প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-২৫+২৬

0
169

#প্রণয়ের_বাঁধন |২৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

মির্জা বাড়ির ডায়নিংয়ে উপস্থিত সবাই যেন নীরবশ্রোতা। এদিকে তামান্না হাত দু’টো নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনড়গল কথা বলে যাচ্ছে। হেনতেন বিয়ের প্ল্যান প্রোগ্রামিং নিয়ে কথা বলে বলে ওনার মুখটা একটুও বন্ধ হওয়ার ফুরসত পাচ্ছে না। নেওয়াজ সাহেব চুপচাপ। কিছু বললে স্ত্রীর কাছে এক পয়সার দাম পাওয়া যাবে না। তাই অহেতুক কথা না বলে নিশ্চুপ আছেন। শাহারিয়ার মির্জা বোনের সাথে সায় মিলিয়ে মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলছেন। তনুজা-ইভান আর নিতি ছাড়া ছোট-বড় সবাই উপস্থিত ছিলো। এমন সময় দিব্য এসে আড়চোখে চারিদিকে অবলোকন করে চেয়ার টেনে বসে। ফুপি আর বাবার কথা শ্রবণ করে সেকেন্ডেই ঠাহর করে আজ ডিনার কম বিয়ের শলা পরামর্শ চলছে। কাঁচের জগটা হাতে তুলে পানি ঢালতে ঢালতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দিব্য বলল,

-“ মাম্মা আমার কিছু বলার আছে।”

তামান্না ঢের বি’র’ক্ত হলেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা চলছে তার মধ্যে এই ছেলে বা হাত দিয়ে দিলো। শিরিন খাবার সার্ভ করতে করতেই ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। দিব্য নির্বিকার মুখাবয়ব করে কোনো ভণিতা ছাড়াই সোজাসুজি স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

-“ মাম্মা আমি নিতিকে বিয়ে করতে চাই।”

ছেলের এহেন নির্লিপ্ত কথায় শাহারিয়ার সাহেবের কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আচমকা গলায় খাবার আঁটকে বিষম খেয়ে কাঁশতে থাকলেন। নুরজাহান কেবল একটুকরো রুটি ছিঁ’ড়ে মুখে পুরে ছিলেন। চিবাতে ভুলে বসে; ঘাড় ঘুরিয়ে নাতির দিকে চাইলেন। তামান্নার মেজাজ লহমায় তুঙ্গে উঠল। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে অসহ্যকর চাহনিতে তাকায়। শিরিনের কান দুটো অবিশ্বাস্য ঠেকছে। চোখদুটো বিস্ময়ে কোটর ছাড়িয়ে যাওয়ার জো হয়েছে। খাবার মুখে তোলার জন্য নৃত্য কেবল হা করেছিলো; তাজ্জব বনে তার হা যেন তিনগুণ বাড়ে। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি সাবাড় করে নিজেকে স্বাভাবিক করেন শাহারিয়ার মির্জা। রাগান্বিত মুখবিবরে ছেলের দিকে চাইলেন। শাসিয়ে উঠলেন,

-“ দিব্য মাথা ঠিক আছে তোমার? কী বলতে চাইছো তুমি?”

দিব্যর ত্যাড়া জবাব,

-“ কেনো শুনতে পাওনি? কী বললাম শুনোনি?”

শাহারিয়ার মির্জা নড়েচড়ে বসলেন। আওয়াজ চড়িয়ে বললেন,

-“ দিব্য আমি মোটেই তোমার সাথে ফা’জ’লামি করছি না। এতদিন তো বে’য়া’দ’বি করতেই, আজ সকলের সামনে ফা’জ’লা’মি করছো। দিন দিন তোমার অধঃপতন দেখে আমি হতাশ না হয়ে পারছি না।”

-“ পাপা তোমার সাথে আমার ফা’জ’লা’মি করার সম্পর্ক নয়। আমি মোটেই ফা’জ’লা’মি করছি না। যা বলছি ভেবেচিন্তে আর সিরিয়াসলি।”

শাহারিয়ার মির্জা কড়া চোখে তাকিয়ে কিছু বলবেন সেই মূহূর্তে নুরজাহান বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলেন। নুরজাহান বেগম শান্ত কণ্ঠে শুধালেন,

-“ ছোট দাদুভাই তুমি জানো নিতির বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে? তা আজ হঠাৎ তোমার এমন বলার কারন কী?”

দিব্য ভ্যাবাচ্যাকা খায়। গা-ধী নিতির উপর মে’জা’জ চ’ড়লো। উত্তরে কী বলবে ভেবে দিশেহারা! কোনো রকমে কয়েকটা শব্দ গুছিয়ে জড়তা নিয়ে বলল,

-“ বিয়ের কথা শুনেই তো এখন বলতে বাধ্য হয়েছি।”

শাহারিয়ার মির্জা রা’গে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। আঙুল উঁচিয়ে উচ্চস্বরে বললেন,

-“ তোমার লজ্জা করছে না? এখানে বড়রা সবাই আছে তার মধ্যে এভাবে নি’র্ল’জ্জের মতো কথা বলতে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। এখন এসে তুমি তামাশার কথা বলছো।”

থেমে স্ত্রীর দিকে রা’গি দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,

-“ শিরিন তোমার ছেলেকে বোঝাও। তার না আর ক’দিন পরেই ফ্লাইট। এখন আবার কোন নাটক করতে, সিনক্রিয়েট করতে, এরকম ভং ধরে কথাবার্তা বলছে।”

এরমধ্যে নেওয়াজ সাহেব মুখের থেকে তালা খুললেন। অমায়িক কণ্ঠে বললেন,

-“ ভাইজান আপনি শান্ত হয়ে বসুন। মাথা ঠান্ডা রেখে আগে দিব্যর পুরো কথা শুনুন। ছেলেটা কী বলতে চাইছে আগে শুনি। তারপর ভালো করে জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।”

তামান্না খেকিয়ে উঠলেন,

-“ আর কী শুনবে, হ্যাঁ? শুনতে পাওনি ও কী বলল? ভালো করে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কী আছে? আর কীসের সিদ্ধান্ত নিবে? কী বলতে চাইছো তুমি?”

