#প্রণয়ের_বাঁধন |৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে আটটার ঘর পেরিয়েছে। মির্জা বাড়ির ডাইনিংয়ে নাস্তা করতে বসেছে, ইভান, নুরজাহান, তামান্না আর তার দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে নৃত্য। শিরিন খাবার সার্ভ করছে, তনুজা একপাশে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে হেল্প করছে। নুরজাহান খাবার খাচ্ছেন আর মাঝেমধ্যে কথা বলছেন। এদিকে ইভানের মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। সে ডানে-বায়ে না তাকিয়ে ব্রেডে ছোট ছোট বাইট দিচ্ছে। শিরিনকে উদ্দেশ্য করে নুরজাহান জিজ্ঞাসা করলেন,
-” ছোটো বউমা? ছোটো খোকা দেশে কবে ফিরবে? আজ অনেকদিনই তো হলো অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছে। তা তার ফেরার সময় হয়নি এখনো? কাজ শেষ হয়নি?”
-” দিব্যর বাবা রাতে ফোনে বলল, সামনের সপ্তাহেই চলে আসবে। কাজ শেষের দিকেই প্রায়।”
-” ও, আচ্ছা। তা দেখে শুনে থাকতে বলো। বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকলে খুব চিন্তা হয়। কী খাচ্ছে না খাচ্ছে। বাইরের খাবার ছেলেটা আমার ঠিকমতো খেতে পারে না। না খেয়ে খেয়ে একেবারে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে আসে।”
শিরিন প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে। নুরজাহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আশেপাশে তাকিয়ে শুধালেন,
-” দিব্য দাদুভাই কই? সে এখনো খেতে আসলো না যে!”
-” দিব্য আসছে। আমি একটু আগেই ডেকে আসছি। দিব্য শাওয়ার নিচ্ছে। চলে আসবে এক্ষুনি।”
-” দিনদিন বাড়ির নিয়ম-কানুন সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে। যে যার খুশি, মর্জি মতো চলছে। আমি বেঁচে থাকতেই এই অবস্থা। না জানি আমার না থাকাকালীন এই সংসারে কী হয়! হায় খোদা!”
খাবার খেতে বসেও চিরাচরিত, স্বভাবসুলভ প্যাঁচাল ধরেছে নুরজাহান। তার রুলস সবাই একসাথে সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করা। এই রুলস সর্ব প্রথম ব্রেক করে ইভান। সে তো অনেকদিন বাড়িতে না থাকার মতো থাকত। বাড়ির পানিও ছুঁয়ে দেখতো না। বাইরে দিনরাত কাটত তার। দিব্যর মুখোমুখি হতে হবে বলে এ বাড়ি মুখো তার হতে ইচ্ছে করত না। তারপর দিদুনের অনুরোধে, অনেকদিন ধরে বলার পর সে বাড়িতে ফেরে। আর সকালের নাস্তা একসাথেই করে। তবে রাত করে বাড়ি ফেরা ড্রিংক করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হাজার বলে-কয়ে , কাউন্সিলিং করেও এটা ছাড়ানো যাচ্ছে না। ইভান বাড়ির কারো সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আর সবার কথায়, হ্যা-হু ব্যাস এতটুকুই। দিব্যর সাথে দিনে একবারই তার দেখা হয় সকালের নাস্তার টেবিলে। তবে দু’জনের মধ্যে কথা হয় না। একজন টেবিলের একপ্রান্তে আর আরেকজন টেবিলের অপরপ্রান্তে। দুইজন দুই মেরুতে বসে। দেখেও যেন দেখেনি এমন ভঙ্গিমায় থাকে ওরা দু’জনে।
