#প্রণয়ের_বাঁধন |২২| প্রথম অংশ
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
তৃষাকে দেখার সাথে সাথেই ইভানের মুখাবয়ব কঠিন হয়; ইচ্ছে করছে সজোড়ে কষিয়ে একটা চপটেঘাত করতে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পরপর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ইভান। তৃষা নিচে পরা ফুলগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টি তুলে ইভানের দিকে তাকাল। উপহাস করে সুরেলা কণ্ঠে বলল,
-” ইশশ্! এইরে ফুলগুলো তো ন’ষ্ট হয়ে গেলো। একদম সোজা ময়লার মধ্যে পরল। সো স্যাড! তা বউয়ের জন্য নিচ্ছিলে বুঝি!”
ইভান স্পষ্ট রাগি দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রু বাঁকিয়ে ছোট করে বলল,
-” তোহ?”
-” গুড…গুড জব।”
একটু থেমে ফের ব্যঙ্গাত্মক ভঙিতে শুধোয়,
-” তা একটা আনস্মার্ট, সাধারণ মেয়ের মধ্যে কী এমন দেখলে? যে এত তাড়াতাড়ি প্রেমে পরে গেলে। বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করলে যে। দেখতে আহামরি সুন্দরীও নয়; ওই সাধারণ মেয়েটা তোমার স্ট্যাটাসের সাথে যায়? বলো ইভান যায়?”
প্রশ্ন করে চোখ পিটপিট করে দুই হাত বুকে ভাঁজ করে উত্তরের অপেক্ষায় রয় তৃষা। ইভান তৎক্ষণাৎ বলল,
-” কবিগুরুর একটা কথা মনে পরে গেল; উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কথাটাই মনে পড়েছে। কবিগুরু বলেছেন, ‘সৎ পথে করিও ভ্রমণ যদিও হয় দেরি, অসৎ নারী না করিও বিয়ে যদিও হয় পরি!’ উত্তরটা এর মধ্যে আছে; আশাকরি বুঝে নিয়েছো।”
তৃষার মুখ থমথমে হয়ে যায়। এক ঝটকায় অপমানে ফর্সা মুখটা কালোয় ছেয়ে যায়। ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” আফসোস হয়। খুব বেশিই আফসোস হয়; নিজের রুচির উপর। থ্যাংক গড! অসংখ্য ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তার উপর। ঠিক শেষ মুহূর্তে এসে বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম।”
তৃষা ভেতরে ভেতরে সাপের মত রাগে ফোঁসফোঁস করছে। সব রাগ গিয়ে ঠেকছে এক বিন্দুতে। সেই বিন্দু হলো ‘তনুজা’ এই একটা মেয়ের জন্য ওরা দুইভাই তাকে খা’রাপ বলে অ’পদস্থ করে চলছে। না আর মানা যাচ্ছে না। তৃষা ফণা তোলা সাপের মত ফোঁস করে মুখ খুলল। কণ্ঠে ঝরল তীব্র আক্রোশ রাগ-ক্ষোভ,
-” আমার একাধিক রিলেশন ছিলো এইজন্য আমি খা’রা’প! এইজন্য আমার সাথে বিয়ে না হয়ে বড় বেঁচেছো, রাইট? আমি যদি রিলেশন করে খা’রাপ হই? তাহলে সেই একই দোষে তনুজাকেও তো দোষী সাব্যস্ত করতে হয়। তবে তনুজার বেলায় তোমরা কেনো অন্ধ? বলো…বলো তো আমায়?”
ইভান রাগান্বিত স্বরে বলল,
-” ডো’ন্ট টক ননসেন্স। অল অর নট লাইক ইউ! ফারদার তনুজার সাথে নিজের তুলনা করবে না।”
কথার মাঝেই তৃষা গা জ্ব’লু’নি দিয়ে শব্দ করে হাসল। আপনাআপনি ইভানের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে; দাঁত কটমট করে চাইল। তৃষা হাসি থামিয়ে পরপর বলে উঠল,
-” তোমার বউ তনুজা.. সতী সাবিত্রী তনুজা এতটাই লয়াল? একজনের সাথে বিয়ের আগে রঙ্গলীলা করে, খুব সুন্দর করে সেসব হাইডে রেখে; বরের সাথে সংসার করে যাচ্ছে। এটাকে কী প্রতারণা বলে না? এটাকে কী চিট করা বলে না? তোমার সাথে চিট কী শুধু আমিই করেছি? তনুজা করেনি? করছে না? ইভেন এখনও প্রতিনিয়ত চিট করে চলছে ও। তনুজা তো সুন্দর নিখুঁত অ্যাক্টিং করে যাচ্ছে তোমার সাথে। আমি যতটুকু জানি ওর মনে এখনো অন্যকেউ আছে। অতীত লুকিয়ে তনুজা তোমাকে ঠকাচ্ছে না ইভান?”
ইভানের মেজাজের পারদ সর্বোচ্চ হয়। গলার স্বর চড়িয়ে বলল,
-” একদম আ’জে’বা’জে কথা বলবে না। আমি আবারও বলছি, সবাই তোমার মত নয়। এটা পাবলিক প্লেস, তাই সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। নাহলে তনুজা সর্ম্পকে আজেবাজে বলায়, তোমার গায়ে হাত তুলতেও আমি দু’সেকেন্ড সময় নিতাম না।”
-” বাহবা! এতটা অন্ধ বিশ্বাস বউয়ের উপর। আমার না একটা কথা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। মা’রা’ত্মক কিউরিওসিটি হয় আমার। কিউরিওসিটি দমিয়ে রাখতে না পেরে আজ প্রশ্নটা করেই ফেলছি; আচ্ছা ওই মেয়ে জাদুটোনা জানে নাকি? তোমরা দুই ভাইই যে ওই মেয়ের প্রতি একদম অন্ধ হয়ে গেলে।”
শেষের কথা শুনে ইভানের কপালে পরপর দু’টো ভাঁজ পরে। দুইভাই বলতে কাকে বোঝাচ্ছে? দিব্যকে? কিন্তু কেনো? ইভানের মনে প্রশ্নের সঞ্চার হয়। ইভান প্রশ্ন করে উঠল,
-” কী বলতে চাইছো তুমি?”
