প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-০৯

0
200

#প্রণয়ের_বাঁধন |৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

-” তনুজা..তনুজা তনুজা সামান্য একটা সাধারণ মেয়ের কাছে আমি হেরে যাচ্ছি! কী আছে এই মেয়েটার মধ্যে! যা আমার মধ্যে নেই! মেয়েটা কী আমার থেকেও সুন্দরী? আমার থেকেও বেশি এডুকেটেড? নাকি এই
তৃষা চৌধুরীর থেকেও বেশি স্মার্ট? কোনটা? না না। কোনটাই নয়। তবে কেন, সবাই ঐ মেয়েটার উপরই ফিদা হয়। আমার মাথায় ধরছে না।”

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে তৃষা। সামনের চেয়ারে বসা লিমন মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,

-” আহামরি সুন্দরী নয়। তবে মেয়েটার ফেসের মধ্যে আলাদা একটা মায়াবী দ্যুতি আছে। ঐযে সব ছেলেরা যেমন চায়। একটা ভালো গুণসম্পন্ন মেয়ে। মেয়েটার এই ভালোর গুণ সকলকে তার প্রতি আকর্ষিত করে।”

-” শাট আপ।”

লিমনের মুখে তনুজার গুণগান শুনে তৃষার পিত্তি জ্ব’লে উঠে। কান দিয়ে রা’গে ধোঁয়া বেরুতে থাকে যেন। কষিয়ে ধ’ম’ক দিয়ে লিমনকে থামিয়ে দেয়। লিমন মুখটা গম্ভীর করে থাকে। তৃষা একটু সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

-” দিব্য আমার ফোন তুলছে না। নিউ নম্বর দিয়ে কল দিলে গলা শুনেই কল কে’টে দিচ্ছে। এমনিতেই আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না, আর তুই কীনা আমারই সামনে তনুজার গুণগান করছিস।”

লিমন গোমরা মুখ করে বলে,

-” ও দিকে ফোন দিয়ে ঐ মহিলা তো আমাকে রিতিমত ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে দিয়েছে। আরো টাকা চাইছে। টাকা না দিলে দিব্যকে সব বলে দিবে বলে ভ’য় দেখাচ্ছে। শা/লি জবর বা’ল ফালাইছে আমার। কাজের কাজ কিছুই হলো না। সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। মাঝখানে ব’লির পাঠা আমি হয়ে গেলাম।”

টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে একহাতে থুতনি চেপে ধরে তৃষা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-” ওকে আর কিসের টাকা দিবো? একবার অতগুলো টাকা দিলাম না! তাও যদি প্ল্যান অনুযায়ী কিছু হতো, তাহলে আরো দিতাম। কিন্তু সব তো উল্টো হলো। শুধু শুধুই আমার অতগুলো টাকা লস গেল। একদম লস প্রজেক্ট। এবার মনে হচ্ছে আমের আমও গেল সাথে বস্তাটাও। উফ্!”

-” আমার মনেহয় তোর ইভানকে বিয়ে করে নেওয়াটাই ভালো ছিলো। শেষ দিকে এসে কেন যে দিব্যর দিকে ব্যায়াস হয়ে গেলি, আমার মাথায় ধরলো না। ও ব্যাটা যে রাগি আর জেদি মনেহয় না তোকে__”

কথার মাঝেই তৃষা বলে উঠে,

-” এখন বুঝতে পারছি বড্ড বো’কা’মি করে ফেলেছি। ইভান প্রেমিক হিসেবে খুবই আনরোমান্টিক ছিল। মনে হতো না জানি ওর বেড পারফরম্যান্স কত বা’জে হবে। আর ইভান কেমন একটা শাসনের মধ্যে রাখত। যা আমার মোটেই ভালো লাগত না।”

-” দিব্যকে টেস্ট করেছিস নাকি? যে এখন দিব্যকে চাইছিস!”