ইভান হাত বাড়িয়ে টেবিলের মাঝ থেকে জুসের জগটা নিতে যাচ্ছিল। এমন সময় শিরিন বলে উঠে,
-” ইভান দাঁড়াও। তনুজা দিচ্ছে। এই তনুজা! ইভানকে জুস দাও।”
তনুজা কিছুপল চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর টেবিলের মাঝখান থেকে ফলের জুসের জগটা হাতে নিয়ে ইভানের পাশে এগিয়ে যায়। গ্লাসে ঢালতে থাকে তনুজা। তন্মধ্যে চেয়ার টানার শব্দ হওয়ায় তনুজা চোখ তুলে সামনে তাকায়। সুঠাম দেহে আঁটসাঁট কফি কালারের টিশার্ট আর নীল জিন্স পরনে, চুলগুলো ভেজা। মুখটা গম্ভীর। তবে বরাবরের মতোই খুব হ্যান্ডসাম লাগছে দিব্যকে। তনুজাকে ইভানের পাশে দেখে ক্রোধে ভেতরে ভেতরে ফেটে পরে দিব্য। সব রাগ যেন নিরীহ চেয়ারটার উপর মেটায় সে। শব্দ করে চেয়ার টেনে বসে। তনুজার শান্ত চোখ দু’টো দিব্যর মুখাবয়বে আঁটকায়। ফর্সা মুখটা কেমন ফ্যাকাসে ম্লান হয়ে আছে। তনুজার মায়া হলো দিব্যর জন্য। তার বুকটা হু হু করে উঠে বেদনায়। এরমধ্যে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জলদগম্ভীর স্বর কানে পৌঁছাতেই কেঁপে উঠে তনুজার পেলব শরীর।
-” স্টুপিড কোথাকার! কোথায় তাকিয়ে আছো, হ্যা? চোখে দ্যাখো না নাকি? কোন ধ্যানে আছো?”
ইভানের চড়িয়ে যাওয়া মেজাজের এহেন কথাশুনে উপস্থিত কয়েকজোড়া চোখ সেদিকে নিবদ্ধ হয়। তনুজা সাথে সাথে দাঁত দিয়ে জিভ কা/টল। জুস ঢালতে গিয়ে তার বেখেয়ালে গ্লাস ভরতি হয়ে উপচে পরেছে। আর উপচে পড়া জুস টেবিল ভেসে ইভানের গায়ের উপর পরেছে। তনুজার বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠে ইভানের ধ’ম’ক শুনে। তনুজার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। ভীতু সন্ত্রস্ত হয়ে অপরাধীর সুরে আমতা আমতা করে বলে,
-” স স স্যরি! আসলে আমি খেয়াল করিনি।”
ইভান রুঢ় কণ্ঠেই বলে,
-” খেয়াল করোনি। কোনদিকে তাকিয়ে হা করে আছো। যে এদিকে জুস ঢেলে বন্যা বয়ে দিচ্ছো। কেয়ারলেস একটা। আমার ড্রেসটা নোংরা করে ছাড়ল। যত্তসব!”
ইভানের এভাবে তনুজাকে বলায়, দিব্যর মেজাজ খারাপ তুঙ্গে উঠে। তার হাতের আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। বরাবরই দিব্যর রাগ-জিদ বেশি। সে নিজেকে কন্ট্রোল করার বৃথা প্রয়াস চালিয়ে যায়। অবশেষে সে হেরে যায়। আচমকা নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে দিব্য দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,
-” সামান্য একটু জুস পরেছে তাতে এমন কী হয়েছে? এরজন্য রাফ অ্যান্ড টাফ বিহেভিয়ার করতে হবে। আর ও ইচ্ছে করে করেছে যে তুই এমন বাজে বিহেইভ করছিস ওর সাথে। সামান্য একটা বিষয়ে কেউ এভাবে রিয়েক্ট করে।”
সবাই অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছায়। নরমালি এরা দুইভাই কারো ভালো-মন্দ কোন ব্যাপারেই মাথা ঘামানো দূর, বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট দেখায় না। আর আজ দিব্য ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলছে। শিরিন ভ’য়ে ভ’য়ে আছে। তনুজার চোখ ছলছল করছে। ইভানের কপালে ভাঁজ পরে। আজ দেড় বছর কথা হয় না তাদের দু’জনের। আজ হঠাৎ এমন কী হলো! দিব্য এভাবে বলতে গেল! ইভানের কাছে বিষয়টা ভালো ঠেকল না। তনুজার প্রতি দিব্যর এই টান, এই সহানুভূতিশীল কথা ইভানের সয্য হলো না। নিজের ইগো ধরে রাখতে গলার স্বর চড়িয়ে সে বলল,
