প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-০৩

0
403

#প্রণয়ের_বাঁধন |৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

-” সী ইজ অ্যা প্রোস্টিটিউট। তৃষা একটা প্রোস্টিটিউট।”

তৃষার নাম শোনার সাথে সাথে বি/শ্রী গালিটা কন্ঠনালী অব্দি আসলেও দিব্য সেটা মুখ দিয়ে বের না করে গিলে নেয়। দিব্যর হাতের আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। বড় বড় শ্বাস ফেলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে মুখে সে বলল ,

-” তৃষার মতো মেয়েরা টাইমপাসের জন্য পারফেক্ট। শুধুই টাইমপাসের জন্য। তৃষা কখনোই লাইফ পার্টনার হওয়ার যোগ্য নয়। এরা বাড়তি খাওয়া রুচিসম্পন্ন। আজ একে ভালো লাগছে তো কাল এর থেকে বেটার কাউকে দেখলে সেখানে নিজেকে সঁপে দেবে। আর যাইহোক না কেন এসব মেয়েদের সাথে সংসার হয় না। এদের সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখাও মহা বড়সড় ভুল। নিজের হাতে নিজের ধ্বং/স ডেকে আনা। তাই জেনেশুনে সাফওয়ান দিব্য নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা/র/বে না।”

দিব্য ঘাস ছিঁড়ে হাতের উপর রেখে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। উপস্থিত কয়েকজোড়া চোখ বিস্ময় নিয়ে দিব্যর দিকে তাকিয়ে থাকে। লিমন পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে আ/গু/ন জ্বা/লা/তে নিবে তন্মধ্যেই দিব্য একটান দিয়ে সিগারেটটা নিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে চাপ দিয়ে ধরে। লিমনের হাত থেকে লাইটার নিয়ে আ/গু/ন জ্বালাতে থাকে দিব্য। লিমন কপাল কুঁচকে বলল,

-” দিব্য শা/লা তোর একটা জিনিসে আমার খুব হিং/সা হয়। যদি আল্লাহ সেটা আমাকে দিত। তাহলে মেয়েদেরকে পটাতে পারতাম ভালো। কপাল করে একটা ইন্নোসেন্ট ফেস পেয়েছিস। দারুণ মাইরি! তোর মতো এই ইন্নোসেন্ট ফেসটা সকল ছেলেদের দরকার ছিলো।”

দিব্য ছাড়া বাকীরা হো হো শব্দ করে হাসতে থাকে। লিমনের কথায় দিব্য আগ্রহ দেখায় না। সে আছে অন্য ধ্যানে। তার ভেতরটা তুষের আ/গু/নের মতো জ্ব/লছে। দিব্যর ভেতর যে আ/গু/ন জ্ব’ল’ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের সব পানি দিলেও যেন নিভবে না। দিব্যর চোখে মুখে স্পষ্ট ইভানের প্রতি রাগ-ক্ষোভ। দিব্য দাঁত কটমট করে। তার অবচেতন মন আওড়ায়,

-” ইভান যদি ইনটেনশনালি, প্ল্যান করে তনুজাকে বিয়ে করে থাকে, তবে ইভানকে এর চরম মাশুল গুনতে হবে।”

তনুজা…তনুজা নামটা মস্তিষ্কে স্মরণ হতেই একটা মায়াভরা মুখ, হরিণী শান্ত চোখ দিব্যর চোখ দুটোয় জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে। ভীতু, বোকা বোকা মেয়েটাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল দিব্য। সেই মেয়ে আজ অন্যকারো ঘরে, অন্যকারো বউ পরিচয়ে আছে। দিব্যর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চিনচিনে ব্যাথা হয় বুকের বা পাশে। দিব্য একহাত বুকের উপর রেখে অস্ফুটে আওড়ায়,

-” তনুজা আই রিয়েলি লাভ ইউ। আই রিয়েলি লাভ ইউ তনু। যে বা যারা এই নোংরা গেইম খেলেছে তাদের কাউকে আমি ছাড়ব না। ছাড়ব না।”

