প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-২০

0
207

#প্রণয়ের_বাঁধন |২০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

রাতের আকাশ মেঘে ঢাকা। কখন জানি বৃষ্টি নামবে এমন অবস্থা। কালো মেঘের চাদরে মুড়ানো আকাশের দিকে চেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তনুজা। দুই হাত বুকে ভাঁজ করে উদাসী হয়ে ভাবনার সুতো ছড়িয়ে; ভাবতে মশগুল। হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দে ভাবনার সুতোয় টান পরে। পরপর সুপরিচিত মিষ্টি কণ্ঠস্বর আসলো,

-” ভাবিমণি, আছো?”

এগিয়ে স্মিত হেসে বলে তনুজা,

-” হ্যাঁ, নিতি। ভেতরে এসো।”

নিতি বিনিময় মিষ্টি হেসে ভিতরে ঢুকে। তনুজা ফের বলে উঠল,

-” বসো।”

নিতি ছোট করে শ্বাস ফেলল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

-” পরে বসব। এখন নয়। যে জন্য আসা। নানুআপু পাঠালেন আমায়। নানুআপুর এক খালাতো বোন সাথে ছেলের বউ, নাতির বউ; এক কথায় বলতে গেলে পুরো ফ্যামেলি এসেছে। এদিকে তাদের কোন এক আত্মীয়ের বাসায় বউ ভাতের দাওয়াত ছিলো। সেখান থেকে ফেরার সময় নাকি ভাবলেন নানুআপুকে একবার দেখে যাবেন, তাই এসেছেন। এখন ভাইয়া বিয়ে করেছে শুনে। ভাইয়ার বউ দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে। নানুআপু তোমাকে নিচে যেতে বলেছেন।”

তনুজা আলতো হেসে বলল,

-” আচ্ছা।”

নিতি সতর্ক কণ্ঠে বলল,

-” নানুআপু আমাকে বলে দিয়েছে, তারা যেহেতু তোমাকে এই প্রথম দেখবে। তাই একটু পরিপাটি হয়ে আসতে। মানে একটু সাজগোজ করে।”

তনুজা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে ছোট করে বলল,

-” তাই”

-” হুম। নানুআপুর এই খালাতো বোনটা না খুব শুচি বাই। আর কেমন খুঁতখুঁতে। সব কিছুতেই নাক সিঁটকানোর নেচার তার। আবার মান্ধাতার আমলের চিন্তা-ভাবনায় মনমস্তিষ্ক ঘেরা। আমার তো বুড়িটারে চরম লেবেলের এলার্জি লাগে। মাত্র পাঁচ মিনিট ওখানে ছিলাম। তাই বিরক্তিতে আজকের মতো নিচে যাওয়ার শখ ম-রে গিয়েছে আমার। ইয়া আল্লাহ! এই নানুটা নানুআপুর থেকেও এক কাঠি উপরের খিটখিটে মেজাজের। ভাবতে পারছ তুমি! তাহলে কেমন!”

নিতির মুখের এক্সপ্রেশন দেখে তনুজা ঠোঁট টিপে হাসে। নিতি সিরিয়াস মুখ ভঙ্গিতে ফের বলতে থাকে,

-” রবি ঠাকুরের ‘অপরিচিতা’ গল্পের বিনুদার মতোই অনেকটা। বিনুদা যেমন সবার পছন্দের অতি সুন্দরীকে চলনসই বলে। ঠিক এই নানুটাও অমন। কোনকিছুই তার মনে ধরে না। বাবরে! এখানেই ক্ষ্যান্ত নয়; এর তো আবার বুলেটের বেগে মুখ চলে। মুখের সামনেই সব বলে ফেলে। পুরাই অসয্য!”

