#প্রণয়ের_বাঁধন |১৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঋতুতে হেমন্তকাল। বিকেল থেকেই আকাশে একদল কালো মেঘের আনাগোনা চলছিল। গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে বসুন্ধরায় সন্ধ্যা নামতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়। সন্ধ্যা থেকে একটানা দেড়ঘন্টা ধরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর সাথে দমকা হাওয়া বইছে। ভরা কার্তিকে হঠাৎ করেই বৈরী আবহাওয়ার দেখা মিলল। রাতে পিচের ভেজা রাস্তায় কৃত্রিম আলোতে বৃষ্টির পানি চিকচিক করছে। ঠান্ডা ঠান্ডা চমৎকার পরিবেশ। এই সুন্দর চমৎকার আবহাওয়াতেও ইভানের ভেতর কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। কপালে মুক্তোর মতন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দিদুনের ওভাবে বলায় ভেতরে ভেতরে টেনশন হচ্ছে তার। যতক্ষণ না শিওর হচ্ছে ততক্ষণে স্বস্তি মিলবে না; এটা নিশ্চিত।
ইভান দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ তার পাশে বসা রমণীতে। নিম্নাষ্ঠে দাঁত বসিয়ে একপল কোণাচোখে পাশের সিটে বসা তনুজার দিকে চাইল। পরপর নজরে আসলো ক্লান্তি আর অবসাদে ছেয়ে থাকা একটা মায়াবী মুখশ্রী। নিমিষেই অস্থিরতা দূর হয়ে সেখানে মায়া আর একটা সুপ্ত অনুভূতি জন্মাল ইভানের হৃদগহীনে। পরপর শ্বাস টেনে নিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দেয় সে।
ঢাকার নামিদামি আভিজাত্য পূর্ণ স্কয়ার হাসপাতালের পার্কিং লনে গাড়িটা পার্ক করে ভেতরে যায়। লিফটে করে সাততলাতে কাংখিত চেম্বারটির সামনে আসে। রিসিপশন ডেস্কের গার্লের সাথে কথা বলতে থাকে ইভান। তনুজা ডোরের পাশে বড় নেইম প্লেটে নজর বুলায়। গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর সাবরিনা খানম****** নামের সাথে ডিগ্রি গুলো দেখে বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নামকরা ডক্টর। ডেস্কে দায়িত্বে থাকা মেয়েটি ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি টেনে কোমল স্বরে বলল,
-” ভেতরে পেশেন্ট আছে। স্যার; প্লিজ আপনারা বসুন। আমি ম্যামকে আপনাদের কথা বলছি।”
ইভান প্রত্যুত্তরে বলল,
-” থ্যাংকস।”
মেয়েটির ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হয়,
-” ওয়েলকাম।”
ইভান পরপর একহাত দিয়ে ইশারা করে তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” তনুজা! তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চলো বসবে।”
