প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-১৫+১৬

0
165

#প্রণয়ের_বাঁধন |১৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

রৌদ্রজ্জ্বল ঝলমলে নতুন দিন। সকাল থেকে কিচেনে রান্না করতে খুব ব্যস্ত তনুজা। নতুন বুয়া এখনো ঠিক করা হয়নি। ওদিকে শিরিন সুলতানার মাথাটা ধরেছে, তাই এখনো নিচে আসেনি। আজ সকল কাজ ত্রস্ত হাতে একা একাই করছে তনুজা। এতটুকু দম ফেলানোর ফুরসত মিলছে না তার। টেবিলে নাস্তাগুলো একএক করে সাজানোর সময় তামান্না এসে চেয়ার টেনে বসল। কপাল কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-” আজ এত বেলা হয়েছে তা কেউ ডাইনিংয়ে এখনো আসছে না যে। আর এসেই বা কী করবে! এখনো তো ব্রেকফাস্ট তৈরিই হয়নি। তা কী এতো রান্না করলে যে এতো বেলা হয়ে গেলো?”

একা হাতে সবকিছু করতে যে ঢের সময় লাগে; যে নিজে রান্না করে তা কেবল সেই জানে। শুয়ে-বসে শরীর না নাড়িয়ে চলা মানুষ তা কীকরে জানবে? আর বুঝবে! তনুজার জায়গায় অন্যকেউ হলে এভাবে বলতে দু-দু’বার ভাবতো না। কিন্তু তনুজার ধাতে নেই কারো সাথে রুড আচরণ করা। তাই তো সে স্বভাবসুলভ নম্র স্বরে প্রত্যুত্তরে বলল,

-” স্যরি ফুপি। একটু দেরি হয়ে গেলো। পরোটা, আলুর দম, কালাভূনা, আর সবজি।”

সামনে পরোটার প্লেট থেকে একটা পরোটা উঁচুতে তুলে নাক সিঁটকে তনুজার দিকে তাকাল তামান্না। রুঢ় গলায় চেঁচিয়ে বলল,

-” পরোটা! আমার রুটি কই? পরোটা বানিয়েছো ঠিক আছে। তবে জানো না তুমি, আমি তেলে ভাজা পরোটা খাই না। আমার জন্য তেল ছাড়া সেঁকে নিতে পারতে। তেলে চুপচুপ করছে সবগুলো। এখন আমি কী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো; শুনি?”

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয় তনুজার বুক চিঁড়ে। পরপর বলে ওঠে,

-” আপনার জন্য রুটি করেছি। কিচেনে আছে নিয়ে আসছি।”

এইবলে কিচেনে পা বাড়াবে তনুজা এমন সময় নজরে আসে গাঁয়ে আঁটসাঁট পিৎ রঙের শার্ট, হাতার আস্তিন কনুই অবধি গোটাতে গোটাতে এদিকে তাকিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামছে ইভান। ইভানের মুখাবয়ব বড্ড শান্ত, ধূসর চোখজোড়া স্থির। সেদিনের কথা মনে পড়তেই তনুজা চমকায়, অপ্রস্তুত হয়। সবটা শুনে থাকলে, যদি সেদিনের ন্যায় ফুপিকে ত্যাড়া করে কিছু বলে উঠে ইভান! এই নিয়ে তনুজার ভেতর আতংকের সৃষ্টি হয়। পরপর নজর সরিয়ে তনুজা কিচেনের দিকে পা বাড়ায়।

ইভান চেয়ার টেনে বসে। একএক করে নুরজাহান বেগম তারপর দিব্যর বাবা শাহরিয়ার মির্জা আসলেন। ইভান প্রথমে কথা তুলল,

-” দিদুন! শুধু রান্নার জন্য দু’টো বুয়া রাখবে। তুমি না পেলে আমায় বলবে, আমি আজকের মধ্যেই ঠিক করে দিবো।”

নুরজাহান বললেন,

-” একটা তো ধোঁয়া মোছার জন্য আছেই। আর রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য আবার দু’টো দিয়ে কী হবে, দাদুভাই? বাড়ির বউ আছে। কাল ওটাকে বিদায় দিয়েছি, আরেকটা ধীরস্থির ভাবে দেখেশুনে ঠিক করবো।”

-” তনুজার কলেজ আছে। তারপর একজনকে সবসময় অহেতুক অর্ডার করা মানে তারউপর জুলুম করা। যারা নিজে কিছু না করে অর্ডার করবে, তাদের জন্য হলেও দরকার আছে। আচ্ছা তোমাকে দেখতে হবে না। আমি নিজেই আজকে দু’জনকে ঠিক করে পাঠিয়ে দিবো।”

নুরজাহান ঢের বিরক্ত হয়। তবে আর কথা বাড়ালেন না। তামান্নার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে রাগে হিসহিস করতে থাকে। ভাইপো ইন্ডিরেকটলি বলল; তার বউয়ের উপর, অহেতুক অর্ডার করে সে। মুখটা রাগে অন্ধকার হয়ে যায় তামান্নার। নুরজাহান, তামান্নাকে উদ্দেশ্য করে শুধাল,

-” নিতি পৌঁছে গিয়েছে কী? ফোন দিয়েছে? তা আজ এতো তাড়াহুড়ো করে গেলো। না খেয়ে-দেয়েই সাত সকালে রওনা দিল যে। পরীক্ষা-টরিক্ষা আছে নাকি?”