স্ত্রীর একাধিক প্রশ্নবাণে মুখটা ম্লান হলেও নেওয়াজ সাহেব চুপ রইলেন না। ওনার মনে খটকা লাগলো। দুপুরে পাত্রপক্ষের সামনে মেয়েকে কেমন বিষন্ন মলিন লাগছিলো। আর দিব্য যেহেতু এরকম বলছে। কোনো কানেকশন তো নিশ্চয় আছে। চশমাটা ঠেলে ঠিক করে তীক্ষ্ণ চোখে দিব্যর দিকে চাইলেন নেওয়াজ সাহেব। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

-“ দিব্য বাবা তুমি নিতিকে পছন্দ করো? দ্যাখো বাবা তোমার আরো আগে বলা উচিত ছিলো। একে তো বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। আর সর্বোপরি নিতিরও নিজস্ব মতামতের ব্যাপার আছে।”

দিব্যর অসহ্য ঠেকছে। নিতিকে সবার সামনে ছোট করবে না বলে সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছে। এখন যে এভাবে নিজেকে সবার চক্ষুশূ’ল হতে হবে তা কস্মিনকালেও ভাবেনি। চোখদুটো বুজে এক নিঃশ্বাসে অধৈর্য স্বরে বলে উঠল দিব্য,

-“ আমরা একে অপরকে পছন্দ করি।”

শিরিন অবিশ্বাস্য চোখে চাইলেন। তামান্না রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

-“ ভাইজান এখনো চুপ করে আছো যে। কিছু বলো। তোমার ছেলেকে বুঝাও। আর এক সপ্তাহ পরেই মেয়ের বিয়ে। এখন এসব বলে-কয়ে বিয়েটা যেনো ভেঙে না দেয়।”

শাহারিয়ার মির্জা হম্বিতম্বি শুরু করলেন। নুরজাহান ছেলেকে শান্ত হতে বললেন। নেওয়াজ সাহেব নৃত্যকে আদেশ স্বরুপ বললেন,

-“ নৃত্য এক্ষুনি গিয়ে আপুকে ডেকে আনো। যাও!”

নৃত্য মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ত্রস্ত পায়ে যায়। তামান্না ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-“ নিতিকে ডাকার কী দরকার?”

উত্তর দিলেন না নেওয়াজ সাহেব।

.

নিতি মাথাটা নুইয়ে ওড়নার আস্তিন মুঠো করে ধরে আছে। নিতির বাবা শিরিন সুলতানাকে ইশারায় কিছু বোঝালেন। শিরিন বুঝে নেন। পরপর নিতির পাশে গিয়ে, মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে শুধালেন,

-“ নিতি মামণি! ভ’য় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আর লজ্জা না পেয়ে সত্যি করে বলো; তুমি দিব্যকে পছন্দ করো?”

নিতি দৃষ্টি জমিনে নিবন্ধ করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। কেনো জানি ভ’য় হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছে। গলাটা একটু কাঁপলো বোধহয়। জবাবে মাথা উপর-নিচ করে বলল,

-“ হ-হ্যা।”

মাথা নুইয়ে থাকলেও মায়ের অ/গ্নিচক্ষু তার দিকে তাক করানো ঠিক আঁচ করতে পারে নিতি। নেওয়াজ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“ নিতি মা আমার। তোমার আরো আগে এটা বলা উচিত ছিলো। আমি এক জায়গায় কথা দিয়েছি। তবে যাইহোক আমি এমন বাবা না যে নিজের ইগো, কথা রাখতে; মেয়ের চাওয়া-পাওয়া, মেয়ের খুশির জলাঞ্জলি দিবো।”

নিতির প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। মেয়েদের মন বড় আ’জ’ব বোধহয়! হঠাৎ ওর মনে হচ্ছে নিজের খুশির জন্য, নিজের ভালোবাসার জন্য বাবাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলল। নিজেকে স্বা’র্থপর মনে হচ্ছে ওর। নেওয়াজ সাহেব শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে নম্র ভদ্র চিত্তে বললেন,

-“ আম্মা আপনি যেহেতু মুরব্বি। আর এই বাড়ির প্রধান হর্তাকর্তা আপনিই। ভাইজানও আছেন। আমি আমার মতামত জানাতে চাই। আমি বরাবরই আমার মেয়েদেরকে সব বিষয়ে প্রায়োরিটি দিয়ে আসি। আর আমার মনেহয় আমার মেয়েরা উ’চ্ছৃ’ঙ্খল নয়। ওদের মধ্যে যথেষ্ট আদব-কায়দা, লেহাজ আছে।”

থেমে,

-“ একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করা খা’রা:প নয়। সারাটা জীবন যার সাথে কাটাবে নিজের পছন্দ মত হওয়াই ভালো। আমি মেয়ের জন্য একটা জামা কিনতে গিয়েও দু’বার শুনে নেই এটা তোমার পছন্দ হয়েছে তো। আর এতো বিয়ের ব্যাপার। সারাজীবনের ব্যাপার। আমার ভুল হয়েছিলো এ ব্যাপারে আমি সরাসরি মেয়ের সাথে কথা বলিনি। আমি ওর মা’কে দিয়েছিলাম মেয়ের মতামত জানার দায়িত্ব। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। যাজ্ঞে এসব বলে এখন লাভ নেই। আপনাদের যদি দ্বিমত না থাকে তাহলে, আমি ওদের জানাশোনাকে প্রায়োরিটি দিতে চাই। আর আমার বন্ধুকে ফোন করে মাফ চেয়ে নিবো। ব্যাপার না, একটু সম্মান ক্ষুন্ন হলেও যদি আমার মেয়ের মুখে হাসি ফুটে; তাহলে আমি তাই করবো।”