তনুজা যেন নিতির কথায় ভীষণ মজা পাচ্ছে। ওর চিন্তা হওয়ার বদলে কেমন হাসি পাচ্ছে। তনুজা মজার ছলে বলল,

-” বিয়ে তো অলরেডি হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আপাতত রিজেক্ট হওয়ার ভ’য় নেই; তোমার সেই এলার্জি নানুর কাছে।”

নিতি প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে। শেষে তাড়া দিয়ে বলে,

-” আরেহ; আমি তোমাকে একটু সতর্ক করলাম এই আরকি। যাতে কিছু বলে ফেললে মন খা’রাপ করো না। আচ্ছা আমি যাই। তুমি চটজলদি রেডি হয়ে নিচে এসো।”
.

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তনুজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জানালার কাঁচ গড়িয়ে পরা বৃষ্টির ফোঁটা দেখে নিলো। চোখে হালকা করে কাজল দেয়, ঠোঁটে হালকা করে পিংক কালারের লিপগ্লস দেয়। পরপর শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে নেয়। তন্মধ্যে মুঠোফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। হাতে নিয়ে ইভানের কল দেখতে পায়। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,

-” হ্যালো? তনুজা?”

এই সময় ইভানের কল দেখে তনুজা বেশ অবাক হয়।

-” হুঁ।”

-” তুমি সবার সাথে ডিনার করে নিও। আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। এখানে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি ডিনার করে ফিরব।”

-” আচ্ছা।”

-” বাই।”

আর বাক্য ব্যয় না করে খট করে কল কাটে ইভান। আগের মতো রাত করে বাড়ি ফেরে না সে। বাড়িতেই সবার সাথে ডিনার করে। ইভানের এই পরিবর্তনে তনুজা খুশি। যতই হোক মানুষটা তার স্বামী। আর প্রত্যেকটা মেয়েই চায় তার স্বামী ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক। সব বাজে অভ্যাস থেকে শতশত মাইল দূরত্বে থাকুক। তনুজার চাওয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। ও মন থেকে চায়; ওর এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রণয়ের সুন্দর একটা পরিণয়।

____________

ড্রয়িংরুমে অনেকগুলো অপরিচিত মুখ। তনুজা নিচু গলায় সালাম দেয়। শুভ্র রঙা আটপৌরে শাড়ি পরনে বৃদ্ধা মহিলা কপালে ভাঁজ ফেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তনুজাকে। নুরজাহান বেগম বেশ প্রফুল্ল চিত্তে তনুজাকে সবার সাথে পরিচয় করে দিলেন। অতিথি প্রৌঢ়া মহিলাটি বেশ অমায়িক গলায় কুশলাদি বিনিময় করল। নিতির কথিত এলার্জি নানু ফারিদা বেগম ভ্রুতে ঢেউ তুলে নাকমুখ কুঁচকে বলে উঠলেন,

-” নুরি! নাতবউ দেখতে মিষ্টিই আছে। তবে গাঁয়ের রংটা একটু চাপা। গাঁয়ের রং আরেকটু উজ্জ্বল হলে, ছেলের সাথে ভালো মানাতো। মির্জা বাড়ির বড় বউ দর্শনধারীতে বেশ কমই হয়ে গেলো না!”

নুরজাহানের মুখে বিরক্তির ছাঁট পরে। পরপর কণ্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,

-” হ্যা বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে দর্শনধারীও একটা বড় বিষয়। তবে শুধু দর্শনধারী দেখে তো মূ-র্খ-রা। আমার মনেহয় গুণ আগে দেখতে হয়। আদব-কায়দা, লেহাজ আগে দেখতে হয়। সংসারের জন্য এসব বিষয়ই জরুরী। যাত্রা পালার অভিনেত্রীরাও তো ঢের সুন্দরী। কিন্তু তাদের দিয়ে কী, সুন্দর সংসার হয়? সভ্য সমাজের মানুষ কী তাদের ঘরে তুলতে চায়?”