তৃষা বাঁকা হাসল। বলল,
-” সেকি ইভান আমার ধারণাই তাহলে ঠিক। এতক্ষণ তো আমি ধারণার উপর কথা বলে যাচ্ছিলাম। তোমার বউ সত্যিই তার প্রেম কাহিনী লুকিয়ে রেখেছে! তোমার বউয়ের যে তোমারই ছোট ভাইয়ের সাথে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো; সেসব কিছুই জানো না? আমি যেমন কথায় স্পষ্টভাষী, ঠিক তেমনি কাজেও। তাই তো কোনকিছু অগোচরে, আড়ালে-আবডালে থাকে না। সেইজন্য সবার কাছে খুব সহজেই খা’রাপ হয়ে যাই। নিজেকে সতী সাবিত্রী দেখাতে তনুজার মতো মিনমিন করে মিথ্যে বলে, গোপন করে চললে; আজ আমিও সবার কাছে ভালো থাকতাম, হুঁ।”
“ছোট ভাইয়ের সাথে..” কথাটা ইভানের কানে ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। লহমায় ইভানের চক্ষু দু’টো রাগে লাল টকটকে হয়ে আসে। আ/গু/নের লাভা বেরুচ্ছে যেন। তৃষাকে যেন চোখ দিয়েই ভ’স্ম করে দিবে। ইভান ব্রজকণ্ঠে বলল,
-” মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ। আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি এখানেই খু//ন করে ফেলব।”
তৃষা ইভানের রাগের তোয়াক্কা করল না। থোড়াই কেয়ার করে ও বলল,
-” শাট আপ! জাস্ট শাট আপ। আমি একটাও উল্টাপাল্টা কথা বলছি না। আর নাতো মিথ্যে। কোনটাই নয়। যা বলছি সব জেনেশুনেই বলছি। আই ওয়েললি নো। দিব্য তনুজাকে ভালোবাসে। এন্ড তন__”
কথাটা সম্পূর্ণ না করতে দিয়ে ইভান কর্কশ স্বরে বলল,
-” আমি যতটা জানি দিব্যর সাথে তোমারও তো রিলেশন ছিলো। এখন শুধু শুধু কোন হিংসা পরায়ণ হয়ে বেহুদা তনুজার নামে মিথ্যে বলছো, শুনি? তুমি আমাকে যা বলবে বাচ্চা শিশুর মতো আমি তাই বিলিভ করব? লাইক সিরিয়াসলি?”
তৃষা বি’র’ক্ত হয়। সাথে প্রচন্ড রাগও হয় তনুজার প্রতি এত বিশ্বাস-ভরসা দেখে। এই বিশ্বাস ভরসা দেখে তৃষা উন্মাদ হয়; রাগে-ক্ষোভে ফেটে পরে। তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলল,
-” তুমি ভুল ইভান, তুমি ভুল। আমি সত্যি বলছি দিব্য-তনুজা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতো। ইভেন এখনও বাসে। এইযে হুট করে দিব্য ইউএসএ পারি জমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, এটা কী এমনি এমনি? নিজের প্রেমিকাকে একই বাড়িতে অন্যকারো সাথে নিজ চোখে মেনে নিতে পারছে না জন্যই দিব্য শুধু বাড়ি নয়, এই শহর নয়; দেশ ছেড়েই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
ইভানের সময় যেন থমকে গেল। মুখটা চুপসে ছোট হয়ে আসে। কেনো জানি তৃষার কথাগুলো মিথ্যে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ দিব্যর ইউএসএ যাওয়ার ডিসিশন যে এমনি এমনি নয়, তা ইভানকেও ভাবায়। তবে এইজন্য! তা ইভানের কল্পনা কেনো; দুঃস্বপ্নেও ছিলো না। ইভানের বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়। মন থেকে প্রে করছে, তৃষার কথাগুলো যেন মিথ্যে হয়। কস্মিনকালেও যেন সত্যি না হয়। তৃষা ছোট করে নিঃশ্বাস টেনে পুরোদমে শুরু করে,
-” আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে দিব্যর ফ্রেন্ড সার্কেলে খোঁজ নাও। সেখান থেকেই সত্যি জানতে পারবে। এদিকে আমি অল্প-স্বল্প জানি লিমনের কাহিনী। তোমার একবারও মনেহয়নি লিমন তনুজাকে চেনে কী করে? কারন দিব্যর বন্ধু লিমন। আমি যতটুকু জানি লিমন তনুজাকে পছন্দ করতো। ওদিকে দিব্যর সাথে তনুজার সম্পর্ক দেখে বেচারা মেনে নিতে না পেরে ওরকম একটা গেইম খেলেছে। বেচারা নিজেও পেল না, দিব্যকেও পেতে দিলো না তনুজাকে। মাঝখানে ক্যাচটা তুমি ধরে ওদের দু’জনকে একসাথে আউট করে দিলে। ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করে নিলে।”
তৃষা রঙচঙ মাখিয়ে সত্যের সাথে খানিক মিথ্যেও বলে। ইভানের মস্তিষ্ক ফাঁকাফাকা লাগছে। হঠাৎই সেদিন ক্লিনিকে তনুজার বান্ধবীর বলা কথা স্মরণ হয় ইভানের, ” ওনার সাথে তোর বিয়ে হয়নি?” দুইয়ে দুইয়ে এইবার চার হয়। তারমানে তৃষার কথাগুলো মিথ্যে নয়। ইভানের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো। সাথে যেন সবকিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলছে। ইভানের নিজেকে অসাড় লাগছে। তৃষা মনে মনে পৈ’শা’চি’ক আনন্দ অনুভব করছে। মুখে মিথ্যে বেদনার ছাপ টেনে আনল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলার স্বর নিচু করে বলল,
-” স্যরি ইভান, আমি এভাবে বলতে চাইনি। এসব বলে মোটেই তোমাকে হার্ট করতে চাইনি। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম, এন্ড এখনো বাসি। শত হোক তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। জীবনে অনেক কিছুই আসে যায় তবে কখনোই প্রথম ভালোবাসাকে ভুলা যায় না। শরীর দেওয়া যায়, কিন্তু মন! মন সে তো আ’মৃ’ত্যু প্রথম ভালোলাগা আর ভালোবাসাকে মনে রাখে।”
সুক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে কথাগুলো বলে তৃষা। ইভান বাকরুদ্ধ, নিস্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। ফুলগুলো অমনি অবহেলায় পরে রইল। পথচারীর পদাঘাতে পি’ষ্ট হতে থাকল। নতুন করে ফুলের তোড়া নেওয়ার চিলতে আগ্রহ জাগল না ইভানের মধ্যে। পরপর সম্বিৎ ফিরে পেতেই গাড়িতে উঠে বসে। শব্দ করে ডোর লাগিয়ে সিটে কাঁধটা এলিয়ে দেয়। ক্লান্ত ভঙিতে চোখদুটো বুঁজে নেয়। অস্ফুটে আওড়ায়,
-” আমি এখনও মন থেকে চাইছি, যা ভাবছি; সবটা যেন মিথ্যে হয়। ফের যেনো মেয়ে জাতির কাছে আমাকে ঠকতে না হয়!”