-” আরে না! দিব্য আমাকে সেদিন পার্লার থেকে এয়ার পোর্টে ড্রপ করে দিয়েছিলো। তবে তখনও আমাদের মধ্যে কোন রিলেশন ছিলো না। আমি জাস্ট দিব্যকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ছিলাম। ইভানের সম্পর্কে মিথ্যে বলে। আর এটা সত্যি ছিলো ইভান আমাকে বিদেশে পড়াশোনা করতে দিতে রাজি ছিলো না। এটাকে হাতিয়ার করে, আরো উল্টোপাল্টা বুঝ দিয়ে নির্বোধ দিব্যকে ইভানের বিরুদ্ধে নেই। দিব্যর কাছে প্রমাণ করতে চাই ইভান একটা সাইকো, অভার পজেসিভ। ওর সাথে কোন মেয়েই কখনো হ্যাপি হবে না। অবশেষে বিয়ের দিন দিব্য আমায় হেল্প করে। আর হেল্প করতে গিয়েই দুভাইয়ের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়। তারপর বিদেশ যাওয়ার পর দিব্যর সাথে আমার ফোনে যোগাযোগ হতো। যেখানে আমার মেলোড্রামা থাকত। এভাবে ফোনেই আমাদের একটা রিলেশন হয়। আর ফোনেই ব্রেক আপ করে দিব্য।”

-” আমিও বুঝতে পারিনি দিব্য সত্যি সত্যি তনুজার প্রেমে পরে যাবে। সেদিন আমরা বাইক নিয়ে ঘুরতে যাই। রাস্তার পাশে থাকা টং দোকানে চা খাচ্ছিলাম। আমাকে ডেয়ার দেওয়া হয়েছিলো, পথ দিয়ে প্রথম যে যাবে তাকেই প্রপোজ করা। সেদিন প্রথম মেয়েটি তনুজা ছিলো। প্রপোজ করার সাথে সাথেই রিজেক্ট হই আরো কড়া কথা শুনতে হয়েছিলো। এই নিয়ে বন্ধুরা ট্রল করে। দিব্য খুব মজা নেয়। আমি দিব্যর উপর বিরক্ত হয়ে বলি, কত পারিস তুই মেয়েটাকে পটিয়ে দেখা। দিব্য কলার ঝাঁকিয়ে বাজি ধরে মেয়েটাকে প্রেমে ফেলবেই। অবশ্য দিব্যর দারুণ অ্যাক্টিং এর কাছে মাত্র দু’মাসেই মেয়েটি গলে পরে। রোজ রোজ ঐ দিকে যেতো দিব্য। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের দিয়ে ফুল পাঠাতো। আরো যত ভালো কাজ আছে সেসব মেয়েটির সামনে দেখাত। মেয়েটি তো প্রেমে পরল পরল, সাথে স্লিপ কে’টে দিব্যও।”

-” তনুজার উপর এমন অন্ধ বিশ্বাস জন্ম হলো দিব্যর, যে তার কাছে খা’রাপ প্রমাণ করতে গিয়েও হলো না। তার বিশ্বাস রয়েই গেলো তনুজা ইন্নোসেন্ট। আমি চেয়েছিলাম, আমাকে দেওয়া গালিটা স্বয়ং দিব্য নিজে তনুজাকে দিবে। আর দিব্যর দিদুন বুড়িটাকে তো আমি চিনি। বড্ড পুরোনো দিনের ধ্যান ধারণায় ঘেরা যার মনমস্তিষ্ক। বুড়িটা নিশ্চয় তনুজাকে সাথে সাথে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে। তা তো করলোই না, উল্টো ইভানের সাথে জুড়ে দিলো। আর এখন তো আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে শুনে, ইভান বউকে নিয়ে শপিং করছে। সে কী বিয়েটা মেনে নিলো?”

লিমন অসহায় মুখ করে। তাড়া দিয়ে বলে,

-” সেসব আমি জানি না। এখন আমি তো মাইনকা চিপায় পরছি। তোকে তো ঐ মহিলা চেনে না। তোর কথামতো তোকে হেল্প করতে গিয়ে আমি ফেসে গিয়েছি। ঐ মহিলা আমাকে সেই রকম ভ’য় দেখাচ্ছে। এই সপ্তাহের মধ্যে বিশ হাজার টাকা না দিলে দিব্যকে বলে দিবে সব। এখন আমি কী করব?”