-” খানিকক্ষণ আগে আমি ফোন করেছিলাম। এখনো পৌঁছায়নি। আজকে নাকি ওর প্রেজেন্টেশন আছে। তাই সকাল সকাল চলে গিয়েছে।”

প্রেজেন্টেশন কী তা নুরজাহানের বোধগম্য হয় না। তবে বুঝলেন পরীক্ষার মতোই জরুরী কিছু একটা। তনুজা খাবার সার্ভ করছিলো। আগে নুরজাহান আর চাচা শ্বশুরের প্লেটে পরোটা দেয়। তারপর ইভানের প্লেটে দিতে নেয়। ইভান চোখ তুলে তনুজার দিকে তাকাল। কিছু নোটিশ করে ইভানের কপাল কুঁচকে আসে। ইভান ভ্রু নাড়িয়ে ইশারা করে। তনুজা বুঝতে না পেরে বোকা বোকা চোখে চাইল। ইভান এবার এক আঙুল নিজের কপালে ডলে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” আটার ডো।”

-” ওহ্!” অস্ফুটে আওড়ায় তনুজা। পরপর বুঝতে পেরে শাড়ির আঁচল টেনে কপালটা ডলে নেয়। মূহুর্তেই শুকিয়ে যাওয়া আটার খুঁতখুঁত কালো রঙের শাড়ির আঁচলে জড়ায়।

সবার খাওয়া-দাওয়ার মাঝ পর্যায়ে দিব্য এসে বসে। মুখটা তার শুকনো। আশেপাশে তার নজর নেই। শাহারিয়ার মির্জা চোখ তুলে ছেলের দিকে চাইলেন। গম্ভীর মুখে শুধোলেন,

-” দিব্য! এসব কী শুনছি?”

দিব্য নির্লিপ্ত। সেকেন্ডেই পড়ে নেয় বাবাকে। বাবা কী বলবে তা যেন দিব্যর আগে থেকেই জানা। শাহারিয়ার সাহেব বলতে থাকেন,

-” তোমার মাম্মা যা বলল, তা সত্যি? তুমি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছো তুমি ইউএসএ চলে যাবে?”

-” হুঁ।”

দিব্য ছোট্ট করে জবাব দেয়। উপস্থিত সবাই অবাক হয়। শাহারিয়ার সাহেবের মুখটা আরেকটু গম্ভীর হয়ে আসে। কপালে প্রগাঢ় খাঁজ পরে। ভরাট স্বরে ফের জিজ্ঞেস করলেন,

-” হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?”

-” এমনিই।”

ছেলের জবাব বড্ড গা ছাড়া আর হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হলো শাহারিয়ার মির্জার। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে এবার। মোটা গলায় বললেন,

-” এমনিই মানে? যখন পড়াশোনার জন্য আমি যেতে বলেছি, তখন যাওনি তুমি। তোমার নাকি দেশে থাকতেই ভালো লাগে। বাইরে বিদেশ বিভূঁইয়ে অচেনা জায়গা, অপরিচিত সবার মাঝে তোমার ভালো লাগবে না। থাকতে পারবে না তুমি। দেশে ঘরের বাইরে বেরুলেই চেনা মুখ, পরিচিত সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়। নিজের চেনা শহর ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে থাকতে গেলে তোমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এমনই অজুহাত দিয়েছিলে। তা এখন হুট করে এমন বলছো কেনো? আমার মাথায় ধরছে না। তোমার ডিসিশন শুনে তোমার মাম্মা তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যাইহোক, তুমি এসব চিন্তা বাদ দাও। অফিসে জয়েন না করতে চাও, না করলে। বিসিএস দাও, বা তোমার যেটা ইচ্ছে সেটাই করো।”

দিব্য খাবার মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” আমি মামার সাথে ফোনে রাতে কথা বলেছি। মামাকে সব ব্যবস্থা করতে বলেছি। আর আমি অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নট হুট করে। আর তখনকার দিব‌্যর সাথে আজকের দিব্যকে মিলাতে যেয়ো না, বাবা।”

-” তুমি এতটাও বড় হয়ে যাওনি দিব্য। যে নিজের ডিসিশন নিজেই নিবে। তোমার ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তোমার বাবা-মা বেঁচে আছে।”

ইভান মুখে থাকা খাবার চিবিয়ে যাচ্ছে। কেনো জানি খানিকক্ষণ আগের মতো স্বাদ, তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যাচ্ছে না। গলাধঃকরণ করতে কষ্ট হচ্ছে। ইভানের অবচেতন মন দিব্যর এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। মনের কোণে জমে থাকা রাগ-ক্ষোভের পর্দা যেন দূরে সরতে চাইছে। সেখানে ছোটভাইয়ের জন্য ফের আগের মতো এক টুকরো নির্মল ভালোবাসা, আদর স্নেহ ভিড় করতে জমাচ্ছে। দিব্যর বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে কেমন মুষড়ে উঠলো হৃদয়টা। পরম স্নেহ মাখা কণ্ঠে নিষেধ করতে ইচ্ছে করল। তবে অদৃশ্য একটা বাঁধা থাকায়; মনে হওয়া কথাটা আর বলে উঠা হলো না ইভানের। তারপরও অন্তরাত্মা চাইছে দিব্য সাথেই থাকুক। কথা না হলো। চোখের দেখা তো হয়। হাজার হোক ভাই তো। নুরজাহান রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,

-” বুঝি না বাপু। তোমাদের একেকজনের মতিগতি বোঝা বড় দায়। কখন কার কী মনে ওঠে, আর তাই করে বসো। ঠিক বিদেশ বিয়ে ঐ সাদা চামড়া আর পাটের আঁশের মতন সোনালি চুলওয়ালা বিদেশিনী বিয়ে করবে।”

সবাই চুপচাপ থাকলেও নৃত্য ফিক করে হেঁসে ওঠে। তনুজা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শাহারিয়ার মির্জা আদেশের সুরে বললেন,

-” দিব্য তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তোমার মা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। শুনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তুমি যাওয়ার পর একদম শয্যাশায়ী হয়ে যাবে আমি শিওর। তাই বলছি পা’গলামি বাদ দাও।”

দিব্য নির্বিকার ভাবে বলল,

-” স্যরি বাবা সম্ভব নয়। আমি মামার সাথে কথা বলেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব প্রসেস যেনো শেষ হয় বলে দিয়েছি। আর আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল-অনড়।”

শাহারিয়ার মির্জা এবার তেতে উঠলেন। কণ্ঠটা বেশ চড়িয়ে বলল,

-” ছোট থেকেই তুমি জিদি, রাগি ঠিক আছে। তোমার যা মনেহয় তাই করো; সেটাও ঠিক আছে। তাই বলে আমাদের একটা কথাও রাখবে না; এটা কখনোই আশা করিনি তোমার কাছে।”

সেই তখন থেকে নিজেকে, নিজের মেজাজকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো দিব্য। বাবার কথায় এবার আর শান্ত থাকা হলো না। ঝট করে মেজাজটা চটে গেল। ক্ষিপ্ত হলো সে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল,

-” হ্যাঁ আমার যা মনেহয় আমি তাই করি। আর সেটা সবার কাছে সবসময় রং হয়। আর এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমি চাইবো, সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। কারো মতামত আমার উপর চাপিয়ে দিবে না। আমার মনে হয়েছে তাই আমি বাইরে যেতে চাচ্ছি। সেখানে মাম্মা তারপর তুমি এত বাঁধা কেনো দিচ্ছো, বলো তো?”