___________
তনুজা কাচা কভারগুলো বালিশে ভরে বিছানাটা ঠিক করে পাশ ঘুরতে নিলে; আচমকা সেন্টার টেবিলের উপর থাকা কাঁচের গ্লাসটা শাড়ির আঁচলে বেঁছে ফ্লোরে পরে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। সুন্দর গ্লাসটার এহেন দশা করায় তনুজার মুখটা ম্লান হয়ে আসে। তড়িৎ হাঁটু গেড়ে বসে কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে থাকে। হঠাৎ ডানহাতের তর্জনীতে কাঁচের অংশ লাগতেই মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে,
-” আহ্!”
বলে পরপর আঙুলের দিকে তাকায়। আঙুলের ডগায় লাল তরল পদার্থ গড়িয়ে পরছে। তনুজা পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে আঙুলটা মুছে নেয়। অতঃপর টুকরোগুলো বাইরে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে আসে।
পড়ার টেবিলে বসে প্র্যাকটিক্যাল খাতা তৈরি করছে তনুজা। এদিকে লিখতে গিয়ে আঙুলে চাপ পড়তেই ক্ষ’ত স্থানে ব্যাথা লাগছে। অবশেষে খাতাগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টার ঘর পেরিয়েছে। এরমধ্যে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢোকে ইভান। শব্দ শুনে তনুজা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইভানের দিকে তাকায়। স্মিত হেসে বলল,
-” ওহ্, আপনি?”
তনুজা কয়েক কদম এগোয়। রুমের মাঝে সটান দাড়িয়ে তনুজার দিকে চেয়ে ইভান। ইভানের সবসময় পরিপাটি থাকা চুলগুলো এলোমেলো, কপাল ছাড়িয়ে ভ্রুয়ের কাছাকাছি নেমেছে। মুখাবয়ব টানটান, দৃষ্টিজোড়া নিস্পন্দ। তনুজার হঠাৎ আজকের ইভানকে কেমন অদ্ভুত অন্যরকম ঠেকল। এ’কদিনের ইভানের সাথে আজকের ইভানের বেশ তফাৎ লাগছে। এ ক’দিনে রুমে ঢুকেই প্রথমে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দেয়। সাথে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে তনুজাকে আলিঙ্গন করা, তারপর মনটা ফুরফুরে করতে লম্বা কিস করা। ইভানের এসব পা’গ’লামি কাজ আর কথা শুনে আজ ক’দিনে তনুজা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আজ ইভানের দৃষ্টি, মুখাবয়ব অন্যরকম ঠেকছে। কিছু ভেবে তনুজা মিহি স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ঠিক আছেন? না মানে শরীর খা’রা’প লাগছে কী?”
ঝ’ড়ের আগে প্রকৃতি যেমন নীরব, শান্ত গুমোট থাকে, ঠিক তেমনি ইভানও ঠান্ডা নিস্পন্দ আছে। তনুজার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল ইভান। একদম ঠান্ডা অথচ প্রগাঢ় স্বরে শুধালো,
-” দিব্যকে আগে থেকেই চিনতে তুমি?”
মস্তিষ্কে কথাটা ঢুকতেই সোজা প্রশ্নটা ছু’রি’র মত সোজা বুকে গিয়ে গাঁথে তনুজার। মূহুর্তেই বুকটা ভ’য়ে আ’তং’কে এফোঁড়-ওফোঁড় হয় ওর। এই প্রশ্নের অর্থ তনুজা ঢের অনুমান করতে পারছে। অবচেতন মন আওড়ায়,
-” তবে কী কোনভাবে ইভান জেনে গিয়েছে? কীভাবে?”
তনুজার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জো হয়েছে। মস্তিষ্ক শুণ্য লাগছে। তনুজাকে নিরুত্তর দেখে ইভানের কপালের ভাঁজ প্রগাঢ় হয়। জলদগম্ভীর স্বরে ফের বলল,
-” কী হলো আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি? আনসার মি?”
ইভানের ধ’ম’কে তনুজা কেঁপে উঠল। তনুজার দু’চোখ কান্নায় ভেঙে আসার জোগার; কোন রকমে কান্না সংবরণ করে মাথা নুইয়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলে,
-” হ-হু।”
ইভান চোখদুটো বুজে নেয়। বুক চিঁড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বেরুয় ওর।
#চলবে
#প্রণয়ের_বাঁধন |২২| বর্ধিতাংশ
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঘরময় শুনশান পিনপতন নিরবতা নিস্তব্ধতায় মুড়ানো। ইভানের ভারী দীর্ঘশ্বাস নিস্তব্ধতার সাথে মিলেমিশে রুমের পরিবেশ আরো ভারী হয়। ইভান নিশ্চল চাহনিতে তনুজার দিকে তাকায়। ভারিক্কি গলায় শুধায়,
-” দিব্য তোমাকে এই বাড়িতে এনেছিলো? দিব্যর সাথে তোমার রিলেশন ছিলো, রাইট? দিব্যকে ভালোবাসো তুমি?”