-” আমি কার সাথে কীভাবে কথা বলব তোর থেকে শুনতে হবে নাকী? ফারদার কখনো আমার কোন ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করবি না। মাইন্ড ইট”
দিব্যও দ্বিগুণ রাগ নিয়ে উঁচু স্বরে বলে,
-” তোর ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার জিরো ইন্টারেস্ট আমার।”
থেমে, তাচ্ছিল্য হাসে দিব্য। বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলে,
-” মেয়েটার সাথে কোন কারন ছাড়াই, হুদাই রাফ ব্যবহার করলি। এভাবে চা/মা/ড়ের মতো কথার ধরণ আর আচরণ চোখের সামনে দেখে। কিছু না বলে চুপ করে দর্শক হয়ে থাকতে পারলাম না। তাই বলা আরকি। এছাড়া তোর সাথে কথা বলার কোনই ইচ্ছে আমার নেই, হাহ।”
দিব্যর এই তাচ্ছিল্য করে বলা শুনে রাগে ইভানের মুখ কালো হয়ে যায়। সে কণ্ঠে তেজ নিয়েই বলল,
-” আমি আমার বউয়ের সাথে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কথা বলবো। তাতে তোর কোন সমস্যা আছে?”
দিব্য চোখ বন্ধ করে নেয়। কপালের নীল রগগুলো ফুলে উঠেছে তার। ইচ্ছে করছে এই টেবিলটা উল্টে ফেলে দিতে। খাবার সহ সবকিছু ছুঁড়ে মা/রতে তাতে যদি একটু হলেও রাগটা কমতো। নুরজাহান অগ্নি চক্ষু নিয়ে তনুজার দিকে তাকিয়ে আছে। তামান্না তামাশা দেখছে, নৃত্য সরু চোখে ভাইয়াদের দিকে ভীতু ফেস করে তাকিয়ে। দিব্য কিছু বলবে সেই সময় শিরিন এক হাত উঁচু করে বলেন,
-” ইভান-দিব্য অনেক হয়েছে। ব্যাস আর নয়।”
থেমে, দম ফেলে ফের বলতে থাকে,
-” একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তোমরা দুইভাই এমন করলে হয়। এটা লোকে শুনলে কী বলবে? বলো তো আমায়? দুইভাই আজ দেড় বছর কথা বলো না। এটা নিয়ে সোসাইটিতে আড়ালে কথা হয়। সেসব না হয় বাদ দিলাম। এখন যদি তোমরা এভাবে ঝগড়া করো। এসব লোকে শুনলে তো তাদের হাসি, ঠাট্টা বাড়বে বৈ কমবে না। লোকসমাজে বের হতেই লজ্জা করবে।”
দিব্য ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
-” আর দিদুন তোমাকে বলি। কী হলো না হলো আর অমনি একটা মেয়েকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলে। জাস্টিফাই করলে না আসলে দোষি কে? মেয়েটা দোষ করেছে কীনা? সেসব না জেনেই জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলে, হাহ! তাও যদি একজন সুস্থ মানুষ হতো। যে নিয়মিত ড্রিংক করে, সে কখনোই সুস্থ মস্তিষ্কের লোক হয় না। এই বিয়ে দিয়ে তোমরা তনুজার ক্ষ/তিই করেছো। এর ফলাফল দেখতে পেলে তো। পেলো তো আজ। আজ সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ও তনুজার সাথে কী বাজে আচরণ করল! দু’দিন পর তনুজার গায়ে হাত তুলবে না এর গ্যারান্টি দিতে পারবা! পারবা? বলো, বলো আমায়?
