প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-০৬

0
274

#প্রণয়ের_বাঁধন |৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

-” হ্যালো, বেব? হাউ অ্যাবাউট ইউ?”

পরিচিত মেয়েলি স্টাইলি ভয়েজ শ্রবণ হতেই দিব্যর চড়িয়ে থাকা মেজাজ দ্বিগুণ হয়। দিব্য রাগে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। শক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠে,

-” আবার কেনো কল করেছো? তোমাকে ওয়ার্ন করা সত্বেও নিউ নম্বর দিয়ে আমাকে আবার কল দেওয়ার সাহস কোথায় পেলে তুমি? আর কী চাই তোমার?”

-” তোমাকে চাই।”

পাতলা ওষ্ঠজোড়া নেড়ে বিড়বিড়িয়ে বলে তৃষা। যা ফোনের এপাশে থাকা দিব্যর কানে পৌঁছায় না। তৃষা দিব্যর কথা আজ আর গায়ে মাখল না। তৃষা নড়েচড়ে বসে। মুখে একটা পৈশাচিক হাসি ঝুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,

-” কুল কুল…কুল বেইব! এতো হাইপার হওয়া ঠিক নয়। উত্তেজিত হওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষ/তিকর। আমি আবার বরাবরই তোমার ভাল-মন্দের দিকে একটু বেশিই নজর দিয়ে থাকি। তোমার ভালো চাই, তাই বলছি শুধু শুধু উত্তেজিত হয়ে প্রেশার বাড়িয়ো না, ডার্লিং।”

তৃষার ন্যাকামি কথা শুনে দিব্যর গা জ্বলে উঠল। দিব্য তেজি গলায় বলে,

-” ন্যাকামি বন্ধ করো। আর তোমার মতো মেয়ে কারো ভালো চায়! হাহ! হাসালে! ড্রামা বন্ধ করো।”

শেষের কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বলে দিব্য। তৃষা ডিভানে গা এলিয়ে দেয়। পরপর মাথার নিচে একহাত রেখে অন্যহাতে ফোনটা কানে চেপে বলে,

-” আচ্ছা আমার কথা বাদ দাও। তা তোমার পেয়ারের ফেরেশতার মতো ভালো ফারিশতা নূর তনুজার কী খবর? বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে যাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেই তার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকলে। তারপর সেই মেয়েটার জন্য আমাকে ইগনোর করতে শুরু করলে। তা তার কথা কিছু বলো? বলো বলো আমায়। আমি খুব এক্সাইটেড তার ব্যাপারে শুনতে।”

দিব্য কিছু বলে না, নিরুত্তর থাকে। তৃষা শব্দ করে জ্বলুনি দেওয়া হেসে ফের বিদ্রুপের সুরে বলে,

-” দিব্য বেইব! যার জন্য আমাকে খা’রা’প বলেছিলে। আমাকে প্রো/স্টি/টিউট বলতেও তোমার মুখে আটকায়নি। সেই তনুজা ওরফে তোমার তনু। তোমার সতী সাবিত্রী তনু! সে কী করল? কী করল? তার প্রেমিকের বাড়িতে থেকেই, প্রেমিকের বড় ভাইয়ের সাথে ফ/ষ্টিন/ষ্টি করলো।”