নিজের স্বামীর মুখ নিঃসৃত এহেন প্রশ্নবাণে তনুজার সত্তা গলা কা//টা প্রাণীর মত ছটফট করছে। ওর ভেতরটা কষ্টে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। একেকটা প্রশ্ন ওর কাছে বি/ষ সমতুল্য ঠেকছে। বি/ষ পান করলে যেমন সারা শরীর নীল হয়ে আসে; সাথে অসহনীয় যন্ত্রনা হয়। ঠিক অমনি কথাগুলো কর্ণগোচর হয়ে নিউরনে পৌঁছাতেই। নিউরনে নিউরনে বেদনার অসহায়ত্বের সৃষ্টি হয়। সেই বেদনা-যন্ত্রনা ক্রমশ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পরে। নিজেকে কোন রকমে স্বাভাবিক করে কান্নাভেজা কণ্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে তনুজা,
-” না।”
তনুজার এই এক শব্দের জবাব ইভানের মেজাজ চড়িয়ে দেয়। আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে সজোড়ে দেওয়ালে ঘু’ষি মে”রে চেঁচিয়ে বলল,
-” কোনটা না? তোমার দিব্যর সাথে রিলেশন ছিলো না? তোমরা একেঅপরকে…”
এতটুকু বলে থেমে যায় ইভান। বাকী কথাটা গিলে নেয়। তনুজার গোটা শরীর জমে ঠান্ডা হিম শীতল হয়ে যায়। পায়ের তলার জমিন ফাঁকাফাঁকা লাগছে। চারিপাশটা ওর দুলছে। মৃ/ত্যু সমতুল্য য’ন্ত্রণায় ভেতরটা ছটফট করছে ওর। ইভান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কাঠিন্য সুরে বলল,
-” তোমাকে নিয়ে আমি প্রাউড ফিল করতাম। গর্ব করে তোমার সমন্ধে উঁচু গলায় কথা বলেছি। বাট এখন দেখছি তোমার সম্পর্কে আমি ভুল জেনেছি। তোমাকে নিয়ে বড় করে কথা বলতে গিয়ে আমার মুখটা থিতু হয়েছে। কারন আমি তোমাকে চিনতে ভুল করেছি। আমি এগেইন মানুষ চিনতে ভুল করেছি। কেনো সবকিছু লুকিয়েছো? মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে আবার মিথ্যে বলে যাচ্ছো।”
থেমে গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ইভান। পরপর বলে উঠল,
-” ওহ্! শিট! শিট! আমারই ভুল। আবার কাউকে বিশ্বাস করাই আমার মা’রাত্ম’ক ভুল। কারন দিনশেষে তাদের সবারই বেরোয় একই রুপ। তারা শুধু জানে চি’ট করতে।”
বুকফাটা কান্না পাচ্ছে তনুজার। চোখজোড়াতে নোনতা জলের ফোয়ারা বইছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। কোন রকমে শ্বাস টেনে নিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,
-” ইভান! আমি মিথ্যে বলছি না। আমার পুরো কথাটা তো শুনুন। প্লিজ আমায় বলতে দিন।”
ইভান রেগে কয়েক কদম এগিয়ে তনুজার দুই বাহু শক্ত করে ধরে। চোখদুটো ওর অস্বাভাবিক লাল। ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
-” কী বলবে তুমি? আবার মিথ্যে বলবে, তাই তো? অনেস্টলি বলো তুমি; আমার কোন প্রশ্ন ভুল আছে? আমি ভুল বলেছি কিছু।”
তনুজা থেমে থেমে ধীমে স্বরে বলল,
-” আপনার প্রশ্ন করা ভুল নয়। তবে আপনার জানায় ভুল আছে। দিব্য আমাকে এখানে আনেনি। দিব্য যে মামণির ছেলে এটা এই বাড়িতে আসার পর জানি আমি। দিব্যও প্রথমে আমাকে এখানে দেখে অবাক হয়। আর ইভান আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে, আমি মিথ্যে বলব না। হ্যা রিলেশন ছিলো। সবশেষে আপনার শেষ প্রশ্নের জবাবে বলব, এখন দিব্যর প্রতি আমার বিন্দু পরিমাণ ফিলিংস নেই। বর্তমানে ছিটেফোঁটাও অ্যাফেকশন নেই।”
ইভান ধা’ক্কা দিয়ে তনুজার বাহু ছেড়ে দেয়। তনুজা দু’কদম পিছিয়ে যায়। ক্রুদ্ধ রাগি উচ্চস্বরে বলল,
-” মি’থ্যে বলছো তুমি। যে সুন্দর করে এতবড় ঘটনা আড়ালে রাখতে পারে, তার কথা আর বিশ্বাস করা যায়! তুমিই বলো যায়?”
ভেজা ঘনপল্লব তুলে অশ্রুসজল নয়নে ইভানের দিকে তাকায় তনুজা। কাতর স্বরে বলল,
-” ইভান! ইভান আল্লাহর দোহাই লাগে বিশ্বাস করুন আমায়। বিশ্বাস করুন এখন আমার সবটা জুড়ে শুধু আপনি আছেন। আমি মন থেকে আপনাকে ভালোবাসি। বর্তমানে আমার মনেতে আপনি ছাড়া অন্যকেউ নেই।”
তনুজার কাতর স্বর। কষ্টে জর্জরিত হাহাকার বুলি ইভানের হৃদয় ছুঁতে পারছে না। ইভান দপ করে বিছানার একপাশে বসে। দুইহাতে মুখটা চেপে ধরে। দিব্যর সাথে তনুজার রিলেশন ছিলো এটা কোনভাবেই ইভান মেনে নিতে পারছে না। মস্তিষ্ক ঢাকঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে। অনুশোচনায় দ’গ্ধ হচ্ছে ইভানের হৃদয়। জ্ব’লেপু’ড়ে ছারখার হচ্ছে বুক। তারপর তনুজার সবটা গোপন করা। ইভানের মেনে নিতে বড্ড বেশিই কষ্ট হচ্ছে। মুখ থেকে হাত দু’টো নামিয়ে; হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল ইভান। কণ্ঠে এক সমুদ্দুর অসহায়ত্ব-বেদনা নামল,
-” আমি কখনো অর্থের কাছে হারিনি! অর্থ কখনো আমাকে অসহায় বানায়নি! বারংবার আমি প্রিয়জনের কাছে হেরে গিয়েছি। যখনই যাকে সবচেয়ে আপন করেছি; তারাই আমার সাথে প্র’তারণা করেছে, বানিয়েছে অসহায়। বারংবার আমাকে প-ঙ্গু করেছে তারাই!”