দিব্য দুই আঙ্গুলে সিগারেট ধরে সুখটান দেয়। আজ আর সিগারেটের নিকোটিন মস্তিষ্কে সুখানুভূতি দিচ্ছে না। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না দিব্যর। দিব্যর ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে। পর পর আকাশের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়ে দিব্য। তার কষ্টটাও যদি এভাবে ধোঁয়ার মতো বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া যেত। উফ্! তাহলে অন্তত একটু শান্তি মিলত।

__________

ইভান বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে ধপ করে বসে। তার চোখ দু’টো বারবার বুজে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে সে পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করছে। তার সামনের সবকিছু সে ডাবল ডাবল দেখছে। তনুজা পরনের কাপড় দুই হাতে শক্ত করে ধরে জড়সড় হয়ে আছে। তনুজার গলাটা শুষ্ক মরুভূমির মতোন হয়ে আসছে। তনুজা জিভ দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। লাইটের ফকফকা সাদা আলোয় তনুজার শ্যামবর্ণ মুখ, ফোলাফোলা চোখ মোহনীয় লাগছে। ইভান ঘনঘন বার কয়েক পলক ফেললো। তনুজার ফেসের মধ্যে সে তৃষাকে দেখতে পায়। তার চোখে তৃষার ফেস ভাসছে। ইভান দুই হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ ডলে ফের ভালো করে তাকায়। নে/শা অবস্থায় থাকায় তার মনে হচ্ছে এটা তৃষার ফেস। ইভানের মনেহয় আবার তৃষা তার স্বপ্নে এসেছে। ইভান হাত বাড়িয়ে তৃষার মুখটা ছুঁয়ে দেখতে চায়। ইভান তনুজার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে তনুজার মুখ স্পর্শ করতে নেয়। তনুজা এক ঝটকায় ইভানের হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চেঁচিয়ে উঠল,

-” খবরদার! খবরদার! একদম ছোঁবেন না আমাকে। একদম ছোঁবেন না। এবার আমি বুঝতে পারছি সবটা আপনি ইন্টেনশনালি করেছেন। ছিঃ ছিঃ একটা মানুষ এতটা খা/রাপ কী করে হতে পারে! একটা অসহায় মেয়েকে ফাঁসিয়ে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বিয়ে করতে পারে। এরকম একটা লোককে আমি ঘৃ/ণা করি। আমি ঘৃ/ণা করি। আপনি খা/রাপ। খুব খা/রাপ, পৃথিবীর সবচেয়ে খা/রাপ লোক আপনি।”

তনুজা কান্না ভেজা গলায় চেঁচিয়ে একনাগাড়ে বলতে থাকে। তনুজার চিৎকারে ইভানের মস্তিষ্ক একটু সচল হয়। চোখের পলক তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তনুজার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। পর পর তার স্মরণ হয় তনুজার কথা। আজকের ঘটনা তার নিউরনে সাড়া জাগায়। ইভান অ/গ্নি চক্ষু নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তনুজার দিকে এগোতে থাকে। তনুজা পিছাতে থাকে। পিছাতে পিছাতে এক আঙ্গুল উঁচিয়ে ঢোক গিলে নিয়ে তনুজা বলে,

-” এগোবেন না। আমার কাছে আসবেন না। আসবেন না, প্লিজ।”

তনুজার কণ্ঠে অসহায়ত্ব নামল। ইভানের এতে কোন হেলদোল নেই। কথা বলতে বলতে তনুজার পিঠ ওয়্যারড্রোবের দেওয়ালে ঠেকে যায়। পিছনে দেওয়াল, সামনে ইভান। অ/গ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে সে। ইভান ঢুলতে ঢুলতেই তনুজার দিকে ঝুঁকে বলল,

-” কী বললে তুমি? কী বললে? আমাকে ঘৃ/ণা করো? আমাকে?”