তনুজা পলক তুলে তাকিয়ে নীরব সম্মতি দেয়। ওয়েটিং চেয়ারে পাশাপাশি দু’জনে বসে। না চাইতেও কেনো জানি ইভানের টেনশন হচ্ছে। কোথাও শুনেছিলো, আগের দিনের মানুষ; বিশেষ করে মুরব্বিরা এসব ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়। কোনো মেয়ের খাওয়া-দাওয়া, শরীরের অবয়ব দেখে অনুমান করতে পারে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা কীনা। আর দিদুন যেভাবে বলল, সেই শুনে তো ইভানের আকাশসম চিন্তা হচ্ছে। উঁহু! চিন্তা নয়। বরং দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ইভান বসে আরাম পাচ্ছে না। উসখুস করছে। একবার চেয়ারে গা হেলান দিয়ে বসছে; তো সোজা হয়ে। আবার হাত দু’টো কাঁধের পিছনে দিয়ে পা টানটান করছে। ফের গুছিয়ে দুইহাতে মুখটা চেপে ধরে মাথা নুইয়ে আছে। সামনের চেয়ারে এক গর্ভবতী মহিলা বসে। পেট দেখেই অনুমান করা যায়, ভরা পেট তার। তবুও মহিলাটা ইভানের মতো এরকম উসখুস আর নড়াচড়া করছে না। দশমাসের গর্ভবতী মহিলার থেকেও বেশি নড়াচড়া ইভান করছে। তনুজা আড়চোখে ইভানের হাঁসফাঁস নোটিশ করল। তবে কিছু না বলে নিশ্চুপ রইল। ইভান চোখ বন্ধ করে কিছু মনে করতে থাকে। এক বিছানায় থাকে তারা। আর ড্রিংক করে আসে, ড্রিংক করলে তো সবকিছু মেমরিতে থাকে না। ইভানের ইচ্ছে করছে তনুজাকে শুধাতে,
-” আমি তো তেমন কিছুই মনে করতে পারছি না। কখনো কী ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকাকালীন তোমাকে ছুঁয়ে ছিলাম? আমার মনে না থাকলেও তোমার তো মনে থাকার কথা।”
পরপর নির্বোধের মতো এহেন ভাবনা মস্তিষ্কে আসতেই ইভান মনেমনেই নিজের মাথায় নিজেই চাটি দেয়। কী অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা আসছে! তন্মধ্যে ডাক আসতেই তার আজগুবি ভাবনার ছেদ ঘটে। দু’জনে ভেতরে যায়। ইভান “Pull me” দরজাটা একহাতে টান দিয়ে তনুজাকে ইশারা করে। পরপর দু’জনে ভেতরে যায়। ইভান নম্র স্বরে সালাম দেয়। ডক্টর সাবরিনা অমায়িক হেসে উত্তর দেন। সাথে মিষ্টি হেসে স্বাগত জানান। শিরিনের পরিচিত সাবরিনা। ওদের ফ্যামেলির সাথে ভালো একটা সম্পর্ক আছে। তাই আগে থেকেই চেনাজানা। প্রৌঢ় সাবরিনা মুখে একটা আভিজাত্যের ছাপ। ব্যবহারও বেশ অমায়িক। কণ্ঠে ঝরল আন্তরিকতা,
-” প্লিজ টেইক সিট।”
-” থ্যাংকস।”
ইভান তনুজা পাশাপাশি চেয়ারে বসল। সাবরিনা আলতো হেসে বলল,
-” শিরিন বিকেলে ফোন দিয়েছিলো। তুমি আসছো জানাতে।”
একটু থেমে তনুজার দিকে একপল তাকিয়ে ফের বলল,
-” মাশাআল্লাহ! বউমা কিন্তু দারুণ হয়েছে! ভারী মিষ্টি দেখতে।”
সামনের উপর প্রশংসায় তনুজা একটু অপ্রস্তুত হয়। তবে ইভান স্বাভাবিক থাকে। বিনিময় বলে,
-” থ্যাংকস আন্টি।”
-” শুধু শুকনো থ্যাংকস দিলে চলবে না বেটা। দাওয়াত কিন্তু মিস করে গিয়েছি। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া কিন্তু পাওনা রয়ে গিয়েছে।”
সাবরিনা রসিকতা করে বলেন। ইভান স্বল্প হাসল। বলল,
-” শিওর! শিওর আন্টি।”
তনুজার একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। সাবরিনা অমায়িক হাসলেন। কণ্ঠে আদূর জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-” এই রে এত কথা বলছি নামটাই তো এখনও জানা হলো না। কি নাম তোমার?”