তনুজা দু কদম পিছায়; ওর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে। দুইহাতে শাড়ি মুঠো করে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে গুমড়ে কাঁদে। তনুজার সত্তা বলে ‘ ও মোটেই ইভানের সাথে প্র’তা’রণা করেনি। যা সব হয়েছে; সবটা পরিস্থিতির জন্য।” তনুজা একবুক সাহস সঞ্চয় করে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-” ইভান আপনি আমাকে মিসজাজ করছেন। আমি কখনোই আপনাকে ঠ’কাইনি আর না তো চি’ট করেছি। আমি জানি আপনি খুব হতাশ হয়েছেন। আপনি নিজেও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। তাই এই মুহূর্তে এসব বলা আপনার জন্য সহজ হচ্ছে। প্লিজ একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। মনে করুন সিচুয়েশনের কথা। আমি একজনের সাথে সম্পর্ক রেখে স্ব-ইচ্ছায় বিয়েটা করিনি। আর বিয়ের পর এ-ও না যে অতীতকে পেতে চেয়েছি; আর না তো মনে রেখেছি। তাই আমি নির্দ্বিধায়- নিসংকোচে বলতে পারব আমি কক্ষনোই আপনাকে ঠ’কাইনি।”
-” আমি তো নিজেকে তোমার সামনে খোলা বইয়ের মতো উপস্থাপন করেছিলাম। কোনোকিছু আড়ালে রাখিনি। তাহলে তুমি কেনো সবটা লুকালে, আড়াল করে রাখলে। এরপরেও বলবে এটাকে প্র’তারণা বলে না?”
তনুজা থম মে’রে যায়। হঠাৎ চোখের জলেও ভাটা পরে ওর। পাথরের মুর্তির মতো নিষ্প্রাণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। কিছুপল পর নিজেকে ধাতস্থ করে অসহায় কণ্ঠে বলল,
-” হ্যা মানছি আমি আড়াল করেছি। আপনাকে আমার অতীত বলিনি। তবে বাস্তবতার আলোকে এটাকে আদৌও প্র’তারণা বলা যায়? আপনি প্লিজ একবার একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। রাগের মাথায় ভাবলে ভালো কিছুও খারাপ মনেহয়। আর এটা তো খুব সেনসিটিভ বিষয়। তাই বলছি একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন।”
হাঁটুতে কনুই রেখে হাতের আঙুলে কপাল চেপে ধরে বসে ইভান। মস্তিষ্ক ওর হ্যাং হয়ে আসছে; কিছুই ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তনুজা মাথাটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে উপরের দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকায়। থেমে থেমে বলতে লাগল,
-” শুধু সমাজেই নয় গোটা পৃথিবীতে আমার মতো অনেকেই আছে; এভাবে না হলেও পরিবারের চাপে বিয়ে করতে হয়। তাদের সবাই কী হ্যাজবেন্ডকে অতীতের সবটা বলে? বেশিরভাগই বিয়ের পর স্বামীকে আপন করে নেয়। ভুলে যায় অতীতকে। আমি এমন একটা মেয়ে ছোট থেকেই শুনে এসেছি একটা বিবাহিত মেয়ের স্বামী হলো জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ। এই পৃথিবীতে বিয়ের পর সবচেয়ে আপনজন হলো স্বামী। বিয়ের পর আমি আপনাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ইভান আপনি যে দোষে আমাকে দো’ষী বলছেন? আদৌও আমি দো’ষী?”
ইভান ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। তীব্র রাগ-ক্ষোভ নিয়ে বলল,
-” আমি যেদিন জিজ্ঞেস করলাম লিমন তোমাকে চিনে কীভাবে? সেদিন কেনো মিথ্যে বললে। তখনও তো পারতে সত্যি বলতে। এরপরেও আমাকে মানতে হবে তুমি প্র’তারণা করোনি।!
তনুজা চোখ বন্ধ করে নেয়। হঠাৎ প্রশ্ন করে ওঠে,
-” সেদিন সত্যিটা জানার পর কী করতেন? কী এমন হতো?”
ইভান উচ্চ স্বরে বলল,
-” অনেক কিছুই হতো। অনেক কিছুই করা যেতো। যা এখন সহজ হচ্ছে না। তখন নিমিষেই করে ফেলতাম আমি। কারন তখনো তোমার আমার সম্পর্কটা জাস্ট নামে মাত্র বিয়ে ছিলো। চাইলে সবটা আগের মতো করা যেতো।”
তনুজার কণ্ঠে প্রতিবাদ ঝরল,
-” ভুল। আপনি ভুল ইভান। আপনি ভুল ভাবছেন। এখন যতটা সহজে বলছেন, সেই সময়েও বিষয়টা এতটা সহজ ছিলো না। এখন আপনি রা’গে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এসব বলছেন।”
শক্ত কণ্ঠে বলতে গিয়ে আচমকা তনুজার চোখটা ফের টলটল করে উঠল। নরম গাল গড়িয়ে মুক্তো দানার মতো জল টপটপ গড়িয়ে পরল। কাতর স্বরে বলল,
-” আপনি সত্যিটা জানলে ভেঙে পড়বেন। আপনার মানসিক সমস্যা হবে সেইজন্য বারবার বলতে গিয়েও আমি বলতে পারিনি। ইচ্ছে করে আমি গোপন করিনি। অতীত হাইডে রাখার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আশাকরি আপনি আমাকে বুঝবেন।”
ইভান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। ঠান্ডা শীতল অথচ প্রগাঢ় স্বরে বলল,
-” কোন কিছু লুকিয়ে-আড়াল করে খুশি করার চেয়ে, শুরুতেই সত্যি বলা ভালো নয় কী? এতে সাময়িক কষ্ট হলেও, বিশ্বাস হারাতে হয় না। সত্যিকারের সম্পর্ক তো তখনই হয়, যখন একে অপরকে সবকিছু প্রকাশ করা যায়। কোনো কিছু আড়াল করা হয় না; হয় না গোপন করা। এছাড়া যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেই সম্পর্ক পুরোটাই প্রতারণার!”