তৃষা মোটামোটা চোখে তাকিয়ে বলে,

-” গাধা একটা। ভ’য় দেখালো আর তুই ভ’য় পেয়ে গেলি, আ’জ’ব! ও বলবে না। কজ বললে ও নিজেও ধরা খাবে। কেন সে আমাদের কথামত এরুপ করলো।”

-” যদি তাও বলে দেয় দিব্যকে, তখন!”

লিমন ভীতু ভীতু মুখ করে বলে। তৃষা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

-” পরের টা পরে দেখা যাবে। তুই আমাকে হেল্প কর, আমাকে দিব্যর সাথে কথা বলার সুযোগ করে দে। আমার পক্ষে দিব‌্যর কাছে সাফাই গাইবি।”

এরমধ্যে তৃষার ফোনে কল আসে। কথা শেষ করে। তারপর তৃষা বলে,

-” ও তোকে তো বলাই হয়নি। নেক্সট সপ্তাহ থেকে আমি *****কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করছি। আর বিদেশ যাচ্ছি না। পাপা ফোন দিয়ে শিওর হলো আমি জয়েন করবো কীনা।”

___________

দু’তিন দিন পর…

সুন্দর ঝলমলে বিকেল। পরিষ্কার আকাশ। আকাশপানে গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র মেঘের ভেলা হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। আলিশান গেট পেরিয়ে ইভানের কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটা ঢুকল। পরপর গাড়ি থেকে নেমে ত্রস্ত পায়ে ইভান ছুটল। এই সময় তার বাড়ি আসার কথা নয়। ওদিকে ফোনের পর ফোন দিয়ে দিদুন তাকে বি°র°ক্ত করে তুলেছে। তনুজার দাদি নাকি অসুস্থ নাতনিকে দেখতে চেয়েছেন। নুরজাহান বেগম ফোনে কথা দিয়েছেন আজকে বিকেলে ইভানের সাথে তনুজাকে পাঠাবে। ইভান প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু দিদুন সে তো নাছোড়বান্দা। সে ফোনে কথা দিয়েছে। এইজন্য হলেও ইভানকে তনুজাকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। ইভান অবশেষে রাজি হয়। আর ফোনে বলে তনুজাকে রেডি হয়ে থাকতে। তনুজাকে রেডি হয়ে নিচে বা লিভিং রুমে থাকতে না দেখে ইভানের রা’গ লাগল। গটগট পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে সে।

একটু আগে নৃত্য এসে বলে গিয়েছে,

-” নানুআপু রেডি হতে বলেছে তোমায়। ভাইয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে।”

তনুজা শোনার পরপর হাতের কাজ সেরে গোসল নিয়ে এখন রেডি হচ্ছে। তনুজা ওয়াল সেট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কোণা কোমড়ে গুজছে। এমন সময়,

-” কখন না আমি ফোন দিয়ে বলে দিয়েছি, এখনো রে__”

দরজাটা ভিড়ানো ছিলো। লকড করা ছিলো না। ইভান একহাতে ধাক্কা দিয়ে ঠা করে দরজাটা খুলে রুমে পা বাড়ায়। কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই নজর যায় তনুজার দিকে। মুখটা তার হা হয়ে থাকে। গায়ে ব্লাউজ আর পেটিকোট। তনুজা শাড়ি কোমড়ে পেচাচ্ছিল। পরপর দরজার শব্দ, ইভানের গলা শুনে চমকায়, হকচকিয়ে উঠে তনুজা। লজ্জায় আড়ষ্টতায় বাকশুন্য হয়ে যায় তনুজা। ইশশ্! কী লজ্জাকর অবস্থা। কেনো যে দরজাটা লক করে নেইনি সে। সাধারণত এ রুমে কেউ আসে না। তাই তার অতটা খেয়াল হয়নি। আর খুব প্রয়োজনে কেউ আসলেও নক করে আসে। তনুজা তড়িৎ শাড়িটা তুলে দু’হাত আড়াআড়ি করে বুকে জড়িয়ে নেয়। সাথে সাথে উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়ায়। ইভান সম্বিৎ ফিরে পেতেই ফাঁকা ঢোক গিলে নেয়। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করতে তাড়া দেখিয়ে বলে,

-” আমি নিচে ওয়েট করছি। তুমি ফাস্ট আসো। তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আমাকে অফিসে যেতে হবে।”

