#প্রণয়ের_বাঁধন |২৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
শুক্রবার দিন সবকিছুতেই দারুণ একটা পবিত্র পবিত্র ভাব বিরাজ করে। দূরের মসজিদ থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। মির্জা বাড়ির কিচেন থেকে বিভিন্ন মশলাপাতির গন্ধ ভুরভুর করছে। হরেক রকমের পদ রান্না করা হচ্ছে। মাছ-মাংসের গন্ধে তনুজার গা-টা আজ কেমন জানি গুলিয়ে আসছে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। তনুজা খুন্তি দিয়ে প্যানে কিছু নাড়তে ব্যস্ত। এমন সময় তামান্না আসলেন। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে বললেন,
-” আর কতদূর? ওনারা তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো বলে। সময় মতো রান্না শেষ হবে তো।”
দীর্ঘক্ষণ আ’গু’নের আঁচে থেকে পৌষ মাসেও তনুজার কপালে ঘাম জমেছে। কপাল বেয়ে মুখের সাইডে থাকা বেবি হেয়ার কানের পিঠে গুঁজে নেয় তনুজা। ক্লান্তিতে ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। প্রত্যুত্তরে মিহি স্বরে বলল,
-” ফুপি, এই তো শেষের দিকে প্রায়।”
তামান্না কেবিনেটের উপর থাকা খাবারের ঢাকনা খুলে খুলে দেখছেন। কণ্ঠে আদেশ জারি করলেন,
-” সাদা ভাত দেখছি এখনো রান্না হয়নি। বাসমতি চালের সাদা ভাত রান্না করো। আর শোন; সেইসময় বারবার যেনো বলা না লাগে ফলমূল সুন্দর করে কে’টে সাজিয়ে রেখো। ও হ্যা, রান্না শেষে সালাদের জন্য শসা আর গাজর কে’টে রাখবে। সাথে লেবুও রাখবে।”
এরমধ্যে শিরিন সুলতানা আসলেন। তামান্নার হুকুম শুনে বি”র”ক্ত হলেন। তনুজাকে ডেকে বললেন,
-” তনুজা।”
তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
-” হ্যা, মামণি।”
-” সেই সকাল থেকে কিচেনে আছো। রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। বাকি কাজ বুয়ারা আছে করে নিবে। কিছুক্ষণ পর মেহমান আসবে, শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নাও। বড়রা রেডি হয়ে হাত-পা তুলে ঘুরছে, আর বাচ্চা একটা মেয়ে হয়ে তুমি এখনও কিচেনেই আছো।”
তামান্নাকে পিন মে/রে কথাটা বলে শিরিন। তামান্নার মুখে গ্রহণ লাগে যেন। সেকেন্ডেই মুখটা থমথমে গম্ভীর হয়ে যায়। ওনার কাছে আদিখ্যেতা ঠেকল। তবে ভাবীর মুখের উপর কিছু বলার স্পর্ধা দেখালেন না। মনেমনেই রাগ-ক্ষোভ ঝাড়লেন। তনুজা বলল,
-” হাতের কাজটা শেষ করেই যাচ্ছি। আর একটু বাকি আছে। সমস্যা নেই মামণি।”
শিরিনের হাতে থাকা মুঠোফোন শব্দ করে বেজে উঠল। যাওয়ার আগে আদেশের সুরে বললেন,
-” আচ্ছা। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি একটু পরই আসছি; এসে যেনো তোমাকে কিচেনে না দেখি।”
ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায় শিরিন। এরমধ্যে কিচেনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিতির বাবা হালকা কেশে ডাকলেন,
-” তামান্না আছো?”
মহিলা মুখাবয়ব এমন করলেন যেনো বেশ বি’র’ক্ত হলেন। এগিয়ে কর্কশ স্বরে বললেন,
-” হ্যা বলো। কী হয়েছে কী? এত ডাকছো যে?”
তনুজা ফুপা শ্বশুরের উপস্থিত টের পেয়ে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দেয়। ভদ্রলোক কলেজের বাংলার লেকচারার। চাকরির সুবাদে অন্যজেলায় থাকেন। ছুটির দিনগুলোতে নিজ বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি থাকেন। নিজের বউয়ের থেকে মুখ ঝামটা নিত্যকার বিষয় মানুষটার কাছে। তবে বাড়ির নতুন বউয়ের সামনে এহেন কর্কশ বিহেভে ভেতরে ভেতরে আ’হ’ত হলেন নেওয়াজ সাহেব। লজ্জিত হোন। মুখটা ম্লান হয়ে আসলো। শুধালেন,
-” আমার সাদা পাঞ্জাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছো?”
-” কোথায় থাকবে। কেবিনেটে বা আলমারিতে দ্যাখো; আছে হয়তো সেখানে। তাছাড়া যাবে কোথায়।”
নেওয়াজ সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন,
-” খুঁজে দেখলাম। পাইনি জন্যই তো তোমাকে বলছি।”
-” নৃত্যকে বলো খুঁজে দিতে। আর নয়তো চশমাটা পড়ে ভালো করে খুঁজে দ্যাখো। বয়স বাড়ছে সাথে চোখ দু’টো তোমার যাচ্ছে।”
একজন আদর্শ স্ত্রী হলে নিজে গিয়ে খুঁজে দিতো। এতটা আশা ভদ্রলোক করেনও না। তারপরও একটু ভালো করেও তো বলা যেতো। এই ভেবে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় ওনার। কিছু ভেবে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে হঠাৎ বললেন,
-” এখানে এসব আয়োজন না করে বাড়িতে করলে ভালো হতো না। না মানে মেয়ের বিয়ে-শাদির ব্যাপার নানার বাড়িতে করলে, কেমন দৃষ্টিকটু লাগবে না। এখন তো এসব বলে লাভ নেই। একটু ভেবে দেখো, বিয়ের পুরো বিষয়টা বাড়িতে করলে….”
কথার মাঝে দাঁড়ি টেনে দিয়ে উঁচু স্বরে বললেন,
-” ওই অজপাড়া গাঁয়ে গিয়ে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো। ওখানকার লোকজন না জানে কালচার না জানে..”
একবার স্প্রিংয়ে টান পড়লে যেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছুক্ষণ দুলতে থাকে। ঠিক তেমনি তামান্নার মুখটা স্প্রিংয়ের মতো একাএকাই চলতে থাকল। ভদ্রলোক কথাটা বলে যেন বেশ বেকায়দায় পড়লেন। বলে কাজের কাজ কিছুই হলো না। আরো নতুন বউ আবার কাজের লোকদের সামনে এহেন কথাবার্তা শুনে অ’প’মানিত বোধ করলেন। ভদ্রলোক ম্লান মুখে প্রস্থান করলেন।
.