ইভান কাঁচের গ্লাসটা চেপে ধরেছে। শক্ত করে চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বলল,
-” দিদুন ওকে বলে দাও। ও কিন্তু ওর লিমিট ক্রস করছে।”
তনুজার বড্ড অসহায় ঠেকছে। তারজন্যই আজ এরকম হচ্ছে। তনুজার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। তনুজার আঁখিজোড়ায় জল টলমল করছে। থরথর করে কাঁপছে তনুজা। নুরজাহান মুখ কালো করে গম্ভীর গলায় বললেন,
-” দিব্য দাদুভাই থামো তুমি। আমি অনেকক্ষন ধরে তোমাদের অহেতুক ঝগড়া দেখে বিরক্ত হচ্ছি। দয়া করে থামো তোমরা। ইভান কিন্তু খারাপ কিছু বলেনি। বউ ভুল করলে স্বামী শাসন করতেই পারে। স্বামী তার স্ত্রীকে ধ’ম’ক দিবে, এটা এমন কী। ভুল হলে গায়ে হাতও তুলতে পারে। আমাদের সময় কত কী সয্য করেছি।”
দিব্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-” দিদুন তোমাদের সময় আর এখনকার সময় টোটালি আলাদা। আর আমি মোটেই অহেতুক ঝগড়া করছি না। এখানে দোষটা তোমার বড় নাতীর। তার বিহেভিয়ার দেখে আমি বলতে বাধ্য হয়েছি। হাহ! সে বউ বলল। শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। বউয়ের সাথে কেউ বুঝি এরকম আচরণ করে! আরে বুয়ার কাজের ভুলের জন্যও তো কেউ এভাবে ধমকায় না।”
তাচ্ছিল্য করে, উপহাস করে বলে রাগ কমানোর চেষ্টা করে দিব্য। তনুজা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
-” দিব্য তুমি থামো, প্লিজ। আমার ভালো লাগছে না। আমার জন্যই শুধু শুধু একটা সিনক্রিয়েট হলো।”
ইভান কাঁচের গ্লাসে সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করে। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গ্লাস হাতের মুঠোয় চেপে ধরে। মূহুর্তেই গ্লাসটা কয়েক টুকরোয় পরিণত হয়। শব্দ শুনে তাকিয়ে তনুজা আর্তনাদ করে উঠল,
-” একি আপনার হাত কেটে র/ক্ত ঝরছে তো! কী করে গ্লাসটা ভাঙলো।”
-” ইভান!”
শিরিন এগিয়ে আসলো। নুরজাহান হা হুতাশ করে,
-” দাদুভাই! হায় হায়! হাতটা কেটে র/ক্ত বেরুচ্ছে।”
তনুজা আচমকা দুইহাতে ইভানের হাত ধরে। ইভানের র/ক্তাক্ত হাতটা তার একটা হাতের উপর রাখে। ছোট্ট এক টুকরো কাঁচ বিঁধে ছিলো, হাতের তালুতে। তনুজা টান দিয়ে বের করে দেয়। শিরিন নৃত্যকে ডেকে বলে,
-” নৃত্য ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আয়।”
ইভান থ মে/রে শুণ্যে তাকিয়ে আছে। সে যেন অনুভূতি শুণ্য। পাথরের মুর্তির মতো ঠাঁই বসে আছে সে। তনুজার চোখেমুখে অস্থিরতা। তনুজার সমস্ত মনোযোগ এখন ইভানের হাতের দিকে। ইভানের প্রতি তনুজার এই অস্থিরতা দেখে দিব্যর রাগ তরতর করে বাড়তে থাকে। টেবিলে শব্দ করে ঘুষি মে/রে দিব্য উঠে চলে যায়। পরপর ইভানও এক ঝটকায় তনুজার হাত দু’টো সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-” ঔষধ লাগবে না। আমি আসছি।”
আর একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে ইভান গটগট করে বেরিয়ে যায়। পেছনে শিরিন, নুরজাহান ইভানকে ডাকতে থাকে। ইভান পিছু ফিরে তাকায় না। কিছুপল পর নুরজাহান তনুজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-” একবার এক কালনাগিনীর জন্য আমার দুই দাদুভাইয়ের সম্পর্ক খা/রাপ হলো। বুঝতে পারছি না আবার কী হতে যাচ্ছে!”
তামান্না চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিরক্তিকর ফেস করে বলে,
-” এসব তামাশা দেখতে আর একটুও ভালো লাগে না!”
নৃত্য ফাস্ট এইড বক্স এনে বোকাবোকা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
-” ভাবিমণি? ইভান ভাইয়া কই?”