তনুজা মিহি গলায় বলল,
-” ফারিশতা নূর তনুজা।”
-” নাইস নেইম! তোমার মতোই ভারী মিষ্টি তোমার নামটা।”
তনুজা প্রত্যুত্তরে হালকা হাসল। এরমধ্যে সাবরিনা বেল বাজাতেই একজন নার্স আসে। তার রুটিনমাফিক সে পেশেন্টের ওয়েট আর ব্লাড প্রেশার মেপে নেয়। সাবরিনা তনুজার নাম, বয়স প্রেসক্রিপশনে লিখতে থাকে। নার্সটি বিপি বলতেই সাবরিনার কপালে ভাঁজ পরে। পরপর প্রেসক্রিপশনে বিপি টুকে রাখতে রাখতে বললেন,
-” প্রেশার তো একদমই লো।”
সাবরিনা হাত দু’টো টেবিলের উপর ভাঁজ করে রাখলেন। তনুজার দিকে মনোযোগ দিয়ে শুধোলেন,
-” আচ্ছা এবার বলো, কী কী সমস্যা হয়?”
তন্মধ্যে ইভান বলে উঠল,
-” আন্টি আপনি ওর থেকে সবটা শুনে নিন। আমি বাইরে ওয়েট করছি।”
তনুজাকে প্রাইভেসি দিতে ইভানের এরুপ বলা। সাবরিনা অমায়িক কণ্ঠে বলল,
-” থাকতে পারো; আমার কোনো অসুবিধা ছিলো না।”
ইভান তনুজার দিকে চাইল। পরপর বলে উঠল,
-” সমস্যা নেই আন্টি। আমি বাইরেই আছি। তনুজা সবটা বলে নিক। ততক্ষণে আমি আসছি।”
-” ওকে।”
ইভান এবার তনুজার দিকে চাইল। সে বলে,
-” যা যা অসুবিধা হয় সবটা আন্টিকে খুলে বলো। কোনো কিছু লুকিও না। সবটা নির্দ্বিধায় বলো; কেমন? আর হ্যাঁ; আমি বাইরেই আছি। নার্ভাস হয়ো না।”
তনুজা আরেক দফা বিস্মিত হয়। তাকে প্রাইভেসি দিচ্ছে। আবার এদিকে ভরসা আর সাহস বাণী আওড়াতেও ভুলেনি। বাইরের টিপটিপ বৃষ্টির সাথে হওয়া শীতল হাওয়ার মতোই; তনুজার মনের কোণে শান্ত শীতল হাওয়া বয়ে যায়। সাথে শিহরিত হয়, আবেশিত হয় তনুজার অন্তরাত্মা। তনুজা চোখের পলক ফেলে ইশারাতে “ঠিক আছে” বোঝায়।
কিছুক্ষণ পর,
তনুজাকে চেকাপ করার পর ডক্টর সাবরিনা ইভানকে ডাকে। ইভান চিন্তিত উদ্বিগ্ন মুখশ্রীতে বসে। সাবরিনা আলতো হেসে বলতে থাকেন,
-” শিরিনের সাথে কথা বলার সময় তোমার দিদুন পাশে ছিলেন। আন্টি ফোন নিয়ে কথা বলেছিলেন।”
তনুজা এবার লজ্জা পেল। না জানি দিদুন কী কী বলেছে? সাবরিনা বলতে থাকে,
-” আন্টিকে বলো অমন কোনো সুখবর নেই। অমন কিছু বলতে পারলে, আমার নিজেরই ভালো লাগত।”
ইভানের মাথার উপর থেকে চিন্তার পাহাড়টা দূর হয়। পরপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনেমনে আওড়ায়, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ যা কিনা কারো কর্ণগোচর হয় না।
সাবরিনা মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বলতে থাকেন,
-” যাইহোক এখন আসল কথায় আসি, পেশেন্টের প্রেশার লো। আর কোনো কারনে খুব বেশি চিন্তা করে হয়ত। আমি কয়েকটা টেস্ট দিচ্ছি সেগুলো আজই করে নিও। এখন কিছু মেডিসিন দিচ্ছি। সেগুলো চলবে। আর টেস্টের রিপোর্টগুলো আমার হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ট করো। আমি দেখে নিউ মেডিসিন অ্যাড করে দিবো। আর হ্যা; ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল বেশি বেশি খেতে হবে। পেশেন্টের শরীর খুব উইক। রেস্টে থাকতে হবে।”
ইভান কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চাইল,
-” থ্যাংকস আ লট আন্টি।”
-” ওয়েল কাম বাচ্চা।”
কিছু সৌজন্যমূলক আচরণ করে বের হয় ওরা।
পরপর রিসিপশনে গিয়ে বিল পে করে প্যাথলজিতে যায়। টেস্টের জন্য স্যাম্পল হিসেবে ব্লাড কালেক্ট করা হয়। এদিকে বেশ ভালোই রাত হয়ে আসছে। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচের দেওয়ালে চোখ পড়তেই বৃষ্টির অবস্থা ঠাহর করে ইভান। এদিকে তনুজার বিশ্রাম প্রয়োজন। এখানে এভাবে বসে থাকলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। সেই ভেবে ইভান ভ্রুকুটি করে বলল,
-” তনুজা?”