-” জাস্ট শাট আপ! মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ। মুখ সামলে কথা বল। সামনে থাকলে তোকে আমি খু/ন করে ফেলতাম। একদম শেষ করে ফেলতাম তোকে। তনুজা সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলবি না। আর তোর কোন যোগ্যতা নেই নিজেকে তনুজার সাথে কম্পিয়ার করার। আর তোর কী মনেহয় তোর আর লিও-র ক্লোজ ছবিগুলো দেখার পরেও আমি তোর সাথে রিলেশন রাখবো! আরে তোর মতো বা/জে মেয়ের দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছে আর সময় কোনটাই সাফওয়ান দিব্য মির্জার নেই। আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো তোকে হেল্প করায়। আমার বড় ভুল ছিলো তোর কথাগুলো বিশ্বাস করায়। পরে বুঝলাম ইভান ঠিক ছিলো। আরে তুই তো একটা নোং/রা মেয়ে। তাই তো তোকে নিয়ে সন্দেহ হওয়া ইভানের অস্বাভাবিক ছিলো না। আর তুই মিথ্যে বলে আমার কাছে সিম্প্যাথি নিতে আসলি। আমিও বোকার মতো তোর কথায় বিশ্বাস করে নিলাম। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বললি ইভান তোকে পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতে দিবে না। তাই এই বিয়ে করা সম্ভব নয়। আর ইভান অনেক বেশি প্রজেসিভ। ইভানের এই প্রজেসিভনেস এক প্রকার তোর কাছে অত্যাচার ঠেকছে। তুই মানসিকভাবে ডিপ্রেসড হওয়ার নাটক করলি। উফ্!”

একনাগাড়ে বলে বড় বড় শ্বাস ফেলে দিব্য। তৃষা নিজের সাফাই গাইতে বলে,

-” দিব্য তুমি বুঝতে কেনো পারছো না। এখানকার কালচার এটা। সেদিন লিও-র বার্থডে পার্টি ছিলো। পার্টিতে সকলে ড্রিংক করে থাকে, আমিও করেছিলাম। যা এখানকার নরমাল বিষয়। এটা এমন কী! আর ঐ ছবিগুলো ড্রিংক অবস্থায় থাকাকালীন তোলা।”

দিব্য নিজের রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে নেয়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

-” তৃষা অনেক হয়েছে, ব্যাস। অনেক কষ্টে আমার মুখের ভাষা সংযত রেখেছি। আর সম্ভব হচ্ছে না। প্লিজ কল কে/টে দাও।”

তৃষা এবার রাগে আইঢাঁই করতে থাকে। তৃষা বলে,

-” তনুজা! তনুজা যে এমন একটা জ/ঘন্য কাজ করলো। আমার উপর দেওয়া সেই গালিটা তো তনুজা ডিজার্ভ। সেখানে এখনও তনুজার প্রতি তোমার এত প্রেম আছে কীকরে আমার মাথায় ধরছে না। একজনের সাথে প্রেম করে আরেকজনের সাথে বিছানায় রাত কাটায় তনুজা। এরপরেও বলবে, তনুজা আমার থেকেও বেটার। সতী সাবিত্রী তোমার ভীতু বোকা প্রেমিকা তনুজা। হা হা হা!”

দিব্যর শরীর জ্বলুনি দিয়ে উঠে তৃষার হাসি শুনে। দিব্য একটা কষিয়ে রাম ধ’ম’ক দিয়ে বলে,

-” স্টপ। স্টপ। আ’ম শিওর যা কিছু হয়েছে সব ইভান করেছে। ইভানের প্ল্যান করে করা সব। আমি তনুজাকে চিনি। খুব ভালো করে চিনি। আমাদের পাঁচ মাসের রিলেশন ছিলো। এই পাঁচ মাসে কখনো ওর হাত ধরারই সাহস পাইনি আমি। আর না তো তনুজা সুযোগ দিয়েছে। এর-ও ক’মাস আগে থেকে তনুজাকে চিনি আমি। আমার থেকে বেশি ওকে কেউ চিনে না। তাই পুরো পৃথিবী তনুজাকে খারাপ বললেও আমার বিশ্বাস হবে না।”

একটু থেমে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে দিব্য,

-” বাই দ্য ওয়ে। তুমি এতকিছু কী করে জানলে? মাত্র দুইদিনের মধ্যেই আমার বাড়ির সকল খবরাখবর কে পৌঁছালো তোমার কাছে?”