তনুজা মাথা নিচু করে নিরুত্তর থাকে। শিরিন বুয়াকে ডেকে জায়গাটা ক্লিন করতে বলে। নুরজাহান কপাল কুঁচকে বলেন,
-” এখানে এভাবে সংয়ের মতোন না থেকে যাও। যাও তো এখান থেকে। তোমাকে দেখলেই আমার রাগ বাড়ছে। কেমন মেয়ে মানুষ তুমি? বলো তো আমায়? স্বামী কাঁ/টা হাত নিয়ে চলে গেল। অমনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে, তাকে আটকাতে পারলে না। একে তো তোমার বেখেয়ালের জন্যই দুই ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হলো।”
তনুজা অবাক হয়। এখানে সবাই ছিল। তাকে আটকানোর দায়িত্ব কী শুধু তারই ছিলো! আর যে ওভাবে চলে যায়। তাকে কীভাবে আটকাবে? তারপরেও হাতের র/ক্ত দেখে তনুজা আচমকাই, ইভানের হাতটা ধরে। র/ক্ত দেখে তনুজার মাথা হ্যাং হয়ে আসছিল। লোকটা কে? কাল-পাত্র বিবেচনা না করেই। তনুজা হাতটা ধরে, কাঁচের টুকরো ফেলেও দেয়। এসবের পরেও তনুজা কেমন? হাহ! এসবভেবে নিজের উপর নিজেই মনেমনে তাচ্ছিল্য হাসে তনুজা।
_____________
সময় তার আপন গতিতে চলছে। সময় পরিবর্তন হচ্ছে। দিন গিয়ে আসছে রাত, রাত গিয়ে আসছে দিন। তনুজার ভাগ্যেরই শুধু পরিবর্তন হচ্ছে না। তার ভাগ্য তাকে শুধু কাঁদিয়েই যাচ্ছে। সেই ছোট্ট থেকে সে কাঁদছেই। মাঝখানে দাদির কাছে থাকাকালীন তার কান্নারা সাময়িক ছুটি নিয়েছিল বোধহয়। ভেতরে শুণ্যতা, কষ্ট থাকলেও এতটা যন্ত্রণা ছিলো না। যতটা যন্ত্রণা আজ দু’দিন পাচ্ছে সে। জীবন যেন তার জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তনুজা। গাল বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে। দৃষ্টি তার দূর আকাশপানে জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকা তারকারাজির দিকে। আকাশপানে তাকিয়ে সে মায়ের প্রতি অভিযোগ নিয়ে কতশত কথা বলে। ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশ্ন পাঠায় সে। তবে তার প্রশ্নের উত্তর আসে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে তনুজার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। গাল বেঁয়ে পরা জলটুকু হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে নেয়। মনকে শক্ত করার প্রয়াস চালায়।
তনুজা ধরে নেয়, সামনের বাকী দিনগুলো এভাবেই যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই তার কাটবে। তার জীবনে সুখের আশা করা মরিচীকার মতোন। তনুজা নিজের সুখের আশাও করে না আর। তার বেশি খারাপ লাগছে তারজন্যই এই বাড়িতে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি হলো। এরকম বোধহয় রোজরোজই হবে। এই ভ’য় আ/তংকে। তনুজার ম/রে যেতে ইচ্ছে করছে। তবে বিবেক বাঁধা দিচ্ছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়া চরম বোকামি। কতই তো ধৈর্য্য ধরেছে সে। এভাবেই ধৈর্য্য ধরুক। জীবনের বাঁকা মোড় কোথায় গিয়ে শেষ হয় তাই জানার আগ্রহ তনুজার। তবে তার মন বলে, তার জীবনের মোড় ঘুরেফিরে অথৈ সাগরের কষ্টের বুকে গিয়েই শেষ হবে। সুখের দেখা এ জীবনে মিলবে না কভু।
তনুজা নিজের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করে। তার অবচেতন মন আওড়ায়,
-” জানি না! জানি না,আমি! কিচ্ছু জানি না! ওনাকে আমি আপন করতে পারব কীনা তা জানি না। তবে দিব্যর প্রতি নিজের মনকে তো চাইলেই কঠোর করতে পারব। দিব্যর প্রতি এক বিন্দুও দূর্বলতা রাখা আমার জন্য পা/প হবে। হে খোদা! তুমি সাহায্য করো। আমি যেন দ্রুত আমার অতীত ভুলতে পারি।”
রাতে খাওয়ার টেবিলে দিদুনের বলা কথা স্মরণ হয় তনুজার। দিদুন তাকে জিজ্ঞাসা করে, ইভানকে সে ফোন করেছে কীনা? ফোন করে কখন আসছে, তা জেনেছে কীনা! তনুজা কোন জবাব দিতে পারে না। কারন সে তো কল করেনি। আর কল করা তো দূর একবারো খোঁজ নিয়ে হাতের অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করার কথাই তার মাথায় আসেনি। দিদুন এই নিয়ে খানিকটা রাকঢাগ করে। কেমন বউ! সারাদিনে একবারো ফোন দিয়ে শুনেনি। শিরিন সুলতানা বলছেন, ইভানের সাথে দ্রুত সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নিতে। আর ওদিকে দিদুন তো আছেনই। উফ্!