ছেলের দিকে অসন্তুষ্ট চাউনিতে চাইলেন। ধ’ম’কের সুরে বললেন,

-” দিব্য গলার স্বর নামিয়ে কথা বলো। এভাবে কথা বলে নিজেকে আরো বে’য়াদব প্রমাণ করো না।”

বাবার কথায় রাগ হরহুর করে বাড়ল। স্বভাবসুলভ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে টেবিলের উপর থাকা কাঁচের জগটা একহাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। চোখের পলকেই সুন্দর দেখতে কাঁচের জগটা টুকরো টুকরো হয়। সাথে কাঁচ ভাঙার শব্দে কেউ কেউ কেঁপে উঠল। দিব্য কোনদিকে নজর না দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। মূহুর্তেই পরিবেশটা নিস্তব্ধ আর থমথমে হয়ে যায়।

_____________

কয়েকদিন পর…
চাঁদনি রাত খোলা আকাশ। সাথে মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাস। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ইভান আর তনুজা। ইভানের হাতে কফির মগ। খানিকটা দূরত্বে দুইহাত বুকে ভাঁজ করে; আকাশপানে চেয়ে আছে তনুজা। মৃদু বাতাসে শাড়ির আঁচলটা হালকা উড়ছে। উড়ছে শ্যামাবতীর কপালের বেবি হেয়ার। এই দৃশ্য কারো হৃদয়ে ঝড় তুলছে তা কী জানে, শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা শ্যামাবতী? উঁহু! সে যে বড্ড বেখেয়াল। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা পাশে নামিয়ে রাখে ইভান। এক পা দু পা ফেলে তনুজার দিকে এগোয়। হঠাৎ ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণে তনুজা সম্বিত ফিরে পায়। পরপর দু’টো শক্ত উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পায় কোমড়ে। যে ছোঁয়ায় তনুজার পায়ের পাতা শিরশিরানি দিয়ে ওঠে। কেঁপে ওঠে পেলব শরীর। ইভান তনুজার কাঁধে থুতনি রাখে। মোহময় স্বরে ডাকল,

-” তনুজা”

তনুজার রুহুসহ সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল যেন। এই আদূরে মোহময় ডাকে হৃদপিন্ড ছলাৎ করে উঠল। গলাটা চৈত্রের খরার ন্যায় শুকিয়ে আসছে। জিভ দিয়ে ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নেয় তনুজা। অস্ফুট স্বরে বলে,

-” হু।”

ইভান একহাতে তনুজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। পরপর পুরুষালি শক্ত রুক্ষ দু’টো হাতে তনুজার পিঠ জড়িয়ে ধরে। ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস তনুজার চোখেমুখে আঁছড়ে পড়ছে। ইভানের গভীর নজরজোড়া তনুজার ভীতু, মায়াবী মুখবিবরে চেয়ে রইল নির্নিমেষ। তনুজা ও-চোখে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। ও-চোখ দু’টো কেমন অদ্ভুত ঠেকছে। ও চোখ দু’টোতে নজর রাখতেই বুকের ভেতরটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। তনুজা যেন ঐ গভীর নজরজোড়ায় বিলীন হয়ে যাবে। পরপর দৃষ্টি নামিয়ে নেয় তনুজা। ইভান তনুজার কপালে কপাল ঠেকায়। সফট ভয়েজে বলে সে,

-” আমার এখন মনে হচ্ছে, আসলে প্রণয় শুরু হতে হয় বিয়ের মাধ্যমে। যে বাঁধনটা দৃঢ়, শক্ত, মজবুত হয়। যেখানে প্রতিটা মূহুর্ত থাকে হালাল, পবিত্র। দু’জন দু’জনের দিকে তাকানোতেও থাকে নেকি। দিন যায় বাড়ে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা-টান- মহব্বত।”

তনুজার নিঃশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে। সাথে বাড়ছে অজানা আ’তংক-ভ’য়। ইভান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ইভানের হাত দু’টো আস্তে আস্তে তনুজার মসৃণ কোমড়ে নামে। একটু থেমে পূর্ণ দৃষ্টিতে তনুজার দিকে চেয়ে আওড়ায়,

-” তনুজা! তুমি আমার অতীত সম্পর্কে অবগত। আমার ব্যাপারে সবটা যেনে-বুঝে আমাদের এই সম্পর্কের একটা সুন্দর সূচনা করবে কী? আমি জানি তুমি সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পবিত্র। সেখানে আমার অতীতটা তোমার মতো অত সুন্দর নয়। আমার অতীতে এক বি’শ্বা’সঘাতিনী ছিলো। তবে তুমি এতটুকু বিশ্বাস তোমার বরের উপর রাখতে পারো, সে তোমার হক খোয়াইনি। তনুজা তোমার কাছে আমার ছোট্ট একটা রিকোয়েস্ট থাকবে, প্লিজ কখনো আমাকে ঠ’কিয়ো না। এমন কিছু করো না যাতে কোন একদিন আমাকে বলতে হয়, দিনশেষে আমি আবার ঠকে গেলাম। আবার সেই মেয়ে জাতির কাছে। প্রতারনা পেলাম সেই মেয়ে জাতির থেকে।”