তৃষা এবার অপ্রস্তুত হয়। সময় নিয়ে পরপর কিছু শব্দ গুছিয়ে নেয়। সে বলে,

-” ইয়ে খবর কখনো বসে থাকে নাকি। তোমার আর তনুজার প্রেম কাহানি যেভাবে শুনেছিলাম, সেভাবেই।”

-” মিথ্যে বলবে না। এত দ্রুত তো তোমার জানার কথা নয়। ”

তৃষা ঢোক গিলে নেয়। আমতা আমতা করে বলে,

-” আ আরে এসব খবর বাতাসের আগে উড়ে। তুমি জানো না।”

দিব্য কিছু বলে না। কপালের ভাঁজ মিলিয়ে ঠোঁট কামড়ে নীরব থাকে দিব্য। তৃষা কিছু ভেবে কৌশলে শুধোয়,

-” আচ্ছা দিব্য তুমি বলছো, ইভানের প্ল্যান এসব। তোহ তোমার কী মনেহয় ইভান কেনো প্ল্যান করে করেছে এটা!”

-” ইভান তোমাকে না পাওয়ার জন্য আমাকে দায়ী করে। আর হয়তো ও জেনেছিলো আমি তনুজাকে ভালোবাসি। তাই হয়তো আমার থেকে তনুজাকে কেড়ে নিয়েছে। নোংরা গেইম খেলে।”

তৃষা ঠোঁট টিপে শব্দহীন হাসলো। মনেমনে ছক কোষে দিব্যকে ফের দাবার গুটি বানাতে চাইল। গলার আওয়াজ বেদনার্ত বানিয়ে বলল,

-” সো স্যাড, দিব্য। দিব্য আমি তোমার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছি। ইভান শুধু তনুজাকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ওর আরো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে। ও তোমাকে আরো কষ্ট দিতে চায়। ইভান চায় তুমি তাকে আর তনুজাকে একসাথে দেখে প্রতি মূহুর্তে জ্বলো , ছটফট করো, কষ্টে থাকো। দিব্য..দিব্য তুমি ইভানকে সাকসেস হতে দিও না। তুমিও ইভানকে দেখিয়ে দাও। উল্টো ইভানের জ্বলুনি, ছটফটানি হয় তাই করো।”

-” কী করে?”

তৃষা মনেমনে খুশি হলো। যাক টোপ টা কাজে আসছে বোধহয়।

-” আমাকে বিয়ে করে।”

-” মানে?”

-” আগে আমার কথাটা ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবো। তুমি যদি আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাও। তাহলে ইভান তোমার পাশে আমাকে দেখে রাগে, ফুঁসতে থাকে। আর এটা প্রুভ হবে তুমি মোটেই তনুজাকে হারিয়ে শোকে কাতর হওনি। তনুজা তোমার বাজি ধরা প্রেমই ছিলো। আর তোমার জন্য তো আমিই ছিলাম। তোমাকে আর আমাকে দেখলে ইভান লুচির মতো ফুলবে। গো বেচারা ইভান। সে আর তোমার কষ্টে পৈশাচিক আনন্দ নিতে পারবে না। উল্টো নিজের কষ্ট বাড়বে।”

-” অসম্ভব! তোমার কথা শুনে একবার জীবনে বড় ভুল করে ফেলেছি। সেই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাকে। তনুজাকে হারিয়ে। প্রকৃতির বিচার কথাটা মিথ্যা নয়। আমি হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাচ্ছি। আর ইভানের থেকে প্রতিশোধ নিতে, আমি একাই যথেষ্ট। তারজন্য জেনেশুনে তোমাকে নিজের গলায় কাঁ/টা হিসেবে নিতে আমি চাই না। না পারব গিলতে আর না পারব উগড়াতে। আর আমি তনুজার সামনে প্রমাণ দেবো, ইভান ইচ্ছে করে ফাঁদে ফেলে তাকে বিয়ে করেছে। সবার সামনে ইভানের ভালো মানুষীর মুখোশ খুলব। আমার মনেহয় তনুজা প্রমাণ পাওয়ার পর, ইভানকে ডিভোর্স দিতে রাজি হবে।”