তনুজার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘনপল্লব টেনে তুলে অস্ফুটে আওড়ায়,
-” হুঁ।”
ইভান দুই হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে ছিল। পরপর বাম হাতটা বের করে হাতঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বলল,
-” রিপোর্ট দিতে দুই ঘন্টার মতো লাগবে। অলরেডি সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি যেতে যেতে দশটা বেজে যাবে। আর তুমি তো অসুস্থ। এভাবে এখানে থাকলে সমস্যা হবে। তাই বলছি কালকে সকালে অফিস যাওয়ার পথে আমি রিপোর্টগুলো নিয়ে নিবো। এখন চলো বাসায় যাওয়া যাক।”
এসব কিছু যেনো তনুজার কাছে অপ্রত্যাশিত। দাদি ছাড়া তার জীবনে তাকে নিয়ে কখনো কেউ এভাবে ভাবেনি!
.
ঝুপঝুপ বৃষ্টির মধ্যে পার্কিং লনে আসতে গিয়ে তনুজা ইভান হালকা ভিজে যায়। ইভান সিটে বসে একহাতে ভেজা চুলগুলো ঝেরে নিতে নিতে তনুজার দিকে তাকাল। তনুজার শীত শীত করছে। এমনিতেই দূর্বল শরীর, ঠান্ডা ওয়েদার। তার উপর কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়েছে। তনুজা জুবুথুবু হয়ে বসে। একটা হাতের উপর অন্য হাতটা রেখে হালকা ঘসছে। আচমকা গায়ে উষ্ণতার ছোঁয়া পেতেই তনুজা চমকায়। পরপর অপ্রস্তুত হয়ে ঘাড় ঘুরাতেই ইভানের চোখের তারায় চোখ মিলল। ইভান ওর ব্লেজার খুলে তনুজার গায়ের উপর দিয়ে দেয়। শীতল কণ্ঠে বলল,
-” তোমার বোধহয় শীত করছে। এটা জড়িয়ে নাও। উষ্ণতা অনুভব হবে। বেটার লাগবে।”
তনুজা ফ্যালফ্যাল করে কিছুপল ইভানের শান্ত মুখাবয়বের দিকে ঠাঁই চেয়ে রইল। ইভান সোজা হয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তনুজা দুইহাতে ব্লেজারটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। পরিচিত কড়া ম্যান পারফিউমের সুঘ্রাণটা তনুজার কাছে ভীষণ ভালো লাগছে। আচমকা তনুজা দুইহাতে ব্লেজারটা চেপে ধরে, তারপর নাক টেনে সুঘ্রাণটা নেয়। কেমন এক টুকরো প্রশান্তিতে চোখদুটো বুজে আসে তার। এভাবে চোখ বুঁজে থাকতে থাকতে অল্প সময়ের মধ্যেই তনুজা ঘুমিয়ে পরে। মাথাটা গাড়ির ঝাঁকুনিতে এদিক-ওদিক গড়িয়ে পড়ছিল। ইভান আলগোছে তনুজার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রাখল। একহাতে আগলে নিলো নিজের সহধর্মিণীকে। তনুজা ঘুমের মাঝে একহাত দিয়ে ইভানের পেট পেঁচিয়ে শার্ট আঁকড়ে ধরে। বাচ্চাদের মতো ঘুমানো নিজের বউয়ের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে চেয়ে ইভানের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফোটে। এই মূহূর্তটা ইভানের কাছে বেশ ভালো লাগছিলো। একহাতে খুব স্লো স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করছিল। হঠাৎই হালকা ভলিউমে অরিজিৎ সিং এর গান চালু করে,