তনুজার হাঁসফাঁস ঠেকছে। মানুষটা কত সুন্দর তার কথা অবলীলায় বলে ফেলল। আর তনুজাকে তার থেকেও পবিত্র তুলে ধরল। তনুজার বিবেক দং’শন করতে থাকে। সে কীকরে এখনো নির্লিপ্ত আছে! তারও কী উচিত নয়! অতীতটা বলে দেওয়া। তনুজার মন সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে। ওদিকে তনুজার চুপ থাকাকে ইভান মৌন সম্মতি ধরে নেয়। তনুজার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় ইভান। তনুজা দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের দোলাচল থেকে বেরিয়ে আসে; কাঁপা কাঁপা গলায় বলে সে,

-” ইভান, আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।”

তনুজার হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন তুলতুলে গালে গাল ঠেকায় ইভান। ইভানের খোঁচা খোঁচা দাড়ি তনুজার সফট গাল ছুঁইয়ে যাচ্ছে। ইভান লো ভয়েজে বলল,

-” হুম। বলো।”

তনুজা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,

-” ইভান আমার অতীতটা আপনার জানা জরুরী।……….আর বিশ্বাস করুন বিয়ের পর থেকে আমি সেসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে আসছি। আমি সেদিকে ফিরেও তাকাইনি। আমার পৃথিবী আমি আপনি কেন্দ্রিক গড়ে তুলতে চাইছি। প্লিজ আপনি ভুল বুঝবেন না।”

পরপর তনুজা সবটা বলে। একসময় দিব্যর সাথে তার রিলেশন ছিলো। পুরোটা বলে তৃষার কাহিনী। দিব্যর নাম শুনে ইভানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তনুজার কোমড় থেকে হাত দু’টো আলগা হয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ ইভান দু’কদম পিছিয়ে যায়। দিব্যর হঠাৎ বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সব মস্তিষ্কে নাড়া দিতে থাকে। ইভান প্রচন্ড অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। ইভানের বিবেক তাকে ধিক্কার দিচ্ছে; ছিঃ ইভান ছিঃ! তোর আর দিব্যর মধ্যে পার্থক্য রইল কী? ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিলি। যতই দিদুন জোর করুক, তোর কী উচিত ছিলো না, বিয়ের আগে মেয়েটির সাথে একটিবার কথা বলে নেওয়া। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক যেন সচল হয় ইভানের। ইভান দপ করে দোলনায় বসে পরে। দুইহাতে মুখ ডেকে নেয়। ওদিকে তনুজা থরথরিয়ে কাঁপছে। রেলিং ঘেঁষে জমিনে বসে পরে তনুজা। দীর্ঘ সময় গড়াল। দু’জনে নীরব রইল। দিব্য বাইরে চলে যাচ্ছে মামণি খুব অসুস্থ। ইভানের কী করা উচিত বুঝে আসছে না!

অনেকটা সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর ইভানের মস্তিষ্ক সজাগ হয়। ইভান অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। পাথরের মুর্তির মতন ঠাঁই বসেই বলল,

-” এই বিয়েটা তো জোর করে হয়েছে। তাও ভুল বোঝাবুঝিতে। আর আমরা দু’জন তো এই জোর করে নামে মাত্র বিয়ের দোহাই দিয়ে আছি। এবার আমাদের উচিত সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। আমি কালকেই উকিলের সাথে কথা বলবো। আমাদের ডিভোর্সের জন্য। যেহেতু বিয়েটা চাপে পরে হয়েছে তাই এটাকে সারাজীবন টেনে বেড়ানোর মানে হয় না। তুমি চিন্তা করো না। আমি আমার তরফ হতে তোমাকে মুক্তি দিবো। এখনো সময় আছে, তুমি দিব্যর সাথে জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারবে। এব্যাপারে তোমাকে কেউ দায়ী করবে না। সমস্ত দায়ভার আমি নিজেই বহন করবো।”

তনুজার ভীষণ কান্না পেলো। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল।

.

কারো ধাক্কাতে হুঁশ হয় তনুজার। দপ করে চোখ মেলে চাইতেই হালকা সবুজ আলোয় আলোকিত হওয়া ছাদ দেখতে পায়। পরপর ইভানের দিকে নজর পরে। যে কিনা উদ্বিগ্ন হয়ে তনুজার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। ঘুমের মধ্যকার কান্নার শব্দ কেমন বাইরে উম উম করে আসছিলো। তনুজা নড়ছিলো আর শব্দটা হচ্ছিল। ইভানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তড়িৎ তনুজার পাশে ঝুঁকে একহাতে তনুজাকে ধাক্কা দেয়। উফ্! এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো তনুজা এটা ঠাহর করে। তবুও বুকটা ধড়ফড়িয়ে কাঁপছে তার। তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে। তারপর..তারপর আচমকা ইভানের বুকে গা এলিয়ে দেয়। মাথাটা ইভানের বুকের উপর পরে। ইভান একহাতে তনুজাকে আগলে নেয়। তনুজা হয়ত কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে অনুমান করে ইভান। তনুজার শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে ইভান অনুভব করে সেই কম্পন। ইভানের হাতটা তনুজার চুলের ভাঁজে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” তনুজা, কী হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”

ইভানের বুকে তনুজার মাথা। ইভানের হার্টবিট শুনতে পারছে সে। মানুষটাও তাকে নিয়ে নিশ্চয় ঘাবড়ে গিয়েছে। এইযে কেমন দ্রুত গতিতে হৃদপিন্ডটা চলছে। তনুজা চোখদুটো বুজে নেয়। পরম একটা শান্তির জায়গায় মাথাটা রেখেছে সে এমন অনুভূতি হচ্ছে। আজ প্রথম সজ্ঞানে ইভানকে জড়িয়ে আছে সে। তবে আজ কোন দ্বিধা হচ্ছে না। কেমন শান্তি অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে তারজন্য এই পৃথিবীতে একমাত্র শান্তির আবাস স্থল এই বুকটা। তারজন্যই বোধহয় সৃষ্টিকর্তা এই প্রস্থ বুকটা বরাদ্দ রেখেছিলো। স্বপ্নের কথা আর দৃশ্য মনসপটে ভাসতেই ভয়ে শিউরে উঠছে তনুজা। ইভান দুইহাতে তনুজাকে আগলে নিয়ে ফের বলল,