তনুজার নিঃশ্বাস উঠানামা করছে। মুখ দিয়ে রা শব্দটিও বেরোচ্ছে না। উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়েই মাথাটা কাত করে হ্যা সূচক জবাব দেয়। ইভান রুম থেকে যেতেই কড়া ম্যান পারফিউমের সুঘ্রাণটা মিলিয়ে আসে। তনুজা এই ঘ্রাণটার সাথে এ কদিনে বেশ পরিচিত হয়েছে। লোকটা রুমে থাকলেই রুমময় এই সুঘ্রাণটা ছড়িয়ে থাকে। রুমের বাতাসে মিশে থাকে ঘ্রাণটা। একটু সময়ের জন্য ছিলো তাও ঘ্রাণটা তনুজার নাসারন্ধ্রে পৌঁছে যায়। ইভানের প্রস্থান টের পেতেই তনুজা তড়িঘড়ি করে এসে দরজা আঁটকে দেয়। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে।

তনুজা চকলেট কালারের সিল্কের শাড়ি পরেছে। শ্যাম্পু করা ভেজা কোমড় সমান চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। শাড়ির আঁচল ডান বগল গলিয়ে সামনে টেনে রাখা। একহাতে কুঁচি আগলে সিঁড়ি দিয়ে আলতো পায়ে হেঁটে নামতে থাকে। ইভান সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। তনুজা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইভানকে স্ক্যান করলো, সাদা শার্টের উপরে কালো ব্লেজার। ব্লেজারের বোতামগুলো খোলা। কালো প্যান্ট আর কালো সু। শ্যামবর্ণ মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর এসে ঘেমে লেপ্টে রয়েছে। তন্মধ্যেই নুরজাহানের গলার স্বর আসলো। যে কীনা লিভিং রুমেই বসেছিলো।

-” ঐতো নাতবউ রেডি হয়ে আসছে।”

ইভান চোখ তুলে একপল তনুজার দিকে তাকায়। পরপর উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাতে উপরের ব্লেজারটা টেনেটুনে ঠিক করে। নুরজাহান ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” দাদুভাই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছো। মিষ্টি আর ফলমূল নিয়ে যেয়ো কিন্তু। তোমরা তো এখনকার ছেলেপুলেরা শিক্ষিত হলেও এসব ব্যাপারে কান্ডজ্ঞান, জানাশোনা নেই বললেই চলে। খালি পারো টাকা খরচ করে হারাম গিলতে। যা বুদ্ধি শুদ্ধি কমিয়ে ফেলে। সাথে পা/প কাজে উৎসাহিত করে।”

ইভানের সাথে তনুজাও বুঝল। দিদুন ম/দ খাওয়াকে নিয়ে সুক্ষ্ম খোঁচা দিলেন। ইভান হা-হু কিছুই না বলে লম্বা কদম ফেলে হাঁটছে। তনুজা নুরজাহানের সামনে দাঁড়িয়ে সৌজন্যতা করতে নম্র স্বরে বলে,

-” দিদুন আসি।”

-” আচ্ছা যাও। তা সন্ধ্যার পরপরই চলে এসো কিন্তু। বেশি রাত করো না। নেহায়েতই তোমার দাদি অসুস্থ তাই যেতে দিচ্ছি। তাছাড়া অমন বাপের বাড়ি আমার বাড়ির বউকে কস্মিনকালেও যেতে দিতাম না।”

তনুজার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।

.

ইভান ড্রাইভ করছে। পাশে বসা তনুজার খোলা চুল বাতাসে উড়ে এসে বারবার ইভানের মুখের উপর পরছে। শ্যাম্পু করা চুলের গন্ধটা কেমন মা’দ’কতার মতো ঠেকছে। ইভানের ভেতর কেমন শিহরণ জাগাচ্ছে। পাশে বসা রমণী কী এসব খেয়াল করছে! উঁহু! তার দৃষ্টি তো জানালা দিয়ে বাইরে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে কোন ধ্যানে আছে আল্লাহ মালুম! ইভান থেকে থেকে হাত দিয়ে নিজ মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। আবার পরপর বাতাসে এসে মুখে আঁছড়ে পরছে। এতে ইভানের বিরক্ত লাগছে না। ইভানের কেনো জানি তনুজাকে চুলটা বাঁধতে বলতেও ইচ্ছে করছে না। ইভানের মন তার সাথে বেইমানি করছে। এই মা”দক’তা মেশানো ঘ্রাণটা তার নিতে ইচ্ছে করছে। কেমন অদ্ভুত শিহরণে শিহরিত হচ্ছে তার তনুমন।