-” হাম তেরে বিন আব রেহনাহি সাকতে,
তেরে বিনা কীয়া ইয়াজুদ মে’রে
তুঝসে জুদাগার হো জায়েঙি
তো খুদসে হি হো জায়েঙি জুদা
কিউকি তুম হি হো, আব তুম হি হো
জিন্দেগি আব তুম হি হো
চ্যানভি, মেরা দারদভি,
মেরি আশিকী আভ তুম হি হো।”
ইভানের অবচেতন মন গানের প্রতিটি লাইনে তনুজাকে কল্পনা করে। এইযে তনুজা বুকে আছে কেমন শান্তি, শান্তি অনুভব হচ্ছে। আর এই মেয়েটির উপর শুরু থেকেই কেমন একটা দরদ অনুভব হয়। কেমন আদূরে একটা মেয়ে। না চাইতেও মায়ায় ফেলে দিয়েছে। একটু একটু করে মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে। এখন চাইলেও বোধহয় মায়া কাটানো সহজ নয়।
.
পরেরদিন.. টেস্টের রিপোর্টগুলো ইভান নেয়। এমনিতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। প্রেশার লো, তারপর র*ক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ একটু কম ছিলো। ইভান ডক্টরের সাথে কনসালট করে। ডক্টর বলেন,-” চিন্তার কোনো কারণ নেই। মেডিসিনগুলো নিলে, আর পুষ্টিকর খাবার খেলে ঠিক হয়ে যাবে।” ইদানিং রাতে বাড়ি ফিরেই ইভানের প্রথম প্রশ্ন থাকে,
-” ঠিকঠাক ঔষধ খেয়েছো? আর ডিম-দুধ খেয়েছো তো?”
ইভানের কেয়ারে দিনদিন তনুজা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছে। এতটা আদর-যত্ন যে তার আশাতীত ছিলো। তবে মাঝেমধ্যে ভ’য় হয়! এতটা স্বাভাবিক জীবন কী তার ভাগ্যে সইবে! না জানি ভাগ্য তাকে কখন; আবার কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। এই ভয়ে তনুজা সারাটাক্ষণ তটস্থ থাকে। অজানা ভ’য়ে বারংবার আতংকিত হয়।
__________
তিন সপ্তাহ খানেক পর,
রৌদ্রজ্জ্বল ঝরঝরে সুন্দর একটা দিন। ঝকঝকে ফকফকা পরিষ্কার আকাশ। সময়টা সকাল দশটার দিকে। নিতি আর নৃত্য দুইবোন গার্ডেনে । নিতি গতকালই বাড়িতে আসছে। দুইবোন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুল দেখছে আর গল্পের ঝুরি নিয়ে বসেছে। নৃত্য জমে রাখা সব গল্প উগড়ে দিচ্ছে। এই কয়দিনে কোথায় কী ঘটেছে! পাশের বাসার রুম্পা কোথায় ডেটে গিয়েছে সব আপডেট জানাতে থাকে আপুকে। নিতি বিরক্ত হয়ে ধ’ম’ক দিয়ে বলল,
-” থামবি তুই। মানুষের বাড়ির খবরাখবর বাদ দিয়ে নিজের বাড়ির আপডেট দে। ছোট মির্জার কী খবর, তাই বল? সে কী ইউএসএ চলেই যাচ্ছে? তার ডিসিশন চেঞ্জ হচ্ছে না?”