কাজ করতে গিয়ে আচমকা ফুটন্ত তেল তনুজার হাতে ছিটে পরে। প্যানে টগবগ করা গরম তেল পরার সাথে সাথেই কব্জি থেকে ইঞ্চি দুই উপরে পরপর দু-তিনটা ফোসকা উঠে। তনুজা বাম হাতের সাহায্যে ডান হাতটা চেপে ধরে চোখ বুজে নেয়। হাতটা ভীষণ জ্বা’লাপো’ড়া করছে। কাজের বুয়া দেখে তড়িৎ হইহই করে উঠল,
-” অ্যাইরে ভাবিমণি তো হাতটা পুড়াইয়া ফালাইলেন। ইশশ্ রে! কত্তখানি জাইগা জুইড়া ফোস্কা উঠছে। ম্যালা কষ্ট হইতাছে? পুড়তাছে? জলদি ঘরে গিয়া ওষুদ লাগাইয়া ন্যান।”
বুয়ার সহজ-সরল মনের অভিব্যক্তি দেখে তনুজা আলতো হাসল। ওর বলতে ইচ্ছে করল,
-” যার গোটা জীবনটাই কষ্টের যাতনার! তার কাছে এই সামান্য জ্বলন-ব্যাথা কিছুই না। শরীরের ব্যাথা ঔষধ দিলে নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। কারো উপেক্ষায় – অবহেলায় যে প্রতিনিয়ত দম বন্ধ হয়ে আসছে! অসহনীয় যাতনায় ছটফটিয়ে দ-গ্ধ হচ্ছি! মনের এই কষ্ট উপশমের পাথেয় যিনি; তিনি কী আদৌ আর বুঝবেন? রাগ-ক্ষোভ, অভিমান দূরে ঠেলে সবটা স্বাভাবিক করে নিবে কী? মনের সেই যন্ত্রণা-কষ্টের কাছে শরীরের এই সাময়িক কষ্ট তো কিছুই না।”
অবচেতন মন এসব ভেবে মনেমনেই তাচ্ছিল্য হাসে তনুজার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে বলল,
-” ঔষধ নিতে হবে না। এটা তেমন কিছুই না। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”
এইবলে তনুজা কাজ করতে নেয়। কাজের মেয়েটা বাঁধ সাধল। বেগম সাহেবা একটু আগে এসে কি বলেছেন এই বলে তনুজাকে এক প্রকার জোর করে রুমে পাঠায়। এ-ও বলে বাকি কাজ সে করে নিবে।
কাজের মেয়ের নির্ভেজাল সরল ভালোবাসা দেখে তনুজা আপ্লুত হয়। আসলে এই পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত। তার থেকেও বেশি অদ্ভুত মনুষ্য জাতি। এইযে শিক্ষিত হলেও অনেকের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকে না। সুন্দর মন সবারই থাকে না। মানুষের ক্লাস কখনো অর্থ আর স্ট্যাটাসের উপর ভিত্তি করে করতে হয় না। একজন মানুষ কতটুকু ভালো, কতটুকু মানবিক গুন সম্পন্ন এর উপর ভিত্তি করে ক্লাসিফিকেশন করতে হয়। তবেই না ভালোর চর্চা হয়, ভালোর প্রতি উৎসাহিত করে।
___________
তনুজা রুমে প্রবেশ করে দেখে ইভান শাওয়ার নিয়ে বেরুচ্ছে। একপল তনুজার দিকে তাকিয়েই তড়িৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় ইভান। তনুজার কষ্ট অনুভব হয়। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও, দাঁতে দাঁত চেপে ইচ্ছে সংবরণ করে ও। তনুজা শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস বের করতে থাকে। ইভান কেবিনেট খুলে কিছু খুঁজছিলো। তনুজা আন্দাজ করে বলল,
-” টিশার্ট বাকিসব বাম পাশের পাল্লায় রাখা আছে। কালকে গুছানোর সময় এদিকে যায়গা হচ্ছিলো না, তাই ওপাশে রেখেছি।”
ইভান ওপাশের পাল্লা না খুলে এখান থেকেই একটা নেভি-ব্লু কালারের টিশার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকল।
.
আয়নার সামনে বসে তনুজা। শ্যাম্পু করা চুলগুলো চিরুনি করে ছেড়ে দেয়। হাতে স্বর্ণের কয়েকটা চিকন চুড়ি পড়ে নেয়। ডান হাতের চুড়ি গুলো গিয়ে হাতের পোড়াতে ঘর্ষণ লেগে ব্যাথা করছে। ওদিকে বাড়িতে মেহমান আসবে, হালকা গহনা না পড়লে দিদুন রাগ-ঢাক করবেন। অগত্যা তনুজা চুড়ি পরে। ইভান ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে যেতে থাকে। তনুজা উঠে দাঁড়ায়। চোখে টলমলে পানি নিয়ে ডাকল,
-” ইভান।”
ইভানের পা থেমে যায়। উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে নিরুত্তর নিশ্চুপ রয়। কাজলটানা মৃগ নয়ন পানিতে টইটম্বুর করছে তনুজার। বুক ভরা হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিম্নস্বরে বলল,
-” জীবন সহজ নয়! সহজ করে নিতে হয়! অপেক্ষা করে, সহ্য করে, ধৈর্য্য ধরতে হয়।”
থেমে ম্লান স্বরে ফের বলল,
-” ইভান আমি আর কত ধৈর্য্য ধরব? আপনার ইগনোরে আমি সত্যিই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। প্রতিনিয়ত আমার নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। মনে হচ্ছে আমি সাফোকেটিংয়ে ভুগছি। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন আমায়।”
ইভান নাতো টু শব্দটি করলো; আর নাতো ফিরে তাকায়। কথাটা না শোনার মতো গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে। তনুজা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু বিসর্জন দেয়।
___________
নীরবের ফ্যামেলিকে লাঞ্চের ইনভাইট করা হয়েছে। ওনারা খানিকক্ষণ আগেই আসছে। নীরবের বাবা, নেওয়াজ সাহেব আর শাহারিয়ার সাহেব এখনো নামাজ শেষ করে ফেরেনি। নীরবের মা ড্রয়িংরুমে বসে শিরিন সুলতানা আর তামান্নার সাথে গল্প করছেন। এরমধ্যে তামান্না তনুজাকে ডেকে নিতিকে আনতে বলেন। নিতি রেডি হয়ে ঘরময় অস্থিরতায় পায়চারী করছে। যখন থেকে শুনেছে নীরব আসেনি তখন থেকে ওর ছটফটানি কয়েক দফা বেড়ে যায়। এরমধ্যে তনুজা গিয়ে জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল,
-” মাশাআল্লাহ! শাড়িতে তোমাকে ভারী মিষ্টি আর খুব বেশিই সুন্দর লাগছে। যদিও তুমি এমনিতেও সুন্দরী!”