কয়েকটা প্রশ্নের বাণে থিতু হয় ফারিদা বেগমের মুখ। ঐতো ওপাশের সোফায় ওনার নাতির বউ পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রল করছে। এটা নুরজাহানের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকল। এখানে বয়োজ্যেষ্ঠ সবাই আছে, তাদের মাঝে এভাবে বসা মোটেই শোভা পাচ্ছে না। বরং মেয়েটার মধ্যে আদব-কায়দার যথেষ্ট অভাব; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিক দিয়ে তনুজাকে নিয়ে নুরজাহান গর্ব বোধ করেন। মেয়েটা আহামরি সুন্দরী না হলেও যথেষ্ট বিনয়ী আর ভদ্র।

__________

ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটার ঘর পেরিয়েছে। আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলা বর্ষ পঞ্জিকায় অগ্রহায়ণ মাস চলছে। অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহ; আর এদিকে বসুন্ধরায় ঠেকছে আষাঢিয়া বর্ষণ নামছে। জানালার কাঁচ টেনে দিতে গিয়ে তনুজার মুখে বৃষ্টির ছাঁট ছিটে আসে। ইভান খানিকক্ষণ আগেই ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই দুম করে পুরো রুম অন্ধকারে ঢেকে যায়। হঠাৎ কী হলো বুঝতে না পেরে ইভান বলে উঠল,

-” কী হলো?”

তনুজা অন্ধকারে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো; ওখানে দাঁড়িয়েই বলল,

-” বৃষ্টি হচ্ছে তো প্রচুর। লোডশেডিং হয়েছে।”

-” হুম। তবে আলো নিভে গেল যে! আইপিএসের প্রবলেম হয়েছে নাকি?”

কথাটা বলতে বলতে অন্ধকারে হেঁটে গিয়ে হাতড়ে ফোন বের করে ইভান। পরপর ফোনের ফ্লাশ অন করে। ফোনের মৃদু আলোয় তনুজা উল্টোদিক ঘুরে একহাতে জানালার সফেদ পর্দা টেনে দিতে দিতে বলল,

-” হ্যা। আইপিএসের প্রবলেম হয়েছে। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ কয়েকবার আপডাউন করছিলো, সেইসময় হঠাৎ করে আইপিএসের প্রবলেম হয়।”

ইভান ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে ব্রাশ করতে করতে শুধাল,

-” চলছে না! এখন যে প্রবলেম হয়ে গেলো। বৃষ্টির সময় কারেন্ট নেই। আগে থেকে আমাকে জানালে আমি মেকারকে পাঠাতাম। আর নয়তো একটা ব্যবস্থা করা যেতো।”

-” মামণি কথা বলেছেন। রাতেই তো হয়েছে। সকালে সারানোর লোক আসবে।”

ইভান বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ কাটল। পরপর বলে উঠল,

-” বাম পাশের ড্রয়ারে দ্যাখো ক্যান্ডেল আছে।”

তনুজা খুঁজে বড়বড় সুগন্ধিযুক্ত কয়েকটা ক্যান্ডেলের মধ্য থেকে একটা হাতে তুলে নেয়। কিছু ভেবে বলল,

-” এখন তো এটা জ্বালাতে অন্ধকারে কিচেনে যেতে হবে লাইটার আনতে।”

-” ওয়েট। আমি ব্যবস্থা করছি। তোমাকে কিচেনে যেতে হবে না।”

-” সমস্যা নেই আমি যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করে কিচেনে যেতে হবে না। দেখা গেল কষ্ট করে কিচেনে গেলেন। অথচ তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাইটার পেলেন না। তখন শেষমেষ আমাকেই যেতে হবে।”

-” তোমাকে বা আমাকে; কাউকেই এখন লাইটার আনতে কিচেনে যেতে হবে না। এখান থেকেই আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

তনুজা ঠোঁট উল্টাল। পরপর ভাবল কোন যাদুটাদু করে আলো জ্বালাবে! আশ্চর্য! উনি ম্যাজিক জানে নাকি? এইভেবে বিস্ময়ে তনুজার চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। ইভান কাংখিত জায়গায় খুঁজে একটা লাইটার বের করে আনে। তনুজার দিকে এগিয়ে যায়। তনুজার হাতে ক্যান্ডেল। ইভান হাত দিয়ে লাইটারে চাপ দেয়। এমন সময় তনুজা প্রশ্ন করে উঠল,

-” আপনি সিগারেটও খান?”