তনুজা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। তনুজার জন্য গ্রো আপ করা এতটা সহজ নয়। তারপর মানুষটাও কীরকম! এক্ষেত্রে তনুজা কীকরবে ভেবে পাচ্ছে না। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই ধূধূ মরুভূমি দেখতে পাচ্ছে তনুজা।
দীর্ঘক্ষণ ব্যালকনিতে থেকে অতঃপর তনুজা রুমে গিয়ে সোফায় বসে। শরীরটা ক্লান্ত থাকায় চোখ দু’টো বুঁজে আসছে তার। সোফায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পরে সে।
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। পুরো বাড়িতে নীরাবতা বিরাজমান। ইভানের কাছে চাবি থাকে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে আসে । প্রতিদিনের তুলনায় আজকে একটু আগেই ফিরেছে । আজকে মাত্র এক প্যাক হুইস্কি খেয়েছে সে। অফিসে আজকে সারাটাদিন তার কেমন কেমন যেন অস্থির ঠেকেছিল। আবার প্রতিদিন যেখানে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। আজ কেন জানি সন্ধ্যা থেকেই বারবার বাড়িতে ফেরার কথা মনে হচ্ছিল।
ইভান ভেজানো দরজা একহাতে ঠেলে রুমে প্রবেশ করে। পরপর দরজা লক করে দেয়। দু’পা এগোতেই দৃষ্টি যায় সোফায় ঘুমিয়ে থাকা তনুজার দিকে। ইভান পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তনুজার মায়াভরা মুখটা একদম নিষ্পাপ লাগছে। শ্যামবর্ণ মুখটার চোখের কোণায় জল শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। মেয়েটা অনেক কেঁদেছে এই দাগ তার সাক্ষী। হঠাৎ ইভানের খারাপ লাগল। ইভান
একহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। জানে না সকালে হঠাৎ তার কী হয়েছিল! এখন মনে হচ্ছে সে একটু বেশিই খারাপ আচরণ করে ফেলেছে। এটা ঠিক হয়নি। একটা অসহায় মেয়ের সাথে রুঢ় আচরণ করা তার মোটেই উচিত হয়নি। সকালে ইভান যখন লক্ষ্য করে গ্লাস ভরে জুস পরে যাচ্ছে। সেইসময় তনুজাকে বলতে যাচ্ছিল, এমনসময় ইভানের নজরে আসে তনুজা দিব্যর দিকে তাকিয়ে আছে। কেন জানি এটা দেখেই ইভানের মাথা বিগড়ে যায়। তৃষার কথা মনে হয়। মনেহয় তনুজাও বোধহয় সুদর্শন দিব্যতে আকর্ষিত হচ্ছে। ইভানের মনেহয় সবাই সমান! এই মেয়েও তৃষার মতো তার শ্যামবর্ণ গায়ের রঙকে কুৎসিত বলে, ফর্সা হ্যান্ডসাম দিব্যকে চাইবে। এসব ভেবে তার কেমন নিজেকে এলোমেলো লাগে। আর সেইজন্য তনুজার সাথে রুঢ় আচরণ করে ফেলে। তারপর দিব্যকে তনুজার হয়ে ওভাবে বলায় যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতোন হয়। ইভানের রাগ আ/গুনের মতোন দাউদাউ করে বাড়তে থাকে।
ইভান ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। পোশাক পাল্টে সবুজ টিশার্ট আর কালো টাউজার গায়ে জড়ায়। চুলগুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করে নিতে নিতে চোখ সোফায় যায়। তনুজা একটু নড়ে। হাত দু’টো মাথার নিচে দেয়। তনুজার পেট থেকে কাপড় সরে গিয়ে মসৃণ মেদহীন পেট দেখা যাচ্ছে। বুকের উপর থাকা আঁচলও একপাশে সরে আছে। ইভান শুকনো ঢোক গিলে নেয়। তার পুরুষালি নজরকে সে ঘুরিয়ে নেয়। ইভান বিছানায় বসে তার বিবেকে বাঁধছে। মেয়েটা সোফায় কীভাবে শুয়ে আছে। পাশ ফিরতে গেলে যদি পরে টরে যায়। এভাবে, ঠিক হচ্ছে কী?