শাহারিয়ার মির্জা নিরুত্তর। দ্বিমত-দ্বিধা নেই। তবে তামান্নার মুখ দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে সে অসন্তুষ্ট। তামান্না প্রতিবাদ করে উঠলেন,

-“ মাথা খা’রা’প হয়েছে তোমার? এক জায়গায় কথা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ওদের সাথে সাথে তুমিও বাচ্চামি কথাবার্তা বলছো।”

-“ তামান্না এখনো ঘটা করে কাউকে বিয়ের কথা বলা হয়নি।”

নেওয়াজ সাহেব মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন,

-“ নিতি-নৃত্য তোমরা রুমে যাও।”

নিতির তীব্র অনুশোচনা হতে লাগলো। এখন মাম্মা রু’ড আচরণ করবে। পরিবেশ উত্তপ্ত করবে। ফুপির কথাবার্তা শুনে দিব্যর মেজাজ চ’ড়ে যায়। বে’য়া’দবি করে ফেলার তুমুল সম্ভাবনা; তাই আর দেরি না করে গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে দিব্য। পরপর নিতি-নৃত্য রুমের দিকে পা বাড়ায়। তামান্না চেঁচামেচি শুরু করলেন,

-“ নিতি ছোট এটা ওর আবেগের বয়স। ওর সাথে সাথে আমরা অবুঝ হতে পারি না। এই সিদ্ধান্ত আমি মানি না। মেয়েকে আমি ওখানেই বিয়ে দিতে চাই।”

নুরজাহান বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,

-“ আহ্! তামান্না। বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। চুপ কর এবার।”

শাহারিয়ার মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরে চলে গেলেন। শিরিনও পিছুপিছু গেলেন। ননদের উপর রাগও হলো বটে। নিজের ছেলের সাথে বিয়ে না দিতে চাওয়ার এই কথাবার্তা শুনে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে মন চাইলেও; কিছু ভেবে কথাগুলো কণ্ঠনালী অবধি আসতেই গিলে নেন। ভাই-ভাবী যাওয়ার পর তামান্না স্বামীর উপর বেশি তেতে উঠলেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

-“ আমি কিচ্ছুতেই নিতিকে দিব্যর সাথে বিয়ে দিবো না। দরকার পড়লে আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাবো। তাও মেয়েকে এখানে বিয়ে দিবো না। নিজের ভাইয়ের ছেলে হলেও, আমার আদরের মেয়েকে একটা ব’দমে’জা’জি, রা’গি, জেদি ছেলের সাথে দিতে পারবো না। এছাড়াও__”

নুরজাহান ধ’ম’ক দিয়ে উঠলেন,

-“ তামান্না রুমে যা। এখনো সময় আছে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দ্যাখ।”

_________

দিব‌্য লাগাতার কল লিস্টে উপরে থাকা নম্বরে কল দিয়ে যাচ্ছে। সেই অনেকক্ষণ আগে থেকেই কল দিচ্ছে, কিন্তু রিং হয়ে হয়ে কে’টে যাচ্ছে। দিব্য দাঁতে দাঁত চেপে শেষ বারের মত কল দেয়। এবার রিসিভ না হলে সোজা বাইক নিয়ে চলে যাবে। গিয়ে ফোন রিসিভ না করার শা’স্তি স্বরুপ পৌষ মাসের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে এক ঘন্টা ডুবায় চুবিয়ে রাখবে। ওপাশের ব্যক্তির ভাগ্য সহায় হলো। তাই তো কনকনে শীতে ডুবায় থাকার পানিশমেন্ট পেতে হলো না। ফোন তুলল। দিব্য দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

-“ ফোন তুলছিস না কেনো? সেই তখন থেকে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছি।”

ওপাশ থেকে ভিতুসন্ত্রস্ত স্বর আসলো,

-“ হ-হঠাৎ তোর কল দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তুই হঠাৎ! না মানে।”

-“ শোন, আমি যা যা বলব মন দিয়ে শুনবি। আর ঠিকঠাক পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সেটাই করবি।”

ওপাশ থেকে কাঁপাকাঁপা স্বর আসে,

-“ ক-কী করতে হবে?”

-“____________। ক্লিয়ার?”

-“ অসম্ভব। এখনই তো আমার নার্ভাস লাগছে। ভ’য় হচ্ছে। লাগানো তিনটে দাঁত ওর থা/প্প/ড়ে খুলে না যায়। সব শুনে তোর মতো ও যদি আবার..”

-“ ও আমার মতো নয়। আমার থেকে ওর ধৈর্য্য বেশি। ও সহজেই স্টিম পয়েন্টে যায় না। আর যদি রাগের বশে দু চারটে চ-ড়, ঘু-ষি দেয়ও এটা তোর কৃতকর্মের ফল। আমি যেভাবে যেভাবে যা যা বললাম তাই তাইই বলবি। তা না হলে এবার তোকে আর তৃষাকে একসাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো। এই শ্বশুর বাড়িতে কিন্তু __থেরাপি হয়। বুঝতে পারছিস এবার?”