-” আমি বললাম। তুমি ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবো। এদিকে প্রমাণ যোগাড় করতে থাকো। যদি প্রমাণ না পাও। ইভানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সেকেন্ড অপশন হিসেবে আমাকে নিতে পারো। আচ্ছা দিব্য, তুমি ভাবতে থাকো। আর আমি খুব দ্রুতই দেশে ফিরছি। দেশে ফিরে ফেস টু ফেস কথা বলবো। এই ক’দিনে তুমি ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। ইভানকে সাকসেস হতে দিবে নাকী উলটো ওকেই ঘোল খাওয়াবে।”

দিব্য আর কিছু না শুনে কল কেটে দেয়। তৃষা ভাবতে থাকে। নির্বোধ দিব্য। ঠিক রাজি হবে। তনুজাকে হারানোর শোকে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে, দিব্য খ্যাপাটে হবে। সে ইভানকে কষ্টে দেখতে চাইবেই। আর তৃষার টোপ গিলবে। আর টোপ গিললেই তৃষার আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া পূরণ হবে। এইভেবে তৃষার চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করতে থাকে।

___________

ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে চারিদিক থেকে। তনুজার ঘুম হালকা হয় এবার। তনুজা নিভু নিভু চোখে তাকানোর চেষ্টা করে। চোখ মেলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে, গায়ে চাদর জড়ানো দেখে অবাক হয়। তনুজার স্পষ্ট মনে আছে ও তো সোফায় শুয়েছিলো। তাহলে এখানে এলো কী করে? মাথাটা ঘুরিয়ে খানিকটা দূরত্বে ইভানকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখতে পায়। তনুজার অস্বস্তি হতে থাকে। ওর অবচেতন মন আওড়ায়,

-” তাহলে কী উনি..”

এতটুকু ভাবতেই তনুজার অস্বস্তি হুরহুর করে বাতাসের বেগে বাড়ে। তবে তনুজা বেশ বিস্মিতও হয়। লোকটা তার গায়ে চাদর অব্দিও দিয়ে দিয়েছে। মানুষটা বাইরে যতোটা কঠোর স্বভাব দেখায়। ততটাও কঠোর নয় মনটা। তনুজার বুকটা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। ডিম লাইটের সবুজ আলোয় ঘুমন্ত ইভানকে বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগছে। শ্যামবর্ণ মুখটা থেকে কেমন মায়াময় দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তনুজা দুরুদুরু কাঁপতে থাকা বুক নিয়ে, নির্নিমেষ চাউনিতে চেয়ে থাকল ও মুখটাতে। পর পর দৃষ্টি ঘুরিয়ে উঠে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। দুইহাতে হাঁটু জড়িয়ে মাথাটা হাঁটুতে ঠেকিয়ে কিয়ঃক্ষণ চোখ বুঁজে থাকে। ভেতরটায় অস্থির লাগছে। এভাবেই অনেকটা সময় কাটে। তারপর উঠে অজু করে নামাজ পরে নেয় তনুজা।

____________

সকালে শিরিনের সাথে রান্না করে তনুজা। পুরো সকালটা তার কিচেনেই কাটে। তনুজার দাদি ওকে ঘরকন্নার কাজ সব শিখিয়ে ছিলো। যদিও দাদি কাজ করতে দিতো না তেমন। তারপরেও শিখিয়ে দিয়েছিলেন নিজ হাতে। বিয়ের পর মেয়েদের এসব করতেই হয়। তাই শিখে রাখা ভালো। তনুজাও আগ্রহ নিয়ে দাদির কাজ দেখত, মাঝেমধ্যে সাহায্য করতো। সেই থেকেই ঘরকন্নার কাজগুলো তার আয়ত্তে। তনুজা নিস্তেজ হয়ে, রোবটের মতোন কাজ করছিল। ছিলো না মুখে হাসি আর না তো উৎফুল্লতা। রান্না শেষে টেবিল সাজিয়ে রুমে যায় তনুজা। কিচেনে কাজ করতে গিয়ে গরম লেগেছে খুব। আগুনের তাপে থেকে মুখটা কেমন জ্বলছে। মুখে পানির ঝাপটা নেওয়া জরুরী। আর বাতাসে বসে একটু জিরানোও দরকার।