কথাটা শেষ করে হা হা করে হাসতে থাকে ইভান। ইভানের এহেন হাসিতে তনুজা ভড়কায়। ইভান হাসি থামিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

-” তুমি আমাকে কী ঘৃ/ণা করবে, আরে আমি ঘৃ/ণা করি গোটা মেয়ে জাতিকেই। মেয়ে জাতি হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে নি/কৃ/ষ্ট কীট। এদেরকে আমি প্রচন্ড ঘৃ/ণা করি।”

ইভানের মুখ থেকে উটকো বিশ্রী গন্ধ আসলো। তনুজার গা গুলিয়ে আসছে। তনুজা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েই তাচ্ছিল্য করে বলল,

-” নাটক করছেন না! নাটক! এখন নাটক করে এসব বলছেন। তাহলে এরকম আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে কেন করলেন? আপনি বিয়েতে রাজি কেন হলেন? আপনি রাজি না হলে তো এই বিয়ে হয় না। আপনি প্ল্যান করে এসব কিছু করেছেন। আপনি সবাইকে বলতেন সে রাতে আপনার আর আমার মধ্যে এমন কিছুই হয়নি।”

ইভান একহাতে তনুজার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তনুজার নরম গাল একহাতে চেপে ধরে বলল,

-” এই মেয়ে জাতি খুব স্বার্থপর! বেইমান! এই মেয়ে জাতি একটা আ/তং/কের নাম। শোনো মেয়ে ইফতিয়ার ইভানের কাউকে ঠকিয়ে, ফাঁসিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করার মনমানসিকতা আর ইচ্ছে কোনোটাই নেই। আর নাতো কোনদিন ছিলো। যদি ইফতিয়ার ইভান এরকম চরিত্রের হতো, তাহলে সে অনেক আগেই এরকম একটা কিছু করতে পারত।”

ইভানের স্পর্শ অসয্য ঠেকছে তনুজার কাছে। তনুজা প্রশ্ন ছুঁ’ড়ে দেয়,

-” তাহলে এই বিয়েতে রাজি কেন হলেন আপনি? আর বিয়েটা কেন করেই নিলেন?”

তনুজার গাল আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ইভান। এবার ব্যাথায় তনুজার চোখের কোল গড়িয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। ইভানের সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়েই সে জবাব দেয়,

-” সবাই যখন তোমাকে দায়ী করছিল। তোমাকে বাজে বলছিল। জানি না সেই সময় আমার কী হয়েছিল! তোমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা মনে হয়ে তোমার প্রতি দয়া করে এই বিয়েতে আমি মত দিয়েছিলাম। কেন জানি সেইসময় আমার মনে হচ্ছিল তোমাকে সবাই ছিঃ ছিঃ করছে এর পেছনে আমি পত্যক্ষভাবে দায়ি না হলেও হয়ত পরোক্ষ ভাবে দায়ি। আর তোমার কী মনেহয়, আমি তোমার কথামত আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি এরকম বললে সবাই বিশ্বাস করতো? করতো না বিশ্বাস। করতো না। এই সমাজের লোক কারো উপকার করতে পারে না, তবে তারা শুধু অন্যের পিছনে লাগতে পারে। এটা তারা খুব ভালো পারে। কাউকে কীভাবে হেনস্তা করবে, কার থেকে প্রিয় জিনিস কেড়ে নিবে তারা শুধু এসব খা/রা/প কাজেই পারদর্শী।”

এতটুকু বলে থামে ইভান। হাঁপাতে থাকে সে। হঠাৎ ইভান নিজের উপর বিস্মিত হয়। বিস্ময় নিয়ে আওড়ায়,

-” আরে তোমাকে এত সাফাই কেন গাইছি আমি। তোমাকে কৈফিয়ত কেন দিচ্ছি।”

তনুজা ইভানের হাতটা নিজের গাল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে চিল্লিয়ে বলে,