ফর্সা গায়ে মেরুন রঙের জামদানিতে নিতিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নিতি সৌজন্যতা করতে নিরস কণ্ঠে বলল,
-” থ্যাংকস।”
-” চলো এবার। নিচে তোমাকে ডাকছে।”
তনুজা তাড়া দেয়। নিতি আগে তনুজা দু’কদম পিছে। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় দিব্যর সামনাসামনি পরে নিতি। দিব্য কয়েক হাত দূরত্বে, বাইকের চাবি আঙুলের ডগায় ঘুরাতে ঘুরাতে আসছিলো। নিতিকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে একটু অবাক হয়। বাড়ির খবরাখবর আজকাল তেমন কিছুই রাখে না দিব্য। নিচে অচেনা কাউকে দেখেও জানার আগ্রহ হয়নি “কে?” দিব্যর চোখে চোখ মিলতেই নিতির ভেতরের দুষ্টুমিরা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। নিতি মুখের উপর থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজতে গুজতে স্লো ভয়েজে সুর করে গাইল,
-” পা’গ’ল তুজহে মায় কারদুংগি এখদিন পিয়ার মে এখদিন পিয়ার মে।”
এতটুকু গেয়ে বাম চোখ টিপল নিতি। পরপর তড়িৎ একহাত চোখে ধরে পিছনে ঘুরে তনুজাকে বলল,
-” ভাবিমণি দ্যাখো! দ্যাখো তো চোখে কিছু একটা পড়ল হয়তো।”
দিব্য ভ্যাবাচ্যাকা খায়। বো’কা বনে যায়। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ঘটলো যে বেচারা ঠাহর করতে পারল না। তনুজা মনোযোগ দিয়ে নিতির চোখে দেখতে থাকে। তনুজা থাকায় দিব্য আর নিতিকে নিয়ে ঘাটল না। কিছুই না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। দিব্য চলে যেতেই নিতি স্বাভাবিক ভাবে তাকায়।
-” থাক! থাক! লাগবে না, ভাবিমণি। ঠিক হয়ে গিয়েছে। পোকা উড়ে গিয়েছে।”
নিতি দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলে। তনুজা নির্বোধের মতোন চেয়ে রয়। ওর মাথার একহাত উপর দিয়ে যায় সব।
____________
পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে। শহরে শীতের আমেজ পড়েছে। বিকেলের নরম রোদ ব্যালকনিতে দাঁড়ানো দিব্যর গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। একহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে অন্যহাতে জ্বলন্ত সিগারেট দুই ঠোঁটের মাঝখানে চেপে দাঁড়িয়ে দিব্য। এমন সময় মেয়েলি রিনরিনে স্বর ঝংকার তুলল,
-” সিগারেট খায় বো’কা’রা।”
দিব্য পরপর উর্ধ্বমুখী ধোঁয়া ছেড়ে হাতের অবশিষ্ট সিগারেট গ্রীল দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলল। নিতির দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-” তুই?”
নিতি দুই হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়ায়। ও বলল,
-” সিগারেট খেয়ে ঠোঁট দুটো পু’ড়া’চ্ছো। তোমার বউয়ের নিশ্চিত ওই কালচে ঠোঁটে চুমু খেতে একদম রুচি হবে না।”
দিব্য রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। সফেদ দন্তপাটি কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” নি..তি। খেয়ে কাজ নেই তোর! শুধু আসিস মেজাজ খা’রা’প করতে আমার।”
নিতি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
-” কাজেই এসেছি এখন। আমার তোমাকে জরুরী কিছু বলার আছে।”
দিব্য গা ছাড়া ভাবে থাকল। নিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা নুইয়ে একদম নিচু স্বরে বলল,
-” নেক্সট ফ্রাইডেতে বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে।”
দিব্য চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে নিতির দিকে সরু চোখে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-” তোহ!”
কীভাবে বলবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না নিতি। নিতির মধ্যে জড়তারা ভীড় জমিয়েছে। কথাগুলো কণ্ঠনালীতে আঁটকে আসছে; মুখ ফুটে বেরুতে গড়িমসি করছে। এরমধ্যে দিব্য বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,
-” তোর বিয়ে নেক্সট সপ্তাহে; সেখানে আমার কাজ কী? হ্যা আমার কাজ অবশ্য একটা আছে। তুই কী এখন আমাকে এটা বলতে আসছিস, যে আমি আজই যেনো সাউন্ড বক্স নিয়ে আসি। আর সাথে শহরের নামকরা ফটোগ্রাফারকে বলে আসি। হলুদের দিন থেকে শুরু করে একদম বিদায় পর্যন্ত যেন অবিরাম ফটো তুলে যায়। তোরা মেয়েরা তো বিয়েতে এসবই চাস। তা তোর বিয়েতে গিফট হিসেবে আমার তরফ থেকে এতটুকু আমি করতেই পারি।”
নিতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বলল,
-” আরে ধূর! আমাকে বলতে দিবে তো। একটু সময় দিবে। তা না যা মনে হচ্ছে বলেই যাচ্ছো। আমি এই বিয়েটা করতে চাই না।”
দিব্য নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-” এটা আমাকে বলছিস কেনো? তুই বিয়ে করতে চাস না এটা শুনে আমি কী করবো? ফুপিকে বল। এন্ড তোর বাপকে গিয়ে বল। তোর বাপ নেওয়াজ শরীফ না তোর সব আবদার শোনে।”
নিতি তেতে উঠল,
-” উফ্ফ! আবার আমার পাপাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছো। কথাটা মাম্মা বা পাপা কাউকে বলার আগে তোমাকে বলা জরুরী। তাই তোমাকে বলছি।”
থেমে বুক ভরে শ্বাস নেয় নিতি। চোখদুটো বুঁজে মুখস্থ পাঠের ন্যায় গড়গড় করে বলল,
-” আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। কজ আমি তোমাকে পছন্দ করি। শুধু পছন্দই নয় এর থেকে বেশি কিছু।”
ধীরে ধীরে চোখ মেলে দিব্যর দিকে তাকায় নিতি। দিব্যর মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। নিতি ভয়ে ভয়ে ছিলো কথাটা শোনার সাথে সাথে গালে ঠাস করে চ’ড় না পরে। তবে দিব্যকে নির্বিকার দেখে নিতি ভড়কায়। নিতি ম্লান স্বরে বলল,
-” ভেবেছিলাম আজ সাহস করে মিস্টার নীরবকে বলবো বিয়েটা ক্যান্সেল করতে। কিন্তু ও ব্যাটা ইমার্জেন্সি পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি। এদিকে আজকেই আন্টি আংকেল ডেট ফিক্সড করেছেন। আর জানি না মাম্মা এত তাড়াতাড়ি কেনো ডেট বললো। পাপা সামনের মাসের কথা বলছিলো। কিন্তু মাম্মা আগ বাড়িয়ে নেক্সট ফ্রাইডে বলে। এখন আমি কী করবো বুঝতে পারছি না?”