-” তুমি তো দেখছি খুব ভীতু মেয়ে। স্বপ্ন দেখে একদম নার্সারিতে পড়ুয়া বাচ্চাদের থেকেও বেশি ভয় পাচ্ছো। রিলাক্স তনুজা রিলাক্স। এত ভ’য় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আমি আছি তো।”

“আমি আছি তো” কথাটা তনুজার অস্থির চিত্তে প্রশান্তি নিয়ে আসলো। তনুজা ইভানের পিঠের টিশার্টসহ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনেকটা সময় এভাবেই কাটল। ইভানের ভেতরেও একটা সুপ্ত অনুভূতি জন্মাতে থাকে। ভালোলাগায় আবেশিত হয় হৃদয়টা।

_____________

ঝকঝকে তকতকে বড়সড় পরিপাটি আলিশান অফিস রুমের রিভলভিং কালো চেয়ারটায় বসে ইভান। হাত দু’টো তার ল্যাপটপের কিবোর্ডে, চোখদুটো স্থির স্ক্রিনে। কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ তনুজার কথা মনে পড়ল। ইদানিং তার মনমস্তিষ্কের দখলদারিত্ব নেওয়া শুরু করেছে তনুজা। হুটহাট করেই তার তনুজার কথা মনে পড়ে যায়। এইযে এখন কাজের মাঝেও হঠাৎ তনুজার কথা মনে উঠল। ইভান স্ক্রিনে সময় দেখল। পৌনে চারটে বাজে। আজ ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলো তনুজাকে কলেজ থেকে বাসায় পৌঁছে দিতে। তিনটায় ক্লাস শেষ হওয়ার কথা। তনুজাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়েছে কীনা জানার জন্য ফোন হাতে নেয় ইভান। এরমধ্যে ফোনে বাড়ির নম্বর থেকে কল আসে।

-” বাড়ি থেকে এই সময় হঠাৎ কল?”

ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করে ইভান। ফোনের ওপাশ থেকে নৃত্যর বলা কথা শুনে ইভান উদ্বিগ্ন হয়। সেকেন্ডেই চোখেমুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। কণ্ঠে ঝরে পরে সমস্ত উদ্বেগ-উদ্বিগ্নতা,

-” ত-তনুজা? কী হয়েছে তনুজার?”

#চলবে

#প্রণয়ের_বাঁধন |১৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

সময়টা ছিলো দুপুর দু’টো বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। লাঞ্চের পরের ক্লাসটা ছিলো আজকের শেষ ক্লাস। ক্লাস শেষ করে তনুজা করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় একটা সিনিয়র ছেলে তনুজাকে উদ্দেশ্য করে এক হাত উঁচিয়ে ডেকে উঠল,

-” হেই হোয়াইট ড্রেস পরিহিতা?”

বাক্যটা কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই তনুজার পা দু’টো থেমে যায়। একপল অদূরে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে ডাকা ছেলেটার পানে তাকাল। পরপর তনুজা নিজের কালো মিচমিচে মণি এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাইল। আশপাশ তাকিয়ে শিওর হয়, এখানে হোয়াইট রঙের থ্রি পিস শুধু তার পরনেই। তারমানে ছেলেটা তাকেই ডাকছে। তবে ছেলেটির এহেন সম্বোধনে তনুজা হকচকায়; সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। ছেলেটি কয়েক কদম এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

-” হে ইউ! তোমাকেই বলছি।”

বিস্ময়ে তনুজার চিকন ভ্রুদ্বয় গুটিয়ে যায়। জ্বিভ দিয়ে নিম্নোষ্ঠ ভিজিয়ে শুধোয়,

-” আ-আমি? ইয়ে মানে আমাকে কী দরকার?”

-” আমার যদি ভুল না হয়; ইউ ফারিশতা নূর তনুজা?”

-” ইয়াহ।”

ছেলেটি সৌজন্যমূলক হেসে বলল,

-” মাইকোলজি নিউ মিস তৃষা ম্যাম তোমাকে ডেকেছেন। ম্যামের চেম্বারে একবার দেখা করতে বলেছেন।”

-” কেনো?”

বিস্ময়ে তনুজা চট করে প্রশ্নটা করেই ফেলল। ছেলেটা কাঁধ নাড়িয়ে বলল,

-” আমি জানি না। তুমি গিয়েই জেনে নিও। ম্যামের কাছে দরকারে গিয়েছিলাম। সেই সময় ম্যাম আমার উপর ছোট্ট এই কাজটা দেন। আমার কাজ ছিলো তোমাকে বলা। বাকিটা আমার অজানা।”

ছেলেটা শুকনো একটা হাসি দিয়ে আর বাক্য ব্যয় না করে চলে যায়। তনুজার ইচ্ছে হচ্ছে না তৃষার সাথে দেখা করতে। আবার কলেজের মিস ডেকেছেন না গেলেও কেমন হয়। রুপা আজ আসেনি, বাকী ফ্রেন্ডদের থেকে বিদায় নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তনুজা যায়। তৃষার রুমের দোরগোড়ায় দাঁড়াতেই ভেতর থেকে মেয়েলি চিকন স্বর আসলো,

-” এসো..এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

তনুজা ভিতরে যায়। চোখমুখে স্পষ্ট বিরক্তি তার। তবে যথাযথ কার্টেসি মেইনটেইন করে তনুজা। মৃদুস্বরে সালাম দেয়। তৃষা ফিচেল হেসে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,

-” বসো।”

তনুজা অপ্রস্তুত কণ্ঠে তাড়া দিয়ে বলল,

-” নো থ্যাংকস। এভাবেই ঠিক আছি। কাইন্ডলি যদি বলতেন, কীজন্য__”

তৃষা চেয়ারের হাতলে হাত দু’টো রাখে। চোখেমুখে শ°য়°তানি হাসি নিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,

-” বলব বলব। তার আগে বসে, একটু রিল্যাক্স করো।”

