কাছ থেকে নিয়ে তারপর পরিশোধ করেছে।

রোজি বেগম,, মি. এন্ড মিসেস তালুকদার বাসায় ছিলেন না। তারা এক কাছের আত্মীয়র বাসায় দাওয়াতে গিয়েছিলেন,,রাতে ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন। হানিয়া বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কাঁদে। তারপর আকস্মিক রেগে উঠে নিজের হাতে যত্ন করে সাজানো রুমটা নিজেই ধ্বংস করে।

___________

জাভিয়ান তার বেডে শুয়ে তাকিয়ে আছে একটি দূরে বসে থাকা অপ্রিয় থেকেও প্রিয় রমণীটির দিকে।তারও মনে পরে যায় কিছু বিষাক্ত স্মৃতি।
______________

গতকাল রাতে~~

জাভিয়ান হানিয়ার কথা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। রাহাত এসে তার ঘাড়ে হাত রাখলে তার ধ্যান থেকে বের হয়। জাভিয়ান হানিয়ার ব্যবহার ও কাজের জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চায়। বিশেষ করে রাহাত ও তার পরিবারের কাছে। তারপর সেও বের হয়ে আসে রাহাতের বাড়ি থেকে। এতক্ষণ তার খারাপ লাগলেও এখন প্রচন্ড রাগ লাগছে। খারাপ লাগাটা যে শেষ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। সে কিছুতেই হানিয়ার ঘৃণা করার কথাটা মানতে পারছে না। সে তার গাড়ি নিয়ে শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা নদীর কাছে চলে আসে। ঘন্টা দুয়েক থাকার পর তার হুট করে মনে পরে”হানিয়া এতো রাতে একা একাই বের হয়ে এসেছিলো সেই বাড়ি থেকে,,গাড়িটা তো সে নিয়ে এসেছে তাহলে হানিয়া বাসায় যাবে কিভাবে? এখনিই বা কোথায় সে?” কথাগুলো মনে পরতেই তার শরীর একদম ঘেমে চুপচুপে হয়ে যায়। সে তার পকেট থেকে ফোন বের করে হানিয়ার নাম্বারে ক্রমাগত ফোন দিতেই থাকে কিন্তু ফোনটা একবারও রিসিভ হয় না। বরং বন্ধ বলছে তার নাম্বার।

এবার জাভিয়ান আর বসে থাকতে পারে না। সে বসা থেকে উঠে দৌড়ে গাড়িতে এসে বসে পরে,,তারপর গাড়ি চালাতে শুরু করে। একহাত দিয়ে ড্রাইভ করছে আর অন্য হাত দিয়ে হানিয়াকে ফোন দিচ্ছে। তার গাড়িটা যখন হাইওয়েতে উঠেছে তখনই বিপরীত দিক দিয়ে আসা একটা ট্রাকের সাথে তার গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়। সিট বেল্ট লাগানো থাকায় মাথায় তেমন ক্ষতি না হলেও ট্রাকের সাথে সংঘর্ষের কারণে তার গাড়িটা কয়েকবার ডিগবাজি খেয়ে উল্টে একটা গাছের সাথে গিয়ে পুনরায় বারি খায়। এতে তার পিঠের মেরুদণ্ড ও কােমড়ে ভালোই চোট পায়। শুনশান হাইওয়েতে রাত দুইটা কি তিনটায় তাঁকে বাঁচানোর মতো কেউই ছিলো না। বাঁচার সব আশা ছেড়ে দিয়ে অসুস্থ চোখদুটো শেষ বারের মতো কাঙ্ক্ষিত রমণী টিকে দেখার জন্য বারবার আকুতি জানিয়েছে।কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয় নি। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে জাভিয়ান কয়েকটা বাক্য হানিয়ার জন্য উচ্চারণ করেছিলো–

–তোমাকে ভালোবেসে আগলে রাখতে না পারার আক্ষেপ আমায় ওই দুনিয়াতেও তাড়া করে বেড়াবে। তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার পরিবর্তে ঘৃণা করো শুনেই বিদায় নিতে হচ্ছে আমায়,, আমার অপ্রিয় চেয়েও প্রিয় রমণী।

কথাটা বলতে বলতে জাভিয়ানের চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসে। তারপরের ঘটনা জাভিয়ান জানে না। চোখ খুলে সে নিজেকে হসপিটালে পায়। কে বা কারা তাকে নিয়ে এসেছে সে কিছুই জানে না।

শব্দসংখ্যা ~২৭৪৪

~~চলবে?