ওপাশ থেকে সুড়সুড় করে সোজা উত্তর আসলো,

-“ আচ্ছা। আচ্ছা ভাই, ঠিক আছে। যেমনটা বলেছিস, ঠিক তেমনই বলবো।”

কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টুটটুট করে কল কে’টে দেয় দিব‌্য। তারপর আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,

-“ তৃষা…সেদিন ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েছিলো। এবার দ্বিগুন মাশুল গুনতে রেডি থেকো। একেবারে বকেয়ার সাথে বোনাসসহ পাবে।”

__________

রাত গভীর। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ গুমোট। ইভান সবেমাত্র ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে। তনুজা ঘুমে বিভোর। তনুজার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রীতে নিষ্পলক চাউনিতে চেয়ে চেয়ে দেখে ইভান। মুখের উপর থাকা অবাধ্য বেবি হেয়ার আলতো হাতে সরিয়ে দেয় ইভান। হঠাৎ ইভানের দৃষ্টি তনুজার হাতে পড়তেই বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। তনুজার হাতের পো-ড়া দেখে কষ্ট অনুভব হয়। ইভান তড়িৎ গতিতে ফাস্ট এইড বক্স থেকে কাংখিত অয়েন্টমেন্ট হাতে নেয়। যত্ন সহকারে আলগোছে তনুজার হাতে লাগিয়ে দেয়। ইভানের অবচেতন মন ভাবে,

-“ না চাইতেও তোমাকে বোধহয় খুব বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছি। সরি!”

ইভানের স্পর্শে ঘুমের মধ্যে তনুজা নড়েচড়ে। ঘুমের ঘোরেও চোখের ঘনপল্লব নড়ল, সাথে একটু আলগা হয়। পরপর চোখদুটো বুঁজে যায়। মনে হচ্ছে আবেশে, স্পর্শে ঘুমটা আরো গভীর হলো। তনুজার কোমড়ে থাকা কমফোর্টার গলা অবধি টেনে দেয় ইভান। সুন্দর করে কমফোর্টার জড়িয়ে দিয়ে তনুজার মুখের দিকে ঝুঁকে অস্ফুটে আওড়ায়,

-“ এক নীরব কষ্ট অনুশোচনা আমার ভেতরটা জ্বা’লি’য়ে-পু’ড়িয়ে দিচ্ছে! অথচ আমি কারো কাছে কষ্টটা প্রকাশ করতে পারছি না। আ’ম সো সরি তনুজা। নিজের মনকে বোঝাতে আমার একটু সময় প্রয়োজন।”

___________

সকালে বাড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেলা হতে চললো, তবুও সবাই রুমেই। বুয়ার থেকে কাল রাতের ঘটনা সবটা শুনেছে। কাল সারাদিন শরীরের উপর বেশ প্রেশার পড়ায় খুব ক্লান্ত ছিলো। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো ডিনার না করেই।

তনুজার আজ সকাল সকাল বাড়ি যাওয়ার কথা। কালকেই দিদুন পারমিশন দিয়েছিলো। তনুজা রেডি হয়ে রুম থেকে বেরুনোর সময় ব্যালকনির দোরগোড়ায় দাঁড়ায়। ইভান দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে উদাসীন হয়ে দাঁড়িয়ে। তনুজার কথায় সম্বিত ফিরে ঘুরে তাকায়।

-“ আসছি।”

তনুজা সৌজন্যমূলক বলে। ইভান গম্ভীর স্বরে বলল,

-“ বেড টেবিলের উপর দ্যাখো অয়েন্টমেন্ট আর মেডিসিন রাখা আছে। অয়েন্টমেন্টটা দিনে দু থেকে তিনবার হাতে ইউস করবে। আর মেডিসিন…খাবে।”

তনুজা হতবাক হয়। কখন দেখলো? তনুজার ভাবনার চরকায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ইভান ফের বলল,

-“ একটু কেয়ারফুলি চলো। টেইক কেয়ার।”

তনুজার চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। চোখের জল আড়াল করতে, নিজের কষ্ট লুকাতে তড়িৎ উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়ায়। মিহি স্বরে বলল,

-“ আসছি, ভালো থাকবেন।”

দিদুনকে বলে তনুজা গাড়ির কাছে যেতেই ড্রাইভার দরজা খুলে দেয়। গাড়িতে পা দেওয়ার আগে তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা তুলে দোতলার ব্যালকনিতে চায়। তনুজাকে মাথা ঘুরাতে দেখে ইভান উল্টোদিক পিঠ করে ঘুরে দাঁড়ায়। তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অবচেতন মন বলে,

-“ সয্য করতে করতে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছি। তারপরও মনকে বোঝাই, আজ নয়তো কাল সবটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমি বোধহয় ভুল। এখন আমি বুঝতে পারছি। আমি আপনার কাছে অতটাও গুরুত্বপূর্ণ নই। যতটা আমি ভেবেছিলাম।”

______________

অফিসে বসে ফাইলে নজর বুলাতে বুলাতে হাতঘড়িতে সময় দেখে ইভান। পরপর ফোন হাতে নিয়ে কল করে। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে বড় করে সালাম আসলো,

-“ আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”

ইভান উত্তর দিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

-“ ম্যাডামকে ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন?”

বয়স্ক ড্রাইভার অপ্রস্তুত হয়। আমতা আমতা করে বলল,

-“ জ-জি স্যার। ম্যাডাম এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।”

ইভানের কপালে ভাঁজ পড়ল। পরপর গলার স্বর চড়িয়ে বলল,

-“ হোয়াট রা’বিশ! পৌঁছে গিয়েছে মানে? আপনি তনুজাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসেননি?”

-“ জ্বি-না, জ্বি জ্বি স্যার! ম্যাডাম সহিসালামতে বাসায় গিয়েছেন।”

ইভান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। খট করে কল কে’টে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে কাজে মন বসছে না আজ। মনটা আনচান করছে।

#চলবে

#প্রণয়ের_বাঁধন |২৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ঘড়ির কাঁ’টা বেলা এগারোটার ঘর ছুঁইছুঁই। শীতের তেজহীন সূর্যটা কুয়াশার চাদর ভেদ করে সবেমাত্র আলো ছড়াচ্ছে। সাদা টিশার্টের উপর থাকা চেইন খোলা কালো ডেনিম জ্যাকেটটা একহাতে সরিয়ে গায়ে পারফিউম পুশ করে দিব্য। অতঃপর সাদা কেডস জোড়া পায়ে গলিয়ে উবু হয়ে ফিতা বাঁধতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ উচ্চস্বরে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসলো। যেখানে তামান্নার গলার স্বর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। টেবিলের উপর থেকে বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরোয় দিব্য।