কথাটা শেষ করেই গায়ের ব্লেজার খুলে এক ঝটকায় বিছানায় ছুঁ’ড়ে গটগট পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় ইভান। তনুজা দেওয়াল ঘেঁষে ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। দুইহাতে হাঁটু জড়িয়ে মুখ গুঁজে। নদীর পাড় ভাঙা বেপরোয়া তীব্র স্রোতের মত তুমুল জলের স্রোত চক্ষুতারা থেকে নামতে থাকে। কথায় আছে না, অভাগা যেখানে যায়; সেখানেই সাগর শুকিয়ে যায়। তনুজার যেন সেই অবস্থা হয়েছে। মাত্র সুখের মুখ দেখেছিলো তা যেন নিমিষেই ধোঁয়াশায় ছেয়ে যায়। সুখ যেন তনুজার কপালে মরীচিকার ন্যায়।
দীর্ঘক্ষণ গড়ায়। তনুজা অসাড়ের মতো জমিনে বসে রয়। রুমময় নিস্তব্ধতা। বাইরে আজ আর রাত পোকাদের কোলাহল নেই। রাত পোকারা আজ সুর তুলছে না। তারাও বোধহয় তনুজার যন্ত্রনায়-ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে শোক পালন করছে। তনুজা ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে জানালা দিয়ে অদূরে আকাশপানে চায়। মনের সকল কষ্ট যাতনার কথা মনেমনেই সাত আসমানের উপরে থাকা রবের দরবারে পেশ করে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখে তনুজা। আকাশেরও বুঝি মন খা’রাপ। চাঁদ তো দূর তারার ছিটেফোঁটাও নজরে আসছে না। একে মেঘে ঢাকা আকাশ তারপর আজ অমাবস্যা। আকাশটাতে ঘোর কালো অন্ধকার। তনুজার অবচেতন মন ভাবে,
-” সুখ আমার জন্য; সে গুড়েবালি! আমার কপালে সুখ বড্ড বেশিই ক্ষণস্থায়ী। হয়তো আজকের অন্ধকার আকাশের মতোই আমার ভবিতব্য!”
_____________
সময় তার আপন গতিতে চলে। এরমধ্যে দুইদুইটি সপ্তাহ গড়িয়েছে। দিন গিয়ে রাত পেরিয়ে নতুন ভোরের সূচনা হয়েছে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে। আজকে শুক্রবার। তনুজা টেবিলে সকালের নাস্তা রেডি করছে। জীবনে একবার যে কান্না লুকিয়ে বাঁচতে জানে; তারজন্য নিজের কষ্ট সবার দৃষ্টির আড়াল করে, অগোচরে রাখা সহজ হয়। এইযে গোটা দুইদুইটা সপ্তাহ তনুজা কেমন পাথর বনে গিয়েছে। চাপা স্বভাবের মেয়ে হওয়ায় নিজের দুঃখ-কষ্ট, যাতনা সর্বদা নিজের মধ্যেই পুষে রাখে। কারো কাছে শেয়ার করে না।
সেদিনের পর থেকে এক ছাদের নিচে দু’জনে থাকলেও; চীনের মহাপ্রাচীরের মতো সুবিশাল প্রাচীর তৈরি হয়েছে তনুজা-ইভানের মাঝে। অফিসের কাজের অজুহাত দেখিয়ে বাড়িতে খুব স্বল্প সময় থাকে ইভান। ইভান ঠিকমতো কথা বলে না, কেমন ইগনোর করে চলে। তনুজাও ইদানিং নিজের হয়ে সাফাই গাইতে চায় না। ভালো লাগে না ওর। আবার আগের মতো চুপচাপ নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত ইভানের থেকে পাওয়া ইগোনোরে দ/গ্ধ হচ্ছে মেয়েটা। দিন যাচ্ছে অসহনীয় যাতনায় ভেতরে ভেতরে ছটফটিয়ে ম/রছে ও। নুরজাহান বেগম এসে চেয়ার টেনে বসলেন। পরপর ইভান এসে বসল। তনুজা কোণা চোখে চাইল। ইভান ফিরেও তাকালো না। ইভান সেদিনের পর থেকে বিষয়টা নিয়ে খুব ভেবেছে। প্রতিনিয়ত ভেবে চলেছে। ওর মন স্থির করে তনুজার হয়তো কোন দোষ নেই; তবে তৃষার মাধ্যমে খবরটা শুনে ও খুব বেশিই হতাশ হয়, সাথে ক্রুদ্ধ হয় তনুজার উপর। তারপর ইভানের বিবেক ওকে প্রতিনিয়ত দংশন করে চলছে, ওর জন্যই আজ দিব্য কষ্ট পাচ্ছে। দিব্য মেনে নিতে না পেরে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে; আর দশদিন পরেই দিব্যর ফ্লাইট। ইভান তনুজার সাথে সহজ হতে পারছে না, অদৃশ্য প্রাচীর নির্মাণ হয়েছে ওদের সম্পর্কে।
এদিকে শ্বাসরুদ্ধকর যাতনা থেকে রেহাই পেতে তনুজা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও বাড়ি যাবে। শ্বশুরবাড়িতে সবার অবহেলা সয্য করে থাকা যায়। তবে স্বামীর অবহেলা, ইগনোর সয্য করা যায় না। এভাবে তনুজা আর নিতে পারছে না। তনুজা নিচু গলায় বলল,
-” দিদুন!”