রুমে পা দিতেই দেখতে পায়, পরনে অফ হোয়াইট প্যান্ট। নেভি ব্লু শার্ট গায়ে জড়াতে ব্যস্ত ইভান। চুপচুপে ভেজা চুলগুলো মাথা ছাড়িয়ে কপালেও এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে। তনুজা সে দিকে আর দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে। পরপর হাত দু’টো হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে, ইভান শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। ইভানের দৃষ্টি আয়নায় ছিলো। তনুজা খানিকটা দূরত্বে পিছনে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে। হঠাৎ দু’জনের চোখে চোখ পরে। তনুজা তড়িৎ দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ইভানের থেকে দৃষ্টি লুকাতে শাড়ির আঁচল টেনে মুখ মুছতে ব্যস্ত হয়। ইভান বাম হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বোতাম লাগাচ্ছে। তনুজা কোণা চোখে তা দেখল।

বাম হাত দিয়ে ডানহাতের শার্টের আস্তিন গোটাতে থাকে ইভান। তনুজার অবচেতন মন ভাবে,”একবার কী জিজ্ঞেস করব, হাতের অবস্থা কেমন?” পরপর অদৃশ্য এক দ্বিধা এসে জড়ো হয়। তনুজা দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। শোনা আর হয়ে উঠে না। ডান হাতের শার্টের আস্তিন গোটানো হয়। বাম হাতের আস্তিন গোটাতে গিয়েই সমস্যায় পরে ইভান। তনুজা কোণা চোখে ইভানকে লক্ষ্য করছিলো। ইভান ডান হাতের সাহায্যে বাম হাতের আস্তিন গোটাতে গিয়ে বারবার কপাল কুঁচকে নিচ্ছে। হাতের তালুতে কাঁটায় টান লাগতেই ব্যাথায় কপাল কুঁচকে যাচ্ছে ইভানের। তনুজা চোখ তুলে তাকিয়ে বিষয়টা দেখে। ইভান শার্টের আস্তিন গোটাতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছে। তনুজার হঠাৎ কী হলো। ওর ভেতরের কোমল সত্তা ওকে বারবার উস্কাতে থাকে ইভানকে হেল্প করার জন্য। আর এ-ও স্মরণ হতে থাকে। লোকটা তার কেয়ার নিয়েছে। এই মুহূর্তে তাকে সাহায্য করা জরুরী।

আচমকা তনুজা ইভানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইভানের দিকে পলক তুলে তাকায়। একদম মিহি স্বরে বলে,

-” আপনার হাতে বোধহয় লাগছে। আমার কাছে দিন আমি করে দিচ্ছি।”