লিভিংরুমে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে নিতি। দু’চোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার। তামান্না মেয়েকে শাসিয়ে যাচ্ছেন। খানিকক্ষণ আগেই নেওয়াজ সাহেব বেড়িয়েছেন। সরাসরি সামনাসামনি মাফ চেয়ে তাদেরকে আর আগাতে বারণ করতে। তারপর থেকেই তামান্না যেন ক্ষে’পে’ছে। সমস্ত রাগ মেয়ের উপর ঝারছে। পারছে না তো মেয়েকে শূ/লে চড়াতে, এমন এটিটিউড শো করছে। নুরজাহান বেগম এসে মেয়ের দিকে অসন্তোষ বদনে চেয়ে বললেন,

-” এসব কী হচ্ছে বাড়িতে? এটা বাড়ি নাকি ব’স্তি? সক্কাল সক্কাল গলা ফা’টি’য়ে চিৎকার করছিস। বলতো আমায়; তোর সমস্যা কোথায় শুনি?”

শিরিন একবার তামান্নার দিকে তো আবার নিতির দিকে চাইলেন। পরপর নিতির কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে আগলে নেন। তামান্নার দিকে বি’র’ক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

-” তামান্না তোমার মনে হচ্ছে না তুমি বাড়াবাড়ি করছো? বাড়ির সকলে যখন দ্বিমত করছে না। তখন তোমার এতো সমস্যা কীসের? স্বয়ং নেওয়াজ ভাই যেখানে রাজি এরপরেও তুমি এরকম বিহেভিয়ার কেনো করছো?”

ওদিকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে আর শুনছে দিব্য। তামান্না রাগে গজগজ করতে করতে এগিয়ে আসলেন। আচমকা নিতির একটা হাত ধরে টান দিয়ে শিরিনের থেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলেন। তিরিক্ষি গলায় বললেন,

-” আমার মেয়ে! আমার মেয়ের ব্যাপারে যেকোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিশ্চয় আমার আছে। আমি মা! আমার মেয়ের কীসে ভালো হবে সেটা আমার থেকে বেশি কেউ বুঝবে না! মায়ের থেকে মাসির দরদ নিশ্চয় বেশি হয় না। সবার তো উপরে উপরে আলগা দরদ উথলে পড়বে। ব”কলে, মা”রলে কা”টলেও আমার থেকে বেশি কেউ মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত উদ্বিগ্ন হবে না।”

দিব্যর কপালের শিরা উপশিরা ফুলে উঠল। ফুপির আচরণ প্রত্যেকটা কথাবার্তা রং মনে হলো। তারপর অতিমাত্রায় মেজাজ খা’রা’প করে দেয়, মায়ের থেকে এভাবে নিতিকে টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে উঁচু স্বরে কথা বলায়। দিব্যর মেজাজ এতটাই চ’ড়লো; সামনে যা আছে তাই ভে’ঙে চু’রমা’র করতে ইচ্ছে করছে। ফুপির আচরণের তীব্র প্রতিবাদ স্বরূপ মনেমনে ছক কষে নেয় দিব্য। গটগট পা ফেলে এগোয়। পরপর নিতির হাত ধরে। আচমকা দিব্যর এভাবে হাত ধরায় নিতি ভড়কায়, থমকায়। উপস্থিত বাকিরাও অবাক হয়ে চায়। দিব্য রাগটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে কোন রকমে বলল,

-” নিতি চল আমার সাথে।”

নিতি আরেক দফা থমকায়। হতভম্ব হয়ে তাজ্জব বনে বলল

-” চল মানে? কোথায় যাবো?”

দিব্য প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-” যা বলছি তাই কর। গেলেই দেখতে পাবি।”

শিরিন ধ’ম’কের সুরে বললেন,

-” দিব্য! হচ্ছে টা কী?”

দিব্য জবাব দেয় না। নিতিকে ধ’ম’ক দিয়ে উঁচু স্বরে বলল,

-” ন্যাকা কান্না থামা। যা বলছি তাই কর। ফাস্ট চল।”

কথাটা শেষ করেই নিতির হাত ধরে এক প্রকার জোর করে নিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে দিব্য। দিব্যর রাগি অ”গ্নিমূর্তি রুপ দেখে তামান্না ভড়কায়। দিব্যর সামনে কিছু বলতে গলা কাঁপল, সাহসে কুলায় না। তবে এভাবে নিতিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখে ভাবীর উপর সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে থামল। নুরজাহান প্রলাপ শুরু করেছেন,

-” বাড়িতে কী হচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। একের পর এক অশান্তি লেগেই রয়েছে।_____”

তামান্না শিরিনকে দোষারোপ করে বলতে থাকল,

-” ভাবী তোমার সামনে তোমার ছেলে বে’য়া’দবি আচরণ করলো তুমি কিছুই বললে না। আবার মেয়েটাকে এভাবে কোথায় নিয়ে গেলো! তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্বিকার দেখলে; টু শব্দটি অবধি করলে না। এখন আমার মেয়ের ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলে এর দায়ভার তোমাদের নিতে হবে।”

এই বলে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। শাড়ির আঁচল মুখে টেনে বিলাপ করে কান্না শুরু করলেন। নৃত্যকে ডেকে বলল,

-” নৃত্য তোর পাপাকে কল কর। সবটা বল। আজকেই এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।”

শিরিনের প্রচন্ড রাগ হলো। রাগ ক্ষোভ নিয়েই বললেন,

-” তোমার মেয়ে ছোটো নয়। মেয়ে যখন একজনকে পছন্দ করে বসে আছে সেখানে আরেক জায়গায় বিয়ের কথা ভাবো কী করে তুমি? আর আমার জানামতে আমার ছেলে নয়, তোমার মেয়েই __।”

কিছু ভেবে অসম্পূর্ণ বাক্যকে দাঁড়ি টানে শিরিন। কথাটা শেষ করে না।

.