-” ছাড়ুন আমাকে। আর এসব মিথ্যে নাটকীয় কথাবার্তা বন্ধ করুন। আমাকে এত দয়া দেখানোর দরকার ছিলো না। ছিলো না দরকার।”

ইভানের মেজাজ দপ করে বিগড়ে যায়। তনুজার কথায় তরতর করে তার রাগের পারদ সর্বোচ্চ হয়। গলার স্বর চড়িয়ে সে বলল,

-” বলেছিলাম না, এই মেয়ে প্রজাতি খুব স্বার্থপর! তারা শুধু নিজের দিকটা দেখে। এই প্রজাতির উপর আমার আজীবন ঘৃ/ণা রয়ে যাবে। আই হেইট দেম।”

তনুজার দুইবাহু শক্ত করে ধরে বলতে থাকে ইভান। তনুজা ব্যাথায় কুঁকড়ে যায়। তনুজা অস্ফুটে আওড়ায়,

-” আহ্! ছাড়ুন আমার লাগছে।”

ইভান তনুজাকে ধাক্কা দিয়ে সে পিছন ঘুরে যায়। আচমকা ধাক্কা দেওয়ায় তনুজার মাথাটা ওয়্যারড্রোবের সাথে লাগে। ওয়্যারড্রোবের কোণা কপালে লাগে। তনুজা ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। একহাতে কপাল চেপে ধরে। তৎক্ষণাৎ হাতটা ভেজাভেজা অনুভব হয়। তনুজা কপালে চেপে ধরা হাতটা সামনে ধরে দেখে লাল টকটকে তরল হাতে লেপ্টে আছে। তনুজা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওয়্যারড্রোবের সাথে ঠেস দিয়েই নিচে বসে পরে।

ইভান ডানে-বায়ে না তাকিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পরে‌। বিরবির করে সে,

-” প্রত্যেকে সেলফিস। প্রত্যেকেই।”

ইভানের মাথায় বালিশ নেই ,পা দু’টো অর্ধেক বিছানার বাইরে ঝুলছে। পায়ে জুতো জোড়া আছেই, পুরোই এলোমেলো বিধ্বস্ত অবস্থায় শুয়ে বুঁজে নেয় চোখজোড়া।

তনুজা ওভাবে বসেই বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকে ঠাঁয়। ইভানের এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে, ইভানের বলা কিছু কথা পর পর মস্তিষ্কে সারা জাগাতেই তনুজার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে,

-” এই লোকটা তাকে ফাঁ/সিয়ে বিয়ে করতে কেন গেল? লোকটা কোন জোরজবরদস্তিও করেনি। লোকটার চোখেমুখে কোন লালসা দেখতে পাওয়া যায়নি! যেটা দেখা গেলো সেটা মেয়েদের প্রতি তীব্র ঘৃ/ণা। এতই যদি মেয়েদের প্রতি তীব্র ঘৃ/ণা তাহলে বিয়ে কেন করল। লোকটার কথা কী তবে সত্যি? সে দয়া দেখিয়েছে তনুজাকে? সেও কী তনুজার মতো পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে!”

________

নুরজাহান সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আবার পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছে। তামান্না এক মগ কফি হাতে এসে ধপ করে সোফায় বসল। শিরিন বুয়ার সাথে কিচেনে। নুরজাহান গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকলেন,

-” ছোট বউমা?”

শিরিন ত্রস্ত পায়ে কিচেন থেকে বের হয়ে আসতে আসতে বলে,

-” হ্যা মা।”

নুরজাহান পত্রিকায় চোখ রেখেই শুধায়,

-” সে নবাবজাদি মেয়ে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?”