-” বিয়েটা করে নে।”
-” আমি মোটেই প্রাঙ্ক করছি না। আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমার সত্যিই তোমাকে সেই কিশোরী বয়স থেকেই ভালো লাগে। সব কিছু ভুলে আমাকে মেনে নেওয়া কী খুব বেশিই অসম্ভব? এই ইম্পসিবল কে পসিবেলে কনভার্ট করলে খুব বেশিই কী ক্ষ’তি হবে? কারো হৃদয়ের গহীনে লুকানো একতরফা ভালোবাসার পূর্ণতা দেওয়া যায় না?”
নিতির অসহায় চোখ। কণ্ঠে ঝরল করুণ আবদার। দিব্যর পাথুরে কঠিন হৃদয় এতটুকু নাড়া দিলো না। কাটকাট গলায় বলল,
-” ইম্পসিবল। একেবারেই সম্ভব নয়। যা হুট এখান থেকে।”
নিতির ভীষণ কান্না পেলো। সাথে রাগ হলো। কিছুপল থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল নির্লিপ্ত। হঠাৎ কিছু ভেবে বাচ্চামোর সুরে বলল,
-” আমি…আমি সু’ইসাইড করব।”
দিব্য স্বাভাবিক মুখাবয়ব করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-” কীভাবে?”
নিতি কয়েক সেকেন্ড ভাবল। মহা আবিষ্কার করার মতোন মুখভঙ্গি করে বলল,
-” উমম! ব্লে’ড দিয়ে হাতের শিরাগুলো কেটেকুটে।”
-” একটান দেওয়ার পর ব্লা’ড দেখে তুই সেন্সলেস হয়ে পড়বি। তাই এই পদ্ধতিতে তুই উপরে যেতে পারবি না; আ’ম ড্যাম শিওর।”
-” ওকে। এটা বাদ হারপিক খাবো। নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট জিবাণু ধ্বংসকারী হারপিক নিশ্চয় এক নিতিকে নিমিষেই.”
এতটুকু বলে এক আঙুল গলায় টান দেয়। তারপর উপরের দিকে ইশারা করে বলল,
-” নিমিষেই নিতির লাইফ খতম করে একদম উপরে পাঠিয়ে দিবে। সোজা পটল তুলাবে।”
দিব্য নাকমুখ সিটকিয়ে বলল,
-” ছ্যাহ! ইতর কোথাকার! আমাকে রিকোয়েস্ট করলে, ভালো নামকরা কোম্পানির ইঁদুর মা/রা বি//ষ এনে দিতে পারি। যা হারপিকের থেকেও দ্বিগুণ কার্যকারী। সাথে অল্প সময়েই…খ’ত’ম করবে।”
নিতির চোখদুটো কপালে উঠল। এহেন খা’রাপ মানুষ নিতি বাপের জন্মে নয়, দাদার জন্মে নয়, কোন জন্মেই দেখেনি। কত্তবড় খারাপ হলে মানুষ এমনটা বলে। কোথায় সু’ই’সা’ইডের কথাশুনে চিক্কুর লাগা দিবে, তা না আরো ইন্সপায়ার্ড করছে। খা’টাশ কী আর সাধে বলি! এসব ভেবে নিতি কাঁদো কাঁদো ফেস করল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” তোমাকে হেল্প করতে হবে না। আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নিবো হুম। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। ঠিক একটা না একটা উপায় আমি নিজেই বের করে নিবো।”
রাগে গজগজ করতে করতে নিতি পা বাড়ায়।
-” ধ্যাত আমারি ভুল। খিচুড়ির মতো লোককে বিরিয়ানি ভেবে ভুল করেছি। এন্ড এত তোষামোদ করাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল। হু।”
বিড়বিড় করতে করতে পা চালিয়ে প্রস্থান করতে নিয়ে; আচমকা শাড়ির কুচিতে উস্টা খেয়ে পরে যেতে নেয় নিতি। এমন মূহুর্তে একটা শক্তপোক্ত রুক্ষ হাত নিতির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। নিতি ভ’য়ে খিচে চোখ বন্ধ করে ফেলে। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখে দিব্য একহাতে কোমড় জড়িয়ে নিতির দিকে ঝুঁকে। নিতি নিচের দিকে কাত হয়ে আছে। একটু আগের কথা ভেবেই নিতির আকাশসম রাগ হয়। তাই ঠোঁট উল্টে বলল,
-” ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে। এখন এতো ধরতে হবে না তোমাকে। আমি এ.”
নিতির মুখের কথা মুখেই থাকে। নিতির বলতে দেরি দিব্যর ছাড়তে দেরি হয় না। কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। নিতি ধপাস করে ফ্লোরে পরে যায়। নিতি ফ্লোরে দুইহাত ঠেস দিয়ে বিস্ময়কর চাউনিতে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” এটা কী হলো?”
-” কেনো? তুই যা বললি তাইই তো করলাম। তুই-ই তো ছাড়তে বললি।”
কথাটা বলে চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করে সুন্দর করে নিতিকে পাশ কাটিয়ে রুমে যায় দিব্য। নিতি কোমড়ে হাত দিয়ে মনেমনে দিব্যকে আচ্ছা মতো ব’কে।
.
নিতি রুমে গিয়ে শাড়ি খুলে থ্রি পিস পরে নেয়। শাড়িটা বিছানায় এলোমেলো ফেলে রুম থেকে বেরোয় আর বিড়বিড় করতে থাকে,
-” আস্ত খা’টা’শ একটা। এত করে বললাম মন গললো না। ঠিক আছে আমিও বিয়ে করে নিবো। তুই থাক সারাজীবন দেবদাস হয়ে। তনুজা ভাবি যদি মেনে নিয়ে সংসার করতে পারে আমি কেনো পারব না।”
মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত আছে। মন-মেজাজ স্বাভাবিক করতে নিতি ছাদে যায়। নৃত্য ছাদে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে আর ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছে। নিতি গিয়ে গুমড়া মুখ করে পাশে বসে। নৃত্য শুধায়,
-” মন খারাপ তোমার?”
-” উঁহু।”
হাতের বইটা বন্ধ করে পাশে নামিয়ে নৃত্য বলল,
-” অ্যাই আপু চলো ব্যাডমিন্টন খেলি। খেললে পরে দেখবা নিমিষেই মন ভালো হয়ে যাবে। আমি বইটা রেখে ফেদার আর র্যাকেট নিয়ে আসছি। খেলবে আমার সাথে। প্লিজ না করো না।”
নিতি বিরক্ত হয়ে বলল,
-” নৃত্য আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ কানের পাশে ঘ্যানঘ্যান করিস না।”
নৃত্যের মুখটা ম্লান হয়। তা দেখে নিতির খারাপ লাগল। এবার মোলায়েম স্বরে বলল,
-” বোন মন খা’রাপ করিস না। এখন নয়। পরে খেলব।”
নৃত্য হাসিহাসি মুখ করে বলল,
-” ওকে ব্যাপার না। আচ্ছা আমার না জলপাই খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি যদি কয়েকটা জলপাই পেরে দিতে। লবণ, মরিচের গুঁড়া দিয়ে খাবো।”
নিতি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। নৃত্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-” বইটা রুমে রেখে আসি। তুমি পারতে থাকো কেমন।”
কথাটা শেষ করে নৃত্য ভো দৌড় দেয়।
নিতি উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে থাকা জলপাই গাছটার দিকে তাকায়। গাছটা বিশাল বড়সড়। একটা ডাল ছাঁদ ঘেঁষে আছে। নিতি দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে নাগাল পাচ্ছিলো না। তাই রেলিংয়ের উপর দাঁড়ায়।
.