ওদিকে বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নিতি হাতজোড় করে রিকোয়েস্ট করে যাচ্ছে,

-” প্লিজ, দোহাই আল্লাহর মাথা ঠান্ডা করো। তুমি এভাবে আমাকে নিয়ে এলে মাম্মা সারা বাড়ি মাথায় করবে। আরো বেশি ক্ষু’ব্ধ হবে। তাই বলছি..”

দিব্য আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ধ’ম’ক দিয়ে বাইকে চড়তে বলে। নিতি ভ’য়ে ঢোক গিলে নেয়। দিব্যর চ’ড়া মেজাজ দেখে সাহস হয় না। ভ’য়ে জড়সড় হয়ে বাইকে বসে। দিব্য ফোন বের করে কল দেয়। রিসিভ করতেই গমগমে স্বরে আদেশ স্বরুপ বলল,

-” ****প্লাজা সংলগ্ন কাজী অফিসে জলদি আয়।”
ওপাশ থেকে অবাক হয়ে প্রশ্ন আসলো,

-” কাজী অফিস আসবো! কিন্তু কেনো?”

-” কাজী অফিসে মানুষ কীজন্য যায়?”

ওপাশ থেকে সরল উত্তর আসে,

-” বিয়ে করার জন্য। কিন্তু বিয়েটা কার?”

দিব্য স্পষ্ট জবাব দেয় না। তাড়া দিয়ে বলল,

-” শোন তুই জলদি আস, সাথে আরো দুইতিনজনকে জোগাড় করে আন সাক্ষীর জন্য। আমি রাখছি।”

কল কা’ট’তে গিয়ে কিছু ভেবে দিব্য তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

-” এই শোন শোন আমি দুইটা নম্বর মেসেজ করে পাঠাচ্ছি। এক্ষুনি কল দিয়ে কাজী অফিসের অ্যাড্রেস দিয়ে বলবি, দিব্য যেতে বলেছে। বুঝতে পেরেছিস? ক্লিয়ার?”

-” আমি কাকে ফোন করে বলব? আর আমিই কেনো? তুই বল।”

মাথায় হেলমেট পড়তে পড়তে বলল,

-” মেজাজ খা’রা’প আছে, ওপাশ থেকে নেগেটিভ কিছু শুনলে না জানি কী বলে ফেলব। তাই তোকে বলছি। এত কথা বাদ দে। আর যা বলছি তাই কর। কুইক।”

দিব্যর এহেন ফোনালাপ শুনে নিতির মাথায় যেন গোটা আকাশ ভে’ঙে পড়ল। নিতির বুকটা আচমকা ধড়ফড়িয়ে উঠল। হুট করে এভাবে বিয়ে হলে বাড়ির সবাই অসন্তুষ্ট হবে। ঝা’মে’লা বাড়বে বৈ কমবে না। দিব্য বাইক স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে অলরেডি। নিতি কাকুতি মিনতি করে দিব্যকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মনেহয় না দিব্যর কানে অনুনয়, অনুরোধ ঢুকছে।

.

পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নিচের তলায় “কাজী অফিস” লিখে বড়সড় করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা কক্ষের দরজা শব্দ করে ধা’ক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দিব্য। কাঠের চেয়ারের হেডে একটা রঙিন তোয়ালে দিয়ে রাখা। বয়স্ক কাজী সাহেব চেয়ারের হাতলে হাত দু’টো রেখে আয়েশ করে চেয়ারে গা এলিয়ে পান চিবুচ্ছিলেন। হঠাৎ দরজার শব্দে দৃষ্টি সজাগ করে চাইলেন। পরপর একটা ছেলে আর পিছুনে আরেকটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে নড়েচড়ে বসলেন। নক না করে এভাবে ঢুকায় কাজী সাহেবের বদনখানি বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। এরমধ্যে নিতি কান্না ভেজা গলায় দিব্যকে উদ্দেশ্য করে অনুরোধ স্বরুপ বলল,

-” প্লিজ, রাগটা কমাও। ঠান্ডা মাথায় একটু ভাবো। এভাবে হলে বিষয়টা খুব বি/শ্রী হবে। বিয়ে সব মেয়ের জীবনেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে সবাই চায় তার পরিবার তার পাশে থাকুক। সবার সম্মতিতে, সবার দোয়া নিয়ে নতুন জীবনে পদার্পণ করতে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। জীবনের বিয়ে নামক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি আমার পাপাকে ছাড়া, পাপার দোয়া ছাড়া কিচ্ছুতেই এগোতে পারব না। এভাবে বিয়ে করলে আমার পাপাকে হার্ট করা হবে। আমার পাপা ভীষণ কোমল হৃদয় সম্পন্ন। আমি জানি পাপা ঠিক রাজি হবে। আর মাম্মাকে বাড়ির সকলে বোঝালে সেও বুঝবে। তাই এভাবে বিয়ে না করে সবার সম্মতিক্রমে হোক আমি সেটাই চাই।”

দিব্য দুইহাত জিন্সের পকেটে গলিয়ে কাজী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” কাজী সাহেব আপনাকে এখন একটা বিয়ে পড়াতে হবে। জলদি ফটাফট সব ঠিক করে নিন। হাতে সময় কম।”

কাজী নিতির দিকে একবার তো দিব্যর দিকে একবার তাকালেন। চোখদুটো ডলে নিয়ে ভালো করে পরখ করলেন। নিতিকে ইশারায় দেখিয়ে প্রশ্ন করে উঠলেন,

-” মেয়েটা কান্না করছে তো। কান্না করে কেনো? বিয়েতে নিশ্চয় রাজি না। জো’র করে তুলে আনছো কী?”