ইভান পূর্ণ চাউনিতে তনুজার দিকে তাকাল। কেন জানি না করতে পারল না। চুপচাপ নিজের ডান হাতটা সরিয়ে নিলো। তনুজা ইভানের চুপ থাকাকেই নীরব সম্মতি ধরে নিয়ে তার কোমল হাত দিয়ে ইভানের শার্টের আস্তিন খুব যত্ন সহকারে আলগোছে গুটাতে থাকে। ইভানের নিরেট ধূসর চাউনি তনুজার মায়াবী মুখখানায় নিবদ্ধ হয়েছে। ভাসাভাসা চোখদুটো ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে। কালো চিকন ভ্রু জোড়া ভেজাভেজা। কপালের উপর ছোটছোট অবাধ্য চুলেরা বাতাসে নৃত্য করছে যেন। ইভানের কাছে এই দৃশ্যটা সুন্দর লাগলো। সে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকল। শার্ট গায়ের সাথে আঁটসাঁট। হাতাটাও তেমনি আঁটসাঁট। গুটাতে গিয়ে তনুজার বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। ইভানের লোমশ হাতের সাথে তনুজার হাতের ছোঁয়া লাগছে আর যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হচ্ছে। এমন ঠেকছে তনুজার। সহজ কাজটা অতটাও সহজ নয়। এখন মনে হচ্ছে তনুজার। অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপছে তার। গলাটাও শুষ্ক হয়ে আসছে। হাত দু’টো রিতিমত কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতেই গুটানো শেষ করে। জোর করে শুকনো হেসে সরে দাঁড়ায় তনুজা। নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে হঠাৎ শুধোয়,

-” কাল খাবার খেয়েছিলেন কীভাবে? না মানে হাত জ্বলেনি।”

ইভান আড়চোখে তনুজাকে আরেকপল দেখে চিরুনি বাম হাতে নিয়ে চুলগুলো পরিপাটি করতে করতে জবাবে বলে,

-” স্পুন দিয়ে।”

তনুজা ছোট করে ” ও ” বলে আর বাক্য ব্যয় করে না। তার মনে হলো সে বোধহয় অহেতুক বোকা একটা কথা বলে ফেলেছে।

__________

নাস্তা করতে বসেছে সবাই। নুরজাহান শিরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-” দিব্য কই? খেতে আসলো না যে।”

-” থাক মা। আসেনি যখন পরে এসে খেয়ে নিবে।”

চোখে-চোখে আরো কিছু কথা হয় শাশুড়ি-বউয়ের। নুরজাহান আজ আর কথা বাড়ালেন না। থাকগে! কালকে টেবিলে দুই ভাইয়ের ঝ/গড়া হলো। এখন সামনাসামনি না হওয়াই ভালো। শেষে রাগঢাক করে একজনও খাবারই খাবে না হয়ত। শিরিন তনুজাকে ডেকে বলেন,

-” তনুজা! তুমিও বসে পড়ো। অনেক বেলা হয়েছে।”

-” সমস্যা নেই আন্টি। আমি পরে বসব।”

তনুজা নিচু স্বরে জবাব দেয়। শিরিন অমায়িক হেসে বললেন,

-” পরে কেনো? বস তো।”

নুরজাহান ভ্রুকুটি করে বিরস স্বরে বলল,

-” এতোবার বলছে, সেখানে এতো ঢং কীসের! বুঝি না বাপু। আমাদের সময়ে শাশুড়িরা একবার কিছু বললেই টু শব্দটি তো দূর, অমনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম।”

তনুজা আর কথা না বাড়িয়ে চেয়ার টেনে বসে পরে। নৃত্য নানু আপুর দিকে সরু চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে,

-” নানুআপুর তো কথা একটাই, আমাদের সময়..আমাদের সময়। এই আমাদের সময় আমাদের সময় বলে জিকির তোলে। আমার ভীষণ দেখার শখ নানুআপু যেভাবে বলে সেভাবে সব করেছে কীনা। ইশশ্! যদি একবার ট্রাইম মেশিন করে দেখতে যেতে পারতাম। তাহলে খুব ভালো হতো।”

নুরজাহান খাবার খেতে খেতেই বলেন,

-” বুয়া একটু আগে আমার কাছে এসেছিলো। আজ দুপুরে সে নাকি আসতে পারবে না। ছোট বউমা তো একটু পরেই অফিসে যাবে। এইযে নাতবউ! তোমারে বলছি। কি রান্না করা লাগবে সব শাশুড়ির থেকে শুনে নিও। নিজে সবটা রান্না করবে। বুঝঝো?”