ছেলেদের কাছে এছাড়া তো গ্যাস লাইটার থাকার কথা নয়। তাই ভেবে সোজাসুজি প্রশ্ন করে ওঠে তনুজা। ইভান আ-গু-ন জ্বা’লা’তে জ্বা’লা’তে বলল,

-” আগে খেতাম মাঝে মধ্যে। তবে আপাতত বর্তমানে কোনো টাই খাই না। না ওয়াইন আর না সিগারেট।”

-” ওহ্।”

তনুজার হাতে ক্যান্ডেল মৃদু দীপ্ত আলো ছড়াচ্ছে। ইভান চোখ তুলে তনুজার দিকে চাইল। বাসায় ফিরে এতক্ষণে তনুজার মুখায়বে দৃষ্টি যায় তার। আচমকা ইভানের দৃষ্টি আটকায় তনুজার কাজল টানা মৃগনয়নে। তনুজার মুখে বৃষ্টির ছাঁট ক্যান্ডেলের দীপ্ত আলোয় মুক্ত দানার মত চিকচিক করছে। দারুণ মোহনীয় লাগছে। কিছু ভেবে তনুজা শুধায়,

-” আচ্ছা! এই ক্যান্ডেল গুলো আসলো কী করে? না মানে কোনো উপলক্ষে এনেছিলেন?”

ইভান তনুজার মুখায়বে দৃষ্টি রেখেই শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,

-” এই ক্যান্ডেলগুলো অনেকদিন আগের। এগুলো কক্সবাজার থেকে এনেছিলাম। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলাম। সবাই নিয়েছিলো তাই দেখাদেখি আমিও বেশ কিছু নিয়েছিলাম। বেশ কয়েক প্যাকেট এনেছিলাম, সবাইকে দেওয়ার পর কয়েকটা নিজের কাছে রেখেছিলাম। আগে কখনো প্রয়োজন পড়েনি।”

তনুজা স্মিত হেসে বলল,

-” ভালোই হলো আজকে কাজে দিলো।”

-” বড্ড খারাপ হলো।”

তনুজা নির্বোধের মতন চাইল। ভাসা ভাসা চোখদুটোতে প্রশ্ন খেলে যায় “মানে?” যার অর্থ সেকেন্ডেই পরে নেয় ইভান। তাই তো নিজে থেকেই পরপর প্রত্যুত্তর সাজিয়ে নেয়। তনুজার মুখের দিকে ঝুঁকে ঠান্ডা স্বরে বলল,

-” ক্যান্ডেলের দীপ্ত আলো, সাথে বৃষ্টি ভেজা আলতো হাওয়া! কাজল কালো স্নিগ্ধ সরল টানাটানা মৃগ আঁখিজোড়া। আমাকে বেসামাল করে তুলছে। হৃদয়ে অজস্র শিহরণ চলছে; বইছে প্রলয়কারী ঝড়। হাউ ক্যান আই কন্ট্রোল?”

কথাগুলো শ্রবণেদিয়ে পৌঁছাতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয় তনুজা। তড়িৎ বেগে মাথা নুইয়ে নেয়। গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ইভান তনুজার হাত থেকে ক্যান্ডেলটা নিয়ে পাশে ওয়্যারড্রোবের উপর নামায়। পরপর একহাতে তনুজার কোমড় জড়িয়ে ধরে দূরত্ব ঘুচায়। তনুজার বুক দুরুদুরু কাঁপতে থাকে। হিমালয় পর্বতের মত হিম শীতল হয়ে আসে তনুজার গোটা শরীর। ইভানের গরম নিঃশ্বাস চোখেমুখে পড়তেই; ঘনপল্লবগুলো সদ্য ফোঁটা কচি ফুলের ন্যায় তিরতির করে দুলতে লাগল। কাঁপছে তনুজার আকর্ষণীয় ওষ্ঠ। মুহূর্তেই পৃথিবী ভুলে যায় ইভান। ঘুমিয়ে থাকা পুরুষালি সত্তা ঝিমঝিময়ে উঠল। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে চেয়ে কণ্ঠে এক সমুদ্র মায়া ঢেলে ডাকল,

-” তনুজা?”