কাজীর একাধিক প্রশ্নে দিব্যর রাগের পারদ উঁচুতে ওঠে। স্পষ্ট রা’গি দৃষ্টিতে তাকাল। কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বলল,

-” আপনার যেটা কাজ সেটাই করুন। এত জেরা করতে হবে না। প্রশ্ন বাদ দিন; যা বললাম তাই করুন।”

দিব্যর রাগি চোখদুটো তারপর বজ্রকণ্ঠ শুনে কাজী সাহেবের অন্তরাত্মা ভ’য়ে কেঁপে উঠল। কাজী সাহেব ভীতু সন্ত্রস্ত মুখবায়ব করলেন। নিম্নস্বরে বললেন,

-” বিয়ে পড়াবো তা সাক্ষী কই? সাক্ষী লাগবো না?”

-” আপনি কাগজ পত্র সব ঠিকঠাক করতে থাকেন। সাক্ষী পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে।”

কাজী সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সম্মানীয় একটা পেশায় থেকেও এমন নজির আছে, গলায় ছু/রি ধরে জোর করে বিয়ের কার্যক্রম করতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে মা/স্তান গোছের চ্যাংরা-পোলাপাইন এসে হুমকি-ধামকি দেয়। জীবন বাঁচানোর জন্য অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ে পড়াতে হয়। এইযে পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখের পানি দেখে বয়স্ক কাজীর মনটা কিচ্ছুতেই সায় দিচ্ছে না। ছেলেটি নির্ঘাত মেয়েটিকে জো’র করে তুলে এনেছে। মেয়েটিকে দেখে কাজীর বড্ড মায়া হলো। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে এক বুক সাহস সঞ্চয় করে নিলেন। সামনে থাকা বে’প’রোয়া রাগি ছেলেটির পানে চাইলেন। আমতা আমতা করে কম্পিত গলায় বললেন,

-” বা-বাবা বাচ্চা মেয়েটা কান্না করছে তো। এটা কী ঠিক হচ্ছে?”

নিতিকে নিয়ে কাজীর এত আদিখ্যেতা দেখে দিব্যর রাগ হচ্ছে। দিব্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-” একে দেখে কোন এঙ্গেলে আপনার বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে? এর বয়সী অধিকাংশ মেয়ে বিয়ে-থা করে ঘর-সংসার করছে। ইভেন এর ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ কেউ তো বিয়ে করে বছরে বছরে বাচ্চা জন্ম দিয়ে হেট্রিক করে ফেলেছে।”

থেমে… ভ্রু বাঁকিয়ে নিতিকে ইশারা করে বলল,

-” এটা আমার কথা নয়। একেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।”

হঠাৎ নিতির কান্না থেমে যায়। কিছুদিন আগের কথা মনে উঠলো। সেদিনের বলা কথা আজ এভাবে রিটার্ন পেতে হবে তা কস্মিনকালেও ভাবেনি নিতি। এরমধ্যে কয়েক জোড়া জু’তো’র কচমচ শব্দ আসলো। পরপর ইয়াং চার-পাচটা চেলে কক্ষের ভেতর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরে। দিব্যর সাথে একটা মেয়েকে দেখে ছেলেগুলো দিনদুপুরে ভূ-ত দেখার মতো চমকায়। একটা ছেলে যাকে ফোন করে আসতে বলেছিলো। দিব্যর ফ্রেন্ড রিফাত পরপর নিতি আর দিব্যর দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়। তারপর দিব্যকে উদ্দেশ্য করে গমগমে স্বরে বলল,

-” আরে শা/লা সত্যি বিয়ে করতে এসেছিস। আমি তো ভেবেছিলাম ঢপ মা’রছিস। তা দোস্ত হঠাৎ এভাবে?”

দিব্য প্রত্যুত্তর না দিয়ে প্রশ্ন ছুঁ’ড়’ল,

-” তোকে যা বলেছি, তা করেছিস তো। ফোন দিয়ে বলেছিস?”

রিফাত মুখটা কাঁচুমাচু করল। ফিসফিসিয়ে বলল,

-” দুইটা নম্বর দিয়েছিলি। একজন ভদ্রলোক ভালো ভাবেই অমায়িক কথা বললো। চলে আসবে এক্ষুনি হয়তো। আর তোর বাবা তো ঢপ বলের মতো একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ল। সাথে ফোনের ওপার থেকেই রাম ধ’ম’ক দিয়েছে। সামনে পেলে নির্ঘাত শুট করে বসবে।”

কাজী সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজপত্র রেডি করতে থাকেন। এরমধ্যে একসাথে শাহারিয়ার মির্জা আর নেওয়াজ সাহেব ঢুকলেন। নেওয়াজ সাহেব ফোনে মির্জা সাহেবের সাথে কথা বলে একসাথে আসেন। শাহারিয়ার মির্জা পা ফেলেই উঁচু স্বরে বললেন,

-” দিব্য এসব কী শুরু করেছো তুমি?”

নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে বাবা আর মামাকে দেখতে পায়। দৌড়ে বাবার কাছে যায়। আচমকা বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। নেওয়াজ সাহেব মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন। ভরসার বাণী আওড়ালেন,

-” নিতি মা আমার কান্না করে না। এই তো পাপা চলে আসছে। মন খা’রা’প করে না সোনা মা। নৃত্য ফোনে সবটা বলেছে আমায়। আমি সব শুনেছি। পাপা তোমাকে সাপোর্ট করবে এন্ড পাশে থাকবে। ভ’য় পেয়ো না।”

শাহারিয়ার মির্জা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে শাসিয়ে বলতে শুরু করলেন,

-” দিব্য আমাকে রাগিয়ে দিও না। এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি চলো ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তোমার ফুপিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মিটমাট করা যাবে।”

নেওয়াজ সাহেব এগিয়ে আসলেন। নম্র স্বরে বললেন,

-” ভাইজান আমি রাতেই বলেছি আমার দ্বিমত নেই। দিব্য যা করছে আমার তাতে সম্পূর্ণ মত আছে। আপনি রাজি থাকলে আমরা কাজটা সহিসালামতে সম্পন্ন করতে পারি।”