ফোন কানে চেপে কারো সাথে কথা বলতে বলতে দিব্য ছাদে আসছিলো। ছাদে কয়েক পা ফেলতেই ওর চোখ যায়..
#চলবে
#প্রণয়ের_বাঁধন |২৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঠা’স শব্দটা মূহুর্তেই খোলা ছাদ জুড়ে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। তৎক্ষণাৎ নিতি বিস্ময়ে স্তব্ধ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। অবাকের শীর্ষে পৌঁছায় মেয়েটা। পিটপিট করে পলক তুলে নির্বোধের মতোন গোলগোল চোখ করে দিব্যর রাগান্বিত মুখের দিকে তাকায়। আপনাআপনি একটা হাত নিজের মকমলের মতো তুলতুলে গালে চলে যায়। সেকেন্ডের মধ্যে কী ঘটলো! ভেবে কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা।
নিতিকে রেলিংয়ে দেখে ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে দিব্যর অবচেতন মন ভাবে, নিতি বোধহয় সু-ই-সা-ইড করতে যাচ্ছে। তখন নিতির বলা কথাগুলো সিরিয়াসলি না নিলেও; চোখের সামনে এহেন দৃশ্য দেখে এছাড়া দ্বিতীয় ভাবনা দিব্যর মস্তিষ্কে আসে না। দিব্য জোরেশোরে বলে উঠে,
-” নিতি..”
দিব্যর হঠাৎ এভাবে চেঁচিয়ে ডাকায় তিনি ভড়কায়, হকচকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে চাইতেই দেখতে পায়; দিব্য ঝ’ড়ের বেগে ছুটে আসছে। কিছু ঠাহর করার আগেই নিতির চিকন কোমল হাতটা ধরে টান দেয় দিব্য। নিতির মাথাটা গিয়ে সোজা দিব্যর বুকের উপর পরে। মাথা তুলতেই যা ঘটে তার জন্য নিতি মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। দিব্য চোখমুখ শক্ত করে ক’ষি’য়ে নিতির গালে থা/প্প/ড় দেয়।
এদিকে দিব্যর চোখ দু’টো যেন আ’গু:নের স্ফু’লিঙ্গ। রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
-” এটা কী করতে যাচ্ছিলি? তুই পা/গ/ল হয়েছিস নাকি?”
পরপর আঙুলের সাহায্যে কপালে স্লাইড করে রা’গ কমানোর চেষ্টা করে দিব্য। বড়বড় শ্বাস ফেলে ফের বলল,
-” সব কিছুতেই ফা’জ’লামি করে কেউ? ইচ্ছে তো করছিলো ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। তোর ম/রা/র সাধ ইহজন্মের জন্য ছুটাতে ইচ্ছে করছিলো।”
নিতি হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে নিস্পন্দ চোখে তাকিয়ে ছিলো। দিব্যর কথা কর্ণগোচর হয়ে নিউরনে পৌঁছাতেই দিনের আলোর মতো সবটা ফকফকা হয়। নিতি ঢের অনুমান করে ফেলে দিব্য কী ভেবেছে! নিতি সত্যিটা বলে না। ওর কেনো জানি রাগ হচ্ছিলো। তাই তো রাগ দেখিয়ে বলল,
-” ইচ্ছেটা পূরণ করতে। কে বলেছিলো এভাবে টেনে নিচে নামাতে? আর..আর এরকম অ’ভ’দ্রের মতো আচরণ করতে।”
-” নি_তি। চ-ড় যদি আরেকটা খেতে না চাস; তো পা’গ’লা’মি বাদ দে।”
চ-ড় খাওয়ার কথা শুনেই যেন গালের ব্যাথায় টনক নড়লো। গালটা সত্যিই ব্যাথা করছে। রাগের সাথে কান্নাও পাচ্ছে নিতির। হঠাৎ বাচ্চা শিশুর মতো অভিমানী হয়ে ঠোঁট দুটো ফুলাল নিতি। কণ্ঠে নামল তীব্র অভিমান,
-” তুমি জানো আজ অবধি আমার মাম্মা ছাড়া আমার গায়ে কেউ হাত তোলা তো দূর রুড আচরণ করেনি। আর তুমি সবসময় আমার সাথে খেক শিয়ালের মত খ্যাকখ্যাক করা আচরণ তো শো করোই; আর আজকে তুমি তোমার লিমিট ক্রস করে গিয়েছো। আমার গায়ে হাত তুলেছো। আর কে বলেছে আমি সু’ইসা’ইড করতে যাচ্ছি? তোমার মতো একটা বা’জে লোকের জন্য আমার সু-ই-সা-ই-ড করতে বয়েই গিয়েছে।”
থেমে, নাক টেনে চেঁচিয়ে বলল,
-” নিজেকে কী ভাবো তুমি? কী ভাবো টা কী? তোমাকে না পেলে জীবন শেষ করে দিবো! জীবন এতটাই ফে’ল’না? তোমার ভুল চিন্তা ভাবনা তোমার নিজের কাছেই রাখো। আমার জীবন এতটাও সস্তা নয়; যে তোমার মতো অ’ভদ্র…”
বাকি কথা গিলে নেয় নিতি। আঙুলের সাহায্যে চোখের কোণে জমা অশ্রু মুছতে মুছতে দৌড়ে প্রস্থান করে। দিব্য নিম্নাষ্ঠের ডান পাশে দাঁত বসিয়ে নিতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। পরপর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেওয়ালে সজোরে ঘু-ষি মা’রে। চোখ বন্ধ করে নিয়ে ভাবে, চ-ড় দেওয়া কোনমতেই ঠিক হয়নি। কিন্তু তখন রাগে মাথা কাজ করছিলো না, তাই। দিব্যর ভেতর তীব্র অনুশোচনা হতে থাকে। এখন আরো ভ-য় জেঁকে বসে দিব্যর মধ্যে। নিতি রাগ-ক্ষোভ নিয়েই এমনটা বলেছে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। গোধূলির অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিব্য। মনেমনে সিদ্ধান্ত নেয় নিতিকে ঠান্ডা মাথায় বোঝাবে। পাছে না রাগের বশে বড় কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে মেয়েটা।
__________
রুমময় অস্থিরতায় পায়চারী করছে দিব্য। একবার রুমে যাচ্ছে তো আরেকবার করিডোর দিয়ে হাঁটছে। উদ্দেশ্য নিতির সাথে কথা বলা। নিতিকে একটু আগে নিচে যেতে দেখেছে। এখন দোতলায় সিঁড়ি থেকে খানিকটা দূরত্বে দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর নিতিকে সিঁড়ি বেয়ে আসতে দেখা যায়। যাক অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটল। কিন্তু বিধিবাম! নিতি নিজের রুমের দিকে না এসে অন্যদিকে গেল। যা দেখে দিব্যর ধৈর্য্যর বাঁধ হারা হয়। দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে দিব্য।
তনুজার রুমের সামনে গিয়ে নক করে নিতি। তনুজা এগিয়ে আসতেই নিতি হাতে থাকা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট বাড়িয়ে বলল,
-” ভাবিমণি! তুমি বোধহয় বুয়াকে কিছু আনতে দিয়েছিলে। এটা আমার হাতে ধরিয়ে তোমাকে দিতে বলল।”
তনুজা একটু অপ্রস্তুত হয়। হালকা হাসার চেষ্টা করে প্যাকেটটা হাতে নেয় ও। পরপর সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
-” ভেতরে এসো নিতি।”
নিতির মনমেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকায় এড়িয়ে যায়। ও বলে,
-” ঠিক আছে ভাবিমণি! আমার মাথাটা ধরেছে। তাই এখন লম্বা একটা ঘুম দরকার। আমি আসছি, কেমন?”