শিরিন বুঝল। শাশুড়ি মা কাকে মিন করছে। শিরিন কন্ঠ খাদে রেখেই জবাব দেয়,

-” তনুজা রুমেই আছে মা। উঠেছে হয়তো। বাচ্চা মেয়ে লজ্জা পাচ্ছে হয়তো, তাই বেরুচ্ছে না। ”

-” বাচ্চা মেয়ে। ওর এই বয়সে আমাদের সময় মেয়েরা কয় বাচ্চার মা হয়েছে। সাথে ভোর সকালে উঠে বাড়ির সবার জন্য রান্না করতে হতো। যাইহোক, এতবেলা করে ঘুমানো এসব আমার পছন্দ নয়। যেভাবেই হোক বিয়ে যেহেতু হয়েছে তাকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিও। আর তাকে বলো তার স্বামীকে ওসব ছাইপাশ ছাড়াতে। মেয়ে মানুষ চাইলে সব পারে।”

শিরিন ঘাড় নেড়ে ‘হ্যা’ সূচক উত্তর দেয়। তামান্না কফির মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠল,

-” মা আমি বুঝলাম না ঐ মেয়েকে কেন এ বাড়ির বউ করলে। একটা থার্ড ক্লাস ফ্যামেলির মেয়ে, যার বাবার চরিত্র ভালো না। আচ্ছা ফ্যামেলির কথা নাহয় বাদই দিলাম। মেয়েটা? মেয়েটাও তো আহামরি কিছু নয়। না সুন্দরী আর না স্মার্ট। কোনোটাই না। অ্যাভারেজেও পরে না। ধূর! মা তুমি কেন যে ইভানের সাথে এই মেয়েটাকে বিয়ে দিতে গেলে। আমি আমাদের ইভানের জন্য স্মার্ট দেখে, ডানাকাটা পরীর মতোন কাউকে খুঁজে দিতাম। আমার এক বান্ধবীর মেয়ে ছিল খুব সুন্দরী আর অভার স্মার্ট।”

নুরজাহান মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই তামান্না থেমে যায়। নুরজাহান কণ্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,

-” স্মার্ট দিয়ে সংসার হয় না। আর ভুলে যেয়ো না তোমার মা কোনকিছুর কৈফিয়ত দেন না। তাই এরকম নির্বোধের মতো কথা পুনরায় বলবে না।”

বৃদ্ধা নুরজাহানের চোখে-মুখে একটা রাজকীয় ভাব আছে। এটা তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। খানদানি বংশের মেয়ে সে। বয়স হলেও বাড়ির প্রধান সিদ্ধান্ত দাতা সে। তামান্না আর ‘রা’ শব্দটিও উচ্চারণ করল না। কিছুক্ষণ পর শিরিনকে উদ্দেশ্য করে নুরজাহান আদেশের সুরে বলে,

-” ইভান দাদুভাইকে বলে দিও দেবদাস বনে না চলাচল করে, আগের মতো অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে। একের পর এক ব্যবসায় লজ হচ্ছে তারজন্য। এরকম হতে থাকলে ব্যবসা লাটে উঠবে।”

-” ঠিক আছে।”

বলে শিরিন যেতে নিবে, তন্মধ্যেই নুরজাহান বললেন,

-” নাত বউকে এ বাড়ির নিয়ম কানুন সব শিখিয়ে দিবে। আর বলে দিও তার কলেজে যাওয়ার দরকার নাই। সে ঘরসংসার করুক। স্বামী-সংসার আগলে রাখুক। আর শোন তাকে এ-ও বলে দিও, যা হওয়ার হয়েছে এরপর আমার বাড়ির সম্মানহানিকর কিছুর যদি এতটুকু আভাস পাই, তাইলে কিন্তু আমি ঐ মেয়েরে আর কোন সুযোগ দেব না। ঐ মেয়ের জন্য আমার বাড়ির সম্মান ক্ষুন্ন হবে এমন কিছু দেখলেই সেদিনই হবে ঐ মেয়ের শেষ দিন। এই বাড়িতে তার কোন আশ্রয় হবে না। তাই ঐ মেয়েরে সাবধান করে দিও। আশাকরি বুঝতে পারছ কী বলতে চাইছি?”