গাড়ি হঠাৎ জ্যামে আটকায়। গরম লাগছিলো ইভান শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে দেয়। পরপর এসি অন করে দেয়।

গাড়িতে বসে তৃষা। জ্যামে পড়ায় বি’র’ক্তিতে অস্ফুটে সে আওড়ায়,

-” ধ্যাত। এইজন্য এই শহরটাকে বি’র’ক্ত লাগে। যে কয় মিনিটের রাস্তা হয় তার থেকেও ডাবল সময় জ্যামে বসে থাকতে হয়।”

এই বলে ঘাড়টা বাম দিকে ঘুরাতেই থমকায়। দুইহাতে চোখ ডলে নেয় সে। তারপর গাড়ির রংটাতেও নজর বুলায়। হ্যা সে যা দেখছে আর ভাবছে তা সত্যি। তৃষা অস্ফুটে বলে,

-” ইভান! ওটা ইভান না? হ্যা ইভানই তো।”

তৃষা জানালার দিকে মুখটা এগিয়ে দেখতে থাকে। ইভান একহাতে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করছে। ছেলেদের চিরাচরিত স্বভাব এটা। তৃষার দৃষ্টি আঁটকে যায়। শ্যামবর্ণ মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, গায়ে সাদা কালো ড্রেসআপ। হাতে কালো হাতঘড়ি। উফ্ফ! দারুণ আকর্ষণীয় লাগছে ইভানকে। ইভান কী আগের থেকে সুন্দর হয়েছে! নাকি তার চোখেই আজ একটু বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে। এই শ্যাম রংটাকেই তো সে উপেক্ষা করেছিলো। তবে আজ মনে হচ্ছে ইভানের সাথে এই রঙটাই পার্ফেক্ট। লম্বাটে মুখ চোখা নাক। গম্ভীর এটিটিউড। যখন তৃষা ইভানকে দেখতে ব্যস্ত সেইসময় তার নজর যায় পাশের সিটে বসা তনুজার দিকে। তবে তনুজা মুখটা ঘুরিয়ে জানালার দিকে রাখায় মুখ দেখতে পায় না সে। তৃষা ধারণা করে নেয় ওটা নিশ্চয় তনুজা হবে। তৃষার হঠাৎ আফসোস হয়। তনুজার সিটটায় তো তার বসার কথা ছিলো। ঐ সিটে তো সে বেশ কয়েকবার বসেছেও। তৃষার কোথাও জ্বলতে লাগল। তৃষা নিম্নোষ্ঠে দাঁত বসিয়ে ভাবে,

-” ইভান কী ঘাড় ঘুরিয়ে একপল এদিকে তাকাবে? আর যদি তাকায়, তাহলে তাকে দেখে কী রিয়াকশন হবে?”

__________

বাড়ির মেইন ফটকের একপাশে ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিতি। ফর্সা গায়ে হলুদ কামিজ, সাদা চুড়িদার আর সাদা ওড়না। ওড়নাটা কাঁধের উপর দিয়ে একসাইডে রাখা। হাত দু’টো একসাথে করে সে রাস্তা বরাবর উঁকি দিয়ে রিকশা খুঁজছে। এমন সময় শব্দ শুনে পিছন ফিরে দিব্যকে দেখতে পায়। যে কীনা বাইকে চড়ে বসে চাবি দিয়ে চালু করছে। দিব্যর আপাদমস্তক নজর বুলায় নিতি। কালো শার্ট ছেড়ে দিয়ে পরা, উপরের তিনটা বোতাম খোলা থাকায় লোমহীন ফর্সা বুকের ছাতি দেখা যাচ্ছে। শার্টের আস্তিন কনুই অব্দি গোটানো। কালো গ্যাবার্ডিন, কালো কেডস। নিতির চাউনি হঠাৎ শীতলায় কেমন ছেয়ে যায়। এক পশলা ঠান্ডা বাতাস যেন ছুঁয়ে গেলো নিতির তনুমনে। কিছু ভেবে নিতি চোখের পাতা পিটপিট করে ভাবে,

-” ব্যাটা কোনো শোক সভায় যাচ্ছে নাকি! পুরো কালোময় ড্রেসআপ।”

ঠোঁট কামড়ে আনমনে হাসে নিতি। ফের মনেমনে আওড়ায়,

-” তবে ব্যাটাকে এই লুকে একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে। উফ্! হায় মে মারজাওয়া!”