আবার বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সারাদিনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে ছিলো না, আবার খানিক আগে থেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজকের ওয়েদারটা ঠান্ডা। তনুজার গুটিসুটি হয়ে শোয়ার কারন, ওর বোধহয় শীত লাগছে। ঠোঁট দুটোও থেকে থেকে কাঁপছে। অনেকক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকার পর ইভান তনুজার কাছে এগোয়। আচমকা তনুজার মুখের উপর থাকা চুলগুলো একহাতে সরিয়ে দেয় ইভান। তারপর সকল দ্বিধাকে কাটিয়ে তনুজাকে কোলে তুলে নেয়। আলগোছে তনুজাকে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়। পরপর লাইট নিভিয়ে। ডিম লাইট জ্বালিয়ে নিজেও একপাশে শুয়ে পরে। তনুজার শীত শীত অনুভব হচ্ছিল। তনুজা ঘুমের মধ্যেই এগিয়ে আসে, ইভানের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে জুবুথুবু হয়ে শোয়। মেয়েলি শরীর গায়ের সাথে লাগায় ইভানের শরীর শিহরিত হয়। ইভান দুইহাত দিয়ে তনুজাকে দূরে সরিয়ে দেয়। পর পর চাদর টেনে তনুজার গায়ের উপর দিয়ে দেয়। বড় বড় শ্বাস ফেলে ইভান উল্টো পাশ ঘুরে শুয়ে পরে।
_____________
আকাশ যেন গুঙিয়ে কাঁদছে। আকাশের বুক চিঁড়ে কান্নারা বৃষ্টি হয়ে ধরণীতে নামছে। কাঁদছে দিব্যর বুকের ভেতরটা। শান্তি মিলছে না তার। ঘুম নেই চোখ দুটোতে। দিব্যর কষ্ট, রাগ, ক্ষোভ সব আজ মিলেমিশে একাকার হয়েছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট শেষ করছে দিব্য। বেনসন সিগারেটের প্যাকেটটা আর কিছুক্ষণ গেলেই খালি হলো বলে। মুখটা উঁচুতে তুলে ধোঁয়া ছেড়ে খানিকক্ষণ আকাশের দিকে নিস্প্রভ চাহুনিতে চেয়ে রয়। এরমধ্যে মোবাইলে রিং হয়। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে আন্নাউন নম্বর দেখে কপাল কুঁচকে আসে দিব্যর। খানিক সময় নিয়ে রিসিভ করে সে।
-” হ্যালো, কে?”
ওপাশ থেকে কোন শব্দ আসে না। দিব্য আবার বলে,
-” হ্যালো, কে? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?”
তবুও কোন সারা শব্দ পাওয়া যায় না। দিব্যর এবার রাগ হয়। দিব্য বকে কিছু বলবে, তার আগেই মেয়েলি ভয়েজ আসে। দিব্যর কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঞ্চিত হয়। তার সুডৌল সুন্দর কপালের ভাঁজ প্রগাঢ় হয়। কণ্ঠটা কার মস্তিষ্ক জানান দিতেই মাথায় র’ক্ত উঠে দিব্যর।
#চলবে