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে নিতির মুখটা ম্লান হয়ে আসে। নৃত্য ঠোঁট উল্টে বলল,
-” দিব্য ভাইয়ার কথা বলছো? হ্যা সে তো কাগজপত্র অলরেডি জমা দিয়েছে। ইভেন তার ইউএসএ থাকা মামাকে দিয়ে দ্রুত ভিসা পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করছে। মামী বারণ করছে, তারপর মামাও। কিন্তু সে শুনছে না বারণ। আমি যতদূর জানি, এই তো ডিসেম্বরের মধ্যেই সে চলে যাবে।”
নিতির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মুখটা বেদনায় বিবশ হয়ে আসে। সুন্দর ঝলমলে পরিবেশটা মূহুর্তেই বিস্বাদ আর বেদনায় নীল হয়ে গেল। নৃত্য হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বলল,
-” অ্যাই আপু চলো ফুল গাছে পানি দেই।”
মনের এককোণে বেদনাটা লুকিয়ে রেখে মুখে জোর করে হাসি ঝুলিয়ে নিতি বলল,
-” ওকে। মটরের সুইচ দিয়ে আয়।”
নুরজাহান আর দূর সম্পর্কের আত্মীয় এক বৃদ্ধা মহিলা। বাসার ভিতর থেকে গল্প করতে করতে বেরিয়ে আসছিলো। দু’জনেই পান চিবুতে চিবুতে খোশগল্প করছে। হঠাৎ নিতির দিকে নজর পড়তেই বৃদ্ধা মহিলা নুরজাহানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” ভাবি ঐটা তোমার নাতনি না?”
নুরজাহান গালে থাকা পানের পিক একটু দূরে গিয়ে ফেলে আসলেন। গালটা মুছে বললেন,
-” হ্যা! ক্যান কী হয়েছে?”
-” মাশাআল্লাহ! তোমার নাতনি তো দেখতে শুনতে বেশ সুন্দরই। আর বিয়ের উপযুক্তই তো দেখছি। তা বিয়ে-শাদি দিবা না। আমার এক পরিচিত ভালো পাত্র আছে। বাপের বড় ব্যবসা একমাত্র ছেলে। অগাধ ধন সম্পত্তিতে ভরপুর।”
-” বিয়ে-শাদি তো ফরজ। তা বিয়ে তো দিতেই হবে। আর আমাদের মধ্যে এখন নিতিই বিয়ের সিরিয়ালে আছে। ভালো সুপাত্র পেলে দিবো। তবে অর্থ-সম্পদের আগে ছেলের স্বভাব চরিত্র দেখতে হবে। কোন বংশ, বংশের আচার-ব্যবহার দেখতে হবে। আর নিতি আমাদের এখানে থাকলেও ওর বিয়ে-শাদি এসকল বিষয়ে ওর প্রধান অভিভাবক ওর বাবা। তাই আমি জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারি না। আমার অধিকার নেই। শুনেছি ওর বাবা নাকি তার বন্ধুর ছেলের সাথে নিতির বিয়ে দিতে চায়। তাই আমি আর আগ্রহ নিয়ে এই ক্ষেত্রে আগাইনি।”
নিতির কানে সবটা আসে। বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকায় নিতি। মনে মনে আওড়ায়,
-” এই হলো এক সমস্যা। পুরো চৌদ্দ গুষ্টিসহ, আশেপাশের সবার নজর এখন আমার উপর। ঐযে বিয়ের সিরিয়ালে এখন আমি যে।”
হঠাৎ নিতি চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
-” নানুআপু ভুল বললে তো। বিয়ের সিরিয়ালে আমি নই। বিয়ের সিরিয়ালে এখন তোমার ছোট নাতি আছে। কজ সে আমার থেকে বড়।”
নুরজাহান কপাল কুচকালেন। বললেন,
-” বুদ্ধি শুদ্ধি তোমার দিন দিন বাড়ছে না তো কমছে। ছোট নাতি ছেলে। আর তুমি মেয়ে। সেখানে তোমার সাথে ওকে ধরছো। ছেলে মানুষ কামাই-রুজি করবে তারপর তো বিয়ে-থা করবে নাকি।”