তনুজা কলের পুতুলের মতোন ঘাড়টা কাৎ করে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। নৃত্যর হঠাৎ কিছু মনে হতেই বিস্ময় নিয়ে বলে,

-” আমি তো একটা কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি। কালকে কোচিং থেকে ফিরতে বুয়াকে দেখলাম।”

তামান্না মেয়েকে ধ’ম’ক দিয়ে থামিয়ে দেয়। কর্কশ গলায় বলল,

-” স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খাও। খাওয়ার সময়ও তোমার কথা বলতে হবে। রোজরোজ তুমি কোনো না কোনো কারনে লেট করে ক্লাসে ঢোকো। আর স্কুল থেকে এই নিয়ে আমার কাছে কমপ্লেইন আসে।”

মায়ের বকুনিতে নৃত্যর মুখটা ছোট্ট হয়ে এইটুকুন হয়ে যায়। সে আর কথা না বলে চুপটি মে/রে যায়। তামান্না খাবার চিবুতে চিবুতে বলে,

-” আজ নিতি আসবে। নিতির জন্য কী কী রান্না করা লাগবে আমি বলে দিবো। নিতির খাবারে ঝাল একদম কম দিবে।”

তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলে তামান্না। তনুজা বরাবরের মতোই নিশ্চুপ থাকে। নৃত্য এক্সাইটেড হয়ে বলে,

-” ওয়াও! আপু আসবে! দারুণ মজা হবে!”

.

দরজার পাশে থাকা সু তাক থেকে কালো জুতো জোড়া নামিয়ে পায়ে দিতে থাকে ইভান। উবু হয়ে এক হাতের সাহায্যে জুতাটা পায়ে গলিয়ে নিতে থাকে। এমন সময় পান চিবুতে চিবুতে নুরজাহান হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,

-” দাদুভাই আজ বিকেলের দিকে চলে এসো। নাতবউকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাবে। এখনো তো তার তেমন কিছুই কেনাকাটা করা হয়নি। তাই তাকে নিয়ে আজকে মার্কেটে যাবে।”

তনুজা টেবিল থেকে এঁটো প্লেট সরিয়ে কিচেনে যাচ্ছিল। এমন সময় কথাটা তার কানে আসে। ইভান পরপর বলে উঠল,

-” আমার কাজ আছে। আমি যেতে পারব না।”

-” ওমা তা বললে হয়। বিয়ে হয়েছে। এবাড়ির বউ সে। তার ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমার।”

-” আমি টাকা দিয়ে দিবো। যা লাগে কিনে নিতে বলো।”

নুরজাহান গম্ভীর মুখে বলেন,

-” বাড়ির বউ একা একা কেনাকাটা করতে যাবে। এখনকার দিনকাল ভালো না। না না।”

এই দিদুনকে নিয়ে আরেক জ্বালা। এখন এটা ভালো না, ওটা ভালো না। সব ভালো মনেহয় তার সময়ই ছিলো‌। আশ্চর্য! ইভান বিরক্তিতে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ উচ্চারণ করে।

-” একা যেতে সমস্যা হলে নৃত্যকে সাথে নিতে বলো। আলমারির ডানপাশের ড্রয়ারে টাকা আছে। তাকে নিতে বলো। আমি আসছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

ইভান আর বাক্য খরচ না করে পা চালায়। পিছন থেকে দিদুন আইঢাঁই করতে থাকেন। চেঁচিয়ে বলেন,

-” আজ তোমার কাজ আছে, আজ না হয় কাল নিও। কাল না হয় পরশু। তবুও বাড়ির বাচ্চা মেয়েসহ তাকে একলা দোকানে যেতে দিচ্ছি না।”

ইভান ফিরে তাকায় না। আর কোন প্রত্যুত্তরও দেয় না। সে তার মতো আপন মনে ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করে।

#চলবে