নুরজাহান গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
-” হ্যা বলো। শুনছি তো।”
-” দিদুন আমি বাড়ি যাবো।”
চশমার কাঁচ গলিয়ে নুরজাহানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নজরে আসে তনুজার। বৃদ্ধা মানুষটি বাইরে যতটা কাঠিন্য কর্কশ দেখায়; ভেতরে অতটাও নয়। বাইরের শক্ত খোলসের ভিতরে আছে নরম মন। তা এ ক’মাসে ঢের উপলব্ধি করেছে তনুজা। তাই তো এই মানুষটিকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলতে পারলো না। নিম্নস্বরে বলল,
-” না মানে অনেকদিন হলো বাড়িতে যাওয়া হয় না। সেই যে একবার গিয়েছিলাম আর তো যাওয়া হয়নি। দাদির শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। তাই ভাবছি গিয়ে কয়েকদিন থাকব।”
অদূরে কাজের লোকদের সাথে কথা বলে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তামান্না। সে আজ সকাল থেকেই মহাব্যস্ত। আজকে নিতিকে দেখতে আসবে। একদম পাকা কথা বলতে। তাইতো পুরো বাড়ি ঝকঝকে তকতকে, কীভাবে, কী করতে হবে? এই নিয়ে সকাল থেকে ছোটাছুটি করছে। তনুজার কথা কানে যেতেই এগিয়ে আসলেন। বাঁকা চোখে চেয়ে কর্কশ গলায় বললেন,
-” আজ বাড়িতে লোকজন আসবে। যেই দেখেছো বাড়িতে একটু কাজ বেশি আর অমনি বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। নিতি তো সম্পর্কে তোমার ননদ হয়; কিছু দায়িত্বও তো তোমার আছে। কোনো রকমের দায়িত্বের বালাই নেই তোমার মধ্যে। কেমন আক্কেল করে আজকে যাওয়ার কথা বলছো।”
যতটা না তামান্নার কথায় কষ্ট পায় তনুজা তার থেকে বেশি কষ্ট পায়, ইভানকে নীরব দেখে। আগে ইভান ফুপিকে প্রত্যুত্তর দিতে দু’ সেকেন্ড সময় নিতো না। আগের সাথে বর্তমানের তফাৎ তনুজাকে প্রতিনিয়ত যাতনায় পিষ্ঠ করছে। নুরজাহান বেগম মুখ খুললেন,
-” আহ্ তামান্না! থাম তুই। বাচ্চা মেয়ে অনেকদিন যায় না। বিয়ের পর সেই একরাত থেকেছে। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে হয়তো। যতই হোক নিজের বেড়ে ওঠা, নিজের বাড়ির প্রতি আলাদা একটা টান থাকেই। আচ্ছা নাতবউ আজকে বাড়িতে লোকজন আসবে। কাল যেয়ো। দু’দিন থেকেই চলে এসো।”
থেমে ইভানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” দাদুভাই কাল নাতবউকে নামিয়ে দিয়ে এসো, কেমন? ইদানিং কেমন যেনো সবসময় মন ম/রা হয়ে থাকে। বাড়ি থেকে ঘুরে আসুক মনটা ভালো হয়ে যাবে।”
ইভান তড়িৎ গতিতে কাটকাট কণ্ঠে বলল,
-” আমার সময় হবে না। বাড়ির গাড়ি করে যেতে বলো।”
সাধারণত বর-রা বউকে বাপের বাড়ি যেতে দিতে চায় না। তাই হয়তো ইভান এমন বলেছে। নুরজাহান এটা ভেবে ইভানকে আর জোর করলেন না। নুরজাহান তনুজাকে শুধালেন,
-” তা তোমাকে দেখছি কেমন যেনো লাগছে। শরীর ঠিক আছে তোমার? চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো খাও না? ইদানিং আমার বি/ষ ব্যাথাও বেড়েছে, কোনোদিকে নজর দিতে পারি না। বেশি সময় বিছানায় কা’টে আমার।”
তনুজা জবাবে বলে,
-” নাহ দিদুন ঠিক আছি আমি।”
কথাটা শেষ করে কিচেনে যেতে নেয় তনুজা। হঠাৎ মাথাটা কেমন চক্কর দিলো। একহাতে কপালটা চেপে ধরে কিছুপল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আজ দু’দিন শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না। শরীর অতিরিক্ত দূর্বল লাগে। সবসময় মাথাটা কেমন ব্যাথা করে। আবার মাঝে মধ্যে ঘুরেও। রাতে চোখে ঘুম নামে না। রাতের বেশি সময়টাই নির্ঘুমে কা’টে। আগের মত প্রেশার ফল করেছে হয়তো। তাই এমন সমস্যা দেখা দিচ্ছে; তনুজা এটা ভেবে ফের কাজে মনোযোগ দেয়।
__________
নিতি-নৃত্য দুইবোন কমফোর্টার গায়ে দু’জন বিছানার দুই প্রান্তে ঘুমুচ্ছে। ঘড়ির কাঁ’টা দশটার ঘর ছুঁইছুঁই। ভিজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তামান্না। মেয়েদেরকে এখনো ঘুমুতে দেখে কপালে বিরক্তির ছাপ তুলে উচ্চ কণ্ঠে ডাকলেন,
-” নিতি? এই নিতি? এখনো ঘুমাচ্ছো! বেলা দশটা বাজতে চললো। আজ বাড়িতে লোকজন আসবে। সে খেয়াল আছে তোমার?”
ঘুমের মধ্যে কর্কশ স্বর শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে নিতি। নৃত্য শুয়ে পাশ ঘুরে পিটপিট করে চায়। নিতি এলোমেলো চুলগুলো পিছনে ঠেলে মায়ের দিকে তাকায়। মুখটা শুকনো করে বলে,
-” স্যরি মাম্মা একটু বেশি দেরি হয়ে গেলো। আসলে কয়দিন এক্সামের জন্য ঠিকঠাক ঘুমাতে পারিনি। তাই আজকে লম্বা ঘুম দিলাম।”
কথাটা শেষ করে জোর করে হাসার চেষ্টা করে নিতি। ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করে গতকাল বাড়ি ফিরেছে নিতি। নিতির মিথ্যে কথাশুনে নৃত্য ঠোঁট টিপে হাসে। তামান্নার হাতে শাড়ি আর গহনার বক্স ছিলো। সেগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
-” হ্যা জানি তো। এ-ও জানি দুইবোন একসাথে শুয়ে রাতে কেমন ঘুম দিয়েছো। নিশ্চয় সারারাত জেগে মুভি দেখেছো।”
নিতি লজ্জিত হয়। এইরে মা ঠিক ধরে নিয়েছে। রাতে দুইবোন মিলে দুইদুইটা হরর মুভি দেখেছে। ঘুম আসছে শেষ রাতে। তামান্না তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললেন,
-” এখানে শাড়ি আর তোমার জন্য গড়ানো গহনা রাখা আছে। দুপুরে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে এগুলো পরে নিও। আমি সারাদিন কিচেন তারপর ওদিকে তদারকি করতে ব্যস্ত থাকব। বারবার এসে তোমাকে বলতে পারব না। তাই এক্ষুনি বলে রাখলাম, ওনারা আসার আগেই রেডি হয়ে থেকো।”
আর বাড়তি বাক্য ব্যয় না করে তামান্না প্রস্থান করে। নিতি আবার ধপ করে শুয়ে পড়ল। কিছু ভেবে নৃত্য হঠাৎ ভ্রু-ট্রু কুঁচকে ডাকল,
-” অ্যাই আপু?”