তনুজা কাঁধের ব্যাগের ফিতা চেপে ধরে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে বসল। তনুজার সামনে টেবিল তারপর তৃষা মুখোমুখি চেয়ারে। পেপার ওয়েট একহাতে ঘুরাতে থাকে তৃষা। পরপর তনুজার দিকে স্থির চাউনিতে চেয়ে বলে উঠল,

-” কেমন চলছে তোমার সংসার জীবন? কেমন চলছে প্রেমিকের বড় ভাইয়ের সাথে দিনকাল।”

শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তো নয়ই; বরং বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য করে বলে তৃষা। শ্রবণেন্দ্রিয়ে কথাগুলো পৌঁছাতেই শান্ত কোমল তনুজার চিত্ত সেকেন্ডেই কঠিন হয়ে আসে। রাগে সমস্ত কায়া ঘিনঘিন করে ওঠে। সাথে চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। পরপর তনুজা চোখ তুলে তাকিয়ে বলে উঠল,

-” আমি যদি সজ্ঞানে থাকি, তাহলে আমার ভুল হবে না; আমি এখন কলেজে আছি। আর আমার ডিপার্টমেন্টের একজন টিচারের সামনে আছি। বেয়াদবি না নিলে বলি, আমার সংসার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার যায়গা এটা না। পড়াশোনার কোনো টপিক নিয়ে বলার হলে বলতে পারেন। আমার স্বামী সংসার নিয়ে আপনাকে কিছু বলতে আমি আগ্রহী নই। সো কাইন্ডলি টপিকটা চেঞ্জ করুন।”

বোকা, সহজ-সরল কাঁদামাটির মতো নরম তনুজার কঠিন চিত্ত দেখে তৃষা বেশ অবাক হয়। ঠান্ডা গলার কঠিন কথাগুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তৃষার। তৃষার শুভ্র সুন্দর মুখশ্রী থমথমে হয়ে যায়। ভেতরে প্রতিহিংসার আ’গু’ন দপ করে জ্বলে উঠল তার। তৃষা ক’দিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলো তনুজার সাথে কথা বলার জন্য। সে তনুজার সাথে কথা বলে ইভান-তনুজার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে আগ্রহী ছিলো। কথা বলে কোন ফাঁকফোকর পাওয়া যায় কী না! আর সেদিনকার ইভানের আচরণ দেখে সে তো হিং”সায় জ্বলে। তনুজার উপর সমস্ত রাগ, হিংসা তরতরিয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এখন তনুজাকে অপদস্থ করলে যেন একটু প্রশান্তি মিলবে তার অন্তরাত্মায়। তনুজার থেকে এরুপ প্রত্যুত্তর কস্মিনকালেও আশা করেনি তৃষা। রাগে-ক্ষোভে ফর্সা মুখটা কালো করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-” আমার স্বামী! আমার স্বামী যে জোরসে গলায় বলছো, তুমি কী জানো! তোমার স্বামী একসময় আমার হবু স্বামী ছিলো। আমি তার ফ্রিয়ন্সে ছিলাম। সে আমায় ভালোবাসতো।”

তৃষা তার বাম হাতটা তনুজার সামনে মেলে ধরে। ভ্রু বাঁকিয়ে দেখিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,

-” এইযে রিং টা দেখছো না। এটা তোমার বর ভালোবেসে নিজ হাতে আমার ফিঙারে পড়িয়েছিলো।”

চিকন লম্বা ধবধবে সাদা অনামিকা আঙুলে হিরের আংটিটা জ্বলজ্বল করছে। আংটিটা যেনো পুরো হাতটার সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। আচমকা তনুজার ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। পরপর কিছু ভেবে মনকে প্রবোধ দেয় সে। তারপর প্রগাঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,

-” স্যরি আপনার একটু ভুল হয়ে গেলো। মোটেই আমার বর আপনাকে রিং পড়াইনি।”

তৃষার মসৃণ কপালে খাঁজ পড়ল। তৃষা বোকা বনে যায়। তিরিক্ষি গলায় শুধায়,

-” অ্যাই! অ্যাই তুমি জানো না। জানো না আমার আর ইভানের বাগদান সম্পন্ন হয়েছিলো। নাকি না জানার অ্যাক্টিং করছো, হ্যা!”

তনুজা আলতো হেসে বলল,

-” ইভান আপনাকে রিং পড়িয়েছিলো সেটা মিথ্যে নয়। আর বিষয়টা আমি জানি না; এ-ও নয়। তবে সেই সময় ইভান নাতো আমার বর ছিলো, আর নাতো আমি ওনার বউ ছিলাম। তাই আপনার কথাটা ভুল ছিলো।”

সবসময় মেপে মেপে কথা বলা মেয়েটি আজ নিজের কথায়, আর সাহসে চরম অবাক হচ্ছে নিজের উপর। তৃষার সম্মুখে একদণ্ড থাকার ইচ্ছে আর রুচি কোনটাই নেই তনুজার। নেহায়েৎই টিচার বিধায় আসছে। তবে তৃষার কুরুচিপূর্ণ কথা আর সয্য হচ্ছে না। তনুজা চোয়াল শক্ত করে চটজলদি উঠে দাঁড়ায়। কণ্ঠে নামল তীব্র ঘৃ°ণা,

-” সেদিন ওনার চোখে স্পষ্ট আপনার জন্য ঘৃ/ণা দেখেছি আমি। তাই বলছি প্লিজ এবার একটু ভালো হয়ে যান। রঙিন স্বপ্ন আর ছক কষা বাদ দিন। আর হ্যা; টাকা দিয়ে লোকের সাহায্যে জ’ঘ’ন্য কাজ করানোর শাস্তিকে একটু ভ’য় করুন। এখন ছাড় পেয়েছেন বলে যে; সবসময় পেয়ে যাবেন এমন নয়। আর প্রকৃতির বিচার তো আছেই। আপনার সাথে বেহুদা কথা বলার রুচি আর সময় কোনোটাই আমার নেই। আসছি।”

এই বলে পা বাড়ায় তনুজা। কয়েক পা যেতেই থেমে যায়। তৃষা চেয়ারের হেডে কাঁধ এলিয়ে বলতে থাকে,

-” তা এত দ্রুতই এক্সকে ভুলে গেলে! এত টান বরের প্রতি। তা তোমার বর জানে কী! তার বউয়ের এক্স যে তারই ছোট ভাই।”

তনুজার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। চারিপাশটা কেমন ঘুরছে। হঠাৎ করেই ভীষণ অস্থির লাগছে। তৃষা থেমে ফের বলতে থাকে,

-” তার বউয়েরও যে একটা অতীত আছে। এটা জানলে তোমার আর আমার মধ্যে ফারাক কী রইল? আজ আমায় ঘৃ’ণা করছে। কাল যে তোমায় ঘৃ”ণা করবে না এর গ্যারান্টি কী?”