এরমধ্যে পানির পাইপ দিয়ে গলগল করে পানি পড়তে থাকে। নৃত্য বোধহয় সুইচ অন করে দিয়েছে। নিতি পাইপটা হাতে তুলতে তুলতে বলল,
-” নানুআপু এইজন্য! ঠিক এইজন্যই তো তোমার ছোট নাতি দেশ ছেড়ে বিদেশে পারি জমাতে চাইছে।”
নুরজাহান নির্বোধের মতোন চাইলেন। নিতি দাঁত কেলিয়ে বলল,
-” এইযে কবে কামাই রুজি করবে, তারপর তোমরা তার বিয়ে দিবে। তাই তো সে রাগ করে দেশেই থাকতে চাইছে না। বলছি তাকে বিয়ে দিয়ে দাও। বউয়ের মায়ায় হলেও বাইরে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলবে।”
নুরজাহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-” তাকে বিয়ে দিবো, সে কী আমার কথা শুনবে? বড় নাতি তাও একটু-আধটু আমার কথা শোনে। তাকে জোর করে হলেও বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু ছোটটারে সম্ভব হবে না। আমার কথা তো তার সয্যই হয় না। তার সাথে তো আমার দা-কুমড়া সম্পর্ক।”
নিতি সফেদ দাঁত বের করে বলল,
-” আলবাত শুনবে। বিয়ের কথা কখনো বলেছো কী? যে আগেই বলছো শুনবে না। আর আমার কী মনেহয় জানো? এইযে ক’দিন পর শীত আসছে। বিয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়া সত্ত্বেও আরো একটা শীত তাকে বউ ছাড়া কাটাতে হবে। সেই রাগ-ক্ষোভ থেকেই কিন্তু তোমার ছোট নাতি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই বলছি বাইরে না গিয়ে আশেপাশে, সামনে-পিছনে, কত মিষ্টি মেয়ে আছে। তাদের মধ্য থেকে..”
কথা বলতে বলতে ডান সাইডে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ঘুরাতেই নিতির মুখটা হা হয়ে যায়। থতমত খায় সে। একজোড়া অ/গ্নিচক্ষু তার দিকে তাক হয়ে আছে। এইযেনো চোখ দিয়ে ভ’স্ম করে দিবে। নিতির সফেদ দাঁত বের করে হাসিহাসি মুখটা নিমিষেই মিলিয়ে যায়। ভ’য়ে নিতির পা দু’টো কেপে উঠল। দিব্য বাইরে যাওয়ার জন্য বেরুচ্ছিল, নিতির কথাশুনে চট করে মেজাজ চড়ে যায়। তাকে নিয়ে মেয়েটা একের পর এক আলতু ফা’লতু বলেই যাচ্ছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দিব্য চলে যেতে থাকে। নিতির গা হিম হয়ে আসছে। দিব্য নিশ্চয় কষিয়ে একটা রাম ধ’ম’ক দিবে। দিব্য যত এগোতে থাকে নিতির ভয় বাড়তে থাকে। আজগুবি কথাবার্তা আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছি। এইভেবে নিতি হাতের পাইপটা নিয়েই দিব্যর দিকে পুরো ঘুরে দাঁড়ায়। ঘুরার ফলে পাইপের মাথা দিব্যর বরাবর হয়, আর অমনি একটা লঙ্কা কাণ্ড ঘটে যায়। দিব্যর গায়ে পানি ছিটিয়ে পরে। আচমকা পানি পরায় দিব্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,
-” হোয়াট রাবিশ? এটা কী করলি।”
নিতি ধপ করে হাতের পাইপটা নিচে ফেলে দেয়। আর একহাতের নখ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে; তড়িঘড়ি করে বলে,
-” স্যরি! স্যরি! খেয়াল করিনি।”