তামান্না একপাশে বসে আইঢাঁই করতে থাকে। শিরিন মাথা কাৎ করে ছোট করে জবাব দেয়,

-” জি মা।”

____________

তনুজা ওভাবে বসে কাঁদতে কাঁদতে একটা পর্যায়ে চোখ দু’টো লেগে যায়। শেষ রাতের দিকেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে সে। মাথাটা ওয়্যারড্রোবের সাথে ঠেকিয়ে পা দু’টো ফ্লোরে ছড়িয়ে রাখা। এভাবেই একটা বিধ্বস্ত, যাতনার রাত কাটে তনুজার। এরমধ্যে দরজায় শব্দ হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় তনুজা। দরজার দিকে একবার তাকায় তো আরেকবার বিছানায়। বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে ইভান। মুখের একপাশ তার বিছানার সাথে লেপ্টে আছে। এলোমেলো চুলগুলো কপাল ছাড়িয়ে ভ্রুয়ের নিচে নেমে আছে। তনুজা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগোয়। দরজা খুলতেই বুয়া মাজেদা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে উঠল,

-” খালা আম্মা ডাকতাছে তোমারে। তাড়াতাড়ি যাও। কথা আছে নাকী।”

“খালা আম্মা” মানে নুরজাহান। এই বাড়িতে আসার পর এই মহিলাকে তনুজা ভয় পেতো। কেমন সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে। তারপর কাল যা ঘটল তারপর থেকে তো জমের মতো ভয় পায় তনুজা। নুরজাহান কেন সক্কাল সক্কাল ডাকছে এই কথা ভাবতে থাকে তনুজা। তনুজার ভাবনা ভাঙ্গে মাজেদার কর্কশ স্বরে,

-” অ্যাইভাবে স্বয়ংয়ের মতোন খাড়াইয়া না থাইকা তাড়াতাড়ি যাও। নইলে বুড়ি চেইতা যাইবো। বুড়ির বয়স বাড়ছে তয় দেমাগ আর কথার ঝাঁঝ এহনো কমেনি। ”

মাজেদার এরুপ কথায় অবাক হয় তনুজা। অগোচরে মালকিন সম্বন্ধে কীভাবে বলছে, অথচ সামনে থাকলে থরথর করে কেঁপে হুজুর হুজুর করে সম্মান, ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখায়। খালা আম্মা খালা আম্মা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। অথচ এখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বুড়ি বলছে আরো রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করছে। আড়ালে মানুষের কত রুপ!
.
তনুজা ওয়াশরুম থেকে চোখে-মুখে পানির ছিটা দিয়ে রুম থেকে বের হয়। দোতলার করিডোর দিয়ে ভয়ে ভয়ে যাচ্ছিল সে। এমন সময় হাতে টান পরায় হকচকায় তনুজা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ধ্বক করে উঠে বুক। অস্ফুটে আওড়ায়,

-” দিব্য।”

দিব্য মাত্র বাড়ি ফিরল। সে নিজের রুমে যেতে নিলে তনুজাকে যেতে দেখে ভাবে,তনুজাকে সব বলবে। ইভানের মুখোশ খুলবে। ইভান ইচ্ছে করে তার থেকে প্রতিশোধ নিতে তনুকে বিয়ে করেছে। তনুজাকে এসব বলবে। আর ইভানকে সরাসরি ডিভোর্স দিতে বলবে।

এক রাতেই তনুজার চোখ-মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়েছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। দিব্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তনুজার দিকে চায়। তনুজার কপালে আ/ঘা/তের চিহ্ন দেখে দিব্যর কপালে গাঢ় ভাঁজ পরে। দিব্যর মনেহয় এসব কিছু ইভান করেছে। হয়ত জোরজবরদস্তি.. এতটুকু ভাবতেই দিব্যর রাগ আকাশচুম্বী হয়। দিব্য অস্থির হয়ে তনুজার কপাল স্পর্শ করে প্রশ্ন করে,