তনুজা পিছু ঘুরে চাইল। ইভানের কী রিয়াকশন হবে তা তার অজানা। তবুও নিজের আর তৃষার ফারাক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে বলল,

-” আলবাত আপনার আর আমার মধ্যে ফারাক আছে। একজনের সাথে সম্পর্ক রেখে আমি তাকে লাফাতে লাফাতে বিয়ে করিনি। আর না তো আমি তাকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করেছি। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে দু’জনে বিয়েটা করি। আর এ-ও নয়, বিয়ের পর আমি আমার অতীতকে আঁকড়ে ধরে আছি। আর না তো চেয়েছি। কোনোটাই নয়। আমি কোনোভাবেই তাকে ঠকাইনি। আর আপনি তো তাকে ঠ’কিয়েছেন। সেখানে নিজের সাথে আমাকে কম্পিয়ার করেন কী করে!”

তনুজা কথা না বাড়িয়ে বড়বড় শ্বাস ফেলে প্রস্থান করে। এক টুকরো জ্বলত কয়লা যেনো তৃষার মুখে পড়ল। রাগে গজগজ করতে থাকে সে। তনুজা প্রস্থান করতেই কিছু ভেবে দাঁত কিড়মিড়িয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। কাংখিত নম্বরে ডায়াল করে। তিন বারের মাথায় রিসিভ হয়। কর্কশ স্বরে বলে,

-” কোথায় থাকিস? এতবার কল দিচ্ছি রিসিভ কেনো করছিস না!”

ওপাশ থেকে বিবশ গলায় লিমন বলে,

-” বল তুই। তোর কল তুলতে ইচ্ছে করে না। তোর জন্য আমার তিন তিনটে দাঁত খোয়াতে হয়েছে। এখন ফলস দাঁত নিয়ে চলছি। ভ’য় হয় তোর ফোন ধরে আবার জীবনডারে খোয়াই না ফেলি। তোর কথামতো কাজ করে হসটপিলাইজড হয়েছি। তোকে ডরাই বোইন। তুই একটা আতংক মাইরি! তুই মানেই এক অশনিসংকেত আমার জন্যিই।”

তৃষা ধ’ম’কের সুরে বলল,

-” বা’জে ব’কা বাদ দে! টাকা দিয়েছিলাম সেটা, সেটা তো ভালো লেগেছিলো। এমনি এমনি টাকা আসে না তারজন্য কষ্ট করতে হয়। তাই এটুকুন হজম করে নে।”

-” আমি হসটপিটালে ছিলাম তোর কাছে এটু__”

তৃষা থামিয়ে দিয়ে বলল,

-” থাম! আমি যে জন্য ফোন দিয়েছি শোন; দিব্য আর তনুজা তো রিলেশনে ছিলো। তা ওদের দু’জনের কোনো ক্লোজ ছবি টবি আছে কী?”

-” তোর মতো সবাই নাকি! নিজের মতো সবাইকে ভাবিস কেনো! রিলেশনে গেলেই তোর মতো সবাই গা ঘেঁষে, চিপকে থাকে নাকি। আর তনুজা অমন মেয়ে না।”

-” তনুজার গুণগান বাদ দিয়ে, খোঁজ কর। ক্লোজ না থাকলেও পাশাপাশি, যেমনই হোক একটা হলেই হলো। দিব্য আর তনুজার একসাথের পিক। যে করেই হোক সংগ্রহ করে, আমার হটস অ্যাপে সেন্ট করবি। আমি তোর অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অ্যামাউন্ট পাঠিয়ে দিবো।”

-” মাফ চাই বোইন। আমি আর কিছু করতাম না। এবার দিব্য সোজা আমায় উপরে পাঠিয়ে দিবে, আমি ড্যাম শিওর।”

আর একটাও কথা না বলে খট করে কল কা’টে লিমন।

__________

নৃত্যর ফোনকল আসার পর অমনি অফিস থেকে বাসায় ছুটে আসে ইভান। নৃত্য ফোনে বলে,

-” ভাবিমণি হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সেন্সলেস হয়েছে। অনেকক্ষণ হলো; তারপরেও এখনো সেন্স ফেরেনি।”

কলেজ থেকে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতে গিয়ে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে যায় তনুজার। তারপর জ্ঞান হারায়। অনেকক্ষণ পর সবে জ্ঞান ফিরল। তনুজা বিছানায় শুয়ে আছে। নুরজাহান বেগম মাথার পাশে চিন্তিত মুখশ্রীতে বসে। জ্ঞান ফেরার পর বেশ কয়েকবার মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়েছেন। শিরিন সুলতানা বেডের পাশে দাঁড়িয়ে। জ্ঞান ফিরতেই সবাইকে নিজের রুমে দেখে তড়িঘড়ি করে দূর্বল শরীর নিয়েই ওঠে বসতে নেয় তনুজা। সেইসময় নুরজাহান এক হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-” আহ্! উঠা লাগবে না। শুয়ে থাকো তুমি। বিশ্রাম নাও। তা নাতবউ হঠাৎ কী হয়েছিলো?”

তনুজা মিহি স্বরে জবাব দেয়,

-” তেমন কিছু নয় দিদুন। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল।”

নুরজাহানের চোখমুখে হঠাৎ খুশির ঝিলিক দেখা যায়। কণ্ঠে আমোদ ঢেলে শুধোলেন,

-” আলহামদুলিল্লাহ..আলহামদুলিল্লাহ! তা নাতবউ কতদিন হলো? পরীক্ষা-টরীক্ষা করছো কী?”