দিব্য রাগে অ”জগর সাপের মতো ফুঁসতে থাকে। সে এখন রেডি হয়ে বাইরে যাচ্ছিল। আর এই নিতিটা তাকে ভিজিয়ে দিলো। দিব্য পারছে না নিতিকে আস্ত চিবিয়ে কাঁচাই খেয়ে ফেলতে। তবে এই ফাজিল মেয়েকে এমনি ছেড়ে দিলে বড় বার বারবে। দিব্য দাঁতে দাঁত পিষে নিতির দিকে এগিয়ে আসলো। নিতি কাঁদো কাঁদো ফেস করল। কণ্ঠটা সর্বাত্মক অসহায় করে বলল,
-” স্যরি বললাম তো। এবারের মত মাফ করে দাও। ”
দিব্যর হৃদয় নরম হলো না। সে উবু হয়ে পাইপটা হাতে তুলে নিয়ে নিতির মুখ বরাবর ধরল। এরমধ্যে নৃত্য এসে একপাশে হা হয়ে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধা দু’জনে কথা বলতে বলতে ওদিকে এগিয়ে গিয়েছে। চোখেমুখে পানি পরতেই নিতি হাত দু’টো নিজের মুখের উপর ধরল। পানির জন্য চোখ মেলে চাইতে পারছে না নিতি। হাত দু’টো মুখের উপর রেখেই বলল,
-” থামো প্লিজ। আমি পুরো ভিজে যাচ্ছি তো।”
দিব্য দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” আমার সাথে ফাজলামো করার আগে মনে ছিলো না? আর আমাকে নিয়ে সবসময় উল্টো পাল্টা বলা। আর কখনো ফাজলামি ক..”
হঠাৎ দিব্যর কথা থেমে যায়। এরমধ্যে নিতি ভিজে একাকার। নিতির গায়ে সবুজ কুর্তি। গায়ে ওড়না ছিলো না। আঁটসাঁট কুর্তি ভেজার দরুন মেয়েলি অবয়ব স্পষ্ট হয়। দিব্য তড়িৎ দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। পাইপটা ছুঁড়ে গটগট পা ফেলে প্রস্থান করতে থাকে। হঠাৎ থেমে উল্টোদিক ঘুরেই থমথমে স্বরে বলল,
-” সোজা রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিবি। আর এক সেকেন্ডও যেনো এখানে দেরি না হয়। ওপাশে সিকিউরিটি গার্ড আছে। এক্ষুনি ভেতরে যাবি।”
আর দ্বিতীয় কথা না বলে দিব্য ওর মতো চলে যায়। নিজের দিকে নজর পড়তেই নিতির ভীষণ লজ্জা লাগে। পরপর চুলের খোঁপা খুলে কাঁধের দুপাশ দিয়ে সামনে দেয়। আর এক দৌড়ে ভেতরে যেতে নেয়। রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে বড়বড় শ্বাস ফেলে নিতি। লজ্জা আর অস্থির মাঝেও দিব্যর প্রতি মুগ্ধ হয়। তার অবচেতন মন আওড়ায়,
-” একেবারেই ভুল কাউকে পছন্দ করিনি। সে এতটাও খারাপ নয়।”
____________
সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই। শিরিন আর তনুজা সার্ভ করছে। ইভান, নিতি-নৃত্য, তামান্না আর নুরজাহান খাবার খাচ্ছে। শিরিন হঠাৎ ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” ইভান!”
-” হ্যা মামণি বলো।”
-” আজকে তো আরকে গ্রুপ এর এমডির ছেলের এনগেজমেন্ট পার্টি আছে। আমাকেসহ তোমার চাচ্চুকে ইনভাইট করেছিলো। তোমাকেও তো ইনভ্যাইটেশন কার্ড দেওয়া হয়েছে। তোমার চাচ্চু তো অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছে। আর আমার শরীরটাও একটু অসুস্থ। তাই সম্ভব হবে না। তাই বলছি ইনভাইট রক্ষার্থে হলেও তুমি যেয়ো কেমন?”
-” ওকে মামণি।”
-” আর হ্যা বলছি তনুজাকে সাথে নিয়ো। যেহেতু ফ্যামেলি মেম্বারসহ ইনভাইট করা।”
ইভান একপল তনুজার দিকে চাইল। ফের শিরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ঠিক আছে মামণি।”