তনুজা প্রত্যুত্তরে ঠেলেঠুলে হাসার চেষ্টা করল।
.
দিব্য উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে। নিতি দেখেও না দেখার ভান করে লম্বা কদম ফেলে যেতে থাকে। এমন সময় গম্ভীর কণ্ঠস্বর আসলো,
-” নিতি দাঁড়া। তোর সাথে আমার কথা আছে।”
নিতি যেন কথাটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। প্রত্যুত্তরে টু শব্দটি করলো না। ওর মতো যেতে থাকে। এমন সময় হাতে টান পরায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কাটকাট গলায় বলল,
-” হাত ছাড়ো। এভাবে হাত ধরেছো কেনো? জলদি হাত ছাড়ো আমার।”
-” মেজাজ খা’রা’প করে দিস না। যা বলছি তাই কর। ছাদে চল। তোর সাথে কথা আছে।”
-” কিছু বলার হলে এখানেই বলো।”
দিব্য আর দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণ করলো না। হাত ধরে টানতে টানতে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। নিতি জোরেশোরে কিছু বলতেও পারছে না; কেউ দেখলে আবার কী ভাববে! অগত্যা দিব্যর সাথে পা মেলায়। ছাদে উঠতেই দিব্যর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। আর তক্ষুনি এক ঝটকায় নিজের হাতটা দিব্যর বাঁধন থেকে ছুটিয়ে নেয় নিতি। রাগি স্বরে বলল,
-” কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো? আমার কাজ আছে।”
চারিদিকে কুয়াশার চাদরে মুড়ানো। কুয়াশার চাদর গলিয়ে চাঁদের রুপোলি আলোয় বসুন্ধরা আলোকিত। রাস্তার পাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলদে টিমটিমে আলো কুয়াশার জন্য আজ বড্ড মলিন ঠেকছে। শীতের সময় হওয়ায়, রাত বেশি না হওয়া স্বত্বেও চারিদিক, পথঘাট কেমন শুনশান নিস্তব্ধতায় ঘেরা। নিস্তব্ধতার মাঝে নিতির কণ্ঠস্বর বাতাসে ঝংকার তুলল। দিব্য চোখ তুলে নিতির রাগান্বিত মুখবিবরে তাকায়। ছটফটে চঞ্চল নিতির রাগি মূর্তি মুখশ্রীটা একটু অন্যরকম ঠেকল। আজ আর দিব্যর মন রাগতে সায় দিলো না। দিব্য অস্ফুটে বলল,
-” স্যরি!”
নিতি প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-” হোয়াট ফর স্যরি?”
রাগের পারদ আজ নিচের দিকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দিব্য। কিন্তু এই মেয়ের জন্য সম্ভব হবে কী না; আল্লাহ মালুম! দিব্য শান্ত স্বরেই বলল,
-” তখন তোর সাথে মিসবিহেভ করার জন্য।”
থামে দিব্য। নিতির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বিশালাকার আকাশপানে একপল চায় দিব্য। অতঃপর অদূরে শুন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত গলায় বলল,
-” নিতি আমি তোর অনুভূতিকে ছোটো করছি না। আর না তো উপহাস করছি। তবে তুই বুঝদার হ। একটু ভেবে দেখ। হয়তো এটা তোর আবেগ। আর নতুন করে আমার সম্পর্কে নাই বললাম। কারন তুই তো আমার সম্পর্কে সবটা জানিস। নতুন করে কাউকে মেনে নিতে পারব না, ব্যাপারটা এমন নয়। এই পৃথিবীতে ধ্রুব সত্যি কী জানিস?”
নিতির টানাটানা চোখজোড়া দিব্যর শান্ত মুখের দিকে ঠাঁই তাকিয়ে। হঠাৎই খুব মনোযোগী হয়ে পরে ও। এতক্ষণের রাগ-ক্ষোভ সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে। দিব্যর কণ্ঠটা আজ অন্যরকম ঠেকছে। বড্ড বিষণ্ণ লাগছে। নিতি ওর সম্পুর্ন মনোযোগ দিব্যর কথায় মনোনিবেশ করে শ্রবণ করতে থাকে। দিব্য বলতে থাকে,
-” জীবন থেমে থাকে না। সময়ের সাথে সাথে প্রবাহমান জীবন। জীবন যেমন থেমে থাকে না ঠিক তেমনি; শুন্য স্থানগুলোও আজীবন শুন্য থাকে না। এক সময় না একসময় শুন্য স্থান পূর্ণ হয়। এই পূর্ণতা পাওয়ার জন্য কাউকে না কাউকে প্রয়োজন। সর্বোপরি ভাগ্য বলে কথাটা তো অবধারিত, ধ্রুব সত্য। আমি সবটা মন থেকে মেনে নিয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে অস্বস্তি হয়। সেই অস্বস্তিটা কাটানোর জন্য হলেও আমার বাইরে যাওয়া জরুরী। আর নিতি আমি জানি তুই খুব ভালো মেয়ে। তুই কখনোই আমাকে ডিজার্ভ করিস না। তুই আমার থেকেও বেটার ডিজার্ভস করিস। তাই বলছি, যেহেতু তোর জন্য বেটার অপশন আছে তাই মেনে নে। দেখবি সময়ের সাথে সাথে মোহ-টোহ কোথায় উবে যাবে।”
দিব্য ম্লান মুখে আলতো হাসলো। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জোৎস্না স্নিগ্ধ রাত! জোৎস্নার আলোয় দিব্যর হাসিটা বড্ড মলিন আর বিষণ্ণ লাগল। যা নিতির বুকে সুচ ফুটানোর মতো ব্যাথা অনুভব করায়। দৃষ্টি তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বক্ষস্থলের গহীন চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় নিতির। পরপর ম্লান স্বরে বলে উঠল,
-” চাঁদকে কখনোই আমার ঝলসানো রুটি মনে হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না আমি বড্ড আদরে আহ্লাদে বেড়ে উঠেছি। হয়ত আমার জন্য অনেক অপশন আছে। মানলাম তোমার থেকেও বেটার অপশন আছে। যেখানে আমার মনমস্তিষ্ক, আমার কল্পনার রাজ্য; সবটার একছত্র অধিপত্য তুমি। সেখানে বেটার কাউকে প্রয়োজন আছে কী? শত শত বেটার অপশনের ভিড়েও আমার মনমস্তিষ্ক একবার নয় দুইবার নয়, শত সহস্র বার তোমাকেই চাইবে। ইউ আর নট মাই ইনফিচুয়েশন। আমার হৃদসায়রের গভীর ছাড়িয়ে গভীরতম থেকে উত্তাল ঊর্মিমালার মতো আসা ভালোবাসার এক নাম তুমি। তুমি মানেই আমার খেয়ালি অবুঝপনা মনকে হিম করা আদ্রতা। এবার বলো এরপরও তোমাকে শুধুই মোহ আর আবেগের মধ্যে কী করে সীমাবদ্ধ করি!”