তনুজা সরল চোখে নির্বোধের মতন চেয়ে রইল। নুরজাহান তনুজার অভিব্যক্তি পরে নেয়। তারমানে তনুজা বোঝেনি তার প্রশ্ন। এবার একটু ফিসফিসিয়ে বলল,

-” আরে বুঝনি! বলছি কতদিনের পোয়াতি তুমি?”

তনুজার চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে যায়। সাথে মুখটা হা হয়ে আসে। তনুজা তৎক্ষণাৎ মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে উঠল,

-” না না। ইয়ে মানে দিদুন ওরকম কিছু নয়।”

নুরজাহান বেগম ঠোঁট উল্টে বললেন,

-” ডাক্তার দেখাইছো? বিয়ের পর মাথা ঘোরা, এসব এমনি এমনিই হয় না। ছোট মানুষ টের পাচ্ছো না তাই। যাইহোক দাদুভাই আসুক, তারে বলি ডাক্তারের কাছে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে।”

তনুজা অপ্রস্তুত হয়। অসহায় চাহনিতে চেয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

-” দিদুন ওরকম কিছু নয়। ওনাকে এসব বলবেন না প্লিজ। এমনিতেই মাথা ঘুরে গিয়েছিল তাই।”

শিরিন সুলতানা ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-” আহ্; মা কী বলছেন! এমনিতেই মাথা ঘুরে যেতেই পারে। আর ওদের বিয়ে মাত্র দেড় মাস পেরিয়েছে। এখনও দুই মাসও হয়নি।”

ছেলের বউকে থামিয়ে দিতে একটু মোটা গলায় বললেন,

-” তুমি থামো তো। পৌনে দুইমাস কম কোথায়? যেখানে আমার বড় খোকা আমার বিয়ের এক মাসের মধ্যেই আমার গর্ভে আসে।”

ইভান ত্রস্ত পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে আসে। লম্বা লম্বা কদম ফেলে রুমে ঢুকে। রুমে পা দিয়ে পরপর মামণি, দিদুন দেখে। তারপর তনুজাকে শোয়া অবস্থায় বিছানায় দেখতে পায়। লম্বা শ্বাস ফেলে ইভান। কণ্ঠে তার একরাশ উদ্বেগ প্রকাশ পায়,

-” কী হয়েছে তনুজার? হঠাৎ কী করে সেন্সলেস হলো?”

কণ্ঠ শুনে তাকাতেই তনুজার দৃষ্টি মিলল ইভানের দৃষ্টিতে। ঘর্মাক্ত মুখ, কপালের উপর এলোমেলো চুল। চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। তনুজা শীতল চাউনিতে নির্নিমেষ চেয়ে রইল তারজন্য চিন্তাগ্রস্থ, উদ্বিগ্ন হয়ে কাজ ফেলে ছুটে আসা মানুষটার পানে। অদ্ভুত একটা শীতলতা বয়ে যায় তনুজার তনুমনে। শিরিন সুলতানা অমায়িক হেসে আদূরে গলায় বললেন,

-” ইভান বাবা আসছো। আমি এক্ষুনি তোমাকে ফোন দিয়ে জানাতে যাচ্ছিলাম তনুজার জ্ঞান ফিরেছে। এই তো একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে তনুজার। তবে আসছো ভালো হয়েছে। সময় করে তনুজাকে একবার ডক্টর দেখিয়ে আনিও।”

-” ঠিক আছে মামণি।”

নুরজাহান বেগম গমগমে স্বরে বললেন,

-” দাদুভাই! আমি বলি কী আজই নিয়ে যাও। মাথা ঘুরে যাওয়া মানে মনেহয় নাতবউ অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। ঠিকমতো খেতেও দেখি না। তাই ডাক্তার দেখিয়ে একদম নিশ্চিত হয়ে আসো। সাথে মিষ্টি নিয়ে আসো।”

ইভানের চোখ দু’টো কোটর ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসার জো হয়। বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে যায়। অপ্রস্তুত হয়। খালি গলায়ও কেমন বেষম লাগে, সহসা খুকখুক করে কেশে উঠল ইভান। পরপর নিজেকে সামলে অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে ফেলল,

-” হোয়াট? দিদুন কী যা তা বলছো। কী করে? ”

তনুজা লজ্জায় আর অস্বস্তিতে মাথা নুইয়ে নিল। নুরজাহান একগাল হেসে বললেন,

-” নাতবউকে প্রথম থেকেই বাচ্চা-কাচ্চা নেওয়ার কথা বলছিলাম। তোমাদের বাচ্চা নিজ চোখে দেখে যাওয়ার বড় শখ ছিলো আমার। যাজ্ঞে আল্লাহ মনেহয় সেই শখ পূরণ করতে চাইছেন।”

অবাকে, বিস্ময়ে ইভানের চক্ষু চড়কগাছ। ইভান নিস্প্রভ চাহুনিতে তনুজার দিকে চাইল। তনুজা অসহায় ফেস করে মাথাটা আলগোছে দুদিকে ঘুরায়। নীরবে জানান দেয়, ‘না না। এরকম কিছু নয়।’

শিরিন সুলতানা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

-” ইভান আমার মনেহয় এমনিতেও তনুজাকে একবার ডক্টরের কাছে চেকাপ করতে নেওয়া জরুরী। হঠাৎ মাথা ঘোরা, জ্ঞান হারানো ভালো লক্ষণ নয়।”

শিরিনের কথার মাঝেই ইভান বলল,

-” মামণি ঠিক বলেছে। তনুজা তুমি রেডি হয়ে নাও।”

নুরজাহান ফোড়ন কাটলেন,

-” ঐযে ছোটো বউমার বান্ধবী এক ডাক্তারনী আছে না, তার কাছে নিয়ে যাও। হ্যা সুখবর শুনলে ফোন করে সাথে সাথে জানাবা। আর আসার সময় দুহাত ভর্তি মিষ্টি আনবা।”

সুখবর শব্দটি শুনে ইভানের খবর খা”রাপ হচ্ছে। কেমন টেনশন হচ্ছে।

#চলবে