নিতি ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে যায়। দিব্য একপল তাকিয়ে দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে ইশারায় বোঝায়,

-” কী?”

নিতি ফট করে দিব্যর বাইকে বসতে বসতে বলে,

-” আমাকে নীলক্ষেত ড্রপ করে দিবে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রিকশা-টিকশা কিছুই পাচ্ছি না।”

দিব্য বাইক বন্ধ করে ফট করে একলাফে নেমে দাঁড়ায়। সরু চোখে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে গলার আওয়াজ তুলে বলে,

-” নাম..নাম নাম বলছি। আমি ওদিকে যাচ্ছি না। তাই সম্ভব নয়।”

নিতি গোমরা মুখ করে,

-” আরে রিকশা পাচ্ছি না জন্যই তো তোমাকে একটু বললাম। তা না হলে অন্যসময় যেচে লিভ দিতে চাইলেও তোমার বাইকে চড়তাম না, হুঁ। এই রোদের মধ্যে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। রিকশার দেখা মিলছে না।”

-” বাড়ির গাড়িতে যা।”

-” গাড়ি আমার জন্য আমার শ্বশুর রেখে গিয়েছি নাকি! আ’জ’ব!”

-” ফা/লতু কথা বলে টাইম ওয়েস্ট না করে জলদি নাম। আমি তোকে বাইকে চড়িয়ে নিতে পারব না। নাম তুই।”

একহাত কোমড়ে রেখে দিব্য বলে। নিতি ঠোঁট উল্টে বলে,

-” আরে সত্যি বলছি তো। বাড়িতে দু’টো গাড়ি। একটা ইভান ভাইয়া তার বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলেন। আরেকটা গাড়ি তো মামার কাছে। মামা নিয়ে অফিসে গিয়েছেন।”

দিব্য ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বাইকে বসলো। বাইক স্টার্ট দিতে থাকে। বাইক চলছে পিচের রাস্তা দিয়ে। কিছুক্ষণ পরে পেটে মেয়েলি হাতের স্পর্শ পেয়েই দিব্যর সুড়সুড়ি লাগল। নিতি একহাতে দিব‌্যর পেট পেঁচিয়ে ধরেছে। দিব্য ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

-” নিতি হাতটা সরা। ছোট বাচ্চা মেয়ে না তুই, যে পরে যাবি।”

নিতি ইন্নোসেন্ট ফেস করে বলে,

-” তুমি খুব জোরে বাইক চালাচ্ছো আমার ভ’য় লাগছে। যদি পরে যাই। তাই।”

দিব্য পিচের রাস্তায় দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলো,

-” আমার অতো টাইম নেই। আর যত দ্রুত তোকে নামাতে পারি ততই শান্তি। উজবুক একটা।”

নিতি হাত সরায় না। একটা হাত কোলের উপর রেখে, অপর হাতটা অমনি দিব্যর পেট পেঁচিয়ে শার্ট আঁকড়ে ধরে বসে রইল। বাতাসে দিব্যর শার্ট পতপত শব্দ তুলে ফুলেফেঁপে উঠছে। নিতির কাছে মূহূর্তটা ভালো লাগছে। দিব্য কর্কশ গলায় শুধোয়,

-” তা নীলক্ষেত কী মহাকাজ আছে তোর? সেখানে এখন যাওয়ার কারন টাই বা কী?”