নিস্তব্ধতার মাঝে নিতির আবেগঘন কথায় পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে আসে। দিব্য চোখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে নিতির দিকে চায়। ওর অবচেতন মন আওড়ায়,
-” বড় অদ্ভুত আমাদের চাওয়া। সবসময় ভুল করে ভুল কাউকেই আমরা চাই। ভুলেতে ডুব দেই। কিন্তু ভাগ্য তো অন্যকিছু লিখে রাখে। ভাগ্যকে খন্ডনের সামর্থ্য তো কারো নেই। ভাগ্যকে না যায় খন্ডন করা আর না যায় উতরানো। তারপরও বে’হা’য়া মন মানতে নারাজ। না চাইতেও কষ্ট সে পাবেই। এই না পাওয়ার বেদনা, যাতনা কতটা ভয়াবহ তা সেই জানে, যে পায়নি, হারিয়েছে ভালোবাসা।”
দিব্য আরো ভাবতে থাকে, জীবনের বারো আনা তো হেলায়-ফেলায় কাটলো। বাকি আছে যে চার আনা, তা দিয়ে কী একবার গ্রো আপ করার চেষ্টা করা যায় না? নিজের জন্য না হোক, তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনার, তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার রঙিন স্বপ্ন বুকে যতন করেছে যে মেয়েটি; তার স্বপ্নের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য হলেও একবার ট্রাই করে দেখবে কী?
দিব্যর মন দোনামোনা করতে থাকে। সিদ্ধান্তের দোলাচল থেকে বেরিয়ে দিব্য চোখদুটো বুজে নেয়। পরপর নিতির ভাসাভাসা চোখে নিশ্চল চাহনিতে চাইল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” নিতি আমি বলবো আরো একবার ভেবে দেখ। আমার ছন্নছাড়া, অগোছালো এলোমেলো জীবনে নিজেকে জড়িয়ে দিনশেষে তোকে যেনো আফসোস করতে না হয়। তাই বলছি ভালো করে ভাব। ভেবেচিন্তে আমাকে জানা। তারপর…তারপর তুই যেটা চাইবি সেটাই হবে।”
লহমায় আকাশের চন্দ্র হাতে পাওয়ার থেকেও বেশি আনন্দ অনুভব হয় নিতির। চোখমুখ জুড়ে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিতি দিব্যকে ঝাপটে ধরে। দিব্য টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। নিতির কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আনন্দ উচ্ছ্বাস তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ তুলল,
-” যতক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে ততক্ষণ অবধি আমার মন তোমাকেই চাইবে। সাহারার মরুর মতো খরখরে তৃষ্ণার্ত মন আমার বারংবার তোমাকেই চায়। বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার, শুধু পাশে থেকো আপন করে নিও; ব্যস!”
সুন্দর আবেগময় কথার মাঝে দিব্য এক নিমিষেই ছন্দপতন ঘটিয়ে দিলো। ঝটিকায় আগের রুপে ফিরে আসলো। নিতিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে কর্কশ স্বরে আদেশ বাণী আওড়ালো,
-” রুমে যা। কুয়াশা পড়ছে। এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা।”
নিতি চোখ সরু করে তাকায়। মনে মনে ভাবে,
-” ব্যা’টা পুরাই নিরামিষ তো আছেই, তার উপর একদম আনসোশ্যাল দেখছি। কোথায় আলিঙ্গন শক্ত করবে, প্রত্যুত্তরে দু’টো মিষ্টি করে কথা বলবে। তা না…. আশ্চর্য! নিতি যেচে নিজের লাইফে দিব্য নামক প্যারাময় বাঁ-শ স্বইচ্ছায় টেনে নিলি। এবার জিন্দেগি ভর সামলাও একে।”
নিতির ভাবনার সুতোর চরকায় টান পড়লো। দিব্য ধ’ম’কের সুরে বলল,
-” কী হলো এখনো সংয়ের মত দাঁড়িয়েই আছিস; কথা কানে ঢুকেনি?”
নিতি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-” যাচ্ছি যাচ্ছি।”
নিতি ক’কদম যেয়ে পিছু ফিরে চায়। কিছু ভেবে শুধালো,
-” তুমি? দাড়িয়ে আছো যে; ভেতরে যাবা না?”