তনুজার হার্টবিট ফাস্ট হচ্ছে। দম বন্ধ বন্ধ ঠেকছে। তনুজা এত আদূরে মায়া জড়ানো ডাকটা উপেক্ষা করতে পারল না। দৃষ্টি নুইয়ে রেখেই অস্ফুটে আওড়ায়,

-” হু।”

-” কাজল কালো চোখে, হালকা গোলাপি ঠোঁটে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। শুধু ভীষণ বললে ভুল হবে ভ’য়ং’কর সুন্দর লাগছে।”

তনুজা লজ্জায় ডুবলো। আড়ষ্টতায় গাঁট হলো। ইভান মাথাটা নুইয়ে তনুজার কপালে কপাল ঠেকায়। চোখদুটো বুজে নিয়ে আওড়ায়,

-” সৃষ্টিকর্তার কত সুন্দর সুনিপুণ সৃষ্টি। জোড়ায় জোড়ায় করেছেন সৃষ্টি। আমরা শুধু শুধুই আগে হয়রান হই। লাইফ পার্টনার বেছে নিতে হারাম রিলেশনে যাই। অথচ প্রত্যেকের জন্য জীবন সঙ্গী সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করে রেখেছেন। শুধু একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। নিশ্চয় উত্তম কিছুই হবে। তারপরও কিছু হলে সেটা তো পরীক্ষা। বাট হতাশ হতে নেই ভাগ্যর উপর।”

একটু থেমে,

-” তোমার সাথে আমার ভাগ্য জোড়া ছিলো। আমি আমার সেই ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন মনেকরি। প্রণয়ের সুতোয় আমরা দু’জনে বাঁধা পড়েছি; প্রণয়ের সেই বাঁধন শক্ত-দৃঢ়, মজবুত করতে চাই। তোমার কাছে আমার বেশি কিছু চাওয়ার নেই। শুধু এতটুকু চাই আজীবন বিশ্বাস ভরসার মর্যাদা রাখবে। আর মন থেকে আপন করে নিবে। ব্যাস! তাতেই চলবে। আমার জন্য পুরো পৃথিবীর দরকার নেই। শুধু… শুধু বিশ্বস্ত একজন তুমি থাকলেই হবে। সেই তুমিটা একমাত্র তনুজা!”

তনুজার শরীরের কম্পন ক্রমশ বাড়ছে। চৈত্রের খরার ন্যায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে চৌচির হয়ে আসছে। জিহ্বা ভারী হয়ে আছে, বাকরুদ্ধ হয়ে আছে ও। বলতে চেয়েও কোথায় যেন এসে ভ’য়ে , আতংকে আঁটকে যাচ্ছে। ইভান বড় করে শ্বাস টেনে নেয়। পরপর তনুজার থুতনি ধরে উঁচু করে ইভান। তনুজার চোখদুটো বোজা। ইভান সে চোখে চেয়ে বলল,

-” তনুজা, তাকাও। আমার চোখে চোখ রাখ।”

তনুজার পায়ের তালু অবধি শিরশির করে উঠছে। কেমন অদ্ভুত অনুভূতিতে ওষ্ঠাগত হচ্ছে তনুজার প্রাণ। কাঁপা কাঁপা পলক তুলে চায়। ইভানের মুখটা তনুজার সফট গাল ছুঁইছুঁই। তনুজার গালে ডান হাতটা আলতো করে রাখে ইভান। ঠান্ডা গলায় বলল,

-” দিনদিন মা’রা’ত্মক ভাবে তোমার মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। না চাইতেও হুটহাট করেই আমার অবচেতন মন তোমাকে নিয়ে ভাবতে বসে। চায় তোমার সান্নিধ্য। আনবিলিভেবল বাট ট্রু; তনুজা আই লাভ ইউ। আই রিয়েলি লাভ ইউ।”