-” হুম।”
-” আচ্ছা আমি তো এতদিন অন্যকিছু ভাবতাম। না মানে আমার সিক্সসেন্স বলতো, তুমি দিব্য ভাইয়াকে পছন্দ করো। তাহলে কীভাবে কী? এতটা চুপচাপ আছো। তারপর তোমাকে কেমন নিশ্চিত ফুরফুরে মেজাজে লাগছে। এইযে আজ তোমার পাকা দেখা হবে তোমার মন কেমন করছে না?”
-” তুই কী বলতে চাইছিস, ক্রাশকে না পাওয়ার দুঃখে কষ্টে আমাকে দেবদাসের ফিমেইল ভার্সন হতে?”
-” আরে ধূর! তা নয়। একটু তো মন খারাপ হওয়া উচিত তোমার।”
-” তাই তো। মন খারাপ করে; কালো ড্রেসআপ পরে শোক দিবস পালন করতে হবে। তারপর রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার করে, কানে ইয়ারফোন গুঁজে; অরিজিৎ সিংয়ের স্যাড সং শুনতে হবে। তবেই না একটা বিরহ বিরহ ফিলিংস আসবে।”
নৃত্য নাকমুখ কুঁচকে চাইল। বি’র’ক্তিকর কণ্ঠে বলল,
-” আপু! আমি মোটেই মশকরা করছি না। আমি সিরিয়াসলি বলছি।”
-” আমিও তো সিরিয়াসলি বলছি সিস।”
নৃত্য ঠোঁট উল্টাল। বলল,
-” সেদিন কফিশপে গিয়ে ডক্টর নীরব মাহমুদ এর উপর আবার ক্রাশ খেয়ে বসোনি তো। যদি বলো হ্যা; তাতে অবশ্য আমি অবাক হবো না। কারন লোকটা ক্রাশ খাওয়ারই মতো।”
নিতি উঠে বসতে বসতে বলল,
-” উমম! ছোটো মির্জার উপর ক্রাশ খেয়ে বসে না থাকলে, আমি উৎফুল্ল হয়ে খুশিমনে নাচতে নাচতে জেন্টেলম্যান নীরবকে বিয়ে করে নিতাম। কিন্তু এখানে সমস্যা দু’টো।”
নৃত্য সরু চোখে কপাল কুঁচকে চাইল।
-” সমস্যা?”
নিতি কোলের উপর বালিশ নেয়। তাতে কনুই ভর দিয়ে গালের সাথে হাত ঠেকিয়ে বলতে থাকে,
-” হুম। প্রথম সমস্যা হলো বিয়ের পর বাচ্চা হলে; আমার বাচ্চাকে দিব্যকে মামা বলে পরিচয় করিয়ে দিতে আমার বিবেকে প্রচন্ড বাঁধবে। কারন আমি তো কল্পনাতে আমার আর ছোট মির্জার বাচ্চা নিয়ে সাজেক অবধি ঘুরে এসেছি। আমাদের একটা ছোট্ট স্নো হোয়াইট প্রিন্সেস নিয়ে শুভ্র মেঘের ভেলা সাজেকের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরা শেষ। বেবি তার ছোট নরম একটা হাত দিয়ে আমার আঙুল ধরে, অন্য হাত দিয়ে দিব্যর আঙুল ধরে। এমতাবস্থায় ভবিষ্যতে বেবিকে যদি বলি, যাও শোনা মামা হয়। মামার কোলে চ’ড়। বেবি আমার উপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হবে।”
নৃত্যর চোখ ছানাবড়া। সময় নিয়ে বেশ উৎসুক হয়েই ফের প্রশ্ন করে নৃত্য,
-” তা ভীন গ্রহের সেকেন্ড প্রবলেমটা এবার শুনি?”
-” দ্বিতীয় সমস্যাটা মা’রা’ত্মক, ভয়াবহ। অন্যর সাথে বিয়ের পর, যদি দিব্যকে দেখে আমার হুট করে চুমু-টুমু খেতে ইচ্ছে করে; তাহলে নিজেকে আমার ঘোর পা”পী মনে হবে।”
নিতি বিড়বিড় করে বলায় নৃত্যর কানে কথাটা পৌঁছায় না। নৃত্য কান পেতে বলল,
-” কী বলছো শুনতে পাচ্ছি না তো।”
নৃত্যের মাথায় চাটি মে/রে বলল,
-” এটা শোনার বয়স হয়নি তোর।”
নৃত্য সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা নিশ্চয় করবে। এতটা স্বাভাবিক থাকার মেয়ে তুমি নও আপু।”
-” এই তুই বড় না আমি বড়! এত পাকনা পাকনা কথা বলছিস যে।”
চিকু-বান্টি কার্টুনের বান্টির সুরে বলে নৃত্য,
-” বয়সে বড় হতে পারো, বুদ্ধিতে নয়।”
নিতি মোটামোটা চোখে চাইল। নৃত্য পিটপিট করে চেয়ে বলল,
-” আপু নাম তোমার নিতি তাই বলছি; যাই করো না কেনো দুর্নীতি করে নিজের নামের মান ক্ষুন্ন করো না।”
-” জীবনে একবার হলেও দুর্নীতি করবো বলেই তো নিজের নামের বানানে দন্ত-ন ঈ-কার ব্যবহার না করে দন্ত-ন ই-কার ব্যবহার করে আসছি আমি।”
#চলবে