-” তুই যা। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। রাজ্যের ভাবনা আমার ঘাড়ে চেপে দিয়ে তুই তো এখন নিশ্চিন্তে আরামসে ঘুমাবি। এখন কীভাবে সবটা ঠিকঠাক করবো, এই চিন্তায় আমি দিশেহারা হচ্ছি।”
-” প্যারা নিও না। ইচ্ছে থাকলে উপায় বেরোয়।”
দিব্য চোখ গরম করে তাকাতেই নিতি নাকমুখ কুঁচকে ভেংচি কে’টে যেতে থাকে।
___________
ইভান সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। দুইহাতের আঙুল ল্যাপটপের কিবোর্ডে থাকলেও চোখদুটো বারবার তনুজার দিকে যাচ্ছে। তনুজা ব্যাগ গোছাচ্ছে। তনুজা কোণা চোখে ইভানের দিকে তাকাচ্ছে। ওর মনটা খুব করে চাইছে, ইভান বাঁধা দিক। একবার না করুক। ইভান মন থেকে বললেই ও যাবে না। ইভানকে নির্লিপ্ত নির্বিকার দেখে তনুজার বেশি কষ্ট হতে থাকে। ইভান মনে মনে ভাবে,
-” দিদুন তো দুদিনের কথা বলেছিলো। কিন্তু তনুজার ব্যাগ গোছানো দেখে তো মনে হচ্ছে না দু’দিনের জন্য যাচ্ছে।”
একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো পরক্ষনেই কোথা থেকে জড়তা এসে হাজির হয়। আর জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলো না। ইভানের কেনো জানি রাগ হতে থাকে, সে বউয়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না, তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে। তাই বলে টিপিক্যাল বউদের মতো বাপের বাড়ি যেতে হবে। ইভান এটা হজম করতে পারছে না। রাগ করে ল্যাপটপের শাটার বন্ধ করে ল্যাপটপটা শব্দ তুলে সোফায় নামায়। উঠে দুই হাতে টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। তনুজা আড়চোখে সবটা অবলোকন করে। পরপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছু ডাকল,
-” ইভান শুনুন।”
ইভান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। দরজাটা হাট করে খোলা ছিলো। তনুজার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
-” বলো।”
তনুজা এগোয়। ইভানের সামনাসামনি দাঁড়ায়। মুখটা ওর মলিন। ভেতরে ভেতরে গুমরে ম/রছে মেয়েটা। অথচ বাইরে সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক খোলসে আবৃত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে থাকা আকাশে হঠাৎ বিজলির মতো এক টুকরো আলো উঁকি দিয়েছে তনুজার জীবনে। এত যাতনা অবহেলার মাঝেও ওর মনটা চাইছে ইভানকে কিছু বলতে, জানাতে। হয়তো এই খুশির খবরটা শোনার পর ইভানের রাগ-ক্ষোভ কর্পূরের মতো উবে যাবে। তনুজা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। মাথাটা নুইয়ে নিচু স্বরে বলে,
-” ইভান আপনি বা…”
ইভানের কথায় তনুজার কথাটা অসম্পূর্ণ রয়। কথার মাঝেই ইভান বলল,
-” হ্যা বাইরে যাচ্ছি। কী বলবে ফাস্ট বলো? আর একটা কথা শুনে রাখো, এইযে রাত করে ফিরি এর মানে ড্রিংক করে আসি না। একবার কাউকে কথা দিলে সেই কথা ইভান রাখতে জানে। ইভান অন্যদের মতো প্র’তা’রণা করতে জানে না। কোনো কিছু গোপন করে না।”
তনুজার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। যে মন নিয়ে কথাটা বলতে আসছিলো, সে মনটা নিমিষেই বেদনায় নীল হয়ে আসে। ইদানিং রাত করে ফেরে দেখে সেদিন তনুজা আচমকা বলেছিলো, -” আপনি বোধহয় আবার ড্রিংক শুরু করেছেন। তাই রাত করে বাসায় ফেরেন।” সেদিন উত্তর না দিলেও, আজ পুরো কথা না শুনে উল্টো বুঝে এমন ধারালো অ”স্ত্রে”র ন্যায় উত্তর দেয়। যে উত্তরে তনুজার সত্তা র’ক্তা’ক্ত হয়। ইশশ্! এই ব্যাথা যে দেখানো যায় না। তনুজা টলমলে চোখে চেয়ে বলল,
-” ইভান! আপনি একবারো কেনো সিচুয়েশনটা বোঝার চেষ্টা করছেন না। আপনি অযথাই আমাকে মিসজাজ করছেন।”
ইভান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। কণ্ঠটা খাদে নামিয়ে বলল,
-” তোমার অতীত আছে সেখানে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। তোমার অতীতের সাথে দিব্য জড়িয়ে আছে। বিষয়টা চাইলেও আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি তোমার সাথে স্বাভাবিক থাকতে চাইছি বাট পারছি না। বারবার অ’নু’শোচনায় দ/গ্ধ হচ্ছি। ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধে ভুগছি। মনে হচ্ছে আমার জন্য দিব্য তোমাকে পেলো না। দিব্য কষ্ট পেলো। আর তুমি তো জোর করে মেনে নেওয়ার নিছক অভিনয় করে যাচ্ছো।”
তনুজা প্রতিবাদ স্বরূপ বলল,
-” ইভান আমি প্রথমে বিয়েটা মানতে না পারলেও, ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছি। আর চেষ্টা করেছি আপনাকে আপন করার। বিশ্বাস করুন আমায়। আমি আবারো বলছি, আমার মনে আপনি ছাড়া বর্তমানে কেউ নেই। ট্রাস্ট মি!”
-” আমি সবসময় অন্য মানুষের কাছ থেকে নয়, নিজের আপন মানুষদের থেকে কষ্ট পেয়েছি। জীবনে নিজের মানুষদের কাছ থেকে প্রতারণা পেয়ে, আমি বড্ড শান্ত হয়ে গিয়েছি। অনুভূতি শুণ্য হয়ে পড়েছি। সেদিন তৃষার মাধ্যমে কথাগুলো শুনে আমি খুব বেশিই আপসেট হয়ে পরি। এর থেকে বেটার হতো যদি তুমি নিজেই সাহস করে সত্যিটা বলতে। যাইহোক এখন এটা বলে লাভ নেই। তবে জেনে রাখো, আমি ইচ্ছে করে তোমায় কষ্ট দিচ্ছি না। সবকিছু আগের মতো করতে আমার একটু সময় দরকার। আশাকরি তুমি আমার অবস্থা বুঝবে। আপাতত আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।”
ইভান ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করতে থাকে। ওদিকে ছাদ থেকে নেমে রুমের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো দিব্য। ইভান-তনুজার শেষের কথাগুলো ও স্পষ্ট শুনতে পায়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ঘৃ/ণা ভরে গালিসহ একটা নাম উচ্চারণ করলো,
-” তৃষা___”
তনুজা ব্যালকনিতে আসে। গায়ের শালের আস্তিন মৃদু হাওয়ায় দুলছে। ওর চক্ষুতারা পানিতে টলমল করছে। ঘনপল্লব নোনতা জলে ভিজিয়ে অদূরে অন্ধকারে তাকায়। একটা হাত আপনাআপনি শাড়ির আঁচল গলিয়ে তুলতুলে পেটের উপর রাখে। ঠোঁট দুটো নেড়ে বলে,
-” দুঃখ আমার নিত্যদিনের সঙ্গী! সুখ সে তো আমার জন্য কারাগারে বন্দী। সুখের আশা করাও ভুল আমারই!”
_____________
রাতে ডায়নিংয়ে ডিনার করতে বসেছে মির্জা বাড়ির সদস্যরা। এরমধ্যে দিব্যর কথায় যেন খাওয়ার টেবিলে বো-মা বি’স্ফো’রণ ঘটে, এমন মুখাবয়ব করে সকলে এ ওর দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
#চলবে