শেষের কথাগুলো তনুজার কানে বারকয়েক বারি খায়। কেমন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনাল। তনুজার মেরুদন্ডের শিড়দাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। অনুভূতির জোয়ার বইছে ওর মনেপ্রাণে। একদিকে ভালোলাগা আবার অন্যদিকে অজানা আতংক সব মিলিয়ে তনুজার টালমাটাল নাজেহাল অবস্থা। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসে ওর। আচমকা তনুজা ইভানের বুকে মাথা ঠেকায়। থেমে থেমে ধীমে স্বরে আওড়ায়,

-” ইভান! আমি জানি। আমি বুঝতে পারি আপনার চোখের ভাষা। মিথ্যে নয় আপনার কথা। অবিশ্বাস্যও নয়। ইভান আমিও আপনাকে ফিল করি। ইভান আমার ছোট্ট একটা রিকোয়েস্ট কখনো আমাকে ভুল বুঝবেন না, প্লীজ____।”

ইভানের হৃদস্পন্দন যেন ক্ষণিকের জন্য থমকাল। তনুজার শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ, সাথে মেয়েলি মিষ্টি গন্ধটা ইভানকে পা-গ-ল করে তুলছে। অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির ঢেউ খেলে গেল। মনমস্তিষ্ক আয়ত্তে রইল না। বাইরের দমকা হাওয়ার মতোই ইভানের মনে অনুভূতির তান্ডব শুরু হলো। বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ প্রকৃতি তারপর ব্যক্তিগত নারী; দু’টোই ইভানকে উস্কে দিলো। ইভান শুকনো ঢোক গিলে নেয়। এক হাতে তনুজার চুলে আটকানো কাঠি খুলে দেয়। মূহুর্তেই পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পরে তনুজার সুবিন্যস্ত ঘনকালো চুল। ইভান তনুজার চুলে মুখ ডুবায়। তনুজার কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। বাকি কথা শোনার আগেই ইভান মা’দকতা মেশানো কণ্ঠে বলল,

-” তনুজা! তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। ইদানিং সবসময়ই করে। আমার কী উচিত এই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখা? নাকি এই সুন্দর ওয়েদারে প্রাধান্য দিবো? প্রায়োরিটি দিবো মনের আকাঙ্ক্ষাকে?”

ইভানের এহেন কথা, তারপর এতটা কাছে থেকে তনুজারও কেমন হাঁসফাঁস ঠেকছে। প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করে না ইভান। মূহুর্তেই তনুজার কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠে ওষ্ঠ ডুবায়। অনুভূতির জোয়ারে ডুবন্ত তনুজা আচমকা অজান্তেই সায় জানায়। তনুজার একটা হাত ইভানের পেছনের চুলের মাঝে চলে যায়। আরেকটা হাতে পিঠের টিশার্ট খামচে ধরে। টিশার্টের উপর দিয়ে নখ বিঁধে যায় ইভানের পিঠে। আবেশে চোখদুটো বুঁজে আসে দু’জনের। বাইরে তুমুল বর্ষণ। ঘরে এক দম্পতির সম্পূর্ণ নতুন স্পর্শ; স্বর্গীয় অনুভুতিতে টালমাটাল অবস্থা। সময় গড়াল, রাত গভীর হতে থাকল; এদিকে ইভানের স্পর্শও গভীর হয়। তনুজার দু’চোখের কাজল লেপ্টায়, সুবিন্যস্ত চুলগুলো এলোমেলো হয়। বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ ঠান্ডা প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে তাদের পবিত্র বন্ধনের নতুন অধ্যায় রচিত হয়।

___________

দু’দিন পর…
শহরের যানজট কোলাহলময় রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করছে ইভান। পাশে বসে তনুজা। তনুজাকে কলেজ থেকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে ও। লাঞ্চের পর মিটিং আছে। তাই দ্রুত তনুজাকে বাসায় নামিয়ে ফিরতে হবে অফিসে। এরমধ্যে রিয়ার ভিউ মিররে দৃষ্টি যায় ইভানের। একটা কারের সাথে কালো রঙের বাইকের ধাক্কা লাগে।

#চলবে