শাহারিয়ার মির্জার মেজাজ কিছুটা মিইয়ে আসলো। কিছু ভেবে খানিকক্ষণ ধম ধরে থাকলেন। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বললেন,

-” তামান্না যেহেতু চা__”

কথার মাঝেই পুরো কথা পরে নেন নেওয়াজ সাহেব। থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-” তামান্না বেশি বাড়াবাড়ি করছে। ও আজীবনই একরোখা। যাজ্ঞে ওকে আমি বুঝিয়ে বলব। আর আমার মনেহয় একবার বিয়ে হয়ে গেলে ও মেনে নিবে।”

শাহারিয়ার মির্জা আর দ্বিমত করলেন না। ভাবলেন ছেলে-মেয়ে যেহেতু পছন্দ করে; তাই বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাই বেটার। হারাম রিলেশনে থাকার চেয়ে হালাল পবিত্র বন্ধনে বেঁধে দেওয়া গার্ডিয়ানের বড় দায়িত্ব। ছেলে-মেয়ের বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে বিয়ে দেওয়া গার্ডিয়ানের সবচেয়ে বড় কাজ।

প্রথমে দিব্য সাইন করে। কলমটা হাতে নিয়ে সাইন করতে নিতির হাতটা কাঁপছিলো। কাঁপাকাঁপা হাতে নামটা লিখে নিতি। তারপর ধর্মীয় ভাবে দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ সম্পাদন করা হয়। দিব্যর এক ফ্রেন্ড ফা’জ’লামি করে বলে মোহরানা নগদ লিখতে হবে। দিব্যর কাছে যা আছে তাই দিয়ে। দিব্য ভ্যাবাচ্যাকা খায়। জ্যাকেটের পকেট, জিন্সের পকেট হাতড়িয়ে তিন হাজার দুইশো দশ টাকা পায়। বন্ধুরা বলল,’ তাহলে দিব্য এটাই হোক তোর মোহরানা।”

শাহারিয়ার মির্জা চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন,

-” এই না না। আমার ছেলের মোহরানা মাত্র_। কাজী সাহেব আপনি দশ লক্ষ লিখুন। নগদ লিখুন। আমার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আমার ছেলে। আমার সবকিছু তো ওরই।”

নেওয়াজ সাহেব মৃদু হাসলেন। বললেন,

-” ভাইজান বাচ্চারা যেহেতু বলছে এটাই লিখতে দিন। আর মোহরানা কম-বেশি এটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। সংসার জীবনে সুখী হতে দু’জন দু’জনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা- সম্মান, ভালোবাসা প্রয়োজন। টাকা-পয়সা নয়। অর্থ কখনো মানসিক শান্তি দেয় না।”

নিতির মাথায় বড় করে ওড়না টেনে দেওয়া। লজ্জায় দৃষ্টি নত করে আছে। সাথে অজান্তেই কেমন নার্ভাস লাগছে। গলাটা শুকিয়ে আসছে। বিয়ে সম্পন্ন করে উপস্থিত সবাই নতুন দম্পতির জন্য দোয়া করে।

___________

দিব‌্য বাইক চালাচ্ছে নিতি জড়সড় হয়ে দৃষ্টি নুইয়ে বসে। এই মানুষটি আজ থেকে ওর বর। ভাবতেই সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। দিব্য হঠাৎ বলল,

-” এই প্রথম তোর বাপ একটা ভালো কাজ করলো।”

নিতি অবাক হয়ে শুধালো,

-” মানে? বুঝলাম না!”

-” এইযে ফুপির বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলল এন্ড সাহস করে কাজটা করলো। আজকে প্রথম তোর বাপকে আমার পুরুষ মানুষ মনে হচ্ছে। নিজের ফুপি বলে যে তাকে সাপোর্ট করবো এমন নয়। ফুপির রং কথাবার্তা আর আচরণেও তোর বাপ টু শব্দ করে না। এমন মিঁউ মিঁউ করা বিড়াল মার্কা লোক আমার মোটেই পছন্দ নয়। আজ আমার দৌলতে হলেও বিড়াল থেকে একটু উপরের ধাপে উঠলো।”

নিতির রাগ হলো। দিব্যর পিঠে চিমটি কা’ট’লো। দিব্য ‘আউচ’ শব্দ উচ্চারণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ গরম করে তাকায়। নিতি তোয়াক্কা করল না। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-” আমার পাপা মিউমিউ বিড়াল নয়। আমার পাপা অতি ভদ্র। আর এই অতি নম্র ভদ্রতার জন্য সহজেই কঠোর হতে পারে না। চাইলে মুখের উপর উচিত জবাব দিতে পারে,হু।”

দিব্য থামিয়ে দিতে বলল,

-” হয়েছে হয়েছে! এত প্রশংসা করতে হবে না।”

__________

ড্রয়িংরুমে উপস্থিত নুরজাহান, শিরিন, নেওয়াজ আর শাহারিয়ার মির্জা। তামান্না নিজের রুমে ছিলো। শিরিন সুলতানা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” সময় নিয়ে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দিলে ভালো হতো না। এভাবে লোকজন শুনলে কী বলবে?”

শাহারিয়ার মির্জা কিছু বলার আগেই নুরজাহান বেগম মুখ খুললেন। ম্লান মুখে আফসোস ঝরল কণ্ঠে,

-” দুই দুইটা নাতি আমার। তাদের বিয়ে নিয়ে কত আশা-স্বপ্ন ছিলো। বড় ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করব; সকলকে দাওয়াত করে খাওয়াবো। ইয়া মাবুদ! অথচ দুইটা দাদুভাইয়েরই হুট করে বিয়ে হলো। একটা নাতিরও আমার স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হলো না।”

#চলবে