-” তনু? এসব কীকরে হলো। এসব ইভান করেছে না? ও তোমার সাথে জোর করেছে । ও তোমার গায়ে হাত তুলেছে। আমি ওকে শেষ করে ফেলবো। আই কিল হিম। আই রিপিট আই কিল হিম।”

তনুজা দিব্যর হাতটা নিজের কপাল থেকে সরিয়ে দেয়। পর পর বলে উঠল,

-” না দিব্য তুমি যেমন ভাবছো এমন কিছুই না।”

-” তাহলে তোমার কপালে আঘাত কীসের? এটা কী করে হলো।”

তনুজার কেন জানি সত্যিটা বলতে ইচ্ছে করলো না। আর লোকটা হয়তো ইচ্ছে করে আঘাত করেনি। লোকটা বুঝতে পারেনি। তাই তনুজা আসল কথা লুকায়। মিথ্যে বলে,

-” উম! এটা এটা আমি তো ওয়াশরুমে পা পিছলে পরে গিয়েছিলাম। আর দরজার কোণায় লাগে।”

‘উফ্!’ দিব্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তনুজার আঁখি জোড়া ছলছল করছে। আবার ভ’য়ও লাগছে। তার পোড়া কপাল। আবার কে কোন সময় তাকে আর দিব্যকে কথা বলতে দেখে সেটা নিয়ে আবার কী কাহিনী হয়ে যায়। তাই এভাবে দিব্যর সাথে কথা বলতে তনুজার ভ’য় আর অস্বস্তি হচ্ছে। আবার অদৃশ্য একটা বাধাও তনুজাকে শাসাচ্ছে। দিব্যর সাথে তার আর কোন কথা নেই। দিব্যর দিক থেকে তার দৃষ্টি, তার মন সংযম করতে হবে। এটা পা/প। কিন্তু মন সে তো নীতি কথা এতো সহজেই মানতে চায় না। বিবেক দিয়ে না ভেবে আবেগে ভাসতে চায় মন। মনের লাগাম টেনে ধরা এতো সহজ নয়, চাট্টিখানিক কথা নয়। তনুজার বুকের ভেতর মরুর সাইমুম বইছে। তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখছে।

আচমকা দিব্য তনুজার মুখটা দু’হাতে আঁজলা করে ধরে,

-” তনু আমি সারা রাত অনেক ভেবেছি। আমি অনেক ভেবেছি। ভেবে যা বুঝলাম এসবের জন্য ইভান দায়ী। ইভান আমার থেকে রিভেঞ্জ নিতে এসব করেছে। আমি মাম্মার কথামত আর চুপ করে থাকব না। আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবই। আই প্রমিজ।”

তনুজা দিব্যর হাত দুটো মুখ থেকে সরিয়ে দেয়। ভরাট স্বরে সে বলে,

-” দিব্য স্যরি! তুমি বাদ দাও। তা আর হয় না। আর আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি না। নদীর স্রোতের মতো জীবনকে তার আপন গতিতে ছেড়ে দিয়েছি আমি। দেখতে চাই ভাগ্য আমাকে কতটা কাঁদাতে পারে। নিজেকে নিয়ে নতুন করে আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই।”

দিব্য অস্থির চিত্তে বলল,

-” তনু তুমি চাও না, তোমার সাথে যে চিট করেছে তাকে সাজা দিতে। নাকি তাকে তার চিটিং করে করা কাজে সফল হতে দিবে। সফল হতে দিবে নাকী সাজা দিবে? তুমি ইভানকে ডিভোর্স দিবে তনু। আমি তোমার পাশে আছি থাকব। আমি উকিলের সাথে কথা বলব। তোমার আর ইভানের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব।”

তনুজা ঠোঁট প্রসারিত করে কিছু বলবে, এমন মূহুর্তে আচমকা নুরজাহানের গলা শুনে তনুজার পিলে চমকে উঠে। ভ’য়ে, আতংকে হাত-পা জমতে শুরু করে তনুজার।

#চলবে