নিতি ঝটপট উত্তর দেয়,

-” বই কিনতে। কিছু গল্প আর উপন্যাসের বই লাগবে। মলাট বই। অনেকদিন হলো বই কেনা হয় না।”

দিব্য ত্যাড়া করে বলে,

-” তোহ তুই কী তোর বাপ নেওয়াজ শরীফের মতোন সাহিত্য মনা হয়ে যাচ্ছিস। তোর বাপের মতো লেখক হয়ে যাচ্ছিস না ত_”

এরমধ্যে দিব্য থেমে যায়। মুখ দিয়ে অস্ফুটে ‘আউচ’ শব্দ বের হয় তার। বাবাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলায় নিতি রাগ করে দিব্যর পেটে চিমটি কা’টে। শার্টের উপর দিয়েই চিমটি দিয়ে নখ বসিয়ে দেয় নিতি। ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে দিব্য। একহাতে পেট থেকে শার্টটা একটু উঁচিয়ে দেখে ফর্সা মেদহীন পেটে দুইটা নখ বিঁধে র/ক্ত জমাট বেঁধে আছে। এইদেখে পরপর বাইকের গতি স্লো করে ঘাড় ফিরে নিতির দিকে র/ক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় দিব্য। রাগি স্বরে বলে,

-” ইচ্ছে তো করছে তোকে পাশের ড্রেনে ছুঁ’ড়ে ফেলতে। নেহায়েৎই একমাত্র ফুপির মেয়ে বলে আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেলি। উফ্! রা/ক্ষুসী একটা এভাবে চিমটি কা’টলি কেনো?”

-” তুমি আমার পাপাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেছো। তারপর ইচ্ছে করে ভুলভাল নাম বলেছো। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আমার পাপা বানিয়ে দিলে। আমার পাপার নাম নেওয়াজ শরীফ নয়। আমার পাপা হলেন নেওয়াজ করিম। শুনেছো?”

নিতি নামগুলো টেনে টেনে জোরে জোরে বলে। দিব্য মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে,

-” জানি জানি। ঐ একই হলো।”

-” মোটেই এক হলো না। আর আমার পাপাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার শাস্তি স্বরুপ চিমটি কে/টেছি। হাহ।”

কথাটা বলে ভেংচি কাটে নিতি। এরমধ্যে দিব্যর ফোনে রিং হয়। পকেট থেকে এয়ারপোড বের করে কানে দেয় দিব্য। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে লিমনের স্বর আসে,

-” হ্যালো,দিব্য? তুই কই?”

-” আসছি আমি। আমার একটু দেরি হবে। ওয়েট কর।”

লিমন ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বলে,

-” দোস্ত তোকে একটা কথা বলার ছিলো। সামনে বলতে ভ’য় হয়। তোর যে রাগ। রেগে নাকমুখ ফাটিয়ে দিতে পারিস। তাই ফোনেই বলছি।”

দিব‌্য বিরক্ত হয়ে বলে,

-” মেয়েদের মতো ন্যাকামি আর ভনিতা না করে সোজা বল।”

-” দোস্ত তৃষা দেশে আসছে।”

-” তোহ?”

দিব্য শান্ত গলায় প্রশ্ন করে। লিমন কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

-” দোস্ত তৃষা তোর সাথে কথা বলতে চায়। আর তৃষা না অনেক চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। তুই একটিবার ওকে সুযোগ দে। তৃষা আর বিদেশে যাবে না। এখানেই স্যাটেল হবে। ও সুন্দর করে ওর জীবনটা সাজাতে চায়। আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ে করে ঘর-সংসার করতে চায়। তাই বলছি তুই তৃষার সাথে সবটা ঠিক করে নে।”

দিব্য খুবই শান্ত গলায় বলে,

-” বুঝলাম না তৃষার জন্য তোর এত দরদ উথলে উঠেছে কেনো! যাইহোক তৃষার যদি এতই ঘর-সংসার করতে ইচ্ছে হয়। আর তোর যদি এতই দরদ উথলে পরে, তাহলে এককাজ কর।”

একটু থেমে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবে দিব্য। নিতি কানটা খাঁড়া করে দিব্যর কথা শুনছে। এয়ারপোড দিব‌্যর কানে, তাই ওপাশের কথা কিছুই জানে না নিতি। দিব‌্য একহাতে কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে ফিচেল হেঁসে বলে,

-” তৃষার জন্য একটা মুস্তাক দাদু খুঁজে দে। ওর জন্য ওটাই বেস্